Showing posts with label সাহিত্য. Show all posts
Showing posts with label সাহিত্য. Show all posts

ধারাবাহিক গল্প "অহং"-এর পঞ্চম পর্বঃ ধোঁয়াশা

Posted by স্বাভিমান Labels: , ,

ধোঁয়াশা

(আমাদের সমকালের জন্য লিখেছেন অনীক লস্কর)

      কুলেন্দ্র ঘুমের ঘোরে চোখ মেলে। ঘরের দেওয়ালের ফাকফোঁকর দিয়ে বাইরেটা দেখতে পায়। রাতের আঁধারের সাথে চাঁদের আলো মায়াবী আয়েশে যেন জড়াজড়ি করে শুয়ে আছে। নৈঃশব্দের সাথে একটানা ঝিঁ ঝঁ পোকার শব্দ নবদম্পতির আলিঙ্গনের স্পর্শের মত একে অপরের সাথে মজে আছে। গাঁয়ের মধ্যরাতির আবেশ কুলেন্দ্র যেন নতুন করে টের পায় – কুলেন্দ্রর গায়ে শিহরণ জাগে। বাড়ি থেকে আজ রীণার দ্রুত চলে যাওয়ার দৃশ্য তার মনে পড়ে – এই প্রথমবার রীণার দেহ-সৌষ্ঠব তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। রীণার প্রেমিক অর্থাৎ কুলেন্দ্রর দাদার জেল, নিজের অমতে অন্যের সাথে বিয়ে, ছেলের অকাল মৃত্যু, অসুখী দাম্পত্য জীবন ইত্যাদির জন্য রীণার প্রতি তার কোন অনুকম্পা হয় না, রীণার প্রতি তার ব্যবহার এই ধারণা নির্ভর যে রীণা ভালমানুষ। ভালমানুষ এ জন্যই যে রীণা সবকিছুকেই মানিয়ে নেয় অন্যের কথা ভেবে – নিজের ইচ্ছাকে চাপা দিয়ে মানসিক যন্ত্রণাকে ভবিতব্য ভেবে সহনীয় করে তোলে। রীণা প্রতিবাদ করে না, বিদ্রোহ করে না, ফুলেন্দ্রর মত বদলা নেওয়ার কথাও ভাবে না – মেয়েলি গুণ অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয় কি দেয়-না সে নিয়েও রীণা সম্ভবত মাথা ঘামায় না। তাহলে রীণা কুলেন্দ্রর সাথে কী কথা বলতে চায়? ফুলেন্দ্রর সাথে দেখা করতেই বা সে কেন আসে? ভবিতব্যের বিপরীত পথ ধরে রীণার এই আনাগোনা নিয়মকে অস্বীকার করার সুপ্ত বাসনার লক্ষণ নয় তো? শহুরে শিক্ষিত আপ-রাইট মহিলা বিশ্বাসের স্ত্রীও তো কেমন যেন নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধ পরিস্থিতি মেনে নিয়েছেন। সেভাবে পাড়াগাঁয়ের মেয়ে রীণার সাথে বিশ্বাসের স্ত্রীর তুলনা করাটা কুলেন্দ্রর মন সায় দেয় না। বিশ্বাসের স্ত্রীকে ভাল লাগার সাথে তার একটা সমীহভাব মিশে আছে। বিশ্বাসের স্ত্রী আধুনিক মনস্কা, সবকিছু জানতে – বুঝতে চায়, নতুন কিছু নিজের উদ্যোমে করারও একটা চাহিদা আছে। সমাজের জন্য কিছু করার তাগিদ ও কুলেন্দ্রর প্রতি তাঁর ব্যবহারই কুলেন্দ্রকে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট করে। ইউনিভার্সিটির সুস্মিতাও আধুনিক -  উচ্চশিক্ষিত – ধনবান – এরিস্ট্রোক্র্যাট পরিবারের মেয়ে। চেহারায় ও বেশভূষায় সুন্দরী ও আকর্ষণীয়। একটা নির্দিষ্ট সময়ে সুস্মিতা যখন দামি গাড়ির দরজা খুলে ইউনিভার্সিটি চত্বরে পা রাখে, এডমিনিসট্র্যাটিভ বিল্ডিংয়ের পাশে দাঁড়িয়ে তাকে দেখার সুযোগ কখনও হাতছাড়া করতে চায় না কুলেন্দ্র। কিন্তু বিশ্বাসের স্ত্রী ও সুস্মিতার মধ্যে একটা ফারাক সে মনে মনে ঠাহর করে। সুস্মিতাকে জড়িয়ে ধরার আকর্ষণ তার শরীরের রক্তপ্রবাহে ঢেউ তুলে। কুলেন্দ্র তাকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করে, কিন্তু সুস্মিতার মুখাবয়ব তার চোখের সামনে আবছা হয়ে যায়। তার চোয়াল শক্ত হয়ে আসে, মুষ্ঠিবদ্ধ হাত আরও জোরে নাড়াচাড়া করতে থাকে – সুস্মিতাকে সে কোনভাবেই দেখতে পায় না। সুস্মিতা তার কাছে অধরাই থেকে যায় – সে নেতিয়ে পড়ে – নির্জীব অবস্থায় কখন যে আবার ঘুমের আবেশে নিমজ্জিত হয় তা বলতেই পারে না। এবারে ঘুমের তাপে তার আর স্বপ্ন ফুটে না।        

              ঘুম যখন ভাঙে, তখন বাড়ির উঠোনে কড়া রোদ এসে পড়েছে। সামনের রাস্তা দিয়ে পাশের গাঁয়ের আমিনূরের সুমো গাড়ির ইঞ্জিনের গড়গড় আওয়াজে ভেসে আসছে। আমিনূর কুলেন্দ্রর স্কুলের বন্ধু। গেল বছর প্রাইভেট ফিনান্সের লোনের গাড়ি লাইনে ছেড়েছে ভাড়া খাটানোর জন্য। লোন নেওয়ার জন্য নগদ জমার অর্থ জোগাড় করেছে দু’খানি পাম্পসেটের অপারেটর হিসেবে পাওয়া কমিশন জমা রেখে এবং একটি ইন্দিরা আবাসের অর্থ দিয়ে। আমিনূরের গ্রামের জমিদার পরিবারের সাদিক চৌধুরী অবিসি কৃষক সমিতির নামে বরাদ্দকৃত এই পাম্পসেট দু’টি আমিনূরের জিম্মায় রেখে খেতের মরসুমে ভাড়া খাটান। তালিকা থেকে অন্যের নাম বাদ দিয়ে ইন্দিরা আবাসের নগদ অর্থও পাইয়ে দিয়েছেন সাদিক। আমিনূররা তা জানে। কিন্তু তথাপিও আমিনূররা চৌধুরীদের প্রতি কৃতজ্ঞ। চরিত্রগতভাবে আমিনূর ও কুলেন্দ্র বিপরীত মেরুর। স্কুলে কুলেন্দ্র শান্তশিষ্ট সুবোধ বালক – আর আমিনূর গাট্টাগোট্টা খারাপ খাসলতের ছেলে হিসেবে পরিচিত। কিন্তু তারপরও তাদের মধ্যেই বন্ধুত্ব জমে উঠে – সে এক অন্য রহস্য। আমিনূর তার মনের কথা কুলেন্দ্রকে বলত। কুলেন্দ্রর মনে পড়ে আমিনূর একদিন বলেছিল, তার আব্বা কেন চৌধুরীদের নিয়ে গালি পাড়েন তা সে বুঝতে পারে না। তার আব্বা নাকি বলেন “আল্লায় সাহারা দিলে চৌধুরীর লুঙি তুইল্যা হুগা দিয়া বাঙ হারাই দিতাম”। তার আব্বার কাছ থেকেই সে শুনেছে এই চৌধুরীরাই তাদের আশ্রয় দিয়েছেন, আর এখানে থাকার জায়গা দিয়েছেন – তথাপি চৌধুরীদের উপর তার আব্বার কেন এত গোসা আমিনূর বুঝে উঠতে পারে না। চৌধুরীদের দৌলতেই তো সে এখন গাড়ির মালিক। তবে পাম্পসেটের ভাড়ার টাকা সময়মত দিতে না পারলে যখন জাত তুইল্যা গাল পাড়ে তখন তারও আব্বার মত গোসা ওঠে। আমিনূর খুব গর্ব করে তার ঠাকুর্দার বীরগাঁথা কুলেন্দ্রকে শোনাত – কুলেন্দ্ররও তা শুনতে ভাল লাগত। মন দিয়ে আমিনূরের পারিবারিক ঐতিহ্যের কথা শুনত বলেই বোধহয় কুলেন্দ্রই ছিল আমিনূরের সবচাইতে প্রিয় বন্ধু। আমিনূরের ভয়ে স্কুলে কুলেন্দ্রকে কেউ কিছু বলতে সাহস করত না। আমিনূরের বাপের বাপ অর্থাৎ দাদাজান ছিলেন পূর্ব-পাকিস্তানের নানকার প্রজা হিসেবে হদ-বেগার। মোট বওয়া – পালকি টানা ইত্যাদি যে কোন গতরখাটা কাজের লাগি জমিদার যখনই হুকুম দিত, তখনই তার দাদাজানকে তাঁর ছোট পোলা অর্থাৎ আমিনূরের বাপরে নিয়া জমিদারের দোয়ারে হাজির হতে হত। হুকুম তালিমে একটু এদিক-ওদিক হলে কিল-লাথি জুটত। তার ঠাকুর্দার মূল দায়িত্ব ছিল জমিদারের লাঠিয়ালের কাজ করা। জমিদারির খাসতালুকে সামান্য জমি খেতি করে সংসারের সবার পেটের নান জোগাড় করতে হত, আর বিনিময়ে হদ-বেগারি গতর খেটে জমির কর দিতে হত।

           এসব কথা ভাবতে ভাবতে কুলেন্দ্রর স্কুলের স্মৃতি মনে হল। দু’জনে স্কুল পালিয়ে করিমগঞ্জ শহরে মর্নিং শো সিনেমা দেখতে যাওয়ার ঘটনা মনে পড়ে কুলেন্দ্রর। বলিউডের হিন্দি সিনেমার নায়ক এক কৃষক পরিবারের ছেলে – জমিদারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে জমিদারকে মেরে পালিয়ে যায়। কমার্সিয়্যাল সিনেমার সমস্ত মশালা সহ বাগী নায়কের নেতৃত্বে কৃষক যোদ্ধাদের বাহিনী ও জমিদারের বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনার মধ্য দিয়ে সিনেমার প্লট এগিয়ে চলে। অনর্গল কথা বলা আমিনূরের স্বভাব। যে সিনেমা দু’জনে মিলে দেখল, হল থেকে বেরিয়েই সেই সিনেমার পুঙ্খানুপুঙ্খ গল্প আবার কুলেন্দ্রকে এমনভাবে বলতে লাগল – যেন কুলেন্দ্র নায়কের বীরত্ব যথাযথ উপলব্ধি করতে পারেনি। কথা বলতে বলতে পায়ে পায়ে দু’জনে কুশিয়ারার পাড়ে এসে পড়ল। আমিনূর একটি কাঠের লগে কুলেন্দ্রকে বসতে বলে সিনেমার কাহিনীর সূত্র ধরে তার দাদাজানের কাহিনী বলতে আরম্ভ করল।

           সিলেট ধর্মপাশার খাজনা-আদায়কারী আজাদ তালুকদার আমিনূরের দাদাজান সহ অন্যান্য নানকারদের বড়-জমিদারের বাড়িতে হাজির হওয়ার জন্য খবর পাঠায়। রোজগারের আশায় সুযোগ পেলেই তারা অন্যত্র কাজের সন্ধানে যায়, সেদিন তারা ভোরবেলা শহরে গিয়েছিল। সকালে ঘুরে এসে জানতে পারে যে তাদের যেতে দেরি হওয়ায় এক কৃষক রমণীকে জমিদারের খাস লোকেরা জোর করে উঠিয়ে নিয়ে গেছে। জমিদার রণেন্দ্র চরণ চৌধুরীর সৌখীনতা ও কামুকতার বর্ণনা দিতে গিয়ে আমিনূর এক সায়র শোনায় – “চৌধরী ছিল রণেন্দ্রচরণ রসিয়া নাগর, জল টাঙ্গনের ঘরে শোয় দোসরা নাগর”।

         কথা বলতে বলতে আমিনূরের উত্তেজনা বাড়তে থাকে, “হুন, আমার দাদাজানর বউত গুরদা আছিল, সবরে কইল - চল, আমরা ওগুর কোন কাজ করতাম নায়, আর আমরার ইজ্জত বাচাইতে বেটিরে ছুটাইয়া আনতে লাগব। আমার দাদাজানর কথায় সব অউ রাজি অইল। জমিদারর দাওয়াত গিয়া আজিলে – জমিদার রাগে গড়গড় কইর‍্যা আগাইয়া আইতে আইতে কইল, “তরার তো সাহস কম নায়, একলগে আইয়া আমার দাওয়াত মাথা তুইল্যা দাড়াইচছ”। দাদাজানের কিছু একটা কওয়ার ধরলেই, জমিদার যেই তার উফরে হাত উঠাইছে, অমনি হাতর লাঠি দিয়া জমিদারর মাথাত বওয়াই দিল। জমিদার মাটিত পড়ি গেছে – রক্ত বারই গেছে। চারদিক থাইক্যা ধর মার আওয়াজ। দাদাজান ইখান থাইক্যা ভাগল। দাদাজানর পরিবারের সবরে কয়দিন আজাদ তালুকদার লুকাইয়া রাখছিল এবং পরে ন-আবাদি বিলর জমিদার চৌধরীর ইখান নানকার কইর‍্যা পাঠাই দিল। ওউ জমিদারিতও পরে গণ্ডগোল লাগায় অউ জমিদারর কুটুম তাঁর মসির ঘরর ভাই রসিদ চৌধরীর আব্বার জাগাত আইয়্যা ঠেক বানাইছইন আমার দাদাজান যেখান অখন আমরা আছি, আব্বার কাছ থাইক্যা হুনছি ঔ জিল্লাতও চৌধরী জমিদারর বিরুদ্ধে নানকার হকলে বউত লড়াই লড়ছইন – তখন থাইক্যাউ আব্বার গোসা কীনা জানি না”। সাদিক চৌধুরীদের এখন আর জমিজমা তেমন নেই – ভিটেমাটি ও কয়েক কিয়ার নিজস্ব ক্ষেতের জমি ছাড়া বাকি সব বিক্রি করে দিয়েছে। সাদিকরা পাঁচ ভাই – এক ভাই থানার দারোগা, একজন হাকিম, একজন উকিল ও আরেক ভাই বিডিও’র চাকরির সুবাদে গ্রামের বাইরে নিজের নিজের সংসার নিয়ে থাকেন। সাদিক গৃহস্থি সামলান ও গ্রামের মাতব্বর হিসেবে পঞ্চায়েত প্রধানও তাকে সমীহ করে চলে – স্থানীয় প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিদের সাথে তার দহরম-মহরম রয়েছে। সরকারী সুযোগ সুবিধা কে কীভাবে পাবে বা ব্যবহার হবে সেব্যপারে সাদিক চৌধুরীর মতকে সব ক্ষেত্রে সবাই গুরুত্ব দেয়। সবাইর ধারণা সাদিক চৌধুরী সবক্ষেত্রেই বিবেচকের মত সিদ্ধান্ত নেন। একমাত্র আমিনূরের আব্বাই ব্যতিক্রম। আমিনূরের মাঝে মাঝে মনে হয় তার আব্বা নিমখহারামি করছেন। গোসার কারণ জিজ্ঞেস করলে তার আব্বা তেলে-বেগুনে জ্বলে     ওঠেন – আমিনূরের সাথে এব্যাপারে কোন কথা বলতে চান না। আমিনূর কিন্তু সাদিক চৌধুরীর দৌলতেই বেশ কিছু অর্থ কামিয়েছে, তাই সাদিক জাত তুলে গালি পাড়লে তার পিত্ত জ্বললেও সে তা হজম      করে নেয়।  

            গল্প বলার উত্তেজনায় দু’জনেই পেটের খিদা ভুলে ছিল – এক্ষণে পেটে মোচড় দিয়ে তা জানান দেয়। পাশের ঝুপটি দোকানে দু’জনে মিলে পেটপূর্তি ঘুঘনি দিয়ে হলুদ-ভাতের পোলাও খায় ও তারপর গরুর দুধের চা খেয়ে আমিনূর একটা বিড়ি ধরায়। বেলা তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল – সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে। এবার বাড়ি ফেরার তাড়া – স্কুল ছুটির সময়ের আগেই বাড়িতে পৌঁছতে হবে। লাইনের সুমো গাড়িতে চেপে দু’জনে গৃহাভিমুখে রওয়ানা দেয়। আমিনূরের বাড়ির সামনে পৌঁছতেই অনেক লোকের জটলা দেখা যায় ও বাড়ির ভেতর থেকে কান্নার রোল ভেসে আসে। আমিনূর বুঝতে পারে দাদাজান আর বেঁচে নেই – বেশ কিছুদিন বিছানায় কাটিয়ে প্রায় শতবছরের দীর্ঘ আয়ু পেয়ে তার গর্বের দাদাজান আজ ইন্তেকাল ফরমাইয়াছেন।

             এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘড়িতে সকাল ন’টা বেজে গেছে কুলেন্দ্রর তা খেয়ালই নেই। মিনিট-সেকেণ্ড-ঘণ্টা দিয়ে সময়ের হিসেব আর ভাবনার সময়ের হিসেবের মধ্যে এক বৈপরিত্য রয়েছে। বর্তমান যখন মস্তিষ্কের উপর চেপে বসে তখন সে ভাবনাকে সময়ের পেছন দিকে যেতে প্ররোচিত করে। ভবিষ্যত কল্পনার বাস্তবভিত্তি সময়ের উভয়মুখী আনাগোনার মধ্য দিয়ে একে একে রূপ নিতে থাকে। কিন্তু দৈনন্দিন জীবনের হিসেবের সময় বড়ই নির্মমভাবে একমুখীন। শৈশবের স্মৃতি কুলেন্দ্রকে এখন তাড়া করলেও শৈশব তো আর ফিরে আসবে না। কুলেন্দ্রর এই অলস সকালের কয়েক ঘন্টা সময়ের মধ্যেই তার বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে বেশ কয়েকটি মটর-সাইকেলে তার গাঁয়ের বন্ধুরা বেড়িয়ে গেল – দু’চারটে বড় গাড়িও লাইনের ট্রিপ ধরতে বেরিয়ে পড়েছে। হাইওয়েতে যাওয়ার জন্য গ্রাম থেকে কুলেন্দ্রর বাড়ির পাশ দিয়ে গুপ্ত বাড়ির পেছন দিয়ে সোজা একটা নতুন রাস্তা হওয়ায় আজকাল এই সুবিধে হয়েছে। এই রাস্তা বানানোর কাজেও কুলেন্দ্রর বন্ধুরা ছোটোখাটো উপ-ঠিকাদারি পেয়েছিল। বলাই-মদন-আমিনূররা বেরিয়ে যাওয়ার সময় চিৎকার করে বলে গেছে – “হই কুলেন্দ্র, আজকে আছচ তো, বিকালে দেখা অইব”। এদের মধ্যে কেউ ঠিকাদারের এজেন্ট, কেউ স্কুলে মাস্টার, কারুর বাজারে কম্প্যুটার-ইন্টারনেটের দোকান রয়েছে। কুলেন্দ্রর বাবা গাঁয়ের ফসল কিনে সাপ্তাহিক হাট-বাজারে ঠেলা দিয়ে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে মোটামুটি একটা কামাই করতেন – কুলেন্দ্রর বাবার মত গাঁয়ের অনেকেই সাইকেল-ঠেলায় বিভিন্ন ধরনের মাল বয়ে নিয়ে সাপ্তাহিক হাট-বাজারের ব্যবসার সাথে যুক্ত থাকত। এখন সে ব্যবসা থেকে আর মুনাফা আসে না। চালানি মালের সাথে টেক্কা দিয়ে আর লাভ করা যায় না। কুলেন্দ্রর বাবার আয় এখন আর প্রায় নেই, বয়সের ভারেও ন্যুব্জ। ফুলেন্দ্রর আয়ে সংসার চলত – সেটাও এখন বন্ধ। হঠাৎ মস্তিষ্কে হাজির হওয়া এই দুশ্চিন্তায় তার বুকের ভেতরটা কেমন যেন ভারী ভারী লাগে।

             নিজের অজান্তেই পায়ে পায়ে কখন যে উঠোনের একপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে কুলেন্দ্রর তা খেয়ালই নেই। হঠাৎ বাড়ির গেটের সামনে এসে একটা গাড়ি থামলে সে সম্বিত ফিরে পায়। মারুতি-৮০০ গাড়ি থেকে প্রথমেই যাকে সে নামতে দেখে তাতে তার নিঃশ্বাসের গতি তীব্র হতে থাকে। গাড়ি থেকে প্রথমেই নামেন বিশ্বাসের স্ত্রী এবং তারপর একে একে জিতেন বিশ্বাস ও আরেকজন অপরিচিত ভদ্রলোক। ধীরে ধীরে শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি স্বাভাবিক হয় – গেটের সামনে গিয়ে কুলেন্দ্র জিজ্ঞেস করে “আরে, আফনারা যে!” এর কোন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার আগেই তাঁরা ততক্ষণে কুলেন্দ্রর বাড়ির উঠোনে এসে হাজির হয়েছেন। কুলেন্দ্র ঘরের ভেতর আসার ইঙ্গিত করলে জিতেন বিশ্বাস উঠোনে বসার ইচ্ছে প্রকাশ করেন – কুলেন্দ্র সে অনুযায়ী বসার জায়গা করে দেয়। বিশ্বাসের স্ত্রীই প্রথমে কথা পাড়েন, “আমরা এসেছি একটা প্রজেক্ট নিয়ে - ও আরে, আগে তো তোমার সাথে ওনার পরিচয় করিয়ে দেই – ইনি হচ্ছেন প্রজেশ কর, শিলচরে থাকেন – ছিয়াশির ভাষা আন্দোলনের ছাত্র নেতা – এখন আমাদের এনজিও করেন”। প্রজেশ করকে কুলেন্দ্রর খুব চেনা চেনা লাগছে – কোথায় যেন দেখেছে। কুলেন্দ্রর কৌতূহলী দৃষ্টি দেখে প্রজেশ কর বলে ওঠেন – আমি এঅঞ্চলে আগে অনেকবার এসেছি। বিশ্বাসের স্ত্রী বলতে থাকেন, “আমরা একটা প্রজেক্ট নিয়ে এসেছি – আপনি যদি এঅঞ্চলে আমাদের কাজ করেন – তাহলে একটা মাসমাইনে দেব ......।” কুলেন্দ্রর যেন বিশ্বাসের স্ত্রীকে অপরিচিত ঠেকে – কেন জানিনা তার রীণার কথা আবার মনে পড়ে – রীণা তো এরকম স্বার্থপর নয়, না স্বার্থ কী বস্তু রীণা বুঝেই না। সেই তূল্যমূল্য বিচারে সে ব্যস্ত হয়ে পড়ে – ওরা কী কথা বলছে তার কর্ণগোচর হয় না। হঠাৎ বাইরে রাস্তায় অনেক লোকের হৈ-হট্টগোল ও চিৎকারের আওয়াজ শুনে সে দৌড়ে বেরিয়ে দেখে, পাগলা শংকর লাঠি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চিৎকার করে বলছে  “কত লোক মারিয়াছি এই খাণ্ডা দিয়া, আপনি মরিব আজি দেখ দাড়াইয়া”, আর সবাই তাকে জাপটে ধরে বেঁধে ফেলার চেষ্টা করছে। শংকরকে আগে কখনও এরকম উত্তেজিত ও আক্রমণাত্মক হতে দেখেনি। কুলেন্দ্র তাড়াতাড়ি সবাইকে জোর করে সরিয়ে দিতেই, শংকরের লাঠির আঘাত তার কাঁধ ও মাথায় এসে পড়ে। কুলেন্দ্র মাটিতে লুটিয়ে পড়ে, চেতনা হারাতে হারেতে সে শংকরের কান্নার আওয়াজ শুনতে পায়। চেতন থেকে অচেতনের যাত্রায় পরিচিত – অপরিচিতের ব্যবধান ধীরে ধীরে কুলেন্দ্রর মস্তিষ্কে ধোঁয়াটে হয়ে আসে।         

হেমাঙ্গ বিশ্বাস স্মরণে

Posted by স্বাভিমান Labels: ,

অরূপ বৈশ্য

(বরাক কণ্ঠের জন্য) 
হেমাঙ্গ বিশ্বাসের সৃষ্টি আমাদেরকে একটা উত্তাল সময়কে স্মরণ করিয়ে দেয়। কিন্তু সেই সময়ের আবেগ কী এখনো আমাদের মনকে নাড়া দেয়? আবেগ কাল-নির্ভর, আবার কাল নিরন্তর প্রবহমান। তাহলে একই আবেগ কী বারবার ফিরে ফিরে আসে? তাই যদি সত্যি হয়, তাহলে কালের আমরা পর্বভাগ করব কী করে, প্রতিটি সময়ের পরিধিকে আমরা আলাদা করে চিনব কী করে? অথচ হেমাঙ্গ বিশ্বাসের মত সংগঠক-শিল্পী উত্থানোন্মুখ সমাজ-পরিবর্তনকামী শ্রেণির অফুরন্ত গতিশীলতায় সৃষ্ট প্রাণশক্তিকেই ধারণ করেছেন তাঁর সৃষ্টিশীল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে। তাঁর সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সূচনা সেই সময়ে যখন ভারতীয় বুর্জোয়া শ্রেণির প্রগতিশীল ভূমিকা নিঃশেষিত হয়ে প্রতিক্রিয়াশীল ভূমিকা প্রাধান্যের জায়গায়, যখন এই শ্রেণিটির দেশীয় গ্রামীণ সামন্তশ্রেণির সাথে গাঁটছাড়া বেঁধে তাদের উপনিবেশিক প্রভুদের সাথে আপস রফা চূড়ান্ত, যখন চূড়ান্ত স্বাধীনতা অর্জনের জন্য চিনে শ্রমিক-কৃষকের নেতৃত্বাধীন নতুন শক্তি উদিত, যখন একের পর এক কৃষক বিদ্রোহে ভারতের মাটিতে পোঁতা লাল-পতাকা আকাশে উড্ডীন।
সেই সময়ের সৃষ্ট এবং সেই সময়কে বদলে দেওয়ার অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত একজন শিল্পী কালজয়ী হয়ে যাওয়ার নিদর্শন হচ্ছেন আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় হেমাঙ্গ বিশ্বাস। কিন্তু আমাদেরই এই সুরমা-বরাক উপত্যকার সন্তান শহিদ মাধব নাথের স্মৃতিতে গাওয়া হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গান ‘আমরা তো ভুলি নাই শহিদ, সেকথা কি ভুলা যায়......” কি সত্যিই আমাদের এখনও আবেগতাড়িত করে? করে না, করার কথা নয় – কারুর কাছে এটা স্মৃতিমেদুরতা – কারু কাছে বিশেষ করে নব্য প্রজন্মের কাছে যোগসূত্রহীন। সেজন্যই সম্ভবত আমাদের এই সুরমা-বরাক অঞ্চলের একজন মহান সংগ্রামী শিল্পীর জন্মশতবর্ষেও আমরা বেশ নির্লিপ্ত। এঅঞ্চলের বোদ্ধারা তাদের ঘরের এই মহান মানুষকে নিয়েও যে বিশেষ কোন চর্চা করার, তার জীবন ও সৃষ্টির ডকুমেন্টশন করার ব্যপারে কোন উৎসাহ দেখান না, তার রহস্য লুকিয়ে রয়েছে সম্ভবত শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গীর মধ্যে। হেমাঙ্গ বিশ্বাস যে আবেগকে সাধারণীকৃত ও আধুনিক প্রগতিশীল মননে পরিশীলিত করতে পেরেছিলেন তা আজকের এই পরজীবী মনস্কতায় আচ্ছন্ন মধ্যশ্রেণির সাথে যোগসূত্র স্থাপনের আবেগ নয়, এটা এমন এক আবেগ যা জাগ্রত লোকায়ত আবেগকে সাধারণীকৃত করে এবং আধুনিক সমাজ দেখতে আগ্রহী মধ্যবিত্ত মনকেও তার গণ্ডির মধ্যে আকৃষ্ট করে নিতে সক্ষম হয়। তাই এই আবেগ ফিরে ফিরে ভেসে আসে প্রবহমান কালের স্রোতকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে এবং মানুষ এই আবেগ-স্নাত হয় যখন তার মনে জয়ের আকাঙ্খা, পরিবর্তনের আকাঙ্খা, নতুনের আকাঙ্খা সঞ্চারিত হয়। পরাজয়ের গ্লানি ও সামগ্রিক হতাশার বাতাবরণেও কালজয়ী আবেগ মানুষের মন জয় করে নিতে পারে, কিন্তু সে এক ভিন্ন ধরনের আবেগ, এক ভিন্ন শ্রেণির – ভিন্ন পরিস্থিতির আবেগ যেখানে আলস্য - কর্মবিমুখতা – অসন্তুষ্টি আধুনিক বুর্জোয়া মনকে গ্রাস করে নেয়। কিন্তু যে পরিস্থিতিতে মানুষ আত্মসন্তুষ্ট, ন্যায়-অন্যায় ভেদ ভুলে সাফল্য – আয়েস – স্থবিরতাকেই জীবনের লক্ষ্য হিসেবে জ্ঞান করতে শিখে সেই বাস্তব পরিস্থিতিতে কালজয়ী সৃষ্টির আবেগ চোরাস্রোতে বয়ে চলে, মানুষের আবেগে ধরা দেয় না। কালকে আমরা যদি এরকম বাস্তব পরিস্থিতির গুণাবলি দিয়ে ভাগ করি তাহলে কালজয়ী সৃষ্টি আমরা তাকেই বলতে পারি যা সময়ের এক বিশেষ মূহূর্তে নতুন রূপে নতুন বার্তা নিয়ে ফিরে ফিরে আসে।

                     যারা শ্রমিক-শ্রেণির নেতৃত্বাধীন এক নতুন সভ্যতা গড়ার কল্পনা করেন, তারা রাষ্ট্র-উৎপাদন পদ্ধতি-বিনিময় মূল্যকে যেমনি অন্য বিকল্প দিয়ে প্রতিস্থাপিত করার রূপরেখা তৈরি করার কথা ভাবেন, ঠিক তেমনি সভ্যতার অবিভাজ্য অঙ্গ কলা-সংস্কৃতি চর্চার বিকল্প রূপরেখা তৈরির দায়ও তাদের উপর বর্তায়। তাদের কাছে হেমাঙ্গ বিশ্বাস চর্চা ভীষণ জরুরি বিশেষ কর সেই যুগ-সময়ের সন্ধিক্ষণে যখন জয়ের আকাঙ্খা, পরিবর্তনের আকাঙ্খা, নতুনের আকাঙ্খা সঞ্চারিত করার সামাজিক শক্তির আবারও ঘুম থেকে জেগে ওঠার বার্তা আকাশে-বাতাসে ভেসে বেরায়। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের মত সংগঠক-শিল্পীর সৃষ্টি আবার ফিরে আসবে, কিন্তু সচেতনভাবে ফিরিয়ে আনতে হবে নতুন রূপে, নতুন উপলব্ধিতে, নতুন সভ্যতার প্রয়োজনে। সেজন্যই হেমাঙ্গ বিশ্বাসের কর্মকাণ্ড নিয়ে চর্চা এতো জরুরি। এই পরিপ্রেক্ষিতে সলিল চৌধুরী-হেমাঙ্গ বিশ্বাস বিতর্ক নিয়ে কিছু কথা বলা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।

                   হেমাঙ্গ বিশ্বাসের জন্ম শতবর্ষে তারা মিউজিক চ্যানেলে আজ সকালের আমন্ত্রণের অতিথি শিল্পী শুভ প্রসাদ নন্দী মজুমদারের অনুষ্ঠানে শুভেন্দু মাইতী বলেন, হেমাঙ্গ বিশ্বাস যে অহং-বর্জিত একজন বড়মাপের মানুষ তার প্রমাণ মেলে সলিল চৌধুরীর সংস্কৃতি-সংক্রান্ত মতকে মেনে নেওয়ার মধ্য দিয়ে। দুটি ভিন্ন মতের বিতর্কে অন্যের মতের সাথে একমত হয়ে গেলে নিজের মত ত্যাগ করে তার মান্যতা দেওয়ার মধ্যে নিশ্চয়ই নিরহংকারী ব্যক্তিত্বের পরিচয় পাওয়া যায়, কিন্তু হেমাঙ্গ বিশ্বাসের মতো সাধারণ মানুষের কাছের শিল্পীর এই তথ্য থেকে তাঁর নিরহংকারী ব্যক্তিত্বের পরিচয় পাওয়া খুব জরুরি বিষয় নয়, যা আমাদের কাছে জানা বেশি জরুরি তা হল সেই বিতর্কের মোদ্দা কথা এবং সলিল চৌধুরীর মতকে মেনে নেওয়ার সঠিকতার বিষয়। এই বিতর্কের কোন লিখিত ডকুমেণ্ট পাঠের সুযোগ না হওয়া সত্বেও, বিভিন্ন আলোচনা থেকে এই বিতর্কের সারকথা বিধৃত করা যায়। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের মত ছিল এই যে লোকায়ত জীবন থেকে রূপ-বিষয়কে নিয়ে গান রচনা করে লোকায়ত মানুষকে ভবিষ্যত সমাজের জন্য লড়াইয়ে উদ্দীপ্ত করা, অন্যদিকে সলিল চৌধুরীর মত ছিল আধুনিক সমাজ গড়ার লক্ষ্যে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে আধুনিক বিষয়কে নতুন রচনায় লোকায়েতের সাথে সমন্বিত করতে হবে।

                    এক সঠিক মত থেকে শুরু করে বিতর্ককে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে সলিল চোধুরীর মতকে গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে হেমাঙ্গ বিশ্বাস নতুন সমাজ গড়ার প্রাণশক্তি স্তিমিত হয় আসার সেই সময়ের অন্তর্বস্তুকে মেনে নিয়েছেন। সেজন্যই হেমাঙ্গ বিশ্বাসরা আসামের সমাজ জীবনে অন্তর্নিহিত উগ্রজাতিয়তাবাদী মূল্যবোধ ও উত্থানোন্মুখ উগ্রজাতিয়তাবাদকে যথাযথ গুরুত্ব আরোপ করতে পারেননি এবং সেই শক্তির কাছে প্রগতিশীল শক্তির পরাজয়কে অসহায়ের মত মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন। এই বাস্তবস্তাকে এবার খানিকটা ব্যাখ্যা করা যাক।

          
      যখন কোন সমাজ আন্দোলিত হয় - যখন সমাজের প্রগতিশীল শ্রেণি-বর্ণ তাদের পুরোনো অবস্থা পরিবর্তনে সচল হয়ে উঠে, তখন পুরোনো-প্রতিক্রিয়াশীল ও নতুন-প্রগতিশীল মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির সংঘাত সমাজের অভ্যন্তরেই চলমান সংগ্রামের রূপে দেখা দেয়। এই সংঘাতে নতুনের বিজয় ঘটবে কিনা বা যদি বিজয় ঘটে তাহলে পরিবর্তিত সমাজের সংস্কৃতি চর্চার রূপ কী হবে বা হওয়া উচিত তা কিন্তু নির্ধারিত হবে সেই সমাজের অভ্যন্তরেই এবং তা বহন করবে সেই গণ-সমাজই। শিল্পসংস্কৃতি-সংগঠক এবং শিল্পের স্রষ্টাও কিন্তু এই জেগে ওঠা সমাজেরই অঙ্গ। সুতরাং শিল্পীর সৃষ্টি মানুষের অবচেতনে থাকা নতুনের বার্তাকে বহন করবে গণ-সমাজের সচেতন হয়ে ওঠার সংগ্রামী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। এ এক বিচিত্র পথে বহুমুখী আন্তঃক্রিয়া যেখানে বিভিন্ন মত-পথ শুধু নয়, পুরোনোকে ভাঙার রস আস্বাদনে উত্থিত বিভিন্ন শ্রেণি-বর্ণের মূল্যবোধেরও এক অন্ত ও আন্তঃক্রিয়া। সুতরাং প্রগতিশীল শিল্পী যদি আধুনিক বা নতুন অন্তর্বস্তু সংগ্রামের স্থান-কালের সীমার বাইরে থেকে বহন করে এনে লোকায়ত চর্চার সাথে জুড়ে দিতে চান তাহলে তা আপাত আধুনিক মনে হতে পারে, কিন্তু গণ-সমাজ তাদের সংগ্রামের বর্ষাফলক যার দিকে তাক করার কথা তাকে চিনতে ভুল করবে এবং ফলে এই সংগ্রামের মধ্য থেকে সৃষ্ট শিল্প-রচনাকেও তার জীবনের অঙ্গ করে নিতে বিফল হবে।

                     আসামের উদাহরণ এব্যাপারে আমাদেরকে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দিতে পারে। আসামে কৃষক অভ্যুত্থানের সাথে সামঞ্জস্য রেখে চীনের শ্রমিক-কৃষকের লড়াই থেকে, আমেরিকার শ্রমিকদের লড়াই থেকে দিন-বদলের কথা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সংযোজিত করা হল, কিন্তু আসামের এই সংগ্রামী কৃষকদের অবচেতনে থাকা উগ্রজাতিয়তাবাদ বিরোধিতাকে (লোকায়ত স্তরে থাকা উগ্রজাতিয়তাবাদী আবছা রূপের বিরোধিতা) কোন ভাষা দেওয়ার প্রচেষ্টা হল না, আমেরিকার গণসঙ্গীত ‘নিগারদের’ চিনল – কিন্তু এখানে চা-শ্রমিক ঝাড়খণ্ডী-আদিবাসীদের জীবন সংগ্রাম নিয়ে তেমন কোন রচনা হল না এবং ফলে গণ-সমাজকে তাদের সংগ্রামের সমস্ত অন্তর্বস্তুকে জলাঞ্জলি দিয়ে আশ্রয় নিতে হল উগ্রজাতিয়তাবাদী শিবিরের কাছেই।

             হেমাঙ্গ বিশ্বাসই তখনকার সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম ব্যক্তিত্ব যিনি সঠিক পথটি চিনতে পেরেছিলেন, কিন্তু এই পথে আরও বহুদূর অগ্রসর হয়ে সঠিক চিন্তাকে সম্প্রসারিত ও সার-সংকলিত করার বিপরীতে তখনকার সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মূল ধারার চিন্তায় প্রভাবিত হয়ে গিয়েছিলেন। সে সময়ের সংগ্রামী উত্তাপ এবং চোখের সামনে থাকা মডেলকে অনুসরণ করার আবহ সম্ভবত বিকল্প চিন্তার পথ রুদ্ধ করে দাঁড়িয়েছিল। এই রুদ্ধদ্বার আমাদের সামনে আজ নেই, অথচ শীতের ভোরে সংগ্রামের উত্তাপ নেওয়ার সূর্য বহুদূরে উঁকিঝুঁকি মারছে, তাই এখনই সময় নতুন করে – নতুন ভাবে দিন-বদলের গান বাঁধার উদ্যোগ নেওয়ার এবং সেই কাজটি সবচে ভাল হতে পারে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের কর্মকাণ্ডের চর্চার মধ্য দিয়েই।  

বিশেষ অধিকার (অনু গল্প)

Posted by স্বাভিমান Labels: ,



           আকাশে মেঘ জমেছে, পথ নিরিবিলি; সব চুপ; সন্ধ্যা পেরিয়ে রাতের পহর। পথের মোড়ে একটি বাড়ির নিচের ঘরে জানালায় আলো জ্বলছে; কাছে এসে চোখ তুলে তাকাতেই জানালা বুজে গেল। বন্ধুদের আড্ডায় এভাবেই বলতে শুরু করল সুমিত। বন্ধুদের মধ্যে অনেকেই এই গূঢ় পদ্য-মুহুর্তের সূচনায় হতাশ হল, কেউ আবার হাটের রচনার কোন লঘু পর্ণ-মুহুর্ত কল্পনা করে উৎসুখ হয়ে উঠল। সবাই যখন ভাবছে সুমিত এবার বন্ধ জানালার ভেতরে প্রবেশ করবে, সুমিত কিন্তু তার বাচনে এক রহস্যের বুনোট বুনতে লাগল। সুমিত বলতে লাগল, সত্যি এ এক ভয়ঙ্কর মুহুর্ত। উপরে ঘনকালো মেঘলা আকাশের গাড় অন্ধকার ও নিচে রাস্তার দু’পাশে মিউনিসিপালটির নিয়নের বাতির স্নিগ্ধ আলো – উলম্ব এই স্পেসের মাঝখানে আমি তেতলা বাড়ির ছাদের আবছায়ায় দাঁড়িয়ে। হঠাৎ প্রচণ্ড কর্কশ শব্দে আকাশ আলোয় ঝলসে উঠল, একই সাথে নিভে গেল নিয়নের বাতি। ক্ষণিকের এই বৈপরিত্যের ঘোর কাটতে না কাটতেই চরাচর ঘন আঁধারে ডুবে গেল, রাতের পাহাড়ে এক গভীর গুহার মধ্যে একা বাসের অনুভূতিতে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। আমি ফিরে গেলাম ঘরে।

             আমি প্রতিরাতে একটা নির্দ্দিষ্ট সময়ে এই ছাদে এসে দাঁড়িয়ে থাকতাম। যে এলাকায় আমি ভাড়াঘরে থাকতাম সেই এলাকায় ক্রমশ ঢাল বেয়ে নিচের দিকে নেমে যাওয়া রাস্তার দু’পাশে সারিবদ্ধ দু-তিনতলার বাড়ি, পাহাড়ের শৃঙ্খলা মেনে রাস্তাটি যখন আবার উপর দিকে উঠে গেছে তখন অন্তত নাম-ঠিকানায় আরেকটি এলাকা শুরু। রিসার্চ স্কলার হিসেবে একটি প্রজেক্ট নিয়ে এই পাহাড়ি রাজ্যে আমাকে যেতে হয়। ক্রমশ এই পাহাড়ি রাজ্যের মোহনীয় প্রাকৃতিক শোভা ও সহজ সরল মানুষদের প্রতি আমি এক অমোঘ আকর্ষণ অনুভব করতে থাকি, বিশেষ করে আমার বাড়ির রাস্তার বিপরীত বাড়ির তেতলার জানালার পাশে টেবিল ল্যাম্পের আলোয় যে মেয়েটি গভীর রাত অবধি বসে থাকত সেই মেয়েটির প্রতি। ময়নামতির পথের ধারে পটলচেরা কাজলনয়নী যেমন কবিকে আকর্ষিত করে, এই পাহাড়ি ঢালু পথের ধারে লঙ্কাচেরা চোখের মুখাবয়বের রূপ-লাবণ্য আমাকে অনুরূপভাবে আকর্ষিত করতে থাকে। ঢালু পথের বাঁকে আমি কতবার তার সামনাসামনি হয়েছি, কিন্তু কথা বলার সাহস জোটাতে পারিনি। এটা শুধু একারণেই নয় যে, আমি মুখচোরা প্রকৃতির ছেলে ছিলাম বলে। বরঞ্চ কথা বলার সাহস জোটাতে না পারার মুখ্য কারণ ছিল যে, পাড়ার মোড়ে বা রাস্তায় মোটরবাইকে যে উঠতি ছেলেছোকরারা ঘুরে বেড়াত তারা জানত আমি মায়াং অর্থাৎ বিদেশি। মায়াং হয়ে কথা বলার প্রচেষ্টার অন্য অর্থ দাঁড়িয়ে যাওয়ার বিপদকে অবজ্ঞা করার সাহস আমার ছিল না।

              সেদিন সকাল থেকেই আকাশ মেঘাচ্ছন্ন ছিল। মাঝে মাঝেই দূরে পূব-আকাশের পাহাড়ের আড়াল থেকে উঁকি মেরে রোশনাই ছড়িয়ে সূর্য ঘন মেঘের আড়ালে চলে যাচ্ছিল। সকাল দিকে দু’এক পশলা বৃষ্টির ফলে পাহাড়ি ঢালু পথের কালো চিকচিকে স্যাঁতস্যাঁতে কিন্তু মনমাতানো রূপ বেরিয়ে পড়েছিল, যেন পাহাড়ের গা বেয়ে মাথায় বোঝা নিয়ে নামতে থাকা কোন সাঁওতালি-মুণ্ডারি আদিবাসী রমণীর ঘর্মাক্ত গাল।

              পাহাড়ি রাজ্যের মেঘলা সকালের এই আমেজের সুর কেটে দেয় বাতাসে ভেসে আসা এক তীব্র কলরব। জানালা দিয়ে রাস্তায় উঁকি মেরে দেখি এক বড়সড় মিছিল এই পথ দিয়ে এগিয়ে চলেছে। সামনের ব্যানারে কী লেখা রয়েছে তা ভাষা না জানার জন্য পড়তে পারিনি। কিন্তু একি, ব্যানারের এক প্রান্ত ধরে রয়েছে আমার উলটো দিকের বাড়ির সেই মেয়েটি। পেন্টে পা-ঢুকিয়ে, জামা গায়ে গলিয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়ি। দৌড়ে এগিয়ে গিয়ে ব্যানারের কিছু পেছনে মিছিলে ঢুকে পড়ি। দৌড়তে গিয়ে হাঁফিয়ে গিয়েছিলাম। কিছুটা ধাতস্ত হওয়ার আগেই দেখি সামনে বিশাল পুলিশ ব্যারিকেড, ঘাবড়ে গিয়ে যতটা সম্ভব সবার অলক্ষ্যে মিছিলের পেছন দিকে চলে আসি। পুলিশ মিছিলকে রাজভবনের দিকে যেতে দেবে না, কিন্তু মিছিলের নেতৃত্ব নাছোড়বান্দা। সেই মেয়েটিও যে সেই নেতৃত্বের একজন তা বুঝতে আমার অসুবিধে হয়নি। আচমকা মিছিলকারীদের উপর পুলিশের বেধড়ক লাঠির ঘা যথেচ্ছভাবে আছড়ে পড়তে লাগল। সেই মেয়েটির জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেও ঘটনার আকস্মিকতার রেশ কাটতেই আমার বাস্তববোধ জাগ্রত হয়ে উঠল। আমার রিসার্চের এমন রসদ হাতছাড়া করা যায় না। পকেট থেকে হাতের মুঠোর সাইজের স্লিম ডিজিট্যাল ক্যামেরা বের করে ছবি তুলতে লাগলাম। সরকারি তথ্যপাতি সংগ্রহের উদ্দেশ্যে সারাদিন অফিসে অফিসে দৌড়ঝাপ করে বেশকিছু অ্যাপয়েন্টমেন্ট জোগাড় করলাম। এভাবে ঘুরতে ঘুরতে বেলা কখন ঢলে পড়ে আবছা অন্ধকার ছেয়ে গেছে তা ঠাহর করতে পারিনি। রাতের খানা হোটেলেই সেরে নিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ালাম।

             বাড়ির সামনে এসে উপরের দিকে তাকাতেই জানালা বন্ধ হয়ে গেল, নিভে গেল আলো। যথারীতি সিগেরেটে আগুন ধরিয়ে ছাদে গিয়ে দাঁড়ালাম, জানালা বন্ধ রইল – ভেতরে অন্ধকার থাকায় কিছুই দেখার জোঁ ছিল না। ভগ্নমনোরথ হয়ে ঘরে এসে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। ভোরের দিকে তীব্র চিৎকার, গাড়ির ইঞ্জিনের ঘরঘর আওয়াজ, হৈ-হুল্লোড়ে আমার ঘুম ভেঙে গেল। সামনের রাস্তায় সেই মেয়েটির বাড়ির সামনে বিরাট জটলা। নিচে নেমে গিয়ে দেখি পুলিশ-মিলিটারিতে সমস্ত পাড়া ছয়লাপ। পুলিশের গাড়ির সাথে একটি অ্যাম্বুলেন্সও দাড়িয়ে আছে। ধীরে ধীরে বাড়ির কাছে যেতেই দেখি ক’জন লোক কাঁধে ও পায়ে ধরাধরি করে মুখ ছাড়া বাকি অংশ চাদরে মোড়ে একটি দেহ সিঁড়ি দিয়ে নামিয়ে আনছে। মুখের দিকে চোখ পড়তেই আঁতকে উঠি, মুখাবয়বে সর্বত্র বাহিনীর বিশেষ অধিকার প্রয়োগের ছাপ জ্বলজ্বল করছে। তৎক্ষণাৎ আমার মোবাইল ফোন বেজে উঠে। মবাইলের স্কিনে লেখা গাইড-স্যার। কোনমতে বলি, “স্যার, অমার রিসার্চের কাজ সবে শুরু”। মোবাইলের স্যুইচ অফ করে দিই। ছাদে যাওয়ার আগে রাস্তা থেকে উপরের দিকে তাকানো এবং জানালা বন্ধ হয়ে যাওয়া – সময়ের এই অদ্ভূত সংযোগ যদি না ঘটত তাহলে পরিস্থিতির কি কোন ইতরবিশেষ ফারাক ঘটত? – এই প্রশ্ন আমাকে আজকের ব্যস্তসমস্ত নাগরিক জীবনের অবসরেও তাড়া করে বেড়ায়।

(c) Picture:ছবি

ডার্করুমে আজাদ

Posted by স্বাভিমান Labels: , ,

(হঠাৎ মনে উদয় হল – তাই এই অনুগল্পটি লিখে ফেললাম)
            তখন কত আর বয়স হবে তার। বছর দেড়েক হল ম্যাট্রিক পাশ করেছে। অসমীয়া মাধ্যমে পড়েছে সে, বাড়িতে বাংলা বললেও নিজেকে অসমীয়া-মুসলিম বলেই জানে বরপেটার ভানুবিলের আজাদ। নিরীহ গোবেচারা প্রকৃতির ছেলে। সেবার যখন সন্ত্রাসী আক্রমণে তার গ্রাম জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যায়, গ্রামের অন্য সমবয়সীদের সাথে সে প্রতিরোধে সামিল হতে পারেনি। তার সমবয়সীরা তাকে কাপুরুষ-মেয়েলি স্বভাবের বলে অবজ্ঞা করত। সেবার তারা সপরিবারে আশ্রয় নেয় রিফিউজি ক্যাম্পে। তাকেও রোজগারের সন্ধানে নেমে পড়েতে হয়। ভাল রোজগারের সন্ধান পেয়ে দুই বন্ধু পাড়ি দেয় মুম্বাই শহরে। উপেন বড়ো তার স্কুলের সহপাঠী এবং দুজনে গলায় গলায় ভাব।
          মুম্বাইয়ে এক ডিজাইনার কোম্পানীর ওয়ার্কশপের ডার্করুমে দুজনে একসাথে কাজ করে। কিন্তু অর্থ রোজগারের যে আশায় দুই বন্ধু মুম্বাই পাড়ি দিয়েছিল তা এখনও পূরণ হয়নি – এই চাকরিতে নিজের খাওয়া-দাওয়ার খরচ শেষে বিশেষ সঞ্চয় করা যায় না। তাই অন্য ভাল কাজের সন্ধানে রয়েছে তারা।
যে মেসে তারা থাকে সেখানে টিভি দেখার বন্দোবস্ত করে দিয়েছে বাড়ি-মালিক। সেদিন রাতের খাওয়া-দাওয়া সেরে টিভির পর্দায় দুজনে চোখ রাখে। গুরদোয়ারায় আমেরিকান যুবকের সশস্ত্র আক্রমণের খবর উপেন খুব মনযোগ দিয়ে শুনে, কিন্তু আজাদ এই খবর শুনতে চায় না। তার গ্রাম আক্রমণের দুঃস্বপ্ন সে ভুলে থাকতে চায়।
           পরদিন যথারীতি কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে দুজনেই। দারোয়ান এসে খবর দেয় আজাদের একটা ফোন এসেছে। ফোন ধরতে চলে যায় আজাদ। কিছুক্ষণ পর আজাদ ফিরে আসে। অন্ধকারে উপেন তার শক্ত চোয়াল ও উদভ্রান্ত চেহারা দেখতে পায়নি। উপেন ফোনের খবর জানতে চাইলে, টেবিলে রাখা ছুরি তুলে নিয়ে সজোরে উপেনের বুকে বসিয়ে দেয় আজাদ উপেন মাটিতে লুটিয়ে পড়ে, আজাদও দেখতে পায়নি তার প্রিয় বন্ধুর প্রাণহীন মুখ। আজাদ রক্তরাঙা ছুরি উঁচিয়ে ধরে ডার্করুম ছেড়ে বেরিয়ে আসে। ভাবলেশহীন আজাদকে এভাবে দেখতে পেয়ে আশপাশের সবাই তাকে ধরে ফেলে, কিন্তু সে যেন কিছুই বুঝতে পারছে না – শারীরিক যন্ত্রণার গোঙানির সাথে মিশে ‘আমি কাপুরুষ নই’ কথাটি তার গলা থেকে বেরিয়ে আসছে। পুলিশ এসে আজাদকে নিয়ে যায়। কথাবার্তা বলে পুলিশের মনে হয় সে মানসিক রোগী – চিকিৎসার জন্য তাকে আদালতের সুপারিশে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পুলিশ খবর নিয়ে জানতে পারে সেদিন আজাদের এক আত্মীয় তাকে রিফিউজি ক্যাম্প আক্রমণের খবর দিয়েছিল, যে আক্রমণে অনেকের সাথে তার পরিবারের সবাই নিহত হয়।
         কিছুদিন চিকিৎসার পর তার মানসিক ভারসাম্য ফিরে এলে তাকে সংশোধনাগারে পাঠানো হয়। আদালত থেকে জেলে পৌঁছতে পৌঁছতে মাগরিবের নামাজের সময় হয়ে যায়। জেল আঙিনার একপ্রান্তে মুসলিম কয়েদিরা সারিবদ্ধ হয়ে হাঁটুগেড়ে বসে পড়েছে। আজাদও তাদের সাথে যোগ দেয়। জীবনে এই প্রথমবারের মত নামাজের মর্মার্থ বোঝার চেষ্টা করে আজাদ।

গণতান্ত্রিক লেখক সংস্থার উদ্যোগে আলোচনা সভা ঃ বিষয় - "দিশেহারা সমকাল - সাহিত্যের ভূমিকা।"

Posted by স্বাভিমান Labels: ,



গুরুগম্ভীর আলোচনাকে অন্তরঙ্গ আলাপচারিতায় রূপান্তরিত করার জন্য সংযোজকের কঠিন দায়িত্ব বর্তায় দীপঙ্কর চন্দের উপর। আলোচনা সভার আহ্বায়ক স্নিগ্ধা নাথ উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন যে বরাকের সাম্প্রতিক ঘটনাবলীকে এক সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে দেখতে হবে এবং দৃষ্টিভঙ্গীর প্রশ্নকেই আলোচনার কেন্দ্রীয় বিষয় হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন। প্রথম নির্দ্দিষ্ট আলোচক সুবীর কর বরাকের সাম্প্রদায়িকতাকে ‘চক্রান্তের তত্ব’ দিয়ে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন এবং তার একটা দীর্ঘ বাস্তব ইতিহাসও তুলে ধরেন। ঘোষিত বিষয় এবং উদ্দেশ্য ব্যাখ্যার মধ্যে একটা সুক্ষ ফারাক ছিল। ফলে আলোচনাটা কোন খাতে যাবে তা নিয়ে বিভ্রান্তি দেখা দেয়। বিষয় যখন ‘দিশেহারা সমকাল’ – তখন সময়টাকে চেনা-বোঝা এবং তার থেকে উত্তরণের দিশা নিয়ে আলোচনাকে কেন্দ্রীভূত করলে আলোচনাকে অনেক গভীরে নিয়ে যাওয়া যেত – শ্রোতার আসনে নতুন প্রজন্মের অংশগ্রহণ সেই আগ্রহকে প্রকাশ করছিল। কিন্তু এর সাথে জুড়ে দেওয়া হয়েছে আরেকটি বিতর্কিত বড় বিষয় “সাহিত্যের ভূমিকা” এবং ফলে দুই খাতে আলোচনায় অনেক গুরুগম্ভীর কথা অনেক স্রোতধারায় এগিয়ে আসলেও একটা মোহনার দিকে অগ্রসর হচ্ছিল না। যেমন শান্তনু সরকার ও অমিতাভ দেব চৌধুরী সৃষ্টিশীল সাহিত্যের দিশা দেখানোর ব্যাপারে কোন বিশেষ ভূমিকা না থাকার পক্ষেই মত পোষণ করেন। এই তিন বক্তাই দিশেহারা সময়কে মধ্যশ্রেণির সমাজ বিচ্ছিন্নতার মাপদণ্ড দিয়ে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন, মধ্যশ্রেণির নেতৃত্বের প্রশ্ন নিয়ে সুবীর করের সাথে দ্বিমত পোষণ করেন শান্তনু। এই দুটো কথার যে কোন একটি থেকে আলোচনা ক্রমশ গভীরতার দিকে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ ছিল, কিন্তু আলোচনা এই দুটোর মধ্যে গাঁটছড়া বেঁধে একটা বিশৃঙ্খলার মধ্যে আটকে যায়। তথাপি আলোচনা ছিল অনেক উন্নত মানের এবং নতুন প্রজন্মের অংশগ্রহণ একটা নতুন মাত্রাও দিয়েছিল। শ্রোতাদের মধ্যে অনেকেই দেখার প্রশ্ন – 
 দর্শনের প্রশ্নকে গুরুত্ব আরোপ করেন – কিন্ত এই প্রশ্নকে মতাদর্শের সাথে গুলিয়ে ফেলে আলোচনাকে তার গণ্ডী অতিক্রম করতে দেওয়া হয়নি। ‘কিছু একটা প্রাপ্তি ঘটল’ - সেই মানসিকতা থেকে দেখলে এটা এক সফল আলোচনা – আবার কেউ বলতে পারেন দিশার সন্ধান করারও পথ পেলাম না। এই দিশার সন্ধানের প্রশ্ন নিয়েও খানিকটা বিতর্ক হয়েছে। অনেকের বক্তব্য থেকে একথাও বেরিয়ে এসেছে যে দিশার সন্ধান করাটাও নাকি সাহিত্যের ক্ষেত্রে হুকুম জারি করা। বিভিন্ন অবস্থান থেকে বিভিন্ন জন বাস্তবকে বিভিন্নভাবে দেখে – সিদ্ধার্থের তাত্বিক বক্তব্যের এই সারকে স্বীকার করেও একথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে দেখারও বিভিন্ন পদ্ধতি থাকা সত্বেও সব পদ্ধতি নিশ্চয়ই একই সাথে শুদ্ধ বা সত্য জানার গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি হতে পারে না – এই পদ্ধতিগুলোর নামই ভাববাদ – বস্তুবাদ – দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ। এই পদ্ধতি আয়ত্ব করার পদ্ধতিও আসলে এই ভিন্ন ভিন্নভাবে দেখা বাস্তবের মধ্যে আন্তঃক্রিয়া ও মত বিনিময় এবং প্র্যাকটিস থেকে গড়ে উঠে। ‘দিশেহারা সমকাল’ ও ‘সাহিত্যের ভূমিকা’ এই দুটি বিষয়ের আলোচনা হতে পারত বাস্তব নিয়ে চর্চা থেকে। একটি ভাল সাহিত্য যেমন গ্রাম সমাজ নিয়ে হতে পারে, ঠিক তেমনি বুর্জোয়া সমাজ বা মধ্যবিত্ত শ্রেণি নিয়েও হতে পারে। যে দক্ষ সাহিত্যিক যত ভালভাবে তার সাহিত্য সৃষ্টির বিষয়কে সামগ্রিকতার অংশ হিসেবে দেখতে পারবে – তার সাহিত্যিই ততবেশী সৃষ্টিশীল হবে এবং তারজন্যই প্রয়োজন বাস্তবের চর্চা। অমিতাভ তথ্য-প্রযুক্তির বিপ্লবের ফলে মধ্যশ্রেণির বিচ্ছিন্নতার জন্য ‘ভার্চুয়্যাল ওয়ার্ল্ড’-এর ভূমিকার কথা তুললেও এনিয়ে আলোচনাকে গভীরে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা থেকে নিজেই বিরত থাকেন -– যুক্তি-প্রতিযুক্তির মাধ্যমে পরস্পর বিপরীত গ্রহণযোগ্য সূত্র প্রতিষ্ঠার অবৈজ্ঞানিক মতের প্রতি তার বিশ্বাসই (যা শক্তিপদ ব্রহ্মচারীর মত হিসেবে সেই মতের প্রতি তিনি আস্থা ব্যক্ত করেন) সম্ভবত এবিষয় নিয়ে বেশিদূর অগ্রসর হওয়া থেকে তাকে বিরত করে। নাহলে বাস্তবতার এই দিক নিয়ে আলোচনা করতে করতে আমরা হয়ত বৃহৎ পরিসরে যেতে পারতাম।
        বাস্তবতার বেশ কিছু দিক উন্মোচিত করে গ্রাম বরাকের ঐক্যের ঐতিহ্য নিয়ে দীর্ঘ বক্তব্য রাখেন তুষার কান্তি নাথ ও মুকব্বীর আলী। এখান থেকেও বাস্তব নিয়ে একটা আলোচনা শুরু হতে পারত – কিন্তু ততক্ষণে বেলা গড়িয়ে পড়েছে অনেক – আলোচনার সার সংকলন করতে ডাকা হল সঞ্জীব দাশকে যিনি সঠিকভাবেই বললেন আলোচনার বিষয়বস্তু জটিল – তাই চটজলদি কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় না এবং সাহিত্য সৃষ্টি যেহেতু হুকুম দিয়ে হয় না, তাই ভাষা আন্দোলন নিয়ে উপন্যাস কেন তৈরি হলনা এপ্রসঙ্গ অবান্তর। কিন্তু অশান্ত বাস্তবে আমার মত যারা অশান্ত চিত্তের অধিকারী – যারা এখনও যৌবনের উন্মাদনার স্বাদ নিতে উদগ্রীব – তাদের কাছে সম্ভবত মনে হয় সময়ের চাহিদার কাছে আমরা ক্রমশঃ পিছিয়ে পড়ছি। সময় অর্থাৎ বাস্তবকে জানা - বোঝার জন্য, আমাদের পারিপার্শ্বিককে চেনার জন্য আত্মতুষ্টির কোন স্থান থাকতে পারে না। বরাকের বুদ্ধিজীবী শ্রেণির এই আত্মতুষ্টিই আসলে এখানকার জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সাহিত্য চর্চার জগতকে করে রেখেছে পঙ্গু ও প্রাণহীন।    

স্বাভিমান:SWABHIMAN Headline Animator

^ Back to Top-উপরে ফিরে আসুন