(ইউনিকোডে যারা পড়তে পারবেন না, তাদের জন্যে ছবিতে রইল নিচে)
বর্তমানের প্রেক্ষিতে ভাষা-সংস্কৃতির সংকট ও উনিশের ঐতিহ্য
Posted by স্বাভিমান Labels: আসাম, বরাক উপত্যকা, ভাষা দিবস
১৯শে মে শহিদ দিবসকে সামনে রেখে ১১মে মধ্যশহর সাংস্কৃতিক সমিতির কার্যালয় হলে কোরাসের উদ্যোগে এক মনোজ্ঞ আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হলো। এই আলোচনা সভায় বক্তারা প্রশ্ন তোলেন ১৯৬১-৭১-৮৬-এর ভাষা আন্দোলনের পর ১৯৯১-তে এসে আমাদের কেন উগ্র-হিন্দু সাম্প্রদায়িকতায় আশ্রয় নিতে হল? ভাষা আন্দোলনের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য কী করে প্রতিক্রিয়াশীলতায় রূপান্তরিত হলো? ১৯ শে মে’র পর ১৯ শে জুনের ঘটনা কেন ঘটল? কেন একাত্তরের ভাষা আন্দোলন পর্যবসিত হলো গুণ্ডাবাহিনীর সম্মুখ সমরে? প্রশ্ন উঠল একষট্টির ভাষা আন্দোলনের পর যে চুক্তি হলো তার ৬(ক) ধারা অনুসারে তৎকালীন কাছাড় বা বর্তমান বরাক উপত্যকার প্রতিটি জনগোষ্ঠীর সাথে সরকারি-প্রশাসনিক যোগাযোগের মাধ্যম সেইসব জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষায় হওয়ার বিষয়টি বাস্তবায়িত না হওয়ার জন্য উনিশ উদযাপনের আয়োজন থেকে কেন কোন জোরদার দাবি উত্থাপিত হলো না? কেন মাতৃভাষার বিষয় শিক্ষক প্রকারান্তরে উঠিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে বাঙালিরা নীরব ভূমিকা পালন করছে? কেন চা-বাগানে বসবাসকারী চা-শ্রমিক ও প্রাক্তণ চা-শ্রমিকদের মাতৃভাষায় পঠন-পাঠনের সুযোগ করে দিতে উনিশের ঐতিহ্য বহনকারীদের কোন তৎপরতাই লক্ষ্য করা গেল না?
নির্দিষ্ট আলোচকরা এই প্রশ্নগুলির উত্তর খোঁজারও চেষ্টা করেন। ড০ সুবীর কর ভাষা আন্দোলনের দুর্বলতাকে স্থানীয় ও উদ্বাস্তুদের দ্বন্দ্বকে সমাধান করার উপযুক্ত প্রয়াস ও পরিকল্পনার অভাবকে দায়ি করেন এবং এই সুযোগে শাসকশ্রেণির রাজনৈতিক চক্রান্ত ও বাম আন্দোলনকে প্রতিহত করার মানসিকতা থেকে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের সৃষ্টি হিসেবে তিনি ঘটনা পরম্পরা বিশদভাবে উল্লেখ করেন। সঞ্জীব দেবলস্কর বলেন ভাষা নিয়ে বাঙালিদের আবেগ-প্রবণতা আর কোন জাতির মধ্যে দেখা যায় না। আক্রান্তরা আক্রমণকারী হতে পারে না এই সূত্র ধরে তিনি বাঙালি-অবাঙালি সম্পর্কে বাঙালির উদারতার নিদর্শন তুলে ধরেন ও মধ্যযুগের অন্ধকারময় সময় পেরিয়ে বাংলা ভাষা গ্রহণ-বর্জনের মাধ্যমে এক বিকাশমান ভাষা বলে উল্লেখ করেন। মুজাম্মিল আলি লস্কর সুস্পষ্ট ভাষায় বলেন যে বাঙালি শিক্ষিত বর্ণহিন্দু সমাজ তাদের প্রতিবেশিকে আলিঙ্গন করে নিতে এখনও দ্বিধাগ্রস্ত। প্রতিবেশিদের সাথে নিয়ে যদি একজোট না হওয়া যায় তাহলে আমরা বাইরের আক্রমণকে প্রতিহত করতে পারব না। শিক্ষাহীনতাই বঞ্চিত মুসলিম সমাজের আসল সমস্যা যারা অতি সাধারণ প্রলোভনেই আকৃষ্ট হয়। কিন্তু আজ নিজস্ব সামাজিক প্রচেষ্টায় এক শিক্ষিত সমাজ গড়ে উঠছে এবং আমরা একে অপরকে চেনার ও আপন করে নেওয়ার প্রচেষ্টা নিলে ঐক্য গড়ে উঠতে পারে এবং এক্ষেত্রে শিক্ষিত বর্ণহিন্দুদের দায়িত্ব অনেক বেশি এবং এই প্রক্রিয়ায় ঐক্যের শেকড় সমাজের গভীরে প্রোথিত হবে। ১৯ শে মে থেকে কেন ১৯ শে জুন হলো তার সঠিক অনুসন্ধান ও ব্যাখ্যা এখনও করা হয়ে উঠেনি, দোষারোপ করেই আমরা আমাদের দায় সারছি। ড০ মৃন্ময় দেব অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় বর্তমান প্রেক্ষিতকে বিশ্ব প্রেক্ষাপট থেকে বরাকের স্থানিক প্রেক্ষাপটে নিয়ে এসে বলেন যে বাঙালি সত্ত্বাও বহুকেন্দ্রিক এবং দুর্ভাগ্যজনক যে বরাকের কেন্দ্রটির জিয়নকাঠি হয়ে উঠেছে অসমীয়া উগ্রজাতিয়তাবাদী কোন পদক্ষেপের প্রতিক্রিয়া হিসেবে যাকে তিনি কনডিশনড রিফ্লেক্স হিসেবে উল্লেখ করেছেন। অন্য সময় এই কেন্দ্রটি আধিপত্যবাদী ও কলকাতামুখীন। ভাষা আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক বিভাজন সবচেয়ে প্রধান বাধা হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন বাংলা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে জমিদার শ্রেণি থেকে যারা এখানে এসছেন তারাই জনমত গঠনে প্রাধাণ্যকারী অবস্থানে রয়েছেন এবং তাদের বর্ণহিন্দু জমিদারি মানসিকতা ও সাম্রাজ্যবাদ নির্ধারিত মানসিকতা এই বিভাজন দূর করার প্রধান প্রতিবন্ধক। শেকড় থেকে উচ্ছেদ হয়ে এর স্মৃতি বহন করে চলেছেন এই উদ্বাস্তুরা কিন্তু এখানে নতুন কোন শেকড় গড়ে তুলতে সক্ষম হননি। অন্যদিকে বরাকের বিভিন্ন সমাজ থেকে উঠে আসা বুদ্ধিজীবীরাও ভাষা আন্দোলনের হাল ধরতে পারেননি এখনও। এভাবে তিনি এক কাঠামোগত ও কার্যপ্রণালীর দুর্বলতার দিকে ইঙ্গিত করেন। কাজল দেমতা ঝাড়খণ্ডী তথা চা-শ্রমিক ও প্রাক্তণ চা-শ্রমিকদের করুণ অবস্থা বর্ণণা করেন এবং তাদের অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে শিক্ষার অভাবকে দায়ি করেন। মাতৃভাষায় তাদের পঠন-পাঠনের সুযোগ না থাকায় অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী প্রাথমিকস্তরেই বাধার সম্মুখীন হয় এবং পড়াশুনা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। উনিশের মে উদযাপনের ক্ষেত্রে তাঁর বাস্তব অভিজ্ঞতা ও মর্মবেদনা ব্যাক্ত করে তিনি বলেন একটি অনুষ্ঠানে ঝুমুর নাচ ও আদিবাসী গান পরিবেশন করতে দিয়ে বাঙালি বুদ্ধিজীবী উদ্যোক্তাদের আপত্তির সম্মুখীন হয়েছেন। উনিশের মে’র দিন বাংলা ছাড়া আর কিছু চলবে না বলে তারা আপত্তি তোলেন। ড০ শান্তি কুমার সিং বলেন যে তাঁরা ভীষণভাবে মর্মাহত এই কারণে যে যখন মাতৃভাষার বিষয় শিক্ষক পদটি প্রকারান্তরে উঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে এবং নির্দিষ্ট ভাষা না জানা অসমীয়াভাষীদের দিয়ে তা পূরণ করে দেওয়া হচ্ছে তখন কিন্তু বৃহৎ জনগোষ্ঠী হিসেবে বাঙালিদের তরফে কোন আপত্তি উঠেনি। সর্বশেষ বক্তা সুব্রত কুমার পাল (শ্যামা) একষট্টির আন্দোলনের সফলতা ও বিফলতার দিক তুলে ধরে বলেন যে আমাদের সীমিত সফলতা ভাষা চুক্তির ৬(ক) ধারার সংযোজন। কিন্তু এরপর অধিকারের আন্দোলনকে আর প্রসারিত করতে পারিনি এবং তার অন্তর্নিহিত কারণ একষট্টির আন্দোলনের মধ্যেই লুকিয়ে আছে। করিমগঞ্জ জেলার বিস্তৃত বাস্তব প্রেক্ষাপট তুলে ধরে তিনি দেখান কোথায় এবং কীভাবে একষট্টির ভাষা আন্দোলন শহর-গঞ্জের এলিট সীমানা অতিক্রম করে নিম্নবর্গীয় হিন্দু-মুসলমান হৃদয় স্পর্শ করতে ব্যার্থ হয়েছে এবং তারা এই আন্দোলনকে শুরু থেকেই সন্দেহের চোখে দেখেছেন। আন্দোলনের উদ্যোক্তারা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জমিদার-মিরাসদার শ্রেণি থেকে উঠে এসেছেন এবং স্বাভাবিকভাবেই রায়ত শ্রেণির আম-জনতারা ন্যায্য দাবিকেও সন্দেহের চোখে দেখেছেন। তিনি আক্ষেপ করে বলেন ছিয়াশির ভাষা আন্দোলনের পরও একান্নবইতে এসে করিমগঞ্জ জেলার অবিসিরা হিন্দুত্ববাদীদের কাছে আশ্রয় নিলেন। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে কোন স্যাকুলার রাজনীতি গড়ে তোলার বিফলতা ভাষা আন্দোলনের দুর্বলতাকেই দেখায়। এখনও যখন বিটিএডিএ-তে শিশুদেরকেও নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে তখনও আমরা বাঙালি-মুসলমানদের পাশে দাঁড়াতে দ্বিধান্বিত। এই প্রক্রিয়া আমাদের সবার অস্তিত্বকে ক্রমশঃ বিপন্ন করে তুলছে। সবশেষে বিটিএডির ঘটনাকে ধিক্কার জানিয়ে, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের উপর আইনি ও সহিংস আক্রমণের বিরুদ্ধ কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের এবং সব জনগোষ্ঠী যাতে তাদের নিজস্ব সমস্যা তুলে ধারতে পারে ও তার সমাধানে যৌথ প্রয়াস নিতে পারে তারজন্য সব জনগোষ্ঠীর এক যৌথ মঞ্চ গড়ে তোলার প্রচেষ্টা নেওয়ার প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা সভার সমাপ্তি ঘোষণা করেন সভার সঞ্চালক বিশ্বজিত দাশ।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
বর্তমানের প্রেক্ষিতে ভাষা-সংস্কৃতির সংকট ও উনিশের ঐতিহ্য
[ভাষা শহিদ দিবস উপলক্ষ্যে এই বিষয়ের উপর কোরাস আয়োজিত আলোচনা সভায়
নির্দিষ্ট আলোচকরা এই প্রশ্নগুলির উত্তর খোঁজারও চেষ্টা করেন। ড০ সুবীর কর ভাষা আন্দোলনের দুর্বলতাকে স্থানীয় ও উদ্বাস্তুদের দ্বন্দ্বকে সমাধান করার উপযুক্ত প্রয়াস ও পরিকল্পনার অভাবকে দায়ি করেন এবং এই সুযোগে শাসকশ্রেণির রাজনৈতিক চক্রান্ত ও বাম আন্দোলনকে প্রতিহত করার মানসিকতা থেকে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের সৃষ্টি হিসেবে তিনি ঘটনা পরম্পরা বিশদভাবে উল্লেখ করেন। সঞ্জীব দেবলস্কর বলেন ভাষা নিয়ে বাঙালিদের আবেগ-প্রবণতা আর কোন জাতির মধ্যে দেখা যায় না। আক্রান্তরা আক্রমণকারী হতে পারে না এই সূত্র ধরে তিনি বাঙালি-অবাঙালি সম্পর্কে বাঙালির উদারতার নিদর্শন তুলে ধরেন ও মধ্যযুগের অন্ধকারময় সময় পেরিয়ে বাংলা ভাষা গ্রহণ-বর্জনের মাধ্যমে এক বিকাশমান ভাষা বলে উল্লেখ করেন। মুজাম্মিল আলি লস্কর সুস্পষ্ট ভাষায় বলেন যে বাঙালি শিক্ষিত বর্ণহিন্দু সমাজ তাদের প্রতিবেশিকে আলিঙ্গন করে নিতে এখনও দ্বিধাগ্রস্ত। প্রতিবেশিদের সাথে নিয়ে যদি একজোট না হওয়া যায় তাহলে আমরা বাইরের আক্রমণকে প্রতিহত করতে পারব না। শিক্ষাহীনতাই বঞ্চিত মুসলিম সমাজের আসল সমস্যা যারা অতি সাধারণ প্রলোভনেই আকৃষ্ট হয়। কিন্তু আজ নিজস্ব সামাজিক প্রচেষ্টায় এক শিক্ষিত সমাজ গড়ে উঠছে এবং আমরা একে অপরকে চেনার ও আপন করে নেওয়ার প্রচেষ্টা নিলে ঐক্য গড়ে উঠতে পারে এবং এক্ষেত্রে শিক্ষিত বর্ণহিন্দুদের দায়িত্ব অনেক বেশি এবং এই প্রক্রিয়ায় ঐক্যের শেকড় সমাজের গভীরে প্রোথিত হবে। ১৯ শে মে থেকে কেন ১৯ শে জুন হলো তার সঠিক অনুসন্ধান ও ব্যাখ্যা এখনও করা হয়ে উঠেনি, দোষারোপ করেই আমরা আমাদের দায় সারছি। ড০ মৃন্ময় দেব অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় বর্তমান প্রেক্ষিতকে বিশ্ব প্রেক্ষাপট থেকে বরাকের স্থানিক প্রেক্ষাপটে নিয়ে এসে বলেন যে বাঙালি সত্ত্বাও বহুকেন্দ্রিক এবং দুর্ভাগ্যজনক যে বরাকের কেন্দ্রটির জিয়নকাঠি হয়ে উঠেছে অসমীয়া উগ্রজাতিয়তাবাদী কোন পদক্ষেপের প্রতিক্রিয়া হিসেবে যাকে তিনি কনডিশনড রিফ্লেক্স হিসেবে উল্লেখ করেছেন। অন্য সময় এই কেন্দ্রটি আধিপত্যবাদী ও কলকাতামুখীন। ভাষা আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক বিভাজন সবচেয়ে প্রধান বাধা হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন বাংলা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে জমিদার শ্রেণি থেকে যারা এখানে এসছেন তারাই জনমত গঠনে প্রাধাণ্যকারী অবস্থানে রয়েছেন এবং তাদের বর্ণহিন্দু জমিদারি মানসিকতা ও সাম্রাজ্যবাদ নির্ধারিত মানসিকতা এই বিভাজন দূর করার প্রধান প্রতিবন্ধক। শেকড় থেকে উচ্ছেদ হয়ে এর স্মৃতি বহন করে চলেছেন এই উদ্বাস্তুরা কিন্তু এখানে নতুন কোন শেকড় গড়ে তুলতে সক্ষম হননি। অন্যদিকে বরাকের বিভিন্ন সমাজ থেকে উঠে আসা বুদ্ধিজীবীরাও ভাষা আন্দোলনের হাল ধরতে পারেননি এখনও। এভাবে তিনি এক কাঠামোগত ও কার্যপ্রণালীর দুর্বলতার দিকে ইঙ্গিত করেন। কাজল দেমতা ঝাড়খণ্ডী তথা চা-শ্রমিক ও প্রাক্তণ চা-শ্রমিকদের করুণ অবস্থা বর্ণণা করেন এবং তাদের অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে শিক্ষার অভাবকে দায়ি করেন। মাতৃভাষায় তাদের পঠন-পাঠনের সুযোগ না থাকায় অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী প্রাথমিকস্তরেই বাধার সম্মুখীন হয় এবং পড়াশুনা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। উনিশের মে উদযাপনের ক্ষেত্রে তাঁর বাস্তব অভিজ্ঞতা ও মর্মবেদনা ব্যাক্ত করে তিনি বলেন একটি অনুষ্ঠানে ঝুমুর নাচ ও আদিবাসী গান পরিবেশন করতে দিয়ে বাঙালি বুদ্ধিজীবী উদ্যোক্তাদের আপত্তির সম্মুখীন হয়েছেন। উনিশের মে’র দিন বাংলা ছাড়া আর কিছু চলবে না বলে তারা আপত্তি তোলেন। ড০ শান্তি কুমার সিং বলেন যে তাঁরা ভীষণভাবে মর্মাহত এই কারণে যে যখন মাতৃভাষার বিষয় শিক্ষক পদটি প্রকারান্তরে উঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে এবং নির্দিষ্ট ভাষা না জানা অসমীয়াভাষীদের দিয়ে তা পূরণ করে দেওয়া হচ্ছে তখন কিন্তু বৃহৎ জনগোষ্ঠী হিসেবে বাঙালিদের তরফে কোন আপত্তি উঠেনি। সর্বশেষ বক্তা সুব্রত কুমার পাল (শ্যামা) একষট্টির আন্দোলনের সফলতা ও বিফলতার দিক তুলে ধরে বলেন যে আমাদের সীমিত সফলতা ভাষা চুক্তির ৬(ক) ধারার সংযোজন। কিন্তু এরপর অধিকারের আন্দোলনকে আর প্রসারিত করতে পারিনি এবং তার অন্তর্নিহিত কারণ একষট্টির আন্দোলনের মধ্যেই লুকিয়ে আছে। করিমগঞ্জ জেলার বিস্তৃত বাস্তব প্রেক্ষাপট তুলে ধরে তিনি দেখান কোথায় এবং কীভাবে একষট্টির ভাষা আন্দোলন শহর-গঞ্জের এলিট সীমানা অতিক্রম করে নিম্নবর্গীয় হিন্দু-মুসলমান হৃদয় স্পর্শ করতে ব্যার্থ হয়েছে এবং তারা এই আন্দোলনকে শুরু থেকেই সন্দেহের চোখে দেখেছেন। আন্দোলনের উদ্যোক্তারা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জমিদার-মিরাসদার শ্রেণি থেকে উঠে এসেছেন এবং স্বাভাবিকভাবেই রায়ত শ্রেণির আম-জনতারা ন্যায্য দাবিকেও সন্দেহের চোখে দেখেছেন। তিনি আক্ষেপ করে বলেন ছিয়াশির ভাষা আন্দোলনের পরও একান্নবইতে এসে করিমগঞ্জ জেলার অবিসিরা হিন্দুত্ববাদীদের কাছে আশ্রয় নিলেন। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে কোন স্যাকুলার রাজনীতি গড়ে তোলার বিফলতা ভাষা আন্দোলনের দুর্বলতাকেই দেখায়। এখনও যখন বিটিএডিএ-তে শিশুদেরকেও নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে তখনও আমরা বাঙালি-মুসলমানদের পাশে দাঁড়াতে দ্বিধান্বিত। এই প্রক্রিয়া আমাদের সবার অস্তিত্বকে ক্রমশঃ বিপন্ন করে তুলছে। সবশেষে বিটিএডির ঘটনাকে ধিক্কার জানিয়ে, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের উপর আইনি ও সহিংস আক্রমণের বিরুদ্ধ কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের এবং সব জনগোষ্ঠী যাতে তাদের নিজস্ব সমস্যা তুলে ধারতে পারে ও তার সমাধানে যৌথ প্রয়াস নিতে পারে তারজন্য সব জনগোষ্ঠীর এক যৌথ মঞ্চ গড়ে তোলার প্রচেষ্টা নেওয়ার প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা সভার সমাপ্তি ঘোষণা করেন সভার সঞ্চালক বিশ্বজিত দাশ।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
বর্তমানের প্রেক্ষিতে ভাষা-সংস্কৃতির সংকট ও উনিশের ঐতিহ্য
[ভাষা শহিদ দিবস উপলক্ষ্যে এই বিষয়ের উপর কোরাস আয়োজিত আলোচনা সভায়
কোরাসের অ্যাপ্রোচ পেপার
স্থান ঃ মধ্যশহর সাংস্কৃতিক সমিতির কার্যালয়, পার্করোড।
তারিখ ঃ ১১-০৫-২০১৪। সময় ঃ সকাল ১০-৩০ টা]
প্রতিবারের ন্যায় ১৯শে মে ভাষা শহিদ দিবস হিসেবে এবারও পালিত হবে। আমরা সবাই, যারা এদিবসকে ঘটা করে পালন করতে প্রতিবছর সচেষ্ট থাকি, অত্যন্ত উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছি যে সেই দিবস পালন নেহাতই এক আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হচ্ছে এবং ভাষিক অধিকারের প্রশ্নে যে প্রাণশক্তি সমগ্র জাতিকে নাড়িয়ে দেয় তা ক্রমশঃই ক্ষীয়মাণ ও সংকীর্ণ বদ্ধজলায় আবদ্ধ হয়ে পড়ছে। আমাদের মনে হয় একষট্টির আন্দোলনের যে ঐতিহ্য আমাদেরকে নতুন পরিস্থিতিতে নতুনভাবে উজ্জীবিত করার কথা ছিল তা করতে না পারার পেছনে ঐতিহ্যকে পুননির্মাণ করার আমাদের উদ্যোগের অভাব দায়ি। এই ভাবনা থেকেই কোরাস এবার নির্দিষ্ট দিবসের পূর্বে ১১ মে, ২০১৪ তারিখে এই আলোচনা সভার আয়োজন করেছে যাতে ভাষা দিবস পালনে আমাদেরকে নতুনভাবে ভাবতে শেখার সূত্রপাত ঘটায়। এই আলোচনা সভায় আলোচকদের উদ্দেশ্যে প্রথামাফিক উদ্যোক্তাদের তরফ থেকে কিছু বিষয় তুলে ধরা হচ্ছে এবং কোরাস আশাবাদী এগুলির উপর ভিত্তি করে এই আলোচনাসভা নতুন দিক উন্মোচিত করার প্রক্রিয়া শুরু করতে সক্ষম হবে।
(১) একষট্টির আন্দোলন যদিও সীমাবদ্ধ ছিল রাজ্য ভাষা আইনের মাধ্যমে রাষ্ট্রের দ্বারা এক ভাষাকে অন্য ভাষাভাষীদের উপর চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে এক গণতান্ত্রিক প্রতিবাদের মধ্যে, কিন্তু তার অন্তর্বস্তুতে ছিল মাতৃভাষায় প্রশাসনিক কাজকর্ম ও পঠন পাঠনের অধিকারকে সাব্যস্ত করার নিরন্তর ও দীর্ঘকালীন গণতান্ত্রিকীকরণের এক প্রক্রিয়ার শুরুয়াত। আমরা জনগোষ্ঠীর অভ্যন্তরের এই মর্মবস্তুকে আড়াল করে শুধুমাত্র একমাত্রিকভাবে বাইরের চাপের বিষয়কেই গুরুত্ত্ব দিয়েছি। চাপিয়ে দেওয়ার রাজনীতি নিশ্চিতভাবে গুরুত্ত্বপূর্ণ, কিন্তু অভ্যন্তরিণ গণতন্ত্রকে বিকশিত না করলে যে বাইরের চাপের কাছে প্রতিনিয়ত নতি স্বীকার করতে হয় – এই সাধারণ সত্য থেকে আমরা বিস্মৃত হয়েছি। ফলে একষট্টির আন্দোলনের বিষয়ও সফলতার মুখ দেখতে ব্যার্থ হয়েছে এবং নিরন্তর হয়ে চলেছে। এই বিফলতার স্বরূপটা কী?
(২) বাঙালি ও বাংলা ভাষার কথাই ধরা যাক। ভাষা যদি জনগোষ্ঠীয় ঐক্যের এক প্রধান মাধ্যম হয়, তাহলে এই ভাষার অন্তর্গত প্রতিটি সমাজ উক্ত ভাষার সাথে একটা যোগসূত্র খুঁজে পেতে পারতে হবে। অর্থাৎ প্রতিটি সমাজের মায়ের মুখের বুলি এক সাধারণ মায়ের ভাষায় রূপান্তরিত হতে হবে যাতে এই ভাষা সবার মাতৃভাষা হয়ে উঠে। কিন্তু মান্য ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার গঠন প্রক্রিয়ায় ফোর্ট-উইলিয়ামের মত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানের মুখ্য ভূমিকা থাকায় এলিট শ্রেণির সংস্কৃত প্রভাতযুক্ত ভাষায় রূপান্তরিত হয়। শ্রীচৈতন্য নিজে সিলেটি হয়েও সিলেটি বুলিকে অপবাদ অবহেলা করে যে ভাব-আন্দোলন করেন তাতে নদীয়ার আঞ্চলিক বুলি মান্য ভাষায় স্থান পায়। কিন্তু ব্রিটিশ কলোনিয়্যাল আধিপত্যবাদী স্বার্থের প্রভাব ও বৈষ্ণব ভাব-আন্দোলন বাংলা ভাষাকে বৃহত্তর বাঙালি সমাজ থেকে অনেক দূরে নিয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ দিয়ে শুরু করে পরবর্তীতে বাংলা ভাষার অনেক গণতান্ত্রিক পরিমার্জন পরিবর্ধন হয়েছে, কিন্তু এখনো বাঙালির ভাষা হিসেবে দাবি করা এই ভাষা সমগ্র বাঙালির মান্য ভাষা হয়ে উঠতে পারেনি। এই উপলন্ধি কিংবা তার বিকল্প উপলব্ধি থেকে মান্য ভাষার বিষয়কে কীভাবে বিচার করা যায়?
(৩) কৈবর্তদের মত সম্প্রদায় কিংবা মুসলমানি বুলি যখন মান্য বাংলার সাথে কোন যোগসূত্রই খুঁজে পায় না, তখন এটা ধরে নেওয়া যায় যে এই ভাষা সাম্প্রদায়িকতা ও বর্ণবাদের গণ্ডিকে অতিক্রম করতে পারেনি এবং আমাদের ভাষা জাতিয়তাবাদ অত্যন্ত দুর্বল ভিতের উপর দাঁড়িয়ে আছে। বাঙালি ভাষিক জাতিয়াবাদের দুর্বলতার স্বরূপ কী এবং এনিয়ে আমাদের কী করণীয়?
(৪) ভাষার সাথে গণ-শিক্ষার প্রশ্ন ও শিক্ষার অধিকারের প্রশ্নটি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। যখন বাংলা মান্য ভাষাটি সমগ্র বাঙালি সমাজের সাধারণ মাতৃভাষা হয়ে উঠতে পারেনি, তখন নিশ্চিতভাবে আমাদের এই ভাষার বিকাশের স্বার্থে এক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। যেহেতু ভাষার নির্মাণ সমাজের এক অভ্যন্তরিণ নিরন্তর জীবন্ত নির্মাণ, তাই গরিষ্ঠাংশ শিক্ষাবিহীন কোন সমাজের ভাষা ও ভাষিক ঐক্যও দূর্বল ও ভঙুর হতে বাধ্য। আবার যেহেতু মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষাগ্রহণ উৎকৃষ্ট ও কার্যকরী পদ্ধতি, তাই মুখের বুলিকে গুরুত্ত্ব দিয়েই আমাদেরকে পঠন পাঠনের ব্যবস্থা করা জরুরি। এই প্রক্রিয়ায় আমরা ধর্ম – বর্ণ বিভাজনের উর্ধে এবং সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের উর্ধে ভাষার ভিত্তিতে ঐক্যকে প্রসারিত করতে পারি এবং সবধরণের ভাষিক আধিপত্যবাদকে মোকাবিলা করার ভিত্তিভূমি তৈরি করতে পারি। বিশ্বায়নের প্রকোপকে মোকাবিলা ও ভাষিক জাতিয়তাবাদী ঐক্য কীভাবে করা যেতে পারে? বরাক উপত্যকার সমাজে শিক্ষা আন্দোলনের স্বরূপ কী হতে পারে?
(৫) ব্রিটিশ কলোনিয়্যাল প্রভাব থেকে ভাষাকে মুক্ত করেই ভাষার উপর যে বর্তমান বাজার সংস্কৃতির আগ্রাসন তার মোকাবিলার এক গণতান্ত্রিক পথ নির্মাণ করা সম্ভব। আমাদের একথা স্মরণে রাখা এবং একে উন্মোচিত করা জরুরি যে ব্রিটিশ কলোনিয়্যালিজম থেকে আজকের সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার মধ্যে এক ধারাবাহিকতা ও ছেদ দুটোই রয়েছে। ভাষাকে ও ভাষিক অধিকারকে বাঁচাতে গেলে আমাদেরকে ধারাবাহিকতার এই অন্তঃসলিলা ফল্গুধারা এবং মাঝেমধ্যে ভঙুর বাঁধ নির্মাণের প্রচেষ্টার অন্তর্নিহিত সূত্রগুলি আমাদের চর্চার বিষয় হয়ে উঠতে হবে। সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের দীর্ঘ ইতিহাসে ভাষা কীভাবে বিপন্ন হয়ে উঠছে?
এতো গেল বাংলা ভাষা ও বাঙালির গণতান্ত্রিকীকরণের বিষয়। এবার দেখা যাক আমাদের প্রতিবেশি অন্যান্য ভাষিকগোষ্ঠীদের ঐক্যের প্রশ্নটি –
(১) যে মাতৃভাষার আন্দোলনে একষট্টির বাঙালিরা যোগ দিল, সেই বাঙালির উত্তরসূরীরা বিভিন্ন ভাষিকগোষ্ঠীর ঐক্য গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এক যান্ত্রিক ঐক্যের কথা বলল বটে, কিন্তু কখনওই এক গঠনমূলক ও জীবন্ত ঐক্য গড়ে তোলার ক্ষেত্রে খুব বেশি সফল হল না। বরাক উপত্যকার বিভিন্ন ভাষিক গোষ্ঠীর ঐক্যের জন্য আমাদের কী করণীয়? অসমীয়া – বাঙালি ঐক্যও কোন পদ্ধতিতে গড়ে উঠতে পারে এবং সেক্ষেত্রে আমাদের কী করণীয়?
(২) বাঙালিদের প্রতিবেশি এক বিশাল জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষার অধিকারের প্রশ্নে বিশেষ কোন আগ্রহই দেখাল না। চা-বাগানে বসবাসকারী এই বিশাল জনগোষ্ঠীটি মাতৃভাষার অধিকারহীনতায় শিক্ষার আলোক থেকে বঞ্চিত হয়ে রইল। গণশিক্ষা ছাড়া যে কোন অঞ্চলেই গণতান্ত্রিক বাতাবরণ তৈরি হতে পারে না এই বাস্তব সত্যের প্রতি আমাদের অনীহা বরাক উপত্যকার জন্য দুর্ভাগ্য ডেকে আনল। উনিশের ঐতিহ্যের বাহক হিসেবে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় আনতে সক্ষম হলাম, ভাষা শহিদ স্টেশনও হয়ত একদিন হবে, আমরা আরও বহুবিধ দাবি উত্থাপন করলাম, কিন্তু ভিন জনগোষ্ঠীর দাবি ও অভিমানের প্রতি আমরা উদাসীন থাকলাম। চা-বাগানে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর জন্য শুধু মাতৃভাষার অধিকারের দাবি জানানোই যথেষ্ট নয়, উনিশের ঐতিহ্য আমাদেরকে যে আরও বিশাল কর্মকাণ্ডে জড়িত হওয়ার আহ্বান জানায় সেটা আমরা বিস্মৃত হলাম। বরাক উপত্যাকার বৃহৎ জনগোষ্ঠী হিসেবে অন্যান্যদের প্রতি আমাদের দায় অনেক – উনিশের ঐতিহ্য থেকে আমাদের সে দায়েরও উন্মোচন হোক আজকের আলোচনা থেকে। চা-বাগানে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর ভাষিক অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আমাদের ভাষিক-সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কীধরনের ভূমিকা নেওয়া উচিত?
তারিখ ঃ ১১-০৫-২০১৪। সময় ঃ সকাল ১০-৩০ টা]
প্রতিবারের ন্যায় ১৯শে মে ভাষা শহিদ দিবস হিসেবে এবারও পালিত হবে। আমরা সবাই, যারা এদিবসকে ঘটা করে পালন করতে প্রতিবছর সচেষ্ট থাকি, অত্যন্ত উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছি যে সেই দিবস পালন নেহাতই এক আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হচ্ছে এবং ভাষিক অধিকারের প্রশ্নে যে প্রাণশক্তি সমগ্র জাতিকে নাড়িয়ে দেয় তা ক্রমশঃই ক্ষীয়মাণ ও সংকীর্ণ বদ্ধজলায় আবদ্ধ হয়ে পড়ছে। আমাদের মনে হয় একষট্টির আন্দোলনের যে ঐতিহ্য আমাদেরকে নতুন পরিস্থিতিতে নতুনভাবে উজ্জীবিত করার কথা ছিল তা করতে না পারার পেছনে ঐতিহ্যকে পুননির্মাণ করার আমাদের উদ্যোগের অভাব দায়ি। এই ভাবনা থেকেই কোরাস এবার নির্দিষ্ট দিবসের পূর্বে ১১ মে, ২০১৪ তারিখে এই আলোচনা সভার আয়োজন করেছে যাতে ভাষা দিবস পালনে আমাদেরকে নতুনভাবে ভাবতে শেখার সূত্রপাত ঘটায়। এই আলোচনা সভায় আলোচকদের উদ্দেশ্যে প্রথামাফিক উদ্যোক্তাদের তরফ থেকে কিছু বিষয় তুলে ধরা হচ্ছে এবং কোরাস আশাবাদী এগুলির উপর ভিত্তি করে এই আলোচনাসভা নতুন দিক উন্মোচিত করার প্রক্রিয়া শুরু করতে সক্ষম হবে।
(১) একষট্টির আন্দোলন যদিও সীমাবদ্ধ ছিল রাজ্য ভাষা আইনের মাধ্যমে রাষ্ট্রের দ্বারা এক ভাষাকে অন্য ভাষাভাষীদের উপর চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে এক গণতান্ত্রিক প্রতিবাদের মধ্যে, কিন্তু তার অন্তর্বস্তুতে ছিল মাতৃভাষায় প্রশাসনিক কাজকর্ম ও পঠন পাঠনের অধিকারকে সাব্যস্ত করার নিরন্তর ও দীর্ঘকালীন গণতান্ত্রিকীকরণের এক প্রক্রিয়ার শুরুয়াত। আমরা জনগোষ্ঠীর অভ্যন্তরের এই মর্মবস্তুকে আড়াল করে শুধুমাত্র একমাত্রিকভাবে বাইরের চাপের বিষয়কেই গুরুত্ত্ব দিয়েছি। চাপিয়ে দেওয়ার রাজনীতি নিশ্চিতভাবে গুরুত্ত্বপূর্ণ, কিন্তু অভ্যন্তরিণ গণতন্ত্রকে বিকশিত না করলে যে বাইরের চাপের কাছে প্রতিনিয়ত নতি স্বীকার করতে হয় – এই সাধারণ সত্য থেকে আমরা বিস্মৃত হয়েছি। ফলে একষট্টির আন্দোলনের বিষয়ও সফলতার মুখ দেখতে ব্যার্থ হয়েছে এবং নিরন্তর হয়ে চলেছে। এই বিফলতার স্বরূপটা কী?
(২) বাঙালি ও বাংলা ভাষার কথাই ধরা যাক। ভাষা যদি জনগোষ্ঠীয় ঐক্যের এক প্রধান মাধ্যম হয়, তাহলে এই ভাষার অন্তর্গত প্রতিটি সমাজ উক্ত ভাষার সাথে একটা যোগসূত্র খুঁজে পেতে পারতে হবে। অর্থাৎ প্রতিটি সমাজের মায়ের মুখের বুলি এক সাধারণ মায়ের ভাষায় রূপান্তরিত হতে হবে যাতে এই ভাষা সবার মাতৃভাষা হয়ে উঠে। কিন্তু মান্য ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার গঠন প্রক্রিয়ায় ফোর্ট-উইলিয়ামের মত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানের মুখ্য ভূমিকা থাকায় এলিট শ্রেণির সংস্কৃত প্রভাতযুক্ত ভাষায় রূপান্তরিত হয়। শ্রীচৈতন্য নিজে সিলেটি হয়েও সিলেটি বুলিকে অপবাদ অবহেলা করে যে ভাব-আন্দোলন করেন তাতে নদীয়ার আঞ্চলিক বুলি মান্য ভাষায় স্থান পায়। কিন্তু ব্রিটিশ কলোনিয়্যাল আধিপত্যবাদী স্বার্থের প্রভাব ও বৈষ্ণব ভাব-আন্দোলন বাংলা ভাষাকে বৃহত্তর বাঙালি সমাজ থেকে অনেক দূরে নিয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ দিয়ে শুরু করে পরবর্তীতে বাংলা ভাষার অনেক গণতান্ত্রিক পরিমার্জন পরিবর্ধন হয়েছে, কিন্তু এখনো বাঙালির ভাষা হিসেবে দাবি করা এই ভাষা সমগ্র বাঙালির মান্য ভাষা হয়ে উঠতে পারেনি। এই উপলন্ধি কিংবা তার বিকল্প উপলব্ধি থেকে মান্য ভাষার বিষয়কে কীভাবে বিচার করা যায়?
(৩) কৈবর্তদের মত সম্প্রদায় কিংবা মুসলমানি বুলি যখন মান্য বাংলার সাথে কোন যোগসূত্রই খুঁজে পায় না, তখন এটা ধরে নেওয়া যায় যে এই ভাষা সাম্প্রদায়িকতা ও বর্ণবাদের গণ্ডিকে অতিক্রম করতে পারেনি এবং আমাদের ভাষা জাতিয়তাবাদ অত্যন্ত দুর্বল ভিতের উপর দাঁড়িয়ে আছে। বাঙালি ভাষিক জাতিয়াবাদের দুর্বলতার স্বরূপ কী এবং এনিয়ে আমাদের কী করণীয়?
(৪) ভাষার সাথে গণ-শিক্ষার প্রশ্ন ও শিক্ষার অধিকারের প্রশ্নটি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। যখন বাংলা মান্য ভাষাটি সমগ্র বাঙালি সমাজের সাধারণ মাতৃভাষা হয়ে উঠতে পারেনি, তখন নিশ্চিতভাবে আমাদের এই ভাষার বিকাশের স্বার্থে এক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। যেহেতু ভাষার নির্মাণ সমাজের এক অভ্যন্তরিণ নিরন্তর জীবন্ত নির্মাণ, তাই গরিষ্ঠাংশ শিক্ষাবিহীন কোন সমাজের ভাষা ও ভাষিক ঐক্যও দূর্বল ও ভঙুর হতে বাধ্য। আবার যেহেতু মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষাগ্রহণ উৎকৃষ্ট ও কার্যকরী পদ্ধতি, তাই মুখের বুলিকে গুরুত্ত্ব দিয়েই আমাদেরকে পঠন পাঠনের ব্যবস্থা করা জরুরি। এই প্রক্রিয়ায় আমরা ধর্ম – বর্ণ বিভাজনের উর্ধে এবং সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের উর্ধে ভাষার ভিত্তিতে ঐক্যকে প্রসারিত করতে পারি এবং সবধরণের ভাষিক আধিপত্যবাদকে মোকাবিলা করার ভিত্তিভূমি তৈরি করতে পারি। বিশ্বায়নের প্রকোপকে মোকাবিলা ও ভাষিক জাতিয়তাবাদী ঐক্য কীভাবে করা যেতে পারে? বরাক উপত্যকার সমাজে শিক্ষা আন্দোলনের স্বরূপ কী হতে পারে?
(৫) ব্রিটিশ কলোনিয়্যাল প্রভাব থেকে ভাষাকে মুক্ত করেই ভাষার উপর যে বর্তমান বাজার সংস্কৃতির আগ্রাসন তার মোকাবিলার এক গণতান্ত্রিক পথ নির্মাণ করা সম্ভব। আমাদের একথা স্মরণে রাখা এবং একে উন্মোচিত করা জরুরি যে ব্রিটিশ কলোনিয়্যালিজম থেকে আজকের সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার মধ্যে এক ধারাবাহিকতা ও ছেদ দুটোই রয়েছে। ভাষাকে ও ভাষিক অধিকারকে বাঁচাতে গেলে আমাদেরকে ধারাবাহিকতার এই অন্তঃসলিলা ফল্গুধারা এবং মাঝেমধ্যে ভঙুর বাঁধ নির্মাণের প্রচেষ্টার অন্তর্নিহিত সূত্রগুলি আমাদের চর্চার বিষয় হয়ে উঠতে হবে। সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের দীর্ঘ ইতিহাসে ভাষা কীভাবে বিপন্ন হয়ে উঠছে?
এতো গেল বাংলা ভাষা ও বাঙালির গণতান্ত্রিকীকরণের বিষয়। এবার দেখা যাক আমাদের প্রতিবেশি অন্যান্য ভাষিকগোষ্ঠীদের ঐক্যের প্রশ্নটি –
(১) যে মাতৃভাষার আন্দোলনে একষট্টির বাঙালিরা যোগ দিল, সেই বাঙালির উত্তরসূরীরা বিভিন্ন ভাষিকগোষ্ঠীর ঐক্য গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এক যান্ত্রিক ঐক্যের কথা বলল বটে, কিন্তু কখনওই এক গঠনমূলক ও জীবন্ত ঐক্য গড়ে তোলার ক্ষেত্রে খুব বেশি সফল হল না। বরাক উপত্যকার বিভিন্ন ভাষিক গোষ্ঠীর ঐক্যের জন্য আমাদের কী করণীয়? অসমীয়া – বাঙালি ঐক্যও কোন পদ্ধতিতে গড়ে উঠতে পারে এবং সেক্ষেত্রে আমাদের কী করণীয়?
(২) বাঙালিদের প্রতিবেশি এক বিশাল জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষার অধিকারের প্রশ্নে বিশেষ কোন আগ্রহই দেখাল না। চা-বাগানে বসবাসকারী এই বিশাল জনগোষ্ঠীটি মাতৃভাষার অধিকারহীনতায় শিক্ষার আলোক থেকে বঞ্চিত হয়ে রইল। গণশিক্ষা ছাড়া যে কোন অঞ্চলেই গণতান্ত্রিক বাতাবরণ তৈরি হতে পারে না এই বাস্তব সত্যের প্রতি আমাদের অনীহা বরাক উপত্যকার জন্য দুর্ভাগ্য ডেকে আনল। উনিশের ঐতিহ্যের বাহক হিসেবে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় আনতে সক্ষম হলাম, ভাষা শহিদ স্টেশনও হয়ত একদিন হবে, আমরা আরও বহুবিধ দাবি উত্থাপন করলাম, কিন্তু ভিন জনগোষ্ঠীর দাবি ও অভিমানের প্রতি আমরা উদাসীন থাকলাম। চা-বাগানে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর জন্য শুধু মাতৃভাষার অধিকারের দাবি জানানোই যথেষ্ট নয়, উনিশের ঐতিহ্য আমাদেরকে যে আরও বিশাল কর্মকাণ্ডে জড়িত হওয়ার আহ্বান জানায় সেটা আমরা বিস্মৃত হলাম। বরাক উপত্যাকার বৃহৎ জনগোষ্ঠী হিসেবে অন্যান্যদের প্রতি আমাদের দায় অনেক – উনিশের ঐতিহ্য থেকে আমাদের সে দায়েরও উন্মোচন হোক আজকের আলোচনা থেকে। চা-বাগানে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর ভাষিক অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আমাদের ভাষিক-সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কীধরনের ভূমিকা নেওয়া উচিত?
আধিপত্যবাদ ও উনিশের ঐতিহ্য
Posted by স্বাভিমান Labels: আসাম, বরাক উপত্যকা, ভাষা দিবস, মার্ক্সবাদ, সংখ্যালঘু১৮ মে, ২০১৪ যুগশঙ্খ |
অসমীয়া মধ্যশ্রেণির বোধোদয় ও বাঙালি উদারতা
সম্প্রতি বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ও অসমীয়া মধ্যশ্রেণির ইতিহাস নিয়ে মূল্যবান গ্রন্থের লেখক ড০ প্রফুল্ল মহন্তের একটি নিবন্ধ বেরিয়েছে অসমীয়া এক দৈনিক কাগজে। এই নিবন্ধে লেখক অসমীয়া জাতি গঠন প্রক্রিয়া থেকে জনজাতীয়দের দূরে ঠেলে দিয়ে অসমীয়া জাতির ধ্বংস ডেকে আনার জন্য অসম সাহিত্য সভা, কংগ্রেস সরকার ও অসমীয়া বর্ণহিন্দু সমাজকে দায়ি করেছেন। গণতন্ত্রের প্রতি এই সজাগতা তার স্বাভাবিক নিয়মে আরও নতুন গঠনমূলক দিক উন্মোচিত করে। এই লেখাটি আসলে অসম সাহিত্য সভার কোন এক অধিবেশনে তাঁর প্রদত্ত ভাষণের সংক্ষিপ্ত রূপ। অসম সাহিত্য সভার মত এক জনপ্রিয় অসমীয়া জাতির প্রতিনিধিত্বকারী একটি প্রতিষ্ঠানে এধরনের খোলাখুলি বক্তব্য পেশ এটাই দেখায় যে আসামের উগ্রজাতিয়তাবাদের দীর্ঘ ইতিহাস অসমীয়া জাতিরও যে সমূহ ক্ষতি সাধন করেছে এই উপলব্ধি অসমীয়া মধ্যশ্রেণির মননে জায়গা করে নিচ্ছে। সাম্প্রদায়িকতাকে আশ্রয় করেই যে উগ্রজাতিয়তাবাদ তার বিষবাষ্প ছড়াচ্ছে এই উপলব্ধি গড়ে ওঠা জরুরি এবং তার থেকেও জরুরি একে প্রতিহত করার কর্মপদ্ধতি প্রণয়ন করা। তবে এই মধ্য শ্রেণির বুদ্ধিজীবীদের উদ্যোগেই আসামের উগ্রজাতিয়তাবাদী ইতিহাসের লুক্কায়িত তথ্যগুলি একে একে উন্মোচিত হয়ে চলেছে। অন্য জাতির কল্যাণ সুনিশ্চিত না করে কোন জাতি নিজের কল্যাণ সুনিশ্চিত করতে পারে না – এটাই মানব সভ্যতার অমোঘ নিয়ম। কিন্তু ইতিহাসের করুণ পরিহাস এই যে আসামকে বধ্যভূমি করে তুলে, আসামের উগ্রজাতিয়তাবাদী ইতিহাসে বাঙালি বিশেষ করে বাঙালি মুসলমানদের লাগাতার গণহত্যার মুখে ঠেলে দিয়ে মানব সভ্যতার এই শিক্ষা নিতে হচ্ছে। এই শিক্ষা কতটা গভীর তার প্রমাণ পাওয়ার জন্য আমাদের ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে। কিন্তু নিবন্ধের লেখক যদি আরও একটু পেছন দিকে তাকাতেন তাহলে কী তিনি বাঙালির উদারতা - মহৎ আবেগপ্রবণতাকে আবিষ্কার করতেন, না তিনিও আঁতকে উঠতেন কলকাতার বাঙালি হিন্দু ভদ্রলোক মধ্যশ্রেণির ভূমিকার কলঙ্কিত অধ্যায়কে দেখে। এই আঁতকে উঠার কাহিনী নিশ্চিতভাবে একমাত্রিক নয়, এই শ্রেণির অভ্যন্তরেই তার প্রতিকল্প নির্মাণের প্রয়াস নিরন্তর অব্যাহত ছিল। কিন্তু যা প্রাধাণ্যকারী ভূমিকায় ছিল তা আঁতকে ওঠার মতই বৈকি।
ব্রিটিশ প্রভাবান্বিত বাংলার ভাষিক-সাংস্কৃতিক নির্মাণ
ইতিহাস ব্যাখ্যার পদ্ধতির প্রভূত উন্নতির পরও অতীত ও চলমান ঘটনাকে কিছু লক্ষণ ও তথ্য দিয়ে চিহ্নিত করার প্রবণতা সাধারণকে আচ্ছন্ন করে রাখে – বিশেষ করে বরাক উপত্যকার মত অঞ্চলে যেখানে ইতিহাস চর্চা বেশিদূর অগ্রসর হয়নি। কিন্তু পরিচিতি ও সংস্কৃতির বলয়কে চেনার জন্য শুধুমাত্র চর্চার অভ্যন্তরিণ কাঠামোর দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে চলে না, ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া যার মধ্য দিয়ে এই চর্চা নির্মিত হয়েছে তার দিকেও তাকাতে হয়। ব্রিটিশ কলোনিয়্যাল শাসকদের বাংলায় পদার্পণ ও কলকাতায় প্রথম রাজধানী গড়ে ওঠা বাংলার ভাষা-সংস্কৃতিকে ইতিহাসের অমোঘ নিয়মে ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছে। উপনিবেশিক শাসনের ছত্রছায়ায় ও মদতে অতীত সাবলিল বাঙালি সমাজ গঠনের প্রক্রিয়ায় ছেদ ঘটিয়ে ভাষা-সংস্কৃতির যে নতুন বয়ান তৈরি হয় তাকে খণ্ডন করার প্রভূত প্রয়াস সত্ত্বেও বাঙালির হিন্দু ভদ্রলোক মধ্যশ্রেণির মননকে এখনও এই বয়ান আচ্ছন্ন করে রেখেছে। তাই এখনও যখন মধ্যযুগকে অন্ধকারময় ও যে সময়ে অসমীয়া জাতিয় চেতনা গড়ে ওঠেনি সেসময়কার অসমীয়াদের প্রতি কলকাতার বাঙালি ব্যক্তিত্ত্বের ভূমিকা ও অবদানকে বাঙালির উদারতার লক্ষণ হিসেবে যখন বরাকের কোন বুদ্ধিজীবী উল্লেখ করেন, তখন মর্মাহত হতে হয় বৈকি। কারণ এভাবে দেখার মধ্যে ব্রিটিশ প্রভাবে কলকাতার বাঙালি হিন্দু ভদ্রলোক শ্রেণির সাম্প্রদায়িকতা ও জাতিদাম্ভিকতার সংমিশ্রণে নির্মিত রেঁনেসার বয়ানেরই পুনরুল্লেখ হিসেবে প্রতিভাত হয়। যদুনাথ সরকারের মত ইতিহাসবিদ এই প্রভাবেই জটিল ইতিহাসকে অতি-সরলিকরণ করেছিলেন এবং ব্রিটিশ শাসনের উচ্ছসিত প্রশংসা করেছিলেন। ১৭৭০ সালের বাংলার দুর্ভিক্ষকে এঁরা ক্লাইভ ও ওয়ারেন হেস্টিংসের নীতির মাধ্যমে লুণ্ঠনের রাজত্বকে কখনও দায়ি করেননি। ব্রিটিশ রাজত্বকে কল্যাণকামী হিসেবে দেখার মধ্য দিয়েই জাতিয়তাবাদী রাজনীতির সাথে এক বড়সড় বিচ্ছেদ রেখা টানা হয়। এখান থেকেই নির্মিত হতে থাকে ভদ্দরলোকি আদবকায়দা, হিন্দু সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠতা, মুসলমানদের অপর ভাবা, ভাষাকে মুসলিম প্রভাব মুক্ত করা ইত্যাদিকে আশ্রয় করে নতুন ভাষিক-সাংস্কৃতিক বয়ান। এর পেছনে ছিল এই শ্রেণির জমিদার-মহাজনী স্বার্থের ভাবাবেগ এবং এজন্য এরা কৃষকদের উপর হওয়া কোন অত্যাচারকেই দেখতে অপারগ ছিলেন। তবে এর বিরুদ্ধ বয়ানও এই শ্রেণিভুক্ত কিছু বুদ্ধিজীবীরা নির্মাণ করেছিলেন, কিন্তু এরা কখনওই প্রাধান্য বিস্তার করতে পারেননি। ১৯৩৭ সালে অষ্ট্রীয়া থেকে এক লেখায় সুভাষ বোস ভারতীয় ইতিহাসে ‘মুসলিম যুগের’ উল্লেখের বিরোধিতা করেছিলেন এবং পলাশির যুদ্ধকে সাধারণ শত্রুর বিরুদ্ধে হিন্দু-মুসলিমের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। বাংলা বিভাজনের ক্ষেত্রে এই বর্ণহিন্দু ভদ্রলোক শ্রেণির ভূমিকাই যে নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করেছে তা ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রিনিটি কলেজের অধ্যাপক জয়া চাটার্যি তাঁর বেঙ্গল ডিভাইডেড গ্রন্থে। তাদের আধিপত্য কায়েম করতে তারা বাংলা বিভাজনকে কায়মনোবাক্যে চাইছিলেন, এর বিনিময়ে রাজধানী দিল্লিতে স্থানান্তরণেও তাদের আপত্তি ছিল না। সি আর দাশের প্রজা-কৃষক পার্টিকে তারা হেয়র চোখে দেখতেন এবং পরবর্তীতে বাংলা বিভাজন রোখার জন্য শরৎ বোস ও আবুল হাসিমের প্রস্তাবকেও তারা আমল দেয়নি। ব্রিটিশ শাসনের আশ্রয়ে এই শ্রেণিটি যে কীভাবে সম্পদশালী হয়ে উঠেছে এবং নিম্নবর্ণীয়দের অধিকারের প্রতি উদাসীন থেকেছে তার ব্যাখ্যা পাই আমরা ইতিহাসবিদ শেখর বন্দোপাধ্যায়ের কাস্ট, পলিটিকস অ্যাণ্ড দ্য রাজ গ্রন্থে। মুগল আমলে প্রতিপত্তিশালী কৈবর্ত জমিদার ও স্বচ্ছল কৈবর্ত সমাজের সন্ধান পাওয়া যায় মেদিনীপুর অঞ্চলে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত যে নতুন মধ্যশ্রেণির সৃষ্টি করে তাতে নিম্নবর্ণীয়রা চিরতরে অধিকারহীন ব্রাত্যতে পর্যবসিত হন। ব্রিটিশদের প্রতি এই নব্য-মধ্যশ্রেণির আনুগত্য ও মুসলিম ও নিম্নবর্ণীয় কৃষক প্রজাদের প্রতি তাদের অবজ্ঞার কারণটি এভাবেই বোঝা যায়। সুতরাং অসমীয়া জাতিয় চেতনা যখন বিকশিতই হয়নি তখন কিছু সংখ্যক বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের অসমীয়াদের প্রতি উদারতার সাথে ব্রিটিশ আনুগত্যে নির্মিত মতাদর্শের কোন বিরোধ ছিল না। তাই এই উদারতার নিদর্শনে আমাদের পুলকিত হওয়ার কিছু নেই। তবে বাংলার কায়স্থ সমাজটি যে হিন্দি বলয়ের মত গঠিত হয়নি, তা গঠিত হয়েছিল করণিক শ্রেণি থেকে, যাদেরকে মনু উল্লেখ করেছিলেন ব্রাত্য-কায়স্থ হিসেবে, তা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক চিত্রলেখা গুপ্ত তাঁর দ্য কায়স্থ – এ স্টাডি ইন দ্য ফর্মেশন অ্যাণ্ড আরলি হিস্টরি অব এ কাস্ট গ্রন্থে দেখিয়েছেন। এটা সম্ভবত একটা কারণ যে উপরিকাঠামোয় বাঙালি বর্ণহিন্দু সাম্প্রদায়িকতার মধ্যে একটা নমনীয়তাও ছিল এবং এদের মধ্য থেকেই বিরোধিতাও উঠে এসেছিল, কিন্তু সেই বয়ান কখনওই প্রাধান্যকারী অবস্থান নিতে পারেনি। ভাষা নিয়ে বাঙালির আবেগকে বিশিষ্টতা দেওয়ার প্রবণতার মধ্যেও খামতি রয়েছে। দেশ-রাষ্ট্রের সীমানাবিহীন ভাষিকগোষ্ঠী ভাষাকেই আবেগের বহিঃপ্রকাশের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে, দেশ-রাষ্ট্র সুনির্দিষ্ট হয়ে গেলে ভাষা ও দেশের আবেগ এক জায়গায় মিলে যায়। ভাষিক আবেগ যে গোষ্ঠী আবেগ ও স্বার্থের সীমানা অতিক্রম করেনি বাংলা বিভাজনের ইতিহাসই তার প্রমাণ। এবার বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলনের সমস্যা নিয়ে কিছু কথা বলে নেওয়া যাক।
নতুন পরিস্থিতিতে উনিশের ঐতিহ্যের পুনর্নিমাণ
বরাক উপত্যকায় গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে প্রধান প্রতিবন্ধকতা যে সাম্প্রদায়িকতা একথা যে কোন পর্যবেক্ষকই স্বীকার করবেন। বরাক উপত্যকার বাঙালিরা বঞ্চিত এবং তাদের ভাষাও অন্যান্য ভাষাগোষ্ঠীর মত আক্রান্ত। কিন্তু ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালিরাই আক্রান্ত। এই আক্রান্তরা পরিচিতির দিক দিয়ে মূলতঃ বাঙালি-মুসলমান হওয়ায় এখানকার ভাষা-সচেতন বাঙালি হিন্দু সমাজ কি আক্রমণকারীদের মিথ্যা ভাষণের প্রতি আকর্ষণ বোধ করে না? নিম্ন অসমের অধিবাসীদের উপর নির্বিচারে বাংলাদেশি তকমা সেঁটে দিয়ে প্রকারান্তরে হত্যালীলাকেও কি বৈধতা দেওয়া হয় না? এভাবেই তৈরি হয় আক্রান্তদের মধ্যেই আক্রমণকারীর মানসিকতা যে মানসিকতার বশবর্তী হয়েই ভাষা আন্দোলনে শহিদত্ব বরণ করা এই বড়ো জনগোষ্ঠীর সন্ত্রাসবাদীরা আজ হত্যার রাজনীতি করছে। শাসক শ্রেণির বঞ্চনা ও মতাদর্শের কাঠামোটি এতই সর্বগ্রাসী ও সুক্ষ্ম যে তা এক বঞ্চিতদের অপরের বিরুদ্ধ লেলিয়ে দিতে পারে। এখানে রাষ্ট্র কাকে মদত দিচ্ছে সেটাই গুরুত্বপূর্ণ কারণ রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদতেই আক্রান্তরা আক্রমণকারী হয়ে উঠতে পারে। সাম্প্রদায়িক মতাদর্শ নিজের জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে রাষ্ট্রের এই মদত গ্রহণ করতে প্রস্তুত করে রাখে। মতাদর্শের এই প্রতিবন্ধকতাকে দূর করতে না পারার ক্ষেত্র তৈরি হয় চিন্তা ও কাজের দৈন্যতা থেকে। চিন্তা ও কাজ পরস্পর সম্পৃক্ত। কিছু পূর্বধারণা, কিছু প্রতীক, কিছু প্রচলিত বয়ানকে স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে ধরে নিয়ে মস্তিষ্কের রসায়নকে নিয়ন্ত্রণ করলে কিছু স্টিরিওটাইপ তৈরি হয়। যে প্রতিবেশিকে বাস্তবে দেখা হলো না, আবার যদি বা দেখা হলো তাকে জানার চেষ্টা করা হলো না, কিন্তু তার সম্বন্ধে একটা মত তৈরি করে নেওয়া হলো। এভাবে যে মতটি নিজের বলে ভাবা হলো তা আসলে প্রচলিত আধিপত্যকারী মত। এভাবেই শাসক শ্রেণি তার বয়ানকে চাপিয়ে দেয় এবং মস্তিষ্ককে নিয়ন্ত্রণ করে। তাই মধ্যবিত্ত শ্রেণি হিসেবে আধিপত্য বিস্তার করার সুপ্ত স্পৃহার বাস্তবায়নের সহজ পথ খুঁজে নেওয়া হয় শাসক শ্রেণির সাম্প্রদায়িক হাতিয়ারের মধ্যে যেখানে কিছু সংখ্যককে অপর বানিয়ে একটি ধর্মীয় বয়ানে অন্যদের উপর আধিপত্য স্থাপন করা যায়। বরাকের মধ্যবিত্ত শ্রেণির চিন্তার উপর এই সাম্প্রদায়িক মতাদর্শের আধিপত্য বিস্তারের আরেকটি সুবিধে রয়েছে। যেহেতু বরাক উপত্যকার বিশেষ করে শিলচরের শিক্ষিত মধ্যশ্রেণিটি মূলতঃ তৈরি হয়েছে তাদের দিয়ে যারা ছিন্নমূল হয়ে এখানে এসেছিলেন। সুতরাং ছিন্নমূল হওয়ার মর্মবেদনা এবং অতীত সচ্ছলতা হারানোর স্মৃতিতে আচ্ছন্ন হয়ে চোখে দেখা, বাস্তব অভিজ্ঞতা বা অভিজ্ঞতার কাহিনী শোনা আংশিক ঘটনাকে তারা সাধারণীকরণ করে ফেলেন এবং তাদের অপরকে খুঁজে পান। সাম্প্রদায়িকতার এই সুবিধা দূর করতে পারে নির্মোহ ইতিহাস চর্চা। বরাক উপত্যকার শিক্ষিত সমাজ হিসেবে আমরা এব্যাপারে বড্ডই স্থাণু। একষট্টির ভাষা আন্দোলন গণতান্ত্রিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার ও বরাকের সমাজে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত শ্রেণির শেকড় প্রোথিত করার এক নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছিল। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা ও বর্ণবাদের গণ্ডী অতিক্রম করে আম কৃষক-জনতার মধ্যে কোন যোগসূত্র স্থাপনের প্রচেষ্টা নেওয়া হলো না। ফলে একদিকে বামপন্থী কৃষক আন্দোলন যেখানে নিম্ন শ্রেণির হিন্দু-মুসলমানরা সমাবেশিত হয়েছিলেন এবং ভাষা আন্দোলন যেখানে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি সমাবেশিত হয়েছিলেন উভয়ই পরাস্ত হলো। পরাজয়ের এক দীর্ঘম্যাদী পথ বেয়ে একানব্বইতে এসে সবাই হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির কাছে আশ্রয় নিল। সুতরাং নতুন গণতান্ত্রিক নির্মাণে আমাদের এই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু এই শিক্ষা নেওয়ার সময় আমাদের একথা মাথায় রাখা জরুরি যে আশির দশক থেকে বিশ্বায়নের অঙ্গ হিসেবে যে কাঠামোগত পুনর্গঠণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে তাতে বরাকের সমাজের অনেক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। বিশুদ্ধ কৃষকের সংখ্যা বরাকের গ্রামাঞ্চলে এখন খুবই সীমিত – কৃষকরা একাধারে শ্রমিকও। তাই ভাষা-পরিচিতির অধিকার,জনগোষ্ঠীগত অধিকার ও শ্রমিক শ্রেণির অধিকারের প্রশ্নে আমাদের যুগপৎভাবে হস্তক্ষেপ করতে হবে। এবারের উনিশ হোক এই পর্যালোচনা শুরু করার দিন।
Subscribe to:
Posts (Atom)