(হঠাৎ মনে উদয় হল – তাই এই অনুগল্পটি
লিখে ফেললাম)
তখন কত আর বয়স হবে তার। বছর দেড়েক হল ম্যাট্রিক পাশ
করেছে। অসমীয়া মাধ্যমে পড়েছে সে, বাড়িতে বাংলা বললেও নিজেকে অসমীয়া-মুসলিম
বলেই জানে বরপেটার ভানুবিলের আজাদ। নিরীহ গোবেচারা প্রকৃতির ছেলে। সেবার যখন
সন্ত্রাসী আক্রমণে তার গ্রাম জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যায়, গ্রামের অন্য সমবয়সীদের
সাথে সে প্রতিরোধে সামিল হতে পারেনি। তার সমবয়সীরা তাকে কাপুরুষ-মেয়েলি স্বভাবের
বলে অবজ্ঞা করত। সেবার তারা সপরিবারে আশ্রয় নেয় রিফিউজি ক্যাম্পে। তাকেও
রোজগারের সন্ধানে নেমে পড়েতে হয়। ভাল রোজগারের সন্ধান পেয়ে দুই বন্ধু পাড়ি
দেয় মুম্বাই শহরে। উপেন বড়ো তার স্কুলের সহপাঠী এবং দুজনে গলায় গলায় ভাব।
মুম্বাইয়ে এক ডিজাইনার কোম্পানীর ওয়ার্কশপের ডার্করুমে
দুজনে একসাথে কাজ করে। কিন্তু অর্থ রোজগারের যে আশায় দুই বন্ধু মুম্বাই পাড়ি
দিয়েছিল তা এখনও পূরণ হয়নি – এই চাকরিতে নিজের খাওয়া-দাওয়ার খরচ শেষে বিশেষ
সঞ্চয় করা যায় না। তাই অন্য ভাল কাজের সন্ধানে রয়েছে তারা।
যে মেসে তারা থাকে সেখানে টিভি দেখার বন্দোবস্ত করে দিয়েছে
বাড়ি-মালিক। সেদিন রাতের খাওয়া-দাওয়া সেরে টিভির পর্দায় দুজনে চোখ রাখে।
গুরদোয়ারায় আমেরিকান যুবকের সশস্ত্র আক্রমণের খবর উপেন খুব মনযোগ দিয়ে শুনে,
কিন্তু আজাদ এই খবর শুনতে চায় না। তার গ্রাম আক্রমণের দুঃস্বপ্ন সে ভুলে থাকতে
চায়।
পরদিন যথারীতি কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে দুজনেই। দারোয়ান এসে
খবর দেয় আজাদের একটা ফোন এসেছে। ফোন ধরতে চলে যায় আজাদ। কিছুক্ষণ পর আজাদ ফিরে
আসে। অন্ধকারে উপেন তার শক্ত চোয়াল ও উদভ্রান্ত চেহারা দেখতে পায়নি। উপেন ফোনের
খবর জানতে চাইলে, টেবিলে রাখা ছুরি তুলে নিয়ে সজোরে উপেনের বুকে বসিয়ে দেয় আজাদ। উপেন মাটিতে লুটিয়ে পড়ে, আজাদও দেখতে পায়নি
তার প্রিয় বন্ধুর প্রাণহীন মুখ। আজাদ রক্তরাঙা ছুরি উঁচিয়ে ধরে ডার্করুম ছেড়ে
বেরিয়ে আসে। ভাবলেশহীন আজাদকে এভাবে দেখতে পেয়ে আশপাশের সবাই তাকে ধরে ফেলে,
কিন্তু সে যেন কিছুই বুঝতে পারছে না – শারীরিক যন্ত্রণার গোঙানির সাথে মিশে ‘আমি
কাপুরুষ নই’ কথাটি তার গলা থেকে বেরিয়ে আসছে। পুলিশ এসে আজাদকে নিয়ে যায়।
কথাবার্তা বলে পুলিশের মনে হয় সে মানসিক রোগী – চিকিৎসার জন্য তাকে আদালতের
সুপারিশে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পুলিশ খবর নিয়ে জানতে পারে সেদিন আজাদের
এক আত্মীয় তাকে রিফিউজি ক্যাম্প আক্রমণের খবর দিয়েছিল, যে আক্রমণে অনেকের সাথে
তার পরিবারের সবাই নিহত হয়।
কিছুদিন চিকিৎসার পর তার মানসিক ভারসাম্য ফিরে এলে তাকে
সংশোধনাগারে পাঠানো হয়। আদালত থেকে জেলে পৌঁছতে পৌঁছতে মাগরিবের নামাজের সময়
হয়ে যায়। জেল আঙিনার একপ্রান্তে মুসলিম কয়েদিরা সারিবদ্ধ হয়ে হাঁটুগেড়ে বসে
পড়েছে। আজাদও তাদের সাথে যোগ দেয়। জীবনে এই প্রথমবারের মত নামাজের মর্মার্থ
বোঝার চেষ্টা করে আজাদ।
0 comments:
Post a Comment