বিপ্লবী বামপন্থার অন্যতম পথিক কমঃ অনির্বাণ বিশ্বাস স্মরণে

Posted by সুশান্ত কর Labels: , ,

এপ্রিল ২০২১ ভো­রবেলা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে চলে গেলেন পিসিসি সিপিআই (এম-এল)-এর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কমরেড অনির্বাণ বিশ্বাস। নকশালবাড়ির বিপ্লবী ধারার রাজনীতিতে তিনি ছিলেন উন্নত তত্ত্বের প্রবক্তা এবং সুলেখক। নকশালবাড়ি আন্দোলনের শুরু থেকেই বিপ্লবী চর্চা ও অনুশীলনের সাথে সরাসরি যুক্ত ছিলেন।

প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময়, ১৯৬৮ সাল থেকেই পার্টির কাজকর্মের সাথে যুক্ত হন কমরেড অনির্বাণ। ১৯৭১ সালে গ্রেপ্তার হয়ে বছরখানেক জেলবন্দি ছিলেন। ছাড়া পাওয়ার পর আবারও নকশালবাড়ি ধারার বিপ্লবী কাজকর্ম চালিয়ে যান। পরবর্তীতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি প্রাপ্ত হন। ১৯৭৫ সালের জরুরি অবস্থার সময়ে আবারও গ্রেপ্তার করা হয় তাঁকে। ১৯৭৭ সালে জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর কিছুদিন পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী হিসেবে কাজ করেন। এছাড়াও বন্দিমুক্তি আন্দোলনের সাথেও ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। পারিবারিক প্রয়োজনে ১৯৮১ সালে হেতমপুরের কৃষ্ণচন্দ্র কলেজে অর্থনীতির অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন এবং সমান্তরালভাবে পার্টির কাজকর্মের সাথেও যুক্ত থাকেন।

তাঁর রাজনৈতিক সহকর্মীরা বলেন, তিনি প্রখর স্মৃতিশক্তির অধিকারী ছিলেন, অনেকেই তাঁকে নলেজ ব্যাঙ্কবলেও ডাকতেন। বোলপুরের পুরোনো সাথী কমরেড মৃত্যুঞ্জয় ঘোষ তাঁর সম্পর্কে বলেনআমার দেখা সেরা সৎ সর্বহারা মতাদর্শের প্রতি নিষ্ঠাবান মানুষ। জ্ঞানের স্পর্শে মনে হত চলমান বিশ্বকোষ শিশুর মতো সরল। প্রাত্যহিক দিনযাপন ছিল চরম অযত্নের। অনির্বাণদা যখন কথা বলতো, সে চলমান সমাজ বাস্তবতা হোক, কবিতা, খেলা (ক্রিকেট বা ফুটবল), দর্শন, অর্থনীতি সবেতেই চূড়ান্ত পাণ্ডিত্যের ঝলক। সেই কমরেড অনির্বাণ বিশ্বাস এর অভাব ভোলার নয়।


একাধিক পত্রিকার সম্পাদনা করেছেন তিনি। সমর সেন সম্পাদক থাকাকালীন ১৯৬৮ সাল থেকেই তিনি ফ্রন্টিয়ার উইকলিপত্রিকার সাথে যুক্ত হন ও পরবর্তীতে লেখালেখি শুরু করেন। ১৯৮৭-তে সমর সেন মারা যাওয়ার পর ফ্রন্টিয়ারের সম্পাদকের দায়িত্ব নেন তিমির বসু। তিমির বাবুর সাথে ২০১২ সাল থেকে সহকারী সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন কমরেড অনির্বাণ। ১৯৮০ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে পিসিসি সিপিআই(এম-এল)-এর ইংরেজি মুখপত্র ফর অ্যা নিউ ডেমোক্রেসি’-র সম্পাদনার কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন । ষাটের দশকের ছাত্র আন্দোলনের কর্মী কমরেড নির্মল ব্রহ্মচারী জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর নরওয়েতে চলে যান। তিনি কলকাতা, লন্ডন, ওসলো ও ঢাকার লেখকদের নিয়ে একটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পত্রিকা বের করে চলেছেন নামপূর্বাশা এখন। দ্বিভাষিক পত্রিকাটির ইংরেজি বিভাগের সম্পাদক ছিলেন কমরেড অনির্বাণ। পত্রিকাটির সর্বশেষ সংখ্যায় কমরেড অনির্বাণ বিশ্বাস সাম্প্রতিক বিধানসভা নির্বাচন প্রসঙ্গে পিসিসি সিপিআই (এম-এল) -এর পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির বিবৃতি সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেন।


২০০৬ সালে প্রকাশিত তাঁর বই ‘The Cowrie Currency and Monetary History of India’ প্রকাশিত হয় ক্যাম্পপ্রকাশনা সংস্থা থেকে। তাঁর অন্যতম চর্চিত বই ‘Money and Markets from Pre-colonial to Colonial India’ প্রকাশিত হয় ২০০৭ সালে দিল্লির আকার বুক্‌সথেকে।

জন্ম ১৯৫২ সালের ২০ জুলাই চট্টগ্রামের শাকপুরায়। বাবা প্রয়াত হৃদয় রঞ্জন বিশ্বাস ছিলেন বীরভূমের হেতমপুরের কৃষ্ণচন্দ্র কলেজের অর্থনীতির অধ্যাপক ও মা প্রয়াতা নমিতা বিশ্বাস। পাঁচ ভাই ও একবোনের মধ্যে তিনি চার নম্বর। বড়ভাই প্রয়াত সুদেব বিশ্বাস ছিলেন শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের স্নাতক এবং সিপিআই (এম-এল) পার্টির শুরুর সময়ের এক নিষ্ঠাবান কর্মী। কমরেড অনির্বাণের স্ত্রী ঝর্ণা বিশ্বাস বর্তমানে হেতমপুরের বাসিন্দা, মেয়ে মৌসুমি বিশ্বাস বিশ্বভারতীতে পদার্থবিদ্যায় গবেষণারত। জামাতা অমিতাভ সৎপথী পেশায় স্কুলশিক্ষক।


সহজ সরল জীবন ধারায় বিশ্বাসী কমরেড অনির্বাণ ছিলেন বিপ্লবী রাজনীতির এক বিশ্বস্ত যোদ্ধা। মৃত্যুর আগে পর্যন্তও তিনি তাঁর বিভিন্ন লেখায় ভারতে সংঘ-বিজেপির ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কথা বলে গেছেন ও সক্রিয়ভাবে তা প্রচার করে গেছেন। বাংলা তথা ভারতের বামপন্থী সমাজবিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ ও বিপ্লবী রাজনীতিতে বিশ্বাসীদের খুব কাছের সহযোদ্ধা ছিলেন তিনি। তাঁর মৃত্যুতে শোক ব্যক্ত করেছেন বহু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। সিপিআই (এম-এল) নিউ ডেমোক্রেসি, সিপিআই (এম-এল) রেড স্টার, সিপিআই (এম-এল) কানু সান্যাল গ্রুপ এর মতো বিপ্লবী বামপন্থী দল এবং বন্দিমুক্তি কমিটি সহ বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংস্থা ও ট্রেড ইউনিয়নের তরফ থেকেও শোক প্রকাশ ও বিদায়ী অভিবাদন জানানো হয়েছে।নয়া গণতন্ত্রব্লগে নিয়মিত লিখবেন বলে জানিয়েছিলেন তিনি এবং কিছু লেখা প্রকাশিতও হয়েছিল ইদানিংকালে।

বিপ্লবী আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করা ও এক উচ্চতর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়াই হবে তাঁকে শ্রদ্ধা জানানোর উৎকৃষ্ট পন্থা। কমরেড অনির্বাণ বিশ্বাস সমাজ-বদলের হাজারো সংগ্রামীদের স্মৃতিতে ও রাজনীতিতে চিরকাল অমর হয়ে থাকবেন।

ইনকিলাব জিন্দাবাদ।
কমরেড অনির্বাণ বিশ্বাস লাল সেলাম।

 

স্বাভিমান:SWABHIMAN Headline Animator

^ Back to Top-উপরে ফিরে আসুন