ফোরাম
ফর সোশ্যাল হারমনি, কোরাস ও উধারবন্দ সিনে ক্লাবের একটি উদ্যোগে
ফোরাম ফর
সোশ্যাল হারমনি একটি মুক্ত মঞ্চ
, গণতন্ত্র-সামাজিক ন্যায় - বৈচিত্র্য ও বহু মতের সুস্থ
বিকাশের পক্ষে এবং নয়া উদারবাদী অর্থনীতি ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে একটি খোলা
মঞ্চ। সবার কথা শুনতে চাওয়া ও নিজের কথা বলতে চাওয়ার ফোরামের এই স্পিরিট থেকেই ‘বাস্তার
সলিডারিটি নেটওয়ার্ক’-এর দুই বক্তাকে ছত্তিশগড়ের চলমান ঘটনা ও ইতিহাস নিয়ে তাদের
অভিজ্ঞতা ও মতামত তুলে ধরার সুযোগ করে দিতে আজ অর্থাৎ ১৩ আগস্ট, ২০১৭ শিলচরে এক
আলোচনা সভার আয়োজন করেছিল ফোরাম। তাদের আলোচনা সবাই মনোযোগ দিয়ে শুনেছে ও
শ্রোতাদের তরফ থেকে বিভিন্ন প্রশ্ন উঠে এসেছে। আলোচনার
একটি সংক্ষিপ্ত বয়ান ও এর তাৎপর্য এখানে তুলে ধরার উদ্দেশ্যেই এই প্রতিবেদন।
তাৎপর্য ব্যাখ্যা করার সুবিধার্থে আলোচনায় উঠে না আসা কিছু বক্তব্য এখানে সংযোজন
করা হয়েছে।
বাস্তার
অঞ্চলে গোণ্ড উপজাতিরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং গবেষকদের মতে
সিন্ধু
সভ্যতার সাথে গোণ্ডদের যোগসূত্র রয়েছে। সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসের কারণ নিয়ে বিভিন্ন
মত রয়েছে, জেনেটিক্স সায়েন্সের ভিত্তিতে গবেষণাকে হাতিয়ার করে কেউ কেউ
প্রাকৃতিক দুর্যোগকেই কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেন। সে যাই হউক, গোণ্ডরা
ভারতের আদি বাসিন্দা এবং সেই দৃষ্টিকোণ থেকে আদিবাসীদের পরিচিতি ও নিজস্ব শাসন
প্রণালীর স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখা ও জল-জমিন-জঙ্গলের উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ বজায়
রাখার প্রশ্ন উন্নয়নের প্রাথমিক শর্ত হিসেবে স্বাভাবিক ভাবেই আলোচনায় উঠে এসেছে।
এই স্বতন্ত্রতার বোধ থেকেই জন্ম নিয়েছিল কোল-ভিল-সাঁওতাল-ওরাং- ভূমিজ-গোণ্ডদের
ব্রিটিশ বিরোধী বিদ্রোহ। গুণ্ডা ধুর ছিলেন গোণ্ডদের সেরকমই একজন বিদ্রোহী নায়ক। পরিচিতির
এই স্বাতন্ত্র্যের স্পৃহাকে দমিয়ে দিতে ও আসাম সহ বিভিন্ন অঞ্চলে গড়ে উঠা
চা-বাগানে এদেরকে সস্তা মজুর হিসেবে নিয়োগ করতে এদেরকে আড়কাঠির মাধ্যমে নিয়ে আসার
সময়ে অত্যাচারের করুণ কাহিনী দাস বাণিজ্যে আফ্রিকান নিগ্রোদের উপর অত্যাচারকেও হার
মানায়। শুরুতে চা-শিল্পে নিয়োজিত চীনা শ্রমিক ও পরে স্থানীয় জনজাতীয় শ্রমিকদের
বিদ্রোহী মনোভাবের জন্যই মালিকদের অনুগত এই নব্য দাস শ্রমিকদের ব্রিটিশ চা-শিল্পে
নিয়ে আসে। তবে কোল-ভিল-সাঁওতাল-ওরাং- ভূমিজ ইত্যাদির তুলনায় আসামের চা-শিল্পে গোণ্ডদের
সংখ্যা সম্ভবত নগণ্য। বাস্তার অঞ্চলের গোণ্ড সহ মধ্য ভারতের আদিবাসীদের উপর
রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন বৃদ্ধি পায় স্বাধীনতা-উত্তর পর্যায়ে যখন শিল্পায়নের জন্য প্রয়োজন
পড়ে খনিজ সম্পদের। বায়লাডিলা খনির নামের সাথে আমাদের এই অঞ্চলের বাসিন্দারা
পরিচিত। বাস্তার অঞ্চলের জমির নিচের খনিজ সম্পদ লুটের জন্য প্রয়োজন সেই জমির দখল
নেওয়া ও তার জন্য প্রয়োজন জঙ্গল ধ্বংস ও জমির উপর বসবাসকারী মানুষদের উচ্ছেদ।
বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানি ও তাদের ভারতীয় পুঁজিপতি সাগরেদদের স্বার্থেই এটা ছিল
প্রয়োজনীয়। স্বাভাবিকভাবেই জল-জমিন-জঙ্গলের অধিকার বজায় রাখতে আদিবাসীরা প্রতিরোধ
করবে এবং সেই প্রতিরোধ যত তীব্র হবে তাকে দমন করতে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস তত তীব্র
হবে। স্বাধীন ভারতে নির্লজ্জ নৃশংস রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের এক করুণ কাহিনী রয়েছে
সেখানে। এটাই হচ্ছে বাসটার অঞ্চলের মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নিজস্ব স্বাতন্ত্র্য বজায়
রেখে উন্নয়নের ধারণাকে বানচাল করে দেওয়ার রাষ্ট্রীয় আয়োজন। উদারবাদী অর্থনীতির
সাথে সামঞ্জস্য রেখে বিভিন্ন প্রদেশে ‘সেজ’ অঞ্চল গড়ে উঠছে যেখানে হাজার হাজার মানুষ উচ্ছেদ হয়েছেন এবং
পুঁজির অবাধ লুণ্ঠনের সুযোগ তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মত কিছু কিছু
ক্ষেত্রে মানুষের প্রতিরোধের সীমিত বিজয়ও অবশ্য আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। বর্তমানে
গোণ্ডদের স্বার্থে প্রচলিত যে জমি বিক্রির আইন রয়েছে সেটাকেও ছত্তিসগড় সরকার তুলে
নিতে চাইছে। এই চিত্র থেকে নাগরিক সমাজের করণীয় কর্তব্য নির্ধারণ করা যায়। কিন্তু গোল বাধে যখন এই বাস্তবতাকে প্রসারিত
করে এমন কিছু সিদ্ধান্তে যাওয়া হয় যা অতিকথন বলেই মনে হয়।
প্রথমে
বিবেচনা করা যাক আদিবাসীদের প্রতিরোধ সংগ্রামের প্রশ্নটি।
কোন কোন
মহল বলতে চান যে বাস্তার অঞ্চলে রাষ্ট্র ও জনগণের মধ্যে যুদ্ধ চলছে। আমরা জানি যে
যুদ্ধ হচ্ছে রাজনীতির ধারাবাহিকতার পরিণতি। জনগণের যুদ্ধ এমন একটি চেতনার প্রকাশ
যেখানে সেই নির্দিষ্ট জনগণ নিজের সংকীর্ণ গোষ্ঠী স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে সব
নিপীড়িতের হয়ে লড়াই করার চেতনায় উপনীত হয়েছেন এবং সে যায়গায় লড়াইয়ের ধারাবাহিকতা
থেকে শিক্ষা নিয়ে একটি অভ্যুত্থানের পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। সেই চেতনায় উপনীত হওয়া
একটি সরলরেখায় ঘটে না, এক আঁকাবাঁকা পথে ঘটে। বাস্তার অঞ্চলে সেই চেতনায় উপনীত
হওয়ার কোনো নজির নেই। বরঞ্চ আদিবাসী চেতনা যে প্রতিক্রিয়াশীল ধারায় বিকশিত হতে
পারে তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ আসামের বড়ো আন্দোলন বা আসাম আন্দোলনের খিলঞ্জিয়া চেতনা।
এই দু’টি আন্দোলনই
প্রথমে গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবিতে শুরু হয় এবং অবড়ো –অনসমীয়াদের
জাতি-নির্মূলিকরণের নৃশংসতায় পর্যবসিত হয়। কারণ আদিবাসী – খিলঞ্জিয়া
চেতনার অভ্যন্তরেই বহিষ্করণের বা অপর জনগোষ্ঠীকে আলাদা করার অন্তর্বস্তু নিহিত
রয়েছে। এই দু’টি
আন্দোলনের ক্ষেত্রেই আমরা প্রতিক্রিয়াশীল পশ্চাদগমন প্রত্যক্ষ করেছি। সুতরাং রাষ্ট্রীয় অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রামকে যুদ্ধ
হিসেবে দেখা একধরনের রোমান্টিক ভ্রান্তি।
ভারতবর্ষের
কিছু কিছু প্রান্তিক বা জঙ্গলাকীর্ণ অঞ্চলে রাষ্ট্রীয় গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের
উপস্থিতি অত্যন্ত দুর্বল এবং বিকৃত উন্নয়নের মডেলের বশবর্তী হয়ে সেই দুর্বল
উপস্থিতিকেও ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছে। কিন্তু তার থেকে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় না
যে ভারতবর্ষে যেটুকু সাংবিধানিক গণতন্ত্র রয়েছে তাকে রক্ষা করার দায়িত্ব মেহনতি
মানুষের নেই। একটা কথা মনে রাখা দরকার যে বুর্জোয়াদের কখনওই কোনো গণতন্ত্রের
প্রজেক্ট ছিল না, পুঁজিবাদের আসল লক্ষ্যই মুনাফা ও সঞ্চয়ন (profit and accumulation)। যেটুকু গণতান্ত্রিক
অধিকার পাওয়া যায় সেটা মেহনতি মানুষের লড়াইয়ের সাথে পুঁজির রফা, কারণ ততটুকু
গণতন্ত্রই বিকশিত হয় যতটুকু না দিলে পুঁজির শোষণের নিয়মকে চালু রাখা সম্ভব নয় বলে
বুর্জোয়াদের কাছে বিবেচিত হয়। ভারতবর্ষের ক্ষেত্রেও সেটা ব্যতিক্রম নয়। স্বাধীন
ভারতের রাষ্ট্র নির্মাণের প্রেক্ষিত ছিল স্বাধীনতা আন্দোলনের মাধ্যমে বিকশিত
মানুষের আকাঙ্ক্ষা ও দেশভাগের মাধ্যমে মানুষের সংগ্রামের পরাজয়। এই প্রেক্ষিতে
রাষ্ট্র পরিচালকরা গণতন্ত্র –সামাজিক ন্যায় – অসম বিকাশ দূর করা এই গুলিকে স্বাধীন দেশ করার লক্ষ্য
হিসেবে রেখেছিলেন, আবার এই লক্ষ্যগুলি থেকে বিচ্যুতি ছিল অন্তর্নিহিত।
গণতন্ত্রের প্রশ্নে আমরা একটা সাংবিধানিক অধিকার - নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি -
ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের ব্যবস্থা পাই, আবার জনগোষ্ঠীগত স্বাধিকার ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার না
দেওয়া – ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠন হলেও ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন – অর্থ ও
ক্ষমতায় প্রভাবিত একটি নির্বাচনী ব্যবস্থা পাই। সামাজিক ন্যায়ের ক্ষেত্রে তপসিলই
জাতি-জনজাতির বিশেষাধিকার মেনে নিলেও সংখ্যালঘুর বিশেষাধিকারের সাংবিধানিক
রক্ষাকবচের যে প্রশ্ন কংগ্রেসের অভ্যন্তরেই উত্থাপিত হয়েছিল তাকে দেশভাগের
সাম্প্রদায়িক বাতাবরণকে কাজে লাগিয়ে বাতিল করে দেওয়া হয়, শুধুমাত্র
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার অধিকার দেওয়া হয়। উৎপাদনী নীতিতে আমদানি
প্রতিস্থাপনের (import substitution) নীতি নেওয়া
হলেও ভারী শিল্পের উপর গুরুত্ব দিয়ে সেটাকে আমদানীকৃত বিদেশি প্রযুক্তির উপর
নির্ভরশীল করে তোলা হয়। পরিকল্পনাভিত্তিক সরকারি ব্যয়ের মাধ্যমে অসম বিকাশকে দূর
করার উদ্দেশ্যও তাতে বাধা প্রাপ্ত হয়। অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদী পুঁজি নির্ভর এক
বিকাশের পথ অনুসরণ করা হয় যে নীতিতে জাতি-বর্ণ ও পরিচিতির বিভাজনকে কাজে লাগিয়ে
মজুরিকে নিচে নামিয়ে রাখা ও আম-জনতার আয়কে নিচে নামিয়ে রাখা হয়। তাতে অভ্যন্তরীণ
চাহিদা সংকুচিত থাকায় দেশীয় শিল্পায়নের বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয়। এরকম একটা ব্যবস্থার
মধ্য দিয়ে স্বাধীন ভারত মেহনতি মানুষের সংগ্রামের মাত্রার সাথে তাল মিলিয়ে পরিবর্ধন
পরিবর্তন হতে থাকে। কিন্তু পরনির্ভর বিকাশের এই মডেলে আমদানি-রপ্তানির ভারসাম্য
নষ্ট হওয়ার ফলে বাণিজ্য ঘাটতি ও মেহনতি মানুষের আন্দোলনের পরাজয়ের ফলেই আশির দশক
থেকে ও সরকারিভাবে ৯১ সালে নিও-লিবারেল ইকোনমিক পলিসির কাছে ভারতবর্ষ আত্মসমর্পণ
করে। বিশ্বে প্রযুক্তির আবিষ্কারের সাথে তাল মিলিয়ে উন্নয়নের কেন্দ্র বদলেছে বিহার
থেকে মুম্বাই হয়ে ম্যাঙ্গালোরে। অতীতে প্রযুক্তির আবিষ্কার যে কর্মসংস্থানের সুযোগ
তৈরি করত, এখন সাইবারনেটিক্স ও এরপর রবোটিক্সের নতুন প্রযুক্তি
কর্মসংকোচন ঘটাচ্ছে বিশ্বব্যাপী, চলছে গণহারে ছাটাই। রপ্তানি নির্ভর অর্থনীতি চালু হয়েছে, রাষ্ট্রীয়
মালিকানাকে অস্বীকার করে সবকিছুকে এমনকি বিত্তীয় ক্ষেত্রকেও ব্যক্তি-মালিকানায়
দেওয়ার প্রক্রিয়া চালু হয়েছে। আম-জনতার আয় কমছে, ফলে চাহিদা
কমতে থাকায় রপ্তানি সামগ্রী ও ভোগ্যপণ্যের দাম কমিয়ে রাখা যায়, কিন্তু
ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ায় আম-জনতার দুর্দশা বাড়ছে ও স্বাধীন বিকাশের পথ বন্ধ হয়ে
যাচ্ছে। ৮০ শতাংশ মানুষকে বঞ্চিত
করে একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চলতে পারে না, কারণ সেখানে সামাজিক অস্থিরতা দেখা দিতে বাধ্য। সুতরাং
যেটুকু গণতন্ত্র বিদ্যমান, বর্তমানে তাকেও বাতিল করে দেওয়ার আয়োজন চলছে জোরকদমে।
ফেডারেল কাঠামোর বিপরীতে ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন চলছে জোরকদমে। অর্থাৎ ফ্যাসিবাদের দিকে যাত্রার পথ হচ্ছে সুগম। তাই মেহনতি
মানুষের একটা প্রধান কর্তব্য ও দায়িত্ব হয়ে পড়েছে চালু গণতন্ত্রকে রক্ষা করা।
শিল্পায়নকে
পুঁজিবাদ বলে ধরে নেওয়া এক ভ্রান্তি। প্রাকৃতিক সম্পদের লুণ্ঠন ও পুঁজির মালিকদের
জমি ছিনিয়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে লড়াইকে সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে মূল লড়াই
হিসেবে ভাবা আরেকটি ভ্রান্তি।
পুঁজিবাদ হচ্ছে বাজারের নিয়ম, মূল্যের
নিয়ম ও মজুরি দাসত্ব চালু থাকা। সেই পরিস্থিতি চালু হয়েছে ভারতবর্ষের উৎপাদনের সব
ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদী অধীনতা ও বিদেশি কর্পোরেট পুঁজির শোষণের অভ্যন্তরেই, শিল্পায়ন
যতই দুর্বল হোক না কেন। বাস্তারের মত বলপূর্বক লুটে বা ‘পুঁজির আদিম
সঞ্চয়ন’ বা বর্তমানে যার রূপকে বলা হয় ‘বিস্থাপনের
মাধ্যমে সঞ্চয়ন’ পুঁজিবাদের জন্মলগ্ন থেকেই তার অনুষঙ্গ ছিল। নিও-লিবারেল
পর্যায়ে সেটা ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে। লাতিন-আমেরিকা, আফ্রিকা, আরব ভূখণ্ড
তো বটেই, তেলের জন্য আমরা দেখতে পাচ্ছি সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন ও
হাজারে হাজারে উদ্বাস্তুদের পশ্চিমী দেশের দিকে প্রব্রজন। লাখ লাখ মানুষ হচ্ছে
বিস্থাপিত, পতিত হচ্ছে মৃত্যুমুখে, মানবতার
বধ্যভূমিতে পরিণত হচ্ছে একের পর এক অঞ্চল, দেশ। খোদ আমেরিকায় শেল-অয়েল উত্তোলনে ফ্র্যাকিং-এর জন্য
মানুষের প্রতিরোধ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। সেখানেও একের
পর এক ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে পড়ে থাকতে দেখছি, হু হু করে বাড়তে দেখছি বেকারত্ব। চীন সেখানে গাড়ির ফ্রন্ট
গ্লাস নির্মাণের কারখানা খোলায় আমেরিকার শাসকরা স্বস্তি পাচ্ছে, বিশ্ব
আধিপত্যের লড়াইয়ে চীনের অগ্রগতি অব্যাহত, সে এক ভিন্ন কাহিনী। অন্যদিকে আইটি কোম্পানিগুলো যখন
ভারতবর্ষে বড়মাপের কর্মী ছাটাই করছে, তখন ট্রাম্পকে সন্তুষ্ট করতে ইনফোসিসের মত আইটি কোম্পানি
১০০০০ আমেরিকানদের চাকরী দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন।
সেরকম পরিস্থিতিতে বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে লড়াই, কর্পোরেট
পুঁজির মূল পুঁজিবাদী আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়াই, বেসরকারিকরণের
বিরুদ্ধে লড়াই ও মজুরি বৃদ্ধির লড়াইয়ে ও শিক্ষা-স্বাস্থ্য – নাগরিক
সুবিধা ও অধিকারের দাবিতে মেহনতি মানুষ সংগঠিত না হলে বাস্তারের মত পুঁজির ‘বিস্থাপনের
মাধ্যমে সঞ্চয়ন’-কে প্রতিহত করা যাবে না।
বাস্তারের
সংগ্রামে আদিবাসীদের বিজয়ের পূর্বশর্ত হচ্ছে ভারতবর্ষে গণতন্ত্র রক্ষা ও
সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মেহনতি মানুষের বিজয় অর্জন করা, আর সেই বিজয়
অর্জন একমাত্র সম্ভব শাসক শ্রেণির একাংশ সহ সব গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্যবদ্ধ
প্রয়াসের মাধ্যমে। এই সত্য অনুধাবন না করতে পারলে
বাস্তারের মানুষকে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বলি হওয়ার দিকে ঠেলে দেওয়া হবে। ব্যক্তি ও
রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের কুটিল চক্রের কানাগলিতে মানুষের প্রতিরোধ হারিয়ে যাবে।