এনআরসি কী? এনআরসি কেন? এনআরসি-তে গ্রহণযোগ্য নথি কী কী? অসমে এনআরসি কীভাবে হয়েছে? ডি-ভোটার কী? কাদের কাছে পাঠানো হয় ডি-ভোটার নোটিশ? তারপর তাঁদের অবস্থা কী হয় বা হতে পারে? ডিটেনশন ক্যাম্প কী? কাদের পাঠানো হয় সেখানে? কীভাবে পাঠানো হয়? ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল কী? কীভাবে কাজ করে ট্রাইব্যুনাল? পপুলেশন রেজিস্ট্রার বা ন্যাশনাল পপুলেশন রেজিস্ট্রার (এনপিআর) কী? জনগণনা বা সেনসাসের সঙ্গে এর পার্থক্য কী? এনআরসি-র সঙ্গে এনপিআর-এর সম্পর্ক কী? এনআরসি তালিকা-ছুট উনিশ লক্ষ কী করবে? কোথায় যাবে? কীভাবে তাদের ভারতীয়ত্ব প্রমাণ হবে? নাগরিকত্ব আইন কী? তার ব্যাখ্যা কী? এনআরসি কোন আইন মোতাবেক হয়েছে? এনআরসি-তে নাম থাকলেই কি কেউ ভারতীয়? আর কোনো প্রমাণ কি তাকে দিতে হবে? এনআরসি তালিকা সম্পর্কে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত কী? এই তালিকা কি রাষ্ট্রের বা অসমের দলিল হিসেবে মান্য? গোটা দেশে বিদেশি নির্ধারণের ভিত্তিবর্ষ কী? অন্যান্য রাজ্যে এনআরসি হলে কী হতে পারে কাট-অব-ডেট?
প্রায় সবার মনে বহু প্রশ্ন। বিভ্রান্তিও প্রচুর। এবং এটা অনস্বীকার্য যে বর্তমানে অন্যান্য রাজ্যে এনআরসি-র পরিপ্রেক্ষিতে এসব প্রশ্ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এবং অনেকেই সবটা জানতে চান। অথচ এনআরসি প্রক্রিয়া, ডি-ভোটার, ডিটেনশন ক্যাম্প, ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল-এর আদ্যোপান্ত নিয়ে কোনো বই-ই নেই।
ঠিক এই অভাববোধ থেকেই ‘অল অ্যাবাউট এনআরসি’ বইয়ের পরিকল্পনা। কোনো দল বা সংগঠনকে দোষারোপ না করে, শুধুই এনআরসি প্রক্রিয়া, ডি-ভোটার, ডিটেনশন ক্যাম্প, ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল সম্পর্কে গত চার-পাঁচ বছরে পত্রপত্রিকায় যা প্রকাশিত, তার নির্বাচিত মলাটবদ্ধ করা হয়েছে।
প্রকাশকের মতে বাঙালি পাঠকের কাছে সত্যিকারের এনআরসি বিশেষজ্ঞ যদি কাউকে বলতেই হয় তো তিনি – বীরেশ্বর দাস। এনআরসি সম্পর্কে সংবাদপত্রে প্রকাশিত তাঁর রিপোর্টিংই ‘এনআরসি : প্রক্রিয়া ও প্রভাব’ বইটির আধার।
এ ছাড়া তিনসুকিয়া থেকে প্রকাশিত ‘উজান’ পত্রিকায় প্রকাশিত তিনটি প্রবন্ধ রাখা হয়েছে বইটিতে। ডি-ভোটার, ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল ও ডিটেনশন ক্যাম্প বিষয়ক তিনটি স্বতন্ত্র প্রবন্ধ। সংক্ষেপে এনআরসি প্রক্রিয়ার সঙ্গে পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেবার ভার স্বচ্ছন্দে বহন করেছেন বীরেশ্বর দাস। এইসঙ্গে রয়েছে লিগ্যাসি ডেটা নিয়ে তাঁর একটি প্রবন্ধ। এনআরসি বা ন্যাশনাল রেজিস্ট্রার অব সিটিজেশনশিপ-এর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি জড়িত নাগরিকত্ব আইন। সেজন্য বইটিতে আছে নাগরিকত্ব আইনের বিশদ ব্যাখ্যা। বর্তমান নিবন্ধটি লিখেছেন বাসব রায় আইনী পরিমর্শের ভিত্তিতে।
নাগরিকত্ব হল রাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্কের নাম। রাষ্ট্রের সদস্যকে নাগরিক বলে। নাগরিকরা রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশগ্রহনের অধিকার সহ কিছু বিশেষ অধিকার পান। সেই অধিকারগুলির বেশকিছু অনাগরিকরা পান না। অধিকার ভোগকরার সাথে নাগরিকদের কিছু দায়িত্বও থাকে। কোন ক্লাবের সদস্য হতে যেমন সেই ক্লাবের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কিছু যোগ্যতা দরকার, তেমনই রাষ্ট্রের নাগরিক হতেও কিছু শর্ত পূরণ করতে হয়। সংবিধান হল রাষ্ট্রের বা দেশের গঠনতন্ত্র। আমাদের দেশের অর্থাৎ গণপ্রজাতন্ত্রী ভারত রাষ্ট্রের সংবিধান ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি বলবৎ হয়। নাগরিকত্ব বিষয়টি সংবিধানের দ্বিতীয় খণ্ডে (Part – II) অনুচ্ছেদ বা ধারা (Article) ৫ থেকে ১১ পর্যন্ত বর্ণিত আছে। সর্বসাধারণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ধারাগুলি সহজ ভাষায় উল্লেখ করা হল।
সংবিধানের ধারা ৫ অনুযায়ী সংবিধান বলবৎ হওয়ার সময় ভারত ভূখণ্ডে বসবাসকারী যাঁদের জন্ম ভারতে হয়েছে বা যাঁদের মা-বাবার কোন এক জনের জন্ম ভারতে হয়েছে তাঁরা ভারতের নাগরিক; এবং সংবিধান বলবৎ হয়ার সময় ভারত ভূখণ্ডে বসবাসকারী যাঁরা সংবিধান বলবৎ হওয়ার পূর্ববর্তী নুন্যতম টানা ৫ বছর ভারতে সাধারণভাবে বসবাস করেছেন তাঁরা সবাই ভারাতীয় নাগরিক। সংবিধানের ধারা ৬ বলছে যে যাঁরা পাকিস্থান থেকে ভারতে এসেছেন এবং যাঁদের বা যাঁদের মা-বাবা কিংবা মাতামহ-মাতামহী অথবা পিতামহত-পিতামহীর যে কোনো একজন অবিভক্ত ভারতে জন্মেছেন তাঁদের ভারতীয় নাগরিক হিসেবে মেনে নেওয়া হবে যদি তাঁরা ১৯ জুলাই ১৯৪৮-এর আগে ভারতে এসে থাকেন; এবং যদি তার পরবর্তী সময়ে এসে থাকেন ও ৬ মাস থাকার পর আবেদন করে ভারতীয় নাগরিক হিসেবে নাম নথিভুক্ত করে থাকেন তাঁদেরও ভারতীয় নাগরিক হিসেবে মেনে নেওয়া হবে।
সংবিধানের ধারা বা অনুচ্ছেদ ৭ তাঁদের জন্য প্রযোজ্য যাঁরা ভারত থেকে পাকিস্থানে চলে গিয়েছিলেন এবং পরে ফিরে এসেছেন। যে সকল ভারতীয় বংশোদ্ভূত সাধারণভাবে বিদেশে থাকতেন তাঁদের জন্য প্রযোজ্য ধারা ৮। যাঁরা বিদেশের নাগরিকত্ব গ্রহন করেছেন তাঁদের জন্য ধারা ৯ প্রযোজ্য। ধারা ১০ বলছে, যারা উপরোক্ত উপায়ে নাগরিক তারা সংসদ কর্তৃক আইন প্রণয়ন অব্দি নাগরিক থাকবেন। সর্বশেষে সংবিধানের ধারা ১১ নাগরিকত্ব অর্জন, বাতিল এবং আনুসঙ্গিক বিষয়ে সংসদের আইন প্রণয়নের সম্পূর্ণ ক্ষমতাকে বহাল রেখেছে।
এরপর সংসদ তৈরি করে নাগরিকত্ব আইন, ১৯৫৫। এই আইনই ভারতের নাগরিকত্ব বিষয়ক একমাত্র আইন যা সময়ে সময়ে সংশোধিত হয়েছে। ১৯৮৫, ১৯৮৭, ১৯৯২ এবং ২০০৪-এ কার্যকর হওয়া সংশোধনীগুলি (Amendments) গুরুত্বপুর্ণ যা পরে আলোচনা করা হবে। নাগরিকত্ব আইনের ধারা ৩ থেকে ৭ অব্দি বর্ণিত মোট ৫ টি উপায়ে ভারতের নাগরিকত্ব অর্জন করা যায়। এখানে শুধু প্রাসঙ্গিক ধারাগুলো ব্যাখ্যা করা হল।
(১) জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব অর্জনের বিষয়টি আছে নাগরিকত্ব আইন ১৯৫৫-এর ৩ নং ধারায়। যেকোনো ব্যক্তি ২৬ জানুয়ারি ১৯৫০ এবং ১ জুলাই ১৯৮৭ তারিখের মধ্যে ভারতে জন্মগ্রহণ করলে তিনি জন্মসূত্রে ভারতীয় নাগরিক হবেন [ধারা ৩(১)(ক)] । ১ জুলাই ১৯৮৭ থেকে ৩ ডিসেম্বর ২০০৪ এর পুর্বে ভারতে জন্ম হলে এবং তাঁর মা-বাবার যেকোনো একজন ভারতীয় হলে তিনি ভারতীয় হবেন [ধারা ৩(১)(খ)]। ৩ ডিসেম্বর ২০০৪ বা তার পর ভারতে জন্ম হলে তিনি তখনই ভারতীয় নাগরিক হবেন যদি তাঁর মা-বাবা উভয়ই ভারতীয় নাগরিক হন অথবা উভয়ের একজন ভারতীয় ও অন্যজন অবৈধ অনুপ্রবেশকারী না হন [ধারা ৩(১)(গ)]। এখানে বলে রাখা ভালো জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব অর্জনকে ১৯৮৬ সালে প্রথম মা-বাবার একজন ভারতীয় হয়ার শর্ত যুক্ত করা হয় (Act No. 51 of 1986, w.e.f. 01-07-1987) । ২০০৩ সালে পুনরায় সংশোধন করে ভারতে জন্ম হওয়া ছড়াও মা-বাবার উভয়কে ভারতীয় হতে হবে অথবা উভয়ের একজন ভারতীয় ও অন্যজন অবৈধ অনুপ্রবেশকারী নন শর্ত যুক্ত করে কার্যত জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব কে নস্যাৎ করে দেওয়া হয় (Act No. 4 of 2004, w.e.f. 03-12-2004)। কথা হল, অবৈধ অনুপ্রবেশকারি কে ? নাগরিকত্ব আইনে ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’ শব্দবন্ধটি ছিলইনা। ২০০৩ এ উপরোক্ত সংশোধনীর মাধ্যমে ধারা ২(১)(খ)-তে এটি সংজ্ঞায়িত করা হয়। তাঁরাই অবৈধ অনুপ্রবেশকারী যাঁরা পাসপোর্ট-ভিসা বা অন্য অনুমতিপত্র ছাড়া অন্য দেশ থেকে ভারতে প্রবেশ করেছেন অথবা বৈধভাবে প্রবেশ করেছেন কিন্তু বৈধতার ম্যাদ উত্তীর্ণ হওয়ার পরও ভারতে থেকে গেছেন। উল্লেখ্য যে ভারতে শরণার্থী বিষয়ক কোন আইন নেই।
(২) নাগরিকত্ব আইন, ১৯৫৫-র ৪ নং ধারা হল ভারতের বাইরে জন্মানো ব্যক্তির নাগরিকত্ব বিষয়ক সিটিজেনশিপ বাই ডিসেন্ট (বংশক্রমিক নাগরিকত্ব)-এর ধারা। ২৬ জানুয়ারি ১৯৫০ থেকে ১০ ডিসেম্বের ১৯৯২-এর মধ্যে ভারতের বাইরে জন্মানো কেউ ভারতীয় হবেন যদি জন্মের সময় তাঁর পিতা ভারতীয় নাগরিক হন এবং ১০ ডিসেম্বর ১৯৯২ থেকে ভারতের বাইরে জন্মানো কেউ ভারতীয় নাগরিকত্ব অর্জন করবে যদি জন্মের সময় তাঁর মা-বাবার কোনো একজন ভারতীয় নাগরিক হন। বলে রাখা ভালো এই ধারাও ২০০৩ সালে সামান্য সংশোধন করা হয়। কিন্তু ভারতের বাইরে জন্ম হলে মা-বাবার একজন ভারতীয় হলেই সন্তান এখনও ভারতীয় হন। অথচ ২ ডিসেম্বের ২০০৪ এর পর ভারতে জন্ম হলে সন্তানের ভারতীয় নাগরিক হতে হলে মা-বাবার উভয়ের ভারতীয় নাগরিক হওয়া আবশ্যক অথবা উভয়ের একজন ভারতীয় ও অন্যজন অবৈধ অনুপ্রবেশকারী না হওয়া আবশ্যক [ধারা ৩(১)(গ)]। এটাকে জন্মস্থানের ভিত্তিতে বৈষম্য, সংবিধানের ১৪ নং অনুচ্ছেদে থাকা সমতার অধিকারের পরিপন্থী বলে ধরা যায়, এবং সেক্ষেত্রে অসাংবিধানিক ও বাতিলযোগ্য। যদিও এ-নিয়ে - নাগরিকত্ব আইনের ধারা ৩(১)(গ) বাতিলের দাবিতে এখন পর্যন্ত সুপ্রিমকোর্টে নির্দিষ্ট কোন আবেদন করা হয়নি। কিন্তু নাগরিকত্ব আইনের ধারা ৩(১)(ক) এবং ৩(১)(খ) বাতিল করে শুধু ৩(১)(গ)-কে বলবৎ করার দাবিতে আবেদন সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চে বিবেচনাধীন [Writ Petition (Civil) No. 311 of 2015] । উক্ত ধারার বলে [ধারা ৩(১)(গ)] জন্মসূত্রে রাষ্ট্রহীন ব্যক্তির সৃষ্টি করা হচ্ছে।
(৩) নাগরিকত্ব অর্জনের তৃতীয় উপায় হল নিবন্ধিকরনের বা নথিভুক্তির (Registration) মাধ্যমে ধারা ৫ অনুযায়ী নাগরিকত্ব লাভ করা। ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্যক্তি যিনি নাগরিক নন এবং অবৈধ অনুপ্রবেশকারী নন তিনি ৭ বছর ভারতে থেকে নিবন্ধিকরনের মাধ্যমে নাগরিকত্বের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে আবেদন করতে পারেন। সেই ব্যক্তি অবিভক্ত ভারতের বাইরে থাকলে ৭ বছরের সময়কাল লাগে না, যে কোনো সময় আবেদন করতে পারেন । কোনো ভারতীয়কে বিয়ে করে ভারতে এসে ৭ বছর বৈধভাবে বসবাসের পরও আবেদন করতে পারেন। যিনি ৫ বছর যাবৎ অভারসিজ সিটিজেন অব ইণ্ডিয়া কার্ড হোল্ডার তিনি শেষ ১২ মাস ভারতে থাকলে নিবন্ধিকরনের মাধ্যমে পূর্ণ নাগরিকত্ব লাভের জন্য আবেদন করতে পারেন। ২০০৩-এর সংশোধনীর (Act No. 4 of 2004, w.e.f. 03-12-2004) আগে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী না হওয়ার শর্ত ছিলনা এবং ৭ বছরের পরিবর্তে ৫ বছর ছিল। উপরন্তু পাকিস্থান সহ কমনওয়েলথ দেশের নাগরিকদের ক্ষেত্রে ৫ বছর বসবাসের শর্ত ছিল না। তখন যে কেউ, অবৈধ অনুপ্রবেশকারী সহ, সহজেই নিবন্ধিকরনের মাধ্যমে নাগরিকত্বের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে আবেদন করতে পারতেন। এমনকি বিদেশি আইনে (Foreigners Act) অনুমতিপত্র ছাড়া ভারতে প্রবেশের জন্য শাস্তি ভোগ করলেও নথিভুক্তির মাধ্যমে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে আইনে কোন বাধা ছিলনা।
(৪) ধারা ৬ হল স্বাভাবিকীকরণের (Naturalization) মাধ্যমে নাগরিকত্ব অর্জনের বিধান। অবৈধ অনুপ্রবেশকারী নন এমন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি বিগত ১৫ বছরের মধ্যে ১২ বছর যার শেষ ১২ মাস ধারাবাহিকভাবে ভারতে থেকেছেন এবং যাঁর চরিত্র ভালো এবং যিনি সংবিধানের অষ্টম তপশীলের একটি ভাষা জানেন, তিনি স্বাভাবিকিকরনের শংসাপত্র (Certificate of Naturalization) মঞ্জুর করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে আবেদন করতে পারেন। ২০০৩ এর সংশোধনীর (Act No. 4 of 2004, w.e.f. 03-12-2004) আগে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী না হওয়ার শর্ত ছিল না এবং ১৫ বছরের পরিবর্তে ১৩ বছর ছিল এবং ১২ বছরের পরিবর্তে ১০ বছর ছিল। কমনওয়েলথভুক্ত দেশের নাগরিকরা স্বাভাবিকীকরণের আওতার বাইরে ছিলেন।
(৫) অসমের ক্ষেত্রে স্বাভাবিকীকরণের এক অতিরিক্ত ধারা ১৯৮৫ সালে অসম চুক্তির ভিত্তিতে নাগরিকত্ব আইনে ধারা ৬(ক) হিসেবে যোগ করা হয়। অতিরিক্ত এই ৬(ক) ধারার মাধ্যমে ১ জানুয়ারি ১৯৬৬ সালের আগে পুর্ব পাকিস্তান থেকে অসমে যাঁরা এসেছেন এবং স্থায়ী ভাবে থাকছেন তাদের ১ জানুয়ারি ১৯৬৬ তারিখ থেকেই ভারতীয় নাগরিক হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। এবং উল্লেখিত তারিখের পর কিন্তু ২৫ মার্চ ১৯৭১-এর আগে পুর্ব পাকিস্তান থেকে অসমে যাঁরা এসেছেন এবং স্থায়ীভাবে থাকছেন তাঁরাও ভারতীয় নাগরিকের সকল অধিকার পাবেন, শুধু ওই সময়ে এসেছেন বলে চিহ্নিত হওয়ার পর নাম নথিভুক্ত করবেন ও ১০ বছরের জন্য ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত থাকবেন। ১০ বছর পর ভোটাধিকার সহ পুর্ণ নাগরিকত্ব পাবেন। অসমে প্রযোজ্য এই বিশেষ ধারা অসমে বসবাসকারী সবার জন্য নয়, শুধুমাত্র যারা তৎকালীন পুর্ব-পাকিন্থান বা বাংলাদেশের ভূখণ্ড থেকে অসমে এসেছেন তাঁদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। সংবিধান বলবৎ হওয়ার সময় যাঁরা নাগরিক তাঁরা নাগরিকত্ব আইনের ৬(ক) ধারার আওতাভুক্ত নন। শুধু অসমের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এই বিশেষ ধারা ৬(ক)-কে অসাংবিধানিক ঘোষণা করে বাতিল করার জন্য অসমের একটি জাতীয়তাবাদী সংগঠন সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেছে, সেই আবেদনটি বর্তমানে সাংবিধানিক বেঞ্চের বিবেচনাধীন [Writ Petition No. 562/2012] । নাগরিকত্ব আইনের ৬(ক) ধারার বলে যাঁরা ২৫ মার্চ ১৯৭১-এর আগে এসেছেন তাঁরা নাগরিকত্ব পেয়ে গেছেন ১৯৮৫ সালে এই ধারা বলবৎ হওয়ার সময় (০৭-১২-১৯৮৫) এবং তৎপরবর্তী সময়ে। তাই ৬(ক) ধারা বাতিল হলেও এই ধারার বলে যাঁরা নাগরিক হয়েছেন তাঁদের নাগরিকত্ব চলে যাবে না। নাগরিকত্ব আইনের এই ৬(ক) ধারা বাতিল করা নিয়ে সাংবিধানিক বেঞ্চের রায় এক অ্যাকাডেমিক চর্চার বিষয় হয়ে থাকবে বলেই ধরে নেওয়া যায়। প্রয়োজন সাপেক্ষে ও অবস্থা বিবেচনায় নাগরিকত্ব আইনের ৬(ক) ধারা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগতদের যুক্ত করে গোটা দেশের জন্য প্রযোজ্য করার দাবি করা যায় এবং সেই দাবিতে সুপ্রিম কোর্টে আবেদনও করা যেতে পারে।
(৬) নাগরিকত্ব আইনের ধারা ৭ অনুযায়ী যদি কোন ভূখণ্ড ভারতের অর্ন্তভুক্ত হয় তবে কেন্দ্রীয় সরকার বিঞ্জপ্তি জারি করে সেই ভূখন্ডের বাসিন্দাদের নাগরিক হিসেবে ঘোষণা করতে পারে। অভারসিজ সিটিজেনসিপ নামে আরও এক ধরনের আধা নাগরিক তৈরি করা হয় ২০০৩ সালের সংশোধনীর মাধ্যমে ধারা ৭(ক) থেকে ৭(ঘ) নাগরিকত্ব আইনে যোগ করার মাধ্যমে। [একই সাথে কমনওয়েলথ সিটিজেনসিপ এবং প্রথম তপশীল বাতিল করা হয়।]
২০০৩-এর নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের (Act No. 4 of 2004, w.e.f. 03-12-2004) মাধ্যমে ১৪(ক) ধারা মূল আইনে যোগ করা হয়। জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদান শিরোনামে এই ধারা কেন্দ্রীয় সরকার কতৃক বাধ্যতামূলকভাবে প্রত্যেক ভারতীয় নাগরিককে পঞ্জিভুক্তিকরন ও তাঁকে জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদানের এক্তিয়ার দেয়। এনআরসি বা এনআরআইসি এবং জাতীয় পঞ্জিয়ন কতৃপক্ষ বা নাগরিক পঞ্জিকরণের মহাপঞ্জিয়কের (রেজিষ্ট্রার জেনারেল) পদ সৃষ্টি করে এই ধারা। উক্ত ধারার বলে এবং ধারা ১৮-র বিধি তৈরীর ক্ষমতাবলে এনআরসি প্রস্তুতকরণের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার ২০০৩ সালেই নাগরিকত্ব (নাগরিক পঞ্জিভুক্তিকরণ এবং জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদান) বিধি ২০০৩ [The Citizenship (Registration of Citizens and Issue of National Identity Cards) Rules, 2003] তৈরি করে। এই নিয়মের ৪ নং বিধি অনুযায়ী বাড়ি-বাড়ি সার্ভে করে পপুলেসন রেজিস্টার তৈরি করবে যাতে প্রত্যেক বসবাসকারীর নাম ও বিবরণ থাকবে। অতঃপর সেই পপুলেশন রেজিস্টার কে যাচাই করে এনআরসি প্রস্তুত করা হবে। নাগরিকত্ব নিয়ে সন্দেহযুক্ত ব্যক্তি বা পরিবারকে বিঞ্জপ্তি দিয়ে জানানো হবে এবং উপ-জেলা বা তহশিল বা মহকুমা নাগরিক পঞ্জিয়ক সেই ব্যক্তি বা পরিবারকে নাগরিকত্ব প্রমাণের সুযোগ দেবেন। তারপর খসড়া প্রকাশিত হবে এবং দাবি ও আপত্তি উপ-জেলা বা তহশিল বা মহকুমা নাগরিক পঞ্জিয়ক গ্রহণ করে তা নিষ্পত্তি করে চূড়ান্ত নাগরিকপঞ্জি প্রকাশ করবেন। এতে বাদ পড়া সবাই জেলা রেজিষ্ট্রারের কাছে আপিল করবেন, জেলা রেজিষ্ট্রার শেষ সিদ্ধান্ত নেবেন। এটাই হল সারা দেশে নাগরিকপঞ্জি তৈরির নিয়ম। যদিও এই নিয়মে নাগরিকত্ব যাচাই বা পরীক্ষণের বিষয়টি উল্লেখ আছে, কিন্তু যাচাই বা পরীক্ষণের কোন প্রক্রিয়া বা ভিত্তির উল্লেখ নেই।
সাধারণভাবে ভোটাররাই নাগরিক - এই নীতি গ্রহণযোগ্য। যাঁদের ভোটার কার্ড বা ভোটার তালিকায় নাম আছে অথবা পিআরসি আছে কিংবা বার্থ সার্টিফিকেট আছে বা জায়গা-জমির দলিল বা নথি আছে অথবা পাসপোর্ট আছে অথবা চাকরি বা পেনশনের প্রমাণ আছে তাঁদের নাগরিক হিসেবে মেনে নিয়ে সারা দেশে এনআরসি করতে বর্তমান নাগরিকত্ব আইনে বা নাগরিকত্ব (নাগরিক পঞ্জিভুক্তিকরন এবং জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদান) বিধি, ২০০৩-এ কোন বাধা বা প্রতিবন্ধকতা নেই। কিন্তু অসমের অনুরূপ কোনো কঠিন প্রক্রিয়া যদি সারা দেশে নাগরিকত্ব (নাগরিক পঞ্জিভুক্তিকরন এবং জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদান) বিধি ২০০৩ সংশোধন করে দেওয়া হয় তবে তা অবশ্যই চিন্তার বিষয়। কেন্দ্রীয় সরকার চাইলেই এই বিধি সংশোধন করতে পারে যেকোনো দিন, তার জন্য সংসদেরও দরকার নেই। এই প্রসঙ্গে বিশেষত ভোটারের নাগরিকত্ব নিয়ে লালবাবু হুসেন মামলায় [Lal Babu Hussein & Others versus Electoral Registration Officer & Others, 1995 AIR 1189, 1995 SCC (3) 100] সুপ্রিম কোর্টের তিন বিচারপতির রায়ের গুরুত্ব আছে, আগ্রহীরা পড়তে পারেন।
অসমের জাতীয়তাবাদী শক্তি সুপ্রিম কোর্টে ২০০৯ সালে এনআরসি-র দাবিতে একটি জনস্বার্থ মামলা করে [Writ Petition (Civil) No. 274 of 2009] যার ভিত্তিতে সুপ্রিমকোর্টের নির্দেশে ও তত্ত্বাবধানে আসামে নাগরিকপঞ্জি হচ্ছে। ইতিমধ্যে অসমের জাতীয়তাবাদী শক্তির চাপে ও অসমের জন্য যেহেতু নাগরিকত্ব আইনে ৬(ক) ধারা আছে এই অজুহাতে ২০০৯ সালে নাগরিকত্ব (নাগরিক পঞ্জিভুক্তিকরন এবং জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদান) বিধি ২০০৩-এ সংশোধন করে বিধি ৪-এর পরিবর্তে বিধি ৪(ক) যোগ করা হয়। এর মাধ্যমে বাড়ি-বাড়ি সার্ভের পরিবর্তে ২৫ মার্চ ১৯৭১-এর পূর্ববর্তী নির্দিষ্ট কিছু নথির সঙ্গে সংযোগী নথি সহ প্রত্যেক ভারতীয় নাগরিকের থেকে আবেদন আহ্বান করার মাধ্যমে এক কঠিন ও জটিল প্রক্রিয়ার সৃষ্টি করা হয়। এই প্রক্রিয়ার শেষ পর্যায় হল বিদেশি আইনের অধীনে গঠিত ট্রাইব্যুনালে আপিল নিষ্পত্তির মাধ্যমে। ধারা ৬(ক) যদিও অতিরিক্ত ধারা, কোন বিকল্প ধারা নয়, কিন্তু বিধি ৪(ক) এক সম্পূর্ণ বিকল্প প্রক্রিয়া যা মূল নাগরিকত্ব আইনের ধারাকেই, যেমন জন্মসূত্রে অর্জিত নাগরিকত্ব কে, মান্য করে না । আইনের অধীনে তৈরি বিধি মূল আইনের পরিপন্থী হতে পারে না, যদি হয় তবে সেটা অসাংবিধানিক ও বাতিলযোগ্য। এছাড়াও নানা বৈষম্যের কারণে অসাংবিধানিক হওয়া সত্ত্বেও উক্ত বিধি ৪(ক) ও উক্ত বিধির অধীন তপশীল অনুযায়ী এনআরসি হচ্ছে অসমে। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয় এটিকে নির্দিষ্ট ভাবে কেউ আদালতে চ্যালেঞ্জ করেনি। সারা ভারতে নাগরিকত্ব (নাগরিক পঞ্জিভুক্তিকরন এবং জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদান) বিধি ২০০৩-এর অধীনে নাগরিকপঞ্জি প্রস্তুতকরণের বিজ্ঞপ্তি [S.O. 2753(E), dated 31.07.2019] জারি করে বলা হয়েছে পপুলেশন রেজিস্টারস-এর এনুমারেসন ১ এপ্রিল ২০২০ থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২০-এর মধ্যে হবে। তার আগেই ত্রিপুরায় অসমের মতো প্রক্রিয়ায় নাগরিকপঞ্জি প্রস্তুতের দাবি জানিয়ে একাধিক সংগঠন সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছে [Writ Petition (Civil) No. 1178 of 2018] ।
নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ২০০৩ (Act No. 4 of 2004, w.e.f. 03-12-2004) নাগরিকত্ব আইন ১৯৫৫-তে মূলত যে পরিবর্তন এনেছে তা হল (১) অবৈধ অনুপ্রবেশকারী সংজ্ঞায়িত করা, (২) এনআরসি করে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করণ (নথিহীন বৈধ নাগরিকরাও অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার আশঙ্কা সহ, অসমে যা হয়েছে বা হচ্ছে), (৩) অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের রেজিস্ট্রজশন বা ন্যাচারেলাইজেশনের মাধ্যমে নাগরিকত্ব লাভের জন্য আবেদনের পথ বন্ধ করা এবং (৪) জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব অর্জনের শর্ত কঠিন করে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের সন্তানদের জন্মসুত্রে রাষ্ট্রহীন মানুষে পরিণত করা। রাষ্ট্রহীন নাগরিক তৈরির মাধ্যমে সস্তা শ্রমিক সৃষ্টির সুচিন্তিত পরিকল্পনার অঙ্গ বলেই মনে হয়।