১৯৮৩র অসমঃ নিপীড়িত বাঙালি হিন্দু

Posted by সুশান্ত কর Labels: , , , , ,



দিগন্ত শর্মা
(দিগন্ত শর্মা, সাদিন কাগজের সাংবাদিক এবং অনুসন্ধানী লেখক। এর আগে তিনি  ‘ নেলি ১৯৮৩নামে একটি অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদন লিখেছিলেন তিনি। বর্তমান অনুবাদক  সেটি বাংলাতে অনুবাদ করেছিলাম। দু’টিই আগে পরে বই হিসেবে বেরোয়। সেই বইতে মূলত ধরা হয়েছিল ধর্মীয় সংখ্যালঘু তথা মুসলমানদের  উপরে নেমে আসা আক্রমণের  ছবি। এবারে বাঙালি হিন্দুর উপরে কেমন অত্যাচার নেমে এসেছিল, সেই প্রশ্নের উত্তর সন্ধানে তিনি ঘুরেছেন ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার  পূব থেকে পশ্চিমে। আর লিখছেন এই নিবন্ধ। ধারাবাহিক ভাবে এটি এই ব্লগ ছাড়াও প্রকাশিত হবে, আরো দুই একটি ব্লগে এবং ছাপার অক্ষরে বেরুবে শিলচর থেকে প্রকাশিত চন্দন সেনগুপ্ত সম্পাদিত মাসিক ‘অরুণোদয়ে’। লেখকের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে যোগাযোগ করুন, এই নম্বরে: ৯৮৫৪৬-৩১৯২৮। )
( মিছিলা নমশূদ্র)


মূল অসমিয়াঃ দিগন্ত শর্মা

বাংলা অনুবাদঃ সুশান্ত কর





প্রস্তাবনা
             ৯৭৯এর প্রথম ভাগে অসমের মঙ্গলদৈ লোকসভা সমষ্টির সাংসদ হীরালাল পাটোয়ারির আকস্মিক মৃত্যু হয়। সে বছরের শেষের দিকে আসনে উপনির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেয় নির্বাচন আয়োগ। একই সঙ্গে ঐ বছরের এপ্রিল মাস থেকে ভোটার তালিকাতে নাম ভুক্তির কাজ আরম্ভ করে। মেমাস অব্দি এই ভোটার তালিকা সংশোধনের কাজ অব্যাহত ছিল। কিন্তু মেমাসের প্রথম সপ্তাহে ভোটার তালিকাতে প্রচুর অবৈধ বিদেশীর নাম ঢোকে গেছে বলে এক অভিযোগ উত্থাপিত হয়  বলা হয়, কংগ্রেস (আই) দল নিজের ভোট ব্যাঙ্ক শক্তিশালী করতে কৌশলে  সন্দেহজনক নাগরিকের নাম ভোটার তালিকাতে ঢুকিয়েছে।  এই অভিযোগ উত্থাপন করে পুরো আসাম কাঁপিয়ে তোলে সারা আসাম ছাত্র সংস্থা  এর আগে অসমে বিদেশী অনুপ্রবেশ থেকে শুরু করে বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের দাবিতে সারা আসাম ছাত্র সংস্থা, সংক্ষেপে ‘আসু’ বিভিন্ন প্রতিবাদী কর্মসূচী রূপায়ণ করে আসছিল। অন্যদিকে সংসদে তখন ভারতীয় জনতা পার্টির নেতা অটল বিহারি বাজপেয়ী ১৯৭৯র আগেই অসম সহ সমগ্র পূর্বোত্তরে বাংলাদেশীদের অবাধ অনুপ্রবেশ হচ্ছে বলে বক্তব্য রেখেছিলেন। সেই বক্তব্য অসমের একাংশ সচেতন ব্যক্তি, রাজনৈতিক নেতা এবং ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্বকে আন্দোলনমুখী করে তোলে। এর আগে ‘আসু’ মুখ্যমন্ত্রী গোলাপ বরবরাকে কয়েক দফা দাবি সম্বলিত স্মারকপত্র প্রদান করেছিল। এমনকি তারা প্রধানমন্ত্রীকেও সত্তর দশকের মধ্য ভাগ থেকেই নানা দাবিতে স্মারকপত্র দিয়ে আসছিল। কিন্তু কেন্দ্রের সরকার সেই সব সমস্যা সমাধানের জন্যে বিশেষ কোনো পদক্ষেপ নেয় নি। ১৯৭৭এ জরুরি অবস্থার পরে কেন্দ্রের সরকার বদল হলো।  অসমেও সরকার বদল হলো। একই সময়ে অত্যন্ত শক্তিশালী ছাত্র সংগঠন সারা আসাম ছাত্র সংস্থারও নেতৃত্ব বদল হলো। আসুর নেতৃত্বে এলেন প্রফুল্ল কুমার মহন্ত এবং ভৃগু কুমার ফুকন।  মঙ্গলদৈ লোকসভা আসনের উপনির্বাচনকে কেন্দ্র করে উত্থাপিত বিদেশী নাগরিকের প্রশ্নটিকে আসুনেতৃত্ব বড় করে তোলে ধরলেন। মঙ্গলদৈ লোকসভা চক্রে ভোটার তালিকাতে বিদেশী নাগরিকের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে বলে নির্বাচনী আয়োগের কার্যালয়ে হাজার হাজার অভিযোগ পত্র প্রেরণ করে। নির্বাচনী আয়োগ সেগুলো পরীক্ষা নিরীক্ষাও করেন। গুরুত্বপূর্ণ কথা এই যে নির্বাচন আয়োগও এই সব অভিযোগ-পত্রের ৬৪.২৮% সত্য বলে ঘোষণাও করে। অর্থাৎ আয়োগ স্বীকার করে নেয় যে প্রায় ৪৫,০০০ ভোটার এই চক্রে       সন্দেহজনক নাগরিক।
          
              
           
মিছিলা নমশূদ্র
এই ঘটনা পুরো আসামকে উত্তেজিত করে তোলে। মঙ্গলদৈর ঘটনাকে আধার করে আসু দাবি তোলে সারা রাজ্যের ১৩টি লোকসভা আসনের ভোটার তালিকাই প্রকাশ করতে হবে এবং বিদেশী নাগরিকের নাম সেগুলোর থেকে বাদ দিতে হবে।  মঙ্গলদৈর ঘটনা রাজ্যের ভূমিপুত্র এবং মধ্যবিত্তদের একাংশকে উত্তেজিত এবং আবেগিক করে তোলে। তাদের বিদেশী বহিষ্কারের দাবিকে আসামের আরো কিছু জাতীয় সংগঠনও সমর্থন জানায়।  বিশেষ করে পূর্ববঙ্গ থেকে অসমে প্রব্রজন অব্যাহত আছে বলে ব্যাপক প্রচার চালানো হয়।  ১৯৭৯তে ‘আসু’র নেতৃত্বে বিভিন্ন দল-সংগঠনের এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেই সর্বদলীয় সভাতে সারা আসাম গণ-সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলা হয়। ‘আসু’র নেতারাই এর নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। অসম সাহিত্য সভাও এই সংগঠনে সামিল হয়।আসুর সভাপতি প্রফুল্ল কুমার মহন্ত ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে এক স্মারক পত্র প্রেরণ করেন, যেখানে অসমে অস্বাভাবিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির পরিসংখ্যা তুলে ধরা হয়। এর পরেই আরম্ভ হয় আন্দোলনের কর্মসূচী---প্রতিবাদী মিছিল, বন্ধ, গণ-সত্যাগ্রহ ইত্যাদি ইত্যাদি...।
         
             
দিগন্ত শর্মার আগেকার বইএর বাংলানুবাদের প্রচ্ছদ
     দিল্লিতে সরকার বদল হয়। ইন্দিরা গান্ধি আবার রাজপাট দখল করেন। দিসপুরে বারবার সরকার গঠন এবং পতনের ঘটনা ঘটে। ‘আসু’র বিদেশী কেন্দ্রিক আন্দোলন সারা রাজ্যকে উত্তাল করে তোলে। সংগঠিত হয় নানা হিংসাত্মক ঘটনা। এরই মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে আন্দোলনকারী নেতৃত্বের কয়েক দফা বৈঠক হয়ে যায় কিন্তু এই সব আলোচনা-বৈঠক সমস্যার কোনো সমাধান করতে পারল না। আন্দোলনকারী নেতৃত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের প্রস্তাব মেনে নিতে রাজি হলো না। ফল-স্বরূপে অসম থেকে এই বিদেশী বিতাড়ন বা বহিষ্কার এক জ্বলন্ত সমস্যা রূপে মাথা তোলে। আসু, গণ-সংগ্রাম পরিষদ তথা আন্দোলনকারী নেতা, কর্মী, সমর্থকেরা বিদেশীর বিরুদ্ধে নিজেরাই ব্যবস্থা নিতে গোপনে শলা-পরামর্শ করতে শুরু করে। ‘বিদেশীরা আছে কই?’ ‘বিদেশী কারা?’ ‘ বিদেশী প্রধান অঞ্চল কোনগুলো...?’ এসব কথার ব্যাপক গুঞ্জন ওঠে।  একাংশ লোক ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাতে  বাঙালি হিন্দু এবং মুসলমান বসতি-প্রধান এলাকাগুলোই বিদেশীর বাসস্থান  বলে চিহ্নিত করে।  সেই প্রব্রজনকারী বা আভ্যন্তরীনভাবে স্থানান্তরিত (internally displaced) মানুষ যে এলাকাগুলো দখল করে বসতি স্থাপন করেছিলেন সেই এলাকাগুলো দখলমুক্ত করবার জন্যে একাংশ নেতা-কর্মীদের গোপন আহ্বান  ছড়িয়ে দেয়া হয়।  আন্দোলনের সমর্থক হাজার হাজার মানুষ এই সব ‘বিদেশী’দের তাড়িতে দেবার জন্যে নানা পদক্ষেপ নিতে শুরু করেন, কোথাও বা তা হিংসাত্মক আকারও নেয়। একই সঙ্গে ‘আসু’, গণ-সংগ্রাম পরিষদ নেতৃত্ব প্রশাসনযন্ত্রকেও অচল করে দেবার জন্যে বহু গোপন বেআইনি কর্মসূচী শুরু করে। এরই মধ্যে ইন্দিরা গান্ধি নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার ১৯৮৩র ফেব্রুয়ারি মাসে অসম বিধান সভার সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ১৯৭৯র থেকে বেশ কবার অসম রাষ্ট্রপতি শাসনাধীনও ছিল। সেখানে কেন্দ্রের কংগ্রেস (ই) সরকার নির্বাচন করবার সিদ্ধান্ত নিলে তাকে প্রত্যাহ্বান জানিয়ে উচ্চতম ন্যায়ালয়ে আবেদন করা হয়। ন্যায়ালয় সেই আবেদন ১ ফেব্রুয়ারি তারিখে প্রত্যাখ্যান করে। ইন্দিরা গান্ধি সঙ্গে সঙ্গে যে সব কর্মচারী নির্বাচনের কাজে  অংশ নেবেন তাদের জন্যে গ্রুপ ইন্সিওরেন্সের সুবিধে দেবার কথা ঘোষণা করেন। আর ঐ ১ ফেব্রুয়ারির থেকেই অসম পরিণত হয় এক জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে। জাতীয় সংগঠনগুলোর বিরোধিতাকে অবজ্ঞা করে ইন্দিরা গান্ধি নির্বাচনী প্রচারও করেন। অসমের ভূমিপুত্রের (খিলঞ্জিয়া) একাংশ এই নির্বাচনকে অবৈধ আখ্যা দেন। আন্দোলনকারীরা নির্বাচন বয়কটের আহ্বান জানান। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার অধিকাংশ মানুষ এই আহ্বানকে সমর্থন জানান। পুলিশ ফাঁড়ি ঘেরাও, রাস্তা-ঘাট বন্ধ, সেতু জ্বালিয়ে দেয়া ইত্যাদি আরম্ভ হয়। পুলিশের গুলিতে বেশ কিছু ছাত্রনেতার মৃত্যুও হয়। রাজ্যের পরিস্থিতি হয়ে পড়ে অগ্নিগর্ভ। ওদিকে বাঙালি অধ্যুষিত বিভিন্ন       অঞ্চলে আক্রমণ নামাবার গোপন পরিকল্পনা প্রস্তুত করা হয়। অসমিয়ার অস্তিত্ব রাখতে অসমকে বিদেশী মুক্ত করতেই হবেতারজন্যে বিদেশী তাড়াতে হবে। ‘আহ আহ ওলাই আহ! খেদ ঐ খেদ , বিদেশীক খেদ!’ স্লোগানে মুখরিত হয় আকাশ। কিন্তু কোথাকার বিদেশী তাড়াবে?  কিছু নেতারা বিভিন্ন জেলার চরঅঞ্চল, বনাঞ্চল, গ্রেজিং এলাকা, পতিত ভূমি, সরকারি খাস জমিতে বসবাস করা বাঙালি হিন্দু –মুসলমানকে বিদেশি বলে শনাক্ত করে  সেই এলাকাগুলোতে পরিকল্পিত ভাবে আক্রমণ নামাতে শুরু করেনমঙ্গলদৈ চাউলখোয়া চরঅঞ্চল, নগাঁও (এখনকার মরিগাঁও) জেলার নেলি অঞ্চল, মৈরাবাড়ি, কামপুর, চামগুড়ি, কামরূপ জেলার গোরেশ্বর, চমরিয়া, নলবাড়ির মোকালমোয়া, দরং জেলার খৈরাবাড়ি-কলাই গাঁও ইত্যাদি জায়গাতে আন্দোলনকারীরা নৃশংস আক্রমণ নামায়।  সেরকম এখনকার ধেমাজি জেলার  (তখনকার লখিমপুর জেলা)  বিষ্ণুপুর, শান্তিপুর  ইত্যাদির বাসিন্দা হিন্দু বাঙালিদের উপরে ফেব্রুয়ারির ১৪ তারিখ থেকে ধারাবাহিকভাবে ভয়াবহ  আক্রমণ  নেমে আসে। অসমিয়া এবং জনজাতীয় হাজার হাজার মানুষ একত্রিত হয়ে অত্যন্ত নির্মম এবং জঘন্য আক্রমণ নামায় শিলাপাথারের কাছে ‘আর্নে’ বলে এক বিশাল চরঅঞ্চলে। সেই নিরীহ বাঙালিরা বিদেশী বহিষ্কার আন্দোলনে  সৃষ্ট সংঘাতময় পরিবেশের কেমন বলি হয়েছিলেন, সেই সংঘাতের আগেকার এবং পরবর্তী প্রব্রজন  (Migration) বা স্থানান্তরণ (Displacement)  পরিস্থিতি, সংঘাত পরবর্তী ন্যায় ব্যবস্থার এই সব মানুষের জীবনে কী রকম প্রভাব ফেলেছে, পরবর্তী কালে শান্তি স্থাপনের ক্ষেত্রে এই সব নির্যাতিত মানুষের ভূমিকা কী ছিল... অগ্নিগর্ভ ১৯৮৩ সনের ফেব্রুয়ারি মাসে সারা আসামেই বাঙ্গালিরা কী রকম নির্যাতিত হয়েছিলেন---ক্ষেত্র-ভিত্তিক অধ্যয়ন করে এই লেখাটি তৈরি করা হয়েছে।
                                                                       

(এক)

সবুজ আর্নে চরের রক্তাক্ত অধ্যায়
           
         
  ছেঁড়া পা ছুঁয়ে মিছিলা নমশূদ্র নীরবে কাঁদছিলেন
       ‘সেদিন সকালে উঠে বাড়িতে এটা ওটা করছিলাম। ছেলেমেয়েরা উঠোনে ছিল। ওদের বাবা একবার ঘরে যান, আরেকবার আসেন। গ্রামের বুঝদার মানুষেরা দিন দুই আগেই ধেমাজির দিকে অনেক বড় গণ্ডগোলের কথা শুনেছিলেন।  সেদিনও আমাদের গ্রামের উত্তর দিকে অনেক হৈ হট্টগোল কানে আসছিল। কোথায় কী হচ্ছে---কিছুই ধরতে পারছিলাম না। কিন্তু হঠাৎই সকালে সকালে আমাদের গ্রামেও চিৎকার চেঁচামেচি, হুলস্থূল, কান্নাকাটি, মার ধর আরম্ভ হয়ে গেলো। হাজার হাজার লোকে ঘিরে ফেলল আমাদের গ্রাম। ওদের হাতে দা, বর্শা, বল্লম, বন্ধুক, তির-ধনুক, লাঠি আর জ্বালানো মশাল...। গ্রামের লোকেরা পালাতে শুরু করলে যাকে যেখানে পেলো কোপাতে শুরু করল। আক্রমণকারীদের কেউ বা লাঠি দিয়ে মারল, কেই তির ধনুকে, কেউ বা বন্দুক দিয়ে গুলি করল। আমি বাড়ির উঠোন থেকে ছেলেমেয়ে দুটোর হাতে ধরে প্রাণ বাঁচাতে দৌড় দিলাম। আমার স্বামী আর বড় মেয়ে রীণাও দৌড় দিল। কিন্তু সেরকম দৌড়োচ্ছি যখন তখনি অস্ত্র হাতে লোকগুলো আমাদের ঘিরে ফেলল। ওদের কেউ একজন আমাকে লম্বা একটা ডেগার দিয়ে ঘা বসালো। ঘাটা আমার পায়ে লেগে পা একটা দুই টুকরো হয়ে গেলো। হাঁটুর নিচের টুকরোটি ছিটকে দূরে পড়ে গেলো আর আমি অজ্ঞান হয়ে গেলাম।” কথাগুলো বলে মিছিলা নমশূদ্র নামের পঁয়ষট্টি বছরের মহিলা থামলেন কিছুক্ষণ। শাড়ির আঁচলে দুই গাল বেয়ে নামা চোখের জল মুছলেন। খানিকক্ষণ তিনি মাথা নত করে রইলেন। একটি পিড়িতে বসে কথা বলছিলেন তিনি। এইবারে তিনি দুই হাতে শাড়ি কুঁচকে বাঁ পা দেখালেন ---‘এই দেখুন...’
           মিছিলা নমশূদ্র যখন আমাদের কথাগুলো বলছিলেন কচি কাঁচা ছেলে মেয়ে, যুবক যুবতী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা পাশে দাঁড়িয়ে বসে সব কথাই শুনছিলেন। কিছুক্ষণ সবাই নির্বাক হয়ে পড়লেন। নীরবতা ভেঙ্গে আমরাই মহিলাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তার পরে কী হলো?’
 ‘তারপরে আমি সেখানেই পড়ে রইলাম। পরে গ্রামের অন্য মানুষকে সঙ্গে নিয়ে আমাকে তুলে নিয়ে এলেন স্বামী। জ্ঞান যখন ফিরে এলো, আমার অবশিষ্ট পাটুকু কাপড়ে বাঁধা ছিল। অসহ্য ব্যথায় আমি ছটফট করছিলাম। এরই মধ্যে আমি স্বামীকে জিজ্ঞেস করলাম ছেলেমেয়ের কথা। তখনই তিনি হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলেন। বললেন, আমাদের বারো বছরের ছেলে বিজয় আর ছয় বছরের মেয়ে শ্রীমতীকে ঘাতকেরা কেটে মেরে ফেলেছে। আমি যেখানে পড়ে ছিলাম, সেখানেই বুঝি বিজয় আর শ্রীমতীরও মৃতদেহ পড়ে ছিল।  স্বামীকে জিজ্ঞেস করলাম, বড় মেয়ে রীণা কই? তিনি বললেন, রীণার (১৬) হাতে দায়ের ঘা পড়েছে, পিঠে একটা তির বিঁধেছে। ওকে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখে হয়তো ওরা মৃত বলে ভেবেছিল, ছেড়ে চলে গেছে। আমার পা কাটার যন্ত্রণা দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিল এই সন্তান হারাবার দুঃখ, এরপরে স্বামী আমাকে  ভৈরবপুর আশ্রয় শিবিরে নিয়ে এলেন...।’ 
        
         
নাম তাঁর পক্ষ নমশূদ্র।
     ‘শিবিরে কদিন থাকলেন?’
            ‘ঠিক মনে নেই। কিন্তু এটা মনে আছে---আমার এই পা আর সন্তানকে কেড়ে নিয়ে গেছে অসমিয়াদের যে আক্রমণ সেটি ঘটেছিল ১৯৮৩র ফেব্রুয়ারি মাসে। মানে ফাল্গুন মাসের প্রথম সপ্তাহে। সেদিনটির পরে আর আমি স্বামী ছাড়া নড়াচড়া করতেই অক্ষম হয়ে গেলাম।  এদিকে আমাদের বাড়িঘরও আক্রমণকারীরা জ্বালিয়ে ফেলেছিল। আশ্রয় শিবির থেকে প্রথমে লখিমপুর হাসপাতালে, পরে ডিব্রুগড় হাসপাতালে থেকে মাস ছয়েক চিকিৎসা করালাম।   এর পরে গ্রামে যদিও বা ঘুরে এলাম বছর না ঘুরতেই হঠাৎই একদিন আমার স্বামী  নরেশ নমশূদ্রের মৃত্যু হলো। বাড়িতে পড়ে রইলাম সেই দাঙ্গাতে পঙ্গু আমি আর আমার কন্যা। আমার পা নেই, আর কন্যা রীণার আহত হাত। উঃ কী যে যন্ত্রণা...!’
            ছেঁড়া পা ছুঁয়ে মিছিলা নমশূদ্র নীরবে কাঁদছিলেন। তাঁর বয়স এখন ষাট পার করেছে। ৩২ বছর আগে বিদেশী বিতাড়নের নামে  অসমিয়া জাতির অস্তিত্ব রক্ষার নাম নিয়ে হাতে কর্মে একাংশ বাঙালির উপরে যে হিংস্র আক্রমণ সংঘটিত হয়েছিল, তারই সাক্ষী হিসাবে আজও ধেমাজি জেলার শিলাপাথার থানার অন্তর্গত আর্নে রামনগর গ্রামে আছেন মিছিলা নমশূদ্র। স্বামীর মৃত্যুর পরে সম্পূর্ণ অসহায় হয়ে পড়েছিলেন মিছিলা। কিন্তু আন্দোলনকারী দায়ের ঘায়ে আহত কন্যা রীণাকে স্থানীয় এক তরুণ বিয়ে করে, মিছিলার দৈনন্দিন জীবনের চালিকা শক্তি এখন সেই মেয়ে জামাইই।   দুখানি ক্র্যাচ দু’দিকে ধরে কোনোক্রমে চলাফেরা করেন মিছিলা। প্রতিমুহূর্তে তাঁর ছেঁড়া পা তাঁকে মনে করিয়ে দেয় অসমিয়া জাতির সংগঠিত সেই নৃশংসতা আর বর্বরতার কথা। শুধু যে এই মিছিলা নামের মহিলাটির বেলা, তাই নয়। বৃহত্তর আর্নে চর অঞ্চলে মিছিলা নমশূদ্রের সেই ছিন্ন পাখানি এখন অসমিয়া উগ্রজাতীয়তাবাদের নির্মম ঘৃণনীয় তথা নারকীয় অধ্যায়ের জ্বলন্ত সাক্ষ্য। মিছিলা যখন ক্র্যাচ দু’খানাতে ভর করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এদিকে ওদিকে ঘুরে বেড়ান, তখনই যেন গ্রামবাসীর (সে সময়ের ভুক্তভোগী) চোখে ভেসে উঠে নৃশংস সেই সব আক্রমণের ছবি।
        
            
পক্ষের শূন্য কপাল
   আর্নে রামনগর গ্রামে মিছিলা যখন আবেগ বিহ্বল হয়ে অসমিয়া ভাষী স্থানীয় জনজাতি মানুষের সেই আক্রমণের কথা বর্ণনা করছিলেন তখন কাছেই বসে ছিলেন আরেক মহিলা। মিছিলার কথা শেষ হবে হচ্ছে করতেই সেই মহিলা বলে উঠলেন, ‘ সেই আক্রমণের দিনটিতে আমার বিয়ের মাত্র সাতদিন হয়েছিল। আগের রবিবারে আমাদের বিয়ে হয়েছিল। পরের রবিবারে আমরা আক্রান্ত হলাম। আমাকে আর্নে রামনগরে বিয়ে দিয়েছিলেন। দুদিন আগেই গেছি স্বামীর ঘরে। কিন্তু স্বামীর সঙ্গে একদিন কাটাতে না কাটাতেই সেই আক্রমণ নেমে এলো...’
              মহিলাটি কথা থামালেন। খানিক সবাই নিস্তব্ধ হয়ে রইলেন। তারপরে বড় কষ্টে আটকানো গলাতে মহিলাটি বলে গেলেন, ‘ সেদিন আমার সামনেই স্বামীকে হত্যা করল ওরা। আমাকেও আক্রমণকারীরা মারতে আসছিল। স্বামী আমাকে দৌড়ে পালাতে বলে নিজে ওদের বাধা দিতে দৌড়ে গেলেন। দুই পা দৌড়ে গেছি কি পেছনে ফিরে দেখি, আমার স্বামীকে কোপাচ্ছে ওরা। উনি গড়িয়ে পড়ে গেছেন, সেই শরীরে লাঠি দিয়ে ঘা দিচ্ছে।  তারপরে কিছু লোকে আমাদের বাড়িতে আগুন দিল।  আমি দৌড়ালাম। ইতিমধ্যে গ্রামের মানুষজনও দৌড়োচ্ছে প্রাণ বাঁচাতে। আমি দৌড়ে দৌড়ে প্রাণ বাঁচালাম। কিন্তু আমার সিঁথির সিঁদুর হারালাম। বিয়ের মাত্র সাতদিন পরেই।' আমাদের সামনেই মহিলাটি হুহু করে কেঁদে ফেললেন। আমরা দেখে গেলাম শুধু---তাঁর দুই গাল বেয়ে নামছে চোখের জল। দেখে গেলাম, তাঁর শূন্য কপাল। গেল তিনটা দশক তিনি পার করেছেন এই দুঃখের বোঝা বয়ে বয়ে।  বিয়ের সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র ষোল। নাম তাঁর পক্ষ নমশূদ্র। আর্নে রামনগরের উপেন্দ্র নমশূদ্রের বাইশ বছরের ছেলে মাণিক নমশূদ্রের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল পক্ষের। মিছিলার ছিন্ন পা, পক্ষের শূন্য কপাল---অসমিয়া উগ্রজাতীয়তাবাদী , অসমের অস্তিত্ব রক্ষার নামে সংগঠিত ঘাতক বাহিনী এই সমাজকে দেয়া ‘নির্মম উপহার’ ।
(ক্রমশ:)
             
~~~~~~~০০০০~~~~~~~~~~~
লেখাটি আর যেখানে পড়া যাবেঃ
১) http://sushantakar40.blogspot.in/2015/05/blog-post.html
২)http://ishanerpunjomegh.blogspot.in/2015/05/blog-post_28.html

দুটি সংক্ষিপ্ত লেখা ঃ (১) সাবেরিদাকে আমি যেভাবে দেখেছি (২) মাতৃভাষা, রাষ্ট্রভাষা ও রাষ্ট্র

Posted by স্বাভিমান

সাবেরিদাকে আমি যেভাবে দেখেছি – অরূপ বৈশ্য
মূল্যায়ন নয়, চিত্রায়ণ
প্রয়াত আবুল হুসেন মজুমদার যাকে আমি অন্য অনেকের মত সাবেরিদা বলে সম্বোধন করতাম তাঁর সাথে প্রথম কখন পরিচয় ঘটে তার সন-তারিখ স্মরণে নেই। কী পরিস্থিতিতে পরিচয় ঘটেছিল তাও ঠিকঠাক মনে নেই। সম্ভবত চন্দনদার (চন্দন সেনগুপ্ত) সাথে রাজনৈতিক কোন বিষয়ে নিয়ে আলোচনার জন্য ওনার সাথে দেখা করেছিলাম। কোন কিছুর বিস্তৃত খুঁটিনাটি আমার স্মৃতিতে থাকে না। দীর্ঘদিনের পরিচয়ে যে বিশেষ সাধারণ বৈশিষ্ট্য মনে দাগ কাটে তা’ই স্মৃতির কোন এক স্তরে বাসা বেঁধে বসে থাকে। সাবেরিদা সেরকমই এক ব্যক্তিত্ব যার বিশিষ্টতা প্রশ্নাতীত। তাঁকে কেন্দ্র করে বিতর্কও কম ছিল না। সেটাই স্বাভাবিক। যার নিজস্ব মত আছে এবং যে কোন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নিজের মতকে যুক্তির কাঠামোয় তুলে ধরার সৎ সাহস যার আছে তাকে নিয়ে বিতর্ক তো হবেই। সাবেরিদাকে অনেকে অনেকভাবে দেখেছেন। যেমন গল্পকার মলয় কান্তি দে যেভাবে দেখেছেন তা তাঁর ‘বদ্ধজলার মর্মকথা’ গল্পের চরিত্রের মধ্যে ফুটে উঠেছে। এই সংক্ষিপ্ত নিবন্ধ কোন স্মৃতিচারণ নয়, তাঁর অবদান নিয় কোন মূল্যায়নও নয়, আমার দেখা সাবেরিদাকে তুলে ধরার প্রয়াস মাত্র।
ভাষার প্রশ্নে
নব্বইয়ের দশকের কোন এক সময়ে সাবেরিদার বাড়িতে ভাষার প্রশ্ন নিয়ে কথা হচ্ছিল। সাবেরিদাই মূলত কথা বলছিলেন, আমি তাঁর কথার বিরতিতে আমার মত ব্যক্ত করছিলাম। বেরিয়ে যাওয়ার সময় তাঁর ঘর থেকে সুনীতি চট্টোপাধ্যায়ের অডিবিএল বইখানা নিয়ে আসি। সম্ভবত বছর দু’য়েক পর সাবেরিদা আমাকে ফোন করে বললেন, “অরূপ, আমার অডিবিএল বইটা বোধহয় তোমার কাছে, আমার লাগছিল”। ভাষার উপর সেদিনের তাঁর কথা নিয়ে নিজের মধ্যে পর্যালোচনা করার চেষ্টা করি। তাতে তাঁর সম্পর্কে আমার ধারণা হয় যে সাবেরিদা ভাষাকে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবেই বেশী গুরুত্ত্ব দেন, ভাষা যে উপলব্ধি - কনসেপ্ট ও চেতনার প্রকাশ সেব্যাপারটি তাঁর কাছে গৌণ। এর কিছুদিন পর গণতান্ত্রিক লেখক সংস্থার উদ্যোগে ভাষার অধিকারের প্রশ্ন নিয়ে শিলচর মহিলা কলেজে এক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে নির্দিষ্ট বক্তা হিসেবে সাবেরিদা লিখিত বক্তব্য পেশ করেন। সে পাণ্ডুলিপি এখন কারুর কাছে গচ্ছিত আছে কিনা আমার জানা নেই। সাবেরিদা তাঁর বক্তব্যে নিম্ন অসমের বাঙালি মুসলমানদের ভাষার অধিকার খর্ব হওয়ার ইতিহাস এবং তাদের অনগ্রসরতার আন্তঃসম্পর্ক অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণভাবে তুলে ধরেন। অর্থাৎ মতাদর্শগতভাবে তাঁর অবস্থান যেখানেই থাকুক না কেন, তাঁর চিন্তার চালিকাশক্তি ছিল মানব-কল্যাণ ও সমাজের সবচাইতে নিপীড়িত সবহারাদের বিষয়।
ইসলাম ধর্মের প্রশ্নে
ইসলাম ধর্মের চর্চা, ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনা ও ইসলামে বিশ্বাসী মানুষের জীবনযাত্রার মধ্যে বিশ্বজোড়া বিভিন্নতা রয়েছে। আবার ইসলামে বিশ্বাসী একই সংগঠনের মধ্যেও স্থান-কালের বিচারে বিভিন্নতা রয়েছে। যে ওয়াহাবি মতবাদ উপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে ‘বাঁশের কেল্লার’ লড়াইয়ে কৃষক বিদ্রোহী তিতুমীরের মত নিপীড়িত মানুষের পক্ষের নায়কের জন্ম দেয়, আজ সেই ওয়াহাবি মতবাদকে অন্যত্র সাম্রাজ্যবাদীরা ব্যবহার করছে সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে। কোন নির্দিষ্ট মতাদর্শে বিশ্বাসীরা কোন শ্রেণির স্বার্থে কাজ করছে, নিপীড়িক না নিপীড়িতের হয়ে, সেই ভূমিকা মতদর্শের উপরও প্রভাব বিস্তার করে। সেই ভূমিকার চূলচেরা বাস্তব ব্যখ্যা ছাড়া কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় না। অথচ প্রকৃত বৌদ্ধিক চর্চার বাইরে সাধারণ প্রবণতাই হচ্ছে চটজলদি একমাত্রিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া। এই সাধারণ সত্য ব্যক্তি ও গোষ্ঠী উভয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। সাবেরিদা জামাতে ইসলামী দলের সদস্য ছিলেন। মাঝখানে স্বল্পসময়ের জন্য এই সংস্রব ত্যাগ করেছিলেন। স্থানীয় পত্রিকায় সেরকম একটি সংবাদ সম্ভবত প্রকাশিত হয়েছিল। জামাতে ইসলামী দলের রাজনৈতিক ইসলাম নিয়ে এখানে আলোচনা করার সুযোগ নেই। জামাতে ইসলামী দল ভারত বিভাজনের বিরোধী ছিল। কিন্তু তাদের এই ভূমিকা ম্লান হয়ে যায় যখন জানা যায় যে তাদের এই বিরোধিতার পেছনে এই দলের তাত্ত্বিক নেতাদের ভিন্ন এক মতাদর্শগত ধারণা ছিল। এই তাত্ত্বিক প্রবক্তারা ভেবে ছিলেন যে ইসলামের সাম্যের আবেদনে সাড়া দিয়ে অবিভক্ত ভারতের অ-মুসলমানরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করবে। সাবেরিদা তাঁর বিদ্রোহী সত্তা ও কুসংস্কারমুক্ত মানসিকতার তাগিদেই সম্ভবত সাম্রজ্যবাদ বিরোধী রাজনৈতিক ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন, কারণ তাঁর বৌদ্ধিক নেতৃত্বে পরিচালিত অরাজনৈতিক সংগঠনের উদ্যোগে সাম্রজ্যবাদ বিরোধী বহু আলোচনাচক্র অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং বর্তমান লেখকেরও তাঁর আমন্ত্রণে এধরনের সেমিনারে বক্তা হিসেবে যোগ দিয়ে তাঁর বক্তব্য শোনার সুযোগ ঘটেছে। কিন্তু কুসংস্কারমুক্ত আধুনিক ইসলাম গড়ার প্রয়াসও যে ইসলামকে আমজনতা বিরোধী অবস্থানের দিকে ঠেলে দেয় যদি আরও কিছু অনিবার্য শর্ত পূরণ না হয়, সেব্যাপারে তিনি কতটা সচেতন ছিলেন তা বোঝার কোন সুযোগ ছিল না, কারণ ইসলামকে বিকৃত করার উগ্র-হিন্দুত্ববাদীদের প্রয়াসের অত্যন্ত সঙ্গত বিরোধিতা ছাড়া ধর্ম নিয়ে ব্যক্তিগত স্তরেও তিনি বিশেষ আলোচনা কোনদিন করেননি। সুতরাং জামাতে ইসলামের ভারত বিভাজন বিরোধী ও অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী রাজনৈতিক অবস্থানের যে ক্ষেত্র তাতেই ছিল তাঁর আবাস, ইসলামের বিশুদ্ধীকরণের দিকে ছিল তাঁর নজর, কিন্তু ইসলামীকরণের মতাদর্শের প্রতি তাঁর বিশেষ আকর্ষণ ছিল না। সেটা না হওয়ার পেছনে মুখ্য কারণ এই যে তাঁর চিন্তন-মননের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল নিপীড়িত শ্রেণির মানুষ ও তাঁর নিপীড়িক বিরোধী অবস্থান। সেজন্যই তিনি অনায়াসেই আমাদের মত কম্যুনিস্ট মতাদর্শে বিশ্বাসীদের সাথে মেহনতি মানুষের সংগ্রামী কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ করতে পারতেন। এই আগ্রহই তাঁকে এঅঞ্চলে সুফীবাদের ভূমিকা নিয়ে দীর্ঘ রচনা লিখতে অনুপ্রাণিত করে। হাতে লেখা প্রায় শত পৃষ্ঠার এক পাণ্ডুলিপি তিনি আমাকে পড়তে দিয়েছিলাম, সেই পাণ্ডুলিপির প্রতিলিপি এখনও আমার ঘরে পড়ে রয়েছে কিনা খুঁজে দেখতে হবে।
বুদ্ধিজীবী প্রশ্নে
আমরা প্রতিনিয়ত তথাকথিত কেজো বুদ্ধিজীবীর সম্মুখীন হই যারা সবসময়ই নিজের মতকে প্রতিষ্ঠানের ও প্রভাবশালীদের অনুমোদন পাওয়ার লক্ষ্যকে সামনে রেখে পরিচালিত করেন, সেদিক থেকে তিনি ব্যতিক্রম। কিন্তু সব মানুষেরই যেমন কিছু দুর্বলতা থাকে, তাঁরও নিশ্চয়ই থেকে থাকবে। বিবৃতি দিয়ে স্বল্প সময়ের জন্য জামাতের সঙ্গ ত্যাগ এবং আবার এর সাথে যুক্ত হওয়ার ঘটনা কোন দুর্বলতার লক্ষণ কিনা সেব্যাপারে তাঁর সাথে কথা বলার ইচ্ছে থাকলেও সেটা আর হয়ে উঠেনি। মতাদর্শগত ও ধর্মীয় পরিচিতি তাঁর বৌদ্ধিক অবদানের স্বীকৃতি পাওয়ার ক্ষেত্রে যে অন্তরায় সেটা তিনি উপলব্ধি করতেন ও এব্যাপারে তাঁর মর্মবেদনাও তিনি একান্তে ব্যক্ত করতেন। ইতিহাসবিদ সুজিৎ চৌধুরীর বহু মতের সাথে তিনি একমত ছিলেন না, সেটা তিনি কোথাও লিখিতভাবে ব্যক্ত করেছেন কিনা আমার জানা নেই। বরাক উপত্যকার প্রেক্ষিতে সুজিৎ চৌধুরী নিশ্চয়ই নিজেই ছিলেন এক প্রতিষ্ঠান। সুতরাং খোলাখুলি প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা করা বরাক উপত্যাকার বৌদ্ধিক চর্চার পরিবেশে খুব একটা খাপ খায় না। বাংলার জাতি-বর্ণ পরিচিতির প্রশ্নে ইতিহাসবিদ ডি.আর.ভাণ্ডারকারের ব্যাখ্যার সূত্র ধরে সুজিৎ চৌধুরী কিছু সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন। কিন্ত ভাণ্ডারকারের ব্যাখ্যাই ভ্রান্ত ও অপ্রতুল তথ্যনির্ভর বলে অন্যান্য ইতিহাসবিদদের দাবির প্রেক্ষিতে সুজিৎ চৌধুরীর কোন লেখা প্রকাশ পায়নি। এনিয়ে এঅঞ্চলের কোন ইতিহাসবিদের ভিন্ন কোন লেখা যখন নেই, তখন এনিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করে লেখার জন্য একদিন কথায় কথায় আমি তাঁকে বলেছিলাম। উত্তরে বললেন যে তিনি লিখলে কেউ সেটা গ্রহণ করবে না। আমার মনে হয়েছে যে তিনি বলতে চেয়েছেন যে সেটা তাঁর ক্ষেত্রে অনধিকার চর্চা। বরাক উপত্যকার বৌদ্ধিক পরিবেশে এই যে অনধিকারের আবহ তা তাঁকেও প্রভাবিত করেছে। অন্য অনেকের মত এটাও তাঁর একটি দুর্বলতা। বৌদ্ধিক বিতর্ক মানেই যে কেউ কাউকে ছেড়ে কথা বলবে না সেই আবহ বরাকে তৈরি হয়নি। বরাক উপত্যকার সমাজ জীবনে সেই কর্তাভজা পরিবেশ সর্বত্র এখনও গেঁড়ে বসে আছে। সাবেরিদা এর থেকে বেরিয়েও বেরোতে পারেননি।   
আমাদের বন্ধুত্ব
আমাদের সাথে ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠার পেছনে আরেকটি কারণ ছিল। আমরা তথাকথিত বামপন্থী উন্নাসিকতা ও কূপমণ্ডূকতাকে ঝেড়ে ফেলে ধর্মীয় কারণেও নিপীড়িতের ব্যথিত হৃদয়ের সাথী হতে পিছপা হতাম না। সালমান রুশদির ‘স্যাটানিক ভার্সেস’-এর কোন এক মন্তব্য ইসলামে বিশ্বাসীদের মনে আঘাত করে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ থেকেই জনগোষ্ঠীগত সাইকি’তে আঘাত দেওয়ার প্রতি আমাদের বিরোধী অবস্থান ব্যক্ত করার উদ্যেশ্যে শিলচরে গণতান্ত্রিক লেখক সংস্থার উদ্যোগে একটি সেমিনার সংগঠিত করা হয়। গণতন্ত্রের ও আঘাতপ্রাপ্ত জনগোষ্ঠীর সাথে যুক্তিবিন্যস্ত মত বিনিময় করার পরিবেশ তৈরির স্বার্থে খোলাখুলি এই মত ব্যক্ত করা জরুরি বলে আমরা মনে করি। কারণ একথা স্মরণে রাখা জরুরি যে গোটা বিশ্বব্যবস্থার প্রেক্ষিতে মুসলমান সম্প্রদায় এক নিপীড়িত জনগোষ্ঠী। নিপীড়িতরা স্বাভাবিক কারণেই স্পর্শকাতর। আজকে যারা ইসলামী সন্ত্রাসের বর্বরতার নিদর্শন দিয়ে আমাদের এই অবস্থানের বিরোধিতা করতে চান তাঁরা যেন একথা বিবেচনায় রাখেন যে এই সন্ত্রাসবাদ দীর্ঘ সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ নীতির সন্তান। সাম্রাজ্যবাদী রিজিম চ্যাঞ্জের রণনীতিতে সামিল করে নেওয়া হচ্ছে বহু রাষ্ট্রশক্তিকে, গড়ে তোলা হচ্ছে প্রাইভেট আর্মি। বর্তমানে সিরিয়ার আসাদ শাসনের অবসানের রণনীতি যে বুমেরাং হয়ে ফিরে এসেছে সাম্রাজ্যবাদীদের দিকে সে তথ্য সবারই জানা। প্রভু শক্তির দাপটে মানবতা যখন লাগাতার ভূলুণ্ঠিত হয়, যখন মানবিকতা প্রতিষ্ঠার বিকল্প শক্তি অত্যন্ত দুর্বল হয়, তখন প্রতিরোধের সংগ্রামে এধরনের বিকৃতি ঘটে বা ন্যস্তস্বার্থই জনমতকে তাদের পক্ষে টানতে এধরনের বিকৃতি ঘটায়। যাইহউক, সালমান রুশদির বিষয় নিয়ে সাবেরিদাকে সামিল করার জন্য তাঁর সাথে কথা বলে দেখলাম তিনিও আমাদের মত গণতান্ত্রিক বিরোধিতার অবস্থানে আবদ্ধ থাকতে আগ্রহী। বৌদ্ধিক চর্চার জন্য সাবেরিদা জেহাদ থেকে ইসলামের ইজতিহাদকেই (স্বাধীন যুক্তিতর্ক) গুরুত্ত্ব দিতেন বেশী, যদিও তাঁর বিদ্রোহী সত্তা তাঁকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ইসলামের জেহাদের দিকেই যে আকৃষ্ট করবে সেটাই স্বাভাবিক। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী চলমান গণ-সংগ্রামের পরিস্থিতিতে ইজতিহাদ ও জেহাদের মধ্যে আলাপচারিতা চলতে থাকে। ভিন্ন পরিস্থিতিতে জেহাদ যুক্তি মানে না। কিন্তু যারা বামপন্থাকে চলমান সংগ্রামের সাথে যুক্ত করে দেখতে আগ্রহী নন, যারা প্রগতিশীলতাকে এক মনোগত বিষয় হিসেবেই ভাবতে অভ্যস্ত তারা শুধুমাত্র আমাদের বিরোধিতাই করলেন না, সাবেরিদাকে কেন্দ্রে রেখে বহু অপ্রাসঙ্গিক অভিধায় আমাদের কটাক্ষ করতেও কসুর করলেন না। নিপীড়িতের চলমান সংগ্রামের মধ্যে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখলে ধার্মিক, নাস্তিক, ধর্মবিরোধী সবাই তাদের নিজ নিজ মতাদর্শ নিয়েও বহু সাধারণ ক্ষেত্রে ঐক্যবদ্ধভাবে সামিল হতে পারে, সাবেরিদার সাথে আমাদের বন্ধুত্ব ছিল এই সূত্রে গাঁথা। সাবেরিদার সাথে আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ ক্ষোভও ছিল এই নিয়ে যে সাচার, রঙ্গনাথ মিশ্র কমিশনের গণতান্ত্রিক সুপারিশগুলো নিয়ে জনমত গঠনে তাঁর কলম ও উদ্যোগকে খুব বেশী শাণিত করতে দেখা যায়নি।
চাটুকারদের পাশে ব্যতিক্রম
আমার দেখা সাবেরিদাকে চিত্রায়িত করতে হলে এক তাত্ত্বিক কাঠামোর আশ্রয় নিতে হয়। স্থিথাবস্থার অভ্যন্তরে ন্যায়-অন্যায়, শুভ-অশুভ, নিপীড়িত-নিপীড়ক, পরজীবী-শ্রমজীবী, প্রতিষ্ঠান-অপ্রতিষ্ঠান ইত্যাদি বিপরীত শক্তির প্রবহমান সংঘাত প্রতিটি গোষ্ঠী ও ব্যক্তির চিন্তা-চেতনায় একধরনের দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে। এই দ্বন্দ্ব যত তীব্র হয় ততই এই স্থিথাবস্থার বেড়াজাল থেকে স্বাধীনতা ও মুক্তির চাহিদা তীব্র হতে থাকে। চিন্তা-চেতনার এক প্রক্রিয়া এই চাহিদাকে প্রশমিত করে রাখে, বিপরীত প্রক্রিয়া তাকে চাগিয়ে দেয়। প্রথম প্রক্রিয়ায় আমরা একমাত্রিক মানুষ, বিপরীত প্রক্রিয়ায় আমরা দ্বিমাত্রিক বা বহুমাত্রিক সংঘাতে অস্থির। সাবেরিদার অবস্থান ছিল এ দু’য়ের মাঝখানে। তিনি স্থিথাবস্থাকে মেনে নিতে পারতেন না, আবার ইসলামী আদর্শের অভ্যন্তরে থেকে তাকে বিদ্রোহী পথে পরিচালনা করার দিকেও অগ্রসর হতে পারতেন না। সেদিক থেকে তিনি বেঁচে ছিলেন বৌদ্ধিক সত্তার ইসলামী ইজতিহাদের মধ্যে, বিদ্রোহী সত্তার অবদমনের মাধ্যমে আত্মসমর্পণ করে। তাই বলা যায় যে তিনি জামাতে ইসলামী হয়েও জামাতে ইসলামী নন বা জামাতে ইসলামীর এক নিজস্ব ভিন্ন রূপ। প্রযুক্তি ও আয়ের কাঠামোয় মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীদের জীবন যাপনের স্বাচ্ছন্দ্যের যে বৃদ্ধি ঘটাচ্ছে তাতে হুকুমের গোলাম হয়ে, অনৈতিক উপায়ে বা দিনভর একঘেঁয়েমি কাজের মধ্য দিয়ে আয়বৃদ্ধি সেই বুদ্ধিজীবী শ্রেণির আত্মতৃপ্তি প্রদানের কারক হয়ে উঠছে। কাজের ক্ষেত্রে তাদের নিজের কোন স্বাধীন সত্তার নিয়ন্ত্রণ না থাকা ও কাজের প্রক্রিয়া থেকে তাদের মানসিক বিচ্ছিন্নতা সত্ত্বেও এই স্বাচ্ছন্দ্য এই শ্রেণিকে আত্মতৃপ্ত করে তুলছে। শোষণ-বঞ্চনা ও স্থিতাবস্থা বজায় রাখার জন্য এ বড়ই উপযোগী পরিস্থিতি। বুদ্ধিজীবী শ্রেণির একমাত্রিক মানুষ হয়ে ওঠার এ এক ভয়ঙ্কর পরিণতি। স্থিতাবস্থার অবসানে আমাদের প্রয়োজন দ্বিমাত্রিক ও বহুমাত্রিক মানুষ যার অভ্যন্তরিণ সংঘাতে স্বাধীনতা ও মুক্তির স্পৃহা তীব্রতর হবে, মানুষ হয়ে উঠবে অমানবিক স্থিথাবস্থা ভাঙার আগ্রহে এক একজন বিদ্রোহী। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে আমাদের সমাজে সাবেরিদার মত মানুষের খুবই প্রয়োজন যারা অন্তত চাটুকারদের স্বর্গে সুখনিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। তাই সাবেরিদার মৃত্যুজনিত শূন্যতা আমাদের পীড়া দেয়। সেই শূন্যতাকে ভরাট করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার শপথ ছাড়া আর কীভাবে সাবেরিদার মত বিদ্বজ্জনকে শ্রদ্ধা জানানো যেতে পারে?
(এই সংক্ষিপ্ত নিবন্ধটি লেখার সময় কোন নথি-পত্র বা তথ্য-সূত্রের আশ্রয় নেওয়া হয়নি, সম্পূর্ণ অতীত পাঠ ও অভিজ্ঞতার স্মৃতি থেকে লেখা, তাই তথ্যগত কোন ত্রুটি থেকে থাকলে তার সম্পূর্ণ দায় লেখকের)

মাতৃভাষা, রাষ্ট্রভাষা ও রাষ্ট্র – অরূপ বৈশ্য

মানুষের শ্রমের মাধ্যমে গড়ে উঠছে রকমারি প্রযুক্তি ও সামগ্রী এবং গড়ে উঠছে জটিল সব মানব সম্পর্ক। তাকে একে অপরের বোধগম্য করার যে প্রধান মাধ্যম তা হচ্ছে ভাষা। সেভাবে দেখলে ভাষা হচ্ছে মানুষে মানুষে যোগাযোগের মাধ্যম। কিন্তু ভাষা তো শুধু তাই নয়, ভাষা মনেরও আয়না। অর্থাৎ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর উপলব্ধি, চিন্তা-চেতনা, ধারণা, উন্নয়নের মান ও বিকাশের স্তর ব্যক্ত হয় ভাষার গঠনে। সেজন্যই মায়ের কাছ থেকে শেখা প্রথম ভাষাটি গুরুত্ত্বপূর্ণ। ব্যক্তি ও সামাজিক সত্তা হিসেবে বেড়ে উঠার ঊষালগ্নেই যদি মাতৃভাষার প্রথম সোপানটি কেড়ে নেওয়া হয়, তাহলে তার বিরূপ প্রভাব পড়তে বাধ্য সামাজিক নিয়মে, দেখা দিতে বাধ্য সামাজিক অস্থিরতা। অঞ্চল, দেশ ও বিশ্বজুড়ে চলছে সেই ভাষা-রাজনীতির বহুবিধ খেলা যার পরিণতিতে আজ চারিদিকে অসাম্য ও ধ্বংসের তাণ্ডব।
ভাষার বিকাশ ও উন্নয়ন পরস্পর সংম্পৃক্ত। এ’দুয়ের অগ্রগতির সাথে সাথে গড়ে উঠে জাতীয় চেতনা ও তার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও শাসন প্রণালী যা জন্ম দেয় জাতিরাষ্ট্রের। গনতান্ত্রিক পথে বিকশিত রাষ্ট্র বহুভাষিক ও বহুজাতিক চরিত্রকে মান্যতা দিতে বাধ্য। একে বলপূর্বক নাকচ করার প্রচেষ্টা জন্ম দেয়  জাতি-সংঘর্ষের ও উগ্রজাতিয়তাবাদের। ফলে বিচ্ছিন্ন হওয়ার অধিকারের মধ্যেই আত্মমর্যাদা ও আত্মপরিচয় বজায় রাখার একমাত্র পথ খোলা থাকে। এই বিচ্ছিন্ন হওয়ার অধিকার সাব্যস্ত করতে গিয়েই ভাষিক জাতিয়তাবাদকে ভিত্তি করে জন্ম নিয়েছে আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশ। রাষ্ট্রের বহুভাষিক – বহুজাতিক চরিত্র বজায় রাখার প্রাথমিক শর্তই হচ্ছে মাতৃভাষায় পঠন-পাঠন, উচ্চশিক্ষা ও সরকারি-প্রশাসনিক কাজকর্ম করার অধিকার সাব্যস্ত করা। ফলে রাষ্ট্রভাষা বলে কোন ভাষাকে জাহির করা মানে অন্য সব ভাষার বিরুদ্ধে মৃত্যু পরোয়ানা জারি করা।

     সরকার, প্রশাসন ও বিচার বিভাগ এককথায় রাষ্ট্রই সবার নাগরিক অধিকারকে সুনিশ্চিত করে।  সেজন্যই নাগরিক তালিকায় নাম ওঠানোর প্রশ্ন নিয়ে আসামের ভাষিক রাজনীতি আজ এতো সরগরম। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ‘এনআরসি’ তৈরি হলে আসামের নির্বাচনী রাজনীতিতে ‘বিদেশি ইস্যু’র  অন্যতম হাতিয়ারটি চিরতরে ভোঁতা হয়ে যাবে, তাতে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল নিপীড়িত মানুষেরই মঙ্গল। বাংলাদেশ আসামের প্রতিবেশী রাষ্ট্র হওয়ায় বাঙালিদের উপরই ঝুলতে থাকে অনুপ্রবেশকারীর খড়গ।   নেহেরু-লিয়াকত ও ইন্দিরা-মুজিব চুক্তির শর্ত ভুলে গিয়ে এই খড়গতে শাণ দেওয়া হয় কখনও বাঙালি মুসলমানদের বিরুদ্ধে, কখনও বাঙালি হিন্দুদের বিরুদ্ধে। এই বিভাজনের মানসিকতার ফলেই বরাকের বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজ অসমীয়া আগ্রাসন নিয়ে যতটা স্পর্শকাতর, বাঙালি মেহনতি মানুষের দুঃখ-দুর্দশা ও উন্নয়ন নিয়ে ততটাই উন্নাসিক। অথচ এই দু’টি বিষয়ই পরস্পর সম্পৃক্ত, একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটিকে মোকাবিলা করা যায় না। এই পরস্পর বিচ্ছিন্ন পরিস্থিতির আড়ালে হারিয়ে যায় গণতন্ত্রের মুল মন্ত্র – ‘সবার সমান অধিকার, সমান মর্যাদা’। আশার কথা এই যে মেহনতি মানুষের মুখে উন্নয়নের নতুন ভাষা ফুটতে শুরু করেছে, সেটা যখন সবার কর্ণগোচর হওয়ার মত শক্তি সঞ্চয় করবে, তখনই নতুন আশা সঞ্চারিত হবে, বৌদ্ধিক চর্চার ভাষাও বিকশিত হবে। (ড০ রাজীব কর সম্পাদিত 'উনিশের ডাকে' প্রকাশিত) 

উনিশের স্বপ্ন (গল্প না হলেও, প্রবন্ধ নয়)

Posted by স্বাভিমান

উনিশের স্বপ্ন
(গল্প না হলেও, প্রবন্ধ নয়)
অরূপ বৈশ্য
আমি এই কাহিনীর নায়ক। কিন্তু চারপাশের লোকরা তা মানতে রাজি নয়। কাছের ও দূরের কোন জনপদের মানুষই এই নায়ককে চেনে না। আমি কিংবা আমি নয় এ দুয়ের দ্বন্দ্ব সমাধান করার দায় আমার নেই। আমাকে জীবনের পথ চলতে হয়, তাই এগিয়ে যাই। লোকে কী বলে তা জানার আগ্রহ আমার নেই। তথাপি আমি জানি যে লোকে আমাকে এক অদ্ভুত প্রকৃতির মানুষ বলেই জানে। এই জানা পীড়াদায়ক বটে, কিন্তু তা আমাকে বদলে দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা তৈরির জন্য যথেষ্ট নয়। যথারীতি দিনের কাজকর্ম সেরে একরাশ বিরক্তি নিয়ে বাড়ি ফিরি। সন্ধ্যের দিকে যখন নিজের ইচ্ছেমত ঘুরে বেড়ানোর জন্য বেড়িয়ে পড়ি, তখন সব অবসাদ কেটে যায়। সারা দিনের সবার হুকুম তামিল করার বিনিময়ে আদায় হয় জীবনের বিলাসী স্বাচ্ছন্দ্য। জীবনের এই ছন্দে বৈপরীত্য মাথা চাড়া দেয় না, এক অদৃশ্য শক্তি তাকে চেপে রাখে । একমাত্রিকতার ভারে ন্যুব্জ মন খোলা আকাশের সন্ধানে প্রবৃত্ত হয় না। এই কাহিনীর নায়ক সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়ে, এজন্যই কী লোকে আমার এই আমিকে চেনে না?

আগামীকাল ধর্মঘট, আজ সন্ধ্যে থেকেই ফুরফুরে মেজাজ। বিদেশে নাকি সপ্তাহের শেষ দু’দিন কাউকে কাজের কথা বলা যায় না, এই দু’দিন সবাই স্বাধীন। আমিও স্বাধীনতার স্বাদ ভোগ করার আয়েশে নিদ্রা যাই। ভোর হতেই বেরিয়ে পড়ি। হাটতে হাটতে চলে যাই শিলচর রেলস্টেশনের দিকে। এতো লোক সমাগম দেখে চমকে উঠি। বিকট আওয়াজ শুনে বুক ধড়ফড় করে উঠে, শ্বাস নিতে কষ্ট হয়, দম বন্ধ হয়ে আসে। আমার হাত বা দিকে হেলে পড়ে। এক মোলায়েম মেয়েলি হাত আমার হাতকে চেপে ধরে। আমাকে নীচের দিকে টানতে থাকে, কাতর আর্তি শুনতে পাই। গোঙানির আওয়াজে ভয় পেয়ে এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নেই। সামনের দিকে দৌড়োতে থাকি। হঠাৎ আমাকে পাঁজাকোলে করে নিয়ে কে যেন হাওয়ায় ভাসতে থাকে। আমি কিছু বোঝার আগেই মেশিনের আওয়াজে কথা বলতে শুরু করে। সে যখন বলে আমিই নাকি কাজের লোক, আমি আহ্লাদিত হই। সেই সব অর্বাচীন, প্রগতি-বিরোধীদের অসংখ্য ভিড় ঠেলে আমি যখন প্রাণপণে পালানোর চেষ্টা করছিলাম, তখনই নাকি সে বুঝে যায় আমিই যোগ্য ব্যক্তি। ওর কথার দিকে আমার বিশেষ মনোযোগ ছিল না। ওর দৌলতে উড়তে পেরে আমার বেশ ভাল লাগছিল। আমরা উড়েই চলেছি। সূর্য অস্তমিত, আঁধার নেমে আসে।

নদীর গা ঘেঁষে সরু রাস্তা। ধু ধু মাঠ, ঝাড়-জঙ্গল, পাহাড়, শেয়াল-কুকুরের নিরবিচ্ছিন্ন ডাক সব মিলিয়ে নিসর্গ-প্রকৃতির এক রহস্যময় আবেশ। অজস্র জোনাকি ও মাঝেমাঝে প্রদীপের আলোয় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাঁশ-বেতের দোচালা ঘরগুলো দেখা যাচ্ছে। পথচারীরা এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে, কোথাও গুটিকয় গ্রামবাসী এক জায়গায় জড়ো হয়ে বসে আছে। পাহাড়ের গা ঘেঁসে এই বাসিন্দারাও যেন প্রকৃতিরই অঙ্গ। রোমান্টিক আবেশে সেখানে নেমে যাওয়ার চেষ্টা করতে থাকি। যতই লাফিয়ে পড়ার চেষ্টা করি, শক্তপোক্ত দুটো হাত আমাকে আরও জোরে চেপে ধরে। আমি হাঁপিয়ে উঠি, দম বন্ধ হয়ে আসে, পুনরায় শক্তি সঞ্চয়ের জন্য গা এলিয়ে দেই। হঠাৎ আলোর রোশনাই দেখে চমকে উঠি। নীচে তাকাতেই মন আবার সজীব হয়ে উঠে। প্রশস্ত ঝাঁ চকচকে পথ, ব্যস্তসমস্ত পথচারী এদিক ওদিক ছুটোছুটি করছে। সাঁ সাঁ শব্দে ছুটে চলছে রকমারি যান। বিভিন্ন ডিজাইনের সারি সারি গাড়ির শব্দ প্রশস্ত পথের দুদিকে বিশাল বিশাল অট্টালিকার গায়ে আছড়ে পড়া প্রতিধ্বনিত মূর্ছনা। অত্যাধুনিক শপিং মল, ডিস্কো থেক, বার ক্লাব থেকে দলে দলে মানুষ বেরিয়ে আসছে। রকমারি পোষাকে সজ্জিত ছেলে-মেয়েদের চেহারায় আমোদ-স্ফুর্তির লক্ষণ স্পষ্ট। এখানে আধুনিক সভ্যতা প্রকৃতিকে বাধ্য করেছে দূরে সরে যেতে। আমার অবসাদ কেটে যায়, মনে হয় একটু আগে ফেলে আসা প্রকৃতির নিস্তরঙ্গ জীবন থেকে এ ঢের ভাল। আমাকে বোধহয় এখানেই নামিয়ে দেবে, এই আশা নিয়ে নিশ্চিন্তে গা এলিয়ে দিই। কিন্তু একি, আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে সে এগিয়েই চলেছে। কোথায় যাওয়া হচ্ছে? কোনও উত্তর আসে না। একটা গোপন কথা জানানো হয়নি। আমার একটা অসুখ আছে, মানসিক অসুখ। কোথা থেকে হঠাৎ করে চেতনার এক লহর মানসিক চাপ সৃষ্টি করে, যন্ত্রণা অনুভূত হয়। ভেসে বেড়াতে বেড়াতে সেই অসুখ আবার আমাকে গ্রাস করে। প্রকৃতির আদিম রোমান্টিকতা ও সভ্যতার আধুনিক ভোগবিলাসের হাতছানি কোনকিছুই আমাকে স্বস্তি দেয় না। চাওয়া পাওয়ার এক অজানা রহস্য মনকে ভারাক্রান্ত করে তুলে। এ কোন চেতনা যা আমার এই অসুখের কারণ?  কিছু কথা আছে যা মানুষ তার আপনজন, এমনকি সে তার নিজেকেও বলতে পারে না। আমার অসুখের পেছনের এই রহস্যের কথা কাউকে বলা যায় না, আমার আমাকেও না। কিন্তু আমার মানসিক যন্ত্রণা যে বেড়েই চলেছে। এই লোকটি আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?

অবশেষে লোকটি আমাকে এই পৃথিবী থেকে অনেক দূরে এক অজানা অচেনা পরিবেশে নিয়ে যায়। সম্ভবত কোন ভিন গ্রহে। এখানে সবাই মানুষের মত দেখতে, কিন্তু আচার আচরণ রহস্যময়। সবার মাথায় টুপির মত কি যেন রয়েছে, সেই টুপির চারদিক থেকে আলো ঠিকরে বেরোচ্ছে। আমাকেও সেরকম একটা টুপি পড়িয়ে দেওয়া হয়। কেউ কোনো কথা বলে না, কিন্তু তাদের নিজ নিজ কাজ করে যায়। মনে হয় যেন একে অপরের সাথে বার্তা বিনিময় করছে, এক নির্দেশাত্মক বার্তায় সবাই কাজ করে চলে। এমনকি জীবনধারণের জন্য যার যতটুকু প্রয়োজনীয় তা এক অলঙ্ঘ্য ও পূর্বনির্ধারিত নির্দেশে ব্যবস্থা হয়ে যায়। যে লোকটি আমাকে নিয়ে এসেছে সবাই যেন জেনে গেছে আমি তার অতিথি। লোকটি আমাকে এক বিশাল প্রাসাদোপম অট্টালিকায় নিয়ে যায়। সে রাজ-সিংহাসনের মত সুসজ্জিত একটি চেয়ারে বসে পড়ে। সেখানে বসার সাথে সাথেই প্রাসাদের বিভিন্ন প্রান্তে ছোট ছোট যন্ত্রে একেকটি দল কাজ করতে শুরু করে। কে কী কাজ করবে তার নির্দেশ কোত্থেকে আসে তা ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। কিন্তু সম্পূর্ণ শৃঙ্খলায় কাজগুলি পরিচালিত হয়। এসব দেখতে দেখতে আমার বিরক্তি লাগে। দীর্ঘ যাত্রায় ক্লান্ত শ্রান্ত আমি ক্ষুধার্ত বোধ করি। আমার এই অনুভূতির সাথে সাথেই আমার সামনে সুস্বাদু খাবারের রকমারি সামগ্রী ও বিশ্রামের জন্য উৎকৃষ্ট আরাম-কেদারা হাজির হয়ে যায়। বিশ্রাম নেওয়ার সময় যারা কাজ করছে তাদেরও খেতে দেখি, কিন্তু তাদের খাবার আমার তুলনায় অত্যন্ত নিম্নমানের। আমি যার অতিথি তার মর্যাদা অনুসারেই আমার জন্য এই ব্যবস্থা। আরাম কেদারায় শুয়ে আছি, হঠাৎ দেখি কর্মরত একটি লোক কাঁপতে কাঁপতে মাটীতে শুয়ে পড়ে। আমি ওকে সাহায্য করার জন্য যাওয়ার চেষ্টা করি, কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও আরাম-কেদারা থেকে উঠতে পারি না। কিছুক্ষণের মধ্যেই সবাই মিলে ওকে একটি কোণে নিয়ে যায় এবং সেখানে ওকে নামিয়ে রাখার সাথে সাথেই ওই লোকটি হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। সবাই আবার যে যার কাজে ফিরে আসে। এখানে সবাই একে অপরের প্রয়োজনীয় কথা বুঝতে পারে, কিন্তু আমাদের পৃথিবীর হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ, ঈর্ষা-বিদ্বেষ, সংঘাত-সংঘর্ষ ইত্যাদি সব কিছু এখানে অপ্রয়োজনীয়, অপাংক্তেয়। সবাই এখানে শান্তিতে বাস করে, সবার কথা পূর্বনির্ধারিত ও সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করাই আছে। তাই সবাই সবার কথা বুঝতে পারে। কিন্তু নির্ধারিত সূচী মেনে অত্যন্ত শৃঙ্খলা মেনেই সবাইকে চলতে হয়। আমার আরাম-কেদারা হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায় ও আমাকে উঠে দাঁড়াতে বাধ্য করে। অবশ্য ততক্ষণে আমার ক্লান্তি ঘুচে গেছে, বাইরে বেড়ানোর ইচ্ছে হয়। কোন নির্দেশ ছাড়াই কিছু করার একটাই পরিসর সম্ভবত এখানে রয়েছে, ইচ্ছেমত ঘুরে বেড়ানোর। একে অভ্যাসে পরিচালিত হওয়ার ক্ষমতা বা স্বাধীনতাও বলতে পারেন।

আমি মাথার টুপিটা খুলে রেখে বাইরে বেরিয়ে পড়ি। এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াতেই একজন বৃদ্ধার দেখা মেলে, তিনি যেন আমাকে কিছু বলতে চান। তাঁর ভাষা আমি বুঝতে পারি না, কিন্তু কেউ কিছু বলার চেষ্টা করছে তাতেই যেন আমি কিছুটা স্বস্তি বোধ করি। বৃদ্ধা কী বলতে চাইছেন তা যে আমি বুঝতে পারছি না সেটা অনুমান করে আরেকজন বৃদ্ধকে তিনি ডেকে আনেন। বৃদ্ধ আমাকে জানান তিনি পৃথিবীর ভাষা বুঝতে পারেন, বৃদ্ধার সাথে কথোপকথনে তিনি তাঁর স্ত্রীর প্রতি ভালবাসার জন্য দোভাষীর কর্তব্য পালন করবেন। এখানে এসে এই প্রথম ভালবাসার কথা শুনে আমার কথা বলার উৎসাহ বেড়ে যায়। বৃদ্ধার কাছ থেকে জানতে পারি যে আমি যার অতিথি সে তাঁর সন্তান। কিন্তু সে তার মা ও বাবাকে আর চিনতে পারে না। প্রযুক্তির ভাষাই এখানে একমাত্র ভাষা। তাই বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা পুরোনো জমানার লোক হিসেবে এখানে অপাঙক্তেয়। বৃদ্ধা বলে চলেন, আগে এরকম ছিল না, সবাই সবার সুখ দুঃখে সাথী হওয়ার রীতি ছিল, কলহ-বিবাদ-ঈর্ষা-দ্বেষ এসব যে ছিল না তা নয়। বিভিন্ন গোষ্ঠীর লোকেরা তাদের নিজেদের ভাষায় কথা বলত, কিন্তু অন্যদের সাথে কথা বলার এক সাধারণ ভাষাও ছিল। এখন আর এসব কিছুই নেই, তার প্রয়োজনও নেই। এক কঠোর নিয়মে সব বাঁধা। একদল লোক কাজ করে চলে, কিছু লোক বসে খায়। কিন্তু কারুর বিরুদ্ধে কারুর কোন ক্ষোভ নেই। কিন্তু আমরা যারা পুরোনো প্রজন্মের লোক তাদের জন্য এ এক দমবন্ধকর পরিবেশ। আমাদের কেউ অবজ্ঞা করে না, বেঁচে থাকার জন্য আমাদের প্রয়োজনীয় সামগ্রী আমরা যথারীতি পেয়ে যাই। কিন্তু নিজ সন্তান, আত্মীয় স্বজন, প্রতিবেশীদের আচরণ আমাদের পীড়া দেয়। এই নিষ্ঠুর পরিবেশে বেঁচে থাকার আর কোন আগ্রহ অনুভব করি না। কথা বলতে বলতে বৃদ্ধা ডুকরে কেঁদে উঠেন। আমার অসুখ আবার চাগার দিয়ে উঠে।

 হঠাৎ মাথায় এক বুদ্ধি খেলে। পৃথিবীর বাসিন্দা হিসেবে বাস্তব অভিজ্ঞতা জাত এই বুদ্ধি। আমি বৃদ্ধাকে বলি, আপনারা গোপনে নিভৃতে কেন দিনের পর দিন কেঁদে চলেছেন। আপনাদের মর্মবেদনা প্রকাশ করতে সব বৃদ্ধ-বৃদ্ধা মিলে সর্বসমক্ষে কাঁদুন। তাতে কী হবে? বৃদ্ধা জানতে চান। করে দেখুন না কী হয় আমার এই প্রস্তাবে বৃদ্ধা রাজী হয়ে যান। বৃদ্ধ-বৃদ্ধা বেড়িয়ে পড়েন সবাইকে জড়ো করতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সবাই মিলে চলে আসেন সেই প্রাসাদোপম অট্টালিকায়। সবাই একযোগে কান্না জুড়ে দেন। কর্মরত লোকগুলি কাজ বন্ধ করে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। খানিক পরই তাদের শরীর জোরে ঝাঁকুনি দিয়ে কাঁপতে থাকে মাথা থেকে একে একে টুপি খসে পড়ে। সবাই দৌড়ে এসে সমবেত বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সহ একে অপরকে আলিঙ্গন করতে আরম্ভ করে।

এদিকে সিংহাসনে বসে থাকা সেই লোকটি, আমি যার অতিথি, জোরে জোরে হাত-পা ছুড়তে থাকে। তার দুচোখ দিয়ে যেন আগুন ঠিকরে বেরোচ্ছে। হঠাৎ দৌড়ে এসে আমাকে জাপটে ধরে, যেন পিষে মেরে ফেলবে। আমাকে ঠেলতে ঠেলতে গ্রহের সীমানায় নিয়ে যায়, সজোরে ধাক্কা মেরে শূন্যে ফেলে দেয়। মৃত্যুর গহ্বরের দিকে ধাবমান আমি জেগে উঠে তড়াক করে বিছানায় বসে পড়ি। ঘামে ভেজা বিছানার চাদর দুমরে মোচড়ে এককোণে সরে গেছে। হতবিহ্বল আমার সম্বিত ফিরে আসে পাশের রাস্তা থেকে ভেসে আসা ‘মাতৃভাষা জিন্দাবাদ’ ধ্বনির সমবেত আওয়াজে। তারাপুর রেলস্টেশন চত্বরে যে মেয়েটির হাত ছেড়ে দিয়ে আমি পালিয়ে গিয়েছিলাম, তার চেহারা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠে। আমি তার কাছে অপরাধী হয়ে রইলাম, আত্মহননই কি এই অপরাধের শাস্তি?  না, এই শাস্তি থেকে আমি এখন মুক্ত। জীবনের চেয়ে জীবনের রহস্য জানাই যে বেশী গুরুত্বপূর্ণ এই বোধ আমাকে স্বস্তি দেয়। সমবেত আওয়াজ কোন দিক থেকে আসছে তা ঠাহর করে সেদিকে এগিয়ে চলি। আমার আমিকে খোঁজার এ যাত্রার এখানেই সাময়িক বিরতি।                    







স্বাভিমান:SWABHIMAN Headline Animator

^ Back to Top-উপরে ফিরে আসুন