সৌমিত্র
দস্তিদারের দুটি তথ্যচিত্র :একটি প্রতিবেদন
অরূপ
বৈশ্য
কোরাস ও মজুরি শ্রমিক ইউনিয়নের উদ্যোগে ১১ জানুয়ারী,২০১৫ ভাঙ্গায়
ও ১২ জানুয়ারী,২০১৫ লালায় সৌমিত্র দস্তিদারের দুটি তথ্যচিত্র ‘মুসলমানের কথা’ ও
‘নীল নক্সা’ দেখানো হলো। লালায় শুরুতেই পরিচালক বর্তমান প্রতিবেদককে দু-চারটে কথা
বলতে বললেন। আমি আজকের সংকটের কথা বৃহত্তর ঐক্যের প্রাসঙ্গিকতার কথা বললাম। প্রথমে
“মুসলমানের কথা’ ছবিটি দেখানো হলো। তারপর শুরু হলো আলোচনা। অনেক গুরুত্ত্বপূর্ণ
প্রশ্ন উত্থাপিত হলো। আলোচনায় অংশগ্রহণ করে কতগুলো কথা উত্থাপন করলাম। এই চিত্রনাট্যে
পশ্চিমবঙ্গের প্রেক্ষিতে মুসলমানের মনের ব্যথা কী সেটা উত্থাপিত হলো – সব নিপীড়িত
জনগোষ্ঠী তাদের ভুল-শুদ্ধ যাই হোক তাদের মনের কথা বলুক, বাকী সবাই শুনুক – সেই
সহিষ্ণুতা ও অন্যের কথা শোনার মানসিকতা থেকেই গণতন্ত্র বিকশিত হয়। এই তথ্যচিত্রের
মূল পর্বে দুটি আধুনিক বা সমকালীন বয়ান উঠে এসেছে, যেখানে মুসলমানরাই শুধু তাদের
অন্তরের কথা বলছেন। এক, গ্রামীণ মুসলমানের গরিষ্ঠাংশই হয়ে পড়ছে শ্রমিক এবং দুই, জনগোষ্ঠী
হিসেবে আর্থ-রাজনৈতিক সুযোগ সুবিধা থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছে যা সাচার রিপোর্টের
ভিত্তিতে তুলে ধরা হয়েছে। এই দুটি আধুনিক বয়ানের মধ্যে বৃহত্তর ঐক্যের সম্ভাবনা
রয়েছে। কারণ এই দুটি বিষয়ই শ্রম-শোষনের এক সাধারণ ফ্রেমে ধরা যায়।
কিন্তু ব্রিটিশ আমলের কৃষক বিদ্রোহকে যেভাবে মুসলমানের
বিদ্রোহ হিসেবে তুলে ধরা হয় সেটাকে আরেকটু বিশদভাবে দেখানো যেত। কারণ সেখানে
পরিচালকের কথা বলার সুযোগ ছিল। এই বিষয়ে আমার মত হচ্ছে অভিবক্ত বাংলার পূব ও
পশ্চিমে বা পূর্ব-উত্তর ও পশ্চিমে-দক্ষিণের কিছু বাস্তব পার্থক্য রয়েছে। পশ্চিম
বাংলায় জমিদাররা যারা ব্রিটিশ শাসকের শিবিরে আশ্রয় নিয়েছিল তারা ছিল মূলত হিন্দু
এবং মুসলমানরা ছিল গরীব কৃষক ও ক্ষেত মজুর। কিন্তু মুসলমানদের মধ্যে এক জোতদার
শ্রেণিও গড়ে উঠেছিল এবং এই শ্রেণি বেশ শক্তিশালী ছিল ও তারা সুদী ব্যবসায়ের
মাধ্যমে গরীব মুসলমানদের তীব্র শোষণ করত। তাই মুসলমান কৃষকদের বিদ্রোহের বররশাফলক ব্রিটিশ শাসক ও হিন্দু জমিদারদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হলেও, মুসলিম জোতদারদের বিরুদ্ধেও
কিন্তু মুসলিম গরিব কৃষক ও ক্ষেত-মজুররা অনেক সংগ্রাম পরিচালিত করেছেন যা
শুধুমাত্র মুসলিম বয়ানের ধারণাকে খণ্ডন করে দেয়। এই প্রেক্ষিতটা তুলে ধরলে
তথ্যচিত্রটি সম্পূর্ণতা পেত। অন্যদিকে পূব-বাংলায় মুসলিম জোতদারের সংখ্যা ছিল কম ও
তারা শ্রেণি হিসেবে ছিল দুর্বল। ফলে এই শ্রেণিটি মুসলিম গরিব কৃষকদের সুদ দিলেও
তাদের উপর বেশি চাপ সৃষ্টি করতা না এবং তাদের নিজেদের শ্রেণি স্বার্থে গরিব
কৃষকদের সাথে ঐক্য বজায় রাখার চেষ্টা করত। ফলে ব্রিটিশ শাসক ও হিন্দু জমিদারদের
বিরুদ্ধে কৃষক বিদ্রোহে মুসলিম ঐক্য গড়ে উঠত এবং আপাতদৃষ্টিতে এই বিদ্রোহগুলিকে
অনেকেই হিন্দুদের বিরুদ্ধে মুসলমান বিদ্রোহ হিসেবে দেখত, যদিও বাস্তব সত্যটি
ভিন্ন।
এই পর্বের শেষদিন অর্থাৎ ১৩ জানুয়ারী ছবি দুটি প্রদর্শিত
হলো শিলচরে। শিলচরের গণতান্ত্রিক ও সুস্থ-সাংস্কৃতিক মহলের অনেকেই এলেন এবং
মধ্যশহরের হল ভরে উঠল। কিন্তু আলোচনা তেমন জমে উঠল না। আলোচনায় অংশগ্রহণ করে একজন
বললেন ‘মুসলমানের কথা’ ছবিতে গণতান্ত্রিক হিন্দু বয়ান থাকলে ভাল হত। ‘নীল নক্সা’
ছবি নিয়ে কিছু প্রাসঙ্গিক রাজনৈতিক কথা হলো। অন্তরালে কেউ কেউ বললেন যে ব্রাহ্মণ
বিরোধী কথা বেশি হয়েছে, আবার কেউ বললেন এ তো তথ্যচিত্র নয়, এক বিবৃতি-ধর্মী চিত্র
হয়েছে। ‘নীল নক্সা’ একটি জাতি-নির্মূলিকরণের রাজনৈতিক আখ্যান, তাই এনিয়ে আলোচনায় প্রাসঙ্গিকভাবেই
দুটি বিপরীত বয়ান উঠে এসেছে। এই মন্তব্যগুলো নিয়ে আলোচনায় যেগুলো কথা বলা যেত তা
এখানে বলার চেষ্টা করছি।
‘নীল নক্সা, নিয়ে একথা বলা যায় যে আদিবাসীদের হত্যার ঘটনা
উঠে আসলে ছবিটি পূর্ণাঙ্গ রূপ পেত – সাম্প্রদায়িকতার সাথে জাতি-নির্মূলিকরণের
রাজনৈতিক বয়ানটি আরও স্পষ্ট হত। তবে ক্যামেরার কাজগুলি ছিল খুবই ভাল। দ্বিতীয়
ছবিটির নামই বলে দেয় যে এখানে মুসলমানরাই কথা বলবেন, সুতরাং মূল পর্বে এধরনের কোন
হিন্দু গণতান্ত্রিক বয়ানের কোন সুযোগই ছিল না। প্রথম পর্যায়ে যখন অতীত ইতিহাসের
কিছু কথা বলা হচ্ছে সেই পর্বে কৃষক বিদ্রোহের ও মুসলিম সমাজের বাস্তব চিত্র তুলে
ধরার সুযোগ ছিল পরিচালকের এবং এব্যাপারে আমার মত আমি উপরে তুলে ধরেছি। কিন্তু এই
তথ্যচিত্রকে বিবৃতি-ধর্মী মোটেই বলা যায় না, সেটা সম্পূর্ণত রচনা-ধর্মী যে রচনায়
মুসলমান সমাজের অভ্যন্তর থেকে ছোট ছোট চিত্র ও কথা উঠে আসে যা হৃদয় ছুঁয়ে যায়। কিন্তু
সাম্প্রদায়িক চেতনা অনেক সময় অতি সূক্ষভাবে আমাদের মস্তিষ্ককে নিয়ন্ত্রণ করে এবং
ফলে বাস্তব হৃদয়-বিদারক চিত্রগুলি ডিটারমিনিস্টিক মাইন্ডসেটে কোন রেখাপাত করে না।
ছবিটি শেষ করা হয় আরেকটি আধুনিক বয়ানের স্ন্যাপসট দিয়ে যেখানে মুসলিম মেয়েরা
ক্রিকেট খেলছে।
আমরা এক সংকটময় পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। প্রতিটি সংকটে
শুভ-অশুভ, ভাল-মন্দ, মানবিকতা-পাশবিকতা, গণতন্ত্র-ফ্যাসীবাদ, শান্তি-যুদ্ধ ইত্যাদি
বিপরীত শক্তির সংঘাতময় পরিবেশ দেখা দেয়। বিশ্বব্যাপী নিও-ফ্যাসিবাদ যেভাবে দ্রুতগতিতে
মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে,সেই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে এই সংঘাতে কে জিতবে এখনই বলা সম্ভব
নয়। কিন্তু শুভশক্তির বিজয়কে নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কী করতে হবে তার একটা রূপরেখা
আমরা নিশ্চয়ই তৈরি করতে পারি এবং সেই অনুযায়ী কাজ করতে পারি। সেজন্য প্রয়োজন
কার্যপদ্ধতির প্যারাডাইম সিফট ও প্রধান কর্তব্য নির্ধারন করা। সেই পরিস্থিতির গড়ে
উঠার প্রধান সর্ত হচ্ছে শ্রমিক শ্রেণির পুনর্জাগরণ এবং এই শ্রেণি যেসব মাধ্যমকে
হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে শিক্ষিত হয়ে উঠতে পারে ও নের্তৃত্ব প্রদানের ক্ষমতা
অর্জন করতে পারে সেইসব মাধ্যমকে যথাযথভাবে ব্যবহার করার সুযোগ তৈরি করা। তথ্যচিত্র
এরকমই একটি মাধ্যম এবং চিত্র পরিচালক সৌমিত্র দস্তিদার সঠিকভাবেই তা ব্যবহার
করছেন। পরিশেষে একথাই অতিব গুরিত্ত্বপূর্ণ যে সবার কথা শোনার সহিষ্ণুতাই আ্মাদের
এক গণতান্ত্রিক বয়ান নির্মাণের চাবকাঠি এবং সেদিক দিয়ে ‘মুসলমানের কথা’ তথ্যচিত্রটি
নিশ্চয়ই ভূয়সী প্রশংসার দাবি রাখে।