সংখ্যালঘু প্রশ্ন ও ভারতীয় গণতন্ত্র
Posted by
সংখ্যালঘু প্রশ্ন ও ভারতীয় গণতন্ত্র
(আমাদের সমকালে প্রকাশিত)
সংখ্যালঘু কীভাবে সংখ্যালঘু হয়ে উঠল? প্রশ্নটি বেয়াড়া মনে
হলেও এর উত্তর ইতিহাসে নিহিত। সংখ্যালঘুর বাস্তব অস্তিত্ব, এবং চেতনায় সংখ্যালঘু অস্তিত্বের
বহিঃপ্রকাশ - এই দু’য়ের মধ্যে রয়েছে বিস্তর
ফারাক। সংখ্যাগুরুর চেতনায় সংখ্যালঘু
সম্পর্কে ধারণা তৈরি হওয়া ও সংখ্যালঘুর নিজের মধ্যে সেই ধারণার সুস্পষ্ট রূপ পাওয়া
এই দু’য়ের আন্তঃক্রিয়া রাষ্ট্রনীতিকে প্রভাবিত করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও উপনিবেশ
বিরোধী আন্দোলনের আগে সংখ্যালঘু প্রশ্ন রাষ্ট্রনীতিকে প্রভাবিত করতে পারেনি। তার
মানে এই নয় যে তার আগে সংখ্যালঘুর কোনো অস্তিত্বই ছিল না। একটি স্থূল উদাহরণ দিয়ে
বিষয়টি বোঝানোর চেষ্টা করা যাক। ‘আমি প্রতিদিন হেঁটে অফিসে যাই’ এই বিবৃতির মধ্যে
রাস্তার কথা উহ্য, কারণ সেটা বাস্তবে বিশেষত্বহীনভাবে উপস্থিত আছে। যদি তীব্র
দাবদাহে রাস্তার পিচ গলে যায় তাহলে এই পরিবর্তীত বাস্তবকে বোঝাতে তখন বলতে হবে
‘প্রতিদিনকার মত অফিসে হেঁটে যেতে আজ অতি সন্তর্পণে রাস্তার গলা পিচকে পাশ কাটিয়ে
যেতে হয়েছে’। এখানে রাস্তা নিজের অস্তিত্বকে জানান দিচ্ছে, পথচারীকেও এই পরিবর্তীত
পরিস্থিতিতে নিজের স্বার্থেই এক বিশেষ পদক্ষেপ নিতে হচ্ছে। রাস্তার মত জড় পদার্থের
ক্ষেত্রে বিষয়টি অত্যন্ত সরল, কিন্তু নিয়ত পরিবর্তনশীল ও জীবন্ত মানব সমাজের
ক্ষেত্রে এই প্রক্রিয়াটি বেশ জটিল। যাইহউক, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিশ্বব্যাপী
ব্যাপক প্রব্রজনের ফলে জনবিন্যাসে পরিবর্তন এবং উপনিবেশ বিরোধী জনজাগরণের গর্ভে
জন্ম নেওয়া সমাজের অভ্যন্তরীণ উথালপাতালের ফলে বাস্তবে বিদ্যমান বিভিন্ন
জনগোষ্ঠীগত নিপীড়ণ ও বঞ্চনার প্রশ্নটি সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগুরুর বয়ানে সচেতন ভাষা পায়।
সংখ্যালঘুর সংখ্যালঘু হিসেবে অধিকার প্রতিষ্ঠার আকাঙ্খা ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র
পরিচালনায় একে সামিল করে নেওয়ার সংখ্যাগুরুর গণতান্ত্রিক দায়িত্ব পরষ্পর পরিপূরক হিসেবে
আমাদের সামনে উপস্থিত হয়।
সংখ্যালঘু হয়ে উঠার ক্ষেত্রে আরও কিছু কথা বলে নেওয়া
প্রয়োজন। কোনো ব্যক্তির কোনো গোষ্ঠীতে জন্ম নেওয়াই গোষ্ঠী পরিচিতির পেছনে অন্যতম
কারণ নয়। নির্ভরতার বিভিন্নধরনের ও জটিল সম্পর্ক স্থাপনের মধ্য দিয়ে ব্যক্তি গোষ্ঠী
চেতনায় উপনীত হয়। গোষ্ঠী চেতনা ভাষা, এথনিসিটি, রেস, ধর্ম ইত্যাদিকে ভিত্তি করে
গড়ে উঠে এবং ব্যক্তির আদিম নঞর্থক পরিচিতি গোষ্ঠী পরিচিতির স্বার্থকে জাহির করায়
রূপান্তরিত হয়। এটা চেতনার একধরনের অগ্রগতীও বটে। কিন্তু এই অগ্রগতীর মধ্যেই নতুন
বিপত্তি লুকিয়ে থাকে। এই চেতনা গোষ্ঠীর অভ্যন্তরে সবকিছু ভাল, আর এর বাইরে সবকিছু
খারাপ - এরকম এক ধারণার জন্ম দেয়। কোনো গোষ্ঠী যখন অন্য গোষ্ঠীর সংখ্যাধিক্য কিংবা
আধিপত্যের ফলে নিজেদেরকে বঞ্চিত বলে ভাবতে শুরু করে তখনই সংখ্যালঘু সংখ্যালঘু হয়ে
উঠে। এই গোষ্ঠী চেতনাকে অস্বীকার, অবজ্ঞা বা দমন করে ব্যক্তি স্বাধীনতার আধুনিকতা ও
গণতন্ত্রকে সাব্যস্ত করা যায় না।
সংখ্যালঘুর ভারতীয় বয়ান
স্বাধীনতা-উত্তর ভারতবর্ষে সংঘপরিবারের সংখ্যাগুরুবাদী
সাম্প্রদায়িক আদর্শে ধর্মীয় রাষ্ট্র ও অতীত পুনরুত্থানের গান্ধীবাদী আদর্শে
অনুপ্রাণিত রাষ্ট্রকে অস্বীকার করে নেহেরুবাদী আধুনিক রাষ্ট্র গঠনের যে প্রয়াস শুরু
হয়েছিল তা উপরোক্ত বাস্তব প্রেক্ষিতের মধ্যে নিহিত। সংঘ পরিবার এমন এক তাত্ত্বিক
যুক্তি প্রতিষ্ঠিত করতে চায়, যে মত অনুযায়ী সংখ্যালঘুদের রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক
স্বীকৃতির মাধ্যমে সংখ্যালঘু তৈরি করা হয়। এরজন্যই তারা সংখ্যালঘু অধিকারের পক্ষে
কোনো বয়ান কিংবা সংখ্যালঘুর জন্য নির্ধারিত যে কোনো কল্যাণকামী পদক্ষেপের বিরোধিতা
করে এবং সংখ্যালঘু তোষণবাদ হিসেবে প্রচার করে সংখ্যাগরিষ্ঠবাদকে উষ্কে দেয়। একটি
উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টাকে ব্যাখ্যা করা যাক। রাস্তায় প্রহরারত পুলিশ যখন চেঁচিয়ে
বলে “হে তুম, রোখো”, তখন সেই নির্দিষ্ট ব্যক্তিটি ফিরে তাকায় এবং এভাবে বিষয় (subject) নিজেকে বিষয় করে তোলে। অর্থাৎ বিষয়ের দিকে দৃষ্টি
নিবদ্ধ করেই বিষয়কে বিষয় করে তোলা হয়, তার আগে পর্যন্ত বিষয়ের কোনো অস্তিত্ব নেই।
এভাবে তারা ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতকে নাকচ করে দিয়ে তাৎক্ষণিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার উপর
গুরুত্ব আরোপ করে এবং এভাবে সংখ্যালঘুর অস্তিত্বকে অস্বীকার করে কিংবা সংখ্যালঘুর
অস্তিত্বকেই ধ্বংস করে দিতে চায়। এভাবে অনৈতিহাসিক ও অবৈজ্ঞানিক প্রকরণের মধ্যে
গণতন্ত্রের যে কোনো স্থান নেই তা বলাই বাহুল্য, বরঞ্চ এই প্রকরণ অনুকূল
পরিস্থিতিতে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার যুক্তিকাঠামো হিসেবে পরিগণিত হয়। অন্যদিকে
গান্ধীবাদের মধ্যে অতীত সমাজের পুনরুত্থানের এক রোমান্টিসিজম বিদ্যমান। নিয়ত
পরিবর্তনশীল সামাজিক কাঠামোয় পুরোনো সমাজ ব্যবস্থাকে অবিকল পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা
সম্ভব নয়, তা করতে গেলে সামাজিক বিকৃতি দেখা দেওয়া সম্ভব এবং সংখ্যালঘুর অধিকার
মানার যে আধুনিক গণতান্ত্রিক বয়ান তাকে অস্বীকার করা হয়। এটা নিশ্চয়ই বলা যায় যে
নেহেরুর আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণ প্রক্রিয়ায় বহু খামতি ছিল এবং একে আরও
বিকশিত করার প্রয়োজন ছিল, কিন্তু যারা সংখ্যালঘু অধিকারের প্রশ্নকে কেন্দ্র করে
সম-অধিকার ও সম-মর্যাদা প্রতিষ্ঠার গণতান্ত্রিক ধারণাকেই নস্যাৎ করে দিতে উদ্যত
তাদের প্রয়াস নিশ্চিতভাবে বিপজ্জনক। নেহেরুবাদী রাষ্ট্র গঠনের বয়ানে যুক্তি ও
প্রগতির আধুনিক ধারণা প্রোথিত ছিল, কিন্তু এর স্বরূপ ছিল এলিটিস্ট, কারণ এই বয়ানে
ধরে নেওয়া হতো যে আম-জনতা স্থবির ও পিছিয়ে পড়া যাদেরকে অন্ধরকার থেকে আলোয় আনতে
হবে। দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ-বিভাজনের মাধ্যমে যে ভারতীয় রাষ্ট্র জন্ম হয়
তাতে জাতি-রাষ্ট্রের উপাদান ছিল প্রবল। এই জাতি-রাষ্ট্র ভাষা-সংস্কৃতির একধরনের
সমসত্তা দাবি করে। তাই নেহেরুবাদী আধুনিক ভারতীয় রাষ্ট্রে সংখ্যালঘু প্রশ্নের
মীমাংসার একমাত্র পথ রয়ে যায় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আন্দোলনের মাধ্যমে অধিকার
আদায়ের পথ। স্বাধীনতা সংগ্রামের দিয়ে মধ্য যে বৈচিত্র্যময় জনগোষ্ঠীগত চেতনা জাগ্রত
হয়েছিল, স্বাধীন ভারতীয় রাষ্ট্র গঠনের সময় জাতি-রাষ্ট্রের ধারণাকে খানিকটা নমনীয়
করে ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠন ও সংখ্যালঘুর কিছু সাংবিধানিক অধিকার মেনে নিয়ে এরজন্য
কিছু জায়গা ছেড়ে দেওয়া হয়। নেহেরুবাদী আধুনিক রাষ্ট্র গঠনের এই দুর্বলতার মধ্যেই
লুকিয়ে আছে সংকটকালে আগ্রাসী জাতিয়তাবাদীদের উত্থানের রহস্য। এরজন্যই
স্বাধীনতা-উত্তর ভারতবর্ষের ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে যখনই কোনো পরিচিতির দাবি
জোরদার হয় তখনই এর সামনে ভারত রাষ্ট্রের সাংবিধানিক ব্যবস্থাকে মনে হয় অসহায়।
ভারতীয় উপমহাদেশে পরিচিতির সীমা ও স্তরতন্ত্র অত্যন্ত অনমনীয়, কারণ যারা শাসন
ব্যবস্থায় আধিপত্য বজায় রেখেছে তারা প্রতিনিয়ত বাকী সব পরিচিতিদের অপর হিসেবে হেয়
প্রতিপন্ন করে ও দাবিয়ে রাখে। ভারতীয় দলিতদের ক্ষেত্রে এই বাস্তবটি অত্যন্ত
রূঢ়ভাবে উন্মোচিত। তথাকথিত আধুনিকতার বয়ানেও এই সমস্যা রয়েছে - ব্যক্তি স্বাধীনতার
প্রবক্তারা ব্যক্তি স্বাধীনতা ও গোষ্ঠীগত অধিকার এই দু’য়ের মধ্যেকার আন্তঃসম্পর্ককে
দেখতে অপারগ।
সংখ্যালঘুর অধিকার
ভারতবর্ষে সংখ্যালঘু অধিকারের প্রশ্নটি বেশ জটিল। আমাদের
দেশে ১৮টি অষ্টম তপসিলিভুক্ত স্বীকৃত ভাষা সহ ৪৬০০ ভাষা/উপভাষা রয়েছে যেগুলি ১২ টি
ভাষা-পরিবারের ও ২৪টি লিপির অন্তর্ভুক্ত। আমাদের দেশে ২৮০০ এথনিক কম্যুনিটি এবং
২০,০০০ বর্ণগোষ্ঠী রয়েছে। ভারতে বিশ্বের সব প্রধান ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বাস। একই
জনগোষ্ঠীর বহুমাত্রিক পরিচিতি ভারতীয় বৈচিত্র্যের বৈশিষ্ট্য। উপরন্তু একথা মনে
রাখা উচিত যে কোনো ধর্মীয় জনগোষ্ঠীই সমসত্তাবিশিষ্ট নয়।
ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ হওয়ায় ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকারের
প্রশ্নটি সবসময়ই স্পর্শকাতর। কিন্তু স্বাধীনতা-উত্তর সময় থেকে আজ পর্যন্ত আমরা বহু
পরিচিতির বহুবিধ দাবি উত্থাপিত হতে দেখছি। প্রারম্ভিক ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের পরও
ভাষিক-পরিচিতিকে ভিত্তি করে নতুন রাজ্য গঠন হতে দেখেছি। সম্প্রতি এমনকি জাঠ –
মারাঠাদের মত প্রাগ্রসর পরিচিতিও সংরক্ষণের দাবি তুলছে। আসামে বিভিন্ন জনজাতীয়রা
সংরক্ষণের দাবি জানাচ্ছে, বাঙালিরা চাইছে ভাষিক পরিচিতির নিরাপত্তা। দেশব্যাপী
দলিত আন্দোলন নতুন নতুন মাত্রা নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। তালিকা দীর্ঘ না করে
আমরা একথা নির্বিবাদে বলে দিতে পারি যে এদের সবার মধ্যে রয়েছে সংখ্যালঘু
মনস্তস্ত্ব। তাই এধরনের সব জনগোষ্ঠীকে আমরা এককথায় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী হিসেবে
চিহ্নিত করতে পারি। নির্ধারিত জনগোষ্ঠী নিজেকে কীভাবে দেখে তার মাধ্যমে এবং
জনগোষ্ঠীগত সীমার বাইরে অন্যরা বা সংখ্যাগুরুরা যেভাবে নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীকে দেখে
তার সাথে আলাপচারিতা বা তাকে সংগ্রামের মাধ্যমে মোকাবিলা করার মধ্য দিয়ে সংখ্যালঘু
পরিচিতি গড়ে উঠে। মুসলমানদের উদাহরণই ধরা যাক, কারণ মুসলমান প্রশ্নটি আজকের ভারতে
প্রধান বিচার্য বিষয়। মুসলিম পরিচিতির একটি উপাদান যেমনি মুসলমানরা নিজেদেরকে
কীভাবে দেখে, ঠিক তেমনি অ-মুসলমানরা মুসলমানদের কীভাবে দেখে তার সাথে ডায়লগের
মাধ্যমে কিংবা সংগ্রামের মাধ্যমে মোকাবিলা করার মধ্য দিয়েই মুসলমানদের সংখ্যালঘু
পরিচিতির স্বরূপ নির্ধারিত হয়ে চলেছে প্রতিনিয়ত।
ভারতবর্ষের সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাসে সংখ্যালঘু প্রশ্নটি এক
গুরুত্ত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। স্বাধীনতা সংগ্রামের পর্যায়ে সামাজিক উথালপাতাল
সংখ্যালঘুর অস্তিত্বকে যেভাবে ব্যক্ত করেছে তা বাস্তবের একটি দিক। ধর্মের ভিত্তিতে
দেশভাগ যে সাম্প্রদায়িক ভিত রচনা করে এর উপর দাঁড়িয়ে গত শতকের শেষ দিকে
দক্ষিণপন্থী হিন্দু শক্তির উত্থান এই বাস্তবের আরেকটি দিক। ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর
বাবরি মসজিদ ধ্বংস এই উত্থানের মাইলস্টোন, কারণ এই পর্যায়ে রাষ্ট্রের সাথে মুসলিম
সংখ্যালঘুর সম্পর্ক একেবারে তলানিতে এসে ঠেকে, যদিও সাম্প্রদায়িক হিংসা ভারতীয়
ইতিহাসে নতুন নয় এবং স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে এর যাত্রা শুরু হয় দেশ বিভাজনের মধ্য
দিয়ে। সুতরাং সংখ্যালঘু অধিকারের প্রশ্ন অস্তিত্বের ও সুরক্ষার প্রশ্নকে এড়িয়ে
আলোচিত হতে পারে না।
সংখ্যালঘুর সাংবিধানিক ব্যবস্থা
সংবিধান সভার বিতর্কের সময় কিছু দলিত সদস্যরা নিজেদেরকে
‘রাজনৈতিক সংখ্যালঘু’ হিসেবে মর্যাদা প্রদানের দাবি উত্থাপন করেছিলেন। সংখ্যালঘু
নির্ধারনের ক্ষেত্রে তাঁরা সংখ্যাগত হিসাব নয়, তাদের সামাজিক-অর্থনৈতিক পশ্চাদপদতা
ও জাতিগত শোষণের বিষয়কে বিচার্য বিষয় করেন।
সংবিধান সভার আগে মতিলাল নেহেরুর পৌরোহিত্যে গঠিত নেহেরু
রিপোর্ট ১৯২৮ এবং সাপরু কমিটি রিপোর্ট ১৯৪৫ সংখ্যালঘুর আধিকারের প্রশ্ন সূত্রায়িত
করে। এই রিপোর্ট সংখ্যালঘুদের জন্য রাজনৈতিক ও জনপ্রতিনিধি সংরক্ষণ এবং সংখ্যালঘু
অধিকার সুরক্ষা করার জন্য আলাদা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান গড়ার পরামর্শ দেয়। ১৯৪০ সালে
আবুল কালাম আজাদ ঘোষণা করেন যে সংখ্যালঘু সুরক্ষা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কী কী
ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন তা সংখ্যালঘুদেরই নির্ধারণ করা উচিত, সংখ্যাগুরুদের
এব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত নয়। কিন্তু
দেশবিভাজনের ফলে বিষিয়ে উঠা পরিবেশের প্রেক্ষিতে সংবিধান সভা এই
গণতান্ত্রিক অবস্থান থেকে সরে আসে। সংখ্যালঘু বিষয়ক পরামর্শদাতা কমিটির
চ্যায়ারম্যান বল্লভভাই প্যাটেলের পরামর্শ অনুযায়ী ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের রাজনৈতিক ও
চাকুরি সহ অন্যান্য ক্ষেত্রে সংরক্ষণের মাধ্যমে সুরক্ষা প্রদান করার প্রাথমিক
সূত্রায়ন বাদ দেওয়া হয় এবং তার বদলে সংখ্যালঘু সাব-কমিটি গঠনের প্রস্তাব মেনে
নেওয়া হয় এবং পরামর্শদাতা কমিটির সব পরামর্শই খসড়া সংবিধানের ১৪ নং ভাগে
অন্তর্ভূক্ত করা হয়। এভাবে পরিবর্তীত পরিস্থিতিতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুকে তপসিলি জাতি –
জনজাতি থেকে পৃথক করে দেওয়া হয়।
ভারতীয় সংবিধানের ২৯(১) ধারায় যে কোনো জনগোষ্ঠী তাদের ভাষা
ও সংস্কৃতি সুরক্ষা করার অধিকার প্রদান করা হয়েছে। অনুরূপভাবে ৩০ নম্বর ধারায় ধর্মীয়
ও ভাষিক সংখ্যালঘুদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা ও পরিচালনা করার অধিকার প্রদান করা
হয়েছে। তবে সংবিধান সংখ্যালঘুর কোনো সংজ্ঞা দেয়নি। জাতীয় স্তরকেই সংখ্যালঘু
নির্ধারণ করার একমাত্র মানদণ্ড হিসেবে ধরে নেওয়া হতো। ২০০২ সালে টি.এম.এ পাই
ফাউণ্ডেশন বনাম কর্নাটক রাজ্য ও অন্যান্যদের এক মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায়ে
প্রথমবাররে মত সংখ্যালঘু প্রশ্নের কিছু ব্যাখ্যা মেলে। কেন্দ্র, রাজ্য ও অঞ্চলকে
সংখ্যালঘু নির্ধারণের একক মানা হবে কিনা, কেন্দ্র স্তরের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী
রাজ্যে কিংবা রাজ্য স্তরের সংখ্যালঘু সেই রাজ্যের কোনো অঞ্চলে সংখ্যাগুরু হলে সেই
জনগোষ্ঠী সংখ্যালঘু মর্যাদা হারাবে কিনা এনিয়ে সুপ্রিম কোর্টে বিতর্ক হয়। সুপ্রিম
কোর্ট এই নীতি জারি করে যে কেন্দ্র স্তরে কোনো সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী রাজ্যে যদি
সংখ্যাগুরু হয় তাহলে সেই রাজ্যে এই জনগোষ্ঠী সংখ্যালঘু হিসেবে বিবেচিত হবে না।
অর্থাৎ রাজ্যগুলিতে সংখ্যালঘু নির্ধারণের ক্ষেত্রে রাজ্যের জনসংখ্যাগত বিন্যাসকে
বিবেচনায় রাখা হবে। সংবিধানের ধারা ৩০ মতে যেহেতু ধর্মীয় ও ভাষিক এই দ্বিবিধ
জনগোষ্ঠী সংখ্যালঘু হিসেবে বিবেচিত হতে পারে, তাই রাজ্যিক জনসংখ্যা অনুযায়ী ধর্মীয়
ও ভাষিক জনগোষ্ঠী সংখ্যালঘু হিসেবে বিবেচিত হবে। রাজ্যকে একক হিসেবে ধরে নেওয়ার
পেছনে মূল যুক্তি হলো ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠন। ২০০৪ সালে সংবিধানের ১০৩ তম সংশোধনীর
মাধ্যমে সংখ্যালঘু জাতীয় কমিশনকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ২০০৭ সালের মে
মাসে ক্যাবিনেট সুপ্রিম কোর্টের টি.এম.এ পাই ফাউণ্ডেশন মামলা সহ বিভন্ন মামলার রায়ের
সূত্র ধরে রাজ্যভিত্তিক সংখ্যালঘু নির্ধারণে স্বীকৃতি দেয়।
কিন্তু এই যুক্তির ক্ষেত্রে বিপত্তি রয়েছে। ভাষাভিত্তিক
রাজ্য গঠন সংখ্যাগুরু ভাষিক পরিচিতিকে রাজ্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছে। আসামের
কথাই ধরা যাক। আসামে ভাষিক জনগোষ্ঠী হিসেবে অসমীয়া ভাষিক জনগোষ্ঠীর মানুষকে
সংখ্যাগরিষ্ঠ বিবেচনায় আসাম রাজ্য গঠন হয়, পরবর্তীকালে এই ভাষার ভিত্তিতেই পুরোনো
আসাম ভেঙে আরও রাজ্য তৈরি হয়। বর্তমান আসামে অসমীয়া ছাড়া আরও বহু ভাষাগোষ্ঠীর
মানুষ রয়েছে যার মধ্যে বাংলাভাষীরা প্রধান। রাজ্যিক পরিসরে সংখ্যালঘু নির্ধারণ
করার নিয়ম অনুযায়ী আসামে অসমীয়া ছাড়া বাকী সবাই শিক্ষা ক্ষেত্রে (সংবিধানের ৩০ নং
ধারা শুধুমাত্র শিক্ষা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ) সংখ্যালঘু
সুরক্ষা পাবে। এক্ষেত্রে সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগুরু ভাষিক জনগোষ্ঠীর কোনো সমস্যা দেখা
দেয় না, কারণ রাজ্যিক স্তরের উভয় জনগোষ্ঠীই জাতীয় স্তরে সংখ্যাগরিষ্ঠ নয়। রাজ্যিক
স্তরে ভাষিক সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠী সংখ্যাগুরু হওয়ার সুবাদে রাজ্য পরিচালনা ও নীতি
নির্ধারণের ক্ষেত্রে যে সুবিধা ভোগ করে সেই সুবিধা তারা জাতীয় স্তরে ভোগ করতে পারে
না। অর্থাৎ অন্য সব ফ্যাক্টর বাদ দিলে, শুধুমাত্র জনসংখ্যার বিচারে রাজ্যিক স্তরে
সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু ভাষিক জনগোষ্ঠীদের জাতীয় স্তরে রাষ্ট্র পরিচালনা ও নীতি
নির্ধারণে বাড়তি সুবিধা না পাওয়ার সংখ্যালঘু মানদণ্ড ধরে নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু
ধর্মীয় সংখ্যালঘুর ক্ষেত্রে রাজ্যিক মানদণ্ড খানিকটা গোলমেলে। ভাষাভিত্তিক রাজ্যের
সীমানা যেহেতু ধর্মীয় পরিচিতির সীমানাকে নির্ধারিত করে না, তাই ধর্মীয় সংখ্যালঘুর
ক্ষেত্রে রাজ্যকে একক হিসেবে ধরার ক্ষেত্রে সমস্যা রয়েছে। পঞ্জাবের উদাহরণই ধরা
যাক। পঞ্জাবে হিন্দুরা সংখ্যালঘু। রাজ্যকে একক ধরলে সংবিধানের ধারা ৩০ অনুযায়ী
শিক্ষা ও শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে হিন্দুদের বিশেষ অধিকার দিতে হয়। কিন্তু জাতীয় স্তরে
হিন্দুরা পূর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুবাদে নীতি নির্ধারণ ও রূপায়ণের ক্ষেত্রে
আধিপত্যাধীন অবস্থানে থাকায় কেন্দ্রীয় ব্যবস্থার মাধ্যমে যে সুযোগ লাভ করছে তা
শিখদের ক্ষেত্রে আয়ত্ত করা সম্ভব নয়। সুতরাং এই নীতিতে সংখ্যালঘু অধিকার দেওয়ার
পেছনে সম-অধিকার, সম-মর্যাদা প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব নয়।
সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতা
গ্রামাঞ্চলের বসত এলাকাতে চোখ রাখলে যে কোনো পর্যবেক্ষকের
বসত অঞ্চলের এক প্যাটার্ন নজরে পড়বে। মিশ্র জনবিসতিপূর্ণ অঞ্চলেও অঘোষিত ডিমার্কেশন
লাইন থাকে যে লাইনের এপার ওপারে সম্প্রদায়ভিত্তিক বসতবাটি থাকে। সামাজিক
আচার-অনুষ্ঠান বা সংকীর্ণ সম্পত্তি স্বার্থকে কেন্দ্র করে কোন দ্বন্দ্ব যদি
বহিঃশক্তির হস্তক্ষেপে সংঘাতের সংকট সৃষ্ঠি করে তাহলে এই ডিমার্কেশন লাইনগুলো
ফল্ট-লাইনে রূপান্তরিত হয়। অনুন্নত উৎপাদন ব্যবস্থায় এই বিভাজনরেখা স্বাভাবিক
হিসেবে সবাই মেনে নেয়। তবে উন্নয়নের এক সাধারণ দৃশ্যপট আমাদের নজর এড়িয়ে যায় না।
জনগোষ্ঠীগত মর্যাদা ও প্রভাব-প্রতিপত্তির উপর ভিত্তি করে নাগরিক সুবিধার তারতম্য
গ্রামাঞ্চলেও চোখে পড়ার মত, যদিও বর্তমান সার্বিক আর্থ-সামাজিক সংকটকালে এই
তারতম্য অনেকটাই আবছা হয়ে পড়ছে। কিন্তু সাংস্কৃতিক সামাজিক দূরত্ব যখন ভারতের নগর
সভ্যতায়ও প্রকটভাবে বিদ্যমান থাকে তখন বুঝতে অসুবিধে হয় না যে বিভাজন আমাদের
সামাজিক পরিসরে কতটা গভীরে প্রোথিত। একদিকে নগরায়নের প্রকল্পের মধ্যেই এই বিভজনের
বীজ নিহিত, অন্যদিকে আমাদের মানসিক দূরত্ব এই বিভাজনকে স্বীকৃতি প্রদান করে ঘেটো (ghetto)-সংস্কৃতির জন্ম দেয়। আমাদের শহর-নগরগুলির সামাজিক
বিন্যাসের একটা প্রোফাইল যদি তৈরি করা যায় তাহলে এই বিষয়টি পরিষ্কার আমাদের চোখের
সামনে ভেসে উঠবে। দলিত-সংখ্যালঘুদের বাস সাধারণত শহরতলিতেই দেখা যায়। শহরের
কমার্শিয়্যাল সেন্টার কিংবা মূল-শহরে গড়ে উঠা নতুন বসত অঞ্চলগুলিতে সামাজিক বাধা ও
উন্নয়নের নীতি কসমোপোলিটান-কালচার
গড়ে উঠার প্রধান অন্তরায়। মজুরি, রুজি-রোজগার কিংবা শিক্ষা-চাকুরির ইত্যাদির
সন্ধানে শহরে আসা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর লোকরা শহরের পরিধিকে বিস্তৃত করে নতুন বসত
অঞ্চল গড়ে তুলছে, কিন্ত এই প্রব্রজন বিভাজন রেখাকে মুছে ফেলতে পারছে না। তার ফলে
সাংস্কৃতিক বিভাজন এক নতুন আধুনিক রূপ পরিগ্রহ করছে। কাঠামো ও উপরি-কাঠামোয় যুগপৎ
বিদ্যমান স্তরীভূত বিভাজন যেমনি দলিতদের অপর করে দিয়েছে, ঠিক তেমনি ধর্মীয়
সংখ্যালঘুদের এই কাঠামোর বাইরে রেখে দিয়েছে। এই কাঠামো যতটা শিথিল হয় ঠিক ততটাই
সাংস্কৃতিক ঐক্য গড়ে উঠে। আমাদের বৃহৎ নগরি যেমন নতুন-পুরোনো দিল্লি, নতুন-পুরোনো
হায়দ্রাবাদ কিংবা আহমেদাবাদের নতুন বিস্তৃতির অঞ্চলগুলির জনবিন্যাস বিচার করলে
সাংস্কৃতিক দূরত্ব কতখানি গভীরে এবং কারা ঘেটো-কালচারের বলি তা স্পষ্ট হয়ে পড়ে।
মুম্বাই’র বিশাল বিশাল ঝুপড়ি অঞ্চলে যে লাখ লাখ লোক বাস করেন তাদের অধিকাংশই দলিত,
তাঁরা হয় পুরোনো বস্ত্রশিল্পের কাজ-হারানো শ্রমিক কিংবা কাজের সন্ধানে আসা নতুন
শ্রমিক। বিচ্ছিন্নতার মাত্রার ও প্রভাব প্রতিপত্তির তারতম্য বাদ দিলে এই একই
মানদণ্ড ভাষিক সংখ্যালঘুর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ভাষিক জনগোষ্ঠী হিসেবে আসামের
মুণ্ডারি-সাঁতালি-কুর্মালি-সাদরি ভাষীদের জন্য রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় যেমনি কোনো
জায়গা নেই, আমাদের সামূহিক সাংস্কৃতিক চর্চায়ও তাঁরা অনুপস্থিত। অন্যান্য নিতান্তই
সংখ্যালঘু ভাষিক জনগোষ্ঠীদের অবস্থাও তথৈবচ। বাঙালিরা ঐতিহাসিক কারণে এই
অধিকারগুলির অনেকটাই আদায় করে নিতে পারলেও, এখনও তাদের বিনা বিচারে যেতে হয়
ডিটেনশন ক্যাম্পে।
এধরনের বিচ্ছিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক দ্বীপগুলি থেকেই এই
জনগোষ্ঠীগুলো নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিচিতি রক্ষা ও বিকাশের আওয়াজ তুলে। এই
আওয়াজগুলিকে দমিয়ে দেওয়ার রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের মধ্যেই নিহিত বৈচিত্র্যের প্রতি আঘাত
ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিকৃতির রহস্য। তথাকথিত আধুনিকতার সবধরনের খবরদারি দূরে ঠেলে
এই আওয়াজগুলিকে জনগোষ্ঠীগুলোর অভ্যন্তর থেকে উঠে আসার পরিসর তৈরি করে দেওয়ার মধ্য
দিয়েই স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা সম্ভব। এই মূল্যবোধের জন্য
ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনই নতুন সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্তর্বস্তু হওয়া বাঞ্চনীয়। যাহা
বিদ্যমান তাহাই যদি আধুনিক হয়, তাহলে বৈচিত্র্যের সুরক্ষা ও বিকাশকে সুনিশ্চিত
করাই আজকের আধুনিকতার পরম কর্তব্য।
সংখ্যালঘু সমস্যা ও
সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গি
উপরের আলোচনায় দু’টি বিষয় প্রণিধানযোগ্য। শুধুমাত্র সংখ্যার
বিচার করে সংখ্যালঘু মর্যাদা নির্ধারণ করা মুষ্কিল এবং স্থান-কাল ভেদে সংখ্যালঘু
অধিকারের স্বরূপ ভিন্ন ভিন্ন। ২০০৬ সালে জাস্টিস সাচার কমিটি ও ২০০৭ সালে রঙ্গনাথ মিশ্র
কমিশন সংখ্যালঘু প্রশ্নে রিপোর্ট প্রদান করে। প্রথম রিপোর্ট থেকে ধর্মীয়
সংখ্যালঘুদের নিদারুণ দূরবস্থার কথা আমরা জানতে পারি এবং দ্বিতীয় রিপোর্ট
সংখ্যালঘুর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য জনসংখ্যা অনুপাতে সংরক্ষণের সুপারিশ করে।
সম্প্রতি কুণ্ডু কমিশনও অনুরূপ রিপোর্ট পেশ করেছে। একথা আমাদের বোঝা উচিত যে ভারতীয়
বৈচিত্র্যকে যদি সঠিক অর্থে স্বীকৃতি প্রদান ও প্রতিষ্ঠিত করা না যায়, তাহলে
গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা বিপন্ন হয়। সংখ্যালঘুর অধিকার প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে
সংখ্যাগুরুর গণতন্ত্র প্রসারিত হয়। ইতিহাসের প্রতিটি পর্যায়ে সংখ্যালঘুর যে কোনো
অধিকার প্রতিষ্ঠা গণতন্ত্রের বিকাশের ক্ষেত্রে এক একটি মাইলস্টোন হিসেবে বিবেচিত,
যেমনটি হয়েছিল স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে সংবিধান রচনার মধ্য দিয়ে। কিন্তু এই একেকটি
পদক্ষেপ সংখ্যালঘু সমস্যার স্থায়ী সমাধান করতে অপারগ হওয়ায় যে কোন প্রতিক্রিয়াশীল
আক্রমণের মুখে কিংবা কোনো রেডিক্যাল দাবির মুখে ভারতীয় রাষ্ট্র-ব্যবস্থা অসহায় হয়ে
পড়ে। সুতরাং একটা সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে সংখ্যালঘু তথা ভারতীয় বৈচিত্র্যের
প্রশ্নকে বিচার করতে হবে এবং এর সমাধানের উপায় নির্ধারিত করতে হবে। স্বাভাবিকভাবেই
বর্তমান রাষ্ট্রীয় কাঠামোর আমূল গণতান্ত্রিকীকরণ ও জনগণ-কেন্দ্রীক নতুন উন্নয়ণের
মডেল ছাড়া এই সমাধান সূত্র খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়।
সাংবিধানিক ঘোষণা অনুযায়ী ভারতীয় রাষ্ট্র একটি ফেডারেল
রাষ্ট্র, কিন্তু অন্তর্বস্তুতে এটি এককেন্দ্রিক। ভাষাভিত্তিক রাজ্যগঠন এই এক
কেন্দ্রীকতাকে খানিকটা দুর্বল করলেও নীতি নির্ধারণের সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রের হাতে।
কেন্দ্রের অধীনে রাজ্যগুলির ক্ষেত্রেও এককেন্দ্রিকতার এই অন্তর্বস্তু বিদ্যমান।
যারফলে সর্বভারতীয় কিংবা রাজ্যের এই ক্ষমতার কেন্দ্রে যে জনগোষ্ঠী প্রভাব বিস্তার
করতে সক্ষম তাদের স্বার্থ, মতামত, ভাষা-সংস্কৃতি রাষ্ট্র-পরিচালনার জন্য নীতি
প্রণয়নে অধিক গুরুত্ত্ব পায়। সুতরাং আমাদের রাষ্ট্র কাঠামোকেই ঢেলে সাজানোর
প্রয়োজন। কীভাবে?
প্রথমতঃ উপর থেকে নীচ পর্যন্ত ক্ষমতার যে বিন্যাস, যে
বিন্যাসে উপরের ক্ষমতাবানরা নীচের স্তরে ভাগ-বাটোয়ারার এক দালাল নেটওয়ার্ক তৈরি
করার সুযোগ পায় তাকে উল্টে দিয়ে তলা থকে উপরের দিকে ক্ষমতার বিন্যাস করতে হবে।
ক্ষমতার কেন্দ্র হতে হবে পঞ্চায়েত কিংবা মিউনিসিপাল অথরিটি। নীচের সেই স্তর থেকে
সাধারণ বিষয়গুলি একে একে উপরের দিকে বিন্যস্ত হবে। মূদ্রা, পররাষ্ট্র, সর্ব-ভারতীয়
যোগাযোগ ইত্যাদি বিষয় ছাড়া বাকী সব বিষয়ের বেকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। নির্দিষ্ট
এলাকায় যে সব জনগোষ্ঠীর বসত নেই এবং বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে তাদের জন্য
জনসংখ্যার অনুপাতে সংরক্ষণের বিধান রাখতে হবে। সব জনগোষ্ঠী যাতে তাদের জনসংখ্যার
অনুপাতে ক্ষমতার সমান অংশীদার হতে পারে তা সুনিশ্চিত করতে হবে। ক্ষমতার
বিকেন্দ্রীকরণ এসমস্যার অনেকখানি সমাধান করতে পারবে। আলাপ-আলোচনা ও সহমতের
ভিত্তিতে যাতে নীতি নির্ধারণ করা যায় তার উপর গুরুত্ত্ব দিতে হবে, তাতে যুক্তির
বিচারে কোনো প্রগতিশীল বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বিলম্ব হলেও আখেরে লাভ হবে ও গণতন্ত্র
বিকশিত হবে। জনগণের ক্ষমতায়ন করার জন্য জনপ্রতিনিধিদের ফিরিয়ে আনার অধিকার দিতে
হবে এবং জনমত যাচাইয়ের জন্য গ্রামসভা, মহল্লাসভা, ফ্যাক্টরি সভা, ওয়ার্ড সভা এবং
সর্বোপরি গণভোটের উপর গুরুত্ত্ব আরোপ করতে হবে, এব্যাপারে এলিটিস্ট ধারণার বশবর্তী
হয়ে জনগণের ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভয়ে এগুলিকে এড়িয়ে যাওয়া চলবে না। কারণ ভুল
সিদ্ধান্ত থেকে শিক্ষা নিয়ে জনগণ নতুন সমাজ গড়ার দিকে এগিয়ে যেতে সক্ষম হবে,
এলিটিস্ট হুকুমবাদী পরিচালনায় যা এতাবৎ ব্যাহত হয়ে আসছে। উন্নয়ণের ক্ষেত্রেও
বিদেশি পুঁজি-নির্ভর ‘গ্রোথ-অনলি’ মডেলের বিপরীতে স্থানীয় ক্ষুদ্র ও মিডিয়াম
শিল্পের উপর গুরুত্ত্ব আরোপ করতে হবে যেখানে রাষ্ট্রের মদতে জনগণ তার শ্রমের
দক্ষতা, সৃজনশীলতা ও উপলব্ধ ক্ষুদ্র পুঁজিকে কাজে লাগাতে পারে। শুধুমাত্র এই অর্থনৈতিক মডেলের
মধ্যেই থেমে থাকলে চলবে না, কারণ এমন এক অর্থনৈতিক ভিত্তি রচনা করতে হবে যা উপরের
রাজনৈতিক কাঠামোর অনুকূল। শ্রম-সমবায়ের মালিকানা ও একে বৃহৎ থেকে বৃহত্তর পরিসরে
এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য রাষ্ট্রীয় মালিকানাভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থা কায়েম করতে
হবে। ব্যক্তি-শ্রমিকের আয় বৃদ্ধির প্রয়াস যাতে সমবায়ের সব সদস্যের আয়বৃদ্ধির অধীন
হয় তারজন্য শ্রমিকের যৌথ মূল্যবোধ গড়ে তোলার সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে যাতে সমবায়িক
উৎপাদনের কোনো সংকটকালে শ্রমিক-সদস্য সংখ্যা কমানো না হয়, একইসাথে রাষ্ট্রীয়
মালিকানায় নতুন শ্রমিকদের পরিচালনায় উৎপাদনী উদ্যোগ গড়ে তুলতে হবে যাতে বেকার
শ্রমিকের সংখ্যা বৃদ্ধি না ঘটে ও নতুন নতুন ক্ষেত্রকে আধুনিক উৎপাদনী ব্যবস্থার
অধীনে আনা যায়। এধরনের পরষ্পর পরিপূরক এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ছাড়া পূর্ণ
গণতান্ত্রিক ফেডারেল রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে বজায় রাখা যাবে না। এভাবেই জনগণ দ্বারা, জনগণের জন্য,
জনগণের রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েম করা সম্ভব যেখানে সংখ্যা কিংবা আর্থিক-সামাজিক
মানদণ্ডে কোনো সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীই নিজেদেরকে শোষিত বঞ্চিত বলে ভাববে না। এভাবেই
ভবিষ্যত সমাজের এক সাদামাটা রূপরেখা তৈরি করা যায় যা জনগণের সৃজনশীল অংশগ্রহণে আরও
বিস্তৃত ও অর্থবহ রূপ পরিগ্রহ করতে পারে। কর্মক্ষত্রে দায়িত্ববোধ নিয়ে যারা
চিন্তিত তাদের একথা বোঝা উচিত যে মানুষ যখন শুধুমাত্র নিজের জন্য ও নিজের পরিবারের
জন্য নয়, নিজের স্বার্থে কাজকে যখন সচেতনভাবে জাতির জন্য-দেশের জন্য ও মানব সমাজের
জন্য কাজ করছে বলে ভাবতে শুরু করে তখনই কাজের দক্ষতা ও সৃজনশীলতা উত্তরোত্তর
বৃদ্ধি পায়। বর্তমান ব্যবস্থায় সংকীর্ণ পরিসরে এই বোধ জাগ্রত থাকে, বৃহত্তর পরিসরে
এই বোধকে জাগ্রত করার জন্য চাই নতুন ব্যবস্থা যেখানে মানুষ ব্যাপক সমষ্ঠি
স্বার্থের কথা ভাবতে পারে। বর্তমানে গণতান্ত্রিক ফেডারেলিজমের ও বৈচিত্র্যের উপর
যে আক্রমণ নেমে আসছে তা উৎপাদন ও এর সাথে যুক্ত বন্টন ব্যবস্থার দ্রুত
বেসরকারিকরণের প্রক্রিয়ার মধ্যেই নিহিত।
এ তো গেল ভবিষ্যত সমাজের কথা। কিন্তু এখনই আমাদের সামনে
সবচাইতে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে এই যে যেটুকু সাংবিধানিক গণতন্ত্র স্বাধীনতা-উত্তর
ভারতবর্ষে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা আজ ভূলুণ্ঠিত হতে চলেছে। উগ্র-সাম্প্রদায়িকতাবাদ,
উগ্রজাতিয়তাবাদ ও বর্ণবাদ ভাষিক-ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও দলিতদের সমস্ত অধিকার হরণ করতে
উদ্যত হয়েছে। রাজ্যের হাতে থাকা ক্ষমতাগুলি প্রতিনিয়ত হরণ করা হচ্ছে।
বেসরকারিকরণের মাধ্যমে রাজ্যের হাতে থাকা সম্পদের অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে, আয়ের
পুনর্বন্টনের ক্ষেত্রে কেন্দ্রের মর্জিকে দেওয়া হচ্ছে অধিক গুরুত্ত্ব,
উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মত পিছিয়ে পড়া রাজ্যগুলির যে বিশেষ মর্যাদা দেওয়ার বিধান ছিল
তা তুলে নেওয়া হচ্ছে। স্বাধীনতাহীনতার মূল সূত্রই হচ্ছে মুষ্ঠিমেয়ের হাতে সবার
উন্নয়নের দায়িত্ব সঁপে দেওয়া, উপনিবেশিক যুগে আলোকপ্রাপ্ত ইউরোপিয়ানদের হাতে আমরা
যেভাবে দায়িত্ব সঁপে দিয়েছিলাম। এমতাবস্থায় স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জন্য ভারতবর্ষের
সাংবিধানিক ফেডারেলিজমকে রক্ষা করার মাধ্যমে সংখ্যালঘু অধিকার প্রতিষ্ঠা আশু
কর্তব্য হিসেবে আমাদের সামনে হাজির হয়েছে। আশু ও সুদূর-প্রসারী লক্ষ্যে
নির্ধারিত কর্মসূচীর মাধ্যমেই জনগণ সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরুর বিরোধহীন এক নতুন সমাজ,
নতুন ভারত গড়ার লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে পারে।