পরিচয় (অনুগল্প)

Posted by স্বাভিমান

পরিচয় (অনুগল্প)

আমি সুদেব, সুহেল নই। সুহেল আসছে পরে। একটু পেছনে পড়ে গেছে। পড়বেই তো, সে যে সুহেল। দু’জনের হৃদযন্ত্রটা বা দিকে, মরফোলজি-হিস্টলজিও এক – কিন্তু আমি সুদেব, সুহেল নই। লেভিসের জিন্সটা খুলে ফেল, এবার এডিডাসের জাঙ্গিয়াটাও নামাও বাছা – এবার সুহেলকে চেনা গেল। গুয়েন্তানামোতে তো এভাবেই সুহেলদেরকে চিনে ফেলে। কে বলে মানুষ চেনা দায়? দূর ছাই, কী সব আবোল-তাবোল দিয়ে সময় নষ্ট। আমি সুদেব, সুহেল নই। সুহেলকে আসতে দিন, একটু ধৈর্য ধরুন। আমি সুদেব বলছি, এবার আমার কথা শুনুন।
আমি ভারতীয়। কেউ যদি আওয়াজ দেয় “গরব্ সে বলো” – আমি মনে মনে দোহার দেই। তবে জোরে বলি না, কারণ আমি তো বিশ্ব নাগরিক – ওই শ্বেতাঙ্গদের মতই উন্নত, সংস্কৃতবান। হোক না আমার গায়ের রঙ বাদামি বা দক্ষিণী কালো – ওসব পিগমেন্ট দিয়ে আমার পরিচয় জানা যাবে না। ‘নিগারদের’ মত আমার পূর্বপুরুষ তো আর দাস ছিলেন না। আমার মনের ভেতর থেকে আমার পরিচয়ের উপর ফোকাস পড়ে – যারা বোঝার তারা ঠিক বুঝে নেয়। কাদের বোঝার কথা? কেন মিছিমিছি জটিল প্রশ্ন তুলে সুর কাটছেন - আমার পরিচয়টা তো দিতে দিন। ‘আমি সুদেব, সুহেল নই’ – তার মধ্যেই তো আসলে লুকিয়ে আছে আমার পরিচয়। এই যে আমি আগে চলে আসলাম, সুহেল আঁটকে গেল – কারণটা বুঝতে পারলেন না? আমার মনের ফোকাসই আমার পরিচয়, সুহেলের তো তা নেই। আমি যে সে ভারতীয় নই – আমি সেই ভারতীয়দের বংশধর যারা কাদা মাড়ায় না, বরঞ্চ মায়ের সাথে পেটের টানে যারা কাদা মাড়ায় তাদেরকেই মাড়িয়ে দেয়, এদের পদদলিত করতে যাদের পদস্খলন হয় না আমি তাদেরই প্রতিভূএই উদর-সর্বস্বদের উপরের বা দিকের হৃদযন্ত্রটা পরিচালিত হয় উদরের প্রয়োজনে। কিন্তু আমাদের কাছে তো সেই বাদিকের যন্ত্রটিই আসল, তাই জীবনযাত্রার লটবহর ওই মুটেদের উপর ছেড়ে দিই। আমাদের উদরের দায়িত্ব ওদের, আর ওদের হৃদয়ের দায়িত্ব আমাদের। এভাবে ভাগাভাগি না হলে তো সংসার অচল। তাই তো আমরা “গরব্ সে বলি ...”। আমার হৃদয়ের এই গর্ববোধ থেকে উৎসারিত অনুচ্চারিত বার্তা সেই আমেরিকান ইমিগ্রেশন অফিসারের কাছে পৌঁছে যায় – আমার পরিচয় পেতে তার অসুবিধে হয় না। সেই অফিসারটা জানে আমার পরিচয় আমার অন্তরঙ্গে। দু’জনের মনের তরঙ্গ-দৈর্ঘ্য মিলে যায়, কারণ দু’দলই সংসারের ভাগাভাগিটা মেনে নিয়েছি। তাই আমি সুদেব, সুহেল নই। কারণ সুহেলের পরিচয় তার বহিরঙ্গে যা সে ওই ‘নিগারদের’ মতই নিজে ঠিক করতে পারে না। সুহেল আমার বাল্যবন্ধু, তাই তো তার জন্য অপেক্ষা করছি।
পরিচয়টাই যদি আলাদা, তবে বন্ধু কী করে? আবার জটিল প্রশ্ন। আরে মশাই, আপনি তো দেখছি সব গোবলেট করে দেবেন। একটু ধৈর্য ধরুন, আগে সুহেলের পরিচয়টা জেনে নিন, ততক্ষণে আমি আমার হৃদয়-পথে একবার পরিক্রমা করে আসি। আমাকে তো আবার আসতে হবে – সুহেলকে নিয়ে যেতে হবে না! – সুহেল যে আমার বন্ধু।
সুহেলের পরিচয় আর সুহেলকে দিতে হয় না। মাইকে ঘোষণা করে দেওয়া হচ্ছে সুহেলের পরিচয়। সুরেলা কণ্ঠে একই লাইন বারবার বলা হচ্ছে – “Suheluddin Ahmed alias Subbed Khan, a dreaded Al Qaida terrorist and a recruit from Indian Mujaheedin has been intercepted by the security agency while passing through immigration security check-out. Any relative accompanying him is directed to contact airport security outpost immediately.”  সুদেবের সমস্ত শরীর কেঁপে উঠে, হৃদযন্ত্রটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম করে। বাল্যবন্ধুকে নিয়ে যাবেন না? আবার বেয়াড়া প্রশ্ন। সুদেব ক্রোধ চাপা দিয়ে বলে ওঠে “তাতে আপনার এতো আগ্রহ কেন মশাই?” “আপনার অন্তরের পরিচয়ের জোরটা সুহেলের কোন কাজে লাগবে না?”। সুদেব কোন যুতসই জবাব খুঁজে পায় নাসুহেল যে তার সঙ্গী সুদেবের কথা পুলিশকে বলেনি তা মাইকের ঘোষণা থেকেই সুদেব বুঝতে পারে। সুহেল তো তার সাহায্য নেওয়ার চেষ্টা করতেই পারত, কারণ প্রবাসী বন্ধু সুদেবের উপর ভরসা করেই তো সে এখানে এসেছে। সুহেলের জন্য তদ্বির করার সাহস সঞ্চয় করতে পারে না সুদেব।
বুকের বা দিকে যে গর্বের পরিচয়কে সে বহন করে চলেছে, আজ তাকেই ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার প্রবৃত্তি হয়। এক হীনমন্যতাবোধ তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেফ্ল্যাটের দরজায় স্যুইচের বোতামে চাপ দিতেই কলিং বেলের কর্কশ আওয়াজ তার বিরক্তিকে আরও বাড়িয়ে দেয়। দায়সারাভাবে স্ত্রীর সব প্রশ্নের জবাব দেয়, মাঝেই মাঝেই চাপা ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটতে থাকে। রাতের যৌনমিলনে এই প্রথমবার সে এমন হিংস্র হয়ে উঠে যে তার মেমবিবি প্রতিবাদ করে এবং রিসিভার উঠিয়ে হেল্পলাইনে খবর দিয়ে দেয়। রাতের আঁধারে পুলিশ ভ্যানে তার বহিরঙ্গের পরিচয় তাকে তাড়া করে, অফিসারের কাছ থেকে সুহেলের সন্ধান পেতে সে আগ্রহী হয়ে ওঠে। এবার বলো বাপু তোমার আসল পরিচয়টা? এবার সুদেব বিরক্ত হয় না। সে চাঁপা সুরে বলে উঠে – আমি সুদেব, আবার সুহেলও বটে।  
               

নয়া-উদারবাদী বিশ্বায়ন ও এনরেগা আন্দোলন

Posted by স্বাভিমান Labels: , ,



                                 অরূপা মহাজন
                              (অরুণোদয়ের জন্য)
উনিশ শতকের উদারবাদ

       ‘নয়া-উদারবাদী বিশ্বায়ন’ – ইতিহাসের প্রেক্ষিতে বিচার না করলে এই শব্দবন্ধ ব্যবহারের ক্ষেত্রে জটিলতা দেখা দেয়। উনিশ শতিকার উত্থানোন্মুখ শ্রমিক শ্রেণি ও বিশ্ব-যুদ্ধোত্তর পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় পুঁজির সম্প্রসারণের পরিস্থিতিতে শ্রমিকশ্রেণি ও পুঁজির মধ্যে এক সমঝোতা গড়ে ওঠে। পুঁজির স্বার্থে রাষ্ট্র পরিচালিত হলেও শ্রমিকশ্রেণির সামাজিক সুরক্ষা, ট্রেড ইউনিয়ন ও রাজনৈতিক দলের অধিকারের পক্ষে রাষ্ট্র ভূমিকা নিয়েছে। বাজারে পুঁজিমালিক বা শিল্পমালিকদের উৎপন্ন সামগ্রীর চাহিদা তৈরির ক্ষেত্রে এই শ্রমিক শ্রেণির ক্রয়ক্ষমতার বিশেষ ভূমিকা থেকেছে। পুঁজি ও শ্রমিকের এই সহাবস্থানের পরিস্থিতিতে বিশ্বায়িত পুঁজির পক্ষে রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকদের ভূমিকাকে উদারবাদ হিসেবে পরিগণিত করা হয়েছে। এই উদারবাদ একদিকে শ্রমিক শ্রেণির কিছু সুবিধা আদায়ের পর্যায়কে যেমনি চিহ্নিত করে, ঠিক তেমনি শ্রমিক শ্রেণির পরাজয়কেও সূচিত করে। কারণ সর্বহারা শিল্প শ্রমিকদের আবির্ভাবের সাথে সাথে এটা আশা করা হয়েছিল যে শ্রমিক শ্রেণি মানব সমাজের সাধারণ স্বার্থকে বহন করবে এবং শ্রেণিশাসন ও শোষণের অবসান ঘটবে। সে বিচারে উনিশ শতকের উদারবাদ পুঁজির স্বার্থেই একধরনের শ্রেণিসমঝোতা।
শ্রেণি-সমঝোতার কাঠামোর পতন ও নয়া-উদারবাদ

                     কিন্তু সত্তরের দশকের মুদ্রাস্ফীতির সংকটের চাপে এবং রাষ্ট্রকে নিজেদের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনার মত ক্ষমতাধর বৃহৎ ওলিগোপলিদের (মনোপলি বা একচেটিয়া পুঁজিপতিদের গ্রুপ) আবির্ভাবের ফলে এই শ্রেণি সমঝোতায় ফাটল দেখা দেয়। শিল্পশ্রমিক শ্রেণির ক্ষমতার বাড়বাড়ন্ত যেমনি উদারবাদী নীতিকে নির্ধারণ করেছে, ঠিক তেমনি উদারবাদের পতনের মাধ্যমে যে নতুন পরতিস্থিতির উদয় হয়েছে সেটাও নির্ধারিত হয়েছে এক নতুন শ্রেণির শক্তি সঞ্চয়নের মধ্য দিয়ে, সেই নতুন শ্রেণিটি হচ্ছে বিত্তীয় শ্রেণি। লেনিন বর্ণিত পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ রূপে শিল্পপতিরা বিত্ত বা ফিনান্স পুঁজিকে নিয়ন্ত্রণ করত ও নিজেদের স্বার্থে লগ্নি করত। বর্তমান পর্যায়ে ব্যাপক ও সুগঠিত ঋণ-কাঠামো এবং বিত্ত-বাজারে লগ্নি করার বিস্তৃত সব নব্য-প্রকরণের মাধ্যমে বিত্তপুঁজির নিজস্ব বিত্ত-বাজারে বিত্তীয়-ওলিগোপলিস্টদের আবির্ভাব ঘটেছে এবং এই ওলিগোপলিস্টরা রাষ্ট্রীয় নীতিকে নিয়ন্ত্রিত ও প্রভাবান্বিত করে এই বাজারকে সচল রাখার পক্ষে রাষ্ট্রকে ব্যবহার করছে এবং শ্রমিক তথা আম-জনতার যেটুকু অধিকার উদারবাদের পর্যায়ে স্বীকৃত ছিল সেই অধিকার তথা সামাজিক-সুরক্ষার কাঠামোকে ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছে। পুঁজিবাদের বর্তমান এই পর্যায়কেই নয়া-উদারবাদ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। উদারবাদী বা নয়া-উদারবাদী বিশ্বায়ন আসলে পুঁজির বিশ্বায়ন, শ্রমের বিশ্বায়ন নয়। বর্তমানে পুঁজির এই বিশ্বায়নের গতি অনেক অনেক গুণ তীব্র, কারণ জনস্বার্থে জাতিরাষ্ট্রের যেটুকু নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা পূর্বে ছিল তা এই পর্যায়ে অনেকখানি ক্ষীয়মান।
বাজারের চাহিদা ও নয়া-উদারবাদী উৎপাদন প্রক্রিয়া

              কিন্তু একটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন পাঠকের মনে উদয় হওয়া স্বাভাবিক। উনিশ শতকের উদারবাদের পরিস্থিতিতে শিল্পমালিকদের উৎপাদনের মেশিনকে সচল রাখার জন্য উৎপন্ন সামগ্রীর উপভোক্তা হিসেবে শ্রমিক শ্রেণি যে চাহিদা তৈরি করেছিল, শ্রমিকশ্রেণি তথা আম-জনতার অবনমনের নয়া-উদারবাদী পর্যায়ে পুঁজিমালিকদের জন্য বাজারের প্রয়োজনীয় চাহিদা কারা এবং কীভাবে তৈরি করছে? বিত্ত-বাজারে শেয়ার, বণ্ড, সিকিউরিটির মত পণ্যের কেনাবেচাকে সচল রাখতে আমেরিকার মত পুঁজির কেন্দ্রের বাজারে ঢালাও ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়, এমনকী জনগণের যে অংশ ঋণ ফেরত দিতে সক্ষম নয় তাদেরকেও ঋণের আওতায় নিয়ে আসা হয়। যে এসেটের জন্য ঋণ দেওয়া হয় সেই এসেটের দামের ক্রমাগত বৃদ্ধি ঘটায় ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে ঋণ ফেরত দেওয়ার আস্থা জন্মে এবং ঋণদাতাদেরও আস্থা জন্মে বন্ধক হিসেবে এই এসেটের দাম বৃদ্ধির ফলে। ঋণ প্রদানে ঝুঁকি এড়ানোর জন্য ঋণপ্রদানকারী সংস্থাগুলি এই বন্ধকী সম্পত্তির উপর ভিত্তি করে সিকিউরিটি সার্টিফিকেট তৈরি করে বিনিয়োগকারীদের কাছে বিক্রি করে ঋণপ্রদানের অর্থ আদায় করে এবং এই সিকিউরিটি সার্টিফিকেটগুলো বিত্ত বাজারে ব্যাপক কেনাবেচার মাধ্যমে মূল সম্পত্তির কৃত্রিম মূল্যের এমন ব্যাপকহারে বৃদ্ধি ঘটে যে প্রকৃত মূল্য নির্ধারণ করা মুস্কিল হয়ে পড়ে এবং এভাবে ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধির ফলে এক একটা ফানুস বা বুদবুদ তৈরি হয়। যে কোন কারণে বাজারে অনাস্থা তৈরি হলে এই বুদবুদগুলি ফেটে গিয়ে বাজারে পুঁজির বিনিয়োগ বন্ধ হয়ে যায় এবং বিষাক্ত এসেট হিসেবে পরিগণিত এই সিকিউরিটি সার্টিফিকেটগুলো আর কেউ কিনতে রাজী হয় না, ঋণগ্রহীতারা ঋণ ফেরত দিতে অপারগ হয়ে ওঠে এবং মূল মর্টগেজ সম্পত্তির মূল্য একেবারে তলানিতে চলে যাওয়ায় এগুলো বাজেয়াপ্ত করে ঋণদাতাদের কোন ফায়দা হয় না। তখন “ফার্মগুলি এতো বিশাল যে এদেরকে মরতে দেওয়া যায় না”- এই যুক্তির আড়ালে সরকার জনগণের অর্থে এই বিষাক্ত এসেটগুলো ক্রয় করে কোম্পানীগুলোকে বাঁচিয়ে দেয় এবং আরেকটি নতু্ন সম্পত্তিতে এধরনের ঋণের মাধ্যমে ‘সম্পত্তি বুদবুদ’ তৈরির প্রক্রিয়া সূচনা করে। এভাবেই ‘ডটকম বাবল” “হাউজিং বাবল” ইত্যাদি গড়ে উঠেছে এবং সঙ্গত কারণে ফেটেও গেছে। পুঁজির কেন্দ্রে এভাবে যখন বিত্তবাজারের চাহিদা তৈরির প্রক্রিয়া চালু রয়েছে, তখন ভারতবর্ষের মত প্রান্তিক দেশগুলিতে কাঠামোগত পুনর্গঠনের মাধ্যমে বিত্ত-বাজারের উপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ ক্রমাগত শিথিল করা হচ্ছে এবং শিল্পায়নের এমন এক নীতি অনুসরণ করতে সরকারগুলিকে বাধ্য করা হচ্ছে যেখানে শৌখিন সামগ্রীর চাহিদা তৈরির জন্য জনগণের এক ক্ষুদ্র অংশের আয় বৃদ্ধি ঘটছে।
ভারতবর্ষে উদার-আর্থিক নীতির প্রভাব

           ১৯৮০ সালে ভারত সরকার বিশ্বব্যাঙ্ক থেকে এক বিশাল পরিমাণের ঋণ নেয় এবং এই ঋণের সর্ত হিসেবে কাঠামোগত পুর্ণগঠন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেশি-বিদেশি বৃহৎ কোম্পানীর স্বার্থে এবং নির্দেশে সরকারী নীতি নির্ধারণের প্রক্রিয়া চালু করে এবং আম-জনতার সামাজিক ও আয়ের সুরক্ষার সমস্ত সরকারী নীতি ও ভর্তুকী প্রদানের সব সরকারী বন্দোবস্ত একে একে বাতিল করতে শুরু করে। ১৯৯১ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও তৎকালীন অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিং এই নয়া-উদারবাদী আর্থিক নীতিতে সরকারী অফিসিয়্যাল সিলমোহর লাগিয়ে দেন। আধুনিক বিলাস সামগ্রী তৈরির জন্য শিল্পপতিদের জমি প্রদান সুনিশ্চিত করতে উপনিবেশিক ভূমি অধিগ্রহণ আইন প্রয়োগের মাধ্যমে কৃষক উচ্ছেদ, পুঁজিপতিদের সস্তায় প্রাকৃতিক সম্পদ যোগানের জন্য সংখ্যালঘু-অবিসি-দলিত-জনজাতীয়-আদিবাসী উচ্ছেদ, উন্নয়নের নামে ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে পরিবেশ দূষণ ও জনগণকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে ঠেলে দেওয়া, অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ও সামগ্রীর আমদানী উপর নির্ভর করে রপ্তানী নীতি নির্ধারণ করার ফলে রপ্তানী আয় থেকে আমদানীর ব্যয়ের বৃদ্ধি ঘটানো, বিত্তপুঁজির ফাটকা বাজারে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকর্ষিত করতে সমস্ত নিয়ন্ত্রণ উঠিয়ে দেওয়া, বিত্ত ও শিল্পবাজারে চাহিদা তৈরির জন্য জনগণের এক ক্ষুদ্র অংশের আয় বৃদ্ধির সুযোগ করে দেওয়া। এই পদক্ষেপগুলিই হচ্ছে উদারবাদী অর্থনীতির এমন এক বিকাশের মডেল যেখানে বিকাশের হার বৃদ্ধি সুনিশ্চিত করা হয় অসাম্য ও আমজনতার দুর্দশা বৃদ্ধির মাধ্যমে এবং এই মডেলের প্রবক্তাদের আপ্তবাক্য “বিকাশের লাভ চুঁইয়ে চুঁইয়ে নীচের দিকে যাবে ও আমজনতা লাভবান হবে” – কে অসাড় প্রমাণিত করে।
অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ

               সিঙ্গুরে গাড়ি কারখানার নির্মাণের প্রস্তাবে টাটা’র ১০০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের বিপরীতে সরকারের ৮৫০ কোটি টাকা ভর্তুকীর প্রস্তাব ছিল। সিঙ্গুরের কৃষকদের প্রতিরোধ এবং গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আরও লোভনীয় প্রস্তাবের ফলে টাটা গুজরাতে সেই কারখানা নির্মাণ করে। এভাবে ‘সেজ’ কিংবা ‘সেজ’-বহির্ভুত ক্ষেত্রে বৃহৎ শিল্পপতিদের বিশাল অংকের ভর্তুকী দিয়ে চলেছে সরকার, অথচ অন্যদিকে আমজনতার ব্যবহার্য নিত্য-প্রয়োজনীয় সামগ্রীর উপর ভর্তুকী তুলে দেওয়ার সরকারী পদক্ষেপকে সরকার, দল ও নেতৃত্বের সাহসী পদক্ষেপ হিসেবে প্রচার করা হচ্ছে। অবশ্য জনগণ তাদেরকে যেদিন কড়া জবাব দেবে সেদিন তার সম্মুখীন হওয়ার জন্য তাদের বুকের পাটার সত্যিকার পরীক্ষা হবে। এই প্রক্রিয়ার ফলে শতকোটীপতিদের সংখ্যা ২০০৪ সালে ৯ থেকে ৪০-এ বৃদ্ধি ঘটে যা জাপান, ফ্রান্স, ইতালি, চিনের তূলনায় অনেক বেশি এবং আমেরিকার ঠিক নীচে। উপরের এক ক্ষুদ্র অংশের বর্ধিত বেতন ও অন্যান্য সুযোগের মাধ্যমে আয়বৃদ্ধি ঘটানো হচ্ছে এবং অন্যদিকে প্রতি চারজনের মধ্যে তিনজনের দৈনিক ক্রয়ক্ষমতা ২০ টাকারও কম। ফলে এই আমজনতা বাজারে বিশেষ কোন চাহিদা বৃদ্ধি ঘটাতে সক্ষম হচ্ছে না। যেহেতু যোগান ও উৎপাদন চাহিদার উপর ভিত্তি করে স্থির হয়, তাই উচ্চআয়ের ক্রেতাদের ব্যয় করার ক্ষমতা এবং ‘ইনকাম ইলাস্টিসিটি অব ডিমাণ্ডের’ নিয়ম মেনে আয় বৃদ্ধির চাইতেও বেশি চাহিদা বৃদ্ধির উপর নির্ভর করে তাদের প্রয়োজনীয় বিলাসী সামগ্রীর যোগান ও উৎপাদন বৃদ্ধি এবং বিক্রির জন্য মল, সুপার-মার্কেট ইত্যাদি করা হচ্ছে এবং আমজনতার প্রয়োজনীয় নিত্য-প্রয়োজনীয় সামগ্রীর উৎপাদনে কোন রকমফের হচ্ছে না। উচ্চআয়ের লোকদের প্রয়োজনীয় সামগ্রীর দাম যখন কমছে, তখন নিত্য-প্রয়োজনীয় সামগ্রীর দাম ক্রমাগত বৃদ্ধি ঘটছে। এধরণের চূড়ান্ত অসাম্য ও প্রাকৃতিক সম্পদের উপর কোম্পানীর দখলদারির জন্য ভিটেমাটিছাড়া হওয়ার খাড়া ঝুলছে নিপীড়িত বঞ্চিত জনগোষ্ঠীগুলোর উপর। এটা এরকম এক পরিস্থিতি যা দরিদ্র-পিছিয়েপড়াদের অভ্যন্তরীণ উপনিবেশিক স্থিতি গোটা দেশের উপনিবেশিক স্থিতিকে আরও শক্তিশালী করছে। জনগণ এরকম পরিস্থিতির বিরুদ্ধে এখানে ওখানে স্বতঃস্ফূর্ত বিদ্রোহ করছে, যদিও কোন বিকল্প সংগঠিত শক্তির দেখা এখনও মেলেনি। এই বিদ্রোহ মোকাবিলায় এবং নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার তাড়নায় নয়া-উদারবাদী বিশ্বায়নে বিশ্বাসী সরকার ও বিভিন্ন দল অনেক কদম এগিয়ে গিয়েও মাঝে মাঝে এককদম পিছিয়ে গিয়ে গণস্বার্থে পদক্ষেপ নেয়। এনরেগা জারি করা সেরকমই একটি পদক্ষেপ।
এনরেগার আন্দোলন ও নয়া-উদারবাদের বিকল্প

                  এনরেগার মাধ্যমে যদি গ্রামীণ জনগণ ও শহরের বস্তি ও ঝুপরিবাসীদের সবাইর রোজগারের বন্দোবস্ত করতে এবং তাতে যে গণ-চাহিদা তৈরি হবে তার উপযোগী শিল্পোৎপাদনের নীতি গ্রহণ করতে সরকারকে যদি বাধ্য করা যায়, তাহলে নয়া-উদারবাদী ফ্রেমওয়ার্ক থেকে পিছু হটার জন্য লড়াইয়ের ক্ষেত্র তৈরি হয়। এক হিসাবে দেখা গেছে যে এনরেগার বিধান অনুযায়ী সবাইকে কাজের গ্যারান্টী প্রদান করতে হলে এনরেগার জন্য মোট জাতীয় আয়ের (জিডিপি) ৬-৭% বাজেট বরাদ্দ করতে হয়, বর্তমানে যা মাত্র জিডিপি’র ১%। ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক ও আইএমএফ-এর নির্দেশানুসারে জারি করা ফিনান্স রেগুলেশন ও বাজেট ম্যানেজম্যান্ট আইন, ২০০৩ বলবৎ থাকা অবস্থায় এই বৃদ্ধি সম্ভব নয়, কারণ এই আইন অনুসারে আর্থিক ঘাটতি কমানোর জন্য নিত্য-প্রয়োজনীয় সামগ্রীর উপর ভর্তূকী ও আমজনতার জন্য ব্যয় কর্তন করতে হয়। উপরন্তু এই সংস্থাদ্বয় ইতিমধ্যেই এনরেগার বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করতে শুরু করেছে। সুতরাং এনরেগার পূর্ণাঙ্গ রূপায়ণের লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত এই আইন বাতিলের এবং তার মাধ্যমে বিশ্বপুঁজির নিয়ন্ত্রিত সংস্থাদ্বয়ের নির্দেশ বাতিলের দাবিকে সামিল করে নিতে হবে। এভাবে আমজনতার আয়বৃদ্ধির বিভিন্ন সংগ্রামে উচ্চআয়ের ক্রেতাদের উপযোগী উৎপাদন-নীতির বদলে আমজনতার চাহিদার উপযোগী উৎপাদন নীতি গ্রহণ করার দাবিকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে এবং এই নীতি স্বাভাবিকভাবেই বেসরকারীকরণের বিপরীতে সরকারী উদ্যোগকে প্রসারিত করেই করতে হবে। এই দাবিগুলির তখনই বাস্তবায়ন সম্ভব যখন নীতি-নির্ধারণে আমজনতার মতামত ও অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত করতে গণ-ক্ষমতায়নের জন্য রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে ঢেলে সাজানো হবে। ৭৩তম সংশোধনীর মাধ্যমে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা কায়েম হলেও সংবিধানের ২৪৩ধারার বিধান অনুযায়ী পঞ্চায়েতের আর্থিক স্বশাসন প্রদান না করে পঞ্চায়েতকে ঠুঁটো জগন্নাথ বানিয়ে কেন্দ্র-রাজ্য শাসনের গ্রামীণ দালাল তৈরির কারখানা বানিয়ে রাখা হয়েছে। গ্রামসংসদ বা গ্রামসভা ও পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে এবং কেন্দ্র-রাজ্যকে ফেডারেল কাঠামোয় পুনর্গঠন করে জনগণের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার জন্য রাষ্ট্রকে যথেষ্ট নমনীয় করা যায়। এনরেগার রূপায়ণের সংগ্রামের মধ্য থেকে নয়া-উদারবাদ বিরোধী এক বিকল্প কর্মসূচীর ভিত্তিতে এক নতুন আন্দোলন গড়ে উঠতে পারে। এনরেগার বিধানের পূর্ণাঙ্গ ও বর্ধিত রূপায়ণের দাবিতে আন্দোলন এভাবেই নয়া-উদারবাদ বিরোধী এক ব্যাপক কর্মসূচীর অঙ্গ হয়ে উঠতে পারে এবং এভাবে এই ব্যাপক কর্মসূচীর অঙ্গ হয়ে উঠার উপর এনরেগা আন্দোলনের সফলতাও নির্ভরশীল।                                     

স্বাভিমান:SWABHIMAN Headline Animator

^ Back to Top-উপরে ফিরে আসুন