সদ্য সমাপ্ত পঞ্চায়েত নির্বাচনের তাৎপর্য 'কী করতে হবে?' – সেটাই বিচার্য
Posted by Labels: barak valley, Election, Mojuri Union, New Initiative, Panchayat
(অরুণোদয়ের
জন্য লিখেছেন অরূপা মহাজন)
আসামের পঞ্চায়েত নির্বাচনের ফলাফল
পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করার জন্য প্রয়োজনীয় সব তথ্য আমাদের সংগ্রহে এখনও আসেনি।
সাদামাটাভাবে কতগুলো মন্তব্য অতি-সরলীকরণের দোষে দুষ্ট না হয়েই করা যায়।
গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে বিদীর্ণ কংগ্রেস তার গড় ভোটভিত্তি বজায় রেখেছে – অঞ্চল ভেদে কোথাও
কমেছে – কোথাও বেড়েছে। সংখ্যালঘুদের মধ্যে কংগ্রেসের গ্রহণযোগ্যতা কমে যাওয়ার
প্রবণতা এবারও বজায় রয়েছে – তবে আরও ব্যাপক আকারে ধ্বস যে নামেনি তার মুখ্য কারণ
রাভা হাসং-এর নির্বাচন নিয়ে কংগ্রেসের কূটচাল দিশাহীন বিরোধীদের বিপর্যস্ত করতে
পেরেছে। অনেক লুটপাট ও ভাওতাবাজির পরও পঞ্চায়েত স্তরে গ্রামীণ মানুষের নগণ্য প্রাপ্ত সুযোগ-সুবিধাগুলিকে
বিরোধীদের দিশাহীনতার সুযোগ নিয়ে সামগ্রীকভাবে কংগ্রেস তাদের বদান্যতা হিসেবে
প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। কংগ্রেসের চাতুর্যপূর্ণ রাজনৈতিক পরিভাষা এবং তাদের
বক্তব্যকে আম-জনতার মধ্যে পৌঁছে দেওয়ার প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা জনগণের মধ্যে এমন
এক ধোঁয়াশার জন্ম দেয় যে সঠিক হিসেবে প্রাপ্তির অবনমন সত্ত্বেও কংগ্রেসি শাসনে প্রাপ্তির
আশাকে জিইয়ে রাখে ও চারিপার্শ্বে শূন্যতার মাঝে এই আশার বেলুনকে ফোলাতে তাদের বেগ
পেতে হয় না। তথাপি কংগ্রেসের ঘাড়ে এআইইউডিএফের তপ্ত নিশ্বাসের ফলে জন্ম নেওয়া
ভয়ঙ্কর বিষফোঁড়া নাছোড় গ্যাংগরিঙের রূপ পরিগ্রহ করার ভয় ঢুকেছে কংগ্রেসের
অন্দরমহলে যা কংগ্রেসের গোষ্ঠীদ্বন্দকে বাড়িয়ে দিতে সাহায্য করবে। সামগ্রিকভাবে
বিজেপি ও এজিপি উভয়েরই ভোটব্যাঙ্কে ধ্বস নেমেছে। আসামে বিজেপির মূল দূর্গ বরাক
উপত্যকায় বিজেপির উত্থানের গ্রাফ এবার খাড়া নিচের দিকে নেমে গিয়ে এক বড় পতনের জন্য
অপেক্ষা করছে। সামগ্রিকভাবে কংগ্রেস ভাল ফল করলেও বরাক উপত্যকায় কংগ্রেস কিন্তু
আশানুরূপ ফল করেনি, বরঞ্চ এইউডিএফ বরাক উপত্যকায় কংগ্রেসের অনেকগুলি আসন ছিনিয়ে
নিয়েছে। এবারের নির্বাচনে এইউডিএফ বরাক উপত্যকায় বাঙালি হিন্দু পিছিয়ে পড়া
সম্প্রদায়ের তাৎপর্যপূর্ণ ভোট লাভে সক্ষম হয়েছে। সব প্রতিষ্ঠিত দলের বাইরে
ধনবল-বাহুবলের সাথে টেক্কা দিতে শুধুমাত্র সাংগঠনিক শক্তি ও লিফলেট নিয়ে ভোটারদের
দোয়ারে পৌঁছে যাওয়া কর্মীদের অক্লান্ত পরিশ্রমের উপর ভিত্তি করে এবারে প্রথমবারের
মত গ্রামীণ শ্রমিকের ইউনিয়ন অসম মজুরি শ্রমিক ইউনিয়ন বরাক উপত্যকার তিন জেলায়
ভালসংখ্যক আসনে প্রার্থী দেয় এবং যেখানে তাদের প্রার্থী নেই সেখানে এআইইউডিএফ-কে
সমর্থন করে। ইউনিয়নের প্রায় সব প্রার্থী ভালসংখ্যক ভোট পেয়ে গ্রামাঞ্চলে এক নতুন
শক্তি হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। গ্রামীণ বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক কর্মীদের
অনেকেরই বক্তব্য হচ্ছে এই যে বিগত কয়েকবছর যাবত ইউনিয়নের নেতৃত্বে গ্রামীণ মানুষের
আন্দোলন ইউনিয়নের প্রার্থীদের নিজেদের ভোট প্রাপ্তি যেমনি সুনিশ্চিত করেছে ঠিক
তেমনি এইউডিএফের শক্তি বৃদ্ধির পেছনেও এক পরোক্ষ কারণ হিসেবে ক্রিয়াশীল থেকেছে। সাদামাটাভাবে
নির্বাচনী ফলাফলের সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলিকে এভাবেই বলা যায়। তবে বরাক উপত্যকায় কংগ্রেসের
আশানুরূপ ভোট না পাওয়া, ব্যাপকহারে বিজেপির ভোট কমে যাওয়া, এইউডিএফের ভোট ও আসন
বৃদ্ধি এবং গ্রামীণ শ্রমিক ইউনিয়নের এক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশকে
সমাজ-পরিবর্তনকামীদের ভবিষ্যত কর্মসূচী নির্ধারণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর
হিসেবে বিবেচিত হবে। সর্বোপরি নির্বাচনী ইস্তাহারে এক নতুন সামাজিক-রাজনীতির
প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচনে ইউনিয়নের সফলতা এক বিশেষ আলোচনার দাবি রাখে। পাঠকদের
বোঝার সুবিধার্থে ইউনিয়নের এই ইস্তেহার নিচে হুবহু তুলে দেওয়া হলো।
ইউনিয়নের গ্রামীণ সমর্থন-ভিত্তি যা হয় সরাসরি
ইউনিয়নের নির্বাচনী প্রার্থীর পক্ষে এসেছে অথবা কংগ্রেস-বিজেপিকে পরাস্ত করার
স্বার্থে এআইইউডিএফ-এর পক্ষে গিয়েছে, তা মূলতঃ গ্রামীণ শ্রমিক – দিনমজুর, গরিব ও
ভূমিহীন কৃষক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বা দোকানদার এবং গ্রামীণ শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীদের একাংশ,
জনগোষ্ঠীগতভাবে এরা পিছিয়ে পড়া ও তপসিলি সম্প্রদায় ও সংখ্যালঘু মানুষ। দেখা গেছে
যে যেসব পঞ্চায়েতে সমর্থন ভিত্তির সাথে সাথে ইউনিয়নের শক্তিশালী সংগঠন রয়েছে
সেখানেই ইউনিয়ন সরাসরি ভালসংখ্যক ভোট পেয়েছে এবং অন্যত্র ইউনিয়নের সমর্থন-ভিত্তি
ইউডিএফের সাথে চলে গিয়েছে। অর্থাৎ যেসব পঞ্চায়েতে ইউনিয়ন ভালসংখ্যক ভোট পেয়েছে
সেসব পঞ্চায়েতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা-কাঠামোর বাইরে এক সমান্তরাল গণ-ক্ষমতার কেন্দ্র হিসেবে
ভবিষ্যতে গণ্য হতে পারে যা গ্রামীণ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা-কাঠামোর বর্তমান চরিত্র
পরিবর্তনের লক্ষ্যে প্রতিনিয়ত চাপ সৃষ্টি করে চলবে। স্থানিক মাত্রায় চাপ সৃষ্টির
এই শক্তি যদি রাজ্য ও দেশব্যাপী গণ-আন্দোলনের শরিক এবং একই সাথে চালিকা শক্তি হতে
পারে তাহলেই পরিবর্তনের এক বাতাবরণ তৈরি হতে পারে যখন ক্ষমতা-দখল ও ক্ষমতার চরিত্র
– পরিবর্তন একইসাথে যুগপতভাবে ঘটে। এই দু’টি পরস্পর সম্পৃক্ত ঘটনা বর্তমান
নির্বাচন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে, বর্তমান নির্বাচন প্রক্রিয়ার ব্যাপক জনমুখী
পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে, নির্বাচন বহির্ভূত কোন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বা এই সবগুলির
এক মিশ্র-প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ঘটবে কি না সে প্রশ্নের উত্তরের জন্য এক পৃথক
বিতর্কের সূত্রপাত করা যেতে পারে। কিন্তু একথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে নিপীড়িত
শ্রেণি-বর্ণের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন ও তাকে ব্যাপক পরিসরে সঠিক মৌলিক পরিবর্তনের দিশায়
পরিচালিত করতে সক্ষম সাংগঠনিক প্রস্তুতি ছাড়া পরিবর্তনকামী কিছু লোকের এই ক্ষমতা –
কাঠামোয় অংশগ্রহণ বর্তমান রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলির চরিত্রের কোন পরিবর্তন সূচিত
করতে সক্ষম হবে না, বরঞ্চ এই ব্যবস্থা পরিবর্তনকামী এই লোকদেরকে যারা সমাজের
সবচাইতে পিছিয়ে পড়া অংশকে প্রতিনিধিত্ব করছে তাদেরকে আত্মস্থ করে নিতে পারে। এই
পরিপ্রেক্ষিতে ইউনিয়নের এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও ভালসংখ্যক ভোট প্রাপ্তি নির্বাচনে
কয়েকজন প্রার্থীর জয়ের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ নির্বাচনের মাধ্যমে প্রমাণিত
হওয়া এই শক্তি এক নতুন শ্রেণি রাজনীতির সূচনা করার শুরুয়াত হতে পারে, বিশেষ করে
আজকের পরিস্থিতিতে যখন দেশব্যাপী শ্রমিক আন্দোলন ও সবচাইতে নিপীড়িত জনগোষ্ঠীগুলোর
আন্দোলন আবারও মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে নির্বাচনে জিতে কিছু
সংস্কারমূলক কাজ করা কী মানুষকে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে অধিক সহায়ক হত না? আমাদের
মতে এই প্রশ্নের কোন সরাসরি ইতিবাচক বা নেতিবাচক উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়।
সংস্কারমূলক কাজ নির্বাচনে না জিতেও করা সম্ভব এবং তা ব্যাপক আকারেই করা উচিত এবং
নির্বাচনী ফলাফল ইঙ্গিত করছে যে এই কাজটি অর্থাৎ গ্রামীণ মানুষের ন্যায্য
অধিকারগুলি আদায় করার কাজটি এখন আরও ভালভাবে করা সম্ভব এবং সেক্ষেত্রে জয় –
পরাজয়ের ফারাক খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়, যদিও ইউনিয়নের অনেক প্রার্থীই জয়লাভ
করেছে। তার চাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এই যে সংস্কারমূলক আন্দোলনের অভিমুখকেই
শুধু পরিবর্তনকামী আন্দোলনের দিকে রাখলে চলবে না, পরিবর্তনকামী আন্দোলনও একইসাথে
জোরেসোরে গড়ে তুলতে হবে এবং এর জন্য চাই সচেতন প্রয়াস। আশু কিছু পদক্ষেপ এই সচেতন
প্রয়াসের অঙ্গ হয়ে উঠতে পারে। এগুলি হতে পারে নিম্ন রূপ – (১) রাজ্য ও
দেশব্যাপী মেহনতি মানুষের আন্দোলনের মধ্যে সামঞ্জস্য ও সমন্বয় গড়ে তুলতে আন্দোলনের
বিষয়ের ক্রমাগত সাধারণীকরণ ও সাংগঠনিক উদ্যোগকে স্থানিক গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ না রেখে
ব্যাপক পরিধিতে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ। (২) খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান ও
শ্রমিক অধিকারের আন্দোলনকে আরও জোরদার করার পাশাপাশি জনগোষ্ঠীগত অধিকারের প্রশ্নকে
আরও জোরদার করা। ইউনিয়ন যদিও যুগপতভাবে এই দু’ধরনের আন্দোলনই চালিয়ে যাচ্ছে, তবে
আমার মতে মেহনতি মানুষের পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলে যেসব মধ্যবিত্ত-বুদ্ধিজীবী বা উচ্চ
শ্রেণি-বর্ণের লোকেরা ইউনিয়নের সমর্থনে এগিয়ে এসেছে তাদেরকে পঞ্চায়েত/ব্লক স্তরেই
জনগোষ্টীগত অধিকারের আন্দোলনকে জোরদার করার জন্য এক পৃথক মঞ্চে সমাবেশিত করা যাতে
স্বউদ্যোগে এই আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজে সাংগঠনিকভাবে তারা যুক্ত হতে পারে
এবং শ্রমজীবী মানুষের সংগঠন ইউনিয়নের কাজেও সহযোগিতা ও সহায়তা করতে পারে। ইউনিয়ন
সংগঠন পরিচালন করার জন্য গ্রামীণ সাংগঠনিক কাঠামোয় শ্রমিক-গরিব মেহনতি মানুষ ও
মহিলাদের প্রাধান্য দেওয়া উচিত। (৩) উপরিউক্ত সবগুলি কাজকে এগিয়ে নেওয়ার
জন্য প্রয়োজন এক রাজনীতি সচেতন কর্মীবাহিনী যারা যে কোন শ্রেণি-বর্ণ থেকেই আসতে
পারে, কিন্তু তাদেরকে হতে হবে শ্রমিকশ্রেণির রাজনৈতিক আদর্শে দিক্ষিত ও রাজনীতি
সচেতনভাবে নির্দ্দিষ্ট পরিস্থিতির নির্দ্দিষ্ট ব্যাখ্যা ও তার ভিত্তিতে কর্মসূচী
রূপায়ণের জন্য গণতান্ত্রিক উপায়ে প্রতিনিয়ত ও জীবন্তভাবে গণ-সংগঠনের সাথে ভাবের
আদানপ্রদানে আগ্রহী ও সক্ষম। ◌◌◌
দুর্নীতিমুক্ত - শক্তিশালী
পঞ্চায়েত ও গ্রামসভা এবং গ্রামীণ মানুষের অধিকার সাব্যস্ত করুন।
আসন্ন পঞ্চায়েত
নির্বাচনে অসম মজুরি শ্রমিক ইউনিয়নের মনোনীত ও সমর্থিত প্রার্থীদের ভোট দিন।।
আমরা সামাজিক সংগঠন হয়েও নির্বাচনে অংশগ্রহণ
করছি। কেন? কারণ আমরা চাই পঞ্চায়েত হয়ে উঠুক গ্রামীণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার
হাতিয়ার। তথাকথিত রাজনৈতিক দলগুলি চায় পঞ্চায়েতকে দালাল তৈরির কারখানা হিসেবে
ব্যবহার করতে। আমরা চাই নতুন সামাজিক রাজনীতি যেখানে নির্বাচিত প্রার্থী ভোটারদের
মতামত মেনে চলবে, ওরা চায় নির্বাচনের পর মুষ্টিমেয় প্রভাব-প্রতিপত্তিশালী লোকের
কাছে সাধারণ ভোটাররা যেন পদানত থাকে। আমরা চাই পঞ্চায়েতের হাতে অধিক ক্ষমতা – শক্তিশালী
গ্রামসভা, ওরা চায় ডিআরডিএ-ব্লক ইত্যাদি মারফত মন্ত্রী-আমলাদের ক্ষমতার মাধ্যমে
পঞ্চায়েতকে, ব্যবহার করে হরির লুঠ চালিয়ে যেতে। তাই আইনানুগ গেজেট নোটিফিকেশন হওয়া
সত্ত্বেও ২৯টি বিভাগের ক্ষমতা পঞ্চায়েতের হাতে বাস্তবে দেওয়া হয় না – গ্রামসভাকে
সুকৌশলে বানচাল করে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। ইউনিয়ন তথাকথিত
রাজনৈতিক নেতা ও কতিপয় আমলাদের এই জনবিরোধী ভূমিকার বিরুদ্ধে বিগত বছরগুলিতে
লাগাতার সংগ্রাম চালিয়ে আসছে এবং অনেকক্ষেত্রে সফলতাও লাভ করেছে। এই আন্দোলনকে আরও
জোরদার করতে এই পঞ্চায়েত নির্বাচনে আমরা অংশগ্রহণ করছি।
বন্ধুগণ, এবারের পঞ্চায়েত
নির্বাচন এমন একটা সময়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে যখন আসাম তথা ভারতবর্ষে এক অস্থির
পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
কৃষক-শ্রমিক-মহিলা-নিপীড়িত-বঞ্চিত জনগোষ্ঠী এমনকী মধ্যবিত্ত সহ বিভিন্ন
স্তরের মানুষ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিক্ষোভে ফেটে পড়ছেন, ঠিক তেমনি আসামের জাতি-নির্মূলীকরণের
ঘৃণ্য রাজনীতির বলি হচ্ছেন লাখ লাখ ধর্মীয়-ভাষিক সংখ্যালঘু মানুষ। এই অস্থির
পরিস্থিতির জন্য দায়ী রঙ-বেরঙের শাসক দলগুলির নীতি ও চক্রান্ত। কারণ, সরকারী
জনবিরোধী নীতির ফলেই ধনী ও দরিদ্রের ব্যবধান দিন দিন বেড়েই চলেছে। বিগত
কংগ্রেস-বিজেপির শাসনকালে আমাদের দেশের আরবপতির (একশত শতকোটি টাকার মালিক) সংখ্যা
যেখানে জাপান-চীনের মত দেশের সংখ্যাকেও ছাড়িয়ে গেছে, সেখানে প্রতি ১০০ জনের মধ্যে
প্রায় ৮০ জনের দৈনিক ব্যয় গড়ে মাত্র ২০ টাকা অর্থাৎ তাদের দুবেলা দুমুঠো খাবার
জোটাতে মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয়। নিম্ন আসামের মত ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের
উদবাস্তু শিবিরে আশ্রয় নেওয়া উচ্ছেদ হওয়া মানুষের দুরবস্থার ও হাজার হাজার কৃষকের
আত্মহত্যার করুণ কাহিনী আমাদেরকে পীড়া দেয়। এরকম দুর্বিষহ পরিস্থিতিতেও সরকার
নিত্য-প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে চলেছে। তাই মানুষ আজ দিকে দিকে এই অপশাসনের
বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করছে। এই সব বিদ্রোহকে এক নতুন দিশা দেখাতে, গ্রামীণ
মানুষ-শ্রমিক-কৃষক-নিপীড়িত জনগোষ্ঠী-ছাত্র-যুব ও মহিলাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার
লক্ষ্যে এক নতুন সামাজিক রাজনীতির জন্ম দিতেই অসম মজুরি শ্রমিক ইউনিয়ন এই
নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে।
বন্ধুগণ, অনেকেই আশা
করেছিলেন যে অন্ততঃ ভাষিক-ধর্মীয় অধিকারের প্রশ্নে এআইইউডিএফ দল এক সামাজিক
রাজনীতির জন্ম দেবে। কিন্তু অনেকেই এখন আশাহত হতে শুরু করেছেন। অনেকেই জানেন যে
নিম্ন আসামের ধুবড়ি জেলার ভাসান চরের মৌলানা আব্দুল হামিদ খান ভাষিক-ধর্মীয়
সংখ্যালঘু ও শ্রমিক-কৃষকের এক ব্যতিক্রমী নেতা হিসেবে ‘মৌলানা ভাসানি’ নামে
জনপ্রিয় ছিলেন। কৃষক-মেহনতি মানুষ-ভাষিক-ধর্মীয় সংখ্যালঘু দরদি নেতা ও নিপীড়িত
মানুষের চোখের মণি মৌলানা ভাসানির বিধানসভার ভেতরে ও বাইরে আপসহীন সংগ্রামী
ঐতিহ্যের ধারা এআইইউডিএফের মধ্যে অনুপস্থিত। ধর্মীয় অনুশীলনে দরিদ্র মানুষের কাছের
লোক ও জুলুম-জালিমের বিরুদ্ধে নিরলস জেহাদি মৌলানা ভাসানির
গণতান্ত্রিক-ধর্মনিরপেক্ষ-মেহনতি মানুষের পক্ষে নিরলস আপসহীন সংগ্রামের ফলেই
কংগ্রেস সরকার তাকে বারবার জেলে পুড়ে ফেলে। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের
হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের নীতিতে আকৃষ্ট হয়ে স্বরাজ্য পার্টির একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে
রাজনীতি শুরু করে পরবর্তীতে মৌলানা ভাসানি নিপীড়িত মানুষের অবিসংবাদিত নেতা হয়ে
উঠেন এবং আসামে ও তৎকালীন পাকিস্তানে শাসকদের বিরুদ্ধে এক সামাজিক-রাজনীতির জন্ম
দেন। বাঙালি জাতির নিজের লড়াই নিজে লড়ার পক্ষে এবং কৃষক আন্দোলনের পক্ষে ওকালতি
করায় তাঁকে এমনকী ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীরও কোপের মুখে পড়তে
হয়। নিম্ন আসামে সংখ্যালঘু মানুষের অধিকারের জন্য মৌলানা ভাসানির আপোসহীন লড়াই’র
কোন বৈশিষ্ট্যই আমরা এআইইউডিএফ দলের মধ্যে দেখতে পাচ্ছি না। ধনী-ক্ষমতাবান
ও কংগ্রেসি মার্কা রাজনীতির লক্ষণ এআইইউডিএফের
মধ্যে বেড়েই চলেছে। তথাপি
যেসব পঞ্চায়েতে অসম মজুরি শ্রমিক ইউনিয়ন মনোনীত ও সমর্থিত প্রার্থী নেই, সেখানে
কংগ্রেস-বিজেপি বিরোধী শক্তিশালী প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার জন্য আমরা আহ্বান
জানাচ্ছি।
বন্ধুগণ,অসম মজুরি শ্রমিক ইউনিয়ন জনজাতীয়দের তপসিলিকরণ, মুসলিম ফিসারম্যান – কিরাণ
ইত্যাদি পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ সুবিধা, রঙ্গনাথ মিশ্র কমিশনের সুপারিশ
কার্যকরী করা ও ভাষিক – ধর্মীয় সংখ্যালঘু তথা প্রতিটি জনগোষ্ঠীর জনসংখ্যা অনুপাতে
সংরক্ষণ কার্যকরী করা ইত্যাদি দাবিতে দীর্ঘদিন থেকে আন্দোলন চালিয়ে আসছে এবং এই
নির্বাচনী প্রচারেও এগুলিকে প্রাধান্য দিচ্ছে। পঞ্চায়েত নির্বাচনে
ইউনিয়ন প্রার্থীদের জয়যুক্ত করলে এই অন্দোলন আরও শক্তিশালী হবে।
বন্ধুগণ, সরকার বড় বড় দেশি-বিদেশি কোম্পানী মালিকদের যখন সরকারী অর্থ ব্যয় করে
বিভিন্ন ধরনের ছাড় দিচ্ছে, তখন সমস্ত ভর্তুকি উঠিয়ে দিয়ে আম-জনতার ঘাড়ে বোঝা
চাপিয়ে দেওয়ার নীতি নিয়েছে। বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানীদের সেবা করতে গিয়ে কংগ্রেসি
সরকার খুচরা ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগের ছাড় দিচ্ছে যাতে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাও
বিপদাপন্ন হচ্ছে, নগদ অর্থে সাবসিডি প্রদানের প্রকল্প চালু করে কংগ্রেস সরকার আসলে
একদিকে দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষের জন্য সাবসিডি’র পরিমাণ কমিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত করছে
এবং অন্যদিকে সমাজের দুর্বল অংশ বিশেষ করে মহিলাদের ও শিশুদের বঞ্চিত করে সমাজকে
পঙ্গু করে দেওয়ার নীতি নিয়েছে। তাই সরকারের বিভিন্ন জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে বিভিন্ন
স্থানে বিভিন্ন ভাবে মানুষ বিদ্রোহ করছে। এতে শাসকরা খানিকটা ভয় পেয়েছে। তাই
মানুষকে সন্তুষ্ট করতে এনরেগা, খাদ্য সুরক্ষা বিল, ইন্দিরা আবাস, আইসিডিএস, মিড ডে
মিল, বিভিন্ন ধরনের ভাতার মত কিছু জনমুখী প্রকল্প মানুষের সামনে হাজির করেছে
সরকার। কিন্তু প্রথমত
প্রয়োজনের তুলনায় এগুলি অত্যন্ত নগণ্য, দ্বিতীয়ত এমনভাবে এগুলির নিয়ম বানানো হয়েছে যে প্রকৃত দরিদ্র মানুষকে এর থেকে বঞ্চিত
করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এই যে পঞ্চায়েত ও গ্রামসভাকে শক্তিশালী করে যদি গ্রামীণ মানুষের ক্ষমতায়ন করা না
হয়, তাহলে দালাল আমলা-রাজনীতিবিদরাই বরাদ্দকৃত অর্থ লুটেপুটে খাবে। সুতরাং এই
পরিপ্রেক্ষিতে অসম মজুরি শ্রমিক ইউনিয়ন এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনে উপরোক্ত বিষয়
ছাড়াও যে বিষয়গুলিকে সামনে রাখছে সেগুলি হল - (১) প্রকল্প রূপায়ণে দুর্নীতি দূর করা (২) পঞ্চায়েতের হাতে অধিক ক্ষমতা ও ওয়ার্ডভিত্তিক গ্রামসভাকে শক্তিশালী করা (৩) এনরেগায় বছরে ২০০ দিনের কাজ ও ২৪০ টাকা হাজিরা প্রদান (৪) আইসিডিএস, বিভিন্ন ধরনের ভাতা, ইন্দিরা আবাস, বিপিএল তালিকায় হিতাধিকারী
নির্বাচনে গ্রামসভাকে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান
(৫) সর্বজনীন রেশনিং ব্যবস্থা চালু
করা (৬) গ্রামীণ শিক্ষা, স্বাস্থ্য,
বিদ্যুৎ, পানীয় জল ও যোগাযোগের সুবন্দোবস্ত করা (৭) জমির পাট্টা ও ভূমিহীনদের ভূমি প্রদান। (৮) সাচার রিপোর্টের ভিত্তিতে সংখ্যালঘুদের জন্য এমএসডিপি’র সঠিক রূপায়ণ
সুনিশ্চিত করা ও রঙ্গনাথ মিশ্র কমিশন রিপোর্ট কার্যকরী করা।