গণতান্ত্রিক লেখক সংস্থার উদ্যোগে আলোচনা সভা ঃ বিষয় - "দিশেহারা সমকাল - সাহিত্যের ভূমিকা।"
Posted by Labels: বরাক উপত্যকা, সাহিত্যগুরুগম্ভীর আলোচনাকে অন্তরঙ্গ আলাপচারিতায় রূপান্তরিত করার জন্য সংযোজকের কঠিন দায়িত্ব বর্তায় দীপঙ্কর চন্দের উপর। আলোচনা সভার আহ্বায়ক স্নিগ্ধা নাথ উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন যে বরাকের সাম্প্রতিক ঘটনাবলীকে এক সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে দেখতে হবে এবং দৃষ্টিভঙ্গীর প্রশ্নকেই আলোচনার কেন্দ্রীয় বিষয় হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন। প্রথম নির্দ্দিষ্ট আলোচক সুবীর কর বরাকের সাম্প্রদায়িকতাকে ‘চক্রান্তের তত্ব’ দিয়ে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন এবং তার একটা দীর্ঘ বাস্তব ইতিহাসও তুলে ধরেন। ঘোষিত বিষয় এবং উদ্দেশ্য ব্যাখ্যার মধ্যে একটা সুক্ষ ফারাক ছিল। ফলে আলোচনাটা কোন খাতে যাবে তা নিয়ে বিভ্রান্তি দেখা দেয়। বিষয় যখন ‘দিশেহারা সমকাল’ – তখন সময়টাকে চেনা-বোঝা এবং তার থেকে উত্তরণের দিশা নিয়ে আলোচনাকে কেন্দ্রীভূত করলে আলোচনাকে অনেক গভীরে নিয়ে যাওয়া যেত – শ্রোতার আসনে নতুন প্রজন্মের অংশগ্রহণ সেই আগ্রহকে প্রকাশ করছিল। কিন্তু এর সাথে জুড়ে দেওয়া হয়েছে আরেকটি বিতর্কিত বড় বিষয় “সাহিত্যের ভূমিকা” এবং ফলে দুই খাতে আলোচনায় অনেক গুরুগম্ভীর কথা অনেক স্রোতধারায় এগিয়ে আসলেও একটা মোহনার দিকে অগ্রসর হচ্ছিল না। যেমন শান্তনু সরকার ও অমিতাভ দেব চৌধুরী সৃষ্টিশীল সাহিত্যের দিশা দেখানোর ব্যাপারে কোন বিশেষ ভূমিকা না থাকার পক্ষেই মত পোষণ করেন। এই তিন বক্তাই দিশেহারা সময়কে মধ্যশ্রেণির সমাজ বিচ্ছিন্নতার মাপদণ্ড দিয়ে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন, মধ্যশ্রেণির নেতৃত্বের প্রশ্ন নিয়ে সুবীর করের সাথে দ্বিমত পোষণ করেন শান্তনু। এই দুটো কথার যে কোন একটি থেকে আলোচনা ক্রমশ গভীরতার দিকে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ ছিল, কিন্তু আলোচনা এই দুটোর মধ্যে গাঁটছড়া বেঁধে একটা বিশৃঙ্খলার মধ্যে আটকে যায়। তথাপি আলোচনা ছিল অনেক উন্নত মানের এবং নতুন প্রজন্মের অংশগ্রহণ একটা নতুন মাত্রাও দিয়েছিল। শ্রোতাদের মধ্যে অনেকেই দেখার প্রশ্ন –
দর্শনের প্রশ্নকে গুরুত্ব আরোপ করেন – কিন্ত এই প্রশ্নকে মতাদর্শের সাথে গুলিয়ে ফেলে আলোচনাকে তার গণ্ডী অতিক্রম করতে দেওয়া হয়নি। ‘কিছু একটা প্রাপ্তি ঘটল’ - সেই মানসিকতা থেকে দেখলে এটা এক সফল আলোচনা – আবার কেউ বলতে পারেন দিশার সন্ধান করারও পথ পেলাম না। এই দিশার সন্ধানের প্রশ্ন নিয়েও খানিকটা বিতর্ক হয়েছে। অনেকের বক্তব্য থেকে একথাও বেরিয়ে এসেছে যে দিশার সন্ধান করাটাও নাকি সাহিত্যের ক্ষেত্রে হুকুম জারি করা। বিভিন্ন অবস্থান থেকে বিভিন্ন জন বাস্তবকে বিভিন্নভাবে দেখে – সিদ্ধার্থের তাত্বিক বক্তব্যের এই সারকে স্বীকার করেও একথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে দেখারও বিভিন্ন পদ্ধতি থাকা সত্বেও সব পদ্ধতি নিশ্চয়ই একই সাথে শুদ্ধ বা সত্য জানার গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি হতে পারে না – এই পদ্ধতিগুলোর নামই ভাববাদ – বস্তুবাদ – দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ। এই পদ্ধতি আয়ত্ব করার পদ্ধতিও আসলে এই ভিন্ন ভিন্নভাবে দেখা বাস্তবের মধ্যে আন্তঃক্রিয়া ও মত বিনিময় এবং প্র্যাকটিস থেকে গড়ে উঠে। ‘দিশেহারা সমকাল’ ও ‘সাহিত্যের ভূমিকা’ এই দুটি বিষয়ের আলোচনা হতে পারত বাস্তব নিয়ে চর্চা থেকে। একটি ভাল সাহিত্য যেমন গ্রাম সমাজ নিয়ে হতে পারে, ঠিক তেমনি বুর্জোয়া সমাজ বা মধ্যবিত্ত শ্রেণি নিয়েও হতে পারে। যে দক্ষ সাহিত্যিক যত ভালভাবে তার সাহিত্য সৃষ্টির বিষয়কে সামগ্রিকতার অংশ হিসেবে দেখতে পারবে – তার সাহিত্যিই ততবেশী সৃষ্টিশীল হবে এবং তারজন্যই প্রয়োজন বাস্তবের চর্চা। অমিতাভ তথ্য-প্রযুক্তির বিপ্লবের ফলে মধ্যশ্রেণির বিচ্ছিন্নতার জন্য ‘ভার্চুয়্যাল ওয়ার্ল্ড’-এর ভূমিকার কথা তুললেও এনিয়ে আলোচনাকে গভীরে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা থেকে নিজেই বিরত থাকেন -– যুক্তি-প্রতিযুক্তির মাধ্যমে পরস্পর বিপরীত গ্রহণযোগ্য সূত্র প্রতিষ্ঠার অবৈজ্ঞানিক মতের প্রতি তার বিশ্বাসই (যা শক্তিপদ ব্রহ্মচারীর মত হিসেবে সেই মতের প্রতি তিনি আস্থা ব্যক্ত করেন) সম্ভবত এবিষয় নিয়ে বেশিদূর অগ্রসর হওয়া থেকে তাকে বিরত করে। নাহলে বাস্তবতার এই দিক নিয়ে আলোচনা করতে করতে আমরা হয়ত বৃহৎ পরিসরে যেতে পারতাম।
বাস্তবতার বেশ কিছু দিক উন্মোচিত করে গ্রাম বরাকের ঐক্যের ঐতিহ্য নিয়ে দীর্ঘ বক্তব্য রাখেন তুষার কান্তি নাথ ও মুকব্বীর আলী। এখান থেকেও বাস্তব নিয়ে একটা আলোচনা শুরু হতে পারত – কিন্তু ততক্ষণে বেলা গড়িয়ে পড়েছে অনেক – আলোচনার সার সংকলন করতে ডাকা হল সঞ্জীব দাশকে যিনি সঠিকভাবেই বললেন আলোচনার বিষয়বস্তু জটিল – তাই চটজলদি কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় না এবং সাহিত্য সৃষ্টি যেহেতু হুকুম দিয়ে হয় না, তাই ভাষা আন্দোলন নিয়ে উপন্যাস কেন তৈরি হলনা এপ্রসঙ্গ অবান্তর। কিন্তু অশান্ত বাস্তবে আমার মত যারা অশান্ত চিত্তের অধিকারী – যারা এখনও যৌবনের উন্মাদনার স্বাদ নিতে উদগ্রীব – তাদের কাছে সম্ভবত মনে হয় সময়ের চাহিদার কাছে আমরা ক্রমশঃ পিছিয়ে পড়ছি। সময় অর্থাৎ বাস্তবকে জানা - বোঝার জন্য, আমাদের পারিপার্শ্বিককে চেনার জন্য আত্মতুষ্টির কোন স্থান থাকতে পারে না। বরাকের বুদ্ধিজীবী শ্রেণির এই আত্মতুষ্টিই আসলে এখানকার জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সাহিত্য চর্চার জগতকে করে রেখেছে পঙ্গু ও প্রাণহীন।
0 comments:
Post a Comment