কেন “জয় শ্রীরাম”
Posted by
কেন “জয় শ্রীরাম”
অরূপ বৈশ্য
আধুনিক শিক্ষিত সমাজে “জয় শ্রীরাম” নিয়ে বিতর্ক শুরু হওয়ার খুব বেশিদিন হয়নি। প্রশ্ন জাগে কেন এতো বিতর্ক? রাম তো ঐতিহাসিক কাল থেকে এই উপমহাদেশে এমনকী ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত ছড়িয়ে আছেন। ছড়িয়ে আছে রামের নামে বিচিত্র সব লোকগাঁথা, রাম চরিত্রকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয়েছে অসংখ্য সাহিত্য, সৃষ্টশীল রচনা, মহাকাব্যিক গ্রন্থ। মানুষের সংস্কৃতিচর্চার সাথে জড়িয়ে ছিলেন রাম।
রাম ছিলেন সাঁঝের বেলার ভজন-সংকীর্তনের যৌথ আবেগের মধ্যমনি, সামাজিক বিনোদনের পুতুল নাচ, রাত জেগে যাত্রাপালায় রাবণ বধ। এ’সবেতেই রাম ছিলেন সামাজিক যৌথ সুখ-দুখের সাথী। এই রাম কোথাও প্রজা-বৎসল, কোথাও প্রেমিক, কোথাও ন্যায়ের পক্ষে যোদ্ধা। আবার কোথাও বা রাম সামাজিক শৃঙ্খলা বা শাসনের নামে সম্বুককে মারছেন, অগ্নি-পরীক্ষা নিতে গিয়ে সীতার পাতাল প্রবেশ হতে দিচ্ছেন। রাম ভগবানকে মেনে নিয়ে রাম পালার দর্শক কিন্তু চোখে জল ফেলছে সীতার জন্যই, শোকাহত হচ্ছে সম্বুকের জন্য।
আমাদের বাংলার কবি মধুসূদন দত্ত তো মেঘনাদ বধ কাব্য নামে ভিন্নধর্মী এক মহাকাব্যিক রামায়ণই লিখে ফেললেন। তথাপি রাম নাম নিয়ে দেশব্যাপী যুযুধান শিবির বিভাজন তো কখনও হয়নি। প্রাপ্ত তথ্য মতে আফগানিস্তানের মুসলিম জনজাতীয়দের মধ্যেও রাম আছেন, ইন্দোনেশিয়ার মুসলমানদের মধ্যেও রাম চরিত্র আছে। দেশজ সহজিয়া রাম এরকমই, যে যেভাবে তাকে কল্পনা করেছে সেভাবেই তিনি রচিত হয়েছেন মানুষের মনে, কবির রচনায়, সাহিত্যের সৃষ্টিতে। তাহলে সমস্যা কোথায়, এখন কেন এতো হৈচৈ?
আসলে এই যে সহজিয়া মানুষ, এক হাঁটু কাদামাখা গাঁয়ের কৃষক মাঠ থেকে ফিরে এসে চণ্ডিমণ্ডপে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে, সাথে ঘরের কনিষ্ঠরাও যাবে - এই যে গ্রামীণ অভিজাত বাড়ির গিন্নিমা সাঁঝের বেলার ধূপধূনা দেওয়া শেষ করেছেন, এবার বৈঠক খানায় ধর্মপাঠের আসর বসবে - এই যারা গাঁয়ের সীমানায় আবদ্ধ থেকে দিন শুরু ও শেষ করবে ধর্মচর্চায় – এই যারা সামাজিক বিনোদন খুঁজবে সেই ধর্মচরিত্রের কবির রচনায়, সাহিত্য পাঠে, মহাকাব্যিক কাহিনীতে; সেই সমাজ ভেঙে যাচ্ছে রকেটের গতিতে, ভেঙে ফেলার ঝড়ঝঞ্ঝা তাদের ঠেলে দিচ্ছে নতুন বাস্তবতার দিকে।
চল্লিশ কোটিরও অধিক যে গ্রামীণ জীবন থেকে উঠে আসা পরিযায়ী শ্রমিক তারা সংস্পর্শে আসছে আধুনিকতার, আধুনিকতার সমস্ত মাধ্যমও দ্রুত চলে যাচ্ছে প্রত্যন্ত গ্রামের অভ্যন্তরে, সেটা যেমনি বহির্জগতের সাথে যোগাযোগের মাধ্যম ঠিক তেমনি বিনোদনেরও নতুন মাধ্যম। বোদেলেয়ারের ভাষায় এই আধুনিকতা বর্ণর্ণা করলে বলতে হয় – সেই আধুনিক মানুষ হচ্ছে সেই পথচারী যে বিশাল চওড়া পথ দৌড়ে পেরোচ্ছে, আর তার দু’দিক থেকে দ্রুতগতিতে ভার (weight) ও শক্তি (energy) নিয়ে ধেয়ে আসছে বিশাল বিশাল গাড়ি। এই গাড়িগুলি ছুঁটছে এক মেরু থেকে অন্য মেরুকে জুড়ে, এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামের বুক চিড়ে। পুরোনো কৃষক-পথিক পুরোনো জমিদার-মহাজন পথিকের মাথার পেছনের আলেয়াটা দেখতে পাচ্ছে না।
অন্য এক নিয়ম, অন্য এক হুকুমের অধীনে সে ক্রমশঃ চলে যাচ্ছে, যেখানে সে পুরোনো পরাধীনতাকে চিনতে পাচ্ছে না – আবার নতুন স্বাধীনতাকেও দেখতে পাচ্ছে না। তার পুরোনো মূল্য ও মূল্যবোধ হারিয়ে যাচ্ছে, ঢুকে পড়ছে বাজারের বিনিময় মূল্যে। কিন্তু এটা নতুন অধীনতা (subsumption), পুরোনো মুছে যাওয়া (effacement) নয়। পুরোনো মূল্যবোধ পুরোনো বটে, কিন্তু তা মুছে যায়নি। সংস্কৃতি হচ্ছে এমন এক ভাণ্ডার যেখানে সব অতীত জমা হয়ে থাকে। সেই জমা ভাণ্ডার থেকে প্রয়োজনে বেরিয়ে আসে পুনর্নির্মিত হয়ে। পুনর্নির্মিত হওয়ার শক্তি (Energy) ছাড়া সংস্কৃতির স্টোর-হাউজের কপাট খোলা যায় না। কিন্তু এই স্টোর-হাউজে তো কৃষকের সংগ্রামের গানও জমা হয়ে আছে,জমা হয়ে আছে মেহনতি মানুষের সংগ্রামের কাহিনী -লোকগাঁথা।
যে শক্তি যাকে বের করতে চায় তাকেই বের করার শক্তি প্রয়োগ করবে, কিন্তু যাকে বের করে আনবে সেটা আসবে এক নতুন সমাজে নতুন রূপে। সহজিয়া রাম, মানুষের দৈনন্দিন জীবনের রাম যিনি ছিলেন মানুষের জীবন-যাপনের সাথে যুক্ত তাঁকে এবার বের করে আনা হয়েছে সেই মানুষদের জন্য যারা তাদের জীবনযাত্রার সাথে যুক্ত রামকে ইতিমধ্যে হারিয়ে ফেলেছে। এই নতুন রাম যাকে পুনর্নির্মিত করে সংস্কৃতির গহ্বর থেকে বের করে আনা হয়েছে, তিনি আর সেই জনগণের মধ্যে বাস করা জীবন্ত ভগবান নন, তিনি এসেছেন দ্রুতগতির এই নতুন সমাজের আগ্রাসনের প্রতীক হিসাবে, এসেছেন সেই পথ পার হওয়া পথিক ও সেই চালক যারা দ্রুত গতিতে ছুটছে মৃত্যকে পাশ কাটানোর জন্য তাদের উপর আধিপত্য ও আগ্রাসনের সামঞ্জস্যপূর্ণ কল্পিত শক্তি হিসাবে।
নতুন আধুনিক মানুষ পুরোনোকে খুঁজে পেয়েছে নতুন রূপে। কিন্তু সংস্কৃতির এই ভাণ্ড থেকে কৃষকের মেহনতির মানুষের সংগ্রামের নায়করাও তো বেরিয়ে আসতে পারত নতুন রূপে, কিন্তু বের করার জন্য যে শক্তি চাই, পুনর্নির্মাণের যে শ্রেণি-ক্ষমতা্র চেতনা চাই সেটা যে অনুপস্থিত।
তাই, কেন “জয় শ্রীরাম” এই প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে – সেজন্যই জয় শ্রীরাম। তবে এই আধুনিকতার বিশৃঙ্খলা থেকে বিদ্রোহ গড়ে উঠা স্বাভাবিক, আর এই বিদ্রোহই রামের রাজনৈতিক আধিপত্যবাদী পুনর্নির্মাণকে চ্যালেঞ্জ জানাবে।