ফোরাম ফর সোশ্যাল হারমনির বুলেটিন – ২ (খসড়া)
Posted by Labels: আসাম, ফ্যাসিবাদ, বরাক উপত্যকা, সংখ্যালঘু, সমাজ
ভূমিকা
(দক্ষিণের গ্রামগুলির বুক চিরে চলে গেছে বদরপুর-করিমগঞ্জ রেল লাইন) |
উমরপুর জিপি’র ২
নং ওয়ার্ডে জাতীয় সড়কের পাশে সানিমূর রেজা চৌধুরী বাড়ির টঙ্গিতে
ফোরাম ফর সোশ্যাল হারমনি’র সমীক্ষক দলের সাথে গ্রামবাসীদের মতবিনিময়ের সভা বসে ২০ ডিসেম্বর,২০১৫ বিকেল ৩ টা
নাগাদ। এটা ছিল ফোরামের দ্বিতীয় সমীক্ষা-অঞ্চল,
প্রথম অঞ্চল বেথুকান্দিতে বাঙালি মুসলমানরা সংখ্যালঘু এবং দ্বিতীয় অঞ্চল উমরপুরে বাঙালি হিন্দুরা
নিতান্তই সংখ্যালঘু। বদরপুর থানার পেছন
দিকে উমরপুর জিপি চলে গেছে জাতীয় সড়কের একপাশে বদরপুর পেট্রল পাম্প পর্যন্ত এবং তারপর রাস্তার দু’পাশ
ঘেঁষে রয়েছে উমরপুর জিপি’র বিভিন্ন ওয়ার্ড।
পেট্রল পাম্প পর্যন্ত জাতীয় সড়কই উত্তরের সীমা, কিন্তু
এরপর উত্তরের সীমা নির্ধারণ করেছে বরাক নদীর
বয়ে চলা জলরাশি। দক্ষিণে রয়েছে হাসান-পুর
জিপি, এংলারবাজার ইত্যাদি স্থান। দুই ভাগে ভাগ করে
উমরপুর জিপি’র দক্ষিণের
গ্রামগুলির বুক চিরে চলে গেছে বদরপুর-করিমগঞ্জ রেল লাইন। এই রেল লাইন এই গ্রামগুলির এক জটিল ভৌগোলিক ও
যোগাযোগের সংকট তৈরি করেছে। এ প্রসঙ্গে
পরে আসছি। সভার স্থান-নাম দিয়ে এই প্রতিবেদন শুরু করার পেছনে যে গুরুত্বপূর্ণ সত্যটি লুকিয়ে আছে সেব্যাপারে
প্রথমে আলোকপাত করা যাক।
সভার স্থান বৈশিষ্ট্য
(চৌধুরী বাড়ির এই সেই টঙ্গি যেখানে আমরা বসেছিলাম।) |
সানিমূর রেজা
চৌধুরী বাড়ির টঙ্গি যেখানে ফোরামের টিম বসেছিল সেই টঙ্গিতে একসময়
যখন করিমগঞ্জ আদালত গড়ে উঠেনি তখন আশপাশের এলাকা সহ বিশাল অঞ্চলের গ্রামীণ বিচারের সভা বসত। এই সালিশি সভায় এই
পরিবারের কর্তাই হতেন সালিশ। তখনকার
সময়ে বিশাল ভূ-সম্পত্তির মালিক এই পরিবারের প্রভাব প্রতিপত্তি তাতে সহজেই অনুমেয়। স্বাধীনতা-পূর্ব সময়ে এই চৌধুরী
বাড়িতে সাত-সাতটি পরিবার ছিল যাদের
মধ্যে ছয়টি পরিবারই আনুমানিক ১৯৫৫ সালের মধ্যেই চলে যান তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান তথা অধুনা বাংলাদেশে। এই
পরিবারগুলির শিক্ষিত সদস্যরা এখন বাংলাদেশের
শীর্ষ সরকারি পদে অধিষ্ঠিত, এমবিবিএস ডাক্তার সদস্য সেখানে গিয়ে এফআরসিএস ডাক্তার হন। সামিনূর রেজা চৌধুরীর
পিতা মৃত আসানূর রেজা চৌধুরী এখানে
থেকে যান ও কংগ্রেসে যোগ দেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্বে শিক্ষা-সম্পত্তিতে
প্রভাবশালী ও স্থানীয় ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা এই পরিবারটির
আগের জৌলুস আর নেই – আগের মত ভূসম্পত্তিও নেই এবং পূর্ব-পাকিস্তানে প্রব্রজিত হওয়ার ফলে
পারিবারিক ঐতিহ্য স্বাধীনতা-উত্তর রাজ্যিক
রাজনীতিতে যে প্রভাব বিস্তারের সুযোগ দিতে পারত তা নিঃশেষ হয়ে যায়। বেশ বড় মাপের জমির উপর অনেক গাছ-পালা দিয়ে
সাজানো গোছানো পরিপাটি এই বাড়িটি
যে মার্জিত রুচির পরিচয় বহন করছিল তাতেই এই স্বচ্ছলতার পেছনের কারণ জানার ঔৎসুক্য দেখা দেয় সমীক্ষক দলের। টিম
সদস্যদের প্রশ্নের উত্তরে বাড়ির বর্তমান
মালিক অত্যন্ত অমায়িক স্বভাবের সামিনূর রেজা চৌধুরী যখন এই তথ্যগুলি
পরিবেশন করছিলেন, তখন উপস্থিত অন্যরা এই কথার সাথে সম্মতি জানিয়ে আরও তথ্য সংযোজন করতে গিয়ে জানান যে এরকম বহু
শিক্ষিত পরিবার স্বাধীনতার পর পূর্ব-পাকিস্তানে
চলে গিয়ে গরিব অশিক্ষিত মুসলিম সমাজকে নেতৃত্বহীন করে দেন।
তবে হিফজুর রহমান খাজাম জানান যে দেওবন্দিদের প্রভাবে মুষ্ঠিমেয় কিছু শিক্ষিত পরিবার এদেশে থেকে যান। কিন্তু শিক্ষিত
মধ্যবিত্ত শ্রেণি হিসেবে এরা
যে খুবই দুর্বল হয়ে পড়েন তা বলাই বাহুল্য। এই তথ্যকে সামনে রেখে বাঙালি মুসলিম সমাজের অভ্যন্তরীণ
আর্থিক-সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতির স্বাধীনতা-উত্তর
ক্রমবিবর্তনের একটা সমীক্ষা-ভিত্তিক বিশ্লেষণের প্রচেষ্টা নিশ্চয়ই
করা যায়, কিন্তু ফোরাম ফর সোশ্যাল হারমনি’র
একদিনের এই গ্রাম-পরিক্রমায় ফোরাম টিমের উপর
অর্পিত যে বিষয় ছিল সে সম্পর্কে যতটুকু জানা
গেছে তা এই প্রতিবেদনে সংক্ষেপে তুলে ধরার চেষ্টা করা যাক।
সম্প্রদায়গত ঐক্য ও বিভেদের নিদর্শন
(গ্রামবাসীদের মতবিনিময়ের সভা ) |
(গ্রামবাসীদের মতবিনিময়ের সভা) |
উমরপুর জিপি’র
একমাত্র ৩ নং ওয়ার্ডে প্রায় ১১৫টি পরিবারের মধ্যে ২/৩ টি মুসলিম
পরিবার ছাড়া বাকী সবাই হিন্দু। বারৈ, পাটনি, রুদ্র
পাল ইত্যাদি জনগোষ্ঠীর লোক ছাড়াও একটি ব্রাহ্মণ
পরিবার রয়েছে সেখানে। এই ব্রাহ্মণ পরিবারের
সদস্য পেশায় উকিল বলাই চক্রবর্তী এ অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অসংখ্য নজির তুলে ধরে বলেন যে সাম্প্রদায়িকতা এ
অঞ্চলে কোন বিষয়ই নয়, বরঞ্চ ফোরামের
মনোনিবেশ করা উচিত জাতীয় সড়কের বেহাল অবস্থা নিয়ে এবং এটাই এই অঞ্চলের প্রধান সমস্যা। তবে যখন জানতে চাওয়া হয়
যে এবারের নির্বাচনে জাতীয় সড়কই
কি প্রধান বিষয় হবে, না সম্প্রদায়গত পরিচিতিতেই মানুষ ভোট দেবে,
তখন তাঁকে খানিকটা
দ্বিধান্বিত বোধ করতে দেখা যায়। ভাষা যে শুধু যোগাযোগের মাধ্যম
নয়, মানসিক গঠনেরও বহিঃপ্রকাশ তাঁর বক্তব্য শুনতে শুনতে আমাদের এরকমই মনে হচ্ছিল। তবে এ অঞ্চলের বাসিন্দা
জয়দেব পাল খানিকটা ভিন্ন বাস্তবতার
দিকে ইঙ্গিত করেন। তিনি বলেন হিন্দুদের মধ্যে মুষ্টিমেয় উপরের স্তরের লোক রয়েছেন তারা সবসময়ই সম্প্রীতির নজির
তুলে ধরেন যাতে স্থানীয় রাজনৈতিক
ক্ষমতাবানদের কাছ থেকে সুবিধা আদায়ে কোন বিঘ্ন না ঘটে, কিন্তু
এটা ঘটনা যে উমরপুর চত্বরের ব্যবসায়ী ও
চাকুরীজীবী কয়েকটি পরিবার জমিজিরেত বিক্রি
করে বদরপুর রেল কলোনিতে চলে গেছেন। অর্থনৈতিক কারণ ছাড়াও মুসলিম এলাকা ছেড়ে হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় চলে যাওয়ার পেছনে
স্বাচ্ছন্দ্যবোধের মানসিক দূরত্বও
এক্ষেত্রে কাজ করেছে, যদিও স্থানীয় রাজনৈতিক ক্ষমতার এক ভিন্ন অসাম্প্রদায়িক সমীকরণের নিদর্শন রয়েছে এ
অঞ্চলে। জিপি’র ১ নং ওয়ার্ডের ওয়ার্ড-মেম্বার
নির্বাচনে ২৫০ জন ভোট দেন, তারমধ্যে আনুমানিক ৫০ জন হিন্দু, তথাপি
হিন্দু প্রার্থী নির্বাচিত হোন। পঞ্চায়েতের সহ-সভাপতি পদে হিন্দু
প্রার্থীকে নির্বাচিত করা হয়, যেখানে আনুমানিক ১০ হাজার জনসংখ্যার এই পঞ্চায়েতে মাত্র আনুমানিক ১৫০০ জন হিন্দু।
স্থানীয়ভাবে সম্প্রীতির বাতাবরণ
যে বিদ্যমান সেব্যাপারে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সবাই বিভিন্ন উদাহরণ তুলে ধরেন, আবার
সামগ্রিক সাম্প্রদায়িক পরিবেশ কীভাবে মানসিক দূরত্ব তৈরি
করে ও জীবন জীবিকায় প্রভাব ফেলে তারও উদাহরণ তুলে ধরেন। হিফজুর রহমান খাজাম বলেন দেওরাইল খাদিম পাড়ায় যেসব পরিবার
রয়েছে তারমধ্যে এক চন্দবাড়িও ছিল।
সেই পাড়ার আদম খাকির মোকামের খাদিম হিসেবে চন্দবাড়িকেও গণ্য করা হত এবং তারাও নিজেদেরকে মোকাম কেন্দ্রিক
অনুষ্ঠানের সক্রিয় সদস্য হিসেবেই ভাবতেম,
কিন্তু নব্বইয়ের বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনার পর একটা মানসিক প্রাচীর তৈরি হয়ে গেছে। কর্মকার দত্তদের বসত এলাকা
লালোগ্রামে একসময় ঘটা করে প্রতিবছর
নৌকাপূজা হতো এবং এই নৌকাপূজায় দলে দলে মুসলিম সাধারণ মানুষ অংশগ্রহণ
করতেন। আর্থিক অনটনের কারণে ঘটা করে এখন আর এই নৌকাপূজা হয় না এবং হিন্দু-মুসলিম মেলাপ্রীতির যে সামাজিক পরিসর এই
অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে তৈরি
হতো অন্য কোন মাধ্যম তা আর তৈরি করতে পারেনি। তবে সাম্প্রতিক কোন এক বছরে ঈদ ও দূর্গাপূজা একই দিনে ছিল, সেইসময়
কিছু বিশিষ্ট হিন্দু-মুসলিম ব্যক্তিদের
নিয়ে একটি মিলন অনুষ্ঠান করা হয়েছিল। তাঁর এই বক্তব্য থেকে একথা পরিষ্কার যে হিন্দু-মুসলিম আম জনতার যে সামাজিক
মেলবন্ধনের প্রচলিত অনুষ্ঠানগুলি
ছিল তা ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, তার পরিবর্তে সম্প্রীতির যেটুকু প্রয়াস বিদ্যমান তা
বিশিষ্টজনদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে এবং
তাতে আমজনতাকে আকর্ষিত করার মত প্রাণের টান নেই। নতুন সমাজ গঠনের আন্দোলনের মধ্যেই আমজনতার সামাজিক মিলনের নতুন
রূপ নির্মাণের রহস্য লুকিয়ে আছে
কিনা তা আমাদের ভেবে দেখা উচিত।
ফরিজ উদ্দিন আহমেদ জানান যে ১৯৯৩ সালে তিনি বদরপুর হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে বিজ্ঞান শাখায় এইচএস ক্লাসে পড়তেন। তার ক্লাসে তিনিই ছিলেন একমাত্র মুসলিম ছাত্র। সেসময় একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে শুনতে পান যে বদরপুর চৌমাথায় হিন্দু-মুসলিম দু’পক্ষের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বেঁধেছে। তার সহপাঠীদের সহায়তায় তিনি কোনক্রমে বাড়ি ফেরেন। সেসময় তার পরীক্ষা চলছিল, কিন্তু প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা দেওয়ার জন্য তিনি আর স্কুলে যাওয়ার সাহস করেননি এবং ফলে তার পড়াশোনার পাট এখানেই শেষ হয়।
এই আলাপচারিতায় ফোরাম টিমের ধারণা জন্মে যে এই অঞ্চলে হিন্দু-মুসলিম পরস্পর সহযোগিতার পরিবেশ রয়েছে। কিন্তু এই পরিবেশ আরও সুদৃঢ় ঐক্যের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে অন্তত মানসিক স্তরে বিভাজনের অস্পষ্ট রেখাগুলি ফোটে উঠছে, বিশেষ করে নব্বইয়ের দশক থেকে। নতুন আন্দোলনের সূচনা ও আমজনতার সামাজিক মেলবন্ধনের নতুন রূপ দিয়ে পুরোনো ও প্রচলিত রূপগুলিকে প্রতিস্থাপিত করার মধ্য দিয়েই সামাজিক বিভাজনের গতির মুখকে ঐক্যের দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া যেতে পারে। সেরকম বাস্তব পরিস্থিতি সেখানে রয়েছে, প্রয়োজন শুধু সৃজনশীল স্থানীয় সাংগঠনিক উদ্যোগ। সেই বাস্তব পরিস্থিতিটি কীরকম এবার দেখা যাক।
ঐক্য গড়ার বস্তুগত ভিত্তি ও আমজনতার সমস্যা
জিপি পঞ্চায়েত প্রেসিডেন্টের প্রতিনিধি আসাব উদ্দিন জানান যে এই জিপি’র ১০ টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১ থেকে ৫ নং ওয়ার্ডের ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ বাসিন্দা বিপিএল স্তরের। ২ ও ৪ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দারা ভীষণভাবে বঞ্চিত, কেন তারা বেশি বঞ্চিত সেটা অবশ্য জানা যায়নি। ২ নম্বর ওয়ার্ডের ৭৫ বছরের তসলিম উদ্দিন জানান ১ ও ২ নম্বর ওয়ার্ডে ১ শতাংশ লোক ছোটখাটো চাকুরী করেন, বাকী সবাই দৈনিক আয়ের উপর নির্ভরশীল শ্রমজীবী মানুষ। সবার দেওয়া হিসাবের ভিত্তিতে অনুমান লাগানো যায় যে এই জিপিতে গড়ে অনুমানিক ৭০-৮০ শতাংশ লোক বিপিএল ও শ্রমজীবী মানুষ যাদের অধিকাংশই দিনমজুর। এই শ্রমজীবী মানুষ যেহেতু তাদের আর্থিক ও সামাজিক সুরক্ষা নিয়েই সদা ব্যস্ত ও চিন্তিত, তাই তারাই হতে পারেন নতুন ঐক্য গড়ে তোলার বস্তুগত ভিত্তি এবং শিক্ষিত মধ্যশ্রেণির সচেতন অংশ হতে পারে এই ঐক্য গড়ে তোলার পরিপূরক সহায়ক শক্তি।
সভায় উপস্থিত সবাই যখন পঞ্চায়েতের সমস্যাগুলির কথা বলতে শুরু করেন তখনই সভায় এসে উপস্থিত হোন পঞ্চায়েত সভাপতি প্রতিনিধি আসাব উদ্দিন। সবাই তখন তাকে সমস্যাগুলোর কথা তুলে ধরতে বলে। তিনি আরও জানান, খাদ্য সুরক্ষা কার্ডে পরিবারের অনেক সদস্যদের নাম বাদ দিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে যে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে তা আসলে জেলা সদরে প্রশাসনিক গাফিলতির ফল, পঞ্চায়েত থেকে সঠিক তথ্য পরিবেশন করা হয়েছে। তিনি অকপটে স্বীকার করেন যে এমজিএনআরইজি’র কোন কাজ বর্তমানে চালু নেই, পঞ্চায়েত সভাপতির একাউন্টে ফাণ্ড আসা সত্তেও শৌচালয় নির্মাণে ব্যাপক অনিময় রয়েছে কারণ চাপের মুখে তিনি ফাণ্ড রিলিজ করতে বাধ্য হোন, পানীয় জলের সুবিধার ক্ষেত্রে তিনি জানান যে মোড়ল পাড়ায় পিএইচই প্ল্যান্ট অবস্থিত হওয়া সত্ত্বেও এই পাড়ার বাসিন্দারাই জল পান না। শৌচাগার নির্মাণের ক্ষেত্রে অনিয়মের চালচিত্র বর্ণনা করে রেহান উদ্দিন লস্কর বলেন যে স্বচ্ছ ভারত অভিযান আসলে আমাদের গ্রামে অর্থহীন হয়ে পড়েছে। চাষবাস সম্পর্কে সবার মত হচ্ছে এই যে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায়, ফসলের ন্যায্য দাম না পাওয়ায় এবং জলসেচ ইত্যাদির মাধ্যমে এক ফসলি জমিকে ২/৩ ফসলিতে রূপান্তরিত করার জন্য কোন সরকারি ব্যয় না থাকায় চাষবাস এখন আর লাভজনক নয় এবং চাষবাস থেকে আয় অতি নগণ্য।
ফরিজ উদ্দিন আহমেদ জানান যে ১৯৯৩ সালে তিনি বদরপুর হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে বিজ্ঞান শাখায় এইচএস ক্লাসে পড়তেন। তার ক্লাসে তিনিই ছিলেন একমাত্র মুসলিম ছাত্র। সেসময় একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে শুনতে পান যে বদরপুর চৌমাথায় হিন্দু-মুসলিম দু’পক্ষের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বেঁধেছে। তার সহপাঠীদের সহায়তায় তিনি কোনক্রমে বাড়ি ফেরেন। সেসময় তার পরীক্ষা চলছিল, কিন্তু প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা দেওয়ার জন্য তিনি আর স্কুলে যাওয়ার সাহস করেননি এবং ফলে তার পড়াশোনার পাট এখানেই শেষ হয়।
এই আলাপচারিতায় ফোরাম টিমের ধারণা জন্মে যে এই অঞ্চলে হিন্দু-মুসলিম পরস্পর সহযোগিতার পরিবেশ রয়েছে। কিন্তু এই পরিবেশ আরও সুদৃঢ় ঐক্যের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে অন্তত মানসিক স্তরে বিভাজনের অস্পষ্ট রেখাগুলি ফোটে উঠছে, বিশেষ করে নব্বইয়ের দশক থেকে। নতুন আন্দোলনের সূচনা ও আমজনতার সামাজিক মেলবন্ধনের নতুন রূপ দিয়ে পুরোনো ও প্রচলিত রূপগুলিকে প্রতিস্থাপিত করার মধ্য দিয়েই সামাজিক বিভাজনের গতির মুখকে ঐক্যের দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া যেতে পারে। সেরকম বাস্তব পরিস্থিতি সেখানে রয়েছে, প্রয়োজন শুধু সৃজনশীল স্থানীয় সাংগঠনিক উদ্যোগ। সেই বাস্তব পরিস্থিতিটি কীরকম এবার দেখা যাক।
ঐক্য গড়ার বস্তুগত ভিত্তি ও আমজনতার সমস্যা
জিপি পঞ্চায়েত প্রেসিডেন্টের প্রতিনিধি আসাব উদ্দিন জানান যে এই জিপি’র ১০ টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১ থেকে ৫ নং ওয়ার্ডের ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ বাসিন্দা বিপিএল স্তরের। ২ ও ৪ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দারা ভীষণভাবে বঞ্চিত, কেন তারা বেশি বঞ্চিত সেটা অবশ্য জানা যায়নি। ২ নম্বর ওয়ার্ডের ৭৫ বছরের তসলিম উদ্দিন জানান ১ ও ২ নম্বর ওয়ার্ডে ১ শতাংশ লোক ছোটখাটো চাকুরী করেন, বাকী সবাই দৈনিক আয়ের উপর নির্ভরশীল শ্রমজীবী মানুষ। সবার দেওয়া হিসাবের ভিত্তিতে অনুমান লাগানো যায় যে এই জিপিতে গড়ে অনুমানিক ৭০-৮০ শতাংশ লোক বিপিএল ও শ্রমজীবী মানুষ যাদের অধিকাংশই দিনমজুর। এই শ্রমজীবী মানুষ যেহেতু তাদের আর্থিক ও সামাজিক সুরক্ষা নিয়েই সদা ব্যস্ত ও চিন্তিত, তাই তারাই হতে পারেন নতুন ঐক্য গড়ে তোলার বস্তুগত ভিত্তি এবং শিক্ষিত মধ্যশ্রেণির সচেতন অংশ হতে পারে এই ঐক্য গড়ে তোলার পরিপূরক সহায়ক শক্তি।
সভায় উপস্থিত সবাই যখন পঞ্চায়েতের সমস্যাগুলির কথা বলতে শুরু করেন তখনই সভায় এসে উপস্থিত হোন পঞ্চায়েত সভাপতি প্রতিনিধি আসাব উদ্দিন। সবাই তখন তাকে সমস্যাগুলোর কথা তুলে ধরতে বলে। তিনি আরও জানান, খাদ্য সুরক্ষা কার্ডে পরিবারের অনেক সদস্যদের নাম বাদ দিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে যে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে তা আসলে জেলা সদরে প্রশাসনিক গাফিলতির ফল, পঞ্চায়েত থেকে সঠিক তথ্য পরিবেশন করা হয়েছে। তিনি অকপটে স্বীকার করেন যে এমজিএনআরইজি’র কোন কাজ বর্তমানে চালু নেই, পঞ্চায়েত সভাপতির একাউন্টে ফাণ্ড আসা সত্তেও শৌচালয় নির্মাণে ব্যাপক অনিময় রয়েছে কারণ চাপের মুখে তিনি ফাণ্ড রিলিজ করতে বাধ্য হোন, পানীয় জলের সুবিধার ক্ষেত্রে তিনি জানান যে মোড়ল পাড়ায় পিএইচই প্ল্যান্ট অবস্থিত হওয়া সত্ত্বেও এই পাড়ার বাসিন্দারাই জল পান না। শৌচাগার নির্মাণের ক্ষেত্রে অনিয়মের চালচিত্র বর্ণনা করে রেহান উদ্দিন লস্কর বলেন যে স্বচ্ছ ভারত অভিযান আসলে আমাদের গ্রামে অর্থহীন হয়ে পড়েছে। চাষবাস সম্পর্কে সবার মত হচ্ছে এই যে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায়, ফসলের ন্যায্য দাম না পাওয়ায় এবং জলসেচ ইত্যাদির মাধ্যমে এক ফসলি জমিকে ২/৩ ফসলিতে রূপান্তরিত করার জন্য কোন সরকারি ব্যয় না থাকায় চাষবাস এখন আর লাভজনক নয় এবং চাষবাস থেকে আয় অতি নগণ্য।
জ্বলন্ত সমস্যা
(ব্যানারে জ্বলন্ত সমস্যা) |
(ব্যানারে জ্বলন্ত সমস্যা) |
(সংবাদে জ্বলন্ত সমস্যা) |
সংবাদে জ্বলন্ত সমস্যা |
সংবাদে জ্বলন্ত সমস্যা |
সংবাদে জ্বলন্ত সমস্যা |
সংবাদে জ্বলন্ত সমস্যা |
সংবাদে জ্বলন্ত সমস্যা |
সংবাদে জ্বলন্ত সমস্যা |
স্মারকপত্রে জ্বলন্ত সমস্যা |
স্মারকপত্রে জ্বলন্ত সমস্যা |
ভাঙ্গা হায়ার সেকেন্ডারি
স্কুলের শিক্ষক আব্দুল কায়ূম
লস্কর যোগাযোগের অব্যবস্থার জন্য মালুয়া-কান্দিগ্রাম-চৈতন্যনগর-জগন্নাথপুর-পাটারাকান্দি
গ্রামের দুরবস্থার বাস্তব চিত্র ও
ঐ এলাকার বাসিন্দাদের অবর্ণনীয় দুর্দশার কথা তুলে ধরেন এবং জাতীয়
সড়ক মেরামতির উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। এই এলাকার জ্বলন্ত সমস্যা নিয়ে বিস্তৃত তথ্য তুলে ধরেন এই এলাকার শিক্ষিত
উঠতি যুবক হালিম আহমেদ তালুকদার।
বদরপুর-করিমগঞ্জ রেল লাইন ছয়টি বড় বড় গ্রামকে জাতীয় সড়ক, বাজার
ও চিকিৎসা কেন্দ্রের সাথে যান চলাচলের
যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। এই গ্রামগুলির
বাসিন্দাদের এক গ্রামের সাথে অন্য গ্রামের এবং বাজার, চিকিৎসাকেন্দ্রের
সাথে যোগাযোগের জন্য প্রায় ১০ কিঃমিঃ পথ ঘুরে মকইভাঙা বা দরগাবাজার
হয়ে জাতীয় সড়কে আসতে হয়। বদরপুরের দিকে একটি গ্রামের মানুষ ১-২ কিঃমিঃ পথ অতিক্রম করে জাতীয় সড়কে আসতে পারে,
কিন্তু এই গ্রামের সাথে অন্য গ্রামের
কোন যোগাযোগের রাস্তা না থাকায় তারা এই পথে বেরুতে পারে না। এক জটিল ভৌগোলিক পরিস্থিতি এই গ্রামবাসীদেরকে
যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। গ্রামীণ
রাস্তা রেল লাইনের পাশে এসে শেষ হয়ে গেছে যেখানে রেল লাইনের নীচ দিয়ে রাস্তার দাবিতে ব্যানার টাঙিয়ে ও ব্রডগেজ
রেল লাইন কাজে আপত্তি জানিয়ে গ্রামবাসীরা
তাদের প্রতিবাদ সাব্যস্ত করছেন। সভা শেষে রাতের আঁধারে সেই এলাকা
পরিদর্শনে টিমের সদস্যরা যান এবং সভ্য সমাজে যোগাযোগের এই সামান্য ব্যবস্থা করতে না পারার জন্য স্তম্ভিত হয়ে যান।
আব্দুল কায়ুম লস্কর জানান যে তারা গ্রামীণ রাস্তা বরাবর ছয়টি স্থানে রেল
লাইনের নীচ দিয়ে জাতীয় সড়কে যাওয়ার
ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য দীর্ঘদিন থেকে দাবি জানিয়ে আসছেন। রেল কর্তৃপক্ষ ফিল্ড সার্ভে করে তিনটি স্থানে
এধরনের ব্যবস্থা করার প্রস্তাব জেলা
প্রশাসনের অনুমোদনের জন্য পাঠায়। কিন্তু কোন এক অজ্ঞাত কারণে তিনটির অনুমোদন না দিয়ে ছয়টি এরকম টানেল বানানোর
প্রস্তাব পাঠানো হয় রেল কর্তৃপক্ষের
কাছে। তখন ৫ কোটি টাকা জমা দিলে এই কাজটি করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে
রেল কর্তৃপক্ষ রাজ্য সরকারের কোর্টে বল ঠেলে দেয়। রাজনৈতিক টানাপোড়নে প্রভাবিত প্রশাসনিক কেরামতিতে টানেল বানানোর
কাজ বন্ধ হয়ে যায় এবং যথারীতি ব্রডগেজ
নির্মাণের কাজ চলতে থাকে। তবে প্রতিশ্রুতি মত রেল দপ্তর যদি টানেল না বানায় তবে ব্রডগেজ কাজে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে
গ্রামবাসীরা বদ্ধপরিকর। গ্রামবাসীদের
দাবি অত্যন্ত ন্যায্য এবং এই কাজ করতে প্রয়োজনীয় অর্থের পরিমাণও
খুব বেশি নয়, অভাব শুধু রাজনৈতিক সদিচ্ছার।
উপসংহার
বেহাল জাতীয় সড়কের ধকল
এড়াতে ফোরামের টিমের গাড়ি পেছনের গ্রামীণ বাজার ও ধানক্ষেত বরাবর
পাকা রাস্তার আলো-আঁধারের মায়াজাল ভেদ করে সোজা পাঁচগ্রাম রেলগেটের সামনে এসে শিলচর শহর অভিমুখে যাত্রা করে। কী
দেখলাম তা নিয়ে কথা হচ্ছিল গাড়ির
যাত্রী টিম সদস্যদের মধ্যে, শিলচর যখন পৌঁছলাম তখন মনে হলো অনেক কিছুই দেখা ও জানা হয়নি।