(নিচের লেখাটি দৈনিক যুগশঙ্খের ১৯ অক্টোবর, ২০১৩ সংখ্যায় প্রকাশিত।)
দেবালয় না শৌচালয়
যুক্তির বিচার কখন যে বিশ্বাসের আঙিনায় অনধিকার প্রবেশ করে তা বোঝা
দায়। শৌচালয় না দেবালয় – কোনটা বেশি জরুরি এ নিয়ে এই কদিন আগে জাতীয় পর্যায়ে বিতর্ক
হল। কিন্তু মনে হল যেন এ বিতর্কের আড়ালে আস্তিন গুটিয়ে কিছু লোক দাঁড়িয়ে আছে। কিছু
রূঢ় তথ্য এদেরকে লজ্জাবনত করতে পারত, কিন্তু তা হবার নয় কারণ এরা বিশ্বাসের প্রহরী।
এই তথ্যগুলি অগোছালোভাবে অনেকেরই জানা। তথাপি মানব উন্নয়ন রিপোর্ট ২০১৩ থেকে পাঠকের সুবিধার জন্য এখানে কিছু তথ্য তুলে
ধরছি। ভারতবর্ষের গড় জনপ্রতি আয় ১৯৯০ সালে বাংলাদেশ থেকে ৬০% বেশি এবং ২০১১ সালের
হিসাবে বাংলাদেশের দ্বিগুণ। কিন্তু উন্নত শৌচালয়ের সুবিধা ১৯৯০ সালে ভারতে ১৮% ও
বাংলাদেশে ৩৯% এবং ২০১১ সালে যথাক্রমে ৩৪% ও ৫৬%। শিশুমৃত্যুর হার প্রতি
হাজারে ১৯৯০ সালে ভারতে ৮১ জন ও বাংলাদেশে ৯৭ জন, কিন্তু
সেই হার ২০১১ সনে ভারত ও বাংলাদেশে যথাক্রমে ৪৭ ও ৩৭ জন। গড় আয় ভারতের অনেক বেশি হওয়া সত্ত্বেও উন্নয়নের
এধরনের বহু মানদণ্ডে বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে অনেক এগিয়ে। ধর্মকে যারা স্ত্রী-শিক্ষার
প্রধান অন্তরায় হিসেবে বিবেচনা করেন, তাদের জন্য একটি গুরুত্ত্বপূর্ণ তথ্য হচ্ছে
এই যে, ১৫ থেকে ২৪ বছরের মহিলাদের শিক্ষার হার ১৯৯১ সালে ভারত ও বাংলাদেশে
যথাক্রমে ছিল ৪৯% ও ৩৮%, কিন্তু ২০১০ সালে এই চিত্র পালটে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ৭৪%
ও ৭৮%। এই তথ্যগুলি দুটি বৈশিষ্ট্যকে স্পষ্ট করে দেয়। প্রথমত বাংলাদেশের সাথে
তুলনামূলক বিচারে ১৯৯১ সাল অব্দি ভারতবর্ষের পরিকল্পনা-পর্যায়ে মানব উন্নয়নের
অগ্রগতি ছিল শ্লথ, আর ১৯৯১ পরবর্তী উদারনীতির পর্যায়ে এক্ষেত্রে তুলনামূলক বিচারে
দ্রুত অবনমন ঘটছে। এই পর্যবেক্ষণ থেকেই এর অন্তর্নিহিত কারণ অনুসন্ধানের জন্য
বৌদ্ধিক চর্চায় ব্রতী হওয়া যায়। কিন্তু এই নিবন্ধ অন্য একটি বিষয় উত্থাপিত করার
উদ্দেশ্যে লিখিত, যেখানে যুক্তি ও বিশ্বাসের দ্বন্দ্বে ভারতীয় গণতন্ত্র অসহায় বোধ
করে। এই বিষয়টি বোঝার জন্য একটা সাধারণ উদাহরণের আশ্রয়
নেওয়া যাক।
যুক্তির অসারতা
শিলচর শহরে ইদানীং পাড়ায় পাড়ায় মন্দির নির্মাণের চল হয়েছে। স্যাকুলার
রাষ্ট্র্ তাতে অর্থ বিনিয়োগ করতে পারে না, কিন্তু কম্যুনিটি হলের নামে সরকারি তহবিল
থেকে মন্দির-মসজিদে অর্থ যে যায় তা সর্বজনবিদিত। এক্ষেত্রে দুটি পরস্পর বিপরীত
যুক্তি দাঁড় করানো যায়। একদল বলতেই পারে যে ভারতীয় সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে
যেহেতু ধর্ম এক ব্যাপক পরিসর জুড়ে রয়েছে, তাহলে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে সরকারি অর্থ
বিনিয়োগে আপত্তি থাকার কথা নয়। বিপরীতে অন্যদল দাবি করতে পারে যে ধর্ম একেবারে
ব্যক্তিগত বিষয় এবং সরকারি তহবিলে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের সাথে অবিশ্বাসীদেরও
অংশীদারি রয়েছে, সুতরাং এক্ষেত্রে পাবলিক মানি ব্যয় আপত্তিজনক। এই দুটি বিপরীত
যুক্তির পরিণতি এবার বিচার করে দেখা যাক। প্রথম যুক্তিকে হাতিয়ার করে অর্থ ও
ক্ষমতার পক্ষে জনমতকে প্রভাবিত করা যায় এবং তাতে শাসকেরা তাদের শাসনের পক্ষে
শাসিতের সায় আদায় করে নেয়। অন্যদিকে শপিং মল, মাল্টিপ্লেক্স, শপিং প্লাজা, পাবলিক
ট্রান্সপোর্টকে পঙ্গু করে দিয়ে প্রাইভেট ট্রান্সপোর্ট, উচ্চবিত্তের জন্য বিনোদনের
ব্যবস্থা ইত্যাদিতে সরকারি ব্যয় ও অপব্যয়কে দ্বীতিয় ধারার যুক্তি-বিচার দিয়ে
চ্যালেঞ্জ জানানো সম্ভব হয় না। অথচ এগুলিও শাসকের আর্থিক ক্ষমতা বৃদ্ধির সহায়ক
কাজকর্ম হিসেবে পরিগণিত হয়। একদলের অর্থ ও ক্ষমতার জৌলুস বৃদ্ধি তুলনামূলকভাবে
আরেকদলের পতনকে সুনিশ্চিত করেই গড়ে ওঠে। এই অসাম্য বৃদ্ধি আমজনতার বৃহদংশকে করে
তোলে সামাজিকভাবে অ-সুরক্ষিত। সুতরাং সাংস্কৃতিক মানদণ্ড থেকে যুক্তি-বিচার
আপাতদৃষ্টিতে দুই বিপরীত মেরুর মনে হলেও বাস্তবে ক্ষমতাবানদের পক্ষে পরিপূরক
হিসেবে প্রতীয়মান হয়। ধর্মীয় সংস্কৃতি ও পণ্য সংস্কৃতির ককটেলের কাছে এই যুক্তি
বিন্যাস অসার প্রতিভাত হয়। এই সংস্কৃতির অভ্যন্তরে ‘আমি ও আমরার’ যে স্তরীভূর
চেতনা লালিত হয় তা অন্যের প্রতি ঘৃণা-অবজ্ঞা-অসংবেদনশীলতাকেই বহন করে। এই অন্য হতে
পারে পরিবার, গোষ্ঠী, জাতি, অঞ্চল ইত্যাদি বিভিন্ন পরিচিতির অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু
আমরা যদি বাস্তব পরিস্থিতিকে ‘ইতিহাসের যুক্তির’ দিক থেকে বিচার করি তাহলে আমাদের
সম্বিত ফিরে আসে, আমাদের কর্তব্য আমরা নিরূপণ করতে পারি।
ইতিহাসের যুক্তি
ইতিহাসের যুক্তির মূল কথাটা হচ্ছে যে বর্তমানকে অতীতের ধারাবাহিকতায়
বিচার করা ও ভবিষ্যত সম্পর্কে পূর্বানুমান করা। যে সাধারণ উদাহরণের এখানে উল্লেখ
করা হয়েছে, তাতে এই যুক্তির একটা স্থূল প্রয়োগ করে দেখা যেতে পারে। সত্তরের দশক
পর্যন্ত শিলচর শহরের সামাজিকতার গণ্ডি ছিল পূজা-পার্বণ ও সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান
ছাড়াও একে অপরের বাড়িতে রুটিন করে বেড়াতে যাওয়া। তখনকার সময়ে শিলচরবাসীদের জীবন ও
কর্মে এতো বৈচিত্র ছিল না, সামাজিকতা মূলত জ্ঞাতি-গোষ্ঠী ও পাড়াকেন্দ্রিক হলেও
অনুভূতির কোঠায় দূরত্বটা খুব প্রকট ছিল না, সামাজিকতার জন্য প্রয়োজনীয় অবসর সময়
ছিল অফুরন্ত। আশির দশক থেকে শিলচর শহরের সামাজিক গাঁথনির দ্রুত পরিবর্তন হতে থাকে,
সেই পরিবর্তন কোনো গুণগত পরিবর্তনকে সূচিত করে কীনা তা ভিন্ন প্রশ্ন। গ্রাম ও
শহরের বাইরে থেকে অনেক লোক এখানে বসত গড়ে তুলছে, একদিকে ঘেঁটো ও অন্যদিকে ফ্ল্যাট
সংস্কৃতি পাড়া-সংস্কৃতির বাঁধনকে প্রায় ছিঁড়ে ফেলছে। শ্রমের বিস্তৃত বিভাজন
সামাজিক বিভাজনের কাঠামোয় উলম্ব ও অনুভূমিক পরিবর্তন সাধিত করছে। সামাজিকভাবে যারা
ছিলেন বাকরহিত তারাই বাঙ্ময় হয়ে উঠছেন। এগুলি শুভ লক্ষণ। কিন্তু এই পরিস্থিতি যে
সামাজিকতাকে প্রতিস্থাপিত করছে তার দিকনির্দেশ করা নিয়েই আমাদের ভাবতে হবে।
সত্তরের দশকে উপরে উল্লিখিত সামাজিকতার ধারা ছাড়াও একটা ক্ষীণ প্রাণবন্ত ধারাও
বিদ্যমান ছিল। এই ধারাটি যত না এখানকার স্থানীয়ভাবে প্রাপ্ত তার চাইতে বেশি
বৃহত্তর বাঙালি সমাজের উজ্জ্বল ভূমিকা থেকে প্রাপ্ত। সেটা হচ্ছে এক নতুন
সাংস্কৃতিক চর্চা থেকে উদ্ভূত সামাজিকতা যে চর্চার মূল নিহিত উদ্বাস্তুদের জীবন
সংগ্রাম - খাদ্য আন্দোলন- উপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে আন্দোলন - নক্সালবাড়ির কৃষক
বিদ্রোহ ইত্যাদিতে, যে চর্চা স্থান-কালের সীমাবদ্ধ গণ্ডি পেরিয়ে মানব সভ্যতার জন্য
ভিয়েতনামে উপনিবেশিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধেও আওয়াজ তুলতে পারত, যে চর্চা ভারতের যে
কোন প্রান্তের মানুষের দুর্যোগে শিলচরের রাজপথে রিলিফ সংগ্রহে অনুপ্রাণিত করত।
আমার ধারণা, সেই চর্চাজনিত সামাজিকতার এখন মৃত্যু পরোয়ানা ঘোষিত হয়ে গেছে। কারণ
নিষ্ঠুর শাসন-শোষন ও চাতুর্যের ফলে যে ব্যাপক জনসমাজ ছিলেন বাকরহিত এদের বাঙময় হয়ে
ওঠার জন্য এই চর্চার বাহকরা যত্নবান ছিলেন না। শিক্ষিত মধ্যশ্রেণির উদ্বাস্তু
হিসেবে যে জীবন সংগ্রাম তাদেরকে প্রাণবন্ত করে তুলে ছিল, সুরক্ষিত জীবনের
স্থিতাবস্থায় সেই উদ্বাস্তু মানসিকতাই তাদের জীবনের সৃষ্টিশীল মানসিকতার মৃত্যু
ডেকে আনল। কিন্তু জন্ম-মৃত্যু যেহতু অবিচ্ছেদ্য, তাই নতুন জন্মের জন্য আমাদের অনেক
কসরত করতে হবে এবং জন্মদাত্রীদের তৈরি হতে হবে গর্ভযন্ত্রণাকে আবাহন করার জন্য। পুরোনো
সামাজিকতা ভাঙছে সেটা ভাল, কারণ স্থিথাবস্থা কোনভাবেই কাম্য নয়। কিন্তু যা একে
প্রতিস্থাপিত করছে তা ধর্ম ও পণ্যের এক বাজার-সংস্কৃতি। এভাবে যদি চলতে থাকে তাহলে
শিলচরবাসীর ভবিষ্যত লুম্প্যেন কালচারে আবৃত এক অন্ধকারময় জগত ছাড়া আর কিছুই হবার
নয়। সুতরাং এভাবে যাতে না চলে তারজন্য আমাদের কী করিতে হইবে সেটাই বিচার্য।
বিচারটা করা যাক দেবালয় গড়ে ওঠার এই ক্ষুদ্র বিষয় নিয়েই, কিন্তু প্রেক্ষিতে রাখা
যাক জনগণের মত এক বৃহৎ পরিসরকে। জনগণের সামাজিক ভূমিকাকে যেহেতু নির্ধারণ করা যায়
ভারতীয় গণতন্ত্রের পরিসরে, তাই স্বাভাবিকভাবে উঠে আসবে ভারতীয় গণতন্ত্রে জনগণের
অবস্থানের প্রশ্ন।
ভারতীয় গণতন্ত্র
এটা সত্যি যে ভারতীয় গণতন্ত্র দারিদ্র্য ও বৈচিত্রের মধ্যেও টিঁকে
আছে। জনপ্রতি ২০০০ ডলার বাৎসরিক আয় হওয়ার পর পশ্চিমী দেশে সর্বজনীন ভোটাধিকার চালু
হয়, যেখানে ভারতে স্বাধীনতা-উত্তর পর্যায়ে মাত্র ২০০-২৫০ ডলার জনপ্রতি আয়ের সময়েই
প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। খ্রিষ্টপূর্ব ছ’শ শতিকায় বৌদ্ধদের তথাকথিত
গণ-কাউন্সিল, যেখানে জনগণ যুক্তি-তর্ক
করতে পারত, সেটাকে স্মরণে রাখলে ভারতীয় গণতন্ত্রের টিঁকে থাকার রহস্য খানিকটা বোঝা
যায়। সম্রাট অশোক ও আকবর এধরনের গণতন্ত্রকে চালু করার চেষ্টা করেছেন যেখানে সাধারণ
মানুষ যুক্তি-তর্কে অংশগ্রহন করতে পারত। ভীমরাও আম্বেদকর একে শুধু গ্রহণই করেননি,
গণতন্ত্রকে তিনি জীবনের যৌথ যাপন হিসেবে দেখেছেন। আমাদের শিলচর শহরে অতি সম্প্রতি গণসুর
নাট্যগোষ্ঠীর উদ্যোগে গোপীনাথ হলের সম্মুখে যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল তাতে অতীতের
ঐ প্রতিচ্ছবি দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু ঐ প্রক্রিয়া ছিল ত্রুটিপূর্ণ। গণ-বিতর্কে
সুন্দর বাচনভঙ্গি, সুনির্দিষ্ট যুক্তি-কাঠামো, আকর্ষণীয় উপস্থাপনাকে প্রাধান্য
দিলে গণ-অংশগ্রহণ সম্ভব হয় না। এটা জনগণকে মোহিত করে ও আরেকধরনের মায়াজাল তৈরি
করে। আমাদের আসল উদ্দেশ্য যদি হয় গণ-মানসকে বোঝা, তাহলে গণ-বিতর্ককে এমনভাবে
পরিচালিত করা উচিত যাতে সাধারণ নাগরিকও অংশগ্রহণ করতে পারে এবং আমরা আমাদের জানার
পরিধিকে তাদের কথন থেকে বিস্তৃত করতে পারি ও করণীয় নির্ধারণ করতে পারি। এব্যাপারে
জ্যাঁ ড্রেজ ও অমর্ত্য সেন তাঁদের ‘এন আন-সার্টেন গ্লোরি’ গ্রন্থে বিস্তারিত
লিখেছেন। গণতন্ত্র আমাদের এই নতুন সংস্কৃতি চর্চার রসদ জোগানোকে নিশ্চিত করতে পারে
এবং পাড়ায় পাড়ায় দেবালয়ের বদলে কম্যুনিটি হল গড়ে তোলার জন্য আমাদের আগ্রহান্বিত
করে তুলতে পারে, যেখানে দল-মত-ধর্ম নির্বিশেষে সবাই সাংস্কৃতিক ও সামাজিক
গণ-বিতর্কে অংশগ্রহণ করতে পারে। এই প্রক্রিয়া নিশ্চিতভাবে গণতন্ত্র ও সুস্থ
সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডকে প্রসারিত করবে। কিন্তু এভাবে গণতন্ত্র ক্রমাগত প্রসারিত
হয়ে এগিয়ে যাওয়ার সম্ভাব্যতা নিয়ে অমর্ত্য সেনদের সাথে অনেকেরই দ্বিমত রয়েছে। আমার
মত মার্কসবাদে বিশ্বাসী অনেকেই মনে করেন যে সামাজিক অসাম্য ও অনৈক্য দূর করতে
ভারতীয় গণতন্ত্র কার্যকরী হয়ে ওঠার জন্য এক বৈপ্লবিক উল্লম্ফন প্রয়োজন। সেটা
শুধুমাত্র একটি বিশ্বাস নয়, একটি যুক্তিনির্ভর বিশ্বাস এবং তাই এভাবে বিশ্বাসের
আঙিনায় যুক্তির অনুপ্রবেশে কারুর শংকিত হওয়ার সুযোগ নেই।