হতাশা
ও আশার দ্বন্দ্ব – কল্পনা ও বাস্তবের রসায়ন
এই লেখাটি দৈনিক যুগশঙ্খের ২৭ নভেম্বর, ২০১৩ সংখ্যায় বেরিয়েছে
বাস্তব
ও ভ্রম
আমাদের চোখের সামনে বা চোখের আড়ালে যা ঘটে তার
একটা ব্যাখ্যা আমরা সচরাচর খোঁজার চেষ্টা করি। কেন খুঁজি? কারণ ঘটনাটি যদি শুভ হয়,
তাহলে এটা যাতে নতুন পরিস্থিতিতে – নতুন আঙিকে আবার ঘটে, আর যদি অশুভ হয় তাহলে
এটার পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে, একে সুনিশ্চিত করার প্রয়োজনে কী বন্দোবস্ত করা যায়
এর অনুসন্ধানেই আমরা ব্যাখ্যা খুঁজি। মানুষ হয়ে ওঠার এটা হচ্ছে এক স্বাভাবিক
প্রবৃত্তি। এই ব্যাখ্যা খুঁজতে গিয়ে জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য একমাত্রিক
কোন বস্তু বা ঘটনার সাথে মিল বা সাযুজ্য দেখানোর কিছু প্রচলিত পদ্ধতির আশ্রয়
সাধারণত নেওয়া হয়। এতে একই বাস্তবতার ভিন্ন ভিন্ন দিক ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষিতে আমাদের
কাছে ধরা দেয় এবং তাকেই আমরা আসল বাস্তব বলে ভ্রম করে থাকি। এই ভ্রমই সাধারণকে
পরিচালিত করে বলেই সমাজ পরিবর্তনে বাস্তবকে বোঝার ক্ষেত্রে বৌদ্ধিক চর্চার
গুরুত্ত্ব অপরিসীম। তাহলে প্রশ্ন দাঁড়ায়, আমি যাকে বাস্তব বলে জানলাম তা যদি ভ্রম
হয় তাহলে বাস্তবটা আসলে কী? বাস্তব আসলে এই সব ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষিতে দেখা বিভিন্ন
দিকের এক আন্তঃসম্পর্ক যাকে ইতিহাসের গর্ভে রেখে দেখতে হয়। এই জটিল কাজ ও সামগ্রীক
দৃষ্টিভঙ্গির অভাবজনিত সাম্প্রতিক কিছু সমস্যা নিয়ে আলোচনা করার উদ্দেশ্যেই এই
নিবন্ধ। বাস্তবকে এভাবে দেখা পদার্থবিদ্যার অনিশ্চয়তার সূত্রকেও মান্যতা দেয়, যে
সূত্র মতে বাস্তবের অতি-নির্ধারণ (over-determination) সম্ভব নয়।
বাস্তবতা ও হতাশা
সামাজিক বিষয় নিয়ে আলোচনার উদ্দেশ্যে সাহিত্যের
ভাষার ছোঁয়া থাকা কিছু বাক্যবিন্যাসের আশ্রয় নেওয়া সম্ভবত বেমানান হবে না, যদিও
ডিকেন্সীয় ক্ষমতা দিয়ে রচিত বাক্যবিব্যাস একে আরও সুখপাঠ্য করে তুলত। আর্থ-সামাজিক
বিষয়ের উপর নিবন্ধে সাহিত্যের বয়ান ব্যবহার করা যেহেতু সাধারণত পরিহার্য, তাই একে
কোটেশনের মধ্যে রাখা হয়েছে। বয়ানটা এরকম - “চ’ এগিয়ে যাই, জন্ম থেকে
মৃত্যুর দিকে। আকাশে কালো ধোঁয়া, ফুসফুসে ফুটো। চারিদিকে প্রাসাদ, ভেতরে পিঁপড়ের
সারি টেনে তুলছে এখান ওখান থেকে সামগ্রী, তারপর সারিবদ্ধ বহির্গমন। বাতাসের শহরে
প্রবেশ নিসিদ্ধ, সারিবদ্ধ ছাদ দিয়ে আটকে দেওয়া হয়েছে। চ’ এগিয়ে যাই, চারচাকায় চড়ে
বাতানুকূল বদ্ধ খোপে অদৃশ্য হয়ে। নিজেকে অদৃশ্য করার সাথে সাথে অদৃশ্য হয়ে যায়
সারিবদ্ধ ঝুপড়ির অভ্যন্তরে বাদামি আলোয় ব্যস্তসমস্ত রমণী, দাওয়ায় ন্যাংটো শিশুটির
ফ্যাকাশে চোখের তলায়, কালো ঢোল উদরের আবরণে চিকচিক করা রোদের কিরণ। চ’ এগিয়ে যাই,
কারণ এই অদৃশ্য যখন দৃশ্য হবে, তখন কংক্রিটের ছাদ আটকে দেবে সূর্যের কিরণ। কুছ
পরোয়া নেই, চ’ এগিয়ে যাই, কারণ ওই রমণী ও তাঁর শিশুরা অন্য কোথাও গিয়ে পরিবেশ
নোংরা করার দায়ে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে অদৃশ্য হয়ে যাবে। আমার সন্ততিরা তো যাবে
দিল্লি বা বাঙ্গালোরে, আমি ফ্ল্যাট কিনব কোলকাতায় বা অন্যত্র সুরক্ষিত জায়গায়।
কিন্তু ছোট ছোট শহরে দেবিমূর্তির পেছনে আমরা যখন ধর্মে মাতোয়ারা হয়ে নেচে নেচে
এগিয়ে চলেছি, তখন মেট্রো শহরে আমার সন্ততিরা বিপন্ন। এই অদৃশ্য হয়ে যাওয়া লোকেদের
ঘাঁটিগুলোতেই আমার সন্ততির বিপন্নতার রসদগুলো তৈরি হচ্ছে। তাই এই রসদগুলিকে দাও
ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে, আর এই ঘাঁটিগুলিকে দাও বুলডোজার দিয়ে গুড়িয়ে। চ’ এভাবেই এগিয়ে
যাই প্রযুক্তির উন্নয়নের সোপানে, উন্নয়ন মানে ধার করে কেনা উন্নত প্রযুক্তির যান
যা সাফ করবে আমাদের ছোট শহরের পুঁতিগন্ধময় নর্দমা, বড় বড় হাঁ মেলে ফুটপাত আর
পথচারীদের অত্যাচার সহ্য না করার কথা ঘোষণা করে দেবে, এ কাজ থেকে রেহাই নিয়ে
সাফাইকারীরা ঘুপচিগুলিতে আশ্রয় নিয়ে গড়ে তুলবে বিপন্নতার রসদ তৈরির নতুন ঘাঁটি। এক
ঘাঁটি গুড়িয়ে দিলে গড়ে ওঠে নতুন ঘাঁটি, ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে দিলে সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে
পড়ে নতুন রসদ। না কিছুই হবার নয়, আমরা হতাশ। ডিম লাইটের স্নিগ্ধ আলোয় আমি একা
রাতের প্রহর গুনি। সামাজিকতা আটকে যায় বিবাহযোগ্য সন্তানের স্বজাতির সঙ্গী-খোঁজা সংবাদপত্রের
পাতায়, ধর্মীয় মিছিলের উন্মাদনায় শহরের রাস্তায়। আমি হতাশ এই বিপন্ন সময়ের
বিপন্নতায়”।
প্রব্রজন ও শহরের
জনবিন্যাসে পরিবর্তন
সম্প্রতি মুম্বাই নগরির ধারাভিতে জলের
পাইপলাইনের পাশের ২৪৪টি ঝুপরি বুলডোজার দিয়ে গুড়িয়ে দেওয়া হল। এই অভিযান আরও চলবে।
১৯৯৫-এর আগে সেখানে বাস করার নথি থাকা ১২৫টি পরিবারকে পুনর্বাসন দেওয়া হয়েছে,
বাকীদের মাথাগোঁজার ঠাই করে দেওয়ার দায় কারুর নেই, অথচ এরাও ভারতীয় নাগরিক। দিল্লিতে
ধর্ষনকারীদের ফাঁসির দাবিতে রাজপথ মুখরিত হচ্ছে, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি জন্য
ঝুপরিবাসীদের অস্তিত্বকে দায়ী করে মধ্যবিত্ত মন তার ধ্বংস কামনা করছে। কিন্তু
এধরনের কোনো পদক্ষেপই যখন আমাদের বিপন্ন সময়ের বিপন্ন মানসকে রেহাই দেয় না, তখন
আমাদেরকে করে তুলে হতাশ। এই হতাশা জন্ম দেয় আরও নতুন নতুন সামাজিক ব্যাধির। নিজের চোখে
ধরা দেওয়া ঘটনাপ্রবাহ মধ্যবিত্ত অনুভুতির সাথে মিলে তৈরি করে এক মধিবিত্ত বাস্তবতা
যার আঁচ পাওয়া যায় উপরের বর্ণণায়। কিন্তু এটাই কী সব – না বাস্তব তার চেয়ে কিছু
বেশি। শুষ্ক পরিসংখ্যানের আড়ালে সামাজিক বাস্তবতায় উঁকি মেরে দেখা যাক।
সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে ছোট
শহরগুলিতে ধর্ম-বিশ্বাসজনিত উন্মাদনা বৃদ্ধি পেয়েছে। এটা আসলে পথ-হারানো হতাশ
মধ্যবিত্তের সামাজিক হয়ে উঠার এক ব্যাধি। ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভের ৫৫ তম ও ৬৬ তম
রাউণ্ডের সমীক্ষার তুলনা করলে দেখা যায় যে শহরের জনসংখ্যার হার ২৫.৪% থেকে বেড়ে
দাঁড়িয়েছে ২৭.০%। এই বৃদ্ধির হার আরও বেশি দেখাত যদি নতুন সেন্সাস টাউনগুলি সমীক্ষায়
অন্তর্ভুক্ত করা হত। শহরের কলেবর যে দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে তা আঁচ করা যায় এটিএম
সংখ্যা বৃদ্ধি ও এর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের লাইন থেকে। ১৯৪১-৫১ সালে ভারতের শহরের বৃদ্ধির হার ছিল ৩.৪৭%। এই হার এতো
বেশি হওয়ার কারণ ছিল দেশভাগের ফলে সীমান্তের দুই পারের গ্রামাঞ্চল থেকে শহরে
প্রব্রজন। পরবর্তীতে বৃদ্ধির হার কমে গেলেও সত্তরের দশকে এই বৃদ্ধির হার ছিল সবচাইতে
বেশি, ৩.৯০%। নব্বইয়ের দশকে গ্রাম থেকে শহরে প্রব্রজন কমে যাওয়ার ফলে এই বৃদ্ধি আবার
কমে গিয়ে দাঁড়ায় ২.৭২ শতাংশে। ২০০১-১১ সালে এই বৃদ্ধি ছিল ২.৭৬ শতাংশ। সমীক্ষায়
দেখা গেছে নব্বই ও তার পরবর্তী পর্যায়ে এক শহর থেকে আরেক শহরে প্রব্রজন গ্রাম থেকে
শহরে প্রব্রজন থেকে বেশি। গ্রাম থেকে শহরে কিংবা ছোট শহর থেকে বড় শহরে
প্রব্রজিতদের অধিকাংশই চাকুরি, ব্যবসা, শিক্ষা ও দক্ষ শ্রমিকের কাজের সন্ধানকারী।
দিল্লি-হরিয়ানা, দিল্লি-উত্তরপ্রদেশের নতুন শিল্প-এলাকায় যে শ্রমিক আন্দোলন এখন
গড়ে উঠছে তা নতুন প্রব্রজিত দক্ষ শ্রমিকের এই বিশাল বাহিনী। ভারতের বিভিন্ন শহর
থেকে মেট্রো সিটিতে যাওয়া বাকীরা যুক্ত হচ্ছে মূলত সার্ভিস সেক্টরের সাথে। ছোট
শহরগুলতেও মূলত ব্যবসা, চাকুরি ও সন্তানের শিক্ষার জন্য গ্রাম থেকে উঠে এসে শহরে
বসত গড়ে তুলছে। কোনো কোনো অঞ্চলে যেখানে কৃষির সম্পূর্ণ বিপর্যয় ঘটে গেছে সেখানে
গরিব মানুষের কাজের সন্ধানে শহরে যাওয়ার প্রবণতা থাকলেও, সাধারণভাবে গ্রামীণ গরিব
মানুষ ও অদক্ষ শ্রমিকদের জন্য কাজের সুযোগ তেমন নেই এবং মাথাগোঁজার জন্য প্রয়োজনীয়
জমির সংকুলানও নেই। পতিত বা খোলা জায়গায় যে সব হাউসিং কম্পলেক্স গড়ে উঠছে তা তাদের
নাগালের বাইরে, এগুলো গড়ে উঠছে নব্য-মধ্যবিত্তদের জন্য। বরঞ্চ পুরোনো ঝুপরিবাসীদের
মধ্যে যারা নতুন প্রযুক্তির সাথে যুক্ত হওয়ার মত দক্ষতা অর্জন করতে পারেনি, তারাই
ল্যুম্পেন-প্রলেতারিয়েত হয়ে কোনমতে বাঁচার সংগ্রাম করছে। মুম্বাইর ধারাভিতে যারা
উচ্ছেদ হয়েছে তারা এরকমই এক জন-সমুদায়। ধারাভি এলাকা ৫৫৭ একর জমিতে ৩ লক্ষ
বাসিন্দাদের এশিয়ার সর্ববৃহৎ স্লাম-এলাকা হিসেবে চিহ্নিত ছিল। কিন্তু এখন ধারাভি
থেকেও বৃহৎ আরও চারটি স্লাম-এলাকা রয়েছে। মহারাষ্ট্রের কৃষি বিপর্যয়, দেনার দায়ে
কৃষকের আত্মহত্যা, সুদখোর মহাজনি পুঁজির দৌরাত্মের ফলে ক্যাশ-ক্রপ এলাকাতেও
সামন্তীয় সম্পর্কের দিকে পিছু হঠা ইত্যাদি ঝুপরি এলাকা বৃদ্ধির কারক। এই
প্যারামিটারগুলো আরেকটি সত্যকেও দেখায় যে আমাদের মত বিদেশি বহুজাতিক বেপারিদের উপর
নির্ভরশীল দেশে কৃষিতে পুঁজির অনুপ্রবেশ জমির মালিকানাভিত্তিক সামন্তীয় সামাজিক
সম্পর্ককে খানিকটা ভাঙলেও তা আবার সংকট মুহূর্তে উল্টোদিকে ঘুরে যেতে পারে এবং র্যান্টিয়ার-ফিনান্স
পুঁজি ও মার্কস বর্ণিত “অ্যাবসলুট গ্রাউন্ড রেন্টের” প্রাধান্য বলবৎ হতে পারে। সে
যাইহউক, এধরনের ব্যাতিক্রম বাদ দিলে ও উপরের পরিসংখ্যান ও প্রব্রজনের প্রবণতাকে
বিবেচনায় রাখলে, আমাদের গ্রামাঞ্চলে কারা পড়ে রইলেন? যারা পড়ে রইলেন তাদের সাধারণ
অবস্থার স্বরূপটা কী?
আমাদের দেখা বরাকের গ্রামাঞ্চল
বড় জমির মালিকরা তাদের রায়তদের কাছ থকে আর
খাজনা পান না। রেকর্ড অব রাইটস না থাকলেও রায়তরা নিজেরাই এখন বকলমে জমির মালিক। বড়
জমির মালিকদের পরিবার-পরিজনরা শহরে চলে এসেছেন। ঠিকাদার, ব্যবসায়ীরা ছাড়া চাকুরিজীবীদের
বড় অংশ শহরমুখীন, যারা এখনও শহরে আসেননি তারাও শহরে ফ্ল্যাটবাড়ি বা একফালি জমি
কিনে নেওয়ার চেষ্টায় আছেন। পুরোনো রায়তরা এখন জমির মালিক হলেও নিজের জমি নিজেই চাষ
করেন, কিন্তু তাতে পরিবারের ভরণ-পোষণ চালানো যায় না বলে চাষের মরশুম ছাড়া (বেশির
ভাগ জমি এক-ফসলি, কোথাও কোথাও দু-ফসলি) বাকি সময় তারা বিভিন্ন ধরনের মজুরি শ্রম
করেন। অর্থাৎ কৃষির ক্ষেত্রে তারা একই সাথে উৎপাদনের উপকরণের মালিক ছোট কিংবা
মাঝারি কৃষক এবং নিজের জমির শ্রমিক এবং বছরের অন্য সময় পুরোপুরি মজুরি-শ্রমিক।
বর্তমানে প্রায় সমস্ত ধানের কৃষি জমিতে ট্র্যাক্টর ব্যবহৃত হলেও জলসেচের অভাব ও
বৃহদাকারের কৃষি-ফার্ম না থাকায় ধানের মত কৃষি-উৎপাদ বাজারের বিনিময়ে আসে কম। অর্থনীতিবিদ
উৎসা পট্টনায়েক যেমন দেখিয়েছেন মাঝারি থেকে বৃহদাকারের কৃষিজমি থেকে ২০% থেকে ৬৩%
পর্যন্ত ফসল বাজারে আসে, সেটা বরাক উপত্যকার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, এখানে সরকারি
ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে ফসল কেনারও বিশেষ কোনো বন্দোবস্ত নেই। অর্থনীতিবিদ অমিত
ভাদুরি ফসল উৎপাদনের আগাম ধার দিয়ে ক্ষুদ্র চাষিদের বাজারের চাহিদা নির্ভর বিক্রয়
থেকে বিরত রাখার যে পদ্ধতির কথা বলেছেন সেটাও এখানে প্রযোজ্য নয়, কারণ এখানের বৃহৎ
জমি মালিকরা ফসলের বিনিময়ে চাষের জন্য আগাম ধার দিতে আগ্রহী নয়। বরাকের
গ্রামাঞ্চলে এখন নগদ অর্থমূল্যে ব্যক্তিগত মহাজনি সুদি-ব্যবসার সাথে সাথে চড়া
সুদের হারে মানি-মার্কেটিং সিস্টেমে ইনভেস্টাররা মুনাফার মাধ্যমে শ্রমের উদ্বৃত্ত শুষে
নেয়। বরাকের গ্রামাঞ্চলে এই ব্যাপক শ্রমিকরা বছরের বড় অংশ জুড়ে সরকারি-বেসরকারি
বিভিন্ন প্রকল্প, ক্ষুদ্র শিল্প,নানধরনের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির সাথে বিভিন্ন ধরনের
শ্রমিক হিসেবে যুক্ত। এক্ষেত্রে যেমন রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তি পুঁজির অনুপ্রবেশ রয়েছে,
ঠিক তেমনি রয়েছে বিশ্বব্যাঙ্ক – আইএমএফ ইত্যাদির মাধ্যমে বহুজাতিক পুঁজিরও
অনুপ্রবেশ। এই পুঁজির এক বড় অংশ পরিকাঠামোগত নির্মাণে বিনিয়োগ হচ্ছে। নব্বই
পরবর্তী কাঠামোগত পুর্গঠন প্রক্রিয়ায় শহর ও আধা-শহরগুলির যে কলেবর বৃদ্ধি হয়েছে
এবং সমাজের উপরতলার একাংশের আয় বৃদ্ধি হয়েছে তাতে সার্ভিসিং-রিপেয়ারিং-কনস্ট্রাকশন-ট্রান্সপোর্টেশন
ইত্যাদি ধরনের কাজও বৃদ্ধি হয়েছে। এই কাজগুলিতে মূলত শহর ও আধা-শহরের পার্শ্ববর্তী
কৃষি-অঞ্চলের বাসিন্দা ও শহরের পুরোনো ঝুপরিবাসীদের অনেকেই বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা ও
শ্রমের সাথে যুক্ত হয়েছে, ফলে শহরগুলির আয়তনও বৃদ্ধি পাচ্ছে। সব্জি-চাষ এঅঞ্চলের
ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকদের এক লাভদায়ক ফলন হলেও (চাহিদার তুলনায় ফলন কম হওয়া
লাভদায়ক হওয়ার একটি কারণ), যেহেতু এই চাষ নদির তীরবর্তী জমি ছাড়া অন্য কোথাও প্রায়
হয় না এবং এই চাষ শুধু শীতের দু-তিন মাসই হয়, তাই এই চাষের সাথে যুক্ত কৃষকের
সংখ্যা খুব কম। এধরনের আরও কিছু ফসল রয়েছে যেমন বড় মাপের জমিতে সুপারির চাষ, রাবার
চাষ ইত্যাদি, এছাড়া রয়েছে বিভিন্ন ধরনের কোয়ারি। বাংলাদেশের সাথে বরাকের সুপারির
ব্যবসা পুরোনো, সেদিক থেকে রাবার চাষ নতুন। এই চাষের জমির মালিকরা জমি লিজ দিলে
ভাড়া হিসেবে যে আয় তাদের হতে পারত তার পরিমাণকে জমিতে পুঁজি বিনিয়োগ থেকে মুনাফার সাথে যুক্ত করে দেখেন, অতিরিক্ত মুনাফা
শ্রমিকের উপর কম ব্যয় করে বা কম হাজিরা দিয়েই করতে চান। একই নিয়ম চা-বাগান মালিকদের
ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য যারা জমিতে লিজের মালিক হয়ে নতুন বিনিয়োগের মাধ্যমে জমির ও
শ্রমের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে মুনাফা বৃদ্ধির পদ্ধতির চেয়ে শ্রমিকের জন্য ব্যয়
কমিয়ে মুনাফা বৃদ্ধি করতে সচেষ্ট। উপরন্তু এই ধরনের সামগ্রীর ক্ষেত্রে একটা
সর্বভারতীয় বা আন্তর্জাতিক মার্কেটিং-চেইনের মধ্যে কাজ করতে হয় বলে স্থানীয়
বিনিয়োগকারীদের যথেষ্ট স্বাধীনতা থাকে না।
গ্রামাঞ্চলে যে নতুন শ্রমিকবাহিনীর জন্ম হয়েছে
তাদের একটা বড় অংশ একইসাথে জমির সাথে ও জাতি-বর্ণগত শ্রম-বিভাজনের নিয়মের সাথে যুক্ত।
তাঁরা জমি ও জাত-বর্ণের বন্ধন থেকে ছিন্ন হয়ে সম্পূর্ণ স্বাধীন শ্রমিকে রূপান্তরিত
হয়নি। কিন্তু তাঁরা অত্যন্ত কম মজুরিতে কাজ করে কোনমতে তাদের পরিবার নিয়ে বেঁচে
থাকার জীবন সংগ্রামে লিপ্ত। তাই তাদের কাছে মজুরি ও সামাজিক সুরক্ষার প্রশ্নগুলি
এক গুরুত্ত্বপূর্ণ প্রশ্ন। গ্রামাঞ্চলে সৃষ্ট হওয়া ভূমিহীন ও ভূমিমালিক এই বিশাল
শ্রমিকবাহিনীই নয়া-গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করার বস্তুগত ভিত্তি। এই শ্রমিকরা ও
নতুন শিল্পশ্রমিক ও সার্ভিস সেক্টরের শ্রমিকরা শ্রমশক্তির মূল্যের নিচে ও ওপরে
বিভিন্ন মাত্রার হাজিরা পায় এবং এর সাথে জাতি-বর্ণ ও জনগোষ্ঠীগত স্তরীভূত বিভাজনের
একটা সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু এই বিভাজনে যে অনেকখানি নমনীয়তা এসেছে তা
টের পাওয়া যায় যখন গ্রামাঞ্চলে সামাজিকভাবে আধিপত্যকারী জাতি-বর্ণের লোকদেরকেও
এনরেগার কাজে অংশগ্রহণ করতে দেখা যায়, যদিও সামাজিক সংযোগকে ব্যবহার করে কাজ না
করেও মজুরির একাংশ আদায় করে নেওয়ার প্রবণতা তাদের মধ্যেই বেশি। তথাপি এই শ্রমিকরাই
সমাজ-পরিবর্তনের বস্তুগত ভিত্তি এবং এই ভিত্তি যদি জাগ্রত হয় ও তার সাথে শ্রমিকশ্রেণির আদর্শ বহন করার শক্তি
দিল্লি-হরিয়ানা বা দিল্লি-উত্তরপ্রদেশের মত নতুন শিল্পাঞ্চলের নতুন শ্রমিকরা ও
সার্ভিস সেক্টরের নতুন শহরের শ্রমিকরা যদি জেগে ওঠে তাদের সাথে হাত মেলায়, তাহলে
যে আশার আলো দেখা দেবে তাতেই মধ্যবিত্তের হতাশার বাতাবরণ কাটবে ও তারা সৃষ্টিশীল
কাজে লিপ্ত হবে।
জাগরণের শর্ত ও দ্বন্দ্বের
মীমাংসা
বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র-নায়ক ও বহুজাতিক বৃহৎ
পুঁজিমালিকরা বর্তমান নিও-লিব্যারেল অর্থনীতির ও ব্যবস্থার সংকট থেকে পরিত্রাণের
কোনো পথই খুঁজে পাচ্ছেন না। একদিকে বিকাশ বজায় রাখা, অন্যদিকে ক্রমবর্ধমান
বেকারত্ব, দারিদ্র্য ও অসাম্যের মোকাবিলা করা – এ দুয়ের নাগপাশ থেকে বেরোনোর কোনো
প্রেসস্ক্রিপশন এই নিও-লিব্যারেল অর্থনীতিতে নেই। বরঞ্চ তাদের তথাকথিত বিশ্বায়নের
বিপরীতে একে অপরের বিরুদ্ধে প্রতিযোগী হিসেবে বিভিন্ন ধরনের আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক
মোর্চা গড়ে তুলছেন। ব্রাজিল-রাশিয়া-ভারত-চীন ইত্যাদি ব্রিক (BRIC ) দেশগুলি সামরিক ও
আর্থিক ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য একত্রিত হয়েছে। এধরনের বিভিন্ন মেরুকরণ আন্তর্জাতিক
স্তরে ক্রমাগত ক্ষমতার কেন্দ্রীয় বিন্যাসকে পরিবর্তিত করছে। অভ্যন্তরিণ ক্ষেত্রে
রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গের গ্রহণযোগ্যতা তলানিতে এসে ঠেকছে। বিশ্ব তথা দেশের
শ্রমিকরা কি এই পরিস্থিতির সদ্ব্যবহারে জেগে উঠবে না? উত্তর সম্ভবত ইতিবাচক।
নবজাগরণের এই সম্ভাবনাকে বাস্তবায়িত করতে বৌদ্ধিক ও প্রায়োগিক ক্ষেত্রে নতুন
বামপন্থী চিন্তাধারার অনুপ্রবেশ জরুরি। নতুন বাস্তবতায় নতুন চিন্তা ও কাজ হতাশার
বিপরীতে বাস্তবের আশার দিকটিকে উজ্জ্বল করে তুলতে পারে ও সমাজের অভ্যন্তরে নতুন
প্রাণের সঞ্চার করতে পারে। কল্পনা ও বাস্তবের রসায়নের মধ্যেই আশা ও হতাশার
দ্বন্দ্বের মীমাংসা লুকিয়ে আছে।