বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর অত্যাচার ও মন্দির ভাঙার প্রশ্নে

Posted by স্বাভিমান Labels: , ,




  

                     দৈনিক যুগশঙ্খের ২ অক্টোবর, ২০১৪ সংখ্যায় অতীন দাশের “দুর্গাপুজোয় মনকে যা নিয়তই পীড়িত করে” শির্ষক লেখাটি পড়লাম। এই লেখার মূল বক্তব্যকে সম্পূর্ণ খণ্ডন করে এক বিস্তৃত আলোচনা করা যায়। কিন্তু পাঠক যাতে তাঁর নিজস্ব মতামত নিজেই গড়ে তুলতে সচেষ্ট হোন শুধুমাত্র সেই উদ্দেশ্য থেকে উক্ত নিবন্ধে উল্লিখিত দুটি বিষয়ের উপর আলোকপাত করতেই এই পত্রের অবতারণা। লেখক ইসলাম ও ইসলামের বিস্তৃতি নিয়ে তলোয়ার অর্থাৎ বলপ্রয়োগের তত্ত্বের আশ্রয় নিয়েছেন। সাধারণ পাঠকের কাছে এধরনের সোজাসাপটা জবাব প্রায়শই গ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হয়। কিন্তু বিদ্বৎ সমাজের কাছে এধরনের অতি-সরলীকরণ বহু আগেই প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। উপরন্তু তথ্য নিজে থেকে কোন কথাই বলে না – তথ্য থেকে সত্যকে সমাজবিদ্যার বিশ্লেষণী অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে বের করে নিতে হয়। সামাজিক তথ্যের বিশ্লেষণের মাধ্যমে আবিষ্কৃত সত্য জানার জন্য আমাদেরকে স্বীকৃত ও দক্ষ সমাজবিদ তথা ইতিহাসবিদদের কাছে আশ্রয় নিতে হয়। প্রাচ্যের প্রাচীন ইতিহাসের যে তথ্যের ভাণ্ডার সন্নিবিষ্ট হয়েছে তা সাধারণত করেছেন পরিব্রাজকরা যাদের প্রয়োজন পড়ত প্রাতিষ্ঠানিক মদত। যখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের আধিপত্য বিস্তৃতি লাভ করছে এবং ফরাসী আধিপত্য পতনোন্মুখ সেই সময়কালে প্রাচ্যবিদ্যা চর্চা শুরু হয় ও তা প্রভাব বিস্তার করে। তখনকার লেখায় সন্নিবিষ্ট তথ্য থেকে প্রাচ্যবিদ ও পরিব্রাজকরা যে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন তা সাধারণত এই দুই সাম্রাজ্যের স্বার্থের অনুকূল। তাঁরা সবসময়ই প্রাচ্যকে দেখেছেন পাশ্চাত্যের চোখ দিয়ে। এডোয়ার্ড স্যাইডের ‘অরিয়েন্টেলিজম’ বইয়ে এর বিস্তৃত ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে ভারত-চীন ও আরব দুনিয়া একই ভ্রান্তির শিকার।
  

            যাইহোক, একেবারে নিশ্চিতভাবে বলা না গেলেও ৫৭১ সালকে প্রফেট মহম্মদের জন্ম সাল হিসেবে মেনে নেওয়া হয়েছে। এই সময়কাল আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই সময়ে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য পশ্চিমদিকে পরাজয় বরণ করছে ও পূর্বে প্রতিরোধমূলক যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। ইতালি ও স্পেনে যথাক্রমে লম্বার্ড ও ভিসিগথদের আক্রমণ এগিয়ে চলেছে, পূর্বে বাইজেন্টাইনরা শুধুমাত্র কূটনৈতিক রণনীতি অবলম্বন করে চলেছে। দক্ষিণ আরবে প্রথমে ইথিওপিয়ানদের ও পরে পার্সিয়ানদের দখলের মাধ্যমে ক্ষমতার পতন পূর্বেই শুরু হয়েছে। খ্রিষ্টিয়ান যুগের শুরুতেই মৌসুমী বায়ুর নিয়ম আবিষ্কারের মাধ্যমে গ্রিক জাহাজ মিশর থেকে ভারত যাতায়াত শুরু করে দিয়েছে। ব্যাপক দূরপাল্লার বাণিজ্যের মাধ্যমে বাণিজ্য শহর গড়ে উঠছে। দক্ষিণ আরব ও বাইজেন্টাইন পেলেস্তাইনের মাঝখানে অন্যতম বর্ধিষ্ণু শহর হিসেবে গড়ে উঠছে মক্কা। সম্ভবত মক্কার ভৌগোলিক অবস্থান এই সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। উত্তর থেকে দক্ষিণে – পেলেস্তাইন থেকে ইয়েমেনে যাওয়ার পথ, পূর্ব থেকে পশ্চিমে লোহিত সাগর ও পারস্য উপসাগর হয়ে ইথিওপিয়া যাওয়ার পথে অবস্থিত এই মক্কা। অনুরূপ আর্থিক বিকাশ ঘটছে গোটা পশ্চিম আরবে। পুরোনো বেদুইন ট্রাইবরা তখনও স্থায়ী বসত গড়ে তুলেনি। বাণিজ্য অর্থনীতি ও শহরের বিকাশ তাদের মধ্যেও প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। অভ্যন্তরিণ জনজাতীয় সামাজিক কাঠামোয় অসাম্যের ছায়া পড়তে শুরু করেছে। বাণিজ্য শহরের প্রভাবে অভ্যন্তরিণ সামাজিক ও আর্থিক কাঠামোর পরিবর্তন জনজাতীয় জীবনধারণের নিয়মের সীমা অতিক্রম করে ফেলেছে। বৃহৎ সাম্রাজ্যের কাছে আরবরা সবসময়ই প্রয়োজনীয় ছিল – তাদের আনুগত্য তারা কিনে নিত, এক ট্রাইবের বিরুদ্ধে আরেকটিকে লেলিয়ে দিত। সুতরাং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তাদের সাথে পেতে হলে প্রয়োজন ছিল একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রের জন্ম দেওয়া যা সকল আরববাসীদেরকে ঐক্যবদ্ধ করবে। এই রাষ্ট্র গঠনের অনুকূল মতাদর্শ হিসেবে খ্রিষ্ট ও ইহুদী ধর্ম আরববাসীদের কাছে পরিচিত ছিল। কিন্তু এই দুটি ধর্মই তাদের কাছে বিদেশি ও বৃহৎ সাম্রাজ্যরে ধর্ম ছিল এবং তাই এ ধর্ম গ্রহণ আরব গরিমায় আঘাত করত বলেই জনজাতীয় ধর্ম ত্যাগ করে তারা ঐ সাধারণ ধর্মের দিকে আকৃষ্ট হলো না। উপরন্তু প্রায় এই একই সময়ে ইসলাম ধর্ম জন্ম নিচ্ছে, অন্যথায় সাম্রাজ্যের ধর্মই হয়ত আরবে প্রভাব বিস্তার করত ও ইতিহাস ভিন্ন হত। আরবের সবচাইতে প্রাধাণ্যকারী কুরেশ জনজাতীয়রা তিনটি ভাগে বিভক্ত ছিল ও নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বে লিপ্ত থাকলেও খ্রিষ্টীয়, বাইজেন্টাইন ও ইথিওপিয়ার ক্ষমতার সামনে তারা ঐক্যবদ্ধ থাকত, যৌথভাবে সিদ্ধান্ত নিত ও সাম্রাজ্যগুলির নিজেদের মধ্যে সংঘাতে অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সাথে সমদূরত্ব বজায় রাখত। এই কুরেশিরা পার্শিয়া, ইথিওপিয়া, সিরিয়া ইত্যাদিতে ছড়িয়ে পড়ে ও তাদের বসতি থাকা শহরগুলির প্রভূত বাণিজ্যিক উন্নতি সাধন করে এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ভূমিকা নেয়। প্রফেট মুহম্মদ এই কুরেশি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এবং এক শক্তিশালী আরব রাষ্ট্রের অনুকূল একেশ্বরবাদী ইসলাম ধর্ম গড়ে তোলেন। সমস্ত ট্রাইব, আরব ইহুদীদের এই নতুন ধর্মে আকৃষ্ট করার জন্য জনজাতীয় ও আরব ইহুদি রীতি নীতির অনেক কিছুই ইসলাম ধর্মে সন্নিবিষ্ট করেন। মেদিনাতে ভ্রূণস্তরে যে রাষ্ট্র ইতিমধ্যে গড়ে উঠেছে প্রফেট মুহম্মদ তাতে সুস্থিতি কায়েম করেন। গোটা আরব ইসলাম ধর্মে অন্তর্ভূক্ত হওয়া সত্ত্বেও তার চরিত্র মাল্টি-এথনিক থেকে যায় এবং এই মাল্টি-এথনিক বিভাজনের সীমানা ধরেই আরব রাষ্ট্র তথা অটোমান সাম্রাজ্যকে বহু-রাষ্ট্রে বিভাজিত করা হয়। প্রফেট মহম্মদের জীবতকালে যে ক্ষুদ্র আরব রাষ্ট্রের জন্ম হয় তা পরবর্তীতে বিকশিত হতে থাকে। পার্শিয়ান, সিরিয়ান, ইজিপ্সিয়ান, গ্রীক ইত্যদি অনেকেই আরব হয়ে উঠে। অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য, বিদ্বৎ সমাজে স্বীকৃত ও বিশ্লেষণাত্মক বই ‘মুহম্মদ’-এর লেখক ম্যাক্সিম রডিনসন লিখেছেন ইউরোপীয়রা যেভাবে বিশ্বাস করে আরব শাসকরা সেভাবে বলপ্রয়োগে ধর্মান্তরিত তো করতেনই না, বরঞ্চ এধরনের ধর্মান্তরণকে নাকচ করতেন। ভারতে ইসলামের এক ভিন্ন প্রেক্ষাপট ও কাহিনী রয়েছে। কিন্তু প্রাচ্যের ইতিহাসকে ইউরোপীয়দের চোখে না দেখার অভ্যাস করাই আমাদের সবার জন্য মঙ্গল। কিন্তু তাই বলে বলপ্রয়োগের গঠনাকে একেবারে নাকচ করা যায় না। উমাইয়াদদের রাজত্বে কিছু ক্রিষ্টিয়ান ও ইহুদিদের চাবুক মেরে ধর্মান্তরিত করা হয়েছিল। অথচ কুরেশি রাজত্বে এই উমাইয়াদ বংশের আবু সুফিয়ান কুরেশ শাসকদের বিরোধিতায় ইসলামকেও ঘৃণা করতেন ও এদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন। ধর্মান্তরিত করার এধরনের ঘটনার উল্লেখের মাধ্যমে ইসলামের অগ্রগতিকে ব্যাখ্যা করা যায় না। মূল আরবদের অবদানের সাথে সাথে মুসলিমদের মধ্যে যারা আরব পরিচিতি লাভ করেছিল, কিন্তু আরব শাসনের অধীনে পুরোপুরি চলে যায়নি তাদের মধ্য থেকেও মুসলিম আর্টস, মুসলিম সায়েন্স, মুসলিম ফিলোজফি ইত্যাদি বিকশিত হয়েছে। এক দীর্ঘ পরিক্রমায় ইসলাম ধর্মেও অনেক রীতি-নীতি ও মতধারা সংযোজিত হয়েছে। আধুনিক বিশ্বে তেল সম্পদ লুটের জন্য মুসলিমদের বিরুদ্ধে পশ্চিমী রাষ্ট্র শক্তির চক্রান্ত, অন্যায়, অবিচার ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে মুসলিমদের বিদ্রোহের ন্যায্যতা নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু পাশাপাশি এটাও খেয়াল রাখা উচিত যে এই বিদ্রোহের আড়ালে এই পশ্চিমী রাষ্ট্রশক্তিই তাদের নিজস্ব স্বার্থেই ওয়াহাবি সালাফিপন্থীদের সবচাইতে প্রতিক্রিয়াশীল বাহিনীকে অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে মদত যুগিয়ে যাচ্ছে। আলটপকা মন্তব্য দিয়ে ইসলামের ইতিহাসের বিকৃতি আগ্রাসী পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদকেই পরোক্ষে নিজের অজান্তে মদত যোগায়।

              এবার আসা যাক বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর অত্যাচার ও মন্দির ভাঙার প্রশ্নে। যে কোন শুভবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিই সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার ও মন্দির ভাঙার ঘটনাকে নিন্দাই শুধু করবেন না, ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদের পক্ষেও মত পোষণ করবেন। কিন্তু ঘটনার বিশ্লেষণ নির্মোহ, নৈর্ব্যক্তিক অবস্থান থেকে করাটাই বাঞ্চনীয়, অন্যথায় সঠিক অবস্থান নেওয়া থেকে বিরত থাকার জন্য সাধারণকে প্ররোচিত করতে পারে। এই অত্যাচার ও মন্দির ভাঙার ঘটনাগুলি যে ইসলামি নেতা দিলওয়ার হোসেন সায়েদির ফাঁসির পর থেকে ঘটতে শুরু করেছে লেখক একথা উল্লেখ করেছেন। এই ফাঁসিটা কে দিল? নিশ্চিতভাবে বাংলাদেশের রাষ্ট্র এবং ফাঁসি দেওয়ার পেছনে ছিল বাংলাদেশের জনমতের চাপ। এই তথ্য থেকে কী একথা বলা যায় না যে অত্যাচার ও মন্দির ভাঙার ঘটনাগুলির সাথে সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও জনগণের বৃহদাংশের সমর্থন নেই? এমতাবস্থায় বাংলাদেশের হিন্দুদের নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার প্রশ্ন কী করে উঠে? উপরন্তু মন্দির ভাঙার ঘটনাগুলি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে এই ঘটনাগুলি মূলত রাজনৈতিক প্রতিহিংসা। বাংলাদেশে এবার রেকর্ড সংখ্যক দুর্গাপুজা অনুষ্ঠিত হওয়ার তথ্য কি হিন্দুদের নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার বার্তা বহন করে? বাংলাদেশ থেকে গণহারে হিন্দুদের তাড়িয়ে দিলে আসামে হিন্দু জনসংখ্যা কি অপ্রত্যাশিতভাবে বাড়ত না? যে কোন সামাজিক সংঘাতের ঘটনায় রাষ্ট্র কী ভূমিকা নেয় তা অত্যন্ত গুরুত্ত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয়। রাষ্ট্র জড়িত থাকলে অত্যাচারের ঘটনা বিশ্ববাসীর জনসমক্ষে আসা দুরূহ হয়ে উঠে। উল্টোদিকে রাষ্ট্র সদর্থক ভূমিকা নিলে সামাজিক বিবাদের নিষ্পত্তি বহু ক্ষেত্রে আঞ্চলিক স্তরেই হয়ে যায়। অযোধ্যাবাসীর উপর ছেড়ে দিলে বাবরি মসজিদ বিবাদের নিষ্পত্তি তাঁরাই করে নিতেন বলে আমার বিশ্বাস, এতো পাশবিক আস্ফালন ও রক্তক্ষরণের প্রয়োজন পড়ত না। অন্যদিকে শ্রীলঙ্কায় তামিলদের উপর বর্বরোচিত আক্রমণের ঘটনা নিয়ে বিশ্ববাসী এখনো অন্ধকারে। অন্যায়ের বিরোধিতা ও প্রতিরোধ করার অর্থ এই নয় যে ন্যায়ের সম্ভাবনাকেও সমূলে নাকচ করে দিতে হবে। বাংলাদেশের সমাজে সেক্যুলার মূল্যবোধ অনেক গভীরে প্রোথিত হয়েছে বলেই আমার বিশ্বাস। যেভাবে বাংলাভাষা ও সংস্কৃতির সেক্যুলার চর্চা বাংলাদেশে ক্রমাগত বিকশিত হচ্ছে তার সাংস্কৃতিক মূল্য বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে হলেও সমাজ বহন করবে ও তাকে পরাজিত হতে দেবে না বলেই আমার বিশ্বাস। ভারতবর্ষে গণতন্ত্র ও সেক্যুলার রাজনীতির পরোক্ষ প্রভাবও বাংলাদেশে পড়তে বাধ্য, এক্ষেত্রে আমাদের দায়িত্ব অপরিসীম।  

স্বাভিমান:SWABHIMAN Headline Animator

^ Back to Top-উপরে ফিরে আসুন