সাম্রাজ্যবাদী সংঘাত, ‘লুক ইস্ট পলিসি’ ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অস্থিরতা

Posted by স্বাভিমান

                                                          ।।    অরূপা মহাজন ।।
              
                    [এই প্রবন্ধটি প্রথম প্রকাশিত হয় শিলচার থেকে প্রকাশিত অরুণোদয় পত্রিকার ২০০৮-এর আগস্ট সংখ্যায় এবং পরবর্তীতে কলকাতা ও ত্রিপুরা থেকে প্রকাশিত দুটি পত্রিকায় এই লেখাটি পুনর্মুদ্রিত হয়। প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় এটা এখানে তুলে দিলাম। এই প্রবন্ধটিতে   সাম্রাজ্যবাদী রণকৌশলের ২০০৮ সালে প্রাপ্ত তথ্যের অলোকে রোহিঙ্গিয়া, অন্যান্য জনজাতি সহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সামগ্রিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ভবিষ্যদবাণী করা হয়েছে। কিন্তু নতুন তথ্যের আলোকে এই লেখাটির পুনরায় যাচাই করার যেমনি প্রয়োজন রয়েছে, ঠিক তেমনি অভ্যন্তরিণ আধিপত্যবাদী রাজনীতির কারণ ছাড়া অন্য আরেকটি দৃষ্টিকোণ থেকেও বর্তমান পরিস্থিতির বিচার বিশ্লেষণ করার প্রয়োজন রয়েছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতটি গড়ে উঠেছে ২০০৭-০৮ সালের আমেরিকান সাব-প্রাইম সংকটের পরবর্তীতে। পুঁজিবাদের যে কাঠামোগত সংকটের কথা অর্থনীতিবিদেরা বলছেন সেই সংকটের মধ্যেও ফিনান্সিয়্যাল মার্কেটে বিনিয়োগের মাধ্যমে যে মুনাফা ও কেন্দ্রীভবন ঘটে চলেছিল তাতে বড়রকমের ধাক্কা আসে সাব-প্রাইম সংকটের মাধ্যমে। কিন্তু রাষ্ট্রের উপর ওলিগোপলিস্টিক (মনোপলিদের গ্রুপ) নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে পাবলিক-প্রাইভেট ও বাজার সব স্পেসকে কর্পোরেট প্রয়োজনানুসারে পরিচালিত করে এলিট ও উচ্চ-মধ্যবিত্তদের ক্রয়ক্ষমতার দ্রুত বৃদ্ধি ঘটিয়ে মুনাফাবৃদ্ধি ও পুঁজির কেন্দ্রীভবন প্রক্রিয়াটিকে বজায় রেখেছে। অন্যদিকে আমজনতার ক্রয়ক্ষমতা ও তার সাথে সম্পর্ক রেখে আমজনতার প্রয়োজনীয় সামগ্রীর উৎপাদন কমে চলেছে দ্রুত। সুতরাং আম জনতার বিপর্যয়ের মুখে রাজনৈতিক দলগুলির কর্পোরেট প্রভুদের মুনাফা বৃদ্ধির স্বার্থে নীতি নির্ধারণ করা ছাড়া জনগণকে কাছে টানার একমাত্র সম্বল হয়ে পড়ছে কর্পোরেট প্রভুদের দাক্ষিণ্যে পাওয়া অর্থবল। কর্পোরেট মুনাফার স্বার্থে কর্পোরেট সামাজিক দায়িত্বের নামে যদি কিছু বিনিয়োগ হয়, তখন তারা আহ্লাদে আটখানা হয়ে জনগণের কাছে প্রচার করতে পারেন। অন্যথায় এই অর্থবলের সাথে সংকীর্ণ জাতি-সম্প্রদায়গত খেলায় মদত যোগানো ছাড়া তারা আর কোন পথ খুঁজে পান না এবং এভাবেই গণ-চাহিদার চাপকে তারা মোকাবিলা করেন। কারণ বিকল্প রাস্তাটি হচ্ছে উন্নয়ণের গণমুখী মডেল, ত্রিণমূল গণতন্ত্র ও পিরামিডাকৃতি ক্ষমতা-কাঠামোকে উল্টে দেওয়ার রাজনীতি এবং এই পথ অবলম্বন করা মানে নয়া-উদারবাদকে বিরোধিতা করা]

কিছুদিন আগে অরুণাচল প্রদেশে নির্মাণশিল্পে কর্মরত দিনমজুরদের উপর হামলা হয়। এই দিনমজুরেরা যে বাংলাদেশি মুসলমান নয় –- নিম্ন অসমের বাসিন্দা, সেটা প্রমাণিতও হয়। এবারও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর আক্রমণের সূত্রপাত ঘটে উজান অসমে দিনমজুরদের হেনস্তার মধ্য দিয়ে। এই আক্রান্তরাও মূলত নিম্ন অসমের বাসিন্দা ও সড়ক নির্মাণের কাজে নিযুক্ত ঠিকা শ্রমিক। এই আক্রমণের মাধ্যমে অনুপ্রবেশকারী ইস্যুকে গোটা উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ছড়িয়ে দিতে সচেষ্ট হয় আসু ও তার নতুন তৈরি মঞ্চ ‘নেরসু’। বাংলাভাষী মুসলমানরা তাদের মূল র্টাগেট হলেও বাঙালি হিন্দু, নেপালি, বিহারিরাও স্থানে স্থানে তাদের অক্রমণের লক্ষ্য হয়।

               অসমে ‘বিদেশি খেদার’ নামে সংখ্যালঘুদের আক্রমণের এক ধারাবাহিক ইতিহাস রয়েছে, রয়েছে মুসলমানদের গণহারে কোতল করারও ইতিহাস। এধরনের বড়মাপের মুসলিম গণহত্যার সর্বশেষ সংযোজন ১৯৮৩’র নেলির দাঙ্গা। সত্তরের দশকে অসমে যে ব্যাপক কৃষক আন্দোলন ও তার উপর ভিত্তি করে সত্তরের শেষের দিকে যে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলন বিকশিত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল তাকে ধ্বংস করে দিতেই শুরু হয় আসুর ‘বিদেশি খেদা’ আন্দোলন। ১৯৮৩-তে নির্বাচন ঘোষণা করে আসু আন্দোলনের প্রতি যে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়া হয়, নেলি ছিল সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার উগ্রজাতিয়তাবাদী প্রতিহিংসার বর্বরতম রূপ। নির্বাচনের পর স্বাভাবিকভাবেই স্তিমিত হয়ে পড়া উগ্রজাতিয়তাবাদী শক্তিরা অসম চুক্তির মাধ্যমে চাঙ্গা হয়ে উঠে। কিন্তু দীর্ঘ অগপ শাসন ও আলফা সন্ত্রাস অসমের জনজাতীয়দের মূল অসমিয়া সমাজ থেকে দূরে ঠেলে দেয়। আক্রান্ত হওয়ার ভীতিকে উপেক্ষা করে ন-অসমীয়ারা নিজেদের বাংলাভাষী পরিচিতেতে ফিরে যায়। উগ্রজাতিয়তাবাদী কার্যকলাপ অসমীয়া জাতির যে ক্ষতিসাধন করে তাতে উগ্রজাতিয়তাবাদীরা দ্রুত জনভিত্তি হারাতে শুরু করে। তাদের স্বাভাবিক মৃত্যু অনিবার্য হয়ে উঠা এবং গণতান্ত্রিক পরিবেশ গড়ে উঠার যে সম্ভাবনা দেখা দেয় তাকে প্রতিহত করতে নেওয়া হয় নতুন কৌশল। শুরু হয় জনজাতীয়দের ন্যায্য ক্ষোভকে সংকীর্ণতাবাদে রূপান্তরিত করে সন্ত্রাসের বাতাবরণ সৃষ্টি করার মাধ্যমে। নিম্ন অসমে বড়ো সন্ত্রাসীদের জাতি-নির্মূলীকরণের (Ethnic Cleansing) অভিযান স্বীকৃতি পায় বিটিসি গঠনের মধ্য দিয়ে। এবার জনগোষ্ঠীগত হিংসা ও ঘৃণাকে গোটা উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ছড়িয়ে দিতে অসমিয়া উগ্রজাতীয়তাবাদী ও জনজাতীয় সংকীর্ণতাবাদ এক মঞ্চে সামিল হয়েছে।

                 উজান অসমে আসুর সংখ্যালঘু বিরোধী অভিযানে কংগ্রেস সরকার প্রথম দিকে মদত দেয়। কংগ্রেসিরা নির্বাচনকে সামনে রেখে ‘সাপ হয়ে কাটা ও ওঝা হয়ে ঝাড়ার’ – তাদের পুরোনো রণকৌশলটি প্রয়োগ করতে সচেষ্ট হয়, যাতে সংখ্যালঘুদের ত্রাতা হিসেবে তাদের হারানো মুসলিম ভোট ব্যাঙ্ক ফিরে পাওয়া যায়। বিশ্বায়নের নীতির ফলে দুরবস্থার দ্রুত বৃদ্ধিজনিত ক্ষোভ থেকে মানুষের দৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে নিতেও অনুপ্রবেশকারী ইস্যুটিকে চাঙ্গা করাই সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা হিসেবে বিবেচিত হয়। কিন্তু আসু-নেরসু ও সংঘ পরিবারের এবারের সংখ্যালঘু বিরোধী এই চালে রয়েছে বিশ্ব আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় সাম্রাজ্যবাদী সংঘাতের ছায়াও।

              রাশিয়ার জর্জিয়া আক্রমণ প্রমাণ করে দিয়েছে যে বিশ্ব আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদী রণনীতি রাশিয়ান অক্ষশক্তির চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। জর্জিয়াকে আমেরিকার সামরিক সাহায্য, পোলাণ্ডে আমেরিকার ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপন, কাসপিয়ান অঞ্চল ও কৃষ্ণ সাগরে ক্রমবর্ধমান সামরিক গতিবিধি, কিউবাতে রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপন ইত্যাদি ঘটনার মাধ্যমে রাশিয়া-আমেরিকা সংঘাতের পারদ তড়তড় করে চড়ছিল। জর্জিয়াকে ন্যাটোভুক্তির আমেরিকান প্রচেষ্টা ও ৭-৮ আগস্ট আমেরিকার মদতে জর্জিয়ার সামরিক অভিযান ও দক্ষিণ ওসেটিয়ায় প্রায় ২০০০ সামরিক নাগরিককে হত্যার পর রাশিয়ার সেনাবাহিনী জর্জিয়ায় প্রবেশ করে। এই হত্যালীলার ভিডিও রেকর্ডিং এবং রাশিয়ান আক্রমণে সন্ত্রস্ত ও পলায়নরত জর্জিয়ান বাহিনীর মধ্য থেকে আমেরিকান ইংরেজিতে কথাবার্তার রেকর্ডিংও রয়েছে রাশিয়ার কাছে। ১৯ আগস্ট জর্জিয়া প্রশ্নে ন্যাটোর সভায় আমেরিকান আবেদঙ্কে অগ্রাহ্য করে বেশীরভাগ ইউরোপিয়ান দেশই রাশিয়াকে সমর্থন করেছে। দক্ষিণ ওসেটিয়া ও অবখাজিয়ার স্বাধীনতার স্বীকৃতি প্রদানের পর রাশিয়ার মৃদু নিন্দা শোনা গেলেও রাশিয়ার বিরুদ্ধে অবরোধের আমেরিকান প্রস্তাবে বেশিরভাগ ইউরোপীয় দেশগুলি সম্মতি দেয়নি। কারণ, একদিকে রাশিয়ার তেল সরবরাহের উপর ইউরোপীয় দেশগুলির নির্ভরশীলতা এবং অন্যদিকে আমেরিকান বিশ্ব আধিপত্যকে খর্ব করার সাথে তাদের স্বার্থও জড়িয়ে থাকা। রাশিয়া ইতিমধ্যে ন্যাটোর সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা লিখিতভাবে জানিয়ে দিয়েছে এবং সফলভাবে নতুন প্রযুক্তির ‘টপল ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র’ পরীক্ষণ করে আমেরিকার দিকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে। পরিস্থিতি এমনই যে আমেরিকার মিত্র হিসাবে পরিচিত তুরস্কও কৃষ্ণসাগরে সামরিক গতিবিধির জন্য তাদের বন্দর ব্যবহার করার আমেরিকান প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছে। চীন ও রাশিয়া সহ মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন দেশের ‘সাংঘাই কোঅপারেশন অর্গেনাইজেশন’ রাশিয়াকে সমর্থন করেছে, যদিও নিজেদের অভ্যন্তরিণ কারণে স্বাধিণতার স্বীকৃতির প্রশ্নে কোন মন্তব্য করা থেকে চীন বিরত থেকেছে। এস.সি.ও’র সভায় পর্যবেক্ষক সদস্য হিসেবে ভারতীয় প্রতিনিধিও উপস্থিত ছিলেন। ‘নিউক ডিল’-এর পরিপ্রেক্ষিতে ভারত এব্যাপারে কোন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবে না। তবে একথা খেয়াল রাখা জরুরি যে শীতল যুদ্ধের পরিস্থিতিতে ‘সোভিয়েত রাশিয়ার’ সাথে যে সম্পর্ক ছিল, প্রতিরক্ষা খাতে রাশিয়ার সাথে সে সম্পর্ক এখনও অটুট রয়েছে এবং সম্প্রতি ব্রাহ্ম এরোস্পেস যৌথ উদ্যোগের জন্য ভারত রাশিয়ার কাছে ২ বিলিয়ল ডলার মূল্যের ক্ষেপণাস্ত্রের অর্ডারও দিয়েছে। জর্জিয়া আক্রমণকে কেন্দ্র করে সাম্রাজ্যবাদী সংঘাতের যে ছবি সামনে চলে এসেছে এধরনের সংঘাত আগামীদিনে দ্রুত বৃদ্ধি ঘটতে থাকবে। রাশিয়ান অক্ষশক্তির প্রধান এশিয়ান অংশীদার হচ্ছে চীন। সাম্রাজ্যবাদী সংঘাতের এপিসেন্টার হচ্ছে মধ্য এশিয়া। সে হিসাবে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এবং তাই সাম্রাজ্যবাদী সংঘাতের শিবির বিভাজনের ক্ষেত্রে ভারতবর্ষের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। ভারত সরকারের ‘পূর্বে তাকাও নীতি’ এবং চীন-ভারত ও আশিয়ান দেশগুলির বাণিজ্যিক-আর্থিক নৈকট্য স্থাপনের ক্ষেত্রে মায়ান্মার হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল এবং উত্তর-পূর্ব ভারত ও বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ করিডর। মায়ান্মার-বাংলাদেশের প্রাকৃতিক গ্যাস ভাণ্ডারের দিকেও রয়েছে সাম্রাজ্যবাদী শ্যেনদৃষ্টি। মায়ান্মারের আর্থিক-সামরিক ক্ষেত্রে ও জুন্টা সরকারের উপর রয়েছে চীনের প্রভাব। চীন পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয় দেশগুলির একটি আঞ্চলিক গোষ্ঠী তৈরি করতে এবং আতে জাপানকেও সামিল করে নিতে আগ্রহী। জাপানের সাথে আমেরিকার ক্রমবর্ধমান দূরত্ব এবং এই আঞ্চলিক গোষ্ঠীর সাথে আমেরিকার ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য সংঘাত, মালয়েশিয়া-মায়ান্মার সহ আশিয়ান দেশগুলির সাথে আমেরিকার ক্রমবর্ধমান দূরত্ব এবং এই আঞ্চলিক গোষ্ঠীর সাথে জড়িত বাণিজ্যিক স্বার্থ জাপানকেও চীনের পরিকল্পনার দিকে আকৃষ্ট করছে। বাণিজ্যিক স্বার্থের সম্পর্কগুলি একমুখীন নয় এবং তাতে নানাধরনের জটিলতা রয়েছে, তথাপি আমেরিকা যে ক্রমশই এশিয়ার এই অঞ্চলে কোণঠাসা হচ্ছে তাতে কোন সন্দেহ নেই এবং চীন-ভারত সম্পর্কের উন্নতি এবং চীন-ভারত সহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় সমুদ্র পথের বিকল্প সড়ক ও রেল যোগাযোগ গড়ে উঠা এবং মায়ান্মার-ভারত ও মায়ান্মার-চীন গ্যাস পাইপলাইন গড়ে ওঠার সম্ভাবনা আমেরিকার শিরঃপীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

চীন-ভারত-আশিয়ান বা পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাণিজ্যিক পরিকাঠামো গড়ার ঐতিহাসিক বাস্তবতা ও বাস্তব অগ্রগতি বিচার করে দেখা যাক। সম্প্রতি চীন-ভারত যে প্রাচীন বাণিজ্য পথ রয়েছে সেগুলি চালু করা হচ্ছে। সীমান্ত বাণিজ্যের জন্য সিকিমের গ্যাংটক থেকে ৫৪ কিঃমিঃ দূরে নাথুলা-পাস খুলে দেওয়া হয়েছে। তিব্বতের ইয়াতুং শহর নাথুলা-পাস থেকে মাত্র ৫২ কিঃ মিঃ দূরে। ব্রিটিশ আমলে চীনের কিং-রাজত্বের সময়ে তিব্বত ও ভূটানের বাণিজ্য পথ হয়ে উত্তরবঙ্গের আলিপুরদুয়ারে বক্সা দিয়ে বাংলাদেশের রংপুর, গুয়াহাটির সন্নিকটস্থ হাজো থেকে তিব্বত হয়ে চীনের সিচ্যুয়ান প্রদেশের রাজধানী চেংগদুরের মধ্য দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য পথ ছিল। গুয়াহাটির কামাখ্যার সন্নিকটে ব্রহ্মপুত্র নদ বন্দরটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর ছিল যা পুনরায় নির্মাণ করা হয়েছে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বাণিজ্য পথ নির্মাণের কাজ দ্রুত গতিতে চলছে সেটি বিস্তৃত রয়েছে চীনের ঝেজিং, হিউয়ান, গুরহও এবং ইউনান থেকে মায়ান্মার পর্যন্ত। ইউনানের রাজধানী কানমিং থেকে মায়ান্মার সীমান্ত অঞ্চল মিইতিকিইনা পর্যন্ত রেলপথের কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে এবং ২০০৫-এর এপ্রিলে মায়ান্মার সীমান্ত খুলে দিয়ে ইউনান-ভিয়েতনাম রেলপথ উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। ইউনান-অরুণাচল প্রদেশ-অসম-মণিপুর-মায়ান্মার সড়ক পথ নির্মাণের কাজ দ্রুতগতিতে চলছে। ইউনান থেকে মায়ান্মারের মিইতিকিইনা হয়ে অসমের লিডো এবং লিডো থেকে মণিপুর হয়ে মায়ান্মার হয়ে থাইল্যাণ্ড পর্যন্ত মায়ান্মার-ভারত-থাইল্যাণ্ড ত্রিস্তরীয় মহাসড়ক বা এশিয়ান হাইওয়ে এবং আন্তঃএশিয়ান রেল নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার ব্যাপারেও উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। মণিপুর মায়ান্মার সড়ক নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ হতে চলেছে। পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় রেল-সড়ক যোগাযোগ গড়ে ওঠার সাথে সাথে দক্ষিণ চীন সমুদ্রে ও মায়ান্মারের মধ্য দিয়ে বঙ্গোপসাগরে চীনের উপস্থিতির পরিকল্পনাও আমেরিকা ভাল চোখে দেখছে না। ভারতও মিজোরামের কালাদান নদীর মুখে মায়ান্মারের পুরোনো ব্রিটিশ বন্দরের আধুনিকীকরণের মাধ্যমে নদীপথে বাণিজ্যেরও পরিকল্পনা করছে। আমেরিকা জাপান ও তাইওয়ানের সাথে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করলেও, জাপানের সাথে বাণিজ্যিক স্বার্থের সংঘাত তীব্র হচ্ছে এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া আমেরিকার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তাহলে চীন-ভারত ও আশিয়ান গোষ্ঠীর সাথে জাপানকে সামিল করার চীনের পরিকল্পনার দিকেই জাপান ঝুঁকে পড়বে। সুতরাং এই পরিকল্পনাকে ভেস্তে দিতে ভারতই হবে আমেরিকার কাছে দাবার ঘুঁটি। সেক্ষেত্রে উত্তর-পূর্বাঞ্চলও একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। উত্তর-পূর্বাঞ্চল উন্নয়নের (DoNER) কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মন্তব্য করেছেন – “উত্তর-পূর্বাঞ্চল এখন আর স্পর্শকাতর অঞ্চল নয়, এই অঞ্চল শুধুমাত্র ভারতবর্ষের জন্য নয়, প্রতিবেশী রাষ্ট্র চীন, বাংলাদেশ, ভূটান মায়ানমারের জন্য একটি রণনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল”। বাণিজ্য মন্ত্রী কমল নাথ মন্তব্য করেন যে চীন-ভারতের সাথে আশিয়ানই এশিয়ার ভবিষ্যত। মায়ান্মারের উপর রয়েছে আমেরিকার অবরোধ (Sanction )। মায়ান্মার সরকারের বিরুদ্ধে ভারতকে ব্যবহার করতে আমেরিকা চাপ সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু ভারত সরকার মায়ান্মারে বিনিয়োগ করতে এবং সে দেশের গ্যাস সরবরাহ পেতে আগ্রহী। মায়ান্মারের উপর রয়েছে চীনের প্রভাব। সেজন্য ভারত আমেরিকার প্রস্তাবে সাড়া দেয়নি। মায়ান্মারের ভূগর্ভস্থ গ্যাসের ড্রিলিং-এর কাজের ৩০ শতাংশে ভারতের অংশীদারীত্ব রয়েছে এবং ভারতের ইঞ্জিনিয়ার কারিগররা ড্রিলিং-এর কাজের সহায়তা করছেন। ওনজিসি ও গ্যাস অথরিটি অব ইণ্ডিয়া মায়ান্মারের বৃহত্তর গ্যাস ফিল্ড ‘শিউফিল্ড’ ডেভেলাপমেন্টের কাজে যুক্ত রয়েছে। অপরদিকে চীনের তেল কোম্পানীর সাথে বিভিন্ন দেশে যৌথ উদ্যোগ ইস্পাত সহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও প্রসারিত হচ্ছে। চীন-ভারত বাণিজ্যের বৃদ্ধি ঘটছে এবং এক্ষেত্রে ভারতের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত রয়েছে। আশিয়ানের সাথে ভারতের বাণিজ্য ২০০৫-০৬ সাল থেকে ২০০৬-০৭ সালে আমদানীর ক্ষেত্রে ৬৬% ও রপ্তানীর ক্ষেত্রে ২০.৬৭% বৃদ্ধি ঘটেছে (Source : Director General of Commercial Intelligence and Statistics) আশিয়ানের সাথে চীনের বাণিজ্য বৃদ্ধির হার ৩০%। ভারতের বাণিজ্য চীনের সাথেই সবচাইতে বেশি। ভারতের সাথে সম্পর্কের উন্নতির জন্য সিকিমকে ভারতের অঙ্গ বলে চীন সরকারীভাবে ঘোষণা করেছে। অন্যদিকে গ্যাস রিজার্ভকে কেন্দ্র করে আমেরিকান তৎপরতা এবং বাংলাদেশ সনুদ্রবন্দরে সামরিক ঘাঁটি গড়ে তোলার জন্য আমেরিকার প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে বাংলাদেশে ব্যাপক আমেরিকান সান্রাজ্যবাদ বিরোধী গণচেতনার উন্মেষ ঘটেছে। এই গণচেতনার ভয়েই বাংলাদেশের তদারকি সরকার এমনকী টাটাদের সাথেও চুক্তি করা থেকেও বিরত থাকে এবং সম্প্রতি টাটারা বাংলাদেশের বিনিয়োগ সম্প্রসারণের পরিকল্পনা বাতিল করতে বাধ্য হয়। পার্শ্ববর্তী দেশ নেপালে নতুন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য নতুন সূর্যের উদয় হয়েছে। গোটা উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও পার্শ্ববর্তী দেশগুলির বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে দীর্ঘ বঞ্চনাজনিত ক্ষোভ। চীন-ভারত-মায়ান্মার সবকটি দেশই অভ্যন্তরিণ ক্ষেত্রে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর গণতান্ত্রিক অধিকার মেনে নিতে অস্বীকার করে। ১৭৮৪-তে আরাকান অঞ্চল অধিগ্রহণের পর এবং পরবর্তীতে জাপানী ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের অধিগ্রহণ ও চক্রান্তের ফলে রহোঙ্গিয়া জনগোষ্ঠীর কোন অধিকার সাব্যস্ত হয়নি এবং বাংলাদেশের চট্টগ্রামের কক্সবাজারে এই মুসলিম জনগোষ্ঠীর বহু লোক এখনও রিফিউজি এবং মায়ান্মারে তারা অনুপ্রবেশকারী সমস্যার শিকার। মায়ান্মার সরকার বিভিন্ন বিদ্রোহী জনগোষ্ঠীর সাথে শান্তি চুক্তির মাধ্যমে পুরো দেশে নিয়ন্ত্রণ কায়েম করলেও রোহিঙ্গিয়া সহ বেশ কিছু বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সাথে শান্তি চুক্তি এখনও হয়ে উঠেনি। মায়ান্মারের জুন্টা সরকারের কোনধরনের গণতান্ত্রিক রীতিনীতি না মানাই স্বাভাবিক, যদিও আশিয়ানভুক্ত দেশ হিসাবে তারা মানবাধিকার সংক্রান্ত ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেছে। বাংলাদেশের চাকমাদের প্রশ্ন নিয়েও রয়েছে জটিলতা এবং চাকমারা উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কিছু রাজ্যে বহিরাগত হিসাবে প্রায়শয়ই আক্রমণের শিকার। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মত চীনের ইউনান প্রদেশ বঞ্চিত ও অনুন্নত, তীব্বতীদের গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রতি চীন সরকারের দৃষ্টিভঙ্গী ফ্যাসিস্টসুলভ।

এই পরিপ্রেক্ষিতে জনগোষ্টীগত বঞ্চনার বাস্তবতার উপর দাঁড়িয়ে উগ্রজাতিয়তাবাদী, জনজাতীয় সংকীর্ণতাবাদ ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপ এবং থাইল্যাণ্ডের অস্ত্রব্যবসায়ী কুখ্যাত স্বর্ণ ত্রিভুজের (Golden Triangle) সাথে সম্পর্ককে ব্যবহার করে উত্তর-পূর্বাঞ্চল সহ পার্শ্ববর্তী দেশগুলিতে অস্থিরতা সৃষ্টি করার পেছনে আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থ জড়িত থাকাই স্বাভাবিক। তিব্বতীদের সংগ্রামে যে আমেরিকানরা গণ্ডগোল পাকাতে চাইছে এটাও স্পষ্ট। এবারের অনুপ্রবেশ ইস্যু নিয়ে ঘটনা পরম্পরাও এদিকেই ইঙ্গিত করছে। আগস্ট মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে রাশিয়ান প্রতিনিধি দল অরুণাচল প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর সাথে দেখা করে পরিকাঠামো ও অন্যান্য ক্ষেত্রে বিনিময়ের ব্যাপার আলোচনা করে। বাংলাদেশ আমেরিকার চাপের কাছে নতি স্বীকার করছে বলে একটা ধারণা তৈরি হচ্ছিল, এখন আবার উল্টো ইঙ্গিত আসতে শুরু করেছে। বিশ্ব বাণিজ্য আলোচনা ভেস্তে যাওয়ার জন্য চীন-ভারতকেই দায়ী করছে ওয়াশিংটন এবং অন্যদিকে আশিয়ানের সাথে ভারত মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছে এবং এ’বছরের মধ্যেই চীন ও জাপানের সাথেও আশিয়ানের চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। অন্যদিকে আমেরিকার শর্ত মেনে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করছে আশিয়ানভুক্ত মালয়েশিয়ার মত দেশও। সুতরাং চীন-ভারত ও আশিয়ান দেশগুলির বাণিজ্যিক উদ্যোগ ও আঞ্চলিক জোট গড়ার ক্ষেত্রে ব্যাঘাত ঘটানোর জন্য এঅঞ্চলে অস্থিরতা ও নাশকতা সৃষ্টির পেছনে আমেরিকান মদতপুষ্ট সন্ত্রাসবাদীরা তৎপর থাকবে। এবং তাই আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী গণ-আন্দোলন গড়ে তোলা উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাসিন্দাদের মুখ্য কর্তব্য। এই কর্তব্য পালন করতে হলে এক বৃহৎ গণতান্ত্রিক জোট গড়ে তুলতে হবে। একটি গনতান্ত্রিক কর্মসূচীর ভিত্তিতেই এই জোট গড়ে উঠতে পারে, যে কর্মসূচীতে থাকবে বিদেশি সমস্যার স্থায়ী সমাধানের প্রশ্ন, প্রতিটি জনগোষ্ঠীর সমান অধিকার – সমান মর্যাদার প্রশ্ন ও সম্প্রসারণবাদ, উগ্রজাতীয়তাবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবাদের বিরোধিতা। গণআন্দোলন ও গণপ্রতিরোধই দেশীয় প্রতিক্রিয়াশীল ও সাম্রাজ্যবাদী প্রভুদের টুঁটি চেপে ধরবে।  

ডার্করুমে আজাদ

Posted by স্বাভিমান Labels: , ,

(হঠাৎ মনে উদয় হল – তাই এই অনুগল্পটি লিখে ফেললাম)
            তখন কত আর বয়স হবে তার। বছর দেড়েক হল ম্যাট্রিক পাশ করেছে। অসমীয়া মাধ্যমে পড়েছে সে, বাড়িতে বাংলা বললেও নিজেকে অসমীয়া-মুসলিম বলেই জানে বরপেটার ভানুবিলের আজাদ। নিরীহ গোবেচারা প্রকৃতির ছেলে। সেবার যখন সন্ত্রাসী আক্রমণে তার গ্রাম জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যায়, গ্রামের অন্য সমবয়সীদের সাথে সে প্রতিরোধে সামিল হতে পারেনি। তার সমবয়সীরা তাকে কাপুরুষ-মেয়েলি স্বভাবের বলে অবজ্ঞা করত। সেবার তারা সপরিবারে আশ্রয় নেয় রিফিউজি ক্যাম্পে। তাকেও রোজগারের সন্ধানে নেমে পড়েতে হয়। ভাল রোজগারের সন্ধান পেয়ে দুই বন্ধু পাড়ি দেয় মুম্বাই শহরে। উপেন বড়ো তার স্কুলের সহপাঠী এবং দুজনে গলায় গলায় ভাব।
          মুম্বাইয়ে এক ডিজাইনার কোম্পানীর ওয়ার্কশপের ডার্করুমে দুজনে একসাথে কাজ করে। কিন্তু অর্থ রোজগারের যে আশায় দুই বন্ধু মুম্বাই পাড়ি দিয়েছিল তা এখনও পূরণ হয়নি – এই চাকরিতে নিজের খাওয়া-দাওয়ার খরচ শেষে বিশেষ সঞ্চয় করা যায় না। তাই অন্য ভাল কাজের সন্ধানে রয়েছে তারা।
যে মেসে তারা থাকে সেখানে টিভি দেখার বন্দোবস্ত করে দিয়েছে বাড়ি-মালিক। সেদিন রাতের খাওয়া-দাওয়া সেরে টিভির পর্দায় দুজনে চোখ রাখে। গুরদোয়ারায় আমেরিকান যুবকের সশস্ত্র আক্রমণের খবর উপেন খুব মনযোগ দিয়ে শুনে, কিন্তু আজাদ এই খবর শুনতে চায় না। তার গ্রাম আক্রমণের দুঃস্বপ্ন সে ভুলে থাকতে চায়।
           পরদিন যথারীতি কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে দুজনেই। দারোয়ান এসে খবর দেয় আজাদের একটা ফোন এসেছে। ফোন ধরতে চলে যায় আজাদ। কিছুক্ষণ পর আজাদ ফিরে আসে। অন্ধকারে উপেন তার শক্ত চোয়াল ও উদভ্রান্ত চেহারা দেখতে পায়নি। উপেন ফোনের খবর জানতে চাইলে, টেবিলে রাখা ছুরি তুলে নিয়ে সজোরে উপেনের বুকে বসিয়ে দেয় আজাদ উপেন মাটিতে লুটিয়ে পড়ে, আজাদও দেখতে পায়নি তার প্রিয় বন্ধুর প্রাণহীন মুখ। আজাদ রক্তরাঙা ছুরি উঁচিয়ে ধরে ডার্করুম ছেড়ে বেরিয়ে আসে। ভাবলেশহীন আজাদকে এভাবে দেখতে পেয়ে আশপাশের সবাই তাকে ধরে ফেলে, কিন্তু সে যেন কিছুই বুঝতে পারছে না – শারীরিক যন্ত্রণার গোঙানির সাথে মিশে ‘আমি কাপুরুষ নই’ কথাটি তার গলা থেকে বেরিয়ে আসছে। পুলিশ এসে আজাদকে নিয়ে যায়। কথাবার্তা বলে পুলিশের মনে হয় সে মানসিক রোগী – চিকিৎসার জন্য তাকে আদালতের সুপারিশে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পুলিশ খবর নিয়ে জানতে পারে সেদিন আজাদের এক আত্মীয় তাকে রিফিউজি ক্যাম্প আক্রমণের খবর দিয়েছিল, যে আক্রমণে অনেকের সাথে তার পরিবারের সবাই নিহত হয়।
         কিছুদিন চিকিৎসার পর তার মানসিক ভারসাম্য ফিরে এলে তাকে সংশোধনাগারে পাঠানো হয়। আদালত থেকে জেলে পৌঁছতে পৌঁছতে মাগরিবের নামাজের সময় হয়ে যায়। জেল আঙিনার একপ্রান্তে মুসলিম কয়েদিরা সারিবদ্ধ হয়ে হাঁটুগেড়ে বসে পড়েছে। আজাদও তাদের সাথে যোগ দেয়। জীবনে এই প্রথমবারের মত নামাজের মর্মার্থ বোঝার চেষ্টা করে আজাদ।

প্রযুক্তি-চর্চা, সমস্যা জর্জরিত বরাক উপত্যকা ও বিশেষজ্ঞদের ভূমিকা

Posted by স্বাভিমান Labels: , , , , ,

         

        (বেশ কিছুদিন আগে 'দৈনিক সাময়িক প্রসঙ্গে' এই লেখকের একটি চিঠি বেরিয়েছিল – সেই চিঠির বিষয়বস্তুকে নিয়েই 'অরুণোদয়' কাগজের  জন্য এই পুনর্লিখন – অরূপা মহাজন।)
           ঙ্গল গ্রহে ইসরোর উপগ্রহ অভিযানের জন্য ভারত সরকারের কেবিনেট ৪৫০ কোটি টাকা মঞ্জুর করেছে। এই উপগ্রহটি নাকি লাল-গ্রহের বায়ুমণ্ডল যাচাই করবে। অর্থমূল্যের হিসেবে বিচার করলে এই অভিযানকে ভারতের মত দরিদ্র দেশের অর্থের অপচয় হিসেবে বিবেচনা করা যায় না। কিন্তু এই অভিযানকে ফলাও করে প্রচার করার মধ্যে বিজ্ঞান ও কারিগরি বিদ্যাচর্চার ক্ষেত্রে আমাদের দিশাহীন কিংবা একদেশদর্শী পরিকল্পনার প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এই অভিযানকে কেন এতো গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে? তার দুটি মুখ্য কারণ রয়েছে। প্রথমত এতে আমাদের এলিট শ্রেণির এবং তাদের নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শিক্ষিত ও প্রভাবান্বিত মধ্যশ্রেণির সুপার-পাওয়ার হওয়ার সুপ্ত অলীক বাসনাকে আরেকটু উস্কে দেওয়া যায় – বিশ্ব এলিট ক্লাবের সাথে  গা-ঘেঁষাঘেষি করে তাদের ‘অল্টার-ইগোকে’ ফুলে-ফেঁপে উঠতে দেওয়া যায়। সুপার-পাওয়ার হওয়ার এই বহিরঙ্গের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত একটা অন্তরঙ্গও রয়েছে যা আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের এমনকি মানব সভ্যতার জন্য বিপদজনক। কী সেই বিপদ? বহিরঙ্গে সুপার-পাওয়ার হওয়ার প্রয়াস অন্তরঙ্গে সুপার হওয়ার প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেই করতে হয় অর্থাৎ আমাদের এলিট শ্রেণি ও তাদের পোঁ-ধরারা যখন ইউরোপ-আমেরিকার সমকক্ষ সঙ্গী হওয়ার চেষ্টায় ব্রতী, তখন কোটি কোটি নিরন্ন দরিদ্র মানুষ যারা খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থানের জন্য সরকারী ব্যয় বৃদ্ধি করার ব্যাপারে উদগ্রীব হয়ে এলিট-শ্রেণির উপরে উঠার প্রক্রিয়ায় অন্তরায় হতে চায় – তখন এই নিরন্ন-হাঘরেদের পদদলিত করেই তাদের বাসনাকে কায়েম করা যায় এবং এরজন্যই উন্নত প্রযুক্তির দোহাই দিয়ে সাধারণ মানুষকে ভিটেমাটি ছাড়া করা হচ্ছে – তা সে নিউক্লিয়ার এনার্জির জন্যই হোক বা বিগড্যাম। প্রযুক্তির এই চর্চার সাথে সৃজনশীলতার বিশেষ কোন সম্পর্ক নেই –এটা একধরণের স্কিলের চর্চা। অথচ আমজনতার সমস্যা সমাধানের সাথে যদি প্রযুক্তি চর্চার বিষয়কে জুড়ে দেওয়া যেত তাহলে প্রযুক্তিচর্চার সাথে যুক্ত সবাই সৃজনশীল গবেষণার এক বিশাল কর্মযজ্ঞের সাথে সামিল হয়ে দেশ গঠনে ব্রতী হওয়ার সুযোগ পেত। এই দৃষ্টিভঙ্গীতে যাতে বৌদ্ধিক সমাজ প্রভাবিত না হয় – সেটাই               মঙ্গল-অভিযানকে ফলাও করে প্রচার করার দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ অন্তর্নিহিত কারণ। অথচ আধুনিক ইউরোপ যে এই পথ পরিক্রমা করেই এসেছে সে ব্যাপারে আমাদের এলিটরা অবগত হলেও ন্যস্তস্বার্থে ও ওলিগোপলিস্টদের (একচেটিয়া কর্পোরেটদের গ্রুপ) সেবাদাসত্বের দাসখতে সই করে জ্ঞানচর্চার এক ভ্রান্ত পথের দিকে দেশ-জাতিকে পরিচালিত করছেন।  উন্নত প্রযুক্তির ঢোল বাজিয়ে কর্পোরেট প্রভুদের নির্দেশে ২০০৫ সালে বিদ্যুৎ ক্ষেত্র সংস্কারের আইন পাশ করা হল। দীর্ঘ সাত বছর পর উন্নত প্রযুক্তির দেশজোড়া নমুনা দেখল দেশবাসী। বিদ্যুত ঘাটতিজনিত যন্ত্রণার স্থানিক অনুভূতিকে দীর্ঘ তথাকথিত উন্নত প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বিশাল পরিমাণ মৃত-পুঁজির সৃষ্টি করে এবং সাধারণ মানুষের উপর বিশাল বিদেশি ঋণের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে জাতীয় অনুভূতিতে রূপান্তরিত করা হয়েছে। বিশ্বায়িত প্রযুক্তির বাজারে অনুভূতির বিশ্বায়নের দিকে যাত্রা। বিশ্বায়নের এই যাত্রার বিপরীতে একটা স্থানিক যাত্রার হিসাব আমরা এবার করে দেখতে পারি। কারণ যখন প্রযুক্তি শিক্ষার নামে মঙ্গল গ্রহে যান পাঠাচ্ছে আমাদের সরকার, তখন বরাকের মানুষরা নিজের অঞ্চলের বাইরে বেরোতে নিজের প্রাণটাকেই অজানা ভিন-গ্রহে পাঠিয়ে দিচ্ছেন।
                 বিজ্ঞান ও কারিগরি বিদ্যার বিভিন্ন শাখায় আমাদের এঅঞ্চলে কৃতবিদ্যদের সংখ্যা নেহাত কম নয়। কিন্তু কৃষি-শিল্প-নাগরিক সুযোগ সুবিধা-পরিবেশ ইত্যাদি সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যার সমাধানকল্পে কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজ ও তার বাস্তবায়ন আমাদের খুব একটা চোখে পড়ে না। ভাষা-সংস্কৃতি-উৎপাদন পদ্ধতি-জলবায়ু ইত্যাদি সবদিক থেকে আমাদের মত বৈচিত্রময় দেশে যে কোন সমস্যার একটা স্থানিক মাত্রা থাকে। কিন্তু বাস্তব পৃষ্ঠভূমি থেকে সমস্যা সমাধানের বাস্তব কোন পদ্ধতি আবিষ্কারের কষ্টসাধ্য ও সৃজনশীল পথ পরিহার করে আমরা অনুকরণের মাধ্যমে দক্ষ বিশেষজ্ঞ তকমা পেতে বেশি আগ্রহী। জ্ঞানার্জনকে বাজারের চাহিদার দ্বারা পরিচালিত দক্ষতার (Skill) স্তরে নামিয়ে আনার পরও আমাদের সমাজ নামী উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের অত্যন্ত সম্ভ্রমের সাথে দেখে, কারণ সমাজ ধরে নেয় যে এই প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের বিদ্যা-বুদ্ধি-জ্ঞান এতো বিশাল যে তার থেকে সমাজ উপকৃত হবে। কিন্তু বাস্তবে এই  দক্ষ লোকদের সংখ্যাবৃদ্ধির সাথে তাল মিলিয়ে আর্থ-সামাজিক সমস্যা ও সামাজিক অবনতির মাত্রা কেন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে? এর উত্তর আমাদের সার্বিক আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার সাথে সাথে সম্ভবত শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যেও নিহিত রয়েছে। সম্প্রতি এক টিভি-চ্যানেলের বিতর্ক প্রোগ্রামে একজন অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণ চিকিৎসক মন্তব্য করেন যে আমাদের শিক্ষা পদ্ধতি ক্রমাগত অনুভূমিক (Horizontal) থেকে উলম্ব (Vertical) হয়ে যাচ্ছে এবং ফলে সামগ্রিক জ্ঞানের মাধ্যমে সৃজনীক্ষমতা বিকাশের বদলে এটা একধরনের ট্রেনিং-এ রূপান্তরিত হচ্ছে – সবকিছুই এখন উন্নত  থেকে উন্নততর ওয়ার্কশপ যেখানে পুঁজির সেবা করার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষ লোক তৈরি করা হচ্ছে এবং বিশ্লেষণী ক্ষমতা বিকাশের বদলে শিক্ষার মানে হয়ে যাচ্ছে পুনঃপুনঃ পাঠের মাধ্যমে একধরনের মুখস্ত বিদ্যা (Learning by rote)। এরমধ্যেই ব্যতিক্রমী কাজ যে হচ্ছে না তা নয় –  কিন্তু তা সাধারণত মিডিয়াকে, বাজারের নিয়মকে ও নীতি নির্ধারণকে প্রভাবিত করতে পারে না। এভাবে বেশিদিন চলতে পারে না – কারণ গোটা সমাজ গুটি গুটি পায়ে অতি সত্বর এক ভয়ঙ্কর পরিণতির দিকে পা বাড়াচ্ছে। যদি আমরা মনে করি যে সব বিজ্ঞানই শেষ বিচারে মানব সভ্যতার জন্যই, যে সভ্যতা আজ অস্তিত্ব সংকটের    সামনে দাঁড়িয়ে গেছে – তাহলে আমাদেরকে বিকল্প পথ অনুসন্ধান করতেই হবে।
               অত্যন্ত ছোট মাপের কাজের কথা এখানে উল্লেখ করা যায়। সারা পৃথিবী জল সংকটে ভুগছে – জল নিয়ে প্রায় যুদ্ধ বাধার উপক্রম। দক্ষিন ভারতের কোন এক শহরের পুরসভা ছাদের জল সংগ্রহ করা বাধ্যতামূলক করে দিয়ে উপকৃত হয়েছে। চেরাপুঞ্জিতে যখন জল সংকট, তখন থর মরুভূমির এক বসতি অঞ্চল কোন ব্যয়বহুল পদ্ধতি অবলম্বন না করেই জল সমস্যার সমাধান করে নিয়েছে। আমাদের শিলচরের কোন বিশেষজ্ঞ ছাদের জল নিয়ে একটা হিসাব করতেই পারেন এবং তাতে যদি দেখা যায় আমাদের উপকৃত হওয়ার সম্ভাবনা আছে তাহলে পুরসভা ও উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ তা বাধ্যতামূলক করে দিতে পারে। জল নিষ্কাশনী সমস্যার  সমাধানেও কোন উদ্ভাবনী প্রয়াস নজরে পড়ে না – জল নিষ্কাশন ও জল সংরক্ষণকে সম্পৃক্ত করে ভাবলে কোন সমাধানসূত্র বেরতেও পারে। বরাকের কৃষির অবস্থা খুবই শোচনীয় এবং তারজন্য বিভিন্ন ফ্যাক্টর দায়ি। কিন্তু বরাকের কৃষকদের বাস্তব অভিজ্ঞতাকে সার-সংকলিত করে কোন বিকল্প পন্থা-পদ্ধতি আবিষ্কারের চেষ্টা কেউ করছেন বলে শোনা যায়নি। মাত্র ১০০/১১০ মেগাওয়াট চাহিদা থাকা একটা অঞ্চলে বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানের জন্য কোন এক বৃহৎ কর্মকাণ্ডের প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। সামাজিকভাবে উপযোগী-স্থায়ী ও সস্তায় এই নগণ্য পরিমাণ  বিদ্যুৎ উৎপাদন ও যোগানের বন্দোবস্ত এখানেই করা যায় বলে আমাদের বিশ্বাস। এই বিশ্বাসকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে আমাদের এঅঞ্চলের কারিগরি প্রতিষ্ঠানগুলো কোন কাজ করছে কি? মনে হয় – না। অথচ প্রতিবারই সমস্যা সমাধানের নতুন নতুন মন্ত্র আমাদের শোনানো হয় – এবারের নতুন মন্ত্র হচ্ছে পালাটনা, ভাবখানা এরকম যে এই বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র বরাকের চাহিদা মেটানোর জন্যই তৈরি হচ্ছে, আর বরাক ড্যাম – সে তো আরেক মিথ্যার বেসাতি।  সব পরিকল্পনা তৈরি করা হয় বিদেশি ঋণ ও প্রযুক্তির উপর নির্ভর করে, তাতে সম্পদের বহির্গমণ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি ঘটে প্রকৃত অর্থনীতি পঙ্গু হলেও নীতি নির্ধারকদের কোন মাথাব্যথা নেই। 
              এখন আমাদেরকে প্রতিনিয়ত ভূমিকম্পের বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করা হচ্ছে। ব্যয়বহুল সব পদ্ধতির কথা আমাদেরকে শোনানো হচ্ছে যা আমাদের মত দেশে বাস্তবে গণহারে কার্যকরী হওয়া সম্ভব নয়। ভূমিকম্প রোধ ও ভূমিকম্প থেকে বাঁচানোর কার্যকরী কোন পদ্ধতি যদি বাস্তবায়িত না হয়, তাহলে এই ব্যয়বহুল মচ্ছবের কী অর্থ? সব বিষয়ের উপর আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রচুর অর্থ ব্যয়ে ওয়ার্কশপ হয়। ভিন্ন সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ইতিহাসের প্রেক্ষিতে অত্যন্ত কার্যকরী ও সৃজনশীল আবিষ্কারের ট্যাকনিক্যাল তথ্য এই ওয়ার্কশপগুলোতে দেওয়া হয়। প্রথমত এই বিষয়গুলি ট্রেনিরা ট্রেনিং-লিটার্যা চার থেকে নিজেরাই আয়ত্ব করে নিতে পারে, দ্বিতীয়ত আমাদের বাস্তব পরিস্থিতিতে এগুলোর বিশেষ কোন বাস্তব কার্যকারিতা নেই। সুতরাং এই ওয়ার্কশপগুলো থেকে প্রাপ্ত তথ্যের বোঝাগুলো মাথায় বয়ে নিয়ে বেড়ানো কি অর্থহীন হয়ে পড়ে না?

স্বাভিমান:SWABHIMAN Headline Animator

^ Back to Top-উপরে ফিরে আসুন