মাওবাদী হিংসা ও ভারতীয় গণতন্ত্র
Posted by
Imagine there's no heaven
It's easy if you try
No hell below us
Above us only sky
Imagine all the people
Living for today...
It's easy if you try
No hell below us
Above us only sky
Imagine all the people
Living for today...
মাওবাদী
হিংসা ও ভারতীয় গণতন্ত্র
অরূপা
মহাজন
(অরুণোদয়ের
জন্য)
ভারতীয় মাওবাদীরা দাবি করছে যে তথাকথিত রেড-করিডরের মুক্তাঞ্চলে (যেখানে রাষ্ট্রের উপস্থিতি শুরু থেকেই দুর্বল) তারা জনমুখী উন্নয়ন মডেল রূপায়ণের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে, এই মডেলকে সর্বব্যাপী ও উন্নততর পর্যায়ে নিয়ে যেতে ভারতীয় রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের জন্য দীর্ঘস্থায়ী জনযুদ্ধের অঙ্গ হিসেবে গেরিলা অ্যাকশন চালু রয়েছে। বিপরীতে ভারতীয় রাষ্ট্রের দাবি, মাওবাদীরা নির্বিচার গেরিলা অ্যাকশনের মাধ্যমে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে সরকারি সমস্ত উন্নয়নমূলক উদ্যোগকে বানচাল করে দিতে চাইছে। মাওবাদীদের গেরিলা অ্যাকশন ও মাওবাদীদের বিরুদ্ধে অপারেশন গ্রিন হান্ট-এর মাধ্যমে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ইতিমধ্যে ঘোষিত হয়ে গেছে। ভারতীয় সমাজ-রাষ্ট্রে এই হিংসা কী অবশ্যাম্ভাবী হয়ে উঠছে? এই ধরনের পরিস্থিতি কী হিংসা-প্রতিহিংসার এক অশুভ চক্রের জন্ম দেবে, না এই যুদ্ধের জয়-পরাজয়ের উপর রাষ্ট্রের মানবিক, গণতান্ত্রিক ও বৈপ্লবিক রূপান্তর নির্ভর করবে?
রাষ্ট্র
ও শ্রমিক শ্রেণি
যে কোন শ্রেণিবিভক্ত সমাজে শোষকশ্রেণিই
রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং একইসাথে শাসক-শাসিতের শান্তিপূর্ণ সমঝোতা ও সহাবস্থান
বজায় রাখার জন্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলিকে ব্যবহার করে। একথার অর্থ এই দাঁড়ায় যে
শোষিতরা যথেষ্ট সংঘবদ্ধ হলে শোষণের মাত্রাকে কমিয়ে আনতে পারে ও শ্রমিকশ্রেণির
পক্ষে কিছু ছাড় আদায় করে নিতে পারে। শ্রমিকশ্রেণির পক্ষে এই কাজ স্থিতাবস্থার
পক্ষেও হতে পারে, আবার রাষ্ট্রের বৈপ্লবিক রূপান্তরের লক্ষ্যেও পরিচালিত হতে পারে।
শ্রমিকশ্রেণির সংঘবদ্ধ চাপে রাষ্ট্রের কাঠামোয় যদি এমন নমনীয়তা আসে যা রাষ্ট্রের
প্রতিষ্ঠানসমূহের উপর শ্রমিকশ্রেণির প্রত্যক্ষ বা অপ্রত্যক্ষ প্রভাব বা নিয়ন্ত্রণ
বৃদ্ধির মাধ্যমে শ্রমিকশ্রেণির মতামত গুরুত্ব পায় এবং পুঁজির শোষণের উপর খানিকটা
রাশ টেনে ধরে, তাহলে একে বৈপ্লবিক অগ্রগতিই বলতে হবে। উল্টোদিকে পুঁজি তার নিজস্ব
মুনাফা ও সঞ্চয় বৃদ্ধির প্রয়োজনে যদি শ্রমিকশ্রেণিকে কিছু সুযোগ সুবিধা প্রদান করে
এবং শ্রমিকশ্রেণি যদি একে বিরাট প্রাপ্তি বলে মেনে নেয় তাহলে তা স্থিতাবস্থার
অনুকূল বলেই ধরে নিতে হবে। দ্বীতিয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী পুনর্গঠন পর্যায়ে শিল্পজাত
সামগ্রীর চাহিদা বৃদ্ধির লক্ষ্যে পুজিঁ তার মুনাফা ও সঞ্চয় বৃদ্ধির স্বার্থে
শ্রমিকশ্রেণিকে বেশকিছু সামাজিক সুরক্ষাজনিত সুযোগ-সুবিধা প্রদান করেছিল। পুঁজি ও
শ্রমের এই সমঝোতাকে ‘নিউ-ডিল’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় যেখানে পুঁজির চাহিদা ও
যুদ্ধ-ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনে উজ্জীবিত শ্রমিকশ্রেণির চাহিদা একজায়গায় এসে মিলে
যায়। কোন কোন পর্যবেক্ষক সংঘবদ্ধ শ্রমিকশ্রেণির চাহিদাকে এই ‘নিউ-ডিলের’ পেছনে মূল
কার্যকরী উপাদান হিসেবে দেখান, যদিও এটা আসলে পুঁজির চাহিদার কাছে স্থিতাবস্থার পক্ষে
শ্রমিক শ্রেণিকে কিনে নেওয়া, শ্রমিকশ্রেণির মধ্যে লেবার-এরিস্টোক্রেসি তৈরি করা এবং
সেই অর্থে শ্রমিকশ্রেণির পরাজয় স্বীকার করে নেওয়।
স্থিতাবস্থা
ও বৈপ্লবিক রূপান্তর
স্থিতাবস্থা বা বৈপ্লবিক রূপান্তর উভয়ই দাঁড়িয়ে
থাকে পুঁজির অবস্থা, রাজনৈতিক পরিস্থিতি, শ্রমিকশ্রেণির সচেতনতা, তাত্বিক
হাতিয়ারের পরিপক্কতা ও বৈপ্লবিক সাংগঠনিক স্থিতির উপর। শ্রমিকশ্রেণির
অভ্যুত্থানমূলক-হিংসা তখনই অনিবার্য হয়ে পড়ে যখন শ্রমিকশ্রেণির উপর
অর্থনৈতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত আধিপত্য বজায় রাখার জন্য রাষ্ট্রের সমস্ত শান্তিপূর্ণ
ক্ষমতা নিঃশেষিত হয়ে যায় এবং শ্রমিকশ্রেণিও ক্ষমতাদখলের সচেতনতার উচ্চশিখরে বিরাজ
করে। শাসকশ্রেণি যখন পুরোনো কায়দায় শাসন চালাতে পারে না এবং শ্রমিকশ্রেণিও আর এই
শাসন মানতে রাজি নয়, তখনই বিপ্লবী সংকট দেখা দেয়। কিন্তু শ্রমিকশ্রেণি এই লড়াইয়ে
জয়ী হবে কিনা তা সুনিশ্চিত করার জন্য আরেকটি সর্ত পূরণ হওয়া জরুরি এবং তা হলো
সাংগঠনিক প্রস্তুতি। তবে বাস্তব পরিস্থিতির অপরিপক্কতার পরিস্থিতিতেও
শ্রমিকশ্রেণির স্বতঃস্ফূর্ত বিদ্রোহ যে বিপ্লবীদের অমূল্য ঐতিহাসিক শিক্ষা দিতে
পারে তার জ্বলন্ত উদাহরণ প্যারিস কমিউন। তাই বাস্তব পরিস্থিতি যদি এরকম হয় যে
শ্রমিকশ্রেণি বিদ্যমান রাষ্ট্রকে আর কোনভাবেই ব্যবহার করতে অপারগ এবং শ্রমিক
শ্রেণি বলপ্রয়োগের মাধ্যমে ক্ষমতাদখল করতে আগ্রহী, সেক্ষেত্রে শ্রমিকশ্রেণির
সশস্ত্র সংগ্রামকে নাকচ করে দেওয়া মার্কসীয় বীক্ষায় সংশোধনবাদ হিসেবেই অভিহিত হয়। নয়া-উপনিবেশবাদের
বিরুদ্ধে সংগ্রামে শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে যে বিভিন্ন শ্রেণির ঐক্য গড়ে তোলা
অবশ্যাম্ভাবী হয়ে উঠে তার মধ্যেই নিহিত থাকে সংশোধনবাদের এই শ্রেণিভিত্তির। ভারতীয়
মাওবাদীদের রণনীতি ও রণকৌশলকে মুখ্যতঃ সেই দৃষ্টিকোণ থেকেই বিচার করা উচিত বলে
আমার মনে হয়। সুতরাং মাওবাদীদের ভূমিকা বিচার করার জন্য আমাদের ভারতীয় রাষ্ট্র ও
বর্তমান পরিস্থিতির উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হবে।
নিউ
ডিল ও নিও-লিবার্যালিজম
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ‘নিউ ডিলের’
পর্যায়ের পুঁজিবাদের দীর্ঘকালীন মন্দা শুরু হয় সত্তরের দশকে। এই সংকট থেকে বেরিয়ে
আসার জন্য শুরু হয় পুঁজির এক নতুন পর্যায় যাকে অভিহিত করা হয় নিও-লিবার্যাল
পর্যায় হিসেবে। এই পর্যায়ের অন্তর্নিহিত অর্থ হচ্ছে এই যে শিল্পসামগ্রীর চাহিদার
চেয়ে ফিনান্সিয়্যাল এসেটের চাহিদাবৃদ্ধির উপর গুরুত্ত্ব আরোপ। ফলে বিভিন্ন
ফিনান্সিয়্যাল ইনস্ট্রুম্যান্টের মাধ্যমে শেয়ার, বণ্ড, সিক্যুরিটি ইত্যাদি
বেচাকেনার বাজারে পুঁজির পরিমাণ উৎপাদনীসামগ্রীকে বহুগুণ ছাড়িয়ে গেছে।
ফিনান্সিয়্যাল বাজারকে ধরে রাখা ও এই বাজারে চাহিদা বৃদ্ধিকে পুঁজির সংকট মোচনের
মোক্ষম দাওয়াই হিসেবে ভাবা হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই শ্রমিকশ্রেণির জীবনযাত্রার
মানোন্নয়নের মাধ্যমে উৎপাদনীসামগ্রীর চাহিদাবৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা না থাকায় আমজনতার
উপর স্টীমরোলার চালিয়ে, হত্যা-রাহাজানি-লুটের হাতিয়ার প্রয়োগ করে, জল-জমি-জঙ্গলের
ব্যাপক ধ্বংস ও দখলদারির মাধ্যমে ব্যাপক মানুষকে বাস্তুচ্যুত, ভিটেমাটিহীন মানবেতর
জীবনের দিকে ঠেলে দিয়ে পুঁজি তার আদিম সঞ্চয়ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রাকৃতিক সম্পদ
দখল ও লুট বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে আজকের এই নিও-লিবার্যাল পর্যায়ে। অনুন্নত বা
উন্নয়নশীল বিশ্বের তাবৎ রাষ্ট্র (সাম্প্রতিক প্রতিরোধে ঘুরে দাঁড়ানো কতিপয়
রাষ্ট্রের উদাহরণ বাদ দিলে) পুঁজির এই নীতির সাথে হাত মিলিয়ে জনকল্যাণের ন্যূনতম
দায়কে অস্বীকার করে উন্নয়ন ও বিতরণের সব ভূমিকাকে বেসরকারি হাতে তুলে দিচ্ছে। ভারত
রাষ্ট্রও এই তালিকায় নাম লিখিয়েছে।
পুঁজির
আদিম সঞ্চয়ন
মধ্য ও পশ্চিম ভারতের বিস্তৃত অঞ্চলে প্রাকৃতিক সম্পদ লুণ্ঠনের উদ্দেশ্যে যে ব্যাপক উচ্ছেদ, আদিবাসীদের হত্যা-ধর্ষণ ও ব্যাপক
বনধ্বংস যজ্ঞ চলছে তা দেশি-বিদেশি কর্পোরেট পুঁজির আদিম সঞ্চয়ন প্রক্রিয়ার অঙ্গ। ‘স্বাধীন
ভারতে’ এই প্রক্রিয়া নতুন নয়, কারণ সরকারি হিসেবে স্বাধীনতার পর থেকে ‘সেজ’ গঠন
হওয়ার আগেই বিভিন্ন বৃহৎ প্রকল্পের জন্য প্রায় ৪০ মিলিয়ন লোক উচ্ছেদ হয়েছে যার এক
তৃতীয়াংশেরই মাত্র পুনর্বাসন হয়েছে। তবে বর্তমান নিও-লিবার্যাল পর্যায়ে কর্পোরেট
পুঁজির সরাসরি প্রকৃতিক সম্পদ লুটের স্বার্থে যে ব্যাপক ও বিস্তৃত উচ্ছেদ অভিযান
চলছে তা অভূতপূর্ব। ভারতবর্ষের মত দেশে পুঁজির এই আদিম সঞ্চয়ন প্রক্রিয়া মার্কস
বর্ণিত আদিম সঞ্চয়ন প্রক্রিয়ার সাথে ফারাক রয়েছে। মার্কস লিখেছেন, “কৃষিজীবী
জনসমষ্টির একাংশের দখলচ্যুতি ও উচ্ছেদ শুধু যে শিল্প-পুঁজিকে শ্রমিক, তাদের
জীবিকার্জনের উপায় আর শ্রমপ্রয়োগের বস্তুই জুটিয়ে দিয়েছিল তাই নয়; তা আভ্যন্তরিক
বাজারও সৃষ্টি করেছিল”। (কার্ল মার্কস, পুঁজি, খণ্ড ১, অংশ ২, অধ্যায় ৩০)। ক
বর্তমান ব্যাপক উচ্ছেদ ও ধ্বংসযজ্ঞ পরিচালিত হচ্ছে বহুজাতিক (Transnational) বৃহদাকারের একচেটিয়া (Oligopolies) পুঁজিমালিকদের
স্বার্থে যেখানে সামগ্রীক হিসাবে পুঁজির বহিঃর্গমন হচ্ছে এবং ফলে এই প্রক্রিয়ায় আভ্যন্তরিক
বাজার সৃষ্টি হচ্ছে না।
দিল্লি-হরিয়ানার আধুনিক শিল্পাঞ্চলগুলিতে সস্তা
শ্রমিকের ভিড় দেখা গেলেও বড় শহরে কর্মহীন ঝুপরিবাসীর তূলনায় তা নগণ্য। ব্রিক (BRIC) রিপোর্টে বলা হয়েছে যে ২০২০ সালে ভারতবর্ষের অর্থনীতি জার্মানীর কাছাকাছি চলে
যাবে, শহরের বাসিন্দা ২৩% অর্থাৎ ২৮৫ মিলিয়ন থেকে ৪০% অর্থাৎ ৫৪০ মিলিয়নে বেড়ে
যাবে, অন্যদিকে গ্রামীণ জনসংখ্যা কমে গিয়ে ৮২০ মিলিয়নের কাছাকাছি দাঁড়াবে। কৃষিতে
বিপর্যয়, সরকারি বিনিয়োগের অভাব, কৃষি-সামগ্রীর
মূল্যবৃদ্ধি ইত্যাদির ফলে ক্ষুদ্র-চাষিদের কাছে কৃষি অ-লাভজনক হয়ে পড়ছে। এই কৃষকরা
এখন দৈনন্দিন জীবিকা নির্বাহের তাগিদে অন্যত্র দিনমজুরির সন্ধানে ঘুরে বেড়ায়।
অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধি অর্থাৎ কর্মসংস্থান বৃদ্ধির মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধির
নীতির বদলে আয়ের জন্য রপ্তানীর উপর অধিক গুরুত্ত্ব বিপর্যয় ডেকে আনছে। তূলার মত
ক্যাশ-ক্রপ উৎপাদনের কৃষিক্ষেত্রগুলিতে ঋণে-জর্জরিত কৃষকদের ব্যাপক আত্মহত্যার
ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে কৃষিতে পুঁজির বিনিয়োগ ঘটলেও উৎপাদিকা শক্তি ও
উৎপাদন সম্পর্কের আন্তঃক্রিয়া আধা-সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার অঙ্গই রয়ে গেছে - উন্নত
ও অনুন্নত কৃষি উৎপাদন রাজ্যে সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির ক্রমবর্ধিত অনুপ্রবেশ এবং
মহাজনি ও ফসল ব্যবসায়িদের শোষণ পরস্পরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করেছে এবং তাদের মিলিত
আক্রমণ কৃষককে আরও দুর্বিষহ অবস্থায় ঠেলে দিয়েছে। উপরোক্ত ঋণ-কাঠামোয় বাজার
ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিনিময় না হয়ে আধা-সামন্ততন্ত্রের প্রতীক হয়ে উঠে – যেখানে
দাম যখন চড়া তখন ক্ষুদ্র কৃষক ক্রেতা, যখন কম তখন বিক্রেতা। আধা-সামন্ত শ্রেণির
অর্থনৈতিক ক্ষমতা সম্পূর্ণত জমির উপর বিধিবদ্ধ অধিকার জাত নয়, অ-নথিভুক্ত
প্রজাসত্ব ও প্রজাদের ভোগব্যয়ে ঋণদাতার ভূমিকা নির্ভর। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী
পুঁজির অনুপ্রবেশের ফলে (সরাসরি কৃষি কর্পোরেট পুঁজি এবং আইএমএফ – ওয়ার্ল্ড
ব্যাঙ্কের বিভিন্নধরনের প্রকল্প ঋণ) আধুনিক কৃষিসামগ্রীর মাধ্যমে উৎপাদিকা শক্তির
প্রভূত বিকাশ ঘটেছে। মজুরি শ্রমিক দিয়ে চাষ বৃদ্ধি নিশ্চিতভাবে ধনতান্ত্রিক
পরিবর্তনের দিকে পদক্ষেপ। কিন্তু মজুরিকে মূল্যের নিচে বেঁধে রাখার জন্য
সাম্রাজ্যবাদী কর্পোরেট পুঁজি ও মহাজনী পুঁজি উভয়েরই স্বার্থ জড়িত এবং এজন্যই
উৎপাদিকা শক্তিকে আধা-সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্কের নিগড়ে বেধে রাখতেও তারা তৎপর।
ভারতীয় রাষ্ট্র সরকারি ঋণের সুযোগ কমিয়ে দিয়ে মহাজনী শ্রেণি-আধিপত্য বজায় রাখতে
মদত দিচ্ছে। এনএসএসের তথ্য অনুযায়ী ৪৯% কৃষক পরিবারই ঋণগ্রস্ত। অন্ধ্রপ্রদেশ,
পাঙজাব, কেরালা ও তামিলনাড়ুতে ঋণগ্রস্ততার পরিমাণ বেশি। এনএসএস তথ্য মতে গড় একটি
কৃষক পরিবারের ঋণের পরিমাণ ১২,৫৮৫ টাকা, যার ৩০.৯% আসে গ্রামীণ মহাজন ও ফসল
ব্যবসায়ীদের থেকে। গড়ে ২৪% সুদের হার ধরলে সুদ মেটাতে কৃষকদের খরচ হয় ২০,০০০ হাজার
কোটি টাকা। অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণের পরিমাণ আসলে আরও বেশি হবে।
ভারতে গড় খাদ্যশস্য ব্যবহার এত কমে গেছে তা
ঔপনিবেশিক সময়ের সঙ্গে তুলনীয় – যদিও খাদ্যশস্য রপ্তানি বাড়ছে, আর গ্রামীণ ভারতকে
বাড়তি ক্ষুধার ভার বহন করতে হচ্ছে। অর্থনীতির ক্ষেত্রে পরিষেবায় দ্রুত প্রসার
ঘটছে। জিডিপি-তে কৃষির অংশ ১৯৯০-এ ৩৫% থেকে কমে ২০০৩-০৪ সালে ২৫% হয়েছে – অন্যদিকে
বাণিজ্য, হোটেল, পরিবহণ ও যোগাযোগ ২/৫ থেকে ১/২ অংশ হয়েছে ও শিল্পের ক্ষেত্রে দেখা
দিয়েছে বিকাশহীনতা। কৃষি, খনি ও খাদান ও সরকারি উপযোগিতায় – মোট শ্রমিক সংখ্যা
কমেছে। ১৯৮০-এর দশকে গ্রামীণ কর্মসংস্থান বেড়েছে ২.৪% হারে – সংস্কারের পর তা
কমে দাঁড়িয়েছে ০.৭%। বহু ভূমি সংস্কার আইন প্রণয়ন
ও সংশোধনের পরও মোট চাষযোগ্য জমির ২% মাত্র পুনর্বন্টিত হয়েছে এবং ভাগচাষি বা
বর্গাচাষির ক্ষেত্রে ৪% জমির মালিকানা স্বত্ব দেওয়া হয়েছে। ১.৬% জমি
মালিকদের হাতে ১৭.৩% চাষযোগ্য জমি দখলে আছে। ৭৮.৮%
প্রান্তিক ও ছোট চাষি (২ হেক্টরের কম) এবং ৮.৭%
মাঝারি ও বড় কৃষকদের হাতে(৪ হেক্টরের বেশি)। বর্তমানে চুক্তিপ্রথায় কৃষিমজুরের
সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি ঘটছে যারা চাষের মরশুম ছাড়া অত্যন্ত কম মজুরিতে কাজ করতে
বাধ্য হয়। সুতরাং কৃষি মজুরের মজুরি বৃদ্ধি করা ও সহজ সর্তে সরকারি ঋণের ব্যবস্থা
করা সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির ও সামন্তীয় শোষণের বিরুদ্ধে এক গুরুত্ব্বপূর্ণ পদক্ষেপ। কিন্তু
নিও-লিবার্যাল পলিসির অনুসরণকারী ভারত সরকার এতে আগ্রহী হবে না। কারণ কর্মসংস্থানের
মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ বাজারের চাহিদা বৃদ্ধির বদলে রপ্তানী আয়ের মাধ্যমে
উচ্চশ্রেণিকে সন্তুষ্ট রাখার নীতিই ভারত সরকার অবলম্বন করে চলেছে, যে শ্রেণি কৃষির
রপ্তানী বাজারেও ফাটকা খেলতে আগ্রহী। অথচ কৃষি থেকে পুঁজির বহির্গমন নয়, পুনর্বিনিয়োগই
উচ্ছেদ, কৃষি-বিপর্যয় ইত্যাদির ফলে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া গ্রামীণ মানুষদের
প্রলেতারীয়করণ ঘটায়, অন্যথায় সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির অধীনে একই উৎপাদন সম্পর্কের
পুনরুৎপাদন ঘটতে থাকবে। ভারতবর্ষের পরনির্ভরশীল নীতি বোঝার জন্য আমাদের একথা জানাই
যথেস্ট যে যে কৃষিতে মেধা উদ্যোগের (কে আই এ) ভারত-মার্কিন সংস্থার
পরিচালন সমিতিতে ওয়ালমার্ট ও মনসান্টোর প্রতিনিধি রয়েছে।
বিশ্বব্যাপী
বিক্ষোভ ও সশস্ত্র সংগ্রাম
এই পরিস্থিতিতে আমরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে
ব্যাপকাকারে বিভিন্ন রূপ ও ধরনের প্রতিবাদ-প্রতিরোধ সংগ্রাম সংগঠিত হতে দেখছি। এই
সংগ্রামগুলো অনেক আংশিক বিজয় লাভ করলেও নিও-লিবার্যাল আর্থিক নীতির দিশা থেকে
নিজেদের রাষ্ট্রের মোড় ঘোরাতে পারেনি। এমতাবস্থায় যে দু’টি বিষয় আলোচনায় প্রাধান্যে
চলে আসছে তা হলো – শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্ব ও সশস্ত্র সংগ্রাম। ভারতবর্ষের মত
দেশগুলির রাষ্ট্রের যে চরিত্র পরিবর্তন ঘটিয়েছে, তাতে অভ্যুত্থানমূলক হিংসা –
হিংসাত্মক সংঘর্ষ ও সশস্ত্র সংগ্রামকে অনিবার্য করে তুলছে বলেই অনেকের ধারণা।
এভাবে কোন ধারণায় উপনীত হওয়া নিছক অর্থনীতিবাদী দৃষ্টিভঙ্গী থেকে উদ্ভূত, কারণ
শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্ব ও সশস্ত্র সংগ্রামের প্রশ্নটি বিবেচিত হওয়া উচিত ইতিহাসের
প্রেক্ষিতে সামগ্রিক পরিস্থিতির পর্যালোচনায়।
আর্থিক
অনগ্রসরতা ও গণতন্ত্র
অনেকের কাছেই এটা বিস্ময়কর যে ভারতবর্ষের
দারিদ্র্য, অপুষ্টির মাত্রা যখন সাব-সাহারান আফ্রিকাকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে এবং
অসাম্যের মাত্রা তীব্র হচ্ছে, তখনও ভারতীয় বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্র টিঁকে আছে।
অর্থাৎ আর্থিক উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের সম্পর্ক একমুখীন ও সরলরৈখিক নয় – বরঞ্চ তার
ইতিহাস অনেক জটিল। পশ্চিমের দেশগুলিতে মাথাপিছু গড় আয় ২০০০ ডলার হওয়ার পর সর্বজনীন
ভোটাধিকার চালু হয়েছে, অথচ ভারতবর্ষে ১৯৫২ সালের প্রথম সাধারণ নির্বাচনের সময়
মাথাপিছু গড় আয় ছিল ২০০-২৫০ ডলার। সুতরাং এই গণতন্ত্রকে ব্যবহার করেই শ্রমিকশ্রেণি
ভারতীয় রাষ্ট্রের চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়াশীল আর্থিক নীতিকে কিছুটা হলেও পিছু হঠতে
বাধ্য করতে পারে, যেখানে শ্রমিকশ্রেণি সবার জন্য লড়াই করার চেতনার দিকে আরও একধাপ
অগ্রসর হওয়ার স্পেস খুঁজে পাবে এবং ক্ষমতা দখলের চূড়ান্ত মুহূর্তের জন্য প্রস্তুত
হতে পারবে। ভারতীয় ইতিহাস, বৈচিত্র ও গণতন্ত্রের কথা মাথায় রেখে আমাদের একাজটি
করতেই হবে, যতদিন না পরিস্থিতি পরিপক্ক হয় এবং তারচেয়ে গুরুত্ত্বপূর্ণ বিষয় হলো এই
যে শ্রমিকশ্রেণির সচেতনতা, তাত্ত্বিক ও সাংগঠনিক প্রস্তুতি ও অতীত থেকে শিক্ষা
নিয়ে ভবিষ্যত সমাজ সম্পর্কে নতুন ধারণা তৈরির লক্ষ্যে আমাদের এই গণতান্ত্রিক
সংগ্রামের শিক্ষাকে কাজে লাগাতেই হবে। ‘গ্রামসভার অনুমতি ছাড়া আদিবাসীদের জমি অধিগ্রহণ
করা যাবে না’ – বিচারবিভাগের এই রায় আদিবাসী প্রতিরোধ সংগ্রামকে অনেক উজ্জীবিত
করবে। অন্যদিকে মহেন্দ্র কার্মার কুকর্মের শাস্তি (গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেরই তার
অপরাধের বিচারপ্রক্রিয়া শুরু করা উচিত ছিল) সে পেয়েছে, কিন্তু তাতে গণ-প্রতিরোধের
অগ্রগতি ঘটার ভারতীয় মাওয়িস্টদের ধারণার সাথে একমত হওয়া দুষ্কর। বরঞ্চ “আমরাই
একমাত্র বিপ্লবী এবং আমরাই একমাত্র গণস্বার্থের প্রতিনিধি” – এই বোধ থেকে অপরকে
নিঃশেষ করে দেওয়ার প্রবণতা বাম-বিচ্যুতির গাড্ডায় পড়ার আঁতুড়ঘর। বিপ্লবী আবেগ,
ত্যাগ ইত্যাদির সাথে যদি সঠিক বিপ্লবী-তত্ত্ব বিকাশের লক্ষ্যে অনুশীলনকে পরিচালিত
করা না হয়, তবে ভবিষ্যত সমাজবাদ গঠনের লক্ষ্য থেকে দল ও জনগণকে বিচ্যুত করার দায়
এড়িয়ে যাওয়া যায় না। সশস্ত্র সংগ্রাম যদি গণ-রাজনীতির ধারাবাহিকতা না হয়, তাহলে যা
পড়ে থাকে সেটা শুধুই অস্ত্র, সংগ্রামের অন্তর্বস্তু নিঃশেষিত হয়ে যায়। কর্পোরেট
হায়নাদের বিরুদ্ধে গণ-প্রতিরোধই এই রাজনীতির মুখ্য দিক। কিন্তু এই রাজনীতির মুখ্য
দিশা হতে হবে শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্বে গণতন্ত্রের পূর্ণ বিকাশ যার অন্তে দল,
গণতন্ত্র, রাষ্ট্র সবকিছুই অপ্রয়োজনীয় হয়ে নিঃশেষিত হয়ে যাবে।