মানব মস্তিষ্ক, সমাজ ও সমাজবাদ
অরূপ বৈশ্য
মস্তিষ্কের কোষ বা নিউরনের প্রোটিন আবরণ ভেদ করে তৈরি হয় আয়ন চ্যানেল। দ্রুত খোলে সোডিয়াম চ্যানেল। নিউরনের বাইরে সোডিয়াম পজিটিভ চার্জ আয়নের পরিমাণ ভেতরের চেয়ে বেশি। ফলে পটেনশিয়্যাল ডিফারেন্সের গ্র্যাডিয়েন্ট মেনে সোডিয়াম আয়ন বাইরে থেকে ভেতরে প্রবেশ করে ও নিউরন ভল্টেজ বেড়ে যায়। পটাশিয়াম চ্যানেল যেহেতু ধীরে ধীরে খোলে, ফলে সোডিয়াম চ্যানেলের পর সেই চ্যানেল খোলে। পটাশিয়াম আয়ন আবার বাইরে থেকে ভেতরে বেশি, ফলে তা ভেতর থেকে বাইরের দিকে যায় ও ভল্টেজ কমতে থাকে।
এই আয়ন চ্যানেল ভল্টেজ সংবেদনশীল। ভল্টেজ গ্র্যাডিয়েন্টের
ফলে আয়ন চ্যানেলের মাধ্যমে ভল্টেজ পরিবর্তন করে যা পজিটিভ ফিডব্যাক প্রসেস হিসাবে স্পাইক বা অ্যাকশন পটেনসিয়েলের জন্ম দেয় যা বৈদ্যুতিন সিগনাল হিসাবে নিউরেন ভেতরে বাহিত বা
স্টোর হয় বা নিউরন মেমব্রেনের বাইরে ট্রান্সমিট হয়। নিউরনের ভেতর থেকে বাইরে ও বাইরে থেকে ভেতরে আয়নের এই চলাচল স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় চলতে থাকে।
কিন্তু নিউরনের ভেতরে ও বাইরে ভল্টেজ গ্র্যাডিয়েন্ট
অর্থাৎ সোডিয়াম ও পটাসিয়াম আয়নের ঘনত্বের ব্যবধান প্রাথমিক পর্যায়ে কীভাবে তৈরি হয়?
তার জন্য দায়ি আরেকধরনের মলিকিউল যাকে বলা হয় সোডিয়াম
পাম্প। সোডিয়াম পাম্প সোডিয়াম আয়নকে নিউরনের ভেতর থেকে বাইরে ও পটাসিয়াম আয়নকে বাইরে
থেকে ভেতরে নিয়ে আসে। সেই চলাচল যেহেতু ভল্টেজ গ্র্যাডিয়েন্টের মাধ্যমে আয়ন চলাচলের
বিপরীত দিকে প্রবাহিত হয়, সেজন্য তাকে
শক্তি বা এনার্জি ব্যবহার করতে হয়। অবিচ্ছিন্নভাবে ব্যবহৃত সেই এনার্জির পরিমাণ যে
কোন মুহূর্তে ১৫ ওয়াট। সেই এনার্জির উৎস কী?
কোষের আবরণের মাইটোকোন্ড্রিয়ায় গ্লুকোজের সাথে রক্ত
প্রবাহিত অক্সিজেনের অক্সিডাইজিং মেটাবলিজমের মাধ্যমে গ্লুকোজ থেকে এটিপি পরমাণু বা
মলিকিউল (Adenosine triphosphate) তৈরি হয়। সেটা হচ্ছে শক্তি বা এনার্জির উৎস যা সোডিয়াম
পাম্পের সাথে বণ্ড তৈরি করে এটিপি ভেঙে আয়ন প্রবাহের চালিকাশক্তি হিসাবে কাজ করে।
এবার আয়ন মুভমেন্টের মাধ্যমে যে স্পাইক বা অ্যাকশন পটেনশিল যে ইলেকট্রিক্যাল সিগনাল বা পাল্স প্রবাহের
সূত্রপাত ঘটায়, তা প্রবাহিত হয় ‘আ্যাকজন’ নামে এক তারের মত কনডাক্টরের মধ্য দিয়ে, এবং অ্যাকজনের মধ্য দিয়ে যাতে প্রবাহ ভাল হয় তারজন্য ‘মায়েলিন’ আবরণের ইনস্যুলেটর
দিয়ে ‘অ্যাকজন’ মোড়া
থাকে। কিন্তু শুধুমাত্র ইলেক্ট্রিক সিগনাল হিসাবে প্রবাহিত হয় মূলত মেরুদণ্ডহীন
প্রাণীতে, মানব মস্তিষ্কে নিউরন কোষ পেরিয়ে অ্যাকজন কনডাক্টারে আসার সাথে সাথে তা ক্যামিকেল
সিগনালে রূপান্তরিত হয়। ইলেক্ট্রিক স্পাইক একধরনের রাসায়নিক পদার্থের নিঃস্বরণ ঘটায় (গ্লুটোমেট, গাবা,
গ্লাইসিন) যাকে বলা হয় নিউরোট্রান্সমিটার। সিগনালের মাধ্যমে অ্যাকজনের মধ্য দিয়ে তথ্য
প্রবাহিত হয়ে অন্য নিউরনের ড্যান্ডরাইটের রিসেপ্টরের তালা খোলে দেয় নিউরোট্রান্সমিটার এবং পুনরায় আয়ন চ্যানেলের মাধ্যমে আয়ন প্রবাহিত হয়ে ইলেকট্রিক সিগনালে রূপান্তিরিত
হয়।
দুর্বল সিগনাল ইনহিবিটর বা প্রবাহ নিরোধক হয়, আর হাজার
হাজার নিউরন থেকে আগত তথ্যের সেই সিগনাল এক্সাইটর বা উত্তেজক হিসাবে কাজ করে। এভাবে
একটি নিউরন অন্যটির সাথে কথা বলে, দূরবর্তী প্রবাহের জন্য এধরনের কন্ডাক্টর হাইওয়ে
দিয়ে প্রবাহিত হয়, মস্তিষ্কের একদিক
থেকে অন্যদিকে এবং মেরুদণ্ডের মাধ্যমে পেশী পর্যন্ত প্রবাহের জন্য সুপার-হাইওয়ের
বাণ্ডিল বা ‘করপাস কলোজাম’ দিয়ে
প্রবাহিত হয়।
এভাবেই তথ্য প্রবাহের জন্য সম্পূর্ণ মস্তিষ্ক ব্যবহৃত
হয়। অ্যাকজন কন্ডাক্টর বা তারের পরিবাহিতা ০.২ মিটার
প্রতি সেকেণ্ড থেকে ১০০ মিটার প্রতি সেকেণ্ড। আয়ন চ্যানেল ও অ্যাকজন দিয়ে প্রবাহকে বলা হয় সিনাপটিক ট্রান্সমিশন। ইইজি'র মাধ্যমে ইলেকট্রিক কারেন্ট প্রবাহের
গোলযোগ ধরা পড়ে কারণ আয়ন প্রবাহে ভারসাম্যহীনতায় বেশি বা কম এনার্জির প্রয়োজন পড়ে,
অনুরূপভাবে এফএমআরআই ও একধরনের ব্রেইন-ম্যাপিং। বেশি বা কম এনার্জি মানে বেশি বা কম অক্সিজেনের ব্যবহার,
বেশি বা কম অক্সিজেনের ব্যবহার মানে বেশি বা কম রক্ত প্রবাহ, সেটাই সেই ম্যাপিং-এ প্রতিফলিত
হয়। রাসায়নিক সিগন্যালের ভারসাম্যহীনতা প্রতিফলিত
হয় আচরণে, যার জন্য রাসায়নিক অষুধ ব্যবহার করতে হয়। মস্তিষ্কের গ্রে-ম্যাটারে সব ধরনের
পদার্থ থাকে, হোয়াইট ম্যাটারে থাকে শুধু অ্যাকজন ও মায়েলিন। মস্তিষ্কের সঞ্চালন মূলত
রাসায়নিক হওয়ায় মস্তিষ্কের সঞ্চালনে কোন ধরনের ত্রুটি শরীরের অন্যান্য যন্ত্রে রাসায়নিক
পদার্থের অনাকাঙ্খিত উপস্থিতি ঘটিয়ে বিভিন্ন ধরনের
শারীরিক সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। সেজন্যই মানুষ বেঁচে থাকে ও জীবন উপভোগ করে তার
মস্তিষ্কে।
আমাদের দেহের চারপাশ থেকে অসংখ্য ও বহুবিধ অনুভূতিগুলির
মস্তিষ্কে সঞ্চালন একই প্রক্রিয়ায় ঘটে। আমাদের দেহে অসংখ্য রিসেপ্টর সেল রয়েছে যেখানে
বাইরের অনুভূতিগুলি গৃহীত হয়ে ইলেকট্রিক সিগন্যাল বা বহুবিধ রাসায়নিক সিগনাল হিসাবে উপরে বর্ণিত প্রক্রিয়ায় স্পাইক বা অ্যাকশন পটেনসিয়্যাল তৈরি হয় যার থেকে
সিনেপটিক ট্রান্সমিশন প্রক্রিয়ায় মস্তিষ্কের বিভিন্ন অঞ্চলে পৌঁছে এবং মস্তিষ্ক তা
ডিকোড বা সংকেতগুলির অর্থোদ্ধার করে।
সচেতনতা ও উপলব্ধি এই প্রক্রিয়ায় কীভাবে ক্রিয়াশীল থাকে বা কগনিটিভ বায়াস কীভাবে প্রভাব বিস্তার করে
সেই ভিন্ন প্রসঙ্গে প্রবেশ না করে মস্তিষ্কের এই স্বাভাবিক ক্রিয়ার সাথে সামঞ্জস্য
রেখে সমাজের প্রসঙ্গ অতি-সংক্ষেপে বিচার করে দেখা যাক।
উপরের বর্ণণা থেকে এটা পরিষ্কার যে, মনুষ্য দেহের চারপাশের
অবস্থা বাদ দিলে যা অবশিষ্ট থাকে সেটা হলো শুধু বেঁচে থাকা, পারিপার্শ্বিক মিলে যে
মনুষ্য মস্তিষ্ক, সেটাই জীবন।
সমাজ থেকে বহুবিধ তথ্য অনুভূতির সিগনাল হিসাবে মস্তিষ্কে
প্রবেশ করে। সেগুলির রকমফের নির্ভর করে সমাজ কীভাবে গঠিত তা দিয়ে। অর্থাৎ উৎপাদন সম্পর্ক
ও উৎপাদিকা শক্তির আন্ত:ক্রিয়ায়। অসংখ্য মানবদেহ বা জীবন্ত মস্তিষ্ক মিলেই সমাজ। সমাজের
অবস্থা দেহের বাইরের জগতের সিগনালগুলির স্বরূপ নির্ধারণ করে, আবার সেই
সংকেতগুলি ডিকোড করে মানব মস্তিষ্ক কী অর্থ করল তা নির্ভর করে, জ্ঞানীয় পক্ষপাত বা
কগনিটিভ বায়াসের উপর। জীব জগতের অন্য প্রাণীকে বাদ দিলে, বাস্তব মানব সমাজে মানুষ
ছাড়া বাকী সবকিছুই জড় বা মৃত। সে অর্থে সমাজ মানে মস্তিষ্কের সমাহার, যার প্রতিটি
একক পরস্পরের থেকে আলাদা।
সমাজের কোন একটা আলোড়নের সিগনাল-স্তর মস্তিষ্কে যে স্পাইক ও উত্তেজনার সৃষ্টি করে তা সমাজের একাংশের মধ্যে একইধরনের সমষ্ঠিগত আবেগ ও ক্রিয়ার জন্ম দিতে পারে, কিন্তু সেই উত্তেজনার আবেগ ও ক্রিয়ার রূপান্তরের পর পুনরায় পরস্পর আলাদা আলাদা এককে পরিণত হবে। মানব সমাজে আলোড়নের এমন কোন সিগনাল স্তর সৃষ্টি হওয়া কী সম্ভব যা মানব সমাজের বিপুল গরিষ্ঠাংশের মধ্যে একইধরনের আবেগ ও ক্রিয়ার জন্ম দিতে পারে? পুঁজিবাদী সমাজের ব্যাখ্যা করে মার্কস দেখিয়েছেন যে, সেরকম আবেগ ও ক্রিয়ার জন্ম দেওয়া সম্ভব যার মধ্যে সমাজের যে বিপুল গরিষ্ঠ অংশ সামিল হয়ে যায়, সেই অংশটিকে তিনি অভিহিত করেছেন ‘শ্রমিকশ্রেণি’ হিসাবে। কিন্তু সেই আবেগ ও ক্রিয়া সম্পন্ন হয়ে যাওয়ার পর, প্রতিজন শ্রমিকের মস্তিষ্ক আবার আলাদা আলাদা একক, সেখানে নিহিত সমাজবাদী গঠন প্রক্রিয়ার রহস্য যা এখনো উন্মোচিত হয়নি। বরঞ্চ পুঁজিবাদী বাজার-সভ্যতা সেই রহস্য সমাধানে আরও জটিলতার সৃষ্টি করছে।
বাজারের পণ্যসামগ্রী নিয়ে যে বিজ্ঞাপন হয় কিংবা অনলাইন বিক্রি প্রক্রিয়ায় ক্রেতাকে সামিল করা হয়, সেই বিজ্ঞাপন ও বিক্রি পদ্ধতি দেখে বা স্পর্শে ক্রেতার মস্তিষ্কে কী ধরনের অনুভূতি হয় তা নিউরোসায়েন্সের মাধ্যমে বিক্রেতা বা পুঁজি মালিক আগাম জেনে নিতে পারে এবং সে অনুযায়ী পণ্য উৎপাদন ও বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়ে নিতে পারে। ইইজি ও এফএমআরই’র রিপোর্ট স্টাডি করে বাজারে পণ্য সম্পর্কে ক্রেতার প্রতিক্রিয়া উৎপাদক আগাম জেনে নিতে পারে। ১৫ বছর আগে ৯/১১’র ট্যুইন-টাওয়ার আক্রমণের ফলে জনমনে ভয়ের প্রতিক্রিয়া নিয়ে মস্তিষ্কের এফএমআরআই’র মাধ্যমে এরকম এক স্টাডি আমেরিকাতে হয়েছিল। সেই স্টাডি দেখিয়েছে যে, ৯/১১’র আক্রমণের ঘটনা যে মস্তিস্কে ভয়ের অনুভূতি ট্রিগার করেছিল, তাতে রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেট ভোটারদের মস্তিষ্কে ভিন্ন ভিন্ন ক্রিয়ার জন্ম দিয়েছিল। নিউরোমার্কেটিং বিশেষজ্ঞদের মতে, এফএসিএসের (ফ্যাসিয়েল অ্যাকশন কোডিং সিস্টেম) মাধ্যমে ভারতের মত দেশে যেখানে ভোটারদের মধ্যে মতাদর্শগত মেরুকরণ ঘটেছে, সেখানে এফএমআরআই’র তূলনায় কম ব্যয়ে ভোটারদের মন আগাম ও সুনির্দিষ্টভাবে পড়ে নেওয়া সম্ভব। মস্তিষ্কে নিউরোলিঙ্ক (এন১ ইমপ্লান্ট) বসানো’র বিষয়টি এলেন মাস্ক প্রবর্তন করার পর, পুঁজিপতিরা নিউরোসায়েন্সকে কতটুকু বাণিজ্যিক কারণে ব্যবহার করতে পারে ও মানব মস্তিষ্ককে বাইরে থেকে প্রভাবিত করতে পারে এনিয়ে বিস্ময় সৃষ্টি করেছে।