পরিচয় (অনুগল্প)
Posted byপরিচয় (অনুগল্প)
আমি সুদেব, সুহেল
নই। সুহেল আসছে পরে। একটু পেছনে পড়ে গেছে। পড়বেই তো, সে যে সুহেল। দু’জনের
হৃদযন্ত্রটা বা দিকে, মরফোলজি-হিস্টলজিও এক – কিন্তু আমি সুদেব, সুহেল নই। লেভিসের
জিন্সটা খুলে ফেল, এবার এডিডাসের জাঙ্গিয়াটাও নামাও বাছা – এবার সুহেলকে চেনা গেল।
গুয়েন্তানামোতে তো এভাবেই সুহেলদেরকে চিনে ফেলে। কে বলে মানুষ চেনা দায়? দূর ছাই,
কী সব আবোল-তাবোল দিয়ে সময় নষ্ট। আমি সুদেব, সুহেল নই। সুহেলকে আসতে দিন, একটু
ধৈর্য ধরুন। আমি সুদেব বলছি, এবার আমার কথা শুনুন।
আমি ভারতীয়। কেউ যদি
আওয়াজ দেয় “গরব্ সে বলো” – আমি মনে মনে দোহার দেই। তবে জোরে বলি না, কারণ আমি তো
বিশ্ব নাগরিক – ওই শ্বেতাঙ্গদের মতই উন্নত, সংস্কৃতবান। হোক না আমার গায়ের রঙ
বাদামি বা দক্ষিণী কালো – ওসব পিগমেন্ট দিয়ে আমার পরিচয় জানা যাবে না। ‘নিগারদের’
মত আমার পূর্বপুরুষ তো আর দাস ছিলেন না। আমার মনের ভেতর থেকে আমার পরিচয়ের উপর
ফোকাস পড়ে – যারা বোঝার তারা ঠিক বুঝে নেয়। কাদের বোঝার কথা? কেন মিছিমিছি জটিল
প্রশ্ন তুলে সুর কাটছেন - আমার পরিচয়টা তো দিতে দিন। ‘আমি সুদেব, সুহেল নই’ – তার
মধ্যেই তো আসলে লুকিয়ে আছে আমার পরিচয়। এই যে আমি আগে চলে আসলাম, সুহেল আঁটকে গেল –
কারণটা বুঝতে পারলেন না? আমার মনের ফোকাসই আমার পরিচয়, সুহেলের তো তা নেই। আমি যে
সে ভারতীয় নই – আমি সেই ভারতীয়দের বংশধর যারা কাদা মাড়ায় না, বরঞ্চ মায়ের সাথে
পেটের টানে যারা কাদা মাড়ায় তাদেরকেই মাড়িয়ে দেয়, এদের পদদলিত করতে যাদের পদস্খলন
হয় না আমি তাদেরই প্রতিভূ। এই উদর-সর্বস্বদের উপরের বা দিকের হৃদযন্ত্রটা পরিচালিত হয় উদরের প্রয়োজনে।
কিন্তু আমাদের কাছে তো সেই বাদিকের যন্ত্রটিই আসল, তাই জীবনযাত্রার লটবহর ওই
মুটেদের উপর ছেড়ে দিই। আমাদের উদরের দায়িত্ব ওদের, আর ওদের হৃদয়ের দায়িত্ব আমাদের।
এভাবে ভাগাভাগি না হলে তো সংসার অচল। তাই তো আমরা “গরব্ সে বলি ...”। আমার হৃদয়ের
এই গর্ববোধ থেকে উৎসারিত অনুচ্চারিত বার্তা সেই আমেরিকান ইমিগ্রেশন অফিসারের কাছে
পৌঁছে যায় – আমার পরিচয় পেতে তার অসুবিধে হয় না। সেই অফিসারটা জানে আমার পরিচয়
আমার অন্তরঙ্গে। দু’জনের মনের তরঙ্গ-দৈর্ঘ্য মিলে যায়, কারণ দু’দলই সংসারের
ভাগাভাগিটা মেনে নিয়েছি। তাই আমি সুদেব, সুহেল নই। কারণ সুহেলের পরিচয় তার
বহিরঙ্গে যা সে ওই ‘নিগারদের’ মতই নিজে ঠিক করতে পারে না। সুহেল আমার বাল্যবন্ধু,
তাই তো তার জন্য অপেক্ষা করছি।
পরিচয়টাই যদি আলাদা,
তবে বন্ধু কী করে? আবার জটিল প্রশ্ন। আরে মশাই, আপনি তো দেখছি সব গোবলেট করে
দেবেন। একটু ধৈর্য ধরুন, আগে সুহেলের পরিচয়টা জেনে নিন, ততক্ষণে আমি আমার হৃদয়-পথে
একবার পরিক্রমা করে আসি। আমাকে তো আবার আসতে হবে – সুহেলকে নিয়ে যেতে হবে না! –
সুহেল যে আমার বন্ধু।
সুহেলের পরিচয় আর
সুহেলকে দিতে হয় না। মাইকে ঘোষণা করে দেওয়া হচ্ছে সুহেলের পরিচয়। সুরেলা কণ্ঠে একই
লাইন বারবার বলা হচ্ছে – “Suheluddin
Ahmed alias Subbed Khan, a dreaded Al Qaida terrorist and a recruit from Indian
Mujaheedin has been intercepted by the security agency while passing through
immigration security check-out. Any relative accompanying him is directed to
contact airport security outpost immediately.” সুদেবের সমস্ত শরীর কেঁপে
উঠে, হৃদযন্ত্রটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম করে। বাল্যবন্ধুকে নিয়ে যাবেন না? আবার বেয়াড়া
প্রশ্ন। সুদেব ক্রোধ চাপা দিয়ে বলে ওঠে “তাতে আপনার এতো আগ্রহ কেন মশাই?” “আপনার
অন্তরের পরিচয়ের জোরটা সুহেলের কোন কাজে লাগবে না?”। সুদেব কোন যুতসই জবাব খুঁজে
পায় না। সুহেল যে তার সঙ্গী সুদেবের কথা পুলিশকে বলেনি তা মাইকের ঘোষণা থেকেই সুদেব বুঝতে পারে। সুহেল তো তার সাহায্য নেওয়ার চেষ্টা
করতেই পারত, কারণ প্রবাসী বন্ধু সুদেবের উপর ভরসা করেই তো সে এখানে এসেছে। সুহেলের
জন্য তদ্বির করার সাহস সঞ্চয় করতে পারে না সুদেব।
বুকের বা দিকে যে
গর্বের পরিচয়কে সে বহন করে চলেছে, আজ তাকেই ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার প্রবৃত্তি হয়। এক
হীনমন্যতাবোধ তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। ফ্ল্যাটের দরজায় স্যুইচের বোতামে চাপ দিতেই কলিং বেলের কর্কশ আওয়াজ তার বিরক্তিকে আরও বাড়িয়ে দেয়। দায়সারাভাবে স্ত্রীর
সব প্রশ্নের জবাব দেয়, মাঝেই মাঝেই চাপা ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটতে থাকে। রাতের যৌনমিলনে
এই প্রথমবার সে এমন হিংস্র হয়ে উঠে যে তার মেমবিবি প্রতিবাদ করে এবং রিসিভার উঠিয়ে
হেল্পলাইনে খবর দিয়ে দেয়। রাতের আঁধারে পুলিশ ভ্যানে তার বহিরঙ্গের পরিচয় তাকে
তাড়া করে, অফিসারের কাছ থেকে সুহেলের সন্ধান পেতে সে আগ্রহী হয়ে ওঠে। এবার বলো
বাপু তোমার আসল পরিচয়টা? এবার সুদেব বিরক্ত হয় না। সে চাঁপা সুরে বলে উঠে – আমি সুদেব,
আবার সুহেলও বটে।