ইতিহাসের আলোকে সাম্প্রতিক বাংলাদেশের ঘটনা প্রবাহ
Posted by Labels: chauvinism, communist movement, people's movement, people's power, Politics, শাহাবাগ
(অরুণোদয় ও আমাদের সমকাল-এর জন্য)
অরূপ বৈশ্য
ভূমিকা
অনশনে রুমী স্কোয়াড |
অসমে শাহাবাগের হিন্দুত্ববাদী মুখ |
দেশভাগ ও ধর্মীয় ঐতিহ্য
উত্তর ভারত, পাকিস্তান আর
বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের জীবনে বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাই হয়তো
দেশভাগ। কিন্তু সাম্প্রতিক একটা গবেষণায় বলা হয় যে ১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষ যেভাবে
বাঙালি সাহিত্যকে নাড়া দিয়েছিল, ১৯৪৭-এর দেশভাগ গোটা সমাজকে
ওলটপালট করে দেওয়া সত্ত্বেও কিন্তু ১৯৫০-এর দশক বা তার পরবর্তীকালের সাহিত্যে
সেভাবে রেখাপাত করেনি। কোমল গান্ধার, মেঘে ঢাকা তারা,
সুবর্ণরেখা এই ছবিগুলির স্রষ্টা ঋত্বিক ঘটক একমাত্র ব্যতিক্রম,
অনুরূপ ব্যতিক্রম হিন্দু-উর্দু চলচ্চিত্রে এম এস সথ্যুর গরম হাওয়া।
বাস্তব চর্চার সময় ধরেই নেওয়া হয় যে আমাদের ঐতিহ্য শান্তি-সম্প্রীতি ও অহিংসার –
আর ১৯৪৭-এর ১৪ অগাস্ট যেদিন পাকিস্তানের জন্ম হল – সেটি একটি অঘটন, ভুল, যার জন্য
দায়ী আমরা নই অন্য কেউ। ১ নিজেদের অতীত সম্পর্কে এমন এক সরল একমুখীন ধারণা হিংস্রতার জন্য অন্য কাউকে
দায়ী করার মনস্তত্বের অঙ্গ। হিংস্র কোন অঘটনের জন্য দায়ী এই অপরের উপর
স্বাভাবিকভাবেই আরোপ করতে হয় কিছু চরিত্র যা দিয়ে এই অঘটন সাধারণের বোধগম্য হয়ে
উঠে। এভাবে ব্রিটিশ ও ভারতীয় এলিট ইতিহাস চর্চা সাধারণের ধারণার সাথে এক জায়গায়
এসে দাঁড়ায় যেখানে মুসলিমকে মনে হয় ধাতুগতভাবে হিংস্র, ধর্মোন্মাদ ও অবাধ্য। স্বাধীনতা-উত্তর এই উপমহাদেশে গোষ্ঠীগত
বা সম্প্রদায়গত হিংস্রতার যে ভিন্ন ভিন্ন বয়ান উঠে এসেছে তাতে দেখা যায় সব
জনগোষ্ঠীই নিজেদের মহত্ত্ব ও অপরের হিংস্রতাকে প্রতিষ্ঠিত করার এক যুক্তিকাঠামো
তৈরির প্রয়াস জারি রেখেছে, কিন্তু সেই জনগোষ্ঠীর বয়ানই
আধিপত্যাধীন অবস্থানে থেকেছে যার পক্ষে আধিপত্যাধীন আর্থিক ও রাষ্ট্রীয় শক্তি
হিংস্রতায় মদত যুগিয়েছে। সুতরাং যে কোন তাৎপর্যপূর্ণ সামাজিক ঘটনার বিশ্লেষণে
সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, আর্থিক মুনাফা ও রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের
ইতিহাস থেকে বিচার করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। বিচার-বিশ্লেষণের এই পদ্ধতির উপর
আশ্রয় না করে মিরাট-ভিওয়ান্দি-ভাগলপুর-নেলি-গোহপুর-মোকালমোয়ার সংখ্যালঘু গণহত্যা
এবং সাম্প্রতিক নিম্ন-অসমের জাতি-দাঙ্গা ও আশ্রয় শিবিরে হাজার হাজার মানুষের
অমানবিক অবস্থার খবরাখবর নেওয়ার এবং এই মর্মান্তিক ঘটনা-সমূহের ব্যাখ্যা খোঁজার
তাগিদ আমরা হারিয়ে ফেলি, কারণ আমরা ধরে নেই ধর্মীয়ভাবে
আমাদের কাছে যারা অপর তাদের আগ্রাসী ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতিক্রিয়া তারা
ভোগ করছে। এই একই ধারণা থেকে দেশভাগের দায় অন্যের উপর চাপিয়ে দিয়ে শান্তি-সম্প্রীতি-অহিংসার
ঐতিহ্যের মহিমায় নিজ-জনগোষ্ঠী বা সম্প্রদায়কে মহিমান্বিত করার প্রবণতা দেখা দেয়।
এই প্রবণতা হিন্দু অহিংস ঐতিহ্যের অন্তর্বস্তু ব্রাহ্মণ্যবাদী আধিপত্যের কাছে
আত্মসমর্পণের অন্তরালে থাকা হিংস্রতার কথা নিজের অজান্তেই আড়াল করে চলে। সুতরাং
দেশভাগের সাম্প্রদায়িক প্রভাবের বিষয় নিয়ে আলোচনা করার জন্য আমাদেরকে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই হয়।
বাংলার রাজনীতিতে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের স্বরাজ্য পার্টির সেক্যুলার পলিটিক্স এবং
সংখ্যানুপাতিক অংশীদারির মাধ্যমে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের ভিত্তিতে বাংলাকে ঐক্যবদ্ধ
রাখার প্রয়াস বা পরবর্তীতে সুভাষ বসুর দাদা শরৎ বসু ও আবুল হাসিমের অনুরূপ প্রয়াস
যদি অবিভক্ত বাংলার হিন্দু রাজনীতি মেনে নিত তাহলে হয়ত দেশভাগের অভিশাপ থেকে
বাংলাকে রক্ষা করা যেত। ১৯০৫ সালে বাংলা বিভাজনের সময় পূববাংলার মুসলমান ও
নিম্নবর্গের হিন্দুরা তার সমর্থনে ছিল, কিন্তু কলকাতার
বাবুরা ও বর্ণহিন্দু মধ্যবিত্ত সমাজ তার বিরুদ্ধে মুখর হলেন। এর পেছনে সামাজিক
রসায়ন কী ছিল? পশিমবাংলার বর্ণহিন্দু বাবুদের জমিদারি ছিল
পূব-বাংলায় এবং তাদের জমি থেকে আয়ের জন্য প্রয়োজনীয় শ্রমশক্তির যোগান আসত মুসলমান
ও নিম্নবর্গের মানুষদের কাছ থেকে। এই বাবুদের সন্তুষ্ট রাখার জন্যই ব্রিটিশ
রাজশক্তি ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করে, কিন্তু একই সাথে
ব্রিটিশ রাজশক্তি তাদের শাসনের রাজধানী কলকাতা থেকে স্থানান্তরিত করে দিল্লিতে
নিয়ে গিয়ে বাংলার আর্থিক-রাজনৈতিক বিকাশের ক্ষমতাকে পঙ্গু করে দেয়। বাঙালি ভদ্রলোক
বর্ণহিন্দু বাবুদের আশু সংকীর্ণ স্বার্থ এবং সামাজিক পরিচিতির গর্ব থেকে উদ্ভূত
মুসলমান ও নিম্নবর্গের হিন্দুদের প্রতি অবজ্ঞা এতোই তীব্র ছিল যে বাঙালি জাতির
মেরুদণ্ড ভেঙে দিতে রাজধানী স্থানান্তরিত করার ব্রিটিশ সিদ্ধান্তকে বিরোধিতা করার
অবকাশ তাঁরা পাননি, বরঞ্চ বঙ্গভঙ্গ রদের সিদ্ধান্তে
ব্রিটিশের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রদর্শনের কোন সুযোগই তাঁরা হাতছাড়া করেননি। তাদের
এই গোষ্ঠীগত অবজ্ঞা যে ব্রিটিশ ভক্তির হাত ধরেই ডালপালা মেলছিল তার প্রমাণ মেলে
স্বাধীনতার পূর্বে বঙ্গ-বিভাজনে ব্রিটিশ প্রস্তাবের প্রতি তাদের সায় থেকে, কারণ তখন অবিভক্ত বাংলার রাজনৈতিক ক্ষমতার ভারসাম্যে দলিত-মুসলিমরা
সংরক্ষণের নীতিকে ব্যবহার করে এক প্রভাবশালী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে এবং ফলে
দলিত-মুসলিমরা বিভাজনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় এবং যাকে বলা যায় দুই সামাজিক মেরুর
রোল-রিভার্সেল ঘটে। সাধারণভাবে ব্রিটিশের বিভাজনের রাজনীতিতে এভাবেই সামাজিক
গোষ্ঠীগুলির ভূমিকা থাকলেও দুই পক্ষেই কিছু ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব ছিলেন যারা
ব্রিটিশ রাজনীতির বিরোধিতা করতে গিয়ে এবং বাঙালি জাতির স্বার্থে সবসময়ই বঙ্গভঙ্গের
বিরুদ্ধে ছিলেন।
“মোট কথা, এ আমাদের মূল স্রোতের জাতিয়তাবাদী রাজনীতির
অত্যন্ত দঃখজনক ব্যর্থতা সে প্রায় কখনোই ঠিক-ঠিকমতো বাঙালি মুসলিমদের বক্তব্য বা
বিক্ষোভগুলিকে সম্মানসহকারে বিবেচনা করেনি। এবং ফলত, - যদিও
১৯৪৭ সাল পর্যন্তই বাঙালি মুসলমানের একটা বিরাট অংশ স্পষ্টভাবে নিজেদের স্থানিক বা
সাংস্কৃতিক চরিত্রের উপর জোর দিয়ে গেছেন, মুসলমান হিসেবে
নিজেদেরকে না দেখে ‘বাঙালি মুসলমান’ হিসেবে
নিজেদের অস্তিত্ব প্রকাশ করেছেন, - তাঁরা-ই কিন্তু ক্রমশ
কংগ্রেসি ঘরানার ভারতীয় অস্তিত্বের বিষয়ে প্রশ্নাকুল হয়ে পড়েছিলেন......। কঠিন পথে
হাঁটছিলেন তাঁরা। বিশেষত এই সমাজ যেহেতু সামগ্রিকভাবে অনগ্রসর, অর্থনৈতিকভাবে পশ্চাৎপর এবং রাজনৈতিকভাবে অপরিণত ছিল, সে কারণেই বাঙালি মুসলমানের জাতীয়তা উন্মেষের পথটি ছিল বিশেষভাবে কঠিন।
হয়তো আরও একটু সহমর্মিতা এবং সহযোগিতা তাঁদের প্রাপ্য ছিল এই হাঁটার পথে। হয়তো বা
বঙ্গভঙ্গের মতো প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত কেন এতখানি তাঁদের নাড়িয়ে দিয়ে গিয়েছিল,
সে বিষয়ে কিছুটা খোলাখুলি কথা হতেও পারত তাঁদের মূলস্রোতের রাজনীতিক
গোষ্ঠীর সঙ্গে। বদলে, তাঁরা কেবল প্রান্তেই থেকে গেলেন। আর ‘বিচ্ছিন্নতাবাদ’ হিসেবে ভুল পরিচয়ে হয়ে গেল তাঁদের
সামাজিক ‘স্বাতন্ত্র্য’-র ভাবনা”। ২ প্রাথমিক পর্যায়ে ধর্মীয়
পরিচিতির ভিত্তিতে আলিগর-বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক এলিট-মুসলমানদের দ্বারা নির্মিত
দ্বিজাতি তত্ব যে বাংলার মুসলমানদের প্রভাবিত করতে পারেনি তার রহস্য লুকিয়ে রয়েছে
বাংলার জল-বায়ু-মাটিতে রচিত ইসলামের সামাজিক ইতিহাসে। বাংলাদেশের আজকের
সামাজিক-রাজনৈতিক সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতিতে যারা বাঙালি জাতিয়তাবাদ ও দ্বিজাতি
তত্বের সংঘাত দেখতে পান তাদেরকে আজকের পরিস্থিতির মূল্যায়ন করার আগে সেই ইতিহাসের
দিকে ফিরে তাকাতে হবে। ব্রিটিশ রাজত্বের শেষ পর্যায়ে কলকাতায় ইস্পাহানির মত
অ-বাঙালি এলিট মুসলিমের মদতে মুসলিম লিগ গড়ে উঠলেও মুসলমান কৃষক-মেহনতি আম-জনতার
দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ফজলুল হকের প্রজা কৃষক পার্টি যারা গ্রামীণ মানুষের
ভাষায় মুসলিম কৃষকদের হকের কথা বলত, অন্যদিকে কংগ্রেসের মুসলমানদের মধ্যে তেমন কোন গণ-ভিত্তি ছিল না। চিত্ত
রঞ্জন দাশ এবং পরবর্তীতে শরৎ বসুদের মতামত কংগ্রেসি এলিট নেতৃত্বের কাছে
গ্রহণযোগ্য হয়নি, বর্ণহিন্দু বাবুদের একাধিপত্য সুনিশ্চিত
করতে বাংলার কংগ্রেসি নেতৃত্ব বঙ্গভঙ্গের পক্ষেই ছিল এবং এজন্যই ঐক্যবদ্ধ বাংলার
স্বার্থে হিন্দু-মুসলিম কোন সমঝোতার প্রশ্নকেই বর্ণহিন্দু নেতৃত্ব এড়িয়ে চলে
বাংলার মুসলিমদেরকে দ্বিজাতি-তত্বের পরিণতির দিকে ঠেলে দেয়। আসাম-পূববাংলার
বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এলিট মুসলমানদের তেমন প্রভাব না থাকায় এখানকার মুসলিম লিগ নিজেই
কৃষক স্বার্থে পরিচালিত হয়। পূববাংলার টাঙ্গাইল অঞ্চলের বাসিন্দা আসামের ধুবরির
ভাসান চরের সুফি পির মৌলানা আব্দূল হামিদ খান ভাসানি আসামের চর অঞ্চল, পূববাংলার বিস্তৃত অঞ্চল ও উত্তরবঙ্গের ব্যাপক কৃষকদের অধিকারের দাবিতে
কৃষক সংগঠন গড়ে তোলেন, আসামের সংখ্যালঘু কৃষকদের নাগরিক
অধিকার ও ভাষিক অধিকারের দাবিতে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। মৌলানা ভাসানি তার রাজনৈতিক
জীবন শুরু করেন চিত্ত রঞ্জন দাশের স্বরাজ্য পার্টির ফুট-সোলজার হয়ে গ্রামে গ্রামে
হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের রাজনীতির সংগঠক হিসেবে। সি আর দাশের অকাল মৃত্যুর পর
কংগ্রেস-বিরোধী এই নেতা মুসলিম লিগের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন এবং পরবর্তীতে আসাম
মন্ত্রীসভায় তাঁর নেতৃত্বে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের গ্রুপ গোপীনাথ বরদলৈর বিরুদ্ধে
সৈয়দ সাদুল্লা মন্ত্রীসভা গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিলেও কৃষক প্রশ্নে সৈয়দ
সাদুল্লা ও গোপীনাথ বরদলৈর মধ্যে যে কোন ব্যবধান নেই তা বিধৃত করতে গিয়ে তিনি
বলেছিলেন এদের দু’জনের মধ্যে ফারাক শুধু টুপি আর টিঁকির।
তাঁর কাছে সবধরনের নিপীড়ণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা ছিল ধর্মীয় কর্তব্য।
তিনি রুবুবিয়াহ (Rubu’biyah, anti-communalism) ও জিহাদের (Jihad) মত
ধর্মীয় ধারণাকে নিপীড়ণ, বঞ্চনা এবং
সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছিলেন। দেশভাগের পূর্বে ডিরেক্ট অ্যাকশন ডে–র সময়ে এবং আগে-পরে ব্যাপক হিন্দু-মুসলিম সংঘাতের শঙ্কা ও অম্বিকাচরণ রায়
চৌধুরীর নেতৃত্বে আসাম হিন্দু মহাসভার ব্যাপক উস্কানি সত্বেও আসামে কোনধরনের
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা না হওয়ার কৃতিত্ব মৌলানা ভাসানির নিরলস ঐক্যের প্রয়াস। ঐক্যবদ্ধ
আসাম-বাংলার স্বপ্ন এবং শেষ জীবনে বাংলাদেশ ও উত্তর-পূর্ব ভারত নিয়ে কনফেডারেশন
গড়ার স্বপ্ন দ্বিজাতি তত্বের ধারণার বিরোধী। তাঁর বাঙালি-মুসলমান চেতনা এতই প্রকট
ছিল যে দেশভাগের সময় কংগ্রেসি নেতৃত্ব পশিম-পাকিস্তানের মুসলিম লিগ নেতৃত্বকে এই
বলে সতর্ক করে দিয়েছিল যে “পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করার জন্য
একজন মৌলানাই যথেষ্ট”। সাধারণ মুসলিম মানুষের কাছের মানুষ
অবিসংবিদিত কৃষক নেতা আওয়ামি পার্টি গড়ে বাঙালি জাতিয়তাবাদী সংগ্রাম গড়ে তুলতে
সচেষ্ট হয়েছিলেন সেই কৃষক – মেহনতি মানুষের শ্রেণি
দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এবং তাই তিনি চাইছিলেন বাঙালি জাতি তার নিজের পায়ে তার জাতির
লড়াই লড়ুক তাতে যদি গেরিলা-যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হয় তাতেও আপত্তি নেই, একই সাথে ভারত-পূবপাকিস্তানের বিস্তৃত অঞ্চলে ঐক্যবদ্ধ কৃষক সংগঠন গড়ে
তোলার পক্ষেও ওকালতি করেছিলেন তিনি। তাঁর এই ভূমিকা প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা
গান্ধীকে রুষ্ট করে এবং ফলে মৌলানা ভাসানিকে ভারতে কার্যত গৃহবন্দী করে রাখা হয়
এবং ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়। ৩। ইতিহাসের এই তথ্য এখানে উল্লেখ
করা হল এই ধারণাকে খণ্ডন করতে যে মুসলিম পরিচিতির প্রবক্তা এবং মুসলিম লিগ মানেই
দ্বিজাতি-তত্বের ধারক-বাহক এধরনের অতি-সরলীকরণ যারা করেন তাঁরা শ্রেণি-দৃষ্টিভঙ্গি
থেকে ইতিহাসের বিচার করতে অপারগ।
অবিভক্ত ব্রিটিশ বাংলায় বাঙালি বর্ণহিন্দু এলিটদের ভূমিকা আর পশ্চিম ভারতের
মুসলমান এলিটদের ভূমিকার মধ্যে একটা সাদৃশ্য রয়েছে। স্যার সৈয়দ আহমদ খান যেমনি
সিপাহী বিদ্রোহের বিরোধী অবস্থান নিয়ে স্ব-সম্প্রদায়ের মধ্যে যে সংস্কার আন্দোলন
করেন তার মূলকথা ছিল শাসকশ্রেণির সাথে সক্রিয় সহযোগিতার মাধ্যমে পাশ্চাত্য শিক্ষার
আলোকপাত করা এবং দেশের শাসন-ব্যবস্থায় অধিকার লাভ করা। তিনি মুসলিম স্বার্থকে
হিন্দু স্বার্থ থেকে আলাদা হিসেবে দেখাতেন এবং তাঁর প্রচেষ্টায়ই গড়ে উঠে মুসলিম
আলিগড় অ্যাংলো-ওরিয়েন্টাল কলেজ। ঠিক অনুরূপভাবে বাংলার রাজা রামমোহন রায়
নীলচাষীদের বিদ্রোহের বিরুদ্ধে নীলকরদের সপক্ষে দাঁড়িয়ে ভারতীয় জনসাধারণকে রাজভক্ত
বলে প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন। দুজনেই ধর্মের যুক্তিবাদী ব্যাখ্যায় বৃত ছিলেন। রাজা
রামমোহন রায়ের রাজভক্তির ধারা যদিও বাঙালি বর্ণহিন্দু নেতৃত্বের মধ্যে অব্যাহত
থাকেনি, কিন্তু পৃথক উচ্চবর্গীয় হিন্দু
স্বার্থের ধারা সুপ্তভাবে হলেও অব্যাহত রাখতে সক্ষম হয় বাংলার কংগ্রেসি নেতৃত্ব।
কিন্তু বাংলার মুসলমানদের মধ্যে আলিগড় কলেজের ধারা নয়, বরঞ্চ
প্রথম পর্বে সুফি-পীরদের মাধ্যমে ইসলামের জনমুখী ধর্মীয় ভাবধারার মাধ্যমে মুসলমান
কৃষি-সমাজ গড়ে উঠা ও পরবর্তীতে দেওবন্দ স্কুলের ভাবধারার প্রভাব সুস্পষ্ট।৪
সামজিক ও ধর্মীয় সংগঠন
হিন্দু সমাজ-সংগঠন গড়ে ওঠে হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদী ধারাকে কেন্দ্র করে যেখানে
ব্রাহ্মণ্যবাদী মতাদর্শ ও জাত-বর্ণের ভিত্তিতে অলঙ্ঘণীয় পেশাগত বিভাজনের রাজনীতি ও
সমাজ-আন্দোলনে উচ্চবর্গের আধিপত্যাধীনে খাড়াখাড়ি (vertical) সমাবেশই প্রাধাণ্য পেয়েছে। তবে বাংলা কখনোই
ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্বের শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল না, বরঞ্চ অনার্য ঐতিহ্য সবসময়ই বাংলার গ্রামীণ সমাজ-জীবনে গতিশীল
উপস্থিতি সাব্যস্ত করেছে এবং ফলে হিন্দু-মুসলিম সাংস্কৃতিক সমন্বয়ের ধারা সবসময়ই
অব্যাহত থেকেছে এবং এরজন্যই মোগল শাসকরাও লোকায়ত সাংস্কৃতিক উৎসবে অংশগ্রহণ ও
উৎসাহিত করতেন। একটি হিসাবে দেখা গেছে যে নবাবী আমলে বাংলার বৃহত্তর পনেরোটি জমিদারির
মধ্যে দুটি এবং একুশটি ছোট জমিদারীর মধ্যেও মাত্র দুটি মুসলমানের অধীনে ছিল।
সুতরাং বাংলার জমিদারি ব্যবস্থায় কখনোই মুসলমানদের প্রাধাণ্য ছিল না, ব্রিটিশের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে হিন্দু সাবেকী জমিদারদের কাছ থেকে
অর্থবান বর্ণহিন্দুদের কাছে জমিদারী চলে গিয়েছিলো, মুসলমানরা
সেখানেও অর্থাভাবে জমিদার শ্রেণির বড় অংশ হতে পারেনি। অন্যদিকে বাংলায় বিশেষ করে
পূববাংলায় ইসলাম বিকশিত হয়েছে মুসলিম পীর ও পীরানীদের মাধ্যমে - মানুষের প্রাচীন
ধর্মীয় রীতি ও আচার-আচরণের সাথে সমন্বয় সাধন করে, নদী
অববাহিকা অঞ্চলে জঙ্গল সাফাই করে ব্যাপক স্থায়ী বসতি গড়ে তুলে এবং ইসলামের ধর্মীয়
আচার-আচরণের ক্ষেত্রে সাম্যের নীতির ভিত্তিতে যেখানে আল্লাহর কাছে সবাই সমান এবং
মানুষের মধ্যেই আল্লাহর উপস্থিতি অনুভূত। ৫ হিন্দু বর্ণ-ব্যবস্থার নিস্পেষণ থেকে বাঁচতেও অনেকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে, কিন্তু বর্ণ-বিভাজন যেহেতু শুধুমাত্র উপরিকাঠামোর বিষয় নয় – কর্মের
কাঠামোগত বিভাজন – তাই ধর্মান্তরিত হয়েও এই সামাজিক বৈষম্য
থেকে মুক্ত হওয়া যায়নি। তথাপি পূববাংলার মুসলিম সমাজে আশরফ ও আজলফ মুসলিমদের যে
কট্টর-বিভাজন উত্তর-ভারতে পরিলক্ষিত হয় তার ব্যাপক উপস্থিতি না থাকায় রাজনীতি ও
সামাজিক আন্দোলনে মুসলিম সাধারণ মানুষের আড়াআড়ি (Horizontal) সমাবেশই প্রাধাণ্য পেয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ গঠন
পরবর্তী সুদীর্ঘ সময়ে সমাবেশের এই পরিস্থিতির অনেকখানি পরিবর্তন ঘটেছে – এই দিক নিয়ে আলোচনায় পরে আসছি। আগে বাংলাদেশ গঠনের পর্যায়টা
দেখে নেওয়া যাক।
বাংলাদেশের আবির্ভাব
পশ্চিম পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে পূর্ব-পাকিস্তানের গুরুত্ত্বপূর্ণ নেতা
ছিলেন এইচ.এস.সুরাবর্দী যিনি বুর্জোয়া
রাজনৈতিক নেতা হওয়া সত্বেও পশ্চিম পাকিস্তানের সামন্তশ্রেণির স্বার্থের সাথে আপস
করেই, পূব-পাকিস্তানের নেতাদের বিরাগভাজন
হওয়ার ঝুঁকি নিয়েও, কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে টিঁকে থাকেন। পশ্চিম
পাকিস্তানের বুর্জোয়াপন্থী সামরিক ও মুসলিম লিগ নেতা আয়ুব খান ক্যুর মাধ্যমে
ক্ষমতা দখল করে রাজনীতিতে তাঁর শ্রেণি আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে ভূমি-সংস্কার
কর্মসূচীর মাধ্যমে এমন এক আঘাত হানলেন যা সামন্ত জমিদারশ্রেণির অর্থনৈতিক অবস্থান
খর্ব করে না, কিন্তু রাজনৈতিক অবস্থানকে দুর্বল করে। শাসন
ব্যবস্থাকে সুদৃঢ় করার ক্ষেত্রে পূব-পাকিস্তান নিয়ে আয়ুব খানের তেমন কোন সমস্যা
ছিল না, কারণ পূব পাকিস্তান ছিল শাসন-কেন্দ্রের
হিন্টারল্যাণ্ড এবং সেখানকার রাজনৈতিক দলগুলি ছিল দিশেহারা। আয়ুব খান
পূব-পাকিস্তানে তাঁর ওয়ার্ক প্রোগ্রামের মাধ্যমে কমার্শিয়্যাল স্বার্থকে এবং
মালিকানার ক্ষেত্রে জমির উর্ধসীমা বৃদ্ধি করে গ্রামীণ মধ্যশ্রেণিকে তাদের অর্থ জমি
কেনার জন্য ব্যয় করতে উৎসাহিত করলেন যাতে পূব-পাকিস্তানে নিজস্ব বাঙালি-পুঁজির
শিল্পোদ্যোগ গড়ে না উঠে পশ্চিম পাকিস্তানি ও বিদেশি পুঁজির বিনিয়োগের ক্ষেত্র ও
বাজার হিসেবে বিকশিত হয়। ফলে পূব-পাকিস্তানের গ্রামীণ আধিপত্যকারী শ্রেণি গড়ে তুলে
নতুন মুসলমান সামন্ত-শ্রেণি, কারণ পুরোনো
সিলিং আইনে হিন্দু জমিদাররা জমি মালিকানা খুইয়েছে এবং দেশভাগের আগে-পরে তাদের বড়
অংশটিই এপারে চলে এসেছে। আয়ুব খানের পলিসিতে পশ্চিম পাকিস্তানের গ্রামাঞ্চলে যখন
নতুন বুর্জোয়া শ্রেণির উত্থানের সুযোগ করে দিচ্ছে, তখন
পূব-পাকিস্তানে জমিদার-জোতদার–মহাজন শ্রেণির হাত শক্ত করছে।
পশিম-পাকিস্তানে পাকিস্তানী পুঁজির বিকাশের জায়গা তৈরি করা এবং পূব-পাকিস্তানে
সামন্ত-শ্রেণির হাত শক্ত করে শাসনের পক্ষে সামাজিক সমর্থন আদায় করা – আয়ুবের এই নীতি যে প্রাথমিক সফলতা লাভ করতে সমর্থ হয়েছিল তারও নিদর্শন
পাওয়া যায়। ১৯৫৬ সালে মার্শাল আইন বলবৎ হয় এবং পূব-পাকিস্তানে মার্শাল আইনের
মাধ্যমে হয়রানির বিরুদ্ধে প্রাথমিক পর্যায়ে তেমন কোন প্রতিরোধ গড়ে উঠেনি, বরঞ্চ মধ্যশ্রেণি পূব-পাকিস্তানের সংসদীয় দলগুলির খেয়োখেয়িতে সৃষ্ট
নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে যে আয়ুব খানের সমর্থনে এগিয়ে এসেছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় ২৪
অক্টোবর, ১৯৫৮ সালের ঢাকার পল্টন ময়দানে আয়ুব খানের প্রথম
জনসমাবেশে লাখো লোকের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতির মধ্য দিয়ে। আয়ুব খান মার্শাল আইনের
বিরুদ্ধে প্রতিরোধের একমাত্র সম্ভাবনা ছিল মৌলানা ভাসানির আওয়ামি পার্টির দিক থেকে
কারণ মৌলানা ভাসানির গ্রামীণ কৃষক জনতাকে সমাবেশিত করার ক্ষমতা ছিল এবং
কম্যুনিস্টদের সাথে ছিল তাঁর সম্পর্ক এবং তাই মৌলানা ভাসানিকে শান্তিভঙ্গের
অভিযোগে সামরিক আইনে গ্রেপ্তার করা হয়।
সামরিক আইনে অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রথম সংঘবদ্ধ প্রতিবাদ সাব্যস্ত হয় ১৯৬৪
সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। নির্বাচনী বিধি ও সামরিক শাসনকে কেন্দ্র করে শেখ
মুজিবুর রহমানের বিবৃতিতে শ্রমিক-কৃষকের দূরবস্থা এবং সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে প্রায় কোন উল্লেখ করা হয়নি, অথচ মৌলানা ভাসানির পার্টি আওয়ামি পার্টির পক্ষে হাজি দীনেশ
যে বিবৃতি জারি করেন তাতে তিনি সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা ও কৃষকের অধিকারের প্রশ্নে
অধিক গুরুত্ত্ব আরোপ করেন এবং আয়ুব খানের আর্থিক নীতির বিরোধিতা করে এই রিজিমের
শাসনকে জনগণের নিপীড়ক হিসেবে চিহ্নিত করেন। আয়ুব খান ও পরবর্তীতে ইয়াইয়া খানের
মিলিটারী রিজিমের বিরুদ্ধে শ্রমিক-কৃষক ও ছাত্র আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হতে
শুরু করে, কম্যুনিস্ট পার্টিদের ভূমিকাও বাড়তে থাকে। ১৯৭১-এর
মার্চে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের ও সশস্ত্র সংগ্রামের ডাক দেওয়া হয়। কিন্তু
কম্যুনিস্টদের ভুল মূল্যায়ন, চীন ও রাশিয়ানপন্থী হিসেবে
বিভাজন, সাম্রাজ্যবাদকে অভ্যন্তরিণ শ্রেণি বিভাজনের সাথে
সম্পর্কিত হিসেবে না দেখে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক শ্রেণি আমেরিকা না রাশিয়ান
সামাজিক-সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থ দেখছে তার উপর ভিত্তি করে নিজস্ব রণনীতি নির্ধারণ
করার ফলে পূব-বাংলার দুই প্রধান বুর্জোয়া দল আওয়ামী লিগ ও আওয়ামী পার্টির মধ্যে
আপসপন্থী শেখ মুজিবুরের আওয়ামী লিগকেই ক্ষমতায় বসতে সাহায্য করে। শেখ মুজিবুরের
স্বাধীন বাংলাদেশের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়াকে সুনিশ্চিত করে পূব-পাকিস্তানের সামন্ত শ্রেণি যাদের পশ্চিম পাকিস্তানের বুর্জোয়া শাসকদের
সাথে শ্রেণি মৈত্রী ছিল এবং সোভিয়েত সামাজিক-সাম্রাজ্যবাদীরা যাদের সাম্রাজ্যবাদী
শীতল যুদ্ধের পরিস্থিতিতে আমেরিকানদের বিরুদ্ধে আধিপত্যাধীন এলাকা গড়ে তোলার
লক্ষ্য ছিল। সুতরাং স্বাধীন বাংলায় বাঙালি জাতির প্রতিনিধিত্বকারী শ্রমিক-কৃষক ও
স্বাধীন বুর্জোয়া শ্রেণি ক্ষমতায় আসল না, বুর্জোয়া শ্রেণির একাংশ ক্ষমতায় আসল গ্রামীণ সামন্ত শ্রেণির সাথে আপস রফা
করে। ৬ । বাংলাদেশের বর্তমান ঘটনা প্রবাহ বোঝার জন্য পূব-পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে
রূপান্তরের এই ইতিহাসটা বোঝা অত্যন্ত জরুরি। পশ্চিম-পাকিস্তানী ও বিদেশি পুঁজির
অনগ্রসর পশ্চাদভূমি থেকে বাংলাদেশী ও বিদেশি পুঁজির অধিনস্ত দেশে রূপান্তরণ ঘটল।
অর্থাৎ স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের জন্য যে কাজটি বাকি রইল তা হলো শ্রমিক-কৃষকের
নেতৃত্বে দুর্বল সামন্ত শ্রেণি ও তাদের সবল মদতদাতা বিদেশি পুঁজি মালিকদের ঝেঁটিয়ে
বিদেয় করা। যেহেতু ব্যাপক কৃষকরা রয়েছে ইসলামের মতাদর্শগত ও মসজিদ-কেন্দ্রিক
সাংগঠনিক ছত্রছায়ায়, তাই ধর্মকে
বিরোধিতা করে একাজটি হাসিল করা ও বাঙালি জাতিগঠনের রুদ্ধদ্বারের আগলমুক্ত করা অলীক
কল্পনা। শাহবাগের খাড়াখাড়ি সমাবেশ দিয়ে এলক্ষ্যে পৌঁছনো অসম্ভব, প্রয়োজন আড়াআড়ি সমাবেশের সাথে যুক্ত হওয়া যেখানে ধর্ম-লোকায়ত সংস্কৃতি সব
থাকবে – আবার একইসাথে ভাল-খারাপের গ্রহণ বর্জন চলতে থাকবে।
শাসক শ্রেণি এই খারাপটাকে চাগিয়ে দিতেই আশ্রয় নেয় বিবদমান জনগোষ্ঠীগত দ্বন্দ্বের
মধ্যে। তাই এই দ্বন্দ্ব নিরসনে ভাষিক-ধর্মীয় সংখ্যালঘু অধিকারের প্রশ্নটি
গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। শাহবাগ ও শাহবাগ পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের গতি-প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা করার আগে, বিদেশি পুঁজির মধ্যেকার সংঘাতের দিকটা একটু যাচাই করে দেখা
যাক।
সাম্রাজ্যবাদী সংঘাত ও পূর্বে-তাকাও নীতি
এই বিষয়ে ২০০৮ সালের জুলাই মাসে অরূপা মহাজনের লেখা এক প্রবন্ধ থেকে কিছু কথা
প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় এখানে তুলে ধরছি। “ভারত সরকারের পূর্বে-তাকাও-নীতি এবং চীন-ভারত ও
আশিয়ান দেশগুলির বাণিজ্যিক-আর্থিক নৈকট্য স্থাপনের ক্ষেত্রে মায়ান্মার হচ্ছে
গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল এবং উত্তর-পূর্ব ভারত ও বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ করিডর।
মায়ান্মার-বাংলাদেশের প্রাকৃতিক গ্যাস ভাণ্ডারের দিকেও রয়েছে সাম্রাজ্যবাদী
শ্যেনদৃষ্টি। অন্যদিকে গ্যাস রিজার্ভকে কেন্দ্র করে আমেরিকান তৎপরতা এবং বাংলাদেশ
সনুদ্রবন্দরে সামরিক ঘাঁটি গড়ে তোলার জন্য আমেরিকার প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে
বাংলাদেশে ব্যাপক আমেরিকান সান্রাজ্যবাদ বিরোধী গণচেতনার উন্মেষ ঘটেছে। এই
গণচেতনার ভয়েই বাংলাদেশের তদারকি সরকার এমনকী টাটাদের সাথেও চুক্তি করা থেকেও
বিরত থাকে এবং সম্প্রতি টাটারা বাংলাদেশের বিনিয়োগ সম্প্রসারণের পরিকল্পনা বাতিল
করতে বাধ্য হয়। ... মায়ান্মারের
আর্থিক-সামরিক ক্ষেত্রে ও জুন্টা সরকারের উপর রয়েছে চীনের প্রভাব। চীন পূর্ব ও
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয় দেশগুলির একটি আঞ্চলিক গোষ্ঠী তৈরি করতে এবং তাতে জাপানকেও সামিল করে নিতে আগ্রহী। জাপানের সাথে আমেরিকার ক্রমবর্ধমান
দূরত্ব এবং এই আঞ্চলিক গোষ্ঠীর সাথে আমেরিকার ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য সংঘাত,মালয়েশিয়া-মায়ান্মার সহ আশিয়ান দেশগুলির সাথে
আমেরিকার ক্রমবর্ধমান দূরত্ব এবং এই আঞ্চলিক গোষ্ঠীর সাথে জড়িত বাণিজ্যিক স্বার্থ
জাপানকেও চীনের পরিকল্পনার দিকে আকৃষ্ট করছে। বাণিজ্যিক স্বার্থের সম্পর্কগুলি
একমুখীন নয় এবং তাতে নানাধরনের জটিলতা রয়েছে,তথাপি আমেরিকা যে ক্রমশই এশিয়ার এই অঞ্চলে কোণঠাসা হচ্ছে তাতে কোন সন্দেহ
নেই এবং চীন-ভারত সম্পর্কের উন্নতি এবং চীন-ভারত সহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব
এশিয়ায় সমুদ্র পথের বিকল্প সড়ক ও রেল যোগাযোগ গড়ে উঠা এবং মায়ান্মার-ভারত ও
মায়ান্মার-চীন গ্যাস পাইপলাইন গড়ে ওঠার সম্ভাবনা আমেরিকার শিরঃপীড়ার কারণ হয়ে
দাঁড়িয়েছে”। ৭। ২০০৮ সালের এই পরিস্থিতি থেকে আজকে শুধুমাত্র কিছু দেশে ক্ষমতার কিছু রদবদল হয়েছে, কিন্তু বিনিয়োগের প্রশ্ন নিয়ে সাম্রাজ্যবাদী টানাপোড়েনের যে
বাস্তবতা উপরে উল্লেখ করা হয়েছে তার বিশেষ কোন হেরফের হয়নি। বাংলাদেশের আজকের
ডামাডোলের পরিস্থিতিতে বিদেশি বিনিয়োগের প্রশ্ন নিয়ে আওয়ামী লিগ ও বিএনপি’র মধ্যে কে কার কোলে আশ্রয় নেবে তা নিয়ে টানাহেঁছরা ও রাতারাতি ভোলবদল
জারি রয়েছে, কারণ ক্ষমতায় টিঁকে থাকার জন্য বিদেশি পুঁজি
মালিক ও তাদের দেশের মদত চাই। জাতীয় স্বাধীনতার ঝাণ্ডা তুলে ধরা অনেক কঠিন ও
বিপদসঙ্কুল কারণ তাতে সাধারণ শ্রমিক-কৃষক মেহনতি মানুষকে সংগ্রামের ময়দানে হাজির
করাতে হয়, সুতরাং আওয়ামি লিগ ও বিএনপি কোন না কোন বিদেশি
প্রভুর কোলে আশ্রয় নেবেই – কে কোনদিকে যাবে এখনও স্পষ্ট নয়।
আসলে এই বিষয়টিও কীভাবে রূপ নেবে তা নির্ভর করছে শাহবাগ পরবর্তী বাংলাদেশের শ্রেণি
রাজনীতি কোন দিকে মোড় নেয় তার উপর। এই শ্রেণি রাজনীতি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক
জাতীয়তাবাদের অসম্পূর্ণ কাজটি সম্পূর্ণ করবে না প্রতিক্রিয়াশীলতার গাড্ডায়
নিমজ্জিত হবে – সেটাই এখন দেখার। এর একটা পূর্বানুমান করার
জন্য বাংলাদেশের বর্তমান ঘটনাপ্রবাহের গতি-প্রকৃতি খানিকটা বিচার করে দেখা যাক।
শাহবাগ ও পরবর্তী...... এবং সংখ্যালঘু অধিকার
বাংলাদেশের বাম-বুদ্ধিজীবী বদরুদ্দিন উমর সঠিকভাবে মন্তব্য করেছেন যে শাহবাগ
বিক্ষোভ ছিল প্রাথমিক অবস্থায় অপশাসন ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে লিগ-জামাত আঁতাত
ও বিচারের প্রহসনের বিরুদ্ধে। কিন্তু পরবর্তীতে এই বিক্ষোভ জন-বিচ্ছিন্ন আওয়ামী
লিগের নির্বাচনী মহড়া হিসেবে রূপান্তরিত হয়। এই রূপান্তরণ ঘটে অতি দ্রুত এবং ফলে
গণতান্ত্রিক ব্যক্তি ও সংগঠন এবং গণতন্ত্রের অন্তর্বস্তুকে সুনিশ্চিত করার
প্রয়োজনীয় শক্তি ‘মেহনতি মানুষের’
অংশগ্রহণের মাধ্যমে দাবিসনদের গণতান্ত্রিকীকরণের কোন সুযোগ ঘটেনি।
ফাঁসির মত অগণতান্ত্রিক এবং ক্যামুর ভাষায় ‘রাষ্ট্রের দ্বারা
হত্যার’ দাবিকে সামনে রেখে লিগ এই বিক্ষোভকারীদের আত্মস্থ
করে ফেলে এবং ফলে পরবর্তীতে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তায় এবং সরকারী মদতে আয়োজিত ‘লজিস্টিক সাপোর্ট’ নিয়ে শাহবাগ চত্বরের জমায়েতকে
বজায় রাখতে হয়। তেহরির স্কোয়ারের সাথে তুলনা করলেই (যদিও তুলনামূলক বিচার সবক্ষেত্রে
কার্যকরী পদ্ধতি নয়) এই দ্রুত রূপান্তরণের রহস্যটা বোঝা যায়। মিশরের তেহরির
স্কোয়ারে আমরা গ্রাম-গ্রামান্তর থেকে লাখো মেহনতি মানুষকে ধীর্ঘ পথ পায়ে হেঁটে এসে
অংশগ্রহণ করতে দেখেছি, তাদেরকে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর প্রতিরোধের
সম্মুখীন হতে দেখেছি এবং তাদের মূল দাবি ছিল রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিকীকরণ। অন্যদিকে
শাহবাগে অংশগ্রহণকারীরা ছিল সাইবার-কম্যুনিটি ও প্রফেশন্যাল ক্লাস। আজকের
বিশ্বায়নের চাপে এই প্রফেশন্যাল ক্লাসের আমূল-পরিবর্তনকামী হয়ে ওঠার যথেস্ট
সম্ভাবনা থাকলেও একটি গণতান্ত্রিক কর্মসূচী ও গ্রামীণ মেহনতি মানুষের অংশগ্রহণ
ছাড়া তাদের এই পরিবর্তন সম্ভব নয়। ইউরোপীয়ান বয়ানে ‘সুশীল
সমাজ’ বলতে আমরা যাদেরকে বুঝি ভারত-বাংলাদেশের
মত দেশে এই শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী শ্রেণির স্বাধীন ভূমিকা পালনের ক্ষমতা সীমিত, কারণ তাদের গরিষ্ঠাংশই সরকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের ছুঁড়ে দেওয়া
বিভিন্ন সুযোগ ও প্রলোভনের উপর নির্ভরশীল। শাহবাগের যে মূল দাবি তাকে এবং সেই
দাবিপূরণের হুকুম জারি করে এই বিক্ষোভকারীদের আত্মস্থ করে নিতে শাসকীয় জোটের বিশেষ
বেগ পেতে হয়নি। অন্যদিকে বর্তমানের মাত্র দুইজন নির্বাচিত প্রতিনিধি নিয়ে জামাতে
ইসলামীর দুর্বল গণভিত্তির সাথে আঁতাত করেও নির্বাচনী লড়াইয়ে সুবিধে পাওয়া যায় এবং
ফলে বিএনপি ও লিগ দুই শিবিরেরই জামাত প্রশ্নে একটি রণকৌশল নিতে হয়। শাহবাগ বিক্ষোভ
ও জামাতের ভূমিকাকে মাথায় রেখে এবং আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে এই দুই শিবির
রণকৌশল নির্ধারণ করতে শুরু করে। অভ্যন্তরীণ এই টানাপোড়েনের সাথে যুক্ত হয়েছে
বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগের প্রশ্ন। বিভিন্ন দেশের বড় পুঁজিপতিরা তাদের বিনিয়োগ ও
মুনাফাকে সুরক্ষিত করতে তাদের নিজেদের রাষ্ট্রের মাধ্যমে এই টানাপোড়েনে তাদের
ভূমিকা নির্ধারণ করছে যাতে নির্বাচন-উত্তর বাংলাদেশ সরকারের উপর তাদের আধিপত্য
সুনিশ্চিত করা যায়। এই গোটা খেলায় ভাষা-ধর্মের মত সাংস্কৃতিক সূচকগুলিকে উগ্রভাবে
ব্যবহার করা হচ্ছে এবং এই খেলায় বাজি ধরা হয়েছে শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি মানুষ, বিভিন্ন নিপীড়িত জনগোষ্ঠী এবং শাহবাগের বিক্ষোভকারী সহ
বাংলাদেশী আম-জনতার দুর্ভাগ্যের উপর।
তার মানে কী শাহবাগের বিদ্রোহ বিফলে গেল? সেটা নির্ভর করবে সংগঠিত গণতান্ত্রিক শক্তি কী ভূমিকা নেয় তার উপর। আমার
ধারণা এই বিক্ষোভ থেকে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের এক নয়া মোড় নেবে। আমার এই
আশাবাদের কী কারণ? বাংলাদেশের সব শিবিরেই ফ্যাসিস্ট
মতাদর্শের লোকদের সমাগম থাকলেও বাংলাদেশের বাস্তব মাটিতে তাদের মতাদর্শ গ্রহণযোগ্য
করে তোলা এতো সহজ নয়। অন্য ভাষা-ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ বা তাদের অধিকার অস্বীকার
করা এবং ধর্মীয় আচার-আচরণের প্রতি বিদ্বেষ উভয়ই ফ্যাসিস্ট মতাদর্শের
লক্ষণ এবং এই মতাদর্শের বিরুদ্ধে লড়াই বহু আঁকাবাঁকা পথের মধ্য দিয়ে দীর্ঘকালব্যাপী
চলবে। কিন্তু এই মতাদর্শ যদি একটি ফ্যাসিস্ট শক্তি হয়ে উঠে তাহলে লড়াইটা হবে
মুখোমুখি ও আশু কর্মসূচী। সাধারণ নাগরিকদের উপর অত্যাচারের মাত্রা দিয়ে ফ্যাসিস্ট
শক্তির বিচার হয় না – কারণ একাজ
তথাকথিত গণতন্ত্রের আড়ালেও চলতে পারে। এটা নির্ধারিত হয় এই লক্ষণ দিয়ে যেখানে
শাসকশ্রেণির একাংশ অপর অংশকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার মত ক্ষমতা অর্জন করেছে এবং
রাষ্ট্র-ক্ষমতা নিরঙ্কুশ কুক্ষিগত করার জন্য সাংস্কৃতিক সূচককে ব্যবহার করে বৃহৎ
জন-সমর্থনও আদায় করে নিয়েছে। বাংলাদেশে এই ফ্যাসিস্ট শক্তির উত্থান (তা ভাষা-ধর্ম
ইত্যাদি যে কোন সাংস্কৃতিক সূচককে ব্যবহার করেই হোক না কেন) খুব সহজ নয়। কারণ
বিশ্বায়নের আর্থিক শক্তি এখনই নির্বাচনী গণতন্ত্রকে বাতিল করতে চাইবে না, বাংলাদেশ লিবার্যাল ইসলামের দেশ, বাংলাদেশের ভাষা-জাতীয়তাবাদ সামগ্রিকভাবে আগ্রাসী রূপ পরিগ্রহ করেনি – বরঞ্চ একাত্তরের ত্যাগের এক ঐতিহ্য রয়েছে। বাংলাদেশের মানুষের
বিক্ষোভকে সরকার আত্মস্থ করতে পেরেছে বলে মনে হয় না, কারণ
ফাঁসির দাবি মেনে নেওয়ার বাইরে মানুষ আর কিছুই পায়নি। সুতরাং এই বিক্ষোভকারীদের
কোন সত্যিকার গণতান্ত্রিক বিষয়ে আবার সমাবেশিত হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। তারজন্য
গণতান্ত্রিক সংগঠকদের এক কঠিন প্রস্তুতি চালাতে হবে। বাংলাদেশের মানুষ ইতিমধ্যে
গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তোলার সামূহিক ইচ্ছা ব্যক্ত করতে শুরু করেছে। শাহবাগ
ব্যর্থ হলেও মানুষের ইচ্ছার প্রকাশ ঘটিয়েছে, বাংলাদেশে
প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকারের প্রশ্ন নিয়ে দেশব্যাপী ধর্মঘটের মাধ্যমে এক
সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী চেতনা জাগ্রত হয়েছে, বাংলাদেশের সবচেয়ে
বড় শিল্পদ্যোগ বস্ত্রশিল্পে শ্রমিক আন্দোলনের মাধ্যমে শ্রমিক শ্রেণিও সংগ্রামের
কসরত শুরু করে দিয়েছে। এমতাবস্থায় শুধুমাত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নের সূচকের মাধ্যমে
আধুনিক জাতি-রাষ্ট্রের পক্ষাবলম্বন কিংবা সংকীর্ণ অবস্থান বা অবস্থান-নিরপেক্ষতার
মাধ্যমে শুধুমাত্র নিজস্ব সাংস্কৃতিক সূচককে নির্দিষ্ট করে স্বাধীন রাষ্ট্রের
কল্পনা উভয়ই গ্রহণযোগ্য নয়। তাই আমাদের নতুন পথের সন্ধান করতে হবে যে পথের শুরু
হবে দেশের স্বাধীনতা, জাতির মুক্তি, গণ-ক্ষমতার জন্য গণতন্ত্রের লক্ষ্যে নির্ধারিত এক কর্মসূচীকে ধৈর্য্যের
সাথে জনগণের মধ্যে গ্রহণযোগ্য করে তোলার মধ্য দিয়ে। একাজটি নিশ্চিতভাবে হবে বাম
দিক থেকে এবং এটা আসলে এক গণ-প্রক্রিয়া।
নতুন পথ
শাহাবাগের পালটা ইসলামী সংগঠনগুলোর সমাবেশ |
কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে যে সামাজিক সূচকের অনেক ক্ষেত্রেই বিশেষ করে নারী
শিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভারতবর্ষ থেকেও এগিয়ে। এই সূচকগুলি দেখায় যে
গ্রামাঞ্চলে সামন্ত শ্রেণির আধিপত্য আর আগের মত নিরঙ্কুশ নয় – বুর্জোয়া বিকাশ অনেকখানি হয়েছে। নিও-লিবার্যাল পলিসির চাপে
শহরাঞ্চলের প্রফেশন্যাল ক্লাস আন্দোলনমুখী। বাংলাদেশের লিবার্যাল ইসলাম অনেক বেশি
শক্তিশালী। একবিংশ শতাব্দীর ইসলাম কোরানের সময়ের ইসলাম নয়, বাংলাদেশের
ইসলাম আরবের ইসলাম নয়, ধর্মীয় সংস্কৃতি স্থান-কালের সীমায়
বহুধরনের আদান-প্রদানের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠে– ইসলামের এই
বহুমাত্রিকতা কেউ স্বীকার করুক চাই না করুক – সেটাই বাস্তব।
দেওবন্দী স্কুল, যার প্রভাব এতদঅঞ্চলে সর্বাধিক, তারা বহুত্ত্বকে স্বীকার করে এবং সামাজিক ন্যায়কে ইসলামের মৌলিক নীতি
হিসাবে মানে। সেক্ষেত্রে যে কোন সমাবেশের অভ্যন্তরে যে গণতান্ত্রিক অন্তর্বস্তু
লুকিয়ে থাকে তাকে একজায়গায় নিয়ে আসার প্রচেষ্টা জারি থাকার সম্ভাবনাই প্রবল। এই
প্রচেষ্টার অন্যতম বিষয় নিশ্চিতভাবে হতে হবে সংখ্যালঘু অধিকার, শ্রমিক-কৃষক অধিকার, গণতন্ত্র ও সাম্রাজ্যবাদ
বিরোধিতা।
১ ভগ্নাংশের সমর্থনে দাঙ্গা নিয়ে কী লেখা যায়? – জ্ঞানেন্দ্র পাণ্ডে
২ স্বজাতি স্বদেশের খোঁজে – সেমন্তী ঘোষ
৩ Anisuzzaman Chowdhury edited book titled Moulana Bhasani,
Leader of the Toiling Masses
৪ মুসলিম মানস ও বাংলা-সাহিত্য – আনিসুজ্জামান
৫ The rise of Islam and the Bengal Frontier-Richard Eaton
৬ The emergence of Bangladesh – Vol 2 – Badruddin Umar
৭ সম্রাজ্যবাদী সংঘাত ও লুক-ইস্ট পলিসি – অরুণোদয়, অগাস্ট ২০০৮ সংখ্যা