আকাশে মেঘ জমেছে, পথ নিরিবিলি; সব চুপ; সন্ধ্যা পেরিয়ে রাতের পহর। পথের মোড়ে একটি বাড়ির নিচের ঘরে জানালায় আলো জ্বলছে; কাছে এসে চোখ তুলে তাকাতেই জানালা বুজে গেল। বন্ধুদের আড্ডায় এভাবেই বলতে শুরু করল সুমিত। বন্ধুদের মধ্যে অনেকেই এই গূঢ় পদ্য-মুহুর্তের সূচনায় হতাশ হল, কেউ আবার হাটের রচনার কোন লঘু পর্ণ-মুহুর্ত কল্পনা করে উৎসুখ হয়ে উঠল। সবাই যখন ভাবছে সুমিত এবার বন্ধ জানালার ভেতরে প্রবেশ করবে, সুমিত কিন্তু তার বাচনে এক রহস্যের বুনোট বুনতে লাগল। সুমিত বলতে লাগল, সত্যি এ এক ভয়ঙ্কর মুহুর্ত। উপরে ঘনকালো মেঘলা আকাশের গাড় অন্ধকার ও নিচে রাস্তার দু’পাশে মিউনিসিপালটির নিয়নের বাতির স্নিগ্ধ আলো – উলম্ব এই স্পেসের মাঝখানে আমি তেতলা বাড়ির ছাদের আবছায়ায় দাঁড়িয়ে। হঠাৎ প্রচণ্ড কর্কশ শব্দে আকাশ আলোয় ঝলসে উঠল, একই সাথে নিভে গেল নিয়নের বাতি। ক্ষণিকের এই বৈপরিত্যের ঘোর কাটতে না কাটতেই চরাচর ঘন আঁধারে ডুবে গেল, রাতের পাহাড়ে এক গভীর গুহার মধ্যে একা বাসের অনুভূতিতে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। আমি ফিরে গেলাম ঘরে।
আমি প্রতিরাতে একটা নির্দ্দিষ্ট সময়ে এই ছাদে এসে দাঁড়িয়ে থাকতাম। যে এলাকায় আমি ভাড়াঘরে থাকতাম সেই এলাকায় ক্রমশ ঢাল বেয়ে নিচের দিকে নেমে যাওয়া রাস্তার দু’পাশে সারিবদ্ধ দু-তিনতলার বাড়ি, পাহাড়ের শৃঙ্খলা মেনে রাস্তাটি যখন আবার উপর দিকে উঠে গেছে তখন অন্তত নাম-ঠিকানায় আরেকটি এলাকা শুরু। রিসার্চ স্কলার হিসেবে একটি প্রজেক্ট নিয়ে এই পাহাড়ি রাজ্যে আমাকে যেতে হয়। ক্রমশ এই পাহাড়ি রাজ্যের মোহনীয় প্রাকৃতিক শোভা ও সহজ সরল মানুষদের প্রতি আমি এক অমোঘ আকর্ষণ অনুভব করতে থাকি, বিশেষ করে আমার বাড়ির রাস্তার বিপরীত বাড়ির তেতলার জানালার পাশে টেবিল ল্যাম্পের আলোয় যে মেয়েটি গভীর রাত অবধি বসে থাকত সেই মেয়েটির প্রতি। ময়নামতির পথের ধারে পটলচেরা কাজলনয়নী যেমন কবিকে আকর্ষিত করে, এই পাহাড়ি ঢালু পথের ধারে লঙ্কাচেরা চোখের মুখাবয়বের রূপ-লাবণ্য আমাকে অনুরূপভাবে আকর্ষিত করতে থাকে। ঢালু পথের বাঁকে আমি কতবার তার সামনাসামনি হয়েছি, কিন্তু কথা বলার সাহস জোটাতে পারিনি। এটা শুধু একারণেই নয় যে, আমি মুখচোরা প্রকৃতির ছেলে ছিলাম বলে। বরঞ্চ কথা বলার সাহস জোটাতে না পারার মুখ্য কারণ ছিল যে, পাড়ার মোড়ে বা রাস্তায় মোটরবাইকে যে উঠতি ছেলেছোকরারা ঘুরে বেড়াত তারা জানত আমি মায়াং অর্থাৎ বিদেশি। মায়াং হয়ে কথা বলার প্রচেষ্টার অন্য অর্থ দাঁড়িয়ে যাওয়ার বিপদকে অবজ্ঞা করার সাহস আমার ছিল না।
সেদিন সকাল থেকেই আকাশ মেঘাচ্ছন্ন ছিল। মাঝে মাঝেই দূরে পূব-আকাশের পাহাড়ের আড়াল থেকে উঁকি মেরে রোশনাই ছড়িয়ে সূর্য ঘন মেঘের আড়ালে চলে যাচ্ছিল। সকাল দিকে দু’এক পশলা বৃষ্টির ফলে পাহাড়ি ঢালু পথের কালো চিকচিকে স্যাঁতস্যাঁতে কিন্তু মনমাতানো রূপ বেরিয়ে পড়েছিল, যেন পাহাড়ের গা বেয়ে মাথায় বোঝা নিয়ে নামতে থাকা কোন সাঁওতালি-মুণ্ডারি আদিবাসী রমণীর ঘর্মাক্ত গাল।
পাহাড়ি রাজ্যের মেঘলা সকালের এই আমেজের সুর কেটে দেয় বাতাসে ভেসে আসা এক তীব্র কলরব। জানালা দিয়ে রাস্তায় উঁকি মেরে দেখি এক বড়সড় মিছিল এই পথ দিয়ে এগিয়ে চলেছে। সামনের ব্যানারে কী লেখা রয়েছে তা ভাষা না জানার জন্য পড়তে পারিনি। কিন্তু একি, ব্যানারের এক প্রান্ত ধরে রয়েছে আমার উলটো দিকের বাড়ির সেই মেয়েটি। পেন্টে পা-ঢুকিয়ে, জামা গায়ে গলিয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়ি। দৌড়ে এগিয়ে গিয়ে ব্যানারের কিছু পেছনে মিছিলে ঢুকে পড়ি। দৌড়তে গিয়ে হাঁফিয়ে গিয়েছিলাম। কিছুটা ধাতস্ত হওয়ার আগেই দেখি সামনে বিশাল পুলিশ ব্যারিকেড, ঘাবড়ে গিয়ে যতটা সম্ভব সবার অলক্ষ্যে মিছিলের পেছন দিকে চলে আসি। পুলিশ মিছিলকে রাজভবনের দিকে যেতে দেবে না, কিন্তু মিছিলের নেতৃত্ব নাছোড়বান্দা। সেই মেয়েটিও যে সেই নেতৃত্বের একজন তা বুঝতে আমার অসুবিধে হয়নি। আচমকা মিছিলকারীদের উপর পুলিশের বেধড়ক লাঠির ঘা যথেচ্ছভাবে আছড়ে পড়তে লাগল। সেই মেয়েটির জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেও ঘটনার আকস্মিকতার রেশ কাটতেই আমার বাস্তববোধ জাগ্রত হয়ে উঠল। আমার রিসার্চের এমন রসদ হাতছাড়া করা যায় না। পকেট থেকে হাতের মুঠোর সাইজের স্লিম ডিজিট্যাল ক্যামেরা বের করে ছবি তুলতে লাগলাম। সরকারি তথ্যপাতি সংগ্রহের উদ্দেশ্যে সারাদিন অফিসে অফিসে দৌড়ঝাপ করে বেশকিছু অ্যাপয়েন্টমেন্ট জোগাড় করলাম। এভাবে ঘুরতে ঘুরতে বেলা কখন ঢলে পড়ে আবছা অন্ধকার ছেয়ে গেছে তা ঠাহর করতে পারিনি। রাতের খানা হোটেলেই সেরে নিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ালাম।
বাড়ির সামনে এসে উপরের দিকে তাকাতেই জানালা বন্ধ হয়ে গেল, নিভে গেল আলো। যথারীতি সিগেরেটে আগুন ধরিয়ে ছাদে গিয়ে দাঁড়ালাম, জানালা বন্ধ রইল – ভেতরে অন্ধকার থাকায় কিছুই দেখার জোঁ ছিল না। ভগ্নমনোরথ হয়ে ঘরে এসে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। ভোরের দিকে তীব্র চিৎকার, গাড়ির ইঞ্জিনের ঘরঘর আওয়াজ, হৈ-হুল্লোড়ে আমার ঘুম ভেঙে গেল। সামনের রাস্তায় সেই মেয়েটির বাড়ির সামনে বিরাট জটলা। নিচে নেমে গিয়ে দেখি পুলিশ-মিলিটারিতে সমস্ত পাড়া ছয়লাপ। পুলিশের গাড়ির সাথে একটি অ্যাম্বুলেন্সও দাড়িয়ে আছে। ধীরে ধীরে বাড়ির কাছে যেতেই দেখি ক’জন লোক কাঁধে ও পায়ে ধরাধরি করে মুখ ছাড়া বাকি অংশ চাদরে মোড়ে একটি দেহ সিঁড়ি দিয়ে নামিয়ে আনছে। মুখের দিকে চোখ পড়তেই আঁতকে উঠি, মুখাবয়বে সর্বত্র বাহিনীর বিশেষ অধিকার প্রয়োগের ছাপ জ্বলজ্বল করছে। তৎক্ষণাৎ আমার মোবাইল ফোন বেজে উঠে। মবাইলের স্কিনে লেখা গাইড-স্যার। কোনমতে বলি, “স্যার, অমার রিসার্চের কাজ সবে শুরু”। মোবাইলের স্যুইচ অফ করে দিই। ছাদে যাওয়ার আগে রাস্তা থেকে উপরের দিকে তাকানো এবং জানালা বন্ধ হয়ে যাওয়া – সময়ের এই অদ্ভূত সংযোগ যদি না ঘটত তাহলে পরিস্থিতির কি কোন ইতরবিশেষ ফারাক ঘটত? – এই প্রশ্ন আমাকে আজকের ব্যস্তসমস্ত নাগরিক জীবনের অবসরেও তাড়া করে বেড়ায়।
(c) Picture:ছবি