(C)রবিবারের প্রসঙ্গ |
।। অরূপ বৈশ্য।।
(লেখাটা আজ ১৫ মার্চা রবিবারের প্রসঙ্গে বেরিয়েছে)
ক্রিয়া – প্রতিক্রিয়া
নাগাল্যাণ্ডের ডিমাপুরে করিমগঞ্জ জেলার ভাঙা অঞ্চলের বাসিন্দা শরিফ উদ্দিন খানের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করল বরাকবাসী ৮ মার্চ সর্বাত্মক বন্ধ পালনের মধ্য দিয়ে। শারীরিক অসুস্থতার কারণে বর্তমান নিবন্ধকারের এই বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের সক্রিয় প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার কোন উপায় ছিল না। এব্যাপারে সাময়িক প্রসঙ্গে লেখা দেওয়ার জন্য ফোন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার সুযোগ তৈরি করে দিল। যে কোন ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া থাকে, কিন্তু প্রতিক্রিয়া সবসময়ই বহুবিধ শর্ত-নির্ভর। এই শর্তগুলির অধিকাংশই ইতিহাস নির্ধারিত। তাই কোন সামাজিক ঘটনায় জাতি-ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণিভিত্তিক গোষ্ঠী-নির্ভর ও ব্যক্তিসত্ত্বার বৌদ্ধিক স্থিতি-নির্ভর বিচিত্র সব প্রতিক্রিয়ার এক ক্যানভাস সৃষ্টি হয়। বাস্তব পরিস্থিতি এবং সচেতন হস্তক্ষেপে এই প্রতিক্রিয়াগুলি এক সাধারণ গণতান্ত্রিক দিশা পেতে পারে, আবার ধ্বংসাত্মক দিকেও পরিচালিত হতে পারে। গণতান্ত্রিক অধিকার সুরক্ষা সমিতির সময়োচিত সঠিক হস্তক্ষেপ বরাক উপত্যকার গণতান্ত্রিক পরিবেশ রক্ষায় এক গুরুত্ত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
আক্রমণের মনস্তত্ত্ব
ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার উপরোক্ত এই সূত্রায়ন দিয়েই ডিমাপুরের গণ-উন্মাদনার বিষয়টিকে প্রাথমিকভাবে বিচার করে দেখা যাক। কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক চেতনাই যাদের নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় থাকে, তারা অনায়াসে বলে দিতে পারেন যে ধর্ষণের অভিযোগের প্রতিক্রিয়ায়ই এই গণ-হিস্টরিয়া ও বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড। জেল ভাঙার ঘটনা বাদ দিলে এধরনের হত্যার নজির আমাদের এই উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলিতে অতি-প্রাচীন না হলেও সাম্প্রতিককালে বহুবার ঘটেছে। এই ঘটনাগুলির আগসারিতে দেখা যায় একদল যুবক-বাহিনী। প্রাচীন মূল্যবোধ ও মোবাইল-ইন্টারনেট ব্যবহারে আধুনিক জীবনযাত্রার সংঘাতে এই যুবক বাহিনীর মধ্যে তৈরি হয়েছে একধরনের চিত্ত-বৈকল্য। তৈরি হয়েছে সামাজিক-আর্থিক মর্যাদায় বঞ্চিত, বিধ্বস্ত ও পরাজিত-মানসিকতা প্রসূত একধরনের নীতিহীন আক্রোশ। তাই তাদের পৌরুষ জেগে উঠে ন্যায়ের নামে নিরুপায়-নিঃসহায় টার্গেটের বিরুদ্ধে পেশীশক্তির পাশবিক প্রয়োগের মাধ্যমে। কিন্তু এ তো বাস্তবের শুধুমাত্র এক মনস্তাত্ত্বিক দিক। প্রশ্ন উঠতেই পারে যে তাদের পৌরুষ এক গণতান্ত্রিক পথে জাগ্রত হয়নি কেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে অনেকগুলি তাৎক্ষনিক ও দীর্ঘকালীন শর্তের মধ্যে যা গণ-প্রতিক্রিয়াকে এক পাশবিক পথে পরিচালিত করে।
সামাজিক দ্বন্দ্ব
২০১১ সালের জনগণনার হিসাবে নাগাল্যাণ্ডের জনসংখ্যার দশকীয় (decadal) বৃদ্ধি ঋণাত্মক (-০.৪০%)। নাগাল্যাণ্ডের রাজধানী শহর কোহিমা, কিন্তু বৃহত্তম শহর হচ্ছে ডিমাপুর। এই দুটি শহর সহ কতিপয় জেলা শহরেও জনসংখ্যা এই সময়কালে বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে বোঝা যায় যে ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রান্তের মত নাগাল্যাণ্ডের মূলত শহর সংলগ্ন পাহাড়ের পাদদেশের গ্রামাঞ্চল থেকে শহরের দিকে ক্রমাগত প্রব্রজন ঘটছে। প্রাচীন জনজাতীয় অর্থনীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ সামাজিক-সাংস্কৃতিক আচার-আচরণ আধুনিক জীবনচর্চার মানদণ্ডে গ্রহণযোগ্য বিবেচিত না হলেও এগুলি ছিল জীবনের রঙে রাঙানো। মুখ্যত ষোলটি জনজাতীয় গোষ্ঠীতে বিভক্ত নাগা সমাজ তাদের গোষ্ঠী-সমাজের চারপাশে গণ্ডি এঁকে দিয়েছিল – এটাই ছিল তাদের মানব-পৃথিবী। এই পৃথিবী গড়ে উঠেছে প্রকৃতি ও প্রকৃতির উপর গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষের বেঁচে থাকার শ্রম এবং ব্যবহারের জন্য অতি-প্রাচীন সরল সব হাতিয়ারের উপর ভিত্তি করে। কিন্তু আধুনিক ব্রিটিশ শাসকদের হস্তক্ষেপ, মিশনারীদের ভূমিকা এবং পরবর্তীতে ভারতীয় রাষ্ট্রের দীর্ঘকালীন শাসন ব্যবস্থায় জনজাতীয় সমাজ গাঁথনি ভেঙে পড়েছে। আধুনিক সমাজের উপকরণের সাথে পরিচয় ও তার ব্যবহার জনজাতীয় চরিত্র পালটে দিয়েছে। স্বাধীনচেতা নাগা সমাজ তাদের স্বাধীন শাসন ব্যবস্থা বজায় রাখার সংগ্রাম বরাবরই অব্যাহত রেখেছে এবং তা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক রূপ পরিগ্রহ করেছে। কিন্তু দ্রুত নগরায়ন, আধুনিক উৎপাদন প্রক্রিয়া ও ব্যবসা-বাণিজ্যের সাথে যুক্ত হওয়ার বাস্তব চাপ রয়েছে এবং ফলে শহরের দিকে ধাবিত হচ্ছে নাগা সমাজের বহু লোক। কিন্তু সেখানে বিভিন্ন ধরণের নির্মাণ কাজে সরকারি-বেসরকারি ঠিকাদাররা সস্তা শ্রমিক হিসেবে মূলত আসামের বাঙালি মুসলমান, বিহার-ওড়িষার নিম্নবর্গীয় সমাজের লোকদের নিয়োগ করেছে। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ে অভিজ্ঞ এই সম্প্রদায়ের লোকেরা সেখানে ক্ষুদ্র ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে সেখানকার স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে পড়েছে। এই পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে এক সামাজিক টানাপড়েন। আমাদের বোঝা দরকার এই সামাজিক টানাপড়েনের পরিস্থিতিতে কারা বেশী লাভবান, কোন ন্যস্ত স্বার্থ জড়িত এই দ্বন্দ্বকে এক সংঘাতময় পরিণতি ও ঘৃণার বাতাবরণে রূপান্তরিত করার পেছনে? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে পারিপ্বার্শিক কিছু বিষয় যাচাই করে দেখা যাক।
দীর্ঘম্যাদী ও তাৎক্ষণিক কারণ
উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বাঙালি-মুসলমান বিরোধী উগ্রজাতিয়তাবাদী-সাম্প্রদায়িক প্রচারের এক দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। দেশ-বিভাজনের প্রেক্ষিতে নেহেরু-লিয়াকত চুক্তি ও বাংলাদেশ গঠনের প্রেক্ষিতে ইন্দিরা-মুজিব চুক্তির শর্তগুলির কথা বিবেচনায় না রেখে মনগড়া পরিসংখ্যান, মিথ্যা তথ্য ও সাজানো ঘটনাকে কেন্দ্র করে তথাকথিত বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী ও ধর্মীয়-ভাষিক সংখ্যালঘু বিরোধী এক ধারাবাহিক উগ্র-জাতিয়তাবাদী-সাম্প্রদায়িক প্রচার করে চলেছে ক্ষমতাবান শ্রেণি ও তাদের মতাদর্শগত মেন্টর সংগঠনগুলো। এই অবাস্তব আখ্যান মোটামুটিভাবে সব প্রতিষ্ঠিত দলই আত্মস্থ করে নিয়েছে, কিন্তু জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে মানুষের ঐক্যে বিঘ্ন ঘটানোর এই প্রচারে সবচাইতে অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করে চলেছে বিজেপি দলের মতাদর্শগত মেন্টররা। সংখ্যালঘু অধিকারের প্রশ্নটি শুধুমাত্র উত্তর-পূর্বাঞ্চলে নয়, পার্শ্ববর্তী দেশগুলিতেও এক মুখ্য বিচার্য বিষয় হয়ে রয়েছে। মায়ান্মারে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে সে দেশের বিভিন্ন জনজাতীয় গোষ্ঠীদের মধ্যে ঐক্য গড়ার যে প্রয়াস তার বাইরে রোহিঙ্গিয়া মুসলিমদের রেখে দেওয়া হয়েছে এবং তাদের উপর সবসময় ঝুলতে থাকে আক্রমণের খাঁড়া। বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রে বাঙালি জাতিসত্তার প্রশ্নটি যেহেতু কেন্দ্রীয় বিষয় ছিল, তাই সেখানে মুসলিম সাম্প্রদায়িক শক্তি আজও মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি একথা সত্য। কিন্তু হিন্দু-সংখ্যালঘু অধিকারের বিষয় সেখানেও নিশ্চিতভাবে গণতন্ত্র বিকাশের সাথে সংপৃক্ত। প্রশ্ন উঠতেই পারে যে নাগাল্যাণ্ডের প্রেক্ষিতে এই বিষয়গুলি কতটা প্রযোজ্য যেখানে মোট জনসংখ্যার ৯০.০২% খ্রীষ্টান, ৭.৭% হিন্দু ও ১.৮% মুসলমান? প্রথমত নাগাল্যাণ্ডে আসাম থেকে যাওয়া মুসলমানদের মাতৃভাষা বাংলা। সব মুসলমানদের বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী হিসেবে দেখানোর সার্বিক প্রচার নাগা ভাষিক চেতনায় প্রভাব বিস্তার করে বিশেষ করে উপরোক্ত সামাজিক টানাপড়েনের পরিস্থিতিতে। এবং দ্বিতীয়ত, নাগাল্যাণ্ডের মোট প্রায় ২০ লাখ জনসংখ্যার প্রায় ১.৫ লাখ হিন্দু ও ৩৫ হাজার মুসলমান। এই দেড় লাখ হিন্দুদের মধ্যে ৯২ হাজার ডিমাপুরের ও ২২ হাজার কোহিমার বাসিন্দা এবং মুসলিম জনসংখ্যার প্রায় পুরোটাই এই দুই জেলার বাসিন্দা। সুতরাং ডিমাপুরই হচ্ছে প্রধান জায়গা যেখানে বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী বিরোধী ধারাবাহিক অপপ্রচারের এক বড় মাপের শ্রোতা রয়েছে এবং তারা এই অপপ্রচারের সংগঠকদের স্থানীয় আশ্রয়স্থলও। উপরন্তু ডিমাপুর আসাম সংলগ্ন হওয়ায় ও আসাম থেকে সুগম যাতায়াতের ব্যবস্থা থাকায় তৃণমূলে এধরনের প্রচারকার্য চালানো সুবিধেজনক। সুতরাং ডিমাপুরের শরিফ হত্যার বর্বরোচিত ঘটনার পেছনে এধরনের দীর্ঘকালীন অপপ্রচার যে অপ্রত্যক্ষ কারণ হিসেবে কাজ করেছে এতে কোন সন্দেহ নেই। জনগণকে উত্তেজিত করার জন্য তাৎক্ষণিক প্রত্যক্ষ উদ্যোগের পেছনে এই প্রচারের তৃণমূল সংগঠকদের কোন ভূমিকা রয়েছে কিনা তা অনুসন্ধানের বিষয়। এই তাৎক্ষণিক চক্রান্তের পর্দা ফাঁস করতেই প্রয়োজন নিরপেক্ষ তদন্ত ও তদন্তমূলক সাংবাদিকতা যা আজকাল প্রায় উঠেই গেছে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে আসাম নির্বাচন আর বেশী দূরে নেই এবং তাই পার্শ্ববর্তী কোন অঞ্চলের ঘটনা নির্বাচনী মেরুকরণের উদ্দেশ্যেও সংগঠিত হতে পারে। আমাদের সৌভাগ্য যে বরাকবাসী এখন পর্যন্ত প্রতিটি ঘটনার সুনিয়ন্ত্রিত প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।
অভিবাসী মুসলমান বনাম আক্রমণের মদতদাতা
নাগাল্যাণ্ডে কৃষি ক্ষেত্র ছাড়া নিয়োগের প্রধান মাধ্যম সড়ক, ভবন, টাওয়ার ইত্যাদি পরিকাঠামোগত নির্মাণ কার্যে সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ। এই সব কাজে স্থানীয় নাগা জনগোষ্ঠীর যুবকরা ঠিকাদার ও উপ-ঠিকাদার হিসেবে যুক্ত হচ্ছে। এই কাজগুলি মূলত ডিমাপুর ও কোহিমাকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হচ্ছে। উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া আধুনিকতার ফলে জনজাতীয় অর্থনীতির পরিবর্তন, শিক্ষার প্রসার, নির্মাণ কাজে জমি-অধিগ্রহণ ইত্যাদি নাগাদের মধ্যে ব্যাপক হারে বৃদ্ধি করে চলেছে কর্মপ্রার্থীদের সংখ্যা। শ্রমিক সরবরাহকারী ঠিকাদাররা আগে বিহার অঞ্চলের নিম্নবর্গীয়দের সস্তা শ্রমিক হিসেবে সরবরাহ করত। কৃষি অর্থনীতির বিপর্যয় দেখা দেওয়ায় ও আধুনিক কৃষি উপকরণের মাধ্যমে চাষবাসের জন্য কৃষিতে উদ্বৃত্ত শ্রমিকের প্রাদুর্ভাবের ফলে এই শ্রমিক-যোগানদাররা আসামের মুসলমান শ্রমিকদের সরবরাহ করতে শুরু করে। এই নতুন পরিবেশে দৈনন্দিন সামগ্রীর চাহিদার যোগান দিতে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ে সামিল হয় এই সম্প্রদায়ের অন্যান্য লোকেরা। নাগাল্যাণ্ডে বাইরে থেকে যে সব সামগ্রী যায় তা পরিবহণ হয় ট্রাকের মাধ্যমে। এই পরিবহণ ক্ষেত্রে নিযুক্ত শ্রমিকরাও মূলত এই সম্প্রদায়ভুক্ত। এভাবে গড়ে উঠে এক বড় মাপের অভিবাসী শ্রমিক যাদের অধিকাংশই বাঙালি মুসলিম।
নাগা সমাজের অভ্যন্তরীণ সামাজিক কাঠামোর পরিবর্তন ও অভিবাসীদের উপস্থিতি যে সামাজিক টানাপোড়েন তৈরি করেছে তা শ্রমিকের মজুরিকে নীচে নামিয়ে রাখার উপযোগী। যেহেতু আধুনিক কৃষি কাজে ও নির্মাণ শ্রমে নাগাদের দক্ষতার অভাব রয়েছে এবং স্থানীয় ভাষিক-সাংস্কৃতিক যোগাযোগকে কাজে লাগানোর সুযোগ থাকায় তাদের দরকষাকষির সুযোগও বেশি, তাই ঠিকাদাররা অভিবাসী শ্রমিকদের বেশী পছন্দ করে। কারণ তাতে কম মজুরিতে বেশি মুনাফা করা যায়। এই অভিবাসীরা স্থানীয় বাজারে নতুন চাহিদারও সৃষ্টি করেছে। সাম্প্রদায়িক ও জনগোষ্ঠীগত বিভাজনের পরিস্থিতি মজুরিকে ও সামাজিক সুরক্ষা প্রদানের ক্ষেত্রকে সঙ্কুচিত করে রাখে এবং মুনাফা কামানোর জন্য এধরনের পরিস্থিতি উপযোগী। কিন্তু ব্যবসায়িক স্বার্থে এই পরিস্থিতিকে এক সংঘাতের দিকে ঠেলে দিয়ে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটাতে চাইবে না ব্যবসায়িক মহল। সুতরাং ডিমাপুরের ন্যাক্কারজনক ঘটনার পেছনে যে সেইসব শক্তি ক্রিয়াশীল রয়েছে যারা বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারীর ইস্যুকে চাগিয়ে দিয়ে সাম্প্রদায়িক আধিপত্য বিস্তার করতে চায় এটা প্রায় নিশ্চিত। ন্যায়বিচারের প্রশ্নটি যে সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য সমাজ যখন এই বোধটুকু হারিয়ে ফেলে, যখন নিজের কাল্পনিক অপরকে ধ্বংস করে নিজেদের সমস্যার সমাধানের পথ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস প্রাধাণ্য পায়, তখন এধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তির সম্ভাবনাকে নাকচ করে দেওয়া যায় না।
বিশ্বায়ন ও অভিবাসী শ্রমিক
আজকের বিশ্বায়নের পরিস্থিতিতে প্রত্যন্ত অঞ্চলের কোন ঘটনাকেও বিশ্বব্যাপী সামগ্রিক ঘটনাপ্রবাহ থেকে খুব বেশী বিযুক্ত করা যায় না। ইউরোপীয় দেশগুলিতে যেভাবে অভিবাসী শ্রমিকদের আগমণ ঘটছে এবং তাদের প্রতি রাষ্ট্রীয় অমানবিক আচরণ পরিলক্ষিত হচ্ছে এবং অভিবাসী বিরোধী ফ্যাসিস্ট সামাজিক শক্তির উত্থান ঘটছে তা ভঙুর বিশ্ব-অর্থনীতির বিপদকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। ভারতবর্ষও যেহেতু একই অর্থনীতির পথিক, তাই অনুরূপ ঘটনার এক বিশ্বব্যাপী সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া যায়। পার্থক্য শুধু এটুকুই যে উন্নত দেশ ও অঞ্চলে যাওয়া অভিবাসী শ্রমিকদের দলে শুধুমাত্র কায়িক শ্রমিকরা নন, আইটি সেক্টরের মত ক্ষেত্রে দক্ষ বুদ্ধিজীবী শ্রমিকরাও রয়েছেন। অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের ফলে নিজের পরিবার পরিজন, স্থায়ী বসতবাটী ছেড়ে কায়িক শ্রমিকরা অন্যত্র পাড়ি দিচ্ছেন কাজের সন্ধানে এবং কাজের বিনিময়ে যে আয় হয় তাতে তাদের নিজেদের ও ফেলে আসা পরিবারের বেঁচে থাকার রসদ যোগাতে হয় কায়ক্লেশে। তাদের ভাগ্যে প্রায়শই জোটে ফাটকের আশ্রয়স্থল, পুলিশী হয়রানি ও জাতিগত নিপীড়ণ। চাকুরিয়ান শ্রমিকদের উপর প্রায়শই ঘটে যাওয়া জাতিবিদ্বেষী শারীরিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে অন্তত সরকার প্রতিবাদ জানায়, কিন্তু অসহায় কায়িক শ্রমিকদের হয়ে কথা বলার জন্য তাদের নিজেদের দুর্বল সংগঠন ছাড়া আর কেউ নেই। ডিমাপুরের সাম্প্রতিক ঘটনা আসলে বাঙালি মুসলমান অভিবাসীদের প্রতি ধারাবাহিক দৈনন্দিন অপমান অবহেলার ঘটনার প্রতি প্রশাসনিক প্রশ্রয়জনিত এক দুঃসাহসিক বহিঃপ্রকাশ। গাফিলতির এই ধারাবাহিকতার ফলেই ঘটনার দিনেও সেই প্রশাসনই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় বিফলতার চূড়ান্ত নিদর্শন প্রদর্শন করল।
উপসংহার
অপরকে ঘৃণা ও আক্রমণের ঘটনাকে অনেকে সাংস্কৃতিক মানদণ্ড দিয়ে বিচার করতে চান। যেমন, কেউ কেউ বলেন যে সাংস্কৃতিক ভিন্নতাকে কেন্দ্র করে একে অপরকে আক্রমণের বাতাবরণ তৈরির কোন উপাদান বরাক উপত্যকার সংস্কৃতির মধ্যে নেই, বরাকের সংস্কৃতিই সহিষ্ণুতার ধারক ও বাহক। বহু ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তিও এই সাংস্কৃতিক বয়ানের মধ্যেই সংঘাতের ব্যাখ্যা খুঁজতে চান। এই ভাষ্যের সাথে এক মত হওয়া যায় না, কারণ এই বয়ান ধর্মীয় সাম্প্রদায়িতাবাদীদের বয়ান (যেমন, হিন্দু ধর্মীয় সংস্কৃতি মানেই সহিষ্ণুতা) থেকে পৃথক কোন কিছুকে সূচিত করে না। আসলে সমাজের অভ্যন্তরীণ পরিবর্তনের ফলে দেখা দেওয়া সমস্যার গণতান্ত্রিক সমাধান যখন নাগালের ও ধারণার বাইরে থাকে, তখন সংঘাতময় পথে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটার সম্ভাবনা দেখা দেয়। বরাক উপত্যকায়ও এধরনের বিপদ দেখা দেওয়ার সম্ভাবনার প্রতি আমাদের সজাগ হতে হবে ও অপশক্তির মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় গণতান্ত্রিক শক্তি সঞ্চয় করতে হবে।
ক্রিয়া – প্রতিক্রিয়া
নাগাল্যাণ্ডের ডিমাপুরে করিমগঞ্জ জেলার ভাঙা অঞ্চলের বাসিন্দা শরিফ উদ্দিন খানের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করল বরাকবাসী ৮ মার্চ সর্বাত্মক বন্ধ পালনের মধ্য দিয়ে। শারীরিক অসুস্থতার কারণে বর্তমান নিবন্ধকারের এই বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের সক্রিয় প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার কোন উপায় ছিল না। এব্যাপারে সাময়িক প্রসঙ্গে লেখা দেওয়ার জন্য ফোন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার সুযোগ তৈরি করে দিল। যে কোন ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া থাকে, কিন্তু প্রতিক্রিয়া সবসময়ই বহুবিধ শর্ত-নির্ভর। এই শর্তগুলির অধিকাংশই ইতিহাস নির্ধারিত। তাই কোন সামাজিক ঘটনায় জাতি-ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণিভিত্তিক গোষ্ঠী-নির্ভর ও ব্যক্তিসত্ত্বার বৌদ্ধিক স্থিতি-নির্ভর বিচিত্র সব প্রতিক্রিয়ার এক ক্যানভাস সৃষ্টি হয়। বাস্তব পরিস্থিতি এবং সচেতন হস্তক্ষেপে এই প্রতিক্রিয়াগুলি এক সাধারণ গণতান্ত্রিক দিশা পেতে পারে, আবার ধ্বংসাত্মক দিকেও পরিচালিত হতে পারে। গণতান্ত্রিক অধিকার সুরক্ষা সমিতির সময়োচিত সঠিক হস্তক্ষেপ বরাক উপত্যকার গণতান্ত্রিক পরিবেশ রক্ষায় এক গুরুত্ত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
আক্রমণের মনস্তত্ত্ব
ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার উপরোক্ত এই সূত্রায়ন দিয়েই ডিমাপুরের গণ-উন্মাদনার বিষয়টিকে প্রাথমিকভাবে বিচার করে দেখা যাক। কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক চেতনাই যাদের নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় থাকে, তারা অনায়াসে বলে দিতে পারেন যে ধর্ষণের অভিযোগের প্রতিক্রিয়ায়ই এই গণ-হিস্টরিয়া ও বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড। জেল ভাঙার ঘটনা বাদ দিলে এধরনের হত্যার নজির আমাদের এই উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলিতে অতি-প্রাচীন না হলেও সাম্প্রতিককালে বহুবার ঘটেছে। এই ঘটনাগুলির আগসারিতে দেখা যায় একদল যুবক-বাহিনী। প্রাচীন মূল্যবোধ ও মোবাইল-ইন্টারনেট ব্যবহারে আধুনিক জীবনযাত্রার সংঘাতে এই যুবক বাহিনীর মধ্যে তৈরি হয়েছে একধরনের চিত্ত-বৈকল্য। তৈরি হয়েছে সামাজিক-আর্থিক মর্যাদায় বঞ্চিত, বিধ্বস্ত ও পরাজিত-মানসিকতা প্রসূত একধরনের নীতিহীন আক্রোশ। তাই তাদের পৌরুষ জেগে উঠে ন্যায়ের নামে নিরুপায়-নিঃসহায় টার্গেটের বিরুদ্ধে পেশীশক্তির পাশবিক প্রয়োগের মাধ্যমে। কিন্তু এ তো বাস্তবের শুধুমাত্র এক মনস্তাত্ত্বিক দিক। প্রশ্ন উঠতেই পারে যে তাদের পৌরুষ এক গণতান্ত্রিক পথে জাগ্রত হয়নি কেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে অনেকগুলি তাৎক্ষনিক ও দীর্ঘকালীন শর্তের মধ্যে যা গণ-প্রতিক্রিয়াকে এক পাশবিক পথে পরিচালিত করে।
সামাজিক দ্বন্দ্ব
২০১১ সালের জনগণনার হিসাবে নাগাল্যাণ্ডের জনসংখ্যার দশকীয় (decadal) বৃদ্ধি ঋণাত্মক (-০.৪০%)। নাগাল্যাণ্ডের রাজধানী শহর কোহিমা, কিন্তু বৃহত্তম শহর হচ্ছে ডিমাপুর। এই দুটি শহর সহ কতিপয় জেলা শহরেও জনসংখ্যা এই সময়কালে বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে বোঝা যায় যে ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রান্তের মত নাগাল্যাণ্ডের মূলত শহর সংলগ্ন পাহাড়ের পাদদেশের গ্রামাঞ্চল থেকে শহরের দিকে ক্রমাগত প্রব্রজন ঘটছে। প্রাচীন জনজাতীয় অর্থনীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ সামাজিক-সাংস্কৃতিক আচার-আচরণ আধুনিক জীবনচর্চার মানদণ্ডে গ্রহণযোগ্য বিবেচিত না হলেও এগুলি ছিল জীবনের রঙে রাঙানো। মুখ্যত ষোলটি জনজাতীয় গোষ্ঠীতে বিভক্ত নাগা সমাজ তাদের গোষ্ঠী-সমাজের চারপাশে গণ্ডি এঁকে দিয়েছিল – এটাই ছিল তাদের মানব-পৃথিবী। এই পৃথিবী গড়ে উঠেছে প্রকৃতি ও প্রকৃতির উপর গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষের বেঁচে থাকার শ্রম এবং ব্যবহারের জন্য অতি-প্রাচীন সরল সব হাতিয়ারের উপর ভিত্তি করে। কিন্তু আধুনিক ব্রিটিশ শাসকদের হস্তক্ষেপ, মিশনারীদের ভূমিকা এবং পরবর্তীতে ভারতীয় রাষ্ট্রের দীর্ঘকালীন শাসন ব্যবস্থায় জনজাতীয় সমাজ গাঁথনি ভেঙে পড়েছে। আধুনিক সমাজের উপকরণের সাথে পরিচয় ও তার ব্যবহার জনজাতীয় চরিত্র পালটে দিয়েছে। স্বাধীনচেতা নাগা সমাজ তাদের স্বাধীন শাসন ব্যবস্থা বজায় রাখার সংগ্রাম বরাবরই অব্যাহত রেখেছে এবং তা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক রূপ পরিগ্রহ করেছে। কিন্তু দ্রুত নগরায়ন, আধুনিক উৎপাদন প্রক্রিয়া ও ব্যবসা-বাণিজ্যের সাথে যুক্ত হওয়ার বাস্তব চাপ রয়েছে এবং ফলে শহরের দিকে ধাবিত হচ্ছে নাগা সমাজের বহু লোক। কিন্তু সেখানে বিভিন্ন ধরণের নির্মাণ কাজে সরকারি-বেসরকারি ঠিকাদাররা সস্তা শ্রমিক হিসেবে মূলত আসামের বাঙালি মুসলমান, বিহার-ওড়িষার নিম্নবর্গীয় সমাজের লোকদের নিয়োগ করেছে। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ে অভিজ্ঞ এই সম্প্রদায়ের লোকেরা সেখানে ক্ষুদ্র ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে সেখানকার স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে পড়েছে। এই পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে এক সামাজিক টানাপড়েন। আমাদের বোঝা দরকার এই সামাজিক টানাপড়েনের পরিস্থিতিতে কারা বেশী লাভবান, কোন ন্যস্ত স্বার্থ জড়িত এই দ্বন্দ্বকে এক সংঘাতময় পরিণতি ও ঘৃণার বাতাবরণে রূপান্তরিত করার পেছনে? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে পারিপ্বার্শিক কিছু বিষয় যাচাই করে দেখা যাক।
দীর্ঘম্যাদী ও তাৎক্ষণিক কারণ
উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বাঙালি-মুসলমান বিরোধী উগ্রজাতিয়তাবাদী-সাম্প্রদায়িক প্রচারের এক দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। দেশ-বিভাজনের প্রেক্ষিতে নেহেরু-লিয়াকত চুক্তি ও বাংলাদেশ গঠনের প্রেক্ষিতে ইন্দিরা-মুজিব চুক্তির শর্তগুলির কথা বিবেচনায় না রেখে মনগড়া পরিসংখ্যান, মিথ্যা তথ্য ও সাজানো ঘটনাকে কেন্দ্র করে তথাকথিত বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী ও ধর্মীয়-ভাষিক সংখ্যালঘু বিরোধী এক ধারাবাহিক উগ্র-জাতিয়তাবাদী-সাম্প্রদায়িক প্রচার করে চলেছে ক্ষমতাবান শ্রেণি ও তাদের মতাদর্শগত মেন্টর সংগঠনগুলো। এই অবাস্তব আখ্যান মোটামুটিভাবে সব প্রতিষ্ঠিত দলই আত্মস্থ করে নিয়েছে, কিন্তু জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে মানুষের ঐক্যে বিঘ্ন ঘটানোর এই প্রচারে সবচাইতে অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করে চলেছে বিজেপি দলের মতাদর্শগত মেন্টররা। সংখ্যালঘু অধিকারের প্রশ্নটি শুধুমাত্র উত্তর-পূর্বাঞ্চলে নয়, পার্শ্ববর্তী দেশগুলিতেও এক মুখ্য বিচার্য বিষয় হয়ে রয়েছে। মায়ান্মারে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে সে দেশের বিভিন্ন জনজাতীয় গোষ্ঠীদের মধ্যে ঐক্য গড়ার যে প্রয়াস তার বাইরে রোহিঙ্গিয়া মুসলিমদের রেখে দেওয়া হয়েছে এবং তাদের উপর সবসময় ঝুলতে থাকে আক্রমণের খাঁড়া। বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রে বাঙালি জাতিসত্তার প্রশ্নটি যেহেতু কেন্দ্রীয় বিষয় ছিল, তাই সেখানে মুসলিম সাম্প্রদায়িক শক্তি আজও মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি একথা সত্য। কিন্তু হিন্দু-সংখ্যালঘু অধিকারের বিষয় সেখানেও নিশ্চিতভাবে গণতন্ত্র বিকাশের সাথে সংপৃক্ত। প্রশ্ন উঠতেই পারে যে নাগাল্যাণ্ডের প্রেক্ষিতে এই বিষয়গুলি কতটা প্রযোজ্য যেখানে মোট জনসংখ্যার ৯০.০২% খ্রীষ্টান, ৭.৭% হিন্দু ও ১.৮% মুসলমান? প্রথমত নাগাল্যাণ্ডে আসাম থেকে যাওয়া মুসলমানদের মাতৃভাষা বাংলা। সব মুসলমানদের বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী হিসেবে দেখানোর সার্বিক প্রচার নাগা ভাষিক চেতনায় প্রভাব বিস্তার করে বিশেষ করে উপরোক্ত সামাজিক টানাপড়েনের পরিস্থিতিতে। এবং দ্বিতীয়ত, নাগাল্যাণ্ডের মোট প্রায় ২০ লাখ জনসংখ্যার প্রায় ১.৫ লাখ হিন্দু ও ৩৫ হাজার মুসলমান। এই দেড় লাখ হিন্দুদের মধ্যে ৯২ হাজার ডিমাপুরের ও ২২ হাজার কোহিমার বাসিন্দা এবং মুসলিম জনসংখ্যার প্রায় পুরোটাই এই দুই জেলার বাসিন্দা। সুতরাং ডিমাপুরই হচ্ছে প্রধান জায়গা যেখানে বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী বিরোধী ধারাবাহিক অপপ্রচারের এক বড় মাপের শ্রোতা রয়েছে এবং তারা এই অপপ্রচারের সংগঠকদের স্থানীয় আশ্রয়স্থলও। উপরন্তু ডিমাপুর আসাম সংলগ্ন হওয়ায় ও আসাম থেকে সুগম যাতায়াতের ব্যবস্থা থাকায় তৃণমূলে এধরনের প্রচারকার্য চালানো সুবিধেজনক। সুতরাং ডিমাপুরের শরিফ হত্যার বর্বরোচিত ঘটনার পেছনে এধরনের দীর্ঘকালীন অপপ্রচার যে অপ্রত্যক্ষ কারণ হিসেবে কাজ করেছে এতে কোন সন্দেহ নেই। জনগণকে উত্তেজিত করার জন্য তাৎক্ষণিক প্রত্যক্ষ উদ্যোগের পেছনে এই প্রচারের তৃণমূল সংগঠকদের কোন ভূমিকা রয়েছে কিনা তা অনুসন্ধানের বিষয়। এই তাৎক্ষণিক চক্রান্তের পর্দা ফাঁস করতেই প্রয়োজন নিরপেক্ষ তদন্ত ও তদন্তমূলক সাংবাদিকতা যা আজকাল প্রায় উঠেই গেছে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে আসাম নির্বাচন আর বেশী দূরে নেই এবং তাই পার্শ্ববর্তী কোন অঞ্চলের ঘটনা নির্বাচনী মেরুকরণের উদ্দেশ্যেও সংগঠিত হতে পারে। আমাদের সৌভাগ্য যে বরাকবাসী এখন পর্যন্ত প্রতিটি ঘটনার সুনিয়ন্ত্রিত প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।
অভিবাসী মুসলমান বনাম আক্রমণের মদতদাতা
নাগাল্যাণ্ডে কৃষি ক্ষেত্র ছাড়া নিয়োগের প্রধান মাধ্যম সড়ক, ভবন, টাওয়ার ইত্যাদি পরিকাঠামোগত নির্মাণ কার্যে সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ। এই সব কাজে স্থানীয় নাগা জনগোষ্ঠীর যুবকরা ঠিকাদার ও উপ-ঠিকাদার হিসেবে যুক্ত হচ্ছে। এই কাজগুলি মূলত ডিমাপুর ও কোহিমাকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হচ্ছে। উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া আধুনিকতার ফলে জনজাতীয় অর্থনীতির পরিবর্তন, শিক্ষার প্রসার, নির্মাণ কাজে জমি-অধিগ্রহণ ইত্যাদি নাগাদের মধ্যে ব্যাপক হারে বৃদ্ধি করে চলেছে কর্মপ্রার্থীদের সংখ্যা। শ্রমিক সরবরাহকারী ঠিকাদাররা আগে বিহার অঞ্চলের নিম্নবর্গীয়দের সস্তা শ্রমিক হিসেবে সরবরাহ করত। কৃষি অর্থনীতির বিপর্যয় দেখা দেওয়ায় ও আধুনিক কৃষি উপকরণের মাধ্যমে চাষবাসের জন্য কৃষিতে উদ্বৃত্ত শ্রমিকের প্রাদুর্ভাবের ফলে এই শ্রমিক-যোগানদাররা আসামের মুসলমান শ্রমিকদের সরবরাহ করতে শুরু করে। এই নতুন পরিবেশে দৈনন্দিন সামগ্রীর চাহিদার যোগান দিতে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ে সামিল হয় এই সম্প্রদায়ের অন্যান্য লোকেরা। নাগাল্যাণ্ডে বাইরে থেকে যে সব সামগ্রী যায় তা পরিবহণ হয় ট্রাকের মাধ্যমে। এই পরিবহণ ক্ষেত্রে নিযুক্ত শ্রমিকরাও মূলত এই সম্প্রদায়ভুক্ত। এভাবে গড়ে উঠে এক বড় মাপের অভিবাসী শ্রমিক যাদের অধিকাংশই বাঙালি মুসলিম।
নাগা সমাজের অভ্যন্তরীণ সামাজিক কাঠামোর পরিবর্তন ও অভিবাসীদের উপস্থিতি যে সামাজিক টানাপোড়েন তৈরি করেছে তা শ্রমিকের মজুরিকে নীচে নামিয়ে রাখার উপযোগী। যেহেতু আধুনিক কৃষি কাজে ও নির্মাণ শ্রমে নাগাদের দক্ষতার অভাব রয়েছে এবং স্থানীয় ভাষিক-সাংস্কৃতিক যোগাযোগকে কাজে লাগানোর সুযোগ থাকায় তাদের দরকষাকষির সুযোগও বেশি, তাই ঠিকাদাররা অভিবাসী শ্রমিকদের বেশী পছন্দ করে। কারণ তাতে কম মজুরিতে বেশি মুনাফা করা যায়। এই অভিবাসীরা স্থানীয় বাজারে নতুন চাহিদারও সৃষ্টি করেছে। সাম্প্রদায়িক ও জনগোষ্ঠীগত বিভাজনের পরিস্থিতি মজুরিকে ও সামাজিক সুরক্ষা প্রদানের ক্ষেত্রকে সঙ্কুচিত করে রাখে এবং মুনাফা কামানোর জন্য এধরনের পরিস্থিতি উপযোগী। কিন্তু ব্যবসায়িক স্বার্থে এই পরিস্থিতিকে এক সংঘাতের দিকে ঠেলে দিয়ে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটাতে চাইবে না ব্যবসায়িক মহল। সুতরাং ডিমাপুরের ন্যাক্কারজনক ঘটনার পেছনে যে সেইসব শক্তি ক্রিয়াশীল রয়েছে যারা বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারীর ইস্যুকে চাগিয়ে দিয়ে সাম্প্রদায়িক আধিপত্য বিস্তার করতে চায় এটা প্রায় নিশ্চিত। ন্যায়বিচারের প্রশ্নটি যে সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য সমাজ যখন এই বোধটুকু হারিয়ে ফেলে, যখন নিজের কাল্পনিক অপরকে ধ্বংস করে নিজেদের সমস্যার সমাধানের পথ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস প্রাধাণ্য পায়, তখন এধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তির সম্ভাবনাকে নাকচ করে দেওয়া যায় না।
বিশ্বায়ন ও অভিবাসী শ্রমিক
আজকের বিশ্বায়নের পরিস্থিতিতে প্রত্যন্ত অঞ্চলের কোন ঘটনাকেও বিশ্বব্যাপী সামগ্রিক ঘটনাপ্রবাহ থেকে খুব বেশী বিযুক্ত করা যায় না। ইউরোপীয় দেশগুলিতে যেভাবে অভিবাসী শ্রমিকদের আগমণ ঘটছে এবং তাদের প্রতি রাষ্ট্রীয় অমানবিক আচরণ পরিলক্ষিত হচ্ছে এবং অভিবাসী বিরোধী ফ্যাসিস্ট সামাজিক শক্তির উত্থান ঘটছে তা ভঙুর বিশ্ব-অর্থনীতির বিপদকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। ভারতবর্ষও যেহেতু একই অর্থনীতির পথিক, তাই অনুরূপ ঘটনার এক বিশ্বব্যাপী সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া যায়। পার্থক্য শুধু এটুকুই যে উন্নত দেশ ও অঞ্চলে যাওয়া অভিবাসী শ্রমিকদের দলে শুধুমাত্র কায়িক শ্রমিকরা নন, আইটি সেক্টরের মত ক্ষেত্রে দক্ষ বুদ্ধিজীবী শ্রমিকরাও রয়েছেন। অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের ফলে নিজের পরিবার পরিজন, স্থায়ী বসতবাটী ছেড়ে কায়িক শ্রমিকরা অন্যত্র পাড়ি দিচ্ছেন কাজের সন্ধানে এবং কাজের বিনিময়ে যে আয় হয় তাতে তাদের নিজেদের ও ফেলে আসা পরিবারের বেঁচে থাকার রসদ যোগাতে হয় কায়ক্লেশে। তাদের ভাগ্যে প্রায়শই জোটে ফাটকের আশ্রয়স্থল, পুলিশী হয়রানি ও জাতিগত নিপীড়ণ। চাকুরিয়ান শ্রমিকদের উপর প্রায়শই ঘটে যাওয়া জাতিবিদ্বেষী শারীরিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে অন্তত সরকার প্রতিবাদ জানায়, কিন্তু অসহায় কায়িক শ্রমিকদের হয়ে কথা বলার জন্য তাদের নিজেদের দুর্বল সংগঠন ছাড়া আর কেউ নেই। ডিমাপুরের সাম্প্রতিক ঘটনা আসলে বাঙালি মুসলমান অভিবাসীদের প্রতি ধারাবাহিক দৈনন্দিন অপমান অবহেলার ঘটনার প্রতি প্রশাসনিক প্রশ্রয়জনিত এক দুঃসাহসিক বহিঃপ্রকাশ। গাফিলতির এই ধারাবাহিকতার ফলেই ঘটনার দিনেও সেই প্রশাসনই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় বিফলতার চূড়ান্ত নিদর্শন প্রদর্শন করল।
উপসংহার
অপরকে ঘৃণা ও আক্রমণের ঘটনাকে অনেকে সাংস্কৃতিক মানদণ্ড দিয়ে বিচার করতে চান। যেমন, কেউ কেউ বলেন যে সাংস্কৃতিক ভিন্নতাকে কেন্দ্র করে একে অপরকে আক্রমণের বাতাবরণ তৈরির কোন উপাদান বরাক উপত্যকার সংস্কৃতির মধ্যে নেই, বরাকের সংস্কৃতিই সহিষ্ণুতার ধারক ও বাহক। বহু ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তিও এই সাংস্কৃতিক বয়ানের মধ্যেই সংঘাতের ব্যাখ্যা খুঁজতে চান। এই ভাষ্যের সাথে এক মত হওয়া যায় না, কারণ এই বয়ান ধর্মীয় সাম্প্রদায়িতাবাদীদের বয়ান (যেমন, হিন্দু ধর্মীয় সংস্কৃতি মানেই সহিষ্ণুতা) থেকে পৃথক কোন কিছুকে সূচিত করে না। আসলে সমাজের অভ্যন্তরীণ পরিবর্তনের ফলে দেখা দেওয়া সমস্যার গণতান্ত্রিক সমাধান যখন নাগালের ও ধারণার বাইরে থাকে, তখন সংঘাতময় পথে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটার সম্ভাবনা দেখা দেয়। বরাক উপত্যকায়ও এধরনের বিপদ দেখা দেওয়ার সম্ভাবনার প্রতি আমাদের সজাগ হতে হবে ও অপশক্তির মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় গণতান্ত্রিক শক্তি সঞ্চয় করতে হবে।