সামাজিক আন্দোলন
ও নারী প্রশ্ন
অরূপ বৈশ্য
(আমাদের সমকালের পরবর্তী সংখ্যার জন্য লেখা)
আন্দোলনের বৈপ্লবিক রূপান্তর
এক
নির্দ্দিষ্ট ভৌগোলিক পরিসরে বসবাসকারী মানব সমাজ এক নির্দ্দিষ্ট সামাজিক তথা
উৎপাদন সম্পর্কে আবদ্ধ থাকে। প্রকৃতির সাথে মানুষের সম্পর্কও এই সামাজিক সম্পর্ক
দিয়ে নির্ধারিত হয়। স্বাভাবিকভাবেই এই সম্পর্কই সকল ধরনের শোষণমূলক ব্যবস্থার
ভিত্তি। এই শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত চলতে থাকে বিভিন্ন মাত্রার ও স্তরের সামাজিক
তথা শ্রেণি আন্দোলন। আজকের ভারতবর্ষও এই সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম নয়। বিশ্ব
পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অধীনে পরিচালিত ও প্রভাবিত অভ্যন্তরিণ সামাজিক সম্পর্কের
ঘাত-প্রতিঘাত মজুরি বৃদ্ধি, বেকারত্ব, চূড়ান্ত অসাম্য, প্রাকৃতিক ধ্বংস ও বিপর্যয়,
সামাজিক অ-সুরক্ষা, নাগরিক অসুবিধা ইত্যাদি বহুবিধ প্রশ্নে আবর্তিত হচ্ছে। এই
বিষয়গুলিকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ধরনের ও বিভিন্ন মাত্রার সামাজিক আন্দোলনও গড়ে
উঠছে। সামাজিক সম্পর্কের প্রাথমিক একক হিসেবে পরিবার নামক প্রতিষ্ঠানের অবস্থান
এবং পরিবারের কাঠামো ও পরিবারের চরিত্র দাঁড়িয়ে আছে নারী শ্রমকে কেন্দ্র করে।
সুতরাং সামাজিক আন্দোলনগুলির এক উন্নত পর্যায়ে উপনীত হওয়ার ক্ষেত্রে বা শোষণমূলক
সামাজিক সম্পর্কের বৈপ্লবিক রূপান্তরের জন্য নারী শ্রম-শোষণকে অনুধাবন করা ও নারী
প্রশ্নকে প্রতিটি সামাজিক আন্দোলনের কর্মসূচীতে অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি।
সংগ্রামে নারীর অংশগ্রহণ
বাস্তবে
চলমান সব সামাজিক আন্দোলনে নারী সংগ্রামের বিষয় নিয়ে এক ধোঁয়াশা, অস্বচ্ছতা বা
সচেতনতার অভাব বিদ্যমান। অথচ এইসব আন্দোলনে নারীর অংশগ্রহণ ও লড়াকু মনোভাব
উত্তরোত্তর বৃদ্ধি ঘটছে। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে নারী শ্রমিকরাই মূল অংশগ্রহণকারী,
কারণ সার্ভিস সেক্টর যেমন অঙ্গনওয়াড়ি ওয়ার্কার, আশাকর্মী, সাফাই কর্মী, আইটি
সেক্টরের নির্দ্দিষ্ট কাজ কিংবা প্ল্যান্টেশন ওয়ার্কার ইত্যাদিতে প্রধানত নারীরাই
যুক্ত। এই আন্দোলনগুলিতে সামাজিক ও শ্রমিক অধিকারের বিষয়গুলি উত্থাপিত হচ্ছে নারীর
ব্যাপক অংশগ্রহণের মাধ্যমে, কিন্তু উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে শ্রেণি বা গোষ্ঠী হিসেবে
নারী মুক্তির প্রশ্নটি। নারী প্রশ্নে নেতৃত্বদায়ী নারী সংগঠনগুলির ভূমিকা প্রধানত
নারীর দৈহিক নিপীড়ণের বিরোধিতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে দেখা যায়। নিপীড়ণের
ক্রমবর্ধমান এই রূপগুলি নিশ্চিতভাবে সামগ্রিক সামাজিক-সাংস্কৃতিক অবক্ষয়ের
বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু শাসন ও আইনের সংস্কারের মধ্যে এর বিরোধিতাকে সীমাবদ্ধ রাখলে
শোষণমূলক সামাজিক সম্পর্ক ও আধিপত্যাধীন শ্রেণি-শাসনকে কোন কোন ক্ষেত্রে এমনকী
বৈধতা প্রদান করা হয়।
স্বাধীনতা
সংগ্রামের পর্যায়ে এবং এই সংগ্রামের গর্ভে পিতৃতান্ত্রিক আচার-অনুষ্ঠানের সামাজিক
সংস্কার নারী আন্দোলনের প্রধান দিক ছিল। স্বাধীন ভারতে নারী-পুরুষ সাম্যের সাংবিধানিক
বৈধতা ও নারী নিপীড়নের ক্ষেত্রে কিছু আইনী সুরক্ষা প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে পঞ্চাশ ও
ষাটের দশক এক স্থবির পর্যায় অতিক্রম করে। সত্তরের দশকে উত্তাল সামাজিক আন্দোলন এবং
বর্তমান পর্যায়ে ক্রমবর্ধমান সামাজিক আন্দোলনের পুনর্জাগরণের পর্যায়েও নারী প্রশ্ন
সংস্কারমূলক কর্মসূচীতে আটকে আছে। এই আটকে যাওয়ার মুখ্য কারণ নারী মুক্তির প্রশ্নে
তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক অস্বচ্ছতা। অথচ বিভিন্ন ধরনের সামাজিক আন্দোলনে নারী-শ্রমের
বিষয়টিকে সুনির্দ্দিষ্ট রূপে প্রবিষ্ট করতে না পারলে সামাজিক ও শ্রমিক আন্দোলনের বৈপ্লবিক
রূপান্তর সম্ভব নয়।
তাত্ত্বিক বিপর্যয়
নারী
মুক্তির প্রশ্নে মুখ্যত দু’টি অবস্থান নিতে দেখা যায়। বামপন্থী মুখ্য ধারার মতে
নারী মুক্তির প্রশ্নকে আলাদা করে ভাবার কোন দরকার নেই, কারণ শ্রমিক শ্রেণির
আন্দোলনই এই বিষয়ের মিমাংসা করবে, নারীদের আন্দোলনে সামিল করার জন্যই শুধুমাত্র
নারী সংগঠন বানাতে হবে। অন্য ধারার প্রবক্তাদের মতে, নারীদের সম্পূর্ণ আলাদাভাবে
সংগঠিত হতে হবে, শ্রমিক শ্রেণির আন্দোলনের সাথে একে গুলিয়ে ফেললে চলবে না। প্রচলিত
এই দুই ধারার অতিশয়োক্তি সামগ্রিকভাবে শ্রমিক ও সামাজিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে এক
তাত্ত্বিক বিপর্যয় হিসেবে ভাবা যেতে পারে, কারণ এই দু’টি ধারাই সামাজিক সম্পর্কের
মৌলিক একক হিসেবে পরিবারকে বিবেচনা করে না। মূল্যের নিয়ম ও উদ্বৃত্ত মূল্য
লুণ্ঠনের ক্ষেত্রে পারিবারিক শ্রম ও সামাজিক শ্রমের আন্তঃসম্পর্ককে বিচার্য বিষয়
হিসেবে না ভাবলে নারী শ্রম ও নারী মুক্তির প্রশ্নকে সামাজিক ও শ্রমিক আন্দোলনের
অন্তর্বস্তুতে স্থান দেওয়ার কর্মসূচী নির্ধারণ করা সম্ভব নয়।
পারিবারিক ও সামাজিক শ্রম
যুক্তি
দেখানো হয় যে পারিবারিক শ্রম মূল্যহীন বা যার মূল্য দেওয়া হয় না, কারণ সেই শ্রম
উৎপাদনী শ্রম নয়। এটা উৎপাদনী শ্রম নয় কারণ এই শ্রমের উৎপাদ মূল্যের ব্যবস্থা
অর্থাৎ বাজারের মধ্য দিয়ে যায় না বা বিনিময় হয় না। এই যুক্তি-কাঠামোয় ব্যবহারিক
মূল্য ও বিনিময় মূল্যকে এবং সেই অর্থে পারিবারিক শ্রম ও সামাজিক শ্রমকে পরস্পর
সম্পর্করহিত দু’টি পৃথক স্থান-কালে আলাদা করে দেওয়া হয়। বাজার থেকে না কিনে
পারিবারিক শ্রম দিয়ে তৈরি সামগ্রী ব্যবহারের ক্ষত্রে বাজারের বিনিময় যুক্ত না
থাকলেও সেটা নির্ধারিত হয় পারিবারিক লাভালাভের হিসাব থেকে। এই ব্যবহারিক মূল্য
বাজারের ক্রেতা-বিক্রেতার বিনিময় মূল্য থেকে কম হয়, কারণ বিনিময় মূল্যের ক্ষেত্রে
পরিবহণ শুল্ক, মধ্যসত্ত্বভোগীদের কমিশন, যোগান ও চাহিদার ভারসাম্য ইত্যাদি বাজার
দরকে প্রভাবিত করে। একটি উদাহরণ বিচার করা যাক। নিজের ফার্মে পরিবারের সদস্যরা
স্বল্প পরিমাণ সব্জির চাষ করলেন। সেই সব্জি বাড়ির সব সদস্যরা রান্না করে খেলন। ফলন
ও রান্নায় তাদের শ্রম যুক্ত হলো। সেই সব্জি বাজারে বিক্রি করে সেই অর্থ দিয়ে বাজার
থেকে অন্য প্রয়োজনীয় জিনিস কেনা যেত। তারা যদি সব্জি ফলাতেন না, তাহলে সেই সব্জি
তারা বাজার থেকে কিনতেন। সেটা তারা করতেন যদি ঘরোয়া উৎপাদনে যে ব্যয় প্রতিযোগিতার
বাজারে তার চাইতে কম দামে সেই সামগ্রী কিনতে পাওয়া যায়। অর্থাৎ ব্যবহারেই হোক বা
বিনিময়েই হোক মূল্য অন্তর্নিহিত। কিন্তু পরিবারের অভ্যন্তরে ভোগের জন্য যে শ্রম হয়
যেমন পরিবারের সব সদস্যদের রান্না করে খাওয়ানো, শিশু পরিচর্যা ইত্যাদি পরিবারের
মহিলারা করলেন, কিন্তু সেই পারিবারিক শ্রমের জন্য তারা সরাসরি কোন মূল্য পেলেন না।
সেই পারিবারিক শ্রমও সামগ্রিক সামাজিক ও উৎপাদন সম্পর্কের সাথে যুক্ত। ধরা যাক ঘরের
মহিলা সদস্যকে অন্যত্র সামাজিক উৎপাদনী পরিসরে কাজ করতে হয়। সেই কাজের জন্য
গৃহশ্রমের কিছু অংশ যেমন রান্না করা বা শিশু পরিচর্যা করা তার পক্ষে সম্ভব নয়।
সেক্ষেত্রে রান্নার জন্য বাইরের শ্রমিক (মুখ্যত যারা মহিলাই হোন) এবং শিশু
পরিচর্যার জন্য ক্রেসের মহিলাদের শ্রমশক্তি অর্থের বিনিময়ে ক্রয় করাই যদি লাভজনক
বিবেচ্য হয়, তাহলে তারা তা’ই করবেন। কিন্তু যেসব মহিলা শ্রমিক অন্যত্র রান্নার কাজ
বা শিশু পরিচর্যার কাজ করবেন তাদেরকে নিজের পরিবারেও অনুরূপ কাজ করতে হবে। অর্থাৎ
বাজারের বিনিময়ের চাহিদার উপর নির্ভর করে পারিবারিক কাঠামো ও পারিবারিক শ্রমেরও
পরিবর্তন ঘটবে। এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে গৃহশ্রম, যার সরাসরি মূল্য দেওয়া হয় না,
তার থেকে পারিবারিক গণ্ডির বাইরে কর্মরত পুরুষ শ্রমিকরা অনেকখানি মুক্ত হবেন। এই
গৃহশ্রমে খাওয়া-দাওয়া, পরিচর্যা ও পারিবারিক সাপোর্ট-সিস্টেমে মানসিক স্বস্তির
মাধ্যমে পুরুষ ও নারী উভয় শ্রমিকের শ্রমশক্তির পুনরুৎপাদন হয় যাতে বাইরে গিয়ে তারা
নিজেদের শ্রমশক্তি বিক্রির বিনিময় মূল্য অর্জন করতে পারেন। এই পরিবর্তিত উৎপাদন
সম্পর্কে ও একই উৎপাদন সম্পর্কের অধীনে দু’টি বিভাজন পরিলক্ষিত হচ্ছে। অর্থনীতির
নিয়মে একই মূল্যের বিনিময়ে পুরুষদের করতে হচ্ছে শুধুমাত্র বাইরের শ্রম, নারীদের
করতে হচ্ছে বাইরের ও গৃহশ্রম, আবার অন্যদিকে একাংশ নারী গৃহশ্রমের একাংশ অন্য
নারীদের দিয়ে মূল্যের বিনিময়ে করিয়ে নিচ্ছেন। উপরন্তু নারীদের বাইরের শ্রমের
ক্ষেত্রে পারিবারিক ভরণ-পোষণের চাহিদা যদি বাজারের চাহিদা থেকে বেশি হয়, তাহলে সামাজিক
শ্রমে নারীর মজুরি শ্রমশক্তির মূল্যের কিংবা পুরুষের মজুরির চেয়ে কম হয়। পারিবারিক
ক্ষেত্রে এই চাহিদার নিয়ন্ত্রক ও চালিকাশক্তি হচ্ছে পুরুষ সদস্য, কারণ নারীদের মূল
উপার্জনকারী হিসেবে ধরা হয় না, তারা সহযোগী। সামাজিক শ্রমে পুরুষরা যদি নারীদের
প্রতিযোগী ও পুরুষদের কর্মসংকোচনের কারণ হিসেবে ভাবতে শুরু করে তাহলে নারীরা গৃহের
ভূষণ ও তাদের গৃহের অভ্যন্তরে থাকাই সমীচীন এই পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধ সমাজে চাগার
দিয়ে উঠে। অর্থাৎ সর্বক্ষেত্রে পরিবার পরিচালনার অঘোষিত নিয়ম কিংবা বিবাহজনিত
সামাজিক চুক্তি নারীর শ্রমের স্বরূপ নির্ধারণ করে, অন্যদিকে পারিবারিক কাঠামোর
পরিবর্তন ঘটে সামগ্রিক উৎপাদন সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে। তাই পুরুষ ও নারী এবং
নারী শ্রমিকের মধ্যেকার বিভাজন শ্রমিক আন্দোলন ও সামাজিক আন্দোলনের কর্মসূচী
নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয়।
মার্কসীয় বীক্ষা
দ্বান্দ্বিক
বস্তুবাদের মৌলিক সূত্র বৈপরীত্যের ঐক্য যদি শ্রমিক শ্রেণির সংগ্রামী ঐক্য গড়ে
তোলার প্রশ্নে প্রয়োগ করা হয়, তাহলে শ্রমিক শ্রেণির এই অভ্যন্তরিণ উল্লিখিত অবৈরী
দ্বন্দ্বকে সংগ্রামের প্রায়োগিক রূপে নির্ধারিত করতে হবে। এখানে উৎপাদনেও
বৈপরীত্যের ঐক্য – সামাজিক ও ব্যাক্তিগত বা পারিবারিক। পুঁজিবাদী উৎপাদনে উৎপাদের
মূল্য নির্ধারণ হয় তিনটি উপাদানের মূল্যের যোগফল থেকে। এই তিনটি উপাদান হলো
শ্রমশক্তির মূল্য, শ্রমের উদ্বৃত্ত মূল্য, উৎপাদনের উপকরণের ব্যবহৃত মূল্য অর্থাৎ
অতীত শ্রম বা মৃত শ্রম যা এই উপকরণগুলি তৈরি করেছে তার যে অংশ নতুন উৎপাদে ব্যবহৃত
হলো তার মূল্য। অন্যদিকে এই তিনটি উপাদানের মূল্য নির্ধারণ হয় কতটা গড় সামাজিক
শ্রম-সময় ব্যয় হলো তা দিয়ে। শ্রমশক্তি উৎপাদনের ক্ষেত্রে ও উপকরণের ব্যবহৃত মূল্য
বা অতীত শ্রমের ক্ষেত্রে নারীর অফুরন্ত ঘরোয়া শ্রম হিসাব বহির্ভূতভাবে যুক্ত
রয়েছে। নারী শ্রমিকের সামাজিক শ্রমের ক্ষেত্রে তার নিজস্ব শ্রমশক্তি পুনরুৎপাদনের
জন্য শ্রমও নারী নিজেই করতে হয়। সুতরাং নারীর গৃহশ্রম শুধু উপভোগের জন্য ব্যবহারিক
মূল্যই সৃষ্টি করে না, পুরুষ সদস্য ও নিজের সামাজিক শ্রমের জন্য শ্রমশক্তির
বিক্রির বিনিময় মূল্যও সৃষ্টি করে। সুতরাং শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লবী সংগ্রামে নারী
শ্রমিকের বিশেষ অধিকারের সংগ্রামকে সন্নিবিষ্ট করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।
ভারতীয় বাস্তবতা ও সংগ্রামী কর্মসূচী
সবচাইতে
গ্রহণযোগ্য উৎস এনএসএসও সমীক্ষা রিপোর্ট থেকে এবার ভারতবর্ষের মহিলা শ্রমিকের
অবস্থান দেখা যাক। এই হিসাব অনুযায়ী গ্রামীণ ক্ষেত্রে মহিলা শ্রমিকের সংখ্যা শহর
থেকে বহু বেশি। ২০০০ সালের মধ্যবর্তী সময় থেকে গ্রামীণ ক্ষেত্রে মহিলা শ্রমিকের
অংশগ্রহণ কমতে থাকায় এই ব্যবধানও ক্রমশ কমে আসছে। কৃষির বিপর্যয়, তীব্র বেকারত্ব,
রোজগারের সুযোগ হ্রাস ইত্যাদির ফলে গ্রামীণ ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে মহিলারাই বেশি
কাজ হারাচ্ছেন, এমজিএনরেগা, আইসিডিএস-এর মত প্রকল্প থাকা সত্ত্বেও এই প্রবণতা
গ্রামীণ ক্ষেত্রে তীব্র কর্মসংস্থানের সংকটকে দেখায়। কৃষি উৎপাদনে আধুনিক মেশিন
সরঞ্জামের ব্যাপক অনুপ্রবেশও কৃষিতে মহিলাদের অংশগ্রহণ কমে যাওয়ার একটি প্রধান
কারণ। বৃহৎ পুঁজিনির্ভর সেজ এলাকা গঠনের জন্য কৃষিজমি থেকে উচ্ছেদের ফলেও মহিলারা
কাজ হারাচ্ছেন। একটি নির্ভরযোগ্য হিসাবে দেখা গেছে এধরনের উচ্ছেদের ফলে প্রতি
পাঁচজন কর্মহারাদের মধ্যে মাত্র একজনের পুনর্নিয়োগ হয় এবং সেটাও জোটে পুরুষ
শ্রমিকের ভাগ্যে। বাজারের চাহিদা-নির্ভর প্রতিযোগিতায় টিঁকে থাকতে কৃষির পুঁজিবাদী
রূপান্তর যে নারী সশক্তিকরণ ঘটায় না বরঞ্চ নারীকে পারিবারিক গণ্ডির ভেতরে ঠেলে দেয়
এটা তারই উদাহরণ। এমনকী মহিলা ও পুরুষ শ্রমিকের সংখ্যার ফারাক গ্রাম থেকে শহরে
অনেক বেশি। যদিও আনুসঙ্গিক কিছু সার্ভিস সেক্টরের কাজে নতুন নারী শ্রমিক গড়ে উঠছে,
তবে সামগ্রিকভাবে কাজ হারানো শ্রমিকের সংখ্যার তূলনায় এই নতুন শ্রমিকের আনুপাতিক
বৃদ্ধির হার কম হওয়ায় নারী-শ্রমিকরা কম মজুরিতে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। অর্থাৎ যে
সব সেক্টরে নারীদেরই মুখ্যত নিয়োগ করা হয়, যেমন
স্বাস্থ্যসেবা, শিশু পরিচর্যা, প্ল্যান্টেশন, সাফাই কিংবা এমজিএনরেগার কাজ
ইত্যাদি, সেসব ক্ষেত্রেও নারী-শ্রমিকের রিজার্ভ-আর্মির উপস্থিতি মজুরিকে
শ্রমশক্তির মূল্যের বহু নীচে বেঁধে রাখছে এবং মহিলারা মুখ্যত ইনফর্মাল সেক্টরে কাজ
করায় আইনী সামাজিক শ্রম-সুরক্ষা থেকেও তারা বঞ্চিত। ২০১১-১২-এর এনএসএস সার্ভে
রিপোর্ট অনুযায়ী সংগঠিত ও অসংগঠিত ক্ষেত্রে মহিলাদের গড় দৈনিক মজুরি যথাক্রমে
৪৮১.৯০ টাকা ও ১২০.৩০ টাকা এবং পুরুষদের দৈনিক মজুরি যথাক্রমে ৬৩২.২০ টাকা ও
১৯৪.২০ টাকা। রাজ্যভিত্তিক হিসাবে দেখা
গেছে যে উত্তর ভারত থেকে দক্ষিণ ভারতে এবং সামগ্রিকভাবে উত্তর-পূর্ব ভারতে সামাজিক
শ্রমে মহিলাদের অংশগ্রহণ অনেক বেশি। মহিলাদের সামাজিক শ্রমে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে
পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধ যে প্রভাব বিস্তার করে এবং সামাজিক সম্পর্কের পুঁজিবাদী
রূপান্তর যে নিজে থেকেই এই মূল্যবোধের উপর আঘাত হানে না, বরঞ্চ একে শক্তিশালী করে
রাজ্যভিত্তিক তথ্য এই সত্যকেই প্রতিষ্ঠিত করে। প্রাক-পুঁজিবাদী বা পুঁজিবাদী যে কোন
সামাজিক সম্পর্কে মহিলারা পারিবারিক গণ্ডিতে সর্বদাই শ্রমিক, যখন তারা বাইরের
সামাজিক শ্রমে অংশগ্রহণ করেন তখন তারা দ্বিবিধ শোষণের শিকার হোন। কারণ স্বামী-সন্তান
পরিচর্যা ইত্যাদিতে যে গৃহশ্রম তা ব্যবহারিক মূল্যই সৃষ্টি করে না, পুরুষ সদস্য ও
নিজের শ্রমশক্তি পুনরুৎপাদনের মাধ্যমে শ্রম বাজারে বিনিময়যোগ্য করে তোলে বিনিময়
মূল্যও সৃষ্টি করে। ফলে এক স্তরীভূত মজুরি কাঠামোর মধ্য দিয়ে উৎপাদনের উপকরণের
মালিকশ্রেণি নারীদের উভয় শ্রমের উদ্বৃত্ত মূল্য আহরণ করে এবং তাতে শ্রমিকশ্রেণির
মধ্যে এক বিশেষ সুবিধাভোগী অংশ শোষণের বৈধতা প্রদানের পক্ষে দাঁড়ায়। জ্ঞাতে বা
অজ্ঞাতে মহিলাদের এক ক্ষুদ্র অভিজাত শ্রেণিও এই ফাঁদে পা দেন, এই মহিলারা সমাজ
সংস্কারের পক্ষে বা বিপক্ষে থাকলেও তাতে ইতর বিশেষ ফারাক হয় না।
নারীর সামাজিক শ্রম করার অধিকার নারী-দেহের উপর নিজের
স্বাধীন অধিকার প্রতিষ্ঠার উপর নির্ভরশীল। এই স্বাধীনতা অর্জন করা সম্ভব
পিতৃতন্ত্র তথা পারিবারিক গণ্ডিতে পুরুষ আধিপত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম পরিচালনার
মধ্য দিয়ে। কিন্তু এই সংগ্রাম একাংশ নারীবাদীদের ধারণার অনুরূপ কোন স্বয়ংক্রিয়
সংগ্রাম নয়। সামাজিক পরিসরে নারী শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি, নারী-পুরুষ সম মজুরি,
কাজের বহুল সুযোগ সৃষ্টি ও সামাজিক সুরক্ষার জন্য জঙ্গি নারী আন্দোলন ছাড়া পিতৃতন্ত্রের
বিরুদ্ধে নারীবাদীদের ঘোষিত সংগ্রামে, এমনকী শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলনেও বিজয় অর্জন
করা সম্ভব নয়। পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিরুদ্ধে সংগ্রাম প্রাথমিকভাবে পরিচালিত
করতে হবে সামাজিক-শ্রমে অংশগ্রহণকারী নারী-শ্রমিকদের মধ্যে, তাদের নিজস্ব পরিসরে –
নিজস্ব সংগঠনে, কারণ তারা একইসাথে পারিবারিক শ্রমে যুক্ত ও দ্বিবিধ শোষণের শিকার।
এবং বৃহত্তর শ্রমিক ঐক্য গড়ে তোলার লক্ষ্যে এই লড়াইয়ে সামিল করতে হবে পুরুষ
শ্রমিকদেরও।