(লেখাটা আর ২৩শে মে, ২০১৩ দৈনিক যুগশঙ্খে পাঠকে মতামত হিসেবে বেরিয়েছে)
কলমটা ধরতেই হল। উনিশের রাত প্রায় এগারটা। সন্ধ্যে থেকে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক মঞ্চের অবস্থান কর্মসূচী শুরু হলেও আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হল রাত প্রায় দশটায়। শারীরিক কারণে রাতভর সঙ্গ দেওয়া হল না। তবে গৃহের স্বাচ্ছন্দ্য ও আনুসঙ্গিকতায় ভর করে গভীর-রাত অব্দি কম্প্যুটাররের কি-বোর্ড চালানোর ইচ্ছাশক্তিকে সঞ্চারিত করেছে সম্মিলিতের রূপায়িত উনিশের সন্ধ্যার আবেগ। সামাজিক দায়বদ্ধতা প্রসূত এই আবেগের কি কোন দাম নেই? নিজের কাছে উত্তরটা মনে হল ইতিবাচক। ইতিমধ্যে অক্ষরে প্রকাশিত অনেক লেখা থেকে, যাকে আমরা বলি অতীত জ্ঞান, কিছু কিছু সংগ্রহ করে গুরুগম্ভীর লেখা থেকে এধরনের সামাজিক দায়বদ্ধতা-তাড়িত নিজস্ব অভিজ্ঞতা-নির্ভর লেখা তো কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। এই যুক্তির পথ ধরেই সামাজিক দায়বদ্ধতা ও আশু প্রয়োজনীতার মানদণ্ড থেকে এই লেখাটি বিচার্য।
এবার সম্মিলিত মঞ্চ মানুষের দরবারে হাজির হয়েছে একগুচ্ছ কর্মসূচী নিয়ে। তাদের দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে মূলত বরাক-ব্রহ্মপুত্র ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে বরাক উপত্যকার সাথে ভারতের অন্য প্রান্তের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে। ব্রডগেজ, মহাসড়ক, বাংলাদেশ হয়ে রেল ও জলপথ – এই বিষয়গুলির সুফল নিয়ে বিস্তর লেখালেখি হয়েছে। এই দাবিগুলি রূপায়ণ না হওয়ার পেছনে ট্রান্সপোর্ট লবির হাত রয়েছে বলে বিভিন্ন মহল থেকে ব্যাপক অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। অনেকে ফেন্সিবাজার লবির হাত রয়েছে বলেও অভিযোগ তুলেন। এই অভিযোগের সত্যতাও যাচাই করে নেওয়া যায়। কিন্তু সাধারণ যুক্তি বলে যে বহিঃরাজ্যের ফ্যাক্টরি মালিকদের সিএনএফ এজেন্ট যদি ফ্যান্সিবাজারে থাকে এবং সামগ্রীর সরবরাহ-লাইন যদি সরাসরি বরাকের সাথে না থাকে তাহলে এই দ্বিতীয় অভিযোগের ভিত্তিকে একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
সে যাইহউক, এখানে আলোচনার মূল বিষয় সম্মিলিত সাংস্কৃতিক সংস্থার এবারের প্রয়াসে গুণগত পরিবর্তনের লক্ষণ নিয়ে। এই লক্ষণগুলির অন্যতম হচ্ছে – মানুষের সুখ-দুঃখের বিষয়কে সাংস্কৃতিক পার্ফরমেন্সে ঠাঁই দেওয়ার প্রচেষ্টা ও ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদী আন্দোলন গড়ে তোলাই যে দাবি আদায়ের একমাত্র পথ তার স্বীকৃতি প্রদান। কিন্তু আন্দোলন গড়ে তোলার একটা লক্ষণ-রেখা রয়েছে যার অভ্যন্তরে হৃদয়ের আগুন জ্বলে না - বরঞ্চ নিভে যায়, অধিকার কেড়ে নেওয়ার হাত নিশ্চল হয়ে যায়। অথচ এই লক্ষণ রেখা অতিক্রম করার জন্য যে বুদ্ধির কসরত করতে হয়, সেটা যারা করতে সক্ষম সেই বুদ্ধিজীবী শ্রমিক (আমি এদেরকে বুদ্ধিজীবী শ্রমিকই বলব কারণ তারা অফিস-আদালত-শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পদের কর্মী) তারা এবার অনেক বেশি সংখ্যায় অংশগ্রহণ করেছেন। এদের অংশগ্রহণেই সম্মিলিত মঞ্চ খুব সঠিকভাবেই যে যুক্তি তুলে ধরেছে তা এরকম – আমাদের প্রতি বঞ্চনাজনিত দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলন করতে হবে, আন্দোলন করতে হলে আমাদের চেতনা জাগ্রত করতে হবে, ভাষিক পরিচিতির চেতনা মাথা তুলে দাঁড়াতে শেখায় এবং উনিশের ঐতিহ্য থেকে বাহিত এই চেতনাকে জাগ্রত করতে হবে। মানুষ তার আদিম অবস্থা থেকে তার বিকাশের সমস্ত কিছুকে তার অবচেতনে বহন করে আনে। এই ঐতিহাসিক সামাজিক মানুষ আজ কীভাবে তার ব্যবহারিক জীবন যাপন করবে তা নির্ভর করে তার বর্তমান বাস্তবতা ও এই বাস্তবতাকে সে কীভাবে পরিবর্তন করতে চায় তা দিয়ে। সুতরাং উনিশের ঐতিহ্য দিয়ে সংগ্রামী চেতনা জাগ্রত করার আহ্বান একটি জরুরি আহ্বান। এই চেতনার প্রকৃত স্বরূপ কী তা নিয়ে বিস্তর গবেষণা চলতে থাকুক। কিন্তু সম্মিলিত তার আহ্বানের মধ্য দিয়ে যা বোঝাতে চাইছে তা হচ্ছে ভাষিক অধিকারের চেতনা। বুদ্ধিজীবী শ্রমিকরা অতি সহজেই বুঝতে পারেন যে আমাদের অর্থনৈতিক অধিকার আদায়, বঞ্চনাজনিত সমস্যা নিরসনে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে এবং তারজন্য প্রয়োজন আমাদের ভাষিক পরিচিতির আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার লড়াই। কিন্তু সাধারণ মেহনতি মানুষের কাছে এই ভাষিক অধিকারের প্রশ্নটি তো এখনও বিমূর্ত, যে প্রশ্নটি তাদের কাছে মূর্ত হয়ে উঠে সে হচ্ছে দৈনন্দিন রুটি-রুজির প্রশ্ন। এই সাধারণকে বাদ দিয়ে তো কোন আন্দোলন গড়ে উঠতে পারে না। সুতরাং ভাষার অধিকারের প্রশ্নকে মূর্ত করে তোলার জন্য বুদ্ধিজীবী শ্রমিকদেরকেই অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে। প্রশ্ন হলো কীভাবে?
সাধারণ মেহনতি মানুষের শিক্ষা ও রুটি-রুজির প্রশ্নের সাথে ভাষার অধিকারের যোগসূত্র নিহিত রয়েছে মাতৃভাষায় পঠন-পাঠনের ব্যবস্থা ও মাতৃভাষায় প্রশাসনিক কাজকর্ম সুনিশ্চিত করার মধ্যে। এই মাতৃভাষার প্রশ্নটি শুধুমাত্র বাংলা ভাষার অধিকারের প্রশ্ন নয়, কারণ যে জাতি অন্যের অধিকারের কথা বুঝতে পারে না, সে নিজ জাতির স্বার্থও ভাল করে বুঝে উঠতে পারে না। আমাদের প্রতিবেশি অনেক অ-বাঙালি জনগোষ্ঠীর ভাষা বাংলা ভাষার স্তরে বিকশিত হয়নি। অনেক ভাষার কোন লেখ্য রূপ নেই। কোন জনগোষ্ঠীর ভাষা বিশ্ববিদ্যালয় স্তর পর্যন্ত চালু, আবার কোন ভাষার মাতৃভাষায় প্রাথমিক স্তরে লেখাপড়া করারও বন্দোবস্ত নেই। প্রাথমিক স্তরে শিক্ষালাভ থেকে বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর নব্বই শতাংশ লোকই তো শিক্ষার আলোক থেকে বঞ্চিত থেকে যাবে, শিক্ষাবিহীন এই মানুষ কী করে গোটা সমাজের অধিকারের লড়াই করবেন। বরাক উপত্যকার বাঙালিদের প্রতিবেশি চা-বাগানে বসবাসকারী শ্রমিক পরিবারের মানুষদের যে অঞ্চল থেকে ব্রিটিশ চা-বাগানে নিয়ে আসে, সেই অঞ্চলে তাদের মাতৃভাষার লেখ্যরূপ ইতিমধ্যে তৈরি করেছেন রাঁচি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা বিভাগের বিশেষজ্ঞরা যে ভাষা সাদ্রি ভাষা নামে পরিচিত। আমাদের এখানকার মুণ্ডা, ওঁরাও, কোল, ভিল, সাঁওতাল, ভূমিজ, ঘাটোয়ার, বাউরি, রিকিয়সনরা তাদের মূল ভাষা থেকে খানিকটা সরে এসে নতুন এক কথ্য রূপের জন্ম দিয়েছেন। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় সাদ্রি ভাষার সূত্র ধরে তাদের জন্য বানান, বাক্য তৈরির প্রয়াস হাতে নিতে পারেন এবং আমরা দাবি জানাতে পারি যে প্রাথমিক বিদ্যালয়, ওঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে তাদের মাতৃভাষায় পঠন-পাঠন শুরু করা হোক। এভাবে মানবোন্নয়নের এক মহান কর্মযজ্ঞের শুরুয়াত হতে পারে। আমাদের তথাকথিত বুদ্ধিজীবী পণ্ডিতরা এটি ভাষা না উপভাষা এনিয়ে বিতর্ক জুড়ে দিয়ে গণশিক্ষার আসল কাজটিকে স্থগিত রেখে দেন এবং এভাবেই আসলে উগ্রজাতিয়তাবাদের কাঠামোটিকে টিঁকে থাকতে সহায়তা করেন। চা-জনগোষ্ঠী ঝাড়খণ্ডীদের মত এঞ্চলের বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনজাতিয়দেরও মাতৃভাষায় শিক্ষার অধিকার নেই। এই বিষয়কে গুরুত্ত্ব না দিয়ে ভাষিক অধিকারের আন্দোলন মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না। কোন একটা জনসমষ্ঠির ভাষিক পরিচিতি কী হবে তা কীভাবে নির্ধারিত হবে? ইতিহাস, ভাষাতত্ব, নৃতত্বের বিশেষজ্ঞদের কূটতর্কের মধ্য দিয়ে, না এই জনসমষ্ঠি বর্তমানে কী ভাষায় কথা বলে বা এই জনসমষ্ঠি নিজেদের কী পরিচয় দিতে চায় তা দিয়ে (যা অবশ্যই যাচাই করতে হবে এক ভয়মুক্ত পরিস্থিতিতে এবং এটা করা খুব কঠিন কাজও নয়)? প্রথম প্রক্রিয়া দিয়ে নির্ধারণ করলে বিতর্কের নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তাদের মাতৃভাষায় শিক্ষার অধিকারটুকুও শিকেয় তুলে রাখতে হয় এবং নিজের ভাগ্য নিজে নির্ধারণ করার অধিকারকে অস্বীকার করে গণতন্ত্রকে পদদলিত করা হয়। দ্বিতীয় প্রক্রিয়ায় যে ভাষা যে স্তরে আছে সেখান থেকেই উচ্চতর অধিকার আদায়ের কাজ শুরু করতে হয় এবং সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে সর্বনিম্ন স্তরে মুখের ভাষাকেই মান্যতা দিয়ে লেখ্য ভাষা তৈরির কাজে সচেষ্ট হতে হয় যাতে শিক্ষার প্রসার একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ে। এই গণতান্ত্রিক অবস্থান থেকে বিচার করলে ভাষিক পরিচিতি নির্ধারণ করা খুব জটিল কাজ নয়। অনেকে হয়ত বলবেন তাতে অনৈক্য বাড়বে - আমার মতে অনৈক্য তো বাস্তবে রয়েছে, একাজটি করলে ঐক্যের ও জাতিগঠনের ভিত তৈরি হবে। আমাদের ভাষিক পরিচিতির আন্দোলনকে এই গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে পরিচালিত করতে হবে, অন্যথায় কোন আন্দোলনই তার অভিষ্ঠ লক্ষ্যে পৌঁছতে ব্যর্থ হবে।
দ্বিতীয়ত ইংরেজিতে প্রশাসনিক চিঠিপত্র সাধারণ মানুষের রুটি-রুজির অধিকারকে কীভাবে ব্যহত করে তা আমাদের দৈনন্দিন বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকেই দেখতে পাই। এই বিষয়টি বুঝতে একটা উদাহরণ ধরা যাক। এক গরিব লোক বিডিও’র কাছ থেকে চিঠি পেল যে তার জন্য ইন্দিরা আবাস বরাদ্দ হয়েছে এবং বরাদ্দ অর্থ পেতে হলে তাকে কিছু প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করতে হবে। সে এবং তার প্রতিবেশি ইংরেজিতে লেখা এই চিঠি পাঠোদ্ধার করতে না পেরে কোন শিক্ষিত লোকের দ্বারস্থ হবে। এই উপত্যকায় বাংলায় প্রশাসনিক কাজকর্ম না হওয়ায় শুরুতেই এই পরনির্ভরতা তাকে দালালরাজের খপ্পরে পড়ার এবং এক্ষেত্রে মাথা গোঁজার ঠাই থেকে বঞ্চিত হওয়ার পথ তৈরি করে দেয়।
সুতরাং ভাষার অধিকারের লড়াই শুধুমাত্র সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার অধিকারের লড়াই নয়, সেটা শেষবিচারে অর্থনৈতিক অধিকার ও প্রকৃত উন্নয়নের লড়াই। সেজন্যই গণতন্ত্র ও উন্নয়নের স্বার্থে সব জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষার অধিকারের বাস্তব প্রয়োগের বিষয় নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে ও আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এই ন্যূনতম কর্মসূচীর ভিত্তিতে সমস্ত সংকীর্ণতার উর্ধে উঠে সম্মিলিত প্রয়াস আজ জরুরি হয়ে উঠেছে।
0 comments:
Post a Comment