।। অরূপ বৈশ্য।।
সুকৃতিরজ্ঞন বিশ্বাস |
(১) নির্দিষ্ট বক্তা অধ্যাপক তপোধীর ভট্টাচার্য বিষয়ের
উপর বিস্তৃত আলোকপাত করতে গিয়ে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট উত্থাপন করেন। এই তিনটি
হল – সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদের বিপদ, ধর্ম ও ধর্মতন্ত্রের পার্থক্য ও ইতিহাসের সংজ্ঞা।
প্রথম পয়েন্টে তাঁর বক্তব্য ছিল সরাসরি, মেদহীন ও স্পষ্ট। কিন্তু বাকী দু’টি পয়েন্টে তাঁর বক্তব্য মনে হয়েছে অস্পষ্ট ও ভাসাভাসা। প্রতিটি ধর্মেই দু’টি ধারা বিদ্যমান থাকতে দেখা যায়। একটি ধারা সাধারণ
খেটে খাওয়া মানুষের জীবন সংগ্রাম থেকে প্রাণ সঞ্চার করে এবং এই ধারার গণ আবেদন
শক্তিশালী হয় আম জনতার সংগ্রামের অন্তর্বস্তুতে, অন্য ধারাটি (transcendental) টিকে থাকে ও শক্তিশালী হয় শাসক শ্রেণি-বর্ণের আধিপত্যের
সাথে তাল মিলিয়ে। শাসকশ্রেণির আধিপত্য কত গভীর এর উপরই নির্ভর করে
ধর্মের কোন ধারাটির আবেদন মানুষের কাছে কত বেশি। ইতিহাসের
সংজ্ঞার প্রশ্নে তিনি ইতিহাসবিদদের দৃষ্টিভঙ্গি কী তা বিচার করার উপর গুরুত্ব
দিয়েছেন।এটা যদি ইতিহাস পাঠের মানদণ্ড হয় তাহলে ইতিহাস পাঠই
দুরূহ হয়ে উঠে,কারণ তাতে ইতিহাস পাঠ ও তার গুণমান
নির্ণয়ের আগেই পাঠককে হোঁচট খেতে হয় লেখকের দৃষ্টিভঙ্গির
পরিচয় জেনে নেওয়ার তাগিদ থেকে।
অধ্যাপক তপোধীর ভট্টাচার্য |
(২) দ্বিতীয় বক্তা সুকৃতিরজ্ঞন বিশ্বাস তপোধীর ভট্টাচার্য বর্ণিত
মানবমুখীন ধর্মীয় মতের অনুরূপ মতুয়া ধর্মের কথা উল্লেখ করেছেন, যে ধর্মের
জন্ম হয় পূর্ববঙ্গের দলিত নমঃশূদ্রদের আত্মমর্যাদার আন্দোলন, হরিচাঁদ ও গুরুচাঁদ ঠাকুরের ব্যাপক শিক্ষা আন্দোলন ও
অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের
গর্ভে। পশ্চিমবঙ্গের উচ্চকোটির নম:শূদ্ররা এই ধর্মকে শাসকের ছত্রছায়ায় ব্রাহ্মণ্য হিন্দুধর্মের কাছাকাছি নিয়ে গেছেন,বামফ্রন্ট তৃণমূল হয়ে এই ধারাটি এখন হিন্দুত্ববাদে উজ্জীবিত হওয়ার
চেষ্টা করছে সংঘ পরিবারের হাত
ধরে, তথাগত রায় এই উচ্চকোটিরই
প্রতিনিধি। তথাগত রায় নিজে ইতিহাসবিদ না হয়েও ক্যামব্রিজ ট্রিনিটি কলেজর ফেলো জয়া
চ্যাটার্জিকে যতই তথাকথিত ইতিহাসবিদ
হিসেবে উপহাস করুন না কেন, বিদ্বৎ
সমাজ জয়া চ্যাটার্জি রচিত ১৯৩২-১৯৪৭
সালের বাংলা বিভাজনের ইতিহাসকে অবশ্য পাঠ্য হিসেবেই ভূষিত করবে, অন্যদিকে তথাগত রায়ের ‘যা ছিল
আমাদের দেশ’ বই বৌদ্ধিক মহলে ইতিহাস
রচনার মানদণ্ডে উত্তীর্ণ বলে বিবেচিত
না হওয়ারই সম্ভাবনা। যাইহউক, গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে সামাজিক ন্যায়ের প্রগতিশীল ধারাকে উজ্জীবিত করার মূল আধার হবে
পশ্চিমবাংলার পিছিয়ে পড়া
মেহনতি অংশ ও নাগরিকত্বহীনতায় জর্জরিত দণ্ডকারণ্য ও আসামের দরিদ্র মেহনতি নমঃশূদ্ররা। এই
আন্দোলনের প্রতিনিধি সুকৃতিরঞ্জন বিশ্বাসেরা। তাই তিনি গুরুত্ব আরোপ করেন আন্দোলনের ইতিহাসের উপর। তিনি
গুরুত্ব আরোপ করেন
বাংলার সাম্প্রদায়িক বিভাজনের ইতিহাসের উপর। ১৯০৫-১৯৪৭ সালে বাংলা বিভাজন ও বাংলা বিভাজন রদ
উভয় ক্ষেত্রেই বাঙালি বর্ণহিন্দু ও বাঙালি দলিত-মুসলমানের দু’টি অক্ষের সংঘাতের কাহিনি তিনি প্রাঞ্জল ভাষায় বর্ণনা করেছেন।