২২ এপ্রিল, ২০১৮ ঃ শিলচরে নারী মুক্তি সংস্থার কনভেনশনে
উপস্থাপিত
“নারী আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি” সংক্রান্ত দলিল।
আমরা আজ এই কনভেনশনে মিলিত
হয়েছি নারী নিপীড়ণের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করতে ও আন্দোলনের এক সাধারণ দিশা
নির্ধারণ করতে। ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন বিষয়কে কেন্দ্র করে বিভিন্ন
নারী সংগঠন গড়ে উঠতে আমরা দেখছি, আমরা দেখছি নারী অধিকারের কর্মী হিসেবে বহু প্রতিষ্ঠিত
নারীকে আত্মপ্রকাশ করতে। বিভিন্ন দলেরও রয়েছে নিজস্ব নারী সংগঠন, যারা নিজস্ব দলীয়
মতাদর্শ ও নির্দেশে কাজ করে চলেছে।
বিগত কয়েক দশকে দলীয়
সংগঠনগুলিকে আমরা যে বিষয়ে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার হতে দেখেছি সেটা হলো সংসদ ও
বিধানসভায় নারীর সংরক্ষণের প্রশ্ন। কিন্তু এই আওয়াজের আবেদন ও গ্রহণযোগ্যাতা নারী
সমাজকে এক ঐক্যবদ্ধ মঞ্চে নিয়ে আসতে ব্যর্থ হয়েছে। সেই দাবী সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে
উচ্চশিক্ষিত অগ্রসর মহিলাদের বিতর্কের স্তরে। তার কারণ নারীদের নারী পরিচয়ের উপরও
রয়েছে তার ভাষা, বর্ণ, জাতি, সম্প্রদায়ের পরিচিতি। ফলে ভাষা-ধর্ম-বর্ণগত আধিপত্যের
পরিস্থিতি নারীদেরও আলাদা আলাদা শিবিরে ভাগ করে রাখে। নারী অধিকারের প্রশ্নের সাথে
এই আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়াইকে কখনোই জুড়ে দেওয়া হয়নি। গ্রামাঞ্চলের মহিলারা পঞ্চায়েত
স্তরে সংরক্ষণে বেশি আগ্রহী ছিলেন এবং এই সংরক্ষণ সামাজিক কাজে নারীর অংশগ্রহণে ও
নারী সচেতনতা বৃদ্ধিতে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু তাতে সামগ্রীকভাবে নারী
অধিকার ও অস্তিত্বের প্রশ্নে স্বীকৃতি আদায় করা যায়নি, ফলে নারী পঞ্চায়েত
প্রতিনিধির আড়ালে পুরুষ পরিচালকের ভূমিকা এখনও যথেষ্ট সবল।
নারীর অধিকারের প্রশ্নে
নারীর নিজেদের পছন্দমত পোষাক পরিধানের অধিকার, স্বাধীনভাবে চলাফেরার অধিকার, কথা
বলা ও মত প্রকাশের অধিকার, বিবাহ ও বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার, নারী দেহ নিয়ন্ত্রণের
অধিকার ইত্যাদি বিষয়ে দেশব্যাপী বিতর্ক আমরা জানতে পারছি ইলেক্ট্রনিক ও সোশ্যাল
মিডিয়ার দৌলতে। এই বিষয়গুলি নিঃসন্দেহে ভীষণভাবে
গুরুত্ত্বপূর্ণ। কিন্তু এই বিষয়গুলি যখন শুধুমাত্র উপরের স্তরের কিছু মহিলার মধ্যে
সীমাবদ্ধ থাকে, আম নারী-সমাজকে আকর্ষিত করে না, তখন নারী আন্দোলনে এক এলিটিস্ট
ধ্যানধারণা গড়ে উঠে। ফলে সামগ্রীকভাবে নারী আন্দোলনই বিফল হয়। কিন্তু
ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে বিচ্ছিন্নভাবে হলেও সাধারণ মহিলাদের সামাজিক অন্যায় ও
শারীরিক নিপীড়ণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধে গর্জে উঠতে দেখছি। অথচ এক সাধারণ দিশার অভাব
নারী আন্দোলনকে বিভক্ত ও কোনো সামাজিক পরিবর্তনে অক্ষম করে রেখেছে। গ্রামাঞ্চলে ও শহরের
স্লাম এলাকায় মহিলাদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের প্রশ্নটি অত্যন্ত গুরুত্ত্বপূর্ণ। ঘরে
বাইরে কর্মরত মহিলাদের রক্তাল্পতা ও অপুষ্টি এক মহামারির আকার ধারণ করছে।
এব্যাপারে নারী সংগঠনগুলির ক্ষেত্র সমীক্ষা করে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা ও
নির্দ্দিষ্ট দাবিসনদ তৈরি করা ও আন্দোলনের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে
সরকারকে বাধ্য করা জরুরি।
মহিলাদের ক্ষেত্রে এই
অপুষ্টি ও রক্তাল্পতার দু’টি মূখ্য কারণ রয়েছে। প্রথমত, নয়া উদারবাদী অর্থনীতিতে
আম-নাগরিকদের প্রকৃত পারিবারিক আয় (ব্যয়ের তূলনায়) ধীরে ধীরে কমে আসছে, প্রকৃতি
থেকে আহার্য্য সংগ্রহের সুযোগ সংকুচিত হচ্ছে ( সেটা সর্বত্র ও বিশেষ করে
ক্রমবর্ধিষ্ণু শহুরে স্লাম এরিয়াগুলিতে) এবং দ্বীতিয়ত, পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধে
পরিচালিত পরিবারগুলিতে পুরুষ সদস্য – সন্তান সবাইকে সেবা করার দায় নারীর উপর থাকায়
নারীর ভাগ্যে জোটে সবচাইতে কম পুষ্টি। পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধ যেমনি এই সেবার উপর
মাহাত্ম্য আরোপ করে, ঠিক তেমনি এই একই আদর্শে মোহগ্রস্ত মহিলারাও একে পরম ধর্মীয়
কর্ম বলে মেনে নেয়। যে মহিলারা এই মূল্যবোধে আপত্তি তোলে তাদের পুরুষ সদস্য তো
বটেই মহিলা সদস্যদেরও রোষের শিকার হতে হয়। পুরাতন ও নতুন মূল্যবোধের এই সংঘাত সমাজ
পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজনীয় শর্ত। কিন্তু এই সংঘাতকে উচ্চস্তরের মহিলাদের দৃষ্টি
দিয়ে দেখলে চলে না, কারণ তাদের পক্ষে এ লড়াই এতোটা কন্টকাকীর্ণ নয়, যতটা কঠিন ও
কন্টকাকীর্ণ আম-মহিলাদের ক্ষেত্রে। মূল্যবোধের এই লড়াই চলবে পাশাপাশি, শিক্ষা ও
স্বাস্থ্যের অধিকারের আন্দোলনে অন্তর্নিহিত, নয়া উদারবাদের বিরুদ্ধে নারী-পুরুষের
যৌথ আন্দোলনের অধীন।
আশির দশক থেকে
চালু নয়া উদারবাদী অর্থনীতির ফলে বাস্তবতায় বহু পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে।
ষাট-সত্তরের দশকে কৃষক আন্দোলন, জাতীয় নিপীড়ণ বিরোধী আন্দোলনের অভ্যন্তরে নারী
আন্দোলন যে শক্তি সঞ্চয় করছিল, সামাজিক বাস্তবতার পরিবর্তনের ফলে নারী আন্দোলন আজ
এক দিশাহীন অবস্থায় আছে। এই দিশাহীনত নতুন আন্দোলনের দিকে যাত্রা করার এক
উৎক্রমণকালীন পর্যায় হিসাবে হাজির হয়েছে। কী সেই পরিবর্তন?
এই পরিবর্তনের
মূখ্য দিক হচ্ছে নারীর সামাজিক শ্রমে অংশগ্রহণ। বিগত দশকগুলিতে পরিষেবা ক্ষেত্রে
যে বিকাশ হয়েছে তাতে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেয়েছে। অঙ্গনওয়াড়ি, আশা কর্মী, এনরেগা
ইত্যাদিতে যেমনি নারী শ্রমিকের আধিক্য ঠিক তেমনি নির্মাণ ক্ষেত্রেও পিছিয়ে পড়া
সম্প্রদায়ের পিছিয়ে পড়া মহিলারা যোগ দিচ্ছেন। সংগঠিত ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ
নির্বিশেষে শ্রমিকের সংখ্যা কমেছে। অন্যদিকে অসংগঠিত ক্ষেত্রে বাড়েছে এবং তার
অন্তর্নিহিত অর্থ হচ্ছে সবচাইতে অবদমিত সমাজের মহিলারা সামাজিক শ্রমে যোগ দিচ্ছেন।
অনেকে বলেন যে মেশিনের ব্যবহারের ফলে কৃষিশ্রমে মহিলাদের অংশগ্রহণ কমছে। কিন্তু
কৃষি শ্রমে মহিলাদের শ্রম ছিল পারিবারিক গণ্ডী ও নিয়ন্ত্রণে বাঁধা। সামাজিক শ্রমে
মহিলাদের অংশগ্রহণ পারিবারিক পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধকেও প্রভাবিত করছে। সামাজিক
শ্রমে অংশগ্রহণের ফলে যে সচলতার জন্ম দেয় তা মহিলাদেরকে পরিবারের অভ্যন্তরে নিজের
মত প্রকাশের সাহস যোগায়। এটা একদিক দিয়ে পারিবারিক পুরুষ আধিপত্য ভাঙার এক অনুকূল
পরিস্থিতি বটে। কিন্তু শ্রমের ন্যায্য মূল্যের দাবিতে নারী-পুরুষ যৌথ আন্দোলন যদি
গড়ে না উঠে তাহলে পারিবারিক প্রত্যক্ষ অত্যাচার ও নিপীড়ণের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার
সম্ভাবনা দেখা দেয়। এব্যাপারে নারী সংগঠনগুলির অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা
রয়েছে। নারী চা-শ্রমিক, অসংগঠিত নারী শ্রমিকের ন্যায্য মজুরির দাবিতে মহিলাদের
সংগঠিত করতে পারলে পুরুষরাও তার সহযোগিতায় এগিয়ে আসবে, কারণ তাতে গোটা পরিবারের আয়
ও স্বাচ্ছ্যন্দ বৃদ্ধি হবে ও নারীর স্বাধীনতার লড়াইর পথ মসৃণ হবে। নারী সংগঠকদের
একটা মূখ্য কাজ হচ্ছে একথা বোঝানো যে নারী দ্বিবিধ শ্রম শোষণের শিকার। কীভাবে এ
শোষণ হয়? ঘরে যে বিশ্রাম, আরাম ও খাওয়া দাওয়ার বন্দোবস্ত হয় তা দিয়ে নারী পুরুষ
উভয়েরই শ্রমশক্তি তৈরী হয়। সেটা না হলে নারী পুরুষ কেউই পরদিন শ্রম করে সম্পদ তৈরি
করতে পারতেন না। এই শ্রমশক্তি তৈরী করতে যে ব্যয় হয় তা’ই ন্যূনতম মজুরি হিসেবে বা
কখনও এর চেয়ে কম মজুরি হিসেবে নারী ও পুরুষ শ্রমিক পায় সারাদিন খাটুনি’র পর, তারা
কেউই শ্রমের মূল্য পায় না। কিন্তু যে শ্রমের কোনো মূল্য কেউই পায় না, সেটা হচ্ছে
ঘরোয়া শ্রম যে শ্রম দিয়ে সবার কাজ করার ক্ষমতা বা শ্রমশক্তি তৈরি হয়। সেই ঘরোয়া
শ্রমটা করে মূখ্যত নারীই। নারীকে দিয়ে বিনামূল্যে ঘরোয়া শ্রম করিয়ে নেওয়ার উপরিও
সামাজিক শ্রমেও তাদেরকে পুরুষের চাইতে সস্তায় খাটানো হয়। সেই যে বিনা মূল্যে ঘরোয়া
শ্রম বা সস্তায় নারী শ্রম তার গোটা লাভটাই যায় মালিক শ্রেণি-বর্ণ বা শ্রমের
নিয়ন্ত্রক ও পরিচালক শ্রেণির হাতে। তাতে নারী পুরুষ উভয়েরই ক্ষতি। অর্থাৎ ঘরোয়া
শ্রমের মর্যাদা যখন নারী পুরুষ উভয়ে বুঝবে তখনই উভয়ে যৌথভাবে বেশি বেশি শ্রমের দাম
পাওয়ার লড়াই করতে পারবে। তাই এই লড়াই সামাজিক ও ঘরোয়া শ্রমের মর্যাদার লড়াই,
পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিরুদ্ধেও লড়াই। এই লড়াই পুঁজিপতি, মালিক ও বিভিন্ন
ধরনের মধ্যস্বত্তভোগী শ্রেণির শ্রম শোষণের বিরুদ্ধে নারী পুরুষ উভয়ের যৌথ বিকাশের
উপযোগী এক সুস্থ সমাজ গড়ার লড়াই। নারী অধিকার কর্মী ও নারী সংগঠনদের এক সামগ্রীক
দৃষ্টিতে এক নতুন নারী আন্দোলন গড়ে তুলতে সচেষ্ট হতে হবে।
প্রশ্ন উঠতে পারে
নারীদের কী আলাদাভাবে সংগঠিত হওয়া জরুরি? বিশ্বব্যাপী বাস্তবতার আমূল পরিবর্তনের
ফলে নারী সমাজ নিজেই সমাজ পরিবর্তনের এক মূখ্য শ্রেণিশক্তি হয়ে উঠতে পারে। এই
শ্রেণি শক্তি হয়ে উঠার ক্ষেত্রে দল, গোষ্ঠী, সংগঠন ইত্যাদির সংকীর্ণ বিভাজনের
উর্ধে উঠে নারী অধিকারের লড়াইয়ে সব নারীকে একত্রিত করতে হবে ও সমমর্যাদার নীতির
ভিত্তিতে পুরুষের সাথে ঐক্য গড়ে তোলার প্রয়াস চালিয়ে যেতে হবে। এটাই আজকের সময়ের
মূখ্য কর্তব্য। এই মূখ্য কর্তব্য বাস্তবায়নের যাত্রা শুরু হতে পারে
সাম্প্রদায়িকতা, যুদ্ধ, উগ্রজাতিয়তাবাদ ইত্যাদিতে নারী ও শিশু নিপীড়ণকে হাতিয়ার
হিসেবে যেভাবে উত্তরোত্তর ব্যবহার করা হচ্ছে তার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে গর্জে উঠে।