Arunodoy : January-February 2014

Posted by স্বাভিমান













সামাজিক আন্দোলনের সমস্যা ও বিকল্প ভাবনা

Posted by স্বাভিমান Labels: , ,

।।অরূপ বৈশ্য।।

বামপন্থী দুর্বলতা
         
বামপন্থী পরিচয়ে এখন আর কেউ গর্ববোধ করেন না। উল্টোদিক দিক থেকে বলা যায় যে সচেতন নাগরিক এখন আর বামপন্থীদের মেহনতি মানুষের বন্ধু হিসেবে ভাবেন না। এটা একধরণের নেতির নেতি (Negation of negation)। কেন এমনটা হলো? এই প্রশ্নের উত্তর বেশ জটিল এবং এর উত্তর-সন্ধান এই নিবন্ধের বিষয়বস্তুও নয়। তথাপি এনিয়ে দুটি সামান্য কথা বলে নেওয়া ভাল। পরষ্পর সম্পৃক্ত দুটি কথার একটি বিষয়গত, অন্যটি বিষয়ীগত। ১৮৯১ থকে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী শ্রমিক সংগঠন ধীরে ধীরে বিকশিত হয়ে বিশাল রূপ ধারণ করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা থেকে সামাজিক বিপ্লবের যুগ শুরু হয় ও লেনিনীয় সূত্রায়ন মেনে রুশ বিপ্লব সংঘটিত হয়। এই ঘটনাপ্রবাহ যে বামপন্থী আবেগের জন্ম দিয়েছিল তা আশির দশক থেকে ম্রিয়মাণ হতে শুরু করে। পুঁজির বিশ্বায়নের যে নতুন নিয়ম আশির দশক থেকে শুরু হয়েছে একে অনুধাবন করতে করতেই বামপন্থীদের বহু সময় অতিক্রান্ত হয়ে যায় এবং ফলে নতুন পরিস্থিতিতে রণকৌশল নির্মাণে ব্যার্থ হয়। অন্যদিকে ষাট-সত্তর দশকে যে আমাদের দেশে সামাজিক আন্দোলগুলো বিকশিত হয় তাকে চালু ব্যবস্থা যেমনি আত্মস্থ করে নেয়, ঠিক তেমনি বামপন্থীরাও একে রাষ্ট্র ও দলের মধ্যে আত্মস্থ করে সামাজ পরিবর্তনের আন্দোলনে রূপান্তরিত হওয়ার প্রাণশক্তি কেড়ে নেয়।

এক যাত্রায় ভিন্ন ফল

22nd March, 2014, Jugasankha
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ঘোষণার পর থেকে পূবের বিভিন্ন দেশে সামাজিক আন্দোলনগুলি সমাজ-বিপ্লবে রূপান্তরিত হয়েছে। এই পর্যায় প্রথমে রাশিয়া থেকে শুরু হয়ে সর্বশেষ ১৯৭৫ সালে ভিয়েতনামের বিজয় দিয়ে শেষ হয়। সামাজিক আন্দোলনের প্রেক্ষিত ১৮৯১ থেকে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত লাগাতার কাজের মধ্য দিয়ে বিশ্বব্যাপী শ্রমিকশ্রেণির বিশাল সংগঠন এবং পূবের দেশগুলিতে ব্যাপক কৃষক আন্দোলন গড়ে উঠার মধ্য দিয়ে তৈরি হয়। এই দুই সামাজিক শ্রেণির ঐক্যের প্রশ্ন ও সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বযুদ্ধের পরিস্থিতিকে সামনে রেখেই উপরুক্ত      সমাজ-বিপ্লবগুলি সংঠিত হয়। ভারতবর্ষেও এই পর্যায়ে চৌরিচেরা, তেভাগা, তেলেঙ্গানার মত কৃষক বিদ্রোহগুলি সংগঠিত হয়, কিন্তু উপনিবেশ-বিরোধী আন্দোলন কোনো সমাজ-বিপ্লব সংগঠিত করতে ব্যার্থ হয়। এই ব্যার্থতার পেছনে বহুবিধ কারণের মধ্যে কয়েকটি মৌলিক কারণকে চিহ্নিত করা যায়। দুই শত বছর ধরে ব্রিটিশদের গড়ে তোলা এক ব্যাপক নিপীড়ক রাষ্ট্রের উপস্থিতি, শ্রমিকশ্রেণির বদলে ইংরেজি শিক্ষিত শ্রেণির হাতে জাতীয় আন্দোলনের নেতৃত্ব চলে যাওয়া যে নেতৃত্ব সমাজ-বিপ্লব ছাড়াই দেশের ক্ষমতা নিজের হাতে নিতে বেশি আগ্রহী ছিলেন, কৃষক আন্দোলনগুলির অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভারতীয় জাতি-বর্ণ ব্যাবস্থায় নির্ধারিত সীমানা অতিক্রম করতে ব্যার্থ হওয়া ও শিক্ষিত-শ্রেণির বর্ণবাদী মানসিকতার বিশেষ কোন পরিবর্তন না হওয়া। যে সামগ্রিক পরিস্থিতিতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সমাজ-বিপ্লবগুলি সংগঠিত হয়েছিল সেই পরিস্থিতির ও সামাজিক আন্দোলনগুলির এখন বহু পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। এই পরিবর্তনের স্বরূপ সঠিকভাবে হৃদয়ঙ্গম করার ক্ষেত্রে মাত্রাতিরিক্ত বিলম্বের ফলে অতীত সমাজ-বিপ্লবের সুফলগুলিও একে একে মুখ থুবড়ে পড়েছে। পরাজয় থেকে শিক্ষা নেওয়ার প্রচেষ্টাকে ছাড়িয়ে গেছে পরাজয়ের গ্লানিতে সমাজ-বিপ্লবের প্রবক্তাদের মুখ লুকোনোর প্রচেষ্টা। কিন্তু নতুন পরিস্থিতিতে নতুন রূপের সামাজিক আন্দোলনগুলি আবারও নতুন করে ভাবার জন্য আহ্বান জানাচ্ছে মুখ লুকিয়ে থাকা পরাজিত এই সমাজ-বিপ্লবীদের।

নতুন পরিস্থিতির স্বরূপ

                উপনিবেশিক শাসনে ভারতীয় শিল্পোদ্যোগগুলিকে ধ্বংস করা হয়েছিল। আমাদের বস্ত্রশিল্পকে শুধুমাত্র বাণিজ্যনীতির বাধা তৈরি করেই ধ্বংস করা হলো না, উৎপাদনের সাথে তাঁতশিল্পের শ্রমিকদের আঙুল কেটে ফেলারও নজির সৃষ্টি করেছিল বৃটিশ প্রশাসন। কৃষির উদ্বৃত্ত থেকে যে কৃষক-উদ্যোগপতি গড়ে উঠছিল তার বুনিয়াদটা ভেঙে দেওয়াই ভারতীয় সম্পদ লুণ্ঠনের জন্য উপনিবেশিক শাসনের মূল চাবিকাঠি ছিল। স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে মিশ্র-অর্থনীতির মাধ্যমে পরিকল্পনা খাতে সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি করে পরিকাঠামো নির্মাণ ও শিল্পপণ্যের আমদানি কমিয়ে আনার জন্য ব্যক্তিগত খণ্ডে শিল্পায়নের উপর গুরুত্ত্ব আরোপ করা হল, কিন্তু এরজন্য আমদানি করতে হল ভারি যন্ত্রপাতি। শিল্পায়নের জন্য সহজ সর্তে ঋণের ব্যবস্থা করা হলো। সরকারি ব্যয় করার জন্য আয়ের মূল উৎস হলো ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও আয়ের উপর প্রত্যক্ষ কর, ঋণের উপর সুদ ও ভোগ্যপণ্য বিক্রয়ের উপর পরোক্ষ কর। যেহেতু প্রত্যক্ষ কর ব্যাক্তিগত মুনাফার একটি অংশ এবং সেই মুনাফা তৈরি হয় শ্রমের উদ্বৃত্ত থেকে এবং পরোক্ষ কর তৈরি হয় উপভোক্তার ভোগের থেকে, সুতরাং সরকারি আয়ের মূল অংশই আসে শ্রমজীবী মানুষের থেকে। এই শ্রমজীবী মানুষই মোট জনসংখ্যার প্রায় আশি ভাগ এবং তারা গ্রামীণ কৃষি ব্যবস্থার সাথে যুক্ত। অথচ কৃষিনীতিই এই মিশ্র অর্থনীতির পর্যায়ে সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিত হয়ে রইল। ভূমিহীন, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষীদের জমি মালিকানা দেওয়ার ও আয় বৃদ্ধির জন্য কোন ভূমিনীতি গ্রহণ করা হল না। রান্না করা খাবারের উপর যদি পারিবারিক অর্থনীতি নির্ভরশীল হয়, তাহলে যেমনি রান্নাঘরের আর কোন অস্তিত্ত্ব থাকে না, ঠিক তেমনি কৃষি উন্নয়নের প্রশ্নটির যদি মীমাংসা হয় কৃষির বাইরের নীতি দিয়ে, তাহলে কৃষি উন্নয়ণ বিঘ্নিত হয়। ফলে গরিষ্ঠাংশ মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে যায়, কমে যায় ভোগ্যসামগ্রীর উপর ব্যয় এবং তারসাথে সরকারের পরোক্ষ কর আদায়ের পরিমাণও। সম্পদশালী মানুষের উপর প্রত্যক্ষ করের মাত্রা ও ব্যাপ্তি যেহেতু বাড়ানোর বদলে কমিয়ে আনা হয়, তাই টান পড়ে সরকারি আয়ের ভাঁড়ারে। আয়-ব্যায়ের হিসাবে ভারসাম্য বজায় রাখতে সরকারকে       দেশি-বিদেশি ব্যবসায়িক ব্যাংক থেকে ধার নিতে হয়, কিন্তু সুদ মেটাতে ব্যয়ও তার সাথে পাল্লা দিয়ে বৃদ্ধি ঘটে। সুতরাং এই ভারসাম্যের যাঁতাকল থেকে বেরিয় আসতে ব্যয় সংকোচনের নীতি ও সমস্ত কিছুকে বেসরকারীকরণের নীতি নেওয়া হয়। ১৯৯১ সালে ঘোষিত গৃহীত নতুন অর্থনীতি এই পরনির্ভরশীল অর্থনীতিরই পরিণতি, যেখানে কৃষির উদ্বৃত্ত থেকে শিল্পায়ন নয়, বিকাশের জন্য নির্ভর করা হয় ধার ও বিদেশি ব্যক্তিগত পুঁজির অনুপ্রবেশের উপর। এই ব্যক্তি পুঁজিই জন্ম দিচ্ছে অবাধ দুর্নীতির, বাণিজ্য ও সম্পদ লুণ্ঠনের জন্য অবাধ জমি দখলের জন্য উচ্ছেদ ও পরিবেশ ভারসাম্যহীনতার। ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিদের জমি মালিকানা দেওয়া ও সরকারি উদ্যোগে কৃষিতে জলসেচের ব্যবস্থা করার নীতি মাঝপথে বন্ধ করে দিতে হয়, সরকারি ব্যয় ও ঋণ সংকোচনের ফলে তারাই কৃষিতে লাভজনক বিনিয়োগ করতে সক্ষম হয় যাদের বৃহৎ জমি মালিকানা ও ট্রেক্টর-পাওয়ার টিলার-পাম্প সেট লাগানোর স্বচ্ছলতা আছে ও কৃষি ঋণ পাওয়ার যোগ্যতা আছে। বাকী গরিষ্ঠাংশ ভূমিহীন, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিরা হয়ে পড়ছে সস্তা দিনমজুর। গরিষ্ঠাংশ মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে যাওয়ার ফলে শিল্পজাত পণ্য উৎপাদন খাতে বিদেশি বিনিয়োগ কমে যাচ্ছে। বিনিয়োগ আসছে ফাটকা বাজারে, রপ্তানীযোগ্য পণ্য উৎপাদনের জন্য জমি মালিকানা নেওয়ার খাতে ও শহরের নাগরিকদের জন্য পরিষেবামূলক খাতে। নতুন টেকনলজির উপর নির্ভরশীল এই পরিষেবা খাতে বিনিয়োগ বিস্তৃতি ঘটাচ্ছে শহরের যেখানে জন্ম নিচ্ছে নতুন মধ্যশ্রেণির এবং যেখানে সস্তা কাজের খোঁজে চলে আসছে গ্রামীণ কৃষিজীবীরা। বছরের এক সামান্য সময় কৃষি কাজে গতর খাটিয়ে যারা দুবেলা খাওয়ার জোটায় তারাও বাকী সময় বিভিন্ন ক্ষেত্রে দিনমজুরের কাজের সন্ধান করতে বাধ্য হয়। যেসব পুরুষরা কাজের সন্ধানে অন্যত্র চলে যায় তাদের পরিবারের মহিলারা যৎসামান্য মজুরিতে কৃষি কাজে লিপ্ত হয়। গ্রামীণ কৃষি এরকম এক বিপর্যয়ের সম্মুখীন যেখানে কৃষকেরা প্রতিনিয়ত সস্তা শ্রমিকে রূপান্তরিত হচ্ছে। এই বিপর্যয় গোটা অর্থনীতির বিপর্যয় ডেকে আনছে এবং ফলে পরিষেবামূলক শিল্পে যুক্ত নতুন মধ্যশ্রেণিও এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগোচ্ছে। এই পরিস্থিতি জন্ম দিচ্ছে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক আন্দোলনের।

বরাকের আঞ্চলিক উন্নয়ণ ও সামাজিক আন্দোলন          
   

                    বরাকের আঞ্চলিক উন্নয়ণের প্রশ্ন উত্থাপন হলেই, বুদ্ধিজীবী মহল থেকে একই ভাঙা রেকর্ড বাজতে থাকে। সরকার আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করে আমাদের দেয়নি, উন্নয়ণমূলক প্রকল্প গড়ে তুলতে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ না করে বরাককে বঞ্চিত করা হচ্ছে ইত্যাদি। কিন্তু সরকারি উন্নয়ণ মডেলে বরাকের আসল অর্থনীতি যে ফোঁপরা হয়ে যাচ্ছে এদিকে কারুর নজর নেই। মেঘালয়ের কয়লা খনির ইদুঁর গর্তে ঢুকে যে শ্রমিকরা মারা যায়, ইস্ট-ওয়েস্ট করিডরে যারা সস্তায় কাজ নিতে পার্শ্ববর্তী রাজ্যে যায়, কাজের সন্ধানে অত্যন্ত অমানবীয় সর্তে যারা ভিন রাজ্যে পাড়ি দেয়, যারা ইট-বালি-পাথরের কঠোর কাজে কোন সামাজিক সুরক্ষা ছাড়াই যোগ দেয়, যাদের প্রতিদিন কাজের সন্ধানে ঘুরে বেড়াতে হয় তারা একদা বরাকের কৃষির প্রন্তিক, ক্ষুদ্র ও ভূমিহীন কৃষক। এদের সামাজিক পরিচিতিও একেবারেই স্পষ্ট – যারা যত বেশি কঠোর শ্রম ও যত কম মজুরি কাঠামোর সাথে যুক্ত তারা অবধারিতভাবে সামাজিক মর্যাদার সিঁড়িতে সবচাইতে নিচের দিকের সম্প্রদায়ভুক্ত। অথচ কৃষি আয়ের উদ্বৃত্ত দিয়েই ক্ষুদ্র শিল্প ও এর সাথে যুক্ত শ্রমিক এবং অভ্যন্তরিণ পরিকাঠামোর উন্নতি সাধন করা যেত। ক্যানেল ইরিগেশনের নামে কোটি কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে, কিন্তু সবগুলি আজ অচল। বেশিরভাগ কৃষি জমিই সেচের আওতার বাইরে। ভূমিবন্টন ও পাট্টা দেওয়ার বাগারম্বরই সার, প্রকৃত কৃষকদের জমির মালিকানা নেই - ভূমিহীনদের ভূমি দেওয়ার কোন বালাই নেই। এনরেগার কাজ, যার হাজিরা আগামী ১ এপ্রিল থেকে ১৬৭ টাকা হচ্ছে, সেই প্রকল্প রূপায়ণের ক্ষেত্রে দূরবস্থা প্রকল্প রূপায়ণকারীদের সদিচ্ছাকেই প্রশ্ন চিহ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। শিক্ষিত মধ্যশ্রেণির এক বিভৎস চেহারা বরাকের আমজনতা তাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রত্যক্ষ করছেন, যে শ্রেণি নিজের সমাজের ও অঞ্চলের উন্নয়ণের কথাও ভুলে যায়। সেই আত্মবিস্মৃত ও আত্নসম্মানবোধহীন শ্রেণি যাদের লোভাতুর চোখ গৃহস্থের ভাঁড়ারে, আর নতজানু হয়ে করতল উপরতলার চরণতলে। এই শ্রেণিরই প্রতিবিম্ব আমরা দেখতে পাই সেই বৌদ্ধিক মহলে যারা ভাষা ও আঞ্চলিক প্রেমে গদগদ, শহিদের স্মৃতিতে চক্ষু সদা ভারাক্রান্ত, অথচ বরাকের প্রকৃত উন্নয়ণে প্রাতিষ্ঠানিক বুদ্ধিকে কাজে লাগাতে ও জনমানসে আত্মসম্মানবোধ জাগ্রত করতে চূড়ান্ত অনীহা। আসলে যে মধ্যশ্রেণিটি জীবনীশক্তিহীন, আত্মসম্মানবোধ হারিয়ে ফেলেছে, দেশপ্রেমকে মানুষের জন্য প্রেম নয় ধর্মীয় ও সংকীর্ণ স্বার্থের প্রেমের গণ্ডিতে আবদ্ধ করে ফেলেছে তাদের মেকী বাগাড়ম্বর বরাকের বিভিন্নধরনের সামাজিক আন্দোলনে প্রাণশক্তি সঞ্চার করতে অপারগ। গ্রামীণ ও অসংগঠিত শ্রমিকদের সংগঠিত করে এবং এই শক্তির উপর ভিত্তি করে বরাকের আন্দোলনে নতুন দিশা ও প্রাণসঞ্চার করা সম্ভব। আর সেজন্য প্রয়োজন বাস্তবকে বোঝার এক কঠোর বৌদ্ধিক ও সাংগঠনিক চর্চা। এটাই আজকের সময়ের বামপন্থা।

সামাজিক আন্দোলনের সমস্যা ও সমাধান
            
        
বিগত বছরগুলিতে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দিকে দিকে সামাজিক আন্দোলন সংগঠিত হচ্ছে। কাজের অধিকার, শিক্ষার অধিকার, তথ্য জানার অধিকার, মানবাধিকার, ভাষার অধিকার, জাতি-বর্ণগত অধিকার, জমির অধিকার, পরিবেশ সুরক্ষা, মহিলাদের ক্ষমতায়ন, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং সর্বশেষ দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিভিন্ন মাত্রার ও বিভিন্ন পরিসরের আন্দোলন পরিচালিত হয়ে আসছে। কিন্তু জনমতের চাপে খানিকটা পিছু হটে সার্বিকভাবে উদার অর্থনীতি বা সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের নীতির মধ্যেই এগুলিকে আত্মস্থ করে ফেলা হচ্ছে। দুর্নীতি বিরোধী আম-আদমির উত্থানও যে বিশ্বায়নের নীতির গণ্ডি অতিক্রম করে এগোবে না তার ঘোষণা আগাম দিয়ে রেখেছে এবং এটাই অবশ্যম্ভাবী ছিল। কারণ আধুনিক শ্রমিকশ্রেনির সাথে ব্যাপক শহুরে ও গ্রামীণ অসংগঠিত শ্রমিক এবং ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষিজীবীদের সচেতন ঐক্যই সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নকে প্রতিহত করতে পারে। এবং একাজটি করতে হয় ব্যাক্তিগত মিডিয়া প্রচারের মোহ পরিত্যাগ করেই। বিশ্বপুঁজিবাদ ভীষণ সংকটের মধ্যে পড়েছে, সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো বিভিন্ন স্থানিক যুদ্ধের পরাজয়ের অভিজ্ঞাতা থেকে রণকৌশলগতভাবে পিছু হটছে, সামাজিক আন্দোলনগুলো ব্যাপক ঐক্যের ভিত প্রস্তুত করে রেখেছে। কিন্তু যে বামপন্থা গণতন্ত্র ও শ্রমিকশ্রেণির ক্ষমতা এই দুয়ের মেলবন্ধন ঘটাতে পারে তারাই আজ বিপর্যস্ত ও সুবিধাবাদী অবস্থানে রয়েছে। এক নতুন বামপন্থী উত্থানই সামাজিক আন্দোলনের সমস্যার সমাধান করতে পারে। আমাদের গ্রামাঞ্চলে ‘চুঙ্গা ফুঁ’ বলে একটা কথার প্রচলন রয়েছে। যেখানেই আওয়াজ দেওয়ার জন্য মাইক সাজিয়ে রাখা আছে, সেখানে গিয়েই নিজের মুখ দেখানোর জন্য একটা ‘ফুঁ’ দিতে ব্যস্ত এখন তথাকথিত বামপন্থী ‘চুঙ্গা ফুঁ’রা। এই মুখোসের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রাখা তথাকথিত বামপন্থীদের কঠোর সমালোচন করেই নতুন বামপন্থা মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে ও সামাজিক আন্দোলনকে সমাজ-বিপ্লবের দিশা দিতে পারে।

নাটক ও দর্শক-শ্রোতার আন্তঃক্রিয়া

Posted by স্বাভিমান Labels: , , ,

নাটকের শিল্পগুণ

      
     ত ৮ থেকে ১০ ফেব্রুয়ারী কোরাসের উদ্যোগে বরাক-উপত্যকাব্যাপী নাট্য-পরিক্রমা হয়ে গেল এবং এই পরিক্রমার মূল্যায়ন করার জন্য কোরাস ১৬ ফেব্রুয়ারী মধ্যশহর সাংস্কৃতিক সংস্থার হলে এক অন্তরঙ্গ আলাপচারিতার আয়োজন করে। সেই আলোচনায় অনেক গুরুত্ত্বপূর্ণ বিষয় উত্থাপন হয়। শহরের নাট্যচর্চার সাথে ব্যাপক শ্রমজীবী মানুষের সংযোগ স্থাপনের প্রশ্নটি এই আলোচনায় কেন্দ্রীয় বিষয় হিসেবে উঠে আসে। চিত্রভানু ভৌমিকের উত্থাপিত প্রশ্নের মধ্যেও এই কেন্দ্রীয় বিষয়টিই নিহিত ছিল। তিনি প্রশ্ন তুলেন যে শ্রমজীবী মানুষের সাথে সংযোগ গড়ে তোলার প্রশ্নকে প্রাধাণ্য দিতে গিয়ে নাটকের শিল্পগুণ কী বিঘ্নিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না? এই গুরুত্ত্বপূর্ণ প্রশ্নের সাথে একটা পরিপূরক প্রশ্ন যদি উত্থাপন করা যায় তাহলে এই আশঙ্কার সমাধানের জন্য একটা নতুন নাট্যরূপ নির্ধারণের পথের সন্ধানের দিকে আমরা এক কদম এগিয়ে যেতে পারি। শ্রমজীবী মানুষের সাথে সংযোগ স্থাপন ছাড়া শিল্পগুণ সম্পন্ন নতুন নাটক গড়ে তোলা কী সম্ভব? এই প্রশ্নের উত্তর সন্ধানের মধ্যেই এই নিবন্ধকে সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে এবং এই সন্ধান করা হয়েছে কোরাসের নাট্য পরিক্রমার মূল্যায়নের মধ্যে।

আধুনিক ও তাৎক্ষনিক নাটক

  
  
        কোরাসের উদ্যোগে এবারের নাট্য-পরিক্রমা অনুষ্ঠিত হয় প্রায় দু’দশক পর। দু’দশক আগে যখন পরিক্রমা হয়েছিল তৃতীয় ধারার নাট্য-আন্দোলনের প্রাণশক্তি এতোটা ক্ষয়ে যায়নি। বরাক উপত্যকার বিভিন্ন শহরে বেশকয়েকটি তৃতীয় ধারার নাট্যগোষ্ঠী তখন সক্রিয় ছিল। মূলত ঐ নাট্যগোষ্ঠীগুলোর উপর নির্ভর করেই বরাক-উপত্যকা পরিক্রমা সংগঠিত করা হয়। এই নাট্যপরিক্রমার উদ্দেশ্যই ছিল বৃহত্তর দর্শক তথা শ্রমজীবী মানুষের সামনে নাটক উপস্থাপন করা। মূলত নাট্যব্যাক্তিত্ত্ব বাদল সরকারের লেখা আধুনিক নাটক গ্রামসমাজের কাছে পৌঁছে দেওয়া হত এই পরিক্রমায়। এই আধুনিক নাটকগুলির সাথে কিছু তাৎক্ষণিক নাটকও তৈরি হয়ে যেত যার রসদ সংগ্রহ হত     দর্শক-শ্রোতাদের সাথে আলাপচারিতায়। কিন্তু তাত্ত্বিক সূত্রায়ণ এই ছিল যে তাৎক্ষণিক নাটকগুলো করা হচ্ছে প্রয়োজনের তাগিদে, আর শিল্পগুণ সম্পন্ন আধুনিক নাটক দেখে দর্শক আসলে অনেক কিছু শিখছে এবং এখানেই আমাদের শৈল্পিক পারদর্শিতা ও সামাজিক দায়বদ্ধতার সংযোগস্থল। এই ভাবনা ও নাটকের বিষয় ও উপস্থাপনার মধ্যে কী কোন গলদ রয়েছে? এব্যাপারটা খানিকটা বিশদভাবে বিচার করে দেখা যাক।

          আমরা যখন ধরে নেই যে আমাদের আধুনিক নাটক দেখে ওরা কিছু শিখছে, তখন একপক্ষ দাতা এবং অন্যপক্ষ গ্রহীতা, সেখানে দেওয়া–নেওয়া বা আদান-প্রাদানের কোন সুযোগ নেই, ওদের প্রতিক্রিয়া দেখে আমি উৎফুল্ল হচ্ছি কারণ এটা আমাদের কৃতিত্ব। ওদের কাছ থেকে রসদ নিয়ে যখন তাৎক্ষণিক নাটক করছি, তখনও কিন্তু নির্মাণটা আমাদের – উপস্থাপনাও আমাদের। তাহলে এক্ষেত্রে আমরা যাকে সংযোগ বলে ধরে নিচ্ছি, তা কী সত্যিকারের সংযোগ? এটা যদি সত্যিকারের সংযোগ না হয়, তাহলে কী ধরে নিতে হবে যে কোন ধরণের সর্বজনীন আধুনিক নাটক সম্ভব নয়? এবার এই দুটি প্রশ্নের উত্তর নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করা যাক।

জনসংযোগ ও সর্বজনীন নাটক

           আমরা নাট্যশিল্পের মাধ্যমে কিছু একটা বললাম, ওরা শুনল। এই শোনার প্রতিক্রিয়ায় মস্তিষ্কে যে রসায়ন সৃষ্টি হল তাতে পরবর্তীতে কিছু একটা করল। কিন্তু তাতে নতুন কিছু তৈরি হল না, পুতুলটিতে যতটুকু দম দেওয়া হল সে অনুযায়ী পুতুলটি নাচল – তারপর আবার স্থানু অবস্থায় ফিরে এল। গুরু-শিক্ষককের সম্পর্কে যা হয় – সেটা তার থেকে খানিকটা বেশি – এখানে তোতাপাখিটা নিজের কথাও কিছু বলে। যারা শুনল তাদের খানিকটা লাভ ছাড়া ক্ষতি হলো না, কিন্তু যারা শোনাল তাদের কিন্তু মস্ত ক্ষতি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিল। কেউ হয়ত সংযোগ স্থাপনের আত্মগরিমায় ভুগল, কেউ এই সংযোগস্থাপনের কর্মটিই আসলে এক মায়া এভাবে ভাবতে আরম্ভ করল। তাই যদি হয় – তাহলে তো বলতে হয় সর্বজনীন নাটক বলে কিছু হওয়ার নয়। এই বিষয়টি একটু জটিল। সামগ্রীকভাবে একটি স্থান-কালের সীমার অধীনে অনেকগুলি স্থান-কাল রয়েছে। সামগ্রীক       স্থান-কালের বিষয়বস্তু নিয়ে নাটক যা স্বাভাবিকভাবেই সর্বজনীন হওয়া উচিত, তাকে যখন নির্দিষ্ট আলাদা আলাদা স্থান-কালের মধ্যে উপস্থাপন করা হয় তখন তাকে সেই স্থান-কালের নির্দিষ্টতার সাথে যুক্ত হতে হয় এবং এই যুক্ত হওয়া তখনই সম্ভব হয়ে উঠে যখন বিষয় ও আঙ্গিক উভয়ই এই নির্দিষ্টতার সাথে খাপ খাওয়ার জন্য পরিবর্তিত হয়। অর্থাৎ শ্রেণিবিভক্ত সমাজে উৎপাদন সম্পর্কের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে নাটকের সর্বজনীনতার কোন চূড়ান্ত রূপ নেই, এটা এক ভাঙা-গড়ার নিরন্তর প্রক্রিয়া। এজন্যই কোরাসের শহরের শিল্পীদের অভিনিত বাদল সরকারের নাটক ‘বাসি খবর’ যখন বড়সিঙা চা-বাগানের ‘লেড়কা দফার’ ছেলে-মেয়েরা অভিনয় করে তখন বিষয়-আঙ্গিকের দিক দিয়ে সেটা নতুন মাত্রা পায়। এই নতুন মাত্রা দেওয়ার জন্য আমাদের সেই সমাজকে জানার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, যে প্রক্রিয়ায় ওরাও কথা বলে। সেখান থেকে শুরু হয় সংযোগ স্থাপনের এক তাত্ত্বিক নির্মাণ, যেখানে উভয় পক্ষ কথা বলছে। কী হতে পারে সেই তত্ত্ব যেখানে শিল্পগুণ হারানোর কোন ভয় থাকবে না, অথচ দর্শকের সাথে সংযোগ স্থাপনের সমস্যাও মিটবে।     
 

নাটকের আলাপচারিতা

          এই যে কোরাসের উদ্যোগে গোল-টেবিল বৈঠক হল, সেই ঘনিষ্ঠ আলাপচারিতায় কিছু লোক নিজেদের মধ্যে যুক্তির মাধ্যমে মত বিনিময় করল, আবার নাটকের আঙিনায় আসা কিছু নতুন ছেলে-মেয়েরা শুধুই শুনল। অর্থাৎ মতের আদান-প্রদান ও আবার শুধুই শিক্ষা প্রদান – সংযোগ স্থাপনের দুটি রূপই যুগপৎভাবে সেখানে ক্রিয়াশীল ছিল। কিন্তু এতে প্রধান ধারাটি ছিল যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে মতের আদান-প্রদান যার নিষ্পত্তিতে একটা নতুন মতের সৃষ্টি হতে পারে যা আগে বিদ্যমান ছিল না। নাটক সেরকমই এক আলাপচারিতা যেখানে ভাবের বিনিময় হয় এক নির্দিষ্ট শিল্পরূপে অংশগ্রহণকারীদের সাথে বাকী দর্শক-শ্রোতাদের। নাটকের আলাপচারিতায় অংশগ্রহণকারী দুটি ক্যাটাগরি ভিন্ন ভিন্ন। একদল নাটক করছে ও আরেকদল দেখছে ও শুনছে। এই দুই ক্যাটাগরির মধ্যে কায়িক দূরত্ব একই সমতলের উপস্থাপিত নাটকের তূলনায় মঞ্চ নাটকের ক্ষেত্রে বেশি। যেহেতু কায়িক ও মানসিক দূরত্ব অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত, তাই সমতলে উপস্থাপিত নাটকে উভয় ক্যাটাগরির মধ্যে সংযোগ-স্থাপনের সম্ভাবনা অনেক বেশি। কিন্তু তাতে মৌলিক প্রশ্নটির নিষ্পত্তি হয় না। অর্থাৎ নাটক কী একপক্ষেরই শেখা ও শেখানোর প্রধান শিল্পমাধ্যম হয়ে থাকবে, না তা হয়ে উঠবে উভয় পক্ষের মধ্যে এক ঘনিষ্ঠ আলাপচারিতা? যদিও বাস্তবে এই দুটি দিক সর্বক্ষেত্রেই বিরাজমান, কিন্তু প্রশ্ন হলো কোনটি হবে প্রধান দিক? উভয় ক্ষেত্রেই নাটকের বিষয় ও রূপকে এক রাখা কী সম্ভব? শ্রমজীবী মানুষের সাথে সংযোগ স্থাপনের উপর গুরুত্ব দিতে গিয়ে নাটকের শিল্পগুণের সাথে কী সমঝোতা করতে হবে? এখানেই এসে যায় উৎপাদন সম্পর্ক বা আর্থিক-সামাজিক সম্পর্কগুলি ও তার পরিবর্তনের ধারাকে বোঝা, জানা ও অনুধাবনের বিষয়টি। এই রাজনৈতিক প্রয়াসকে দূরে সরিয়ে রেখে এই শিল্পমাধ্যম বিকশিত হতে পারে বলে আমার মনে হয় না। এটা কেন জরুরি ও কীভাবে তার অগ্রগতি সম্ভব সংক্ষেপে এর বিচার করা যাক এবং কোরাসের এবারের পরিক্রমা থেকে তার একটা উত্তর সন্ধান করা যাক।

শ্রমজীবীদের সাথে সংযোগ ও নতুন নাটক

             যখন কোন বিখ্যাত লোকের লেখা নাটক অভিনীত হয়, তখন সেই নাটকের জন্ম-ইতিহাস চর্চা করার কোন সুযোগ থাকে না, সুযোগ থাকে না লেখক যে পরিবর্তনশীল উৎপাদন-সম্পর্ক থেকে উদ্ভূত ভাবের প্রকাশ এই নাটকে করেছেন তাকে বিচার করার। বর্তমান উৎপাদন-সম্পর্কের বাস্তব পরিস্তিতিতে নির্দিষ্ট সামাজিক অবস্থান আমাদের যে মনোজগত তৈরি করেছে তা দিয়েই আমরা এর প্রাসঙ্গিকতা বিচার করি এবং যখন নাটকটি উপস্থাপিত হয় তখন কিন্তু লিখিত নাটকটি আর অবিকল থাকে না, আমাদের বাস্তবতা তাকে কোন না কোনভাবে প্রভাবিত করে। নাটকটি করার মধ্য দিয়ে আমাদের বাস্তব অবস্থানের সাথে সেই লিখিত পুরোনো নাটকের বিষয়ের এক যোগসূত্র স্থাপিত হয় এবং যখন নাটকটি মঞ্চস্থ হয় তখন এই যোগসূত্রটিই ক্রিয়াশীল থাকে আমাদের    সম-অবস্থানের দর্শক-শ্রোতাদের মধ্যে নাটকের বোধকে ছড়িয়ে দিতে। কিন্তু আমাদের অবস্থান বর্তমান বাস্তবের এক অতি-সীমাবদ্ধ অংশমাত্র এবং তাই বৃহত্তর দর্শক-শ্রোতাদের সাথে সংযোগস্থাপনে এই শিল্প-পরিবেশন অপারগ। সুতরাং সংযোগ স্থাপনের প্রশ্নটি বর্তমান পরিবর্তনশীল সামাজিক সম্পর্ককে জানা ও বোঝার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কিন্তু সমস্যা হলো সেই পরিবর্তনশীল সম্পর্ক ও তার থেকে উদ্ভূত ভাবকে আমরা ততটুকুই জানতে পারি যতটা সে নিজেকে উন্মোচিত করে। সেই উন্মোচন ততটাই ঘটে যতটা শ্রমজীবী মানুষ তার বর্তমান অমানবিক    আর্থ-সামাজিক সম্পর্ককে ভাঙতে সচেষ্ট হয়। এই ভাঙার প্রচেষ্টায় শ্রমজীবী মানুষ তার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের পরম্পরাকেও ভাঙাগড়ার মধ্য দিয়ে নিয়ে যায়। ফলে কায়িক যোগসূত্র ঘটালে অর্থাৎ শহরের নাটক তাদের কাছে নিয়ে গেলে বিষয় ও আঙ্গিকের নতুন সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়, কারণ এখানে উভয়পক্ষই কথা বলতে শুরু করছে। সেই সংগ্রামের সাথে যুক্ত হওয়াটা নাটকের জন্যই প্রয়োজনীয়, নাটক ও দর্শক-শ্রোতাদের সংযোগস্থাপন ও নতুন সৃষ্টির জন্য প্রয়োজনীয়। বাস্তব যতক্ষণ সেভাবে উন্মোচিত না হয়, ততক্ষণ এই সংযোগ স্থাপনের প্রশ্নটি নিজে শেখা ও শেখানোর উদ্দেশ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এই সীমাবদ্ধ উদ্যোগও কম গুরুত্ত্বপূর্ণ নয় – কিন্তু একেই একমাত্র লক্ষ্য করে নিলেই বিপদ।

নাটকের রাজনীতি

    

পরিস্থিতি অনুযায়ী নমনীয়তা নাটকের এক বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিত এবং তাই পরিস্থিতি বিশ্লেষণের মধ্য দিয়েই বিষয়-আঙিকের এই নমনীয় কাঠামোর ভাঙাগড়ার যাত্রা অব্যাহত রাখা সম্ভব এবং সেটাই নাটকের রাজনীতি। নাটকের শিল্পগুণ সৃষ্টির পরিকল্পনা যেহেতু কোন শূন্যগর্ভ থেকে আমাদের মস্তিষ্ক ও মনোজগতে চালিত হয় না, সেটা তৈরি হয় পরতে পরতে লুকিয়ে থাকা বিষয়-আঙিকের বিভিন্ন বাস্তবতার মধ্য থেকে এবং নাট্যকারের সুচারু হস্তক্ষেপে, তাই ভাল নাটকের জন্য এই রাজনীতি চর্চা অত্যন্ত গুরুত্ত্বপূর্ণ। কোরাসের ১৯৯১-৯২-এর পরিক্রমা ছিল সাম্প্রদায়িকতার কড়াল গ্রাস থেকে মানুষকে বের করে আনার এক শিক্ষামূলক অভিযান যে অভিযানের সুফল উপর থেকে অনুধাবন করা যায় না, সমাজের অভ্যন্তর থেকে দেখতে হয়। এবারের পরিক্রমা ছিল ভেতরের ও বাইরের দুই বিপরীতমুখী চেতনা-প্রবাহের এক আন্তঃক্রিয়া যেখানে উভয়পক্ষ কথা বলছে। শ্রমজীবী মানুষরা নিজেরা নাটক করছে, আধুনিক বয়ানকে তার ঐতিহ্যের সাথে মিলিয়ে নিচ্ছে এবং সেসব অঞ্চলেই সমস্ত সামাজিক-রাজনৈতিক আপত্তিকে অস্বীকার করে মানুষ ব্যাপকভাবে অংশ নিচ্ছে যেখানে শ্রমজীবীদের প্রচলিত আর্থ-সামাজিক সম্পর্কের গণ্ডী অতিক্রম করার কোন না কোন প্রয়াস রয়েছে। এই প্রক্রিয়ার অঙ্কুরোদ্গমনই এবারের পরিক্রমার বিশেষত্ব যার উত্তোরোত্তর বিকাশ নাট্যধারায় নতুন প্রাণ সঞ্চার করতে পারে।       

স্বাভিমান:SWABHIMAN Headline Animator

^ Back to Top-উপরে ফিরে আসুন