ধোঁয়াশা
কুলেন্দ্র ঘুমের ঘোরে চোখ মেলে। ঘরের দেওয়ালের ফাকফোঁকর দিয়ে বাইরেটা দেখতে পায়। রাতের আঁধারের সাথে চাঁদের আলো মায়াবী আয়েশে যেন জড়াজড়ি করে শুয়ে আছে। নৈঃশব্দের সাথে একটানা ঝিঁ ঝঁ পোকার শব্দ নবদম্পতির আলিঙ্গনের স্পর্শের মত একে অপরের সাথে মজে আছে। গাঁয়ের মধ্যরাতির আবেশ কুলেন্দ্র যেন নতুন করে টের পায় – কুলেন্দ্রর গায়ে শিহরণ জাগে। বাড়ি থেকে আজ রীণার দ্রুত চলে যাওয়ার দৃশ্য তার মনে পড়ে – এই প্রথমবার রীণার দেহ-সৌষ্ঠব তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। রীণার প্রেমিক অর্থাৎ কুলেন্দ্রর দাদার জেল, নিজের অমতে অন্যের সাথে বিয়ে, ছেলের অকাল মৃত্যু, অসুখী দাম্পত্য জীবন ইত্যাদির জন্য রীণার প্রতি তার কোন অনুকম্পা হয় না, রীণার প্রতি তার ব্যবহার এই ধারণা নির্ভর যে রীণা ভালমানুষ। ভালমানুষ এ জন্যই যে রীণা সবকিছুকেই মানিয়ে নেয় অন্যের কথা ভেবে – নিজের ইচ্ছাকে চাপা দিয়ে মানসিক যন্ত্রণাকে ভবিতব্য ভেবে সহনীয় করে তোলে। রীণা প্রতিবাদ করে না, বিদ্রোহ করে না, ফুলেন্দ্রর মত বদলা নেওয়ার কথাও ভাবে না – মেয়েলি গুণ অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয় কি দেয়-না সে নিয়েও রীণা সম্ভবত মাথা ঘামায় না। তাহলে রীণা কুলেন্দ্রর সাথে কী কথা বলতে চায়? ফুলেন্দ্রর সাথে দেখা করতেই বা সে কেন আসে? ভবিতব্যের বিপরীত পথ ধরে রীণার এই আনাগোনা নিয়মকে অস্বীকার করার সুপ্ত বাসনার লক্ষণ নয় তো? শহুরে শিক্ষিত আপ-রাইট মহিলা বিশ্বাসের স্ত্রীও তো কেমন যেন নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধ পরিস্থিতি মেনে নিয়েছেন। সেভাবে পাড়াগাঁয়ের মেয়ে রীণার সাথে বিশ্বাসের স্ত্রীর তুলনা করাটা কুলেন্দ্রর মন সায় দেয় না। বিশ্বাসের স্ত্রীকে ভাল লাগার সাথে তার একটা সমীহভাব মিশে আছে। বিশ্বাসের স্ত্রী আধুনিক মনস্কা, সবকিছু জানতে – বুঝতে চায়, নতুন কিছু নিজের উদ্যোমে করারও একটা চাহিদা আছে। সমাজের জন্য কিছু করার তাগিদ ও কুলেন্দ্রর প্রতি তাঁর ব্যবহারই কুলেন্দ্রকে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট করে। ইউনিভার্সিটির সুস্মিতাও আধুনিক - উচ্চশিক্ষিত – ধনবান – এরিস্ট্রোক্র্যাট পরিবারের মেয়ে। চেহারায় ও বেশভূষায় সুন্দরী ও আকর্ষণীয়। একটা নির্দিষ্ট সময়ে সুস্মিতা যখন দামি গাড়ির দরজা খুলে ইউনিভার্সিটি চত্বরে পা রাখে, এডমিনিসট্র্যাটিভ বিল্ডিংয়ের পাশে দাঁড়িয়ে তাকে দেখার সুযোগ কখনও হাতছাড়া করতে চায় না কুলেন্দ্র। কিন্তু বিশ্বাসের স্ত্রী ও সুস্মিতার মধ্যে একটা ফারাক সে মনে মনে ঠাহর করে। সুস্মিতাকে জড়িয়ে ধরার আকর্ষণ তার শরীরের রক্তপ্রবাহে ঢেউ তুলে। কুলেন্দ্র তাকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করে, কিন্তু সুস্মিতার মুখাবয়ব তার চোখের সামনে আবছা হয়ে যায়। তার চোয়াল শক্ত হয়ে আসে, মুষ্ঠিবদ্ধ হাত আরও জোরে নাড়াচাড়া করতে থাকে – সুস্মিতাকে সে কোনভাবেই দেখতে পায় না। সুস্মিতা তার কাছে অধরাই থেকে যায় – সে নেতিয়ে পড়ে – নির্জীব অবস্থায় কখন যে আবার ঘুমের আবেশে নিমজ্জিত হয় তা বলতেই পারে না। এবারে ঘুমের তাপে তার আর স্বপ্ন ফুটে না।
ঘুম যখন ভাঙে, তখন বাড়ির উঠোনে কড়া রোদ এসে পড়েছে। সামনের রাস্তা দিয়ে পাশের গাঁয়ের আমিনূরের সুমো গাড়ির ইঞ্জিনের গড়গড় আওয়াজে ভেসে আসছে। আমিনূর কুলেন্দ্রর স্কুলের বন্ধু। গেল বছর প্রাইভেট ফিনান্সের লোনের গাড়ি লাইনে ছেড়েছে ভাড়া খাটানোর জন্য। লোন নেওয়ার জন্য নগদ জমার অর্থ জোগাড় করেছে দু’খানি পাম্পসেটের অপারেটর হিসেবে পাওয়া কমিশন জমা রেখে এবং একটি ইন্দিরা আবাসের অর্থ দিয়ে। আমিনূরের গ্রামের জমিদার পরিবারের সাদিক চৌধুরী অবিসি কৃষক সমিতির নামে বরাদ্দকৃত এই পাম্পসেট দু’টি আমিনূরের জিম্মায় রেখে খেতের মরসুমে ভাড়া খাটান। তালিকা থেকে অন্যের নাম বাদ দিয়ে ইন্দিরা আবাসের নগদ অর্থও পাইয়ে দিয়েছেন সাদিক। আমিনূররা তা জানে। কিন্তু তথাপিও আমিনূররা চৌধুরীদের প্রতি কৃতজ্ঞ। চরিত্রগতভাবে আমিনূর ও কুলেন্দ্র বিপরীত মেরুর। স্কুলে কুলেন্দ্র শান্তশিষ্ট সুবোধ বালক – আর আমিনূর গাট্টাগোট্টা খারাপ খাসলতের ছেলে হিসেবে পরিচিত। কিন্তু তারপরও তাদের মধ্যেই বন্ধুত্ব জমে উঠে – সে এক অন্য রহস্য। আমিনূর তার মনের কথা কুলেন্দ্রকে বলত। কুলেন্দ্রর মনে পড়ে আমিনূর একদিন বলেছিল, তার আব্বা কেন চৌধুরীদের নিয়ে গালি পাড়েন তা সে বুঝতে পারে না। তার আব্বা নাকি বলেন “আল্লায় সাহারা দিলে চৌধুরীর লুঙি তুইল্যা হুগা দিয়া বাঙ হারাই দিতাম”। তার আব্বার কাছ থেকেই সে শুনেছে এই চৌধুরীরাই তাদের আশ্রয় দিয়েছেন, আর এখানে থাকার জায়গা দিয়েছেন – তথাপি চৌধুরীদের উপর তার আব্বার কেন এত গোসা আমিনূর বুঝে উঠতে পারে না। চৌধুরীদের দৌলতেই তো সে এখন গাড়ির মালিক। তবে পাম্পসেটের ভাড়ার টাকা সময়মত দিতে না পারলে যখন জাত তুইল্যা গাল পাড়ে তখন তারও আব্বার মত গোসা ওঠে। আমিনূর খুব গর্ব করে তার ঠাকুর্দার বীরগাঁথা কুলেন্দ্রকে শোনাত – কুলেন্দ্ররও তা শুনতে ভাল লাগত। মন দিয়ে আমিনূরের পারিবারিক ঐতিহ্যের কথা শুনত বলেই বোধহয় কুলেন্দ্রই ছিল আমিনূরের সবচাইতে প্রিয় বন্ধু। আমিনূরের ভয়ে স্কুলে কুলেন্দ্রকে কেউ কিছু বলতে সাহস করত না। আমিনূরের বাপের বাপ অর্থাৎ দাদাজান ছিলেন পূর্ব-পাকিস্তানের নানকার প্রজা হিসেবে হদ-বেগার। মোট বওয়া – পালকি টানা ইত্যাদি যে কোন গতরখাটা কাজের লাগি জমিদার যখনই হুকুম দিত, তখনই তার দাদাজানকে তাঁর ছোট পোলা অর্থাৎ আমিনূরের বাপরে নিয়া জমিদারের দোয়ারে হাজির হতে হত। হুকুম তালিমে একটু এদিক-ওদিক হলে কিল-লাথি জুটত। তার ঠাকুর্দার মূল দায়িত্ব ছিল জমিদারের লাঠিয়ালের কাজ করা। জমিদারির খাসতালুকে সামান্য জমি খেতি করে সংসারের সবার পেটের নান জোগাড় করতে হত, আর বিনিময়ে হদ-বেগারি গতর খেটে জমির কর দিতে হত।
এসব কথা ভাবতে ভাবতে কুলেন্দ্রর স্কুলের স্মৃতি মনে হল। দু’জনে স্কুল পালিয়ে করিমগঞ্জ শহরে মর্নিং শো সিনেমা দেখতে যাওয়ার ঘটনা মনে পড়ে কুলেন্দ্রর। বলিউডের হিন্দি সিনেমার নায়ক এক কৃষক পরিবারের ছেলে – জমিদারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে জমিদারকে মেরে পালিয়ে যায়। কমার্সিয়্যাল সিনেমার সমস্ত মশালা সহ বাগী নায়কের নেতৃত্বে কৃষক যোদ্ধাদের বাহিনী ও জমিদারের বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনার মধ্য দিয়ে সিনেমার প্লট এগিয়ে চলে। অনর্গল কথা বলা আমিনূরের স্বভাব। যে সিনেমা দু’জনে মিলে দেখল, হল থেকে বেরিয়েই সেই সিনেমার পুঙ্খানুপুঙ্খ গল্প আবার কুলেন্দ্রকে এমনভাবে বলতে লাগল – যেন কুলেন্দ্র নায়কের বীরত্ব যথাযথ উপলব্ধি করতে পারেনি। কথা বলতে বলতে পায়ে পায়ে দু’জনে কুশিয়ারার পাড়ে এসে পড়ল। আমিনূর একটি কাঠের লগে কুলেন্দ্রকে বসতে বলে সিনেমার কাহিনীর সূত্র ধরে তার দাদাজানের কাহিনী বলতে আরম্ভ করল।
সিলেট ধর্মপাশার খাজনা-আদায়কারী আজাদ তালুকদার আমিনূরের দাদাজান সহ অন্যান্য নানকারদের বড়-জমিদারের বাড়িতে হাজির হওয়ার জন্য খবর পাঠায়। রোজগারের আশায় সুযোগ পেলেই তারা অন্যত্র কাজের সন্ধানে যায়, সেদিন তারা ভোরবেলা শহরে গিয়েছিল। সকালে ঘুরে এসে জানতে পারে যে তাদের যেতে দেরি হওয়ায় এক কৃষক রমণীকে জমিদারের খাস লোকেরা জোর করে উঠিয়ে নিয়ে গেছে। জমিদার রণেন্দ্র চরণ চৌধুরীর সৌখীনতা ও কামুকতার বর্ণনা দিতে গিয়ে আমিনূর এক সায়র শোনায় – “চৌধরী ছিল রণেন্দ্রচরণ রসিয়া নাগর, জল টাঙ্গনের ঘরে শোয় দোসরা নাগর”।
কথা বলতে বলতে আমিনূরের উত্তেজনা বাড়তে থাকে, “হুন, আমার দাদাজানর বউত গুরদা আছিল, সবরে কইল - চল, আমরা ওগুর কোন কাজ করতাম নায়, আর আমরার ইজ্জত বাচাইতে বেটিরে ছুটাইয়া আনতে লাগব। আমার দাদাজানর কথায় সব অউ রাজি অইল। জমিদারর দাওয়াত গিয়া আজিলে – জমিদার রাগে গড়গড় কইর্যা আগাইয়া আইতে আইতে কইল, “তরার তো সাহস কম নায়, একলগে আইয়া আমার দাওয়াত মাথা তুইল্যা দাড়াইচছ”। দাদাজানের কিছু একটা কওয়ার ধরলেই, জমিদার যেই তার উফরে হাত উঠাইছে, অমনি হাতর লাঠি দিয়া জমিদারর মাথাত বওয়াই দিল। জমিদার মাটিত পড়ি গেছে – রক্ত বারই গেছে। চারদিক থাইক্যা ধর মার আওয়াজ। দাদাজান ইখান থাইক্যা ভাগল। দাদাজানর পরিবারের সবরে কয়দিন আজাদ তালুকদার লুকাইয়া রাখছিল এবং পরে ন-আবাদি বিলর জমিদার চৌধরীর ইখান নানকার কইর্যা পাঠাই দিল। ওউ জমিদারিতও পরে গণ্ডগোল লাগায় অউ জমিদারর কুটুম তাঁর মসির ঘরর ভাই রসিদ চৌধরীর আব্বার জাগাত আইয়্যা ঠেক বানাইছইন আমার দাদাজান যেখান অখন আমরা আছি, আব্বার কাছ থাইক্যা হুনছি ঔ জিল্লাতও চৌধরী জমিদারর বিরুদ্ধে নানকার হকলে বউত লড়াই লড়ছইন – তখন থাইক্যাউ আব্বার গোসা কীনা জানি না”। সাদিক চৌধুরীদের এখন আর জমিজমা তেমন নেই – ভিটেমাটি ও কয়েক কিয়ার নিজস্ব ক্ষেতের জমি ছাড়া বাকি সব বিক্রি করে দিয়েছে। সাদিকরা পাঁচ ভাই – এক ভাই থানার দারোগা, একজন হাকিম, একজন উকিল ও আরেক ভাই বিডিও’র চাকরির সুবাদে গ্রামের বাইরে নিজের নিজের সংসার নিয়ে থাকেন। সাদিক গৃহস্থি সামলান ও গ্রামের মাতব্বর হিসেবে পঞ্চায়েত প্রধানও তাকে সমীহ করে চলে – স্থানীয় প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিদের সাথে তার দহরম-মহরম রয়েছে। সরকারী সুযোগ সুবিধা কে কীভাবে পাবে বা ব্যবহার হবে সেব্যপারে সাদিক চৌধুরীর মতকে সব ক্ষেত্রে সবাই গুরুত্ব দেয়। সবাইর ধারণা সাদিক চৌধুরী সবক্ষেত্রেই বিবেচকের মত সিদ্ধান্ত নেন। একমাত্র আমিনূরের আব্বাই ব্যতিক্রম। আমিনূরের মাঝে মাঝে মনে হয় তার আব্বা নিমখহারামি করছেন। গোসার কারণ জিজ্ঞেস করলে তার আব্বা তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠেন – আমিনূরের সাথে এব্যাপারে কোন কথা বলতে চান না। আমিনূর কিন্তু সাদিক চৌধুরীর দৌলতেই বেশ কিছু অর্থ কামিয়েছে, তাই সাদিক জাত তুলে গালি পাড়লে তার পিত্ত জ্বললেও সে তা হজম করে নেয়।
গল্প বলার উত্তেজনায় দু’জনেই পেটের খিদা ভুলে ছিল – এক্ষণে পেটে মোচড় দিয়ে তা জানান দেয়। পাশের ঝুপটি দোকানে দু’জনে মিলে পেটপূর্তি ঘুঘনি দিয়ে হলুদ-ভাতের পোলাও খায় ও তারপর গরুর দুধের চা খেয়ে আমিনূর একটা বিড়ি ধরায়। বেলা তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল – সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে। এবার বাড়ি ফেরার তাড়া – স্কুল ছুটির সময়ের আগেই বাড়িতে পৌঁছতে হবে। লাইনের সুমো গাড়িতে চেপে দু’জনে গৃহাভিমুখে রওয়ানা দেয়। আমিনূরের বাড়ির সামনে পৌঁছতেই অনেক লোকের জটলা দেখা যায় ও বাড়ির ভেতর থেকে কান্নার রোল ভেসে আসে। আমিনূর বুঝতে পারে দাদাজান আর বেঁচে নেই – বেশ কিছুদিন বিছানায় কাটিয়ে প্রায় শতবছরের দীর্ঘ আয়ু পেয়ে তার গর্বের দাদাজান আজ ইন্তেকাল ফরমাইয়াছেন।
এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘড়িতে সকাল ন’টা বেজে গেছে কুলেন্দ্রর তা খেয়ালই নেই। মিনিট-সেকেণ্ড-ঘণ্টা দিয়ে সময়ের হিসেব আর ভাবনার সময়ের হিসেবের মধ্যে এক বৈপরিত্য রয়েছে। বর্তমান যখন মস্তিষ্কের উপর চেপে বসে তখন সে ভাবনাকে সময়ের পেছন দিকে যেতে প্ররোচিত করে। ভবিষ্যত কল্পনার বাস্তবভিত্তি সময়ের উভয়মুখী আনাগোনার মধ্য দিয়ে একে একে রূপ নিতে থাকে। কিন্তু দৈনন্দিন জীবনের হিসেবের সময় বড়ই নির্মমভাবে একমুখীন। শৈশবের স্মৃতি কুলেন্দ্রকে এখন তাড়া করলেও শৈশব তো আর ফিরে আসবে না। কুলেন্দ্রর এই অলস সকালের কয়েক ঘন্টা সময়ের মধ্যেই তার বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে বেশ কয়েকটি মটর-সাইকেলে তার গাঁয়ের বন্ধুরা বেড়িয়ে গেল – দু’চারটে বড় গাড়িও লাইনের ট্রিপ ধরতে বেরিয়ে পড়েছে। হাইওয়েতে যাওয়ার জন্য গ্রাম থেকে কুলেন্দ্রর বাড়ির পাশ দিয়ে গুপ্ত বাড়ির পেছন দিয়ে সোজা একটা নতুন রাস্তা হওয়ায় আজকাল এই সুবিধে হয়েছে। এই রাস্তা বানানোর কাজেও কুলেন্দ্রর বন্ধুরা ছোটোখাটো উপ-ঠিকাদারি পেয়েছিল। বলাই-মদন-আমিনূররা বেরিয়ে যাওয়ার সময় চিৎকার করে বলে গেছে – “হই কুলেন্দ্র, আজকে আছচ তো, বিকালে দেখা অইব”। এদের মধ্যে কেউ ঠিকাদারের এজেন্ট, কেউ স্কুলে মাস্টার, কারুর বাজারে কম্প্যুটার-ইন্টারনেটের দোকান রয়েছে। কুলেন্দ্রর বাবা গাঁয়ের ফসল কিনে সাপ্তাহিক হাট-বাজারে ঠেলা দিয়ে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে মোটামুটি একটা কামাই করতেন – কুলেন্দ্রর বাবার মত গাঁয়ের অনেকেই সাইকেল-ঠেলায় বিভিন্ন ধরনের মাল বয়ে নিয়ে সাপ্তাহিক হাট-বাজারের ব্যবসার সাথে যুক্ত থাকত। এখন সে ব্যবসা থেকে আর মুনাফা আসে না। চালানি মালের সাথে টেক্কা দিয়ে আর লাভ করা যায় না। কুলেন্দ্রর বাবার আয় এখন আর প্রায় নেই, বয়সের ভারেও ন্যুব্জ। ফুলেন্দ্রর আয়ে সংসার চলত – সেটাও এখন বন্ধ। হঠাৎ মস্তিষ্কে হাজির হওয়া এই দুশ্চিন্তায় তার বুকের ভেতরটা কেমন যেন ভারী ভারী লাগে।
নিজের অজান্তেই পায়ে পায়ে কখন যে উঠোনের একপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে কুলেন্দ্রর তা খেয়ালই নেই। হঠাৎ বাড়ির গেটের সামনে এসে একটা গাড়ি থামলে সে সম্বিত ফিরে পায়। মারুতি-৮০০ গাড়ি থেকে প্রথমেই যাকে সে নামতে দেখে তাতে তার নিঃশ্বাসের গতি তীব্র হতে থাকে। গাড়ি থেকে প্রথমেই নামেন বিশ্বাসের স্ত্রী এবং তারপর একে একে জিতেন বিশ্বাস ও আরেকজন অপরিচিত ভদ্রলোক। ধীরে ধীরে শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি স্বাভাবিক হয় – গেটের সামনে গিয়ে কুলেন্দ্র জিজ্ঞেস করে “আরে, আফনারা যে!” এর কোন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার আগেই তাঁরা ততক্ষণে কুলেন্দ্রর বাড়ির উঠোনে এসে হাজির হয়েছেন। কুলেন্দ্র ঘরের ভেতর আসার ইঙ্গিত করলে জিতেন বিশ্বাস উঠোনে বসার ইচ্ছে প্রকাশ করেন – কুলেন্দ্র সে অনুযায়ী বসার জায়গা করে দেয়। বিশ্বাসের স্ত্রীই প্রথমে কথা পাড়েন, “আমরা এসেছি একটা প্রজেক্ট নিয়ে - ও আরে, আগে তো তোমার সাথে ওনার পরিচয় করিয়ে দেই – ইনি হচ্ছেন প্রজেশ কর, শিলচরে থাকেন – ছিয়াশির ভাষা আন্দোলনের ছাত্র নেতা – এখন আমাদের এনজিও করেন”। প্রজেশ করকে কুলেন্দ্রর খুব চেনা চেনা লাগছে – কোথায় যেন দেখেছে। কুলেন্দ্রর কৌতূহলী দৃষ্টি দেখে প্রজেশ কর বলে ওঠেন – আমি এঅঞ্চলে আগে অনেকবার এসেছি। বিশ্বাসের স্ত্রী বলতে থাকেন, “আমরা একটা প্রজেক্ট নিয়ে এসেছি – আপনি যদি এঅঞ্চলে আমাদের কাজ করেন – তাহলে একটা মাসমাইনে দেব ......।” কুলেন্দ্রর যেন বিশ্বাসের স্ত্রীকে অপরিচিত ঠেকে – কেন জানিনা তার রীণার কথা আবার মনে পড়ে – রীণা তো এরকম স্বার্থপর নয়, না স্বার্থ কী বস্তু রীণা বুঝেই না। সেই তূল্যমূল্য বিচারে সে ব্যস্ত হয়ে পড়ে – ওরা কী কথা বলছে তার কর্ণগোচর হয় না। হঠাৎ বাইরে রাস্তায় অনেক লোকের হৈ-হট্টগোল ও চিৎকারের আওয়াজ শুনে সে দৌড়ে বেরিয়ে দেখে, পাগলা শংকর লাঠি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চিৎকার করে বলছে “কত লোক মারিয়াছি এই খাণ্ডা দিয়া, আপনি মরিব আজি দেখ দাড়াইয়া”, আর সবাই তাকে জাপটে ধরে বেঁধে ফেলার চেষ্টা করছে। শংকরকে আগে কখনও এরকম উত্তেজিত ও আক্রমণাত্মক হতে দেখেনি। কুলেন্দ্র তাড়াতাড়ি সবাইকে জোর করে সরিয়ে দিতেই, শংকরের লাঠির আঘাত তার কাঁধ ও মাথায় এসে পড়ে। কুলেন্দ্র মাটিতে লুটিয়ে পড়ে, চেতনা হারাতে হারেতে সে শংকরের কান্নার আওয়াজ শুনতে পায়। চেতন থেকে অচেতনের যাত্রায় পরিচিত – অপরিচিতের ব্যবধান ধীরে ধীরে কুলেন্দ্রর মস্তিষ্কে ধোঁয়াটে হয়ে আসে।
(আমাদের সমকালের জন্য লিখেছেন অনীক লস্কর)
কুলেন্দ্র ঘুমের ঘোরে চোখ মেলে। ঘরের দেওয়ালের ফাকফোঁকর দিয়ে বাইরেটা দেখতে পায়। রাতের আঁধারের সাথে চাঁদের আলো মায়াবী আয়েশে যেন জড়াজড়ি করে শুয়ে আছে। নৈঃশব্দের সাথে একটানা ঝিঁ ঝঁ পোকার শব্দ নবদম্পতির আলিঙ্গনের স্পর্শের মত একে অপরের সাথে মজে আছে। গাঁয়ের মধ্যরাতির আবেশ কুলেন্দ্র যেন নতুন করে টের পায় – কুলেন্দ্রর গায়ে শিহরণ জাগে। বাড়ি থেকে আজ রীণার দ্রুত চলে যাওয়ার দৃশ্য তার মনে পড়ে – এই প্রথমবার রীণার দেহ-সৌষ্ঠব তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। রীণার প্রেমিক অর্থাৎ কুলেন্দ্রর দাদার জেল, নিজের অমতে অন্যের সাথে বিয়ে, ছেলের অকাল মৃত্যু, অসুখী দাম্পত্য জীবন ইত্যাদির জন্য রীণার প্রতি তার কোন অনুকম্পা হয় না, রীণার প্রতি তার ব্যবহার এই ধারণা নির্ভর যে রীণা ভালমানুষ। ভালমানুষ এ জন্যই যে রীণা সবকিছুকেই মানিয়ে নেয় অন্যের কথা ভেবে – নিজের ইচ্ছাকে চাপা দিয়ে মানসিক যন্ত্রণাকে ভবিতব্য ভেবে সহনীয় করে তোলে। রীণা প্রতিবাদ করে না, বিদ্রোহ করে না, ফুলেন্দ্রর মত বদলা নেওয়ার কথাও ভাবে না – মেয়েলি গুণ অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয় কি দেয়-না সে নিয়েও রীণা সম্ভবত মাথা ঘামায় না। তাহলে রীণা কুলেন্দ্রর সাথে কী কথা বলতে চায়? ফুলেন্দ্রর সাথে দেখা করতেই বা সে কেন আসে? ভবিতব্যের বিপরীত পথ ধরে রীণার এই আনাগোনা নিয়মকে অস্বীকার করার সুপ্ত বাসনার লক্ষণ নয় তো? শহুরে শিক্ষিত আপ-রাইট মহিলা বিশ্বাসের স্ত্রীও তো কেমন যেন নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধ পরিস্থিতি মেনে নিয়েছেন। সেভাবে পাড়াগাঁয়ের মেয়ে রীণার সাথে বিশ্বাসের স্ত্রীর তুলনা করাটা কুলেন্দ্রর মন সায় দেয় না। বিশ্বাসের স্ত্রীকে ভাল লাগার সাথে তার একটা সমীহভাব মিশে আছে। বিশ্বাসের স্ত্রী আধুনিক মনস্কা, সবকিছু জানতে – বুঝতে চায়, নতুন কিছু নিজের উদ্যোমে করারও একটা চাহিদা আছে। সমাজের জন্য কিছু করার তাগিদ ও কুলেন্দ্রর প্রতি তাঁর ব্যবহারই কুলেন্দ্রকে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট করে। ইউনিভার্সিটির সুস্মিতাও আধুনিক - উচ্চশিক্ষিত – ধনবান – এরিস্ট্রোক্র্যাট পরিবারের মেয়ে। চেহারায় ও বেশভূষায় সুন্দরী ও আকর্ষণীয়। একটা নির্দিষ্ট সময়ে সুস্মিতা যখন দামি গাড়ির দরজা খুলে ইউনিভার্সিটি চত্বরে পা রাখে, এডমিনিসট্র্যাটিভ বিল্ডিংয়ের পাশে দাঁড়িয়ে তাকে দেখার সুযোগ কখনও হাতছাড়া করতে চায় না কুলেন্দ্র। কিন্তু বিশ্বাসের স্ত্রী ও সুস্মিতার মধ্যে একটা ফারাক সে মনে মনে ঠাহর করে। সুস্মিতাকে জড়িয়ে ধরার আকর্ষণ তার শরীরের রক্তপ্রবাহে ঢেউ তুলে। কুলেন্দ্র তাকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করে, কিন্তু সুস্মিতার মুখাবয়ব তার চোখের সামনে আবছা হয়ে যায়। তার চোয়াল শক্ত হয়ে আসে, মুষ্ঠিবদ্ধ হাত আরও জোরে নাড়াচাড়া করতে থাকে – সুস্মিতাকে সে কোনভাবেই দেখতে পায় না। সুস্মিতা তার কাছে অধরাই থেকে যায় – সে নেতিয়ে পড়ে – নির্জীব অবস্থায় কখন যে আবার ঘুমের আবেশে নিমজ্জিত হয় তা বলতেই পারে না। এবারে ঘুমের তাপে তার আর স্বপ্ন ফুটে না।
ঘুম যখন ভাঙে, তখন বাড়ির উঠোনে কড়া রোদ এসে পড়েছে। সামনের রাস্তা দিয়ে পাশের গাঁয়ের আমিনূরের সুমো গাড়ির ইঞ্জিনের গড়গড় আওয়াজে ভেসে আসছে। আমিনূর কুলেন্দ্রর স্কুলের বন্ধু। গেল বছর প্রাইভেট ফিনান্সের লোনের গাড়ি লাইনে ছেড়েছে ভাড়া খাটানোর জন্য। লোন নেওয়ার জন্য নগদ জমার অর্থ জোগাড় করেছে দু’খানি পাম্পসেটের অপারেটর হিসেবে পাওয়া কমিশন জমা রেখে এবং একটি ইন্দিরা আবাসের অর্থ দিয়ে। আমিনূরের গ্রামের জমিদার পরিবারের সাদিক চৌধুরী অবিসি কৃষক সমিতির নামে বরাদ্দকৃত এই পাম্পসেট দু’টি আমিনূরের জিম্মায় রেখে খেতের মরসুমে ভাড়া খাটান। তালিকা থেকে অন্যের নাম বাদ দিয়ে ইন্দিরা আবাসের নগদ অর্থও পাইয়ে দিয়েছেন সাদিক। আমিনূররা তা জানে। কিন্তু তথাপিও আমিনূররা চৌধুরীদের প্রতি কৃতজ্ঞ। চরিত্রগতভাবে আমিনূর ও কুলেন্দ্র বিপরীত মেরুর। স্কুলে কুলেন্দ্র শান্তশিষ্ট সুবোধ বালক – আর আমিনূর গাট্টাগোট্টা খারাপ খাসলতের ছেলে হিসেবে পরিচিত। কিন্তু তারপরও তাদের মধ্যেই বন্ধুত্ব জমে উঠে – সে এক অন্য রহস্য। আমিনূর তার মনের কথা কুলেন্দ্রকে বলত। কুলেন্দ্রর মনে পড়ে আমিনূর একদিন বলেছিল, তার আব্বা কেন চৌধুরীদের নিয়ে গালি পাড়েন তা সে বুঝতে পারে না। তার আব্বা নাকি বলেন “আল্লায় সাহারা দিলে চৌধুরীর লুঙি তুইল্যা হুগা দিয়া বাঙ হারাই দিতাম”। তার আব্বার কাছ থেকেই সে শুনেছে এই চৌধুরীরাই তাদের আশ্রয় দিয়েছেন, আর এখানে থাকার জায়গা দিয়েছেন – তথাপি চৌধুরীদের উপর তার আব্বার কেন এত গোসা আমিনূর বুঝে উঠতে পারে না। চৌধুরীদের দৌলতেই তো সে এখন গাড়ির মালিক। তবে পাম্পসেটের ভাড়ার টাকা সময়মত দিতে না পারলে যখন জাত তুইল্যা গাল পাড়ে তখন তারও আব্বার মত গোসা ওঠে। আমিনূর খুব গর্ব করে তার ঠাকুর্দার বীরগাঁথা কুলেন্দ্রকে শোনাত – কুলেন্দ্ররও তা শুনতে ভাল লাগত। মন দিয়ে আমিনূরের পারিবারিক ঐতিহ্যের কথা শুনত বলেই বোধহয় কুলেন্দ্রই ছিল আমিনূরের সবচাইতে প্রিয় বন্ধু। আমিনূরের ভয়ে স্কুলে কুলেন্দ্রকে কেউ কিছু বলতে সাহস করত না। আমিনূরের বাপের বাপ অর্থাৎ দাদাজান ছিলেন পূর্ব-পাকিস্তানের নানকার প্রজা হিসেবে হদ-বেগার। মোট বওয়া – পালকি টানা ইত্যাদি যে কোন গতরখাটা কাজের লাগি জমিদার যখনই হুকুম দিত, তখনই তার দাদাজানকে তাঁর ছোট পোলা অর্থাৎ আমিনূরের বাপরে নিয়া জমিদারের দোয়ারে হাজির হতে হত। হুকুম তালিমে একটু এদিক-ওদিক হলে কিল-লাথি জুটত। তার ঠাকুর্দার মূল দায়িত্ব ছিল জমিদারের লাঠিয়ালের কাজ করা। জমিদারির খাসতালুকে সামান্য জমি খেতি করে সংসারের সবার পেটের নান জোগাড় করতে হত, আর বিনিময়ে হদ-বেগারি গতর খেটে জমির কর দিতে হত।
এসব কথা ভাবতে ভাবতে কুলেন্দ্রর স্কুলের স্মৃতি মনে হল। দু’জনে স্কুল পালিয়ে করিমগঞ্জ শহরে মর্নিং শো সিনেমা দেখতে যাওয়ার ঘটনা মনে পড়ে কুলেন্দ্রর। বলিউডের হিন্দি সিনেমার নায়ক এক কৃষক পরিবারের ছেলে – জমিদারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে জমিদারকে মেরে পালিয়ে যায়। কমার্সিয়্যাল সিনেমার সমস্ত মশালা সহ বাগী নায়কের নেতৃত্বে কৃষক যোদ্ধাদের বাহিনী ও জমিদারের বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনার মধ্য দিয়ে সিনেমার প্লট এগিয়ে চলে। অনর্গল কথা বলা আমিনূরের স্বভাব। যে সিনেমা দু’জনে মিলে দেখল, হল থেকে বেরিয়েই সেই সিনেমার পুঙ্খানুপুঙ্খ গল্প আবার কুলেন্দ্রকে এমনভাবে বলতে লাগল – যেন কুলেন্দ্র নায়কের বীরত্ব যথাযথ উপলব্ধি করতে পারেনি। কথা বলতে বলতে পায়ে পায়ে দু’জনে কুশিয়ারার পাড়ে এসে পড়ল। আমিনূর একটি কাঠের লগে কুলেন্দ্রকে বসতে বলে সিনেমার কাহিনীর সূত্র ধরে তার দাদাজানের কাহিনী বলতে আরম্ভ করল।
সিলেট ধর্মপাশার খাজনা-আদায়কারী আজাদ তালুকদার আমিনূরের দাদাজান সহ অন্যান্য নানকারদের বড়-জমিদারের বাড়িতে হাজির হওয়ার জন্য খবর পাঠায়। রোজগারের আশায় সুযোগ পেলেই তারা অন্যত্র কাজের সন্ধানে যায়, সেদিন তারা ভোরবেলা শহরে গিয়েছিল। সকালে ঘুরে এসে জানতে পারে যে তাদের যেতে দেরি হওয়ায় এক কৃষক রমণীকে জমিদারের খাস লোকেরা জোর করে উঠিয়ে নিয়ে গেছে। জমিদার রণেন্দ্র চরণ চৌধুরীর সৌখীনতা ও কামুকতার বর্ণনা দিতে গিয়ে আমিনূর এক সায়র শোনায় – “চৌধরী ছিল রণেন্দ্রচরণ রসিয়া নাগর, জল টাঙ্গনের ঘরে শোয় দোসরা নাগর”।
কথা বলতে বলতে আমিনূরের উত্তেজনা বাড়তে থাকে, “হুন, আমার দাদাজানর বউত গুরদা আছিল, সবরে কইল - চল, আমরা ওগুর কোন কাজ করতাম নায়, আর আমরার ইজ্জত বাচাইতে বেটিরে ছুটাইয়া আনতে লাগব। আমার দাদাজানর কথায় সব অউ রাজি অইল। জমিদারর দাওয়াত গিয়া আজিলে – জমিদার রাগে গড়গড় কইর্যা আগাইয়া আইতে আইতে কইল, “তরার তো সাহস কম নায়, একলগে আইয়া আমার দাওয়াত মাথা তুইল্যা দাড়াইচছ”। দাদাজানের কিছু একটা কওয়ার ধরলেই, জমিদার যেই তার উফরে হাত উঠাইছে, অমনি হাতর লাঠি দিয়া জমিদারর মাথাত বওয়াই দিল। জমিদার মাটিত পড়ি গেছে – রক্ত বারই গেছে। চারদিক থাইক্যা ধর মার আওয়াজ। দাদাজান ইখান থাইক্যা ভাগল। দাদাজানর পরিবারের সবরে কয়দিন আজাদ তালুকদার লুকাইয়া রাখছিল এবং পরে ন-আবাদি বিলর জমিদার চৌধরীর ইখান নানকার কইর্যা পাঠাই দিল। ওউ জমিদারিতও পরে গণ্ডগোল লাগায় অউ জমিদারর কুটুম তাঁর মসির ঘরর ভাই রসিদ চৌধরীর আব্বার জাগাত আইয়্যা ঠেক বানাইছইন আমার দাদাজান যেখান অখন আমরা আছি, আব্বার কাছ থাইক্যা হুনছি ঔ জিল্লাতও চৌধরী জমিদারর বিরুদ্ধে নানকার হকলে বউত লড়াই লড়ছইন – তখন থাইক্যাউ আব্বার গোসা কীনা জানি না”। সাদিক চৌধুরীদের এখন আর জমিজমা তেমন নেই – ভিটেমাটি ও কয়েক কিয়ার নিজস্ব ক্ষেতের জমি ছাড়া বাকি সব বিক্রি করে দিয়েছে। সাদিকরা পাঁচ ভাই – এক ভাই থানার দারোগা, একজন হাকিম, একজন উকিল ও আরেক ভাই বিডিও’র চাকরির সুবাদে গ্রামের বাইরে নিজের নিজের সংসার নিয়ে থাকেন। সাদিক গৃহস্থি সামলান ও গ্রামের মাতব্বর হিসেবে পঞ্চায়েত প্রধানও তাকে সমীহ করে চলে – স্থানীয় প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিদের সাথে তার দহরম-মহরম রয়েছে। সরকারী সুযোগ সুবিধা কে কীভাবে পাবে বা ব্যবহার হবে সেব্যপারে সাদিক চৌধুরীর মতকে সব ক্ষেত্রে সবাই গুরুত্ব দেয়। সবাইর ধারণা সাদিক চৌধুরী সবক্ষেত্রেই বিবেচকের মত সিদ্ধান্ত নেন। একমাত্র আমিনূরের আব্বাই ব্যতিক্রম। আমিনূরের মাঝে মাঝে মনে হয় তার আব্বা নিমখহারামি করছেন। গোসার কারণ জিজ্ঞেস করলে তার আব্বা তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠেন – আমিনূরের সাথে এব্যাপারে কোন কথা বলতে চান না। আমিনূর কিন্তু সাদিক চৌধুরীর দৌলতেই বেশ কিছু অর্থ কামিয়েছে, তাই সাদিক জাত তুলে গালি পাড়লে তার পিত্ত জ্বললেও সে তা হজম করে নেয়।
গল্প বলার উত্তেজনায় দু’জনেই পেটের খিদা ভুলে ছিল – এক্ষণে পেটে মোচড় দিয়ে তা জানান দেয়। পাশের ঝুপটি দোকানে দু’জনে মিলে পেটপূর্তি ঘুঘনি দিয়ে হলুদ-ভাতের পোলাও খায় ও তারপর গরুর দুধের চা খেয়ে আমিনূর একটা বিড়ি ধরায়। বেলা তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল – সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে। এবার বাড়ি ফেরার তাড়া – স্কুল ছুটির সময়ের আগেই বাড়িতে পৌঁছতে হবে। লাইনের সুমো গাড়িতে চেপে দু’জনে গৃহাভিমুখে রওয়ানা দেয়। আমিনূরের বাড়ির সামনে পৌঁছতেই অনেক লোকের জটলা দেখা যায় ও বাড়ির ভেতর থেকে কান্নার রোল ভেসে আসে। আমিনূর বুঝতে পারে দাদাজান আর বেঁচে নেই – বেশ কিছুদিন বিছানায় কাটিয়ে প্রায় শতবছরের দীর্ঘ আয়ু পেয়ে তার গর্বের দাদাজান আজ ইন্তেকাল ফরমাইয়াছেন।
এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘড়িতে সকাল ন’টা বেজে গেছে কুলেন্দ্রর তা খেয়ালই নেই। মিনিট-সেকেণ্ড-ঘণ্টা দিয়ে সময়ের হিসেব আর ভাবনার সময়ের হিসেবের মধ্যে এক বৈপরিত্য রয়েছে। বর্তমান যখন মস্তিষ্কের উপর চেপে বসে তখন সে ভাবনাকে সময়ের পেছন দিকে যেতে প্ররোচিত করে। ভবিষ্যত কল্পনার বাস্তবভিত্তি সময়ের উভয়মুখী আনাগোনার মধ্য দিয়ে একে একে রূপ নিতে থাকে। কিন্তু দৈনন্দিন জীবনের হিসেবের সময় বড়ই নির্মমভাবে একমুখীন। শৈশবের স্মৃতি কুলেন্দ্রকে এখন তাড়া করলেও শৈশব তো আর ফিরে আসবে না। কুলেন্দ্রর এই অলস সকালের কয়েক ঘন্টা সময়ের মধ্যেই তার বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে বেশ কয়েকটি মটর-সাইকেলে তার গাঁয়ের বন্ধুরা বেড়িয়ে গেল – দু’চারটে বড় গাড়িও লাইনের ট্রিপ ধরতে বেরিয়ে পড়েছে। হাইওয়েতে যাওয়ার জন্য গ্রাম থেকে কুলেন্দ্রর বাড়ির পাশ দিয়ে গুপ্ত বাড়ির পেছন দিয়ে সোজা একটা নতুন রাস্তা হওয়ায় আজকাল এই সুবিধে হয়েছে। এই রাস্তা বানানোর কাজেও কুলেন্দ্রর বন্ধুরা ছোটোখাটো উপ-ঠিকাদারি পেয়েছিল। বলাই-মদন-আমিনূররা বেরিয়ে যাওয়ার সময় চিৎকার করে বলে গেছে – “হই কুলেন্দ্র, আজকে আছচ তো, বিকালে দেখা অইব”। এদের মধ্যে কেউ ঠিকাদারের এজেন্ট, কেউ স্কুলে মাস্টার, কারুর বাজারে কম্প্যুটার-ইন্টারনেটের দোকান রয়েছে। কুলেন্দ্রর বাবা গাঁয়ের ফসল কিনে সাপ্তাহিক হাট-বাজারে ঠেলা দিয়ে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে মোটামুটি একটা কামাই করতেন – কুলেন্দ্রর বাবার মত গাঁয়ের অনেকেই সাইকেল-ঠেলায় বিভিন্ন ধরনের মাল বয়ে নিয়ে সাপ্তাহিক হাট-বাজারের ব্যবসার সাথে যুক্ত থাকত। এখন সে ব্যবসা থেকে আর মুনাফা আসে না। চালানি মালের সাথে টেক্কা দিয়ে আর লাভ করা যায় না। কুলেন্দ্রর বাবার আয় এখন আর প্রায় নেই, বয়সের ভারেও ন্যুব্জ। ফুলেন্দ্রর আয়ে সংসার চলত – সেটাও এখন বন্ধ। হঠাৎ মস্তিষ্কে হাজির হওয়া এই দুশ্চিন্তায় তার বুকের ভেতরটা কেমন যেন ভারী ভারী লাগে।
নিজের অজান্তেই পায়ে পায়ে কখন যে উঠোনের একপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে কুলেন্দ্রর তা খেয়ালই নেই। হঠাৎ বাড়ির গেটের সামনে এসে একটা গাড়ি থামলে সে সম্বিত ফিরে পায়। মারুতি-৮০০ গাড়ি থেকে প্রথমেই যাকে সে নামতে দেখে তাতে তার নিঃশ্বাসের গতি তীব্র হতে থাকে। গাড়ি থেকে প্রথমেই নামেন বিশ্বাসের স্ত্রী এবং তারপর একে একে জিতেন বিশ্বাস ও আরেকজন অপরিচিত ভদ্রলোক। ধীরে ধীরে শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি স্বাভাবিক হয় – গেটের সামনে গিয়ে কুলেন্দ্র জিজ্ঞেস করে “আরে, আফনারা যে!” এর কোন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার আগেই তাঁরা ততক্ষণে কুলেন্দ্রর বাড়ির উঠোনে এসে হাজির হয়েছেন। কুলেন্দ্র ঘরের ভেতর আসার ইঙ্গিত করলে জিতেন বিশ্বাস উঠোনে বসার ইচ্ছে প্রকাশ করেন – কুলেন্দ্র সে অনুযায়ী বসার জায়গা করে দেয়। বিশ্বাসের স্ত্রীই প্রথমে কথা পাড়েন, “আমরা এসেছি একটা প্রজেক্ট নিয়ে - ও আরে, আগে তো তোমার সাথে ওনার পরিচয় করিয়ে দেই – ইনি হচ্ছেন প্রজেশ কর, শিলচরে থাকেন – ছিয়াশির ভাষা আন্দোলনের ছাত্র নেতা – এখন আমাদের এনজিও করেন”। প্রজেশ করকে কুলেন্দ্রর খুব চেনা চেনা লাগছে – কোথায় যেন দেখেছে। কুলেন্দ্রর কৌতূহলী দৃষ্টি দেখে প্রজেশ কর বলে ওঠেন – আমি এঅঞ্চলে আগে অনেকবার এসেছি। বিশ্বাসের স্ত্রী বলতে থাকেন, “আমরা একটা প্রজেক্ট নিয়ে এসেছি – আপনি যদি এঅঞ্চলে আমাদের কাজ করেন – তাহলে একটা মাসমাইনে দেব ......।” কুলেন্দ্রর যেন বিশ্বাসের স্ত্রীকে অপরিচিত ঠেকে – কেন জানিনা তার রীণার কথা আবার মনে পড়ে – রীণা তো এরকম স্বার্থপর নয়, না স্বার্থ কী বস্তু রীণা বুঝেই না। সেই তূল্যমূল্য বিচারে সে ব্যস্ত হয়ে পড়ে – ওরা কী কথা বলছে তার কর্ণগোচর হয় না। হঠাৎ বাইরে রাস্তায় অনেক লোকের হৈ-হট্টগোল ও চিৎকারের আওয়াজ শুনে সে দৌড়ে বেরিয়ে দেখে, পাগলা শংকর লাঠি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চিৎকার করে বলছে “কত লোক মারিয়াছি এই খাণ্ডা দিয়া, আপনি মরিব আজি দেখ দাড়াইয়া”, আর সবাই তাকে জাপটে ধরে বেঁধে ফেলার চেষ্টা করছে। শংকরকে আগে কখনও এরকম উত্তেজিত ও আক্রমণাত্মক হতে দেখেনি। কুলেন্দ্র তাড়াতাড়ি সবাইকে জোর করে সরিয়ে দিতেই, শংকরের লাঠির আঘাত তার কাঁধ ও মাথায় এসে পড়ে। কুলেন্দ্র মাটিতে লুটিয়ে পড়ে, চেতনা হারাতে হারেতে সে শংকরের কান্নার আওয়াজ শুনতে পায়। চেতন থেকে অচেতনের যাত্রায় পরিচিত – অপরিচিতের ব্যবধান ধীরে ধীরে কুলেন্দ্রর মস্তিষ্কে ধোঁয়াটে হয়ে আসে।
0 comments:
Post a Comment