বরাক উপত্যকার প্রেক্ষিতে
আধিপত্যের নতুন বয়ান ও বৌদ্ধিক দীনতা
অরূপ বৈশ্য
২৭ জুলাই, ২০১৪, দৈনিক সাময়িক প্রসঙ্গ |
আত্মবিস্মৃত বাঙালি
বরাক উপত্যাকার প্রেক্ষিতে লিখতে বসলে বাঙালি
প্রশ্নকে গুরুত্ত্ব আরোপ করতেই হয়, কারণ এই উপত্যকায় পরিচিতির দিক থেকে বাঙালিরাই
বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু এই বাঙালির চালচিত্র গোটা বাঙালি জাতির গৌরবগাঁথার
পাঁচালি দিয়ে শুরু করা যায় না। অনেকেই বলেন এবং যথার্থভাবেই বলেন যে আজকের বাঙালির
বৌদ্ধিক কাঙালপনা নিহিত রয়েছে এই বয়ানে যে আজকের বাঙালি এক আত্মবিস্মৃত জাতি।
বৃহত্তর বাঙালি জাতির একটি ধারা সবসময়ই নিহিত ছিল সমগ্র মানবসমাজ নিয়ে
চিন্তা-চর্চার মধ্যে যাকে বাম বা মানবিক আন্তর্জাতিকতাবাদী ধারা হিসেবে নিঃসন্দেহে
অভিহিত করা যায়। যেহেতু সমগ্রের চিন্তার মধ্যেই জ্ঞানের আসল রসদ লুকিয়ে থাকে, তাই
এই ধারার আধিক্যের সময়েই বাঙালি জাতি প্রকৃতি বিজ্ঞান, সমাজ বিজ্ঞান ও
সাহিত্য-সংস্কৃতির জগতে জন্ম দিয়েছে তার রত্নগর্ভাদের। সেই সময়গুলোর এক কালপঞ্জী
তৈরি করে তার সামাজিক-ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের এক সুসমজ্ঞস্য ব্যাখ্যা করার
প্রচেষ্টা করা যেতেই পারে। কিন্তু বর্তমান নিবন্ধ এক ভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে লেখা। তথাপি
প্রারম্ভে কিছু প্রাসঙ্গিক জটিল কথা বলে নেওয়া জরুরি।
সংকীর্ণ স্বার্থের
প্রাধান্য
বর্তমান সময় এক সংকটকালীন সময়। প্রতিটি
সংকটকালীন সময়ের সামগ্রিকতার অভ্যন্তরে আর্থিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, বৌদ্ধিক
ইত্যাদি প্রতিটি ক্ষেত্রে আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য ক্রমান্বয়ে পরিস্ফুট হতে থাকে।
স্থান-কালের বিচারে যারা মানবসমাজের নির্ধারক ও নিয়ন্ত্রক শক্তি এই সংকট আসলে
তাদেরকেই উদ্বেলিত করে তুলে, কারণ তারা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে উঠে এই ভেবে যে নির্ধারিত
ও নিয়ন্ত্রিতরা মাথা তুলে দাঁড়িয়ে যেতে পারে। এই প্রক্রিয়া অনুধাবন করার প্রচেষ্টা
খানিকটা জটিল বৌদ্ধিক চর্চা। কিন্তু এই চর্চাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার প্রবণতাই আসলে
বৌদ্ধিক সংকটের লক্ষণ। বাঙালি বৌদ্ধিক সমাজ, বিশেষ করে বরাক উপত্যকার মত পিছিয়ে
পড়া এক অঞ্চলের স্থাণু বৌদ্ধিক চর্চা যে এই সংকটের গণ্ডি অতিক্রম করার ক্ষেত্রে
প্রতিবন্ধক, সেব্যাপারে দ্বিমত থাকার কোন কারণ নেই। একটা সময় ছিল যখন কে কীভাবে কোন
বিষয়কে দেখছে অর্থাৎ দর্শনের প্রশ্নটি এক গুরুত্ত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয় ছিল। এখন
বিশেষ করে আশির দশক থেকে, কার্যসিদ্ধিই আসল মন্ত্র হয়ে উঠেছে, সবকিছুই এখন ম্যানেজারিয়্যাল
স্কিল। বেড়াল সাদা বা লাল যাই হউক, ইদুঁর মারলেই হলো। এই দক্ষতারই এক উজ্জ্বল
প্রতিভূ হিসেবে হাজির করা হয়েছে আমাদের মাননীয় প্রধাণমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে।
কিন্তু স্থূল চালচিত্র আমাদের ভবিষ্যত সমাজকে এক উজ্জ্বল ভিতের উপর দাঁড় করাতে
পারে না। অথচ আত্মবিস্মৃত বাঙালি জাতি ইদুঁর ধরার এই সংকীর্ণ ছাঁটেই পা দিয়েছে বলে
মনে হয়। ক্ষুদ্র স্বার্থের উর্ধে উঠে বাঙালির বৃহত্ত্বের বৌদ্ধিক চিন্তার বিস্তৃত
হৃদয় বৃত্তি কখনোই প্রাধাণ্যকারী ভূমিকায় ছিল না। নাহলে বাঙালি জাতির বিভাজন
বিরোধী ধারা কখনই পরাভূত হত না। ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গ, ১৯১১-এর কলকাতা থেকে দিল্লিতে
রাজধানী স্থানান্তরের মধ্য দিয়ে বঙ্গভঙ্গ রদ, ১৯৪৮-এর পুনরায় বঙ্গভঙ্গ এই সবকিছুতেই
বাঙালি ভদ্রলোকদের সংকীর্ণ স্বার্থ চিন্তাই আসলে জয়লাভ করেছে। শেখর বন্দোপাধ্যায় ও
জয়া চাটার্যির মত গবেষকরা বাংলার ও বাঙালি রাজনীতিতে ভদ্রলোক শ্রেণির ভূমিকার যে
কূটিল দিককে নথিবদ্ধ করেছেন তা আমাদের চর্চার বিষয় হয়ে উঠে না। কারণ একটি
সমান্তরাল ধারা হিসেবে গূঢ় রহস্যের অনুসন্ধানের জন্য বৌদ্ধিক চর্চা ও বিস্তৃত
হৃদয়বৃত্তি প্রায় নিঃশেষিত এবং তাই চিন্তা-উদ্রেককারী বৌদ্ধিক অবদানও একেবারে
তলানিতে। তাই বরাকের বুদ্ধিজীবী সমাজ যখন সঙ্গত কারণেই অসমীয়া উগ্রাজাতিয়বাদকে
শঙ্কার বিষয় হিসেবে উপস্থাপন করেন তখন যান্ত্রিক সংজ্ঞায় এক অচল অনড় ধারণার মধ্যে
নিজেকে আবদ্ধ করে রাখেন। আসামের উগ্রজাতিয়বাদী রাজনীতিকেও বাস্তব পরিস্থিতির
বাস্তব ব্যাখ্যার হাতিয়ার দিয়ে বিচার করে দেখেন না। তার চাইতেও গুরুত্ত্বপূর্ণ কথা
হচ্ছে এই যে এই বৌদ্ধিক চর্চা কখনোই
শ্রমজীবী মানুষের ঐক্য গড়ে তোলার প্রেক্ষাপট থেকে জাতি-ধর্মের বা পরিচিতির
প্রশ্নকে বিচার করে না এবং ফলে উগ্রজাতীয়তাবাদ ও পরিচিতির প্রশ্ন সামগ্রীকতার
বাইরে এক স্থাণু বিষয় হিসেবে উপস্থাপিত করার প্রবণতা প্রাধান্য পায়।
উগ্রজাতিয়তাবাদ ও বৌদ্ধিক
দীনতা
শাসকীয় রাজনীতির ঘটনাপ্রবাহের পর্যবেক্ষণ
আমাদেরকে সমাজের অভ্যন্তরীণ পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয় যা মনোযোগী দৃষ্টি দাবি করে।
কিন্তু বরাকের বৌদ্ধিক সমাজ আসামের অতীত ইতিহাস ও সাম্প্রতিক ঘটনাবলিকে হেতুবাদের
এক ছাঁচে ফেলে দেখতেই অভ্যস্ত, তাদের দৃষ্টি এর বাইরে কখনওই নিবদ্ধ হয়নি। আসু
আন্দোলন শুরুর পূর্ববর্তী পর্যায়ে উগ্রজাতিয়তাবাদী কাঠামোর অভ্যন্তরে ‘আলি-কুলি-বাঙালির(হিন্দু
ও মুসলমান)’ যে কংগ্রেসী ভারসাম্যের নমনীয় রাজনীতি প্রাধান্য বিস্তার করে ছিল, আসু
আন্দোলন ও অগপ’র ক্ষমতারোহণ এই ভারসাম্যকে ভেঙে দিয়ে আগ্রাসী উগ্রজাতিয়তাবাদের
প্রথম পর্যায়ের ইতি টানে এবং এক স্বাভাবিক মৃত্যুর পথে যাত্রার সূচনা করে।
নেলী-গুহপুর-মোকালমোয়ায় বাঙালি মুসলিম বিরোধী দাঙা করার জন্য অসমীয়া আবেগে যারা
‘ওলাই আহিছিল’, তারা এই ছত্রছায়া থেকে বেরিয়ে যেতে আরম্ভ করে। পরবর্তীতে আলফার
সন্ত্রাসবাদী রাজনীতিও জনসমর্থন হারানোর স্বাভাবিক পড়িণতি লাভ করে। এই দীর্ঘ
পর্যায়ে অসমীয়া সমাজের অভ্যন্তরিণ শ্রেণি বিভাজন যে আরও বিস্তৃত হয়ে শ্রেণি
সম্পর্কের পুনর্বিন্যাস ঘটাচ্ছে তার ইঙ্গিত পাওয়া যায় যখন অসমীয়া মধ্যশ্রেণির
ইতিহাসের লেখক ড০ প্রফুল্ল মহন্ত অসম সাহিত্য সভার মত অসমীয়া জাতীয় সংগঠনের
প্রকাশ্য অধিবেশনে তাঁর সুচিন্তিত লিখিত ভাষণে অসমীয়া সমাজের আজকের দূরবস্থার জন্য
অসমীয়া বর্ণহিন্দু সমাজ, সাহিত্য সভা ও কংগ্রেসের সংকীর্ণ নীতিকে দায়ী করেন। এধরনের
সাহসী প্রকাশ্য বয়ান উত্থাপিত হওয়া অসমীয়া সমাজের অভ্যন্তরিণ শ্রেণি-সম্পর্কের
পুনর্বিন্যাসের এক অন্তর্বর্তীকালকে সূচিত করে। এমতাবস্থায় ষাটের দশকের কৃষক
আন্দোলনে নিহিত ধারায় এক নতুন রূপে বাঙালি-অসমীয়া নির্বিশেষে মেহনতি মানুষের
ঐক্যের প্রশ্নটি আবারও রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। কিন্তু
মূলস্রোতের বামপন্থী বুদ্ধিজীবীদের বৌদ্ধিক কাঙালপনা এই সম্ভাবনাকে সমূলে ধ্বংস
করে দেওয়ার ইন্ধন যোগায়। ভারতীয় পরিচিতির রাজনীতির চোরাস্রোতের যখন বিস্ফোরণ
ঘটেছিল ভিপি সিং-এর আমলে মণ্ডল রাজনীতির মধ্য দিয়ে, তখন এই বামপন্থী বুদ্ধিজীবীরা
পরিচিতির প্রশ্নকে অবজ্ঞা করেছিলেন উৎপাদনের হাতিয়ারের মালিকানাকে একমাত্র ও
ভ্রান্ত মার্কসীয় শ্রেণি-রূপ হিসেবে বিবেচনা করে। এখন পরিচিতির রাজনীতি তার
কার্যক্ষমতা হারাতে বসেছে প্রধানত তিনটি কারণে – (১) পরিচিতির প্রশ্নকে ক্ষমতার
ভারসাম্য গড়ে তোলার একমাত্রিক রূপ হিসেবে দেখা হয়েছে, অভ্যন্তরীণ সামাজিক
পরিবর্তনকে কখনওই বিচার্য বিষয় হিসেবে রাখা হয়নি এবং বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলারও তেমন
জোরদার প্রচেষ্টা হয়নি, যেটুকু হয়েছে তা তথাকথিত সুবিধাবাধী ‘সোস্যাল
ইঞ্জিনিয়ারিং’-এর মধ্যে সীমিত রয়েছে। (২) বিত্ত পুঁজি, বণিক পুঁজি ও কৃষিতে
উদ্বৃত্ত মুনাফা আরোহণের মাধ্যমে সঞ্চিত পুঁজির অধীনে গ্রামাঞ্চলে শ্রেণি
সম্পর্কের প্রভূত পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। (৩) এই দুটি কারণ পরিচিতির গণ্ডির শাসকীয়
রাজনীতিকে বিভ্রান্ত করে তুলেছে। এজন্যই বাঙালি স্বার্থে কথা বলার এক প্রতিযোগিতা
শুরু হয়েছে কংগ্রেস-বিজেপির বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে এবং একাজটি তারা করতে পারছেন
তাদের অসমীয়া কোর-কনস্টিটুয়্যান্সিকে হস্টাইল না করেই। কিন্তু বাস্তব যে তাদের
দিশেহারা করে তুলেছে তা তাদের শারীরিক-ভাষাতেই ফুটে উঠছে। বিভ্রান্তির এই
চালচিত্রটি অনুধাবন করা যায় সর্বভারতীয় ও রাজ্যিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন দলের সর্বমোট ও
জনগোষ্ঠীগত শতকরা ভোটপ্রাপ্তির বিস্তর তথ্যের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচারে। তারা
বিভ্রান্ত কারণ আজকের বাস্তবতায় আসু-আন্দোলন পূর্ববর্তী ‘আলি-কুলি-বাঙালির’
কংগ্রেসি ভারসাম্যের রাজনীতিতে আর ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। অথচ এটাই কামনা করছেন
বরাকের পরাজিত মূলস্রোতের বাঙালি বামপন্থী বুদ্ধিজীবীরা। যখন পরিচিতির রাজনীতি
শ্রেণি রাজনীতির অধীন হয়ে পড়ার এক পরিবর্তনশীল পর্যায় চলছে, তখন তাদের পরিচিতির
প্রশ্ন নিয়ে কালঘুম ভাঙতে শুরু করছে। তবে তারা তাত্বিকভাবে যে কথা বলেন, বাস্তব
রাজনীতিতে পালন করেন অন্য ভূমিকা। তাদের এই বাস্তববাদ সুবিধাবাদ ও বৌদ্ধিক দীনতারই
নামান্তর। এই দীনতা বরাকের বাস্তব প্রেক্ষাপট থেকে খানিকটা বিচার করে দেখা যাক।
বরাক উপত্যকার বাস্তবতা
বাস্তবকে বোঝার জন্য কোন একটা শক্তিশালী
বৈশিষ্ট্যকে মাধ্যম করে নেওয়া একটি মান্য পদ্ধতি। শুধুমাত্র বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে
একে বিচার করলে অভিজ্ঞতাবাদের দোষে দুষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল হয়ে দেখা দেয়।
সুতরাং সাম্প্রতিক নির্বাচনকেই এই বিচারের প্রেক্ষাপট হিসেবে রাখা যেতে পারে। এই
নিবন্ধে বিস্তৃত আলোচনার সুযোগ নেই, তাই বরাক উপত্যকার সমাজের কতকগুলো বৈশিষ্ট্যের
মধ্যেই আলোচনাকে সীমাবদ্ধ রাখব। বরাকের নির্বাচন মানেই হিন্দু-মুসলিম বিভাজন।
কিন্তু এবারের নির্বাচনে যখন সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে ধর্মীয় মেরুকরণ ঘটানোর জোরদার
প্রচেষ্টা অব্যাহত ছিল, তখন বরাকের দুটি সংসদীয় নির্বাচনে চূড়ান্ত ধর্মীয় মেরুকরণ
ঘটেনি। অনেকে এটাকে দেখেন শাসকীয় রাজনীতির বিভিন্ন লবির স্বার্থের সংঘাতের পরিণতি
হিসেবে, কিন্তু এহ বাহ্য। অনেকে আবার মনে করেন করিমগঞ্জে যদি মুসলিম প্রার্থী দেওয়ার
সুযোগ থাকত এবং এইউডিএফের মুসলিম প্রার্থী হতো এবং শিলচরে যদি গেল বারের মত আজমল
প্রার্থী হতেন, তাহলে ভোটিং প্যাটার্ন ভিন্ন হতো – এই বয়ানের মধ্যে হয়ত কিছু
সত্যতা আছে। কিন্তু এই সত্যতা এবারের ভোটে যে মানসিকতা পরিবর্তনের বাস্তব বার্তা
বহন করছে তাকে খণ্ডন করে না। আমাদের স্মরণে রাখা উচিত যে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে
বিজেপির ভোট প্রাপ্তি মাত্র ৩১%, এমনকি উত্তরপ্রদেশে যেখানে সবচাইতে বেশি
মেরুকরণের রাজনীতি হয়েছে সেখানেও এসপি-বিএসপি’র ভোটের যোগফল বিজেপির প্রাপ্ত ভোটের
সমান। আমাদের নির্বাচনী পদ্ধতির জন্য ২২.২% ভোট পেয়েও বিএসপি উত্তরপ্রদেশে একটি আসনও
লাভ করেনি। যাইহউক, বরাকের ভোট চালচিত্রের এই পরিবর্তনের আসল কারণটি অনুধাবন করা
জরুরি। বরাক উপত্যকা তথা আসামের গ্রামাঞ্চলে সর্বশেষ এনএসএস স্যাম্পল সার্ভে
রিপোর্টের তথ্য এবং আমাদের অনেকেরই বাস্তব অভিজ্ঞতা দেখায় যে বরাকের গ্রামাঞ্চলে
কৃষকের সংখ্যা দ্রুতগতিতে কমছে এবং তার স্থান নিচ্ছে মজুরি শ্রমিকের ক্রমাগত
বৃদ্ধি। কৃষকের মানসিক পৃথিবী বাস্তব উৎপাদনের উপকরণের মালিকানা ও জমির সাথে
ধর্মীয় বন্ধনের জন্য সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বয়ানে আকৃষ্ট হওয়ার অনুকূল হয়ে থাকে,
মজুরি শ্রমিকের ক্ষেত্রে যে আবেদন তার কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলার সূত্রপাত ঘটায় এবং
এক ভিন্ন বয়ান তাদের কর্ণগোচর হওয়ার উপযোগী হয়ে থাকে। এই ভিন্ন সাম্প্রদায়িকতা
বিরোধী বয়ান গ্রামাঞ্চলে পৌঁছে দিতে বামপন্থী ও মানবতাবাদী বুদ্ধিজীবীদের একাংশের
নিরলস প্রয়াসও পরিলক্ষিত হয়েছে বরাকে উপত্যকার উর্বর মাটিতে। এই পর্যবেক্ষণের আরও
বিস্তৃত ব্যাখ্যা থেকে বিরত থেকে বরাকের মধ্যবিত্ত শ্রেণির একাংশের স্বরূপ নিয়ে
কিছু কথা বলে নেওয়া যাক।
বরাকের মধ্যবিত্ত
বুদ্ধিজীবী শ্রেণি ও আধিপত্যের পুনর্বিন্যাস
বরাকের মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী শ্রেণির এক বৃহৎ
অংশ গঠিত হয় অবিভাসী বাঙালিদের মধ্য থেকে যারা উদ্বাস্তু হয়ে পূববাংলার সব
সা-সম্পত্তি ত্যাগ করে এখানে এসেছিলেন। এই উদ্বাস্তু বাঙালিদের পূর্ব-প্রজন্মের সঞ্চিত ধন-সম্পত্তি যা
পরবর্তী প্রজন্মে হস্তান্তরিত হয় এবং যা হস্তান্তরিত হওয়ার মধ্য দিয়ে সম্পত্তির
মালিকানাজনিত অসাম্য প্রজন্মের পর প্রজন্ম গড়িয়ে চলে তা বাধা প্রাপ্ত হয়। অর্থাৎ
এই উদ্বাস্তু বাঙালিদের মধ্যে শ্রেণি-বর্ণগত বিভাজনের মানিসকতা বিরাজ করলেও শুরুতে
সম্পত্তির মালিকানাজনিত ভিত্তি ভেঙে যায়। কাঠামোগত এই সাম্য শ্রেণি-বর্ণ
নির্বিশেষে সব উদ্বাস্তু বাঙালিদের মধ্যে একধরনের আত্মীয়তাবোধ জাগ্রত করে, কিন্তু
সেই বোধ বেশিদিন স্থায়ী হয় না। পরবর্তী অভ্যন্তরীণ বিভাজনকে আমরা স্থূলরূপে এভাবে
চিহ্নিত করতে পারি। প্রথমত উচ্চবর্ণের বাঙালি উদ্বাস্তুরা তাদের সামাজিক মর্যাদাকে
ব্যবহার করে শহরে বসত স্থাপন করেন, গ্রামাঞ্চলেও যারা চলে যান তারাও এই সম্পর্ককে
ব্যবহার করে অন্যান্যদের তূলনায় সুবিধাজনক স্থিতি লাভ করতে সক্ষম হন। বাকীরা
উদ্বাস্তু শিবিরে আশ্রয় নিয়ে পরবর্তীতে ক্ষুদ্র-কৃষক, বিভিন্ন ধরনের কায়িক
শ্রম-নির্ভর পেশা ও কৃষি-শ্রমিক হয়ে গ্রামাঞ্চলে বসত স্থাপন করেন। দ্বিতীয় পর্যায়ে
বর্ণহিন্দুরা সরকারি চাকুরির মাধ্যমে প্রশাসন যন্ত্রের অভিন্ন অঙ্গ হয়ে ওঠেন এবং
কৃষি সম্পত্তির পরিবর্তে সরকারি অনুদান ও সুবিধা যখন বেঁচে থাকার মুখ্য ধারা হয়ে
ওঠে তখন বর্ণহিন্দু উদ্বাস্তুরা বাকীদের উপর একধরনের ঢিলেঢালা আধিপত্য স্থাপন করতে
সক্ষম হন, যেহেতু আসামের শিক্ষিত মুসলিম অভিজাত পরিবারের এক বড় অংশ দেশভাগের সময়
পূর্ব-পাকিস্তানে চলে যান। কিন্তু সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ধর্মীয় বন্ধনের কোন
যোগসূত্র না থাকায় মুসলিমরা স্বাভাবিকভাবেই এই আধিপত্য মেনে নিতে পারেনি। এই
দ্বন্দ্ব হিন্দু-মুসলিম মানসিক দূরত্বে এক কাঠামোগত ভিত্তি রচনা করে। তৃতীয়
পর্যায়ে বিশেষ করে আশির দশক থেকে যখন এক মুসলিম মধ্যশ্রেণি কৃষিক্ষেত্র ত্যাগ করে
চাকুরীজীবী হয়ে উঠে আসছে এবং যখন পরিকাঠামোগত বিনিয়োগ, ফিনান্স পুঁজির প্রাধাণ্য,
উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর তূলনায় কৃষি-উৎপাদিত সামগ্রীর ব্যয় বৃদ্ধির ফলে
কৃষি ক্ষেত্রের আয় থেকে জীবন নির্বাহ দুরূহ হয়ে উঠছে, যখন পরিকাঠামো নির্মাণ ও বাণিজ্যিক
উৎপাদনে মাঝারি ও ক্ষুদ্র কৃষকরা মজুরি শ্রমিক হিসেবে নিজের এলাকায় ও অভিবাসী
শ্রমিক হিসেবে যুক্ত হতে আরম্ভ করেছে এবং বর্তমানে কৃষকের তূলনায় তার সংখ্যাধিক্য দেখা
দিয়েছে, বেঁচে থাকার রসদ সংগ্রহে সরকারি প্রশাসনিক যন্ত্রের কার্যকারিতা যখন কমে
আসছে, তখন আধিপত্যের এই রূপের এক নতুন পুনর্বিন্যাস জরুরি হয়ে উঠেছে, আপাত শান্তির
এক আবরণের তলায় অশান্ত ডামাডোলের পরিস্থিতি বিরাজ করছে। কারা এই পুনর্বিন্যাসের
নতুন এক স্থায়ী রূপের নেতৃত্ব দেবে এ এক গুরুত্ত্বপূর্ণ প্রশ্ন। বরাকের
গণতান্ত্রিক ও বামপন্থী বুদ্ধিজীবীদের বৌদ্ধিক দেউলিয়াপনা এ প্রশ্নে কোন সদুত্তর
দেওয়ার ক্ষেত্রকে এখনও ঘোলাটে করে রেখেছে।