নাট্য আন্দোলন – একটি ভাবনা /সংযোজন ঃ বিশ্ব নাট্য দিবস উপলক্ষ্যে কোরাস নাট্য সংস্থা অয়োজিত আড্ডা থেকে ফিরে এসে।

Posted by স্বাভিমান Labels: ,



                                                                      ।। অরূপ বৈশ্য।।
                            ( বিশ্বনাট্যদিবস উপলক্ষে লেখা প্রবন্ধটি অরুণোদয়ে বেরুবে)




রাক উপত্যকার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে এক বিশেষ স্থান জুড়ে রয়েছে নাট্যচর্চা। সামগ্রিক পরিস্থিতি ও সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে বরাকের নাট্যচর্চারও রয়েছে জোয়ারভাটা। বরাকের এই নাট্যচর্চা ও নাট্য আন্দোলনের বিষয় নিয়ে গভীর কোন বিশ্লেষণ বা পর্যায়ক্রমিক ইতিহাস রচনার কাজে কোন নাট্যকর্মী, গবেষক বা সমালোচক ব্রতী রয়েছেন বলে আমার জানা নেই। সমালোচকদের একাংশ বরাকের নাট্যচর্চাকে পশ্চিমবাংলা বিশেষ করে কলকাতার অনুকরণ হিসেবে অভিহিত করে কোন ধরনের বিশ্লেষণে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তাকে নাকচ করে দেন। অথচ কলকাতার নাট্যচর্চা বরাকের মত প্রত্যন্ত অঞ্চলের ক্ষুদে শহরের নাট্যচর্চাকেও যে প্রভাবিত করতে পেরেছে তারও একটা কার্যকারণ সম্পর্ক বিচার করে দেখা চাই। যারা অতীতের নাট্যমোদীদের নাটক দেখার উৎসাহকে অনুকরণের স্পৃহা বলে খারিজ করে দেন এবং যারা যা  কিছু বিদ্যমানতা নিয়েই বেঁচেবর্তে থাকতে চান তাদের দুদলই ভাবনার যান্ত্রিকতায় আবদ্ধ হয়ে যান। সব ঠিক আছেবা সবই ফাঁকি’ – এই দুয়ের টানাপোড়েনে নাট্য আন্দোলনেরনতুন রূপরেখা তৈরির প্রয়াস অনায়াসেই দিকভ্রষ্ট হয়। একথা অনস্বীকার্য যে বরাকের বিভিন্ন পর্যায়ের নাট্য আন্দোলনের জোয়ার মূলত শহরকেন্দ্রিক এবং সামগ্রিক পরিস্থিতি ও কলকাতার নাট্যচর্চার প্রভাবে প্রভাবিত থেকেছে। প্রাণের সাথে প্রাণ জুড়িয়ে নতুন প্রাণের সঞ্চার করতে পারেনি অর্থাৎ সময়ের তাগিদে যে নাটক ও নাট্যদর্শক তৈরি হয়েছিল তাকে বরাকের লোকজীবনের স্পর্শে রাঙাতে পারেনি। তথাপি ভাঁটার অন্তিম লগ্নেও বরাকের নাট্যজননীরপ্রাণশক্তি একেবারে ফুরিয়ে যায়নি, যদিও নাট্যচর্চার এই প্রাণশক্তিকে ভেন্টিলেটারেরউপর নির্ভর করে ধরে রাখতে হচ্ছে। কোন এক অলৌকিককারণে এই নাট্যজননীভেন্টিলেটার থেকে বেরিয়ে এসে আবারও অন্তঃসত্ত্বা হয়ে নতূন প্রাণের জন্ম দিতে সক্ষম হয়ে উঠতে পারে। সাধারণের কাছে এই  অলৌকিককারণটিই আসলে পরিস্থিতি, সময় ও উদ্যমের কার্যকারণগত সম্পর্ক।

                   সামগ্রিকভাবে নাট্যচর্চা এই নিবন্ধের বিষয় নয়, বরঞ্চ নাট্যচর্চা কখন নাট্য আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করেছে এবং সমাজে আলোড়ণ সৃষ্টি করতে পেরেছে সেটাই এখানে আলোচ্য বিষয়। আঠারো শতিকার ইউরোপের আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে প্রাণবন্ত নাট্যচর্চা থেকে উদ্ভূত রঙ্গমঞ্চকে এদেশে আমদানি করে বাংলাতে গিরিশচন্দ্র ঘোষের মত বাবুরা যে বিষয়গুলিকে সংযোজিত করে পেশাদারি নাটকের জন্ম দিয়েছিলেন তা কলোনিয়্যাল প্রভুদের উপযোগিতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। যখন সামাজিক পরিস্থিতি নিস্তরঙ্গ ও স্থিতিশীল, যখন ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রকদের আধিপত্য প্রশ্নাতীত, সেই সময়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী মননশীল নাটক দর্শকদের সামনে উপস্থাপিত করা কি সম্ভব? নাটক এমন এক শিল্পমাধ্যম যা নাট্য আন্দোলনরূপেই প্রতিভাত হয় এবং সমাজ পরিবর্তনের সহায়ক হয়ে উঠে। কারণ নাটক থেকে সমাজ ও সমাজ থেকে নাটক এই দ্বিবিধ ও বিপরীতমুখী প্রত্যক্ষ ও নিরন্তর যাত্রার সংঘাতময় পরিস্থিতিই এই শিল্পকর্মের মূল রহস্য। ফলে নাটক প্রায়শই সমাজবদ্ধ ও সেই সুবাদে রাজনীতির সামাজিকীকরণের সাথে যুক্ত হয়ে রাজনীতিবদ্ধ। অবশ্য নিস্তরঙ্গ আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতেও অন্তঃসলিলা ব্যতিক্রমী সৃষ্টিশীল নাট্যচর্চার কাজ নিরন্তর চলতে পারে এক সর্বব্যাপী নাট্য আন্দোলনের অপেক্ষায় সলতে পাকানোর কাজ হিসেবে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে ১৯২৯  সালে আমেরিকায় গ্রুপ থিয়েটারের জন্ম হওয়া এক ভিন্ন তাৎপর্য বহন করে। ১৯২৯ সাল শেয়ার বাজারের পতনের মাধ্যমে বিশ্ব পুঁজিবাদের মহামন্দার ঘোষণা। শ্রমিক ছাঁটাই, তীব্র বেকারত্ব, ক্ষুধা-অনাহার ও লাগামহীন সামাজিক অসাম্যের ফলে চারিদিকে সামাজিক অস্থিরতা। সংকটে জেরবার অর্থব্যবস্থা থেকে উদ্ভূত আগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদী রাজনীতি। একদিকে উত্থানোন্মুখ জার্মান ফ্যাসিবাদ ও যুদ্ধের জন্য অক্ষশক্তি-মিত্রশক্তির শিবির বিভাজনের প্রস্তুতি, অন্যদিকে ন্যায়-সাম্য-মুক্তির লক্ষ্যে ও ঐক্য-ভ্রাতৃত্ব-সহমর্মিতার ভিত্তিতে দেশ-জাতি-জনগণের সংগ্রামের প্রস্তুতি। এই প্রস্তুতির মুখে দাঁড়িয়েই আমেরিকাতে গ্রুপ থিয়েটার এবং ভারতবর্ষে গণনাট্য আন্দোলনের বিস্তার। সাম্রাজ্যবাদী অক্ষশক্তি ও মিত্রশক্তির দুই কেন্দ্র জার্মানী ও আমেরিকা এবং দেশ-জাতি-জনগণের সংগ্রামের মতাদর্শগত কেন্দ্র সবচাইতে প্রাগ্রসর ও প্রতিবাদমুখর আমেরিকান শ্রমিকশ্রেণি। এরজন্যই ব্ল্যাক থিয়েটারথেকে আরম্ভ করে বিভিন্ন ধরনের প্রাণবন্ত থিয়েটার প্রেক্টিসতখন গড়ে উঠে আমেরিকার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে। বাংলা তথা ভারতবর্ষের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশে এই নাট্য আন্দোলনে এক ভিন্ন মাত্রা যোগ হয়, যখন বাংলায় মঞ্চস্থ হয় বিজন ভট্টাচার্যের নবান্ননাটক। বিয়াল্লিশের মন্বন্তরের করুণ পরিণতির উপর ভিত্তি করে রচিত এই নাটক মধ্যবিত্ত মননে আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং শুরু হয় লোকসমাজের মধ্যে গিয়ে নাট্য  আন্দোলন গড়ে তোলার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত নাট্যকর্মীদের যাত্রা এই নাট্য আন্দোলনে লোকসংস্কৃতির বিভিন্ন কাঠামো ব্যবহার করার কিছুটা প্রচেষ্টা থাকলেও এবং বাংলার লোকসমাজের ও সমসাময়িক বিষয়বস্তু উঠে আসলেও আঙ্গিকের দিক থেকে গ্রুপ থিয়েটারেরআঙ্গিক থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি এবং এই নাট্য আন্দোলন মধ্যবিত্ত শিক্ষিত ভদ্দরলোক দৃষ্টিভঙ্গিরনিয়ন্ত্রনাধীন রয়ে যায় ইতিমধ্যে যুদ্ধ পরবর্তীতে শ্রম-পুঁজির নিউ ডিলেরমাধ্যমে সামাজিক স্থিতিশীলতার বাতাবরণ আমেরিকান শ্রমিক শ্রেণির নতুন সমাজ গড়ার লড়াকু মতাদর্শগত কোরপুঁজির সাথে সমঝোতার মাধ্যমে তার প্রাণশক্তি হারিয়ে ফেলতে শুরু করেছে এবং এর প্রভাব বাংলার গণনাট্য আন্দোলনেও পড়তে শুরু করেছে। উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনের জোয়ারে বাংলার নাট্য আন্দোলন যে নতুন সমাজ গড়ার এজেণ্ডাকে সামনে রেখেছিল তা ধীরে ধীরে সংস্কারমুখী প্রবণতায় পর্যবসিত হতে শুরু করে। যে সব কৃষক বিদ্রোহ স্বাধীনতার নামে ঔপনিবেশিক আপস মেনে নিতে অস্বীকার করেছিল এবং যার উপর ভিত্তি করে বামপন্থা টিঁকে থাকতে পারত সেগুলির মধ্যপন্থী সমাধান বামপন্থায় ভাঁটার টানের জন্ম দিল। আসলে শ্রমিক-কৃষকের প্রশ্নটি যে আমাদের মত দেশে ভাষা-জাতি-বর্ণের প্রশ্নের অধীন হয়ে রয়েছে এই সত্যটি বামপন্থীরা অনুধাবন করতে পারেননি। ফলে তথাকথিত স্বাধীনতা অর্জেনের মাধ্যমে শ্রমিক-কৃষক সমস্যার যে আপাত সমাধান বেরিয়ে আসল তাতে বামপন্থীরা আর নিজেদের বাম অস্তিত্ব বজায় রাখার জনভিত্তি খুঁজে পেলেন না। গণনাট্য কর্মীদের উপর যখন নেমে এল রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস তখন সাংস্কৃতিক আন্দোলনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কম্যুনিস্ট পার্টির সর্বভারতীয় নেতা পি সি যোশী সংস্কারমুখী কর্মসূচীর ভিত্তিতে নগরকেন্দ্রিক নাট্য চর্চার উপর গুরুত্ব দিলেন। প্রাণবন্ত-প্রাণচঞ্চল নাট্যচর্চার এই পর্যায়ে ভদ্দরলোকদেরগণ্ডি পেরিয়ে এক নতুন নাট্য ধারা যাকে সমাজ বহন করবে এরকম কোন নাট্য ধারার জন্ম দিতে ব্যর্থ হলো। এই ব্যর্থতা জন্ম দিল নাট্যচিন্তার বিভিন্ন মতবাদনিয়ে অবান্তর সব বিতর্ক আসলে এইসব বিতর্কের আড়ালে ছিল পরাজয়ের গ্লানি থেকে মুখ লুকোনোর প্রচেষ্টা। ৩০-৪০ দশকের অস্থির পরিস্থিতি যে নাট্য আন্দোলনের জন্ম দিয়েছিল সেখানে নাট্যচিন্তার বিভিন্ন মতবাদে বিশ্বাসীরা একযোগে নাট্যচর্চায় ব্রতী হতে বাধ্য হয়েছিলেন, কম্যুনিস্ট পার্টির সাংগঠনিক নিয়ন্ত্রনের প্রশ্নটি সেখানে ছিল অবান্তর। সমাজ পরিবর্তনের ভাসাভাসা এক মতাদর্শগত আবহের নিয়ন্ত্রনের প্রশ্নকে বিফলতার কারণ হিসেবে যারা বিবেচনা করেন তারা স্নানের জলের সাথে বাচ্চাটিকেছুঁড়ে ফেলার দুঃসাহস করেন। বরাক উপত্যকায় ঐ পর্যায়ে কীধরনের নাট্যচর্চা হয়েছিল তার কোনো লিখিত বয়ান আমাদের কাছে নেই এবং এব্যাপারে আমার কোন ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাও থাকার কথা নয়। কিন্তু একথা আমাদের মনে রাখতে হবে যে বাঙালি অধ্যুষিত বরাকভূমি পূববাংলারই সম্প্রসারিত অংশ এবং নবান্ননাটকের পর পূববাংলাতেই আইপিটিএর শাখা গড়ে ওঠে এবং তেভাগা-নানকার কৃষক বিদ্রোহ বর্তমান বরাক উপত্যকার বিস্তৃত অঞ্চলকেও প্রভাবিত করে।

                
              পরবর্তীতে দেশভাগজনিত ছিন্নমূল উদ্বাস্তুদের আবেগ, কৃষক বিদ্রোহ-শ্রমিক আন্দোলন, সাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি সমস্ত সমসাময়িক বিষয় উঠে আসে পঞ্চাশের দশকের পশ্চিমবাংলার নাট্যচর্চায়ও। কিন্তু গ্রুপ থিয়েটারের অঙ্গনে এই নাট্যচর্চাও বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্তের সীমানা অতিক্রম করে বৃহত্তর সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে পারল না। ফলে দিশাহীন বিতর্কে নিমজ্জিত হয়ে গ্রুপ থিয়েটারকে পর্যবসিত হতে হল বাজারশক্তির ক্রীড়নকে। কিন্তু ১৯৬৫ সালের কল্লোল নাটক জনমণ্ডলীর জনপ্রিয়তা ও জনসমর্থন লাভে সফল হলো। ঐ একই সময়ে ১৯৬৭ সালে শতাব্দী নাট্যগোষ্ঠী গঠন করে বাদল সরকার তৃতীয় নাট্য ধারার প্রয়োগে সচেষ্ট হন। তৃতীয় বিশ্বের বিষয়বস্তুর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি আঙ্গিক হাজির করার এক প্রয়াস নেন বাদল সরকার। গণআন্দোলনের পাশাপাশি নাট্য-আন্দোলনকেও যাতে সমাজ বহন করে নিয়ে যেতে পারে, সামাজিক আন্দোলনগুলিই যাতে মতাদর্শগত সংগ্রাম চালিয়ে যেতে নিজেরাই নাটক তৈরি করতে এবং সংগ্রামরত জনগণের সামনে পেশ করতে পারে অর্থাৎ নবউত্থিত জনসমাজের সাথে যাতে নাট্যচর্চা এক জৈবিক সম্পর্কে আবদ্ধ থাকে  সেই চিন্তা থেকেই সম্ভবত বাদল সরকার বিষয়বস্তু ও আঙ্গিকের এক সুসমঞ্জস্য কাঠামো তৈরি করার চেষ্টায় ব্রতী হন। কিন্তু এই ধারাও শুরুতে যে আশার আলো জাগিয়েছিল তা বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়। তথাপি গ্রামসমাজের বিষয়বস্তুকে শহরে তুলে এনে নগরকেন্দ্রিক এবং শিক্ষিত-ভদ্দরলোক নিয়ন্ত্রিত নাট্য ধারার সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে বাদল সরকারের এই প্রয়াস নাটকের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্ষেত্রে এক অগ্রগতি হিসেবেই বিবেচিত হয়। কিন্তু ষাটের দশকের টালমাটাল সময়ের টানে নাটকের যে জনপ্রিয়তা দেখা দিয়েছিল তাকে জনসমাজের নিজস্ব সাংস্কৃতিক চর্চার ধারা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা যায়নি।

                 ষাটের দশকের শেষে বিশ্ব-পুঁজিবাদ আবারও এক গভীর সংকটের পর্যায়ে প্রবেশ করে। এই পরিপ্রেক্ষিতে বাস্তুহারাদের পুনর্বাসনের অধিকারখাদ্য আন্দোলন ইত্যাদিকে হাতিয়ার করে বামপন্থীদের গ্রহণযোগ্যতার গ্রাফ পুনরায় উর্ধমুখী হতে শুরু করে। ইমার্জেন্সি বিরোধী জেপির আন্দোলনের আবহে বামপন্থী সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা যে বেঞ্চমার্ক অতিক্রম করে তার হদিস মেলে ১৯৭৭-এর নির্বাচনী ফলাফলে। বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসে এবং একইসাথে এও অভিযোগ উঠতে শুরু করে যে কম্যুনিস্ট পার্টি নাট্য আন্দোলনকে নির্বাচনে ব্যবহার করেছে এবং এনিয়ে বিতর্ক দানা বাঁধতে শুরু করে। এই অভিযোগ সত্যকিন্তু এহ বাহ্য। নির্বাচনী লড়াই যদি সামাজিক লড়াইয়ের একটি পর্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়তাহলে নাটকের মত শিল্পমাধ্যম তাতে ব্যবহৃত হলে কোন মহাভারত  অশুদ্ধ হয় না। যা নাট্য আন্দোলনকে অশুদ্ধ করে ও শুকিয়ে যেতে সাহায্য করে তা হল নির্বাচনপূর্ব সমাজপরিবর্তনের এজেণ্ডাকে নির্বাচন পরবর্তীতে ক্রমশঃ পরিহার করার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। নাট্য আন্দোলনকে যা ব্যাহত করে তা হলো বৃহত্তর সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনে একে অঙ্গীভূত করার পরিবর্তে মধ্যবিত্ত বাবু-ভদ্দরলোকদের’ প্রাণহীন গণ্ডিতে তাকে আবদ্ধ করা। এই পর্যায়ের নাট্য আন্দোলনে আবারও ৩০-৪০ দশকের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। ১৯৮০-এর উদার-অর্থনীতির অন্তর্গত কাঠামোগত পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার মধ্যে বামফ্রন্টের বাম-রাজনীতি ১৯৮২ সালে পুনরায় ক্ষমতায় আসার পর যেভাবে অঙ্গীভূত হয়ে যায়ঠিক সেভাবেই নাট্য-আন্দোলনও বাজারের চাহিদার বাইরে বেরিয়ে প্রাণশক্তি সঞ্চারিত করতে অপারগ হয়। এই দুই পর্যায়ই বিষয়বস্তু ও আঙ্গিকের এক জীবন্ত ঐক্যের ভিত্তিতে নতুন কোন স্বনিয়ন্ত্রিত ও সমাজ-নিয়ন্ত্রিত নাট্যধারার সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়।

                 ৩০-৪০ দশকের পূববাংলার এবং ষাটের দশকের পশ্চিমবাংলার নাট্যচিন্তার এই সীমাবদ্ধতার প্রভাবে বরাক উপত্যকার নাট্যচর্চাও প্রভাবিত ছিল। এই প্রভাব এখনও দৃঢ়ভাবে বিদ্যমান থাকায়ই বরাকের নাট্যচর্চা ভেন্টিলেটারের’ উপর নির্ভর করে বেঁচে আছে। কিন্তু আন্দোলনের ক্ষেত্রে এতগুলো ব্যর্থতা বরাকের মত প্রত্যন্ত অঞ্চলের নাট্যকর্মীদের সামনে এক নতূন সুযোগও এনে দিয়েছেবিশেষ করে এই কারণে যে আমাদের রয়েছে পূববাংলার মত ভাষিক অধিকারের প্রশ্নে জীবন্ত ও নিরন্তর গণকার্যকলাপের এক ঐতিহ্য সুতরাং এই ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নেওয়ার বৌদ্ধিক চর্চা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার প্রাণবন্ত প্রচেষ্টা যদি বরাকের নাট্যকর্মীরা অব্যাহত রাখে তাহলে এক নতুন সৃষ্টি উন্মাদনায় আবারও জেগে উঠার সুযোগ আমাদের সামনে আসছে। নাট্যচর্চার প্রাণশক্তি সঞ্চার করার জন্য বিষয়ীগত পরিস্থিতি আবারও অনুকূল হয়ে উঠছে। বিশ্বায়নের সম্মোহনী মায়া এখন মুহ্যমান – উদার আর্থিক নীতি আর্থ-রাজনৈতিক সংকটকে প্রতিনিয়ত ঘনীভূত করে চলেছে। পুনরায় শ্রমিকশ্রেণির জাগরণ আমেরিকার অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ আন্দোলনের রূপে উইসকনসিন প্রদেশে ব্যাপক ও জঙ্গি শ্রমিক ধর্মঘট সংগঠিত করে গোটা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ছে। আমাদের মত কৃষক প্রধান ও জাতি-বর্ণে বিভাজিত দেশের জনগণের লড়াইয়ের জন্য সবচাইতে প্রাগ্রসর শ্রমিক শেণির মতাদর্শগত কোর আবার জেগে উঠছে। বিশ্বব্যাপী এই শ্রমিক আন্দোলনের মধ্যে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের বিস্তারও আবার পরিলক্ষিত হচ্ছে। বেকারত্বঅসাম্যদারিদ্রঅনাহার-বুভুক্ষা আমাদের মত দেশের ঘুমন্ত শ্রমিক-কৃষককেও জাগিয়ে তুলছেআড়মোড়া ভেঙে ঘুম থেকে জেগে ওঠা সিংহের গর্জনধ্বনি প্রতিনিয়ত দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভেসে আসছে। নবউত্থিত সামাজিক আন্দোলন সমস্ত ধরনের নিস্পেষণ যন্ত্রকে ভেঙে দিয়ে নতুন সমাজ গড়ার আকাঙ্খাকে প্রকাশ করছে। এই নতুনের সন্ধান করাটাই আজকের সময়ের জরুরি কাজ যা সামাজিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে যতটুকু প্রযোজ্যঠিক তেমনি প্রযোজ্য নাট্য আন্দোলনের ক্ষেত্রেও। বরাকের নাট্যচর্চার ক্ষেত্রে নতুনের এই সন্ধান শুরু হতে পারে অতীত অভিজ্ঞতার সার সংকলনবরাকের জনসমাজকে জানা ও বোঝার প্রচেষ্টাগণ-আবেগকে বুঝতে ইতিহাসের চর্চা ও সর্বোপরি নতুন বিষয়বস্তু ও আঙ্গিক নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার প্রচেষ্টার মাধ্যমে। এই কাজ করার জন্য বরাকে এক শক্তিশালী নাট্যকর্মীদলের উপস্থিতি রয়েছেপ্রয়োজন শুধু সঠিক দৃষ্টিভঙ্গির।

অসম মজুরি শ্রমিক ইউনিয়নের প্রচারপত্র

Posted by স্বাভিমান


শ্রমিক-কৃষক-দরিদ্র মানুষ ও এনরেগা

শ্রমিকদের অধিকারের দাবিতে গর্জে উঠুন


২ এপ্রিল রাজ্যব্যাপী পঞ্চায়েত/ব্লক অফিস

ঘেরাও করুন।।


মজুরি শ্রমিক ইনিয়নের আন্দোলনে সামিল

হোন।।

বন্ধুগণ,
গরিব-মেহনতি মানুষের বহু সংগ্রামের ফসল এনরেগা আইন বা জবকার্ডের ১০০ দিনের কাজ। পরিবারপিছু বছরে ১০০ দিনের কাজ দেওয়ার গ্যারান্টি দেওয়া হয়েছে এই আইনে । যারা কাজ চাইবে তাদেরকে কাজ দিতে না পারলে বেকার ভাতা দেওয়ারও বিধান রয়েছে এই আইনে। যেহেতু এটা একটা আইন, গ্রামীণ জনগণ আইনের আশ্রয় নিয়ে তাদের অধিকার দাবি করতে পারে এবং গ্রামসভার মাধ্যমে হিসাব দাবি করতে পারে। তাই এই প্রকল্পে চুরি করার সুযোগ কম এবং সেজন্যই রাজ্য সরকারের প্রশাসন যন্ত্র এনরেগার কাজ করতে আগ্রহী নয়। জিলা থেকে পঞ্চায়েত পর্যন্ত বড়-মাঝারি-ছোট আমলা-নেতা ও দালালরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এই প্রকল্প থেকেও কিছু অর্থ কামিয়ে নেওয়ার এবং এব্যাপারে সবচাইতে ভাল উপায় হচ্ছে গ্রামীণ ধনীদের জবকার্ডে বিনা কাজে এন্ট্রি দিয়ে অর্থ আত্মসাৎ করা এবং ভূয়ো গ্রামসভা দেখিয়ে হিসাব পাশ করা।
 রাজ্য সরকারের মন্ত্রী-আমলাদের এই অকর্মণ্যতা ও অপদার্থতার অজুহাতে কেন্দ্রীয় সরকার ২০১২-১৩ অর্থবছরে এনরেগার খাতে বাজেট বরাদ্দ গতবছরের ৪০ হাজার কোটি থেকেও ৭ হাজার কোটি কমিয়ে দিয়েছে। কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী অজুহাত দেখিয়েছেন যে গত বছরের ৬ হাজার কোটি টাকা রাজ্য সরকারগুলির হাতে  রয়েছে। মন্ত্রী এই সত্য চেপে গেছেন যে কাজ পেতে আগ্রহী জবকার্ড-হোল্ডারদের গতবছর নিয়মিত কাজ দেওয়া হয়নি এবং তাদের সবাইকে যদি কাজ দেওয়া হতো তাহলে গতবারের বরাদ্দকৃত অর্থই কম পড়ত। মনে রাখা উচিত যে গতবছরই রাজ্য সরকারগুলির লেবার বাজেট ছিল ৬০,০০০ কোটি টাকা। এনরেগা খাতে বরাদ্দ অর্থের পরিমাণ বৃদ্ধি করার বিপরীতে কমিয়ে দেওয়ার কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী ও গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রীর সিদ্ধান্ত আসলে কেন্দ্রীয় সরকারের গরিব ও শ্রমজীবী বিরোধী চক্রান্তেরই অংগ। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের শ্রমিক বিরোধী চক্রান্তের বিরুদ্ধে আমাদের গর্জে উঠতে হবে।    
বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানী, আইএমএফ-ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান, বড় বড় পুঁজির মালিকদের চাপের কাছে সরকার যে মাথা ঠুকছে তার প্রমাণ দারিদ্রসীমা (বিপিএল) নিয়ে পরিকল্পনা কমিশনের ভূমিকা। কেন্দ্র সরকার ‘কৃষি সহায়তা ও খাদ্য নিরাপত্তা’ নিয়ে আমেরিকার সাথে চুক্তি সই করেছে এবং ফলে কার্গিল-মোসান্ন্টোর মতো আমেরিকার বৃহৎ কোম্পানী আমাদের দেশের খাদ্য নীতির পরামর্শদাতা হয়ে বসে আছে। শহরে ও গ্রামে যথাক্রমে দৈনিক মাথাপিছু ৩২টাকা ও ২৬ টাকা মূল্যের সামগ্রীর কম ভোক্তাদের দরিদ্র দেখিয়ে পরিকল্পনা কমিশনের গতবছরের দারিদ্রসীমার সংজ্ঞা নিয়ে যখন সুপ্রিম কোর্ট আপত্তি তুলেছে, তখন এবছর এই সীমাকে আরও কমিয়ে দিয়ে দরিদ্রের সংখ্যা কমে যাওয়ার দাবি করছে কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা কমিশন। আসলে দরিদ্রের সংখ্যা কম দেখালে দরিদ্রদের জন্য কম অর্থ ব্যয় করতে হয় এবং রাজ্য সরকারগুলির বরাদ্দ কমে যায়। এজন্যই কেন্দ্র সরকারের এই চক্রান্ত।
আসাম সরকারের মন্ত্রী-আমলারা বিদেশি প্রভুদের থেকে নেওয়া ধারের অর্থ লুটেপুটে খেতেই ব্যস্ত। দরিদ্রদের জন্য অর্থবরাদ্দ নিয়ে তাদের বিশেষ মাথাব্যথা নেই, বরঞ্চ এই অর্থ দিসপুর-জিলা সদর ও ব্লক অফিসে বসে কীভাবে আত্মসাৎ করা যায় তার ফন্দি-ফিকির করতেই তাদের বেশি আগ্রহতাই রাজ্য সরকার ২৯টি বিভাগ এখনও পঞ্চায়েতের হাতে হস্তান্তর করেনি। রাজ্য ও কেন্দ্র সরকার বিদেশি  বহুজাতিক কোম্পানীর চাপে গ্রামীণ মানুষ, আমজনতা তথা শ্রমজীবী দরিদ্র মানুষের বিরুদ্ধে চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছে। ইতিমধ্যে শিক্ষা-চিকিৎসা সহ আমজনতার প্রয়োজনীয় সবকিছু কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে কেন্দ্রীভূত করে বড় বড় ব্যাক্তি-মালিকদের মুনাফার জন্য ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। এবারের বাজেট বড় বড় ধনী ব্যবসায়ীদের জন্য ৪৫০০ কোটি টাকার কর ছাড় দিয়েছে, অন্যদিকে ৪৫,০০০ কোটি টাকার অতিরিক্ত অপ্রত্যক্ষ করের মাধ্যমে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে সমস্ত বোঝা দরিদ্র মানুষের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে
এমতাবস্থায় এনরেগার বছরে ২০০ দিনের কাজ, ন্যূনতম ২০০ টাকা মজুরি, এনরেগার কাজে ব্যয়বরাদ্দ বৃদ্ধি, নিয়মিত গ্রামসভা, কাজ দিতে না পারলে বেকার ভাতা, সর্বজনীন রেশন ব্যবস্থা,  ও পঞ্চায়েতের হাতে অধিক ক্ষমতার দাবিতে জোরদার আন্দোলন গড়ে তুলুন, গ্রামে গ্রামে শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থ বিরোধী চক্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ – প্রতিরোধ গড়ে তুলুন এবং আগামী ২ এপ্রিল এই দাবিতে পঞ্চায়েত অফিস/ব্লক অফিসে ঘেরাও/বিক্ষোভ কর্মসূচীর মাধ্যমে এই আন্দোলনের সূচনা করুন।
মজুরি শ্রমিক ইউনিয়নের পক্ষে পারভেজ খশ্রু লস্কর, আলতাফ খান, দক্ষিণা মোহন দাস, শিশির দে, আসাদুর রহমান, ধরিত্রী শর্মা, অরুণ কর্মকার, মৃণাল সোম ও নির্মল কুমার দাস কর্তৃক প্রচারিত ও শিলচর সানগ্রাফিকস থেকে মুদ্রিত

স্বাভিমান:SWABHIMAN Headline Animator

^ Back to Top-উপরে ফিরে আসুন