বিশ্বায়নের প্রেক্ষিতে
ভাষা-সংস্কৃতি ও উন্নয়ন
(এই লেখাটি আজকের অর্থাৎ ২৫ এপ্রিলের যুগশঙ্খে বেরিয়েছে। কিন্তু ছাপা ভুলের জন্য এই পুরো বাক্যটির অর্ধেক ছাপা হয়েছে - "এমনকী বরাক-পশ্চিমবঙ্গ-বাংলাদেশের বাজারে প্রবেশের জন্য ও একচেটিয়া অধিকার লাভের জন্য উনিশ – একুশের ঐতিহ্যও ব্যবহৃত হতে পারে।" )
(এই লেখাটি আজকের অর্থাৎ ২৫ এপ্রিলের যুগশঙ্খে বেরিয়েছে। কিন্তু ছাপা ভুলের জন্য এই পুরো বাক্যটির অর্ধেক ছাপা হয়েছে - "এমনকী বরাক-পশ্চিমবঙ্গ-বাংলাদেশের বাজারে প্রবেশের জন্য ও একচেটিয়া অধিকার লাভের জন্য উনিশ – একুশের ঐতিহ্যও ব্যবহৃত হতে পারে।" )
বরাক উপত্যকার ভাষা-সংস্কৃতির প্রশ্নকে
বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার প্রেক্ষাপটে এখনও সেভাবে বিচার করে দেখা হয়নি। এই প্রেক্ষিতটি
বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ বিশ্বায়নই আজকের পরিস্থিতির প্রাধাণ্যকারী দিক। এই বিশ্বায়নের
প্রকোপে সাধারণের সম্পদ হিসেবে যা কিছু অবশিষ্ট ছিল, তাও আজ বিলীন হতে চলেছে।
তেষ্টা মেটানোর জন্য জল, শ্বাস নেওয়ার জন্য বায়ু, ঘুরে বেড়ানোর জন্য পথ, কথা বলার জন্য ভাষা
সবই আজ পণ্য। যা কেনা-বেচা করা যায় তাই পণ্য – তার কোনো স্থানিক বৈশিষ্ট্য
নেই। কিন্তু স্থানিক বৈশিষ্ট্য যুক্ত হয় যখন ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে একই পণ্যের
রকমারি রূপ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। মুনাফা ও বাড়তি একচেটিয়া আয়ের জন্য পণ্য হয়ে
ওঠে সাংস্কৃতিক উপাদানযুক্ত এক একটি প্যাকেজ। এই প্যাকেজ আসলে ভাষা-সংস্কৃতি ও
উন্নয়নের বিষয়ের এক মিশেল। এই মিশেল কীভাবে ও কারজন্য – এই বাস্তবতার মধ্যে রয়েছে
এক টানাপড়েন বা এক সংঘাত। এই সংঘাতে আমরা কার পক্ষে? কমন বা সাধারণের পক্ষে, না কর্পোরেট মুনাফার
সেবাদাসত্বের পক্ষে।
বিচ্ছিন্নতা ও অবনমনের
প্রকল্প
প্রকৃতির সাথে মানুষের আন্তঃক্রিয়ায় ভাষার
সৃষ্টি – তাই প্রাকৃতিক ভূগোলের নির্দিষ্ট বৈচিত্র ভাষার মধ্যেও এক নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য
আরোপ করে। তাই ভাষা ততটাই সাধারণের মুখের বুলি - যতটা প্রকৃতি, পরিবেশ, প্রাকৃতিক সম্পদ, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ইত্যাদি
সাধারণের নিয়ন্ত্রণে। এইসব থেকে সাধারণের বিচ্ছিন্নতা গভীরতর হয় আঞ্চলিক মোড়কে
পণ্যায়নের মাধ্যমে মুনাফা ও একচেটিয়া লাভের প্রকল্পে। দার্জিলিঙের চায়ের সাথে
যেমনি সেখানকার জলবায়ু – আবহাওয়ার বিশেষত্ব ও নেপালি কন্যার সৌষ্ঠবকেও বাজারজাত করা
হয়, ঠিক তেমনি বরাকের সিটিসি চায়ের সাথেও এখানকার বৈশিষ্ট্য নিয়েই প্রতিযোগিতায়
নামতে হয়। এই আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যকে গ্লোবাল করে তোলার মধ্য দিয়েই ‘রোজকান্দি চা’-কে গ্লোবাল ব্রাণ্ড
হয়ে উঠতে হবে। এমনকী বরাক-পশ্চিমবঙ্গ-বাংলাদেশের বাজারে প্রবেশের জন্য ও একচেটিয়া
অধিকার লাভের জন্য উনিশ – একুশের ঐতিহ্যও ব্যবহৃত হতে পারে। এই প্রক্রিয়ায়
ভাষা-ঐতিহ্য-উন্নয়ন সবকিছুই নির্ধারিত হয় প্রকৃতি-পরিবেশ-সম্পদের উপর নিয়ন্ত্রণ
থেকে সাধারণকে (কমন) বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে। যেসব আঞ্চলিক শ্রেণি-বর্ণ এই
বিচ্ছিন্নতার মদতদাতা, কর্পোরেট মুনাফার উচ্ছিষ্টভোগী – তারাই ঐতিহ্যের নামে
আঞ্চলিক আধিপত্য ও সংকীর্ণ গোষ্ঠীবাদের ধারক ও বাহক। শিল্প – পরিষেবা – পর্যটন যা কিছুই
হোক না কেন বিশ্বায়ন একে ব্যবহার করবে সাধারণের বিচ্ছিন্নতা ও অবনমনের মধ্য দিয়ে।
কিন্তু এই প্রকল্পই তৈরি করে তার প্রতি-প্রকল্প যেখানে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া মানুষ
তার মত করে ঐতিহ্যকে আঁকড়ে ধরতে চায় সাধারণের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার লক্ষ্যে।
উপনিবেশিক উন্নয়ন ও ভাষা
জল-জমি-জঙ্গলের মত সম্পদের প্রাথমিকভাবে
প্রাকৃতিক মূল্য ছাড়া আর কোন মূল্য থাকে না। প্রকৃতিতে বাস করা মানুষ তার শ্রম
যুক্ত করে জমিতে ফসল ফলায়, গাছের ডালপালা দিয়ে জ্বালানি তৈরি করে ব্যবহারিক মূল্য
প্রদান করে। এমনকী প্রাথমিক পর্যায় ব্যক্তি-মালিকানাধীন সম্পদের ক্ষেত্রেও লকির (Locke) সূত্র মেনে সম্পদের
সাথে শ্রম যুক্ত হয়েই মূল্য তৈরি হয়। এই অবস্থায় সম্পদ ও শ্রমের আন্তঃক্রিয়ার সাথে
যুক্ত সুখ-দুঃখ, অভিব্যক্তি, ভাষা-সংস্কৃতি সবকিছুই সাধারণের নিয়ন্ত্রণাধীন।
কীভাবে তা অন্যদিকে মোড় নেয় তা আমাদের চা-শিল্পের ইতিহাস থেকে দেখা যাক।
১৮২৪ সালে মেজর রবার্ট ব্রুস আসামের স্থানীয়
চা-গাছের আবিষ্কার করেন। ১৮৩৯ সালে ‘আসাম কোম্পানী’ গঠনের মাধ্যমে প্রথম
চা-শিল্পের পত্তন হয়। ১৮৫৯ সালের মধ্যে আসামের পাহাড়ী অঞ্চলে দ্রুত গতিতে চা-বাগান
পত্তন হতে শুরু করে। এই শিল্পে উপনিবেশিক স্বার্থ রক্ষা হয় এমন এক উৎপাদন পদ্ধতিতে
যেখানে পুঁজি ও পরিচালনা পদ্ধতি ব্রিটিশদের, কিন্তু জমি ও শ্রম সংগ্রহ
করা হয় ব্রিটিশদের এই উপনিবেশ থেকে। এই জমি শিল্প-মালিকদের কাছে সস্তায় বিক্রি ও
লিজ দেওয়া হয়, জমির খাজনার উপর বিভিন্ন ধরনের ছাড় দেওয়া হয়, স্থানীয় কৃষক ও জনজাতীয়দের
স্বার্থ লঙ্ঘিত করে প্ল্যান্টারদের স্বার্থ সুরক্ষিত করা হয়। জল-জমি-জঙ্গলের অধিকার
হারানো এই স্থানীয়রা জীবনধারণের ক্ষেত্রে তাদের নিজস্ব ভাষা-সংস্কৃতির উপযোগিতার
আর কোন যোগসূত্র খুঁজে পান না। যদি তাদেরকেই এই উন্নয়নের শ্রমিক হিসেবে যুক্ত করা
হত, তাহলে উপনিবেশিক উন্নয়নে তাদের নিজেদের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার লক্ষ্যে এক
বিদ্রোহের হয়ত তারা জন্ম দিতে পারত যে বিদ্রোহ জীবন্তভাবে যুক্ত থাকত তাদের
ভাষা-সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সাথে। কিন্তু ১৮৭০ সালের মধ্যেই ভৌগোলিক মানচিত্রে এক
বিরাট পরিবর্তন সাধিত হয়ে গেল। কয়েক লক্ষ একর বনাঞ্চল ও পতিত জমি চা-মালিকদের
ব্যক্তি-মালিকানায় চলে গেল। মূলত বিহার-পশ্চিমবঙ্গ-উড়িষ্যা-মধ্যপ্রদেশের বিস্তৃত
ঝাড়খণ্ড সাংস্কৃতিক অঞ্চল হিসেবে পরিচিত এলাকা থেকে আঁড়কাঠিদের মাধ্যমে (ঠিকাদার)
শ্রমিক চালানি নিয়ে আসা হল এবং ঘেরাবন্দী করে পার্শ্ববর্তী গ্রাম ও শহর থেকে
বিচ্ছিন্ন করে শ্রমিকদেরকে এক একটা এনক্লেভে ঢুকিয়ে দেওয়া হল। এই আঁড়কাঠিদের
অত্যাচার ও চালানি হয়ে আসার পথে লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের মৃত্যু এখনো শুধুমাত্র ‘সভ্যতা ও উন্নয়নের’ করুণ কাহিনী হয়েই
রইল। সুখের জীবনের টোপ দিয়ে এই শ্রমিকদের এখানকার চা-বাগানে নিয়ে এসে ব্রিটিশরা এক
ঢিলে দুই পাখী মারল। একদিকে ভাষা-সংস্কৃতি-ঐতিহ্য থেকে বিচ্ছিন্ন এই শ্রমিকরা
সস্তা শ্রমের গ্যারান্টি প্রদান করল, অন্যদিকে ঝাড়খণ্ড অঞ্চলের ব্রিটিশ বিরোধী
বিদ্রোহ ও এখানকার সম্ভাব্য স্থানীয় বিদ্রোহকে দুর্বল করে দিল। ভাষা-সংস্কৃতি-ঐতিহ্য থেকে বিচ্ছিন্ন
এই শ্রমিকরা আজও একইভাবে সমস্ত অধিকারবিহীন নিতান্তই সস্তা-শ্রমিক, যাদের ক্ষেত্রে
স্বাধীন ভারতের আইনও প্রযোজ্য হয় না, মালিক-ম্যানেজারই মাই-বাপ ও বিধাতা এবং এই
বিধাতাদের সাথে যোগসূত্র গড়ার জন্য মাঝে রয়েছে ইউনিয়ন বস, তাদের সর্দার ও
বাবু-স্টাফরা। প্রাক-স্বাধীনতা ও স্বাধীনতা-উত্তর পর্যায়ে তাদের
ভাষা-সংস্কৃতি-ঐতিহ্য চর্চা করাটা ছিল দুরূহ কাজ, কিন্তু বর্তমান বিশ্বায়ন
প্রক্রিয়া এক নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। তাদের ভাষা-সংস্কৃতি-ঐতিহ্য, বিরসা মুণ্ডা-সিধো
-কানহোর মত জাতীয় বীর শহিদদেরকে এক নতুন মোড়কে পণ্যায়িত করা হচ্ছে। আমাদের স্বীকৃত
সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ হয়ে উঠছে এই পণ্য লেনদেনের আখড়া, টু-পাইস কামিয়ে
নেওয়ার মাধ্যম। তাদের ঐতিহ্যকে যারা সফলভাবে বিক্রি করতে পারছেন তারাই হয়ে উঠছেন
আইকন। এই আইকনরাই পণ্যের আঞ্চলিক একচেটিয়াদের গ্লোবাল মার্কেটে প্রবেশের ব্রাণ্ড-অ্যাম্বেসেডর।
এই প্রক্রিয়া শ্রমিকদের উপর আধিপত্যকে আরও মজবুত করে, ভাষা-সংস্কৃতি-ঐতিহ্যকে
শ্রম ও শ্রমিকের অধিকার থেকে বিচ্ছিন্ন করার পন্থাকে সর্বজনগ্রাহ্য করে তোলে। যে
শ্রমিকরা নিজেদের ভাষা-সংস্কৃতি-ঐতিহ্যে জাগ্রত হয়ে ছিনিয়ে নিতে পারে শ্রমিকের
অধিকার, শিক্ষার অধিকার ও সম্পদের উপর সাধারণের নিয়ন্ত্রণের অধিকার, সেই শ্রমিকদের এই
নতুন পদ্ধতিতে মোহাচ্ছন্ন করা যায়। যে প্রগতিশীলরা ভাষা-সংস্কৃতির অধিকারের
প্রশ্নকে সঠিক অর্থেই উন্নয়নের সাথে যুক্ত করতে পারে তাদেরকেও এক আধিপত্যবাদী
তথাকথিত উন্নয়নের দিকে মোহাচ্ছন্ন করে রাখা যায়।
নগরায়ন ও ভাষা-সংস্কৃতি
আমাদের এই শহর শিলচর। বিশ্বব্যাপী নগরায়নের যে
কর্মকাণ্ড চলছে, শহর শিলচর তার ক্ষুদ্র সংস্করণ। গণ-স্বাস্থ্য, গণ-শিক্ষা,
গণ-পরিবহণ, সুস্থ-পরিবেশ, সাধারণের জন্য পাঠাগার, সংস্কৃতি চর্চার জন্য কম্যুনিটি
হল, নাগরিক পরিষেবার নিজস্ব উদ্যোগ এগুলিকে প্রাথমিকতায় না রেখে নগরায়নের যে
পরিকল্পনা তা সামাজিক বিচ্ছিন্নতার জন্ম দিচ্ছে। কর্পোরেট, রিয়্যাল-এস্টেট
ব্যবসায়ী ও ব্যক্তিমালিকদের মুনাফার উপর নির্ভরশীল উন্নয়ন বিকৃত নগর-সংস্কৃতির
আতুঁড়ঘর। বঙ্গভবন, সাংস্কৃতিক ভবন ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের সাথে শহরের সাধারণের
কী কোন আত্মিক যোগ রয়েছে কিংবা রয়েছে তাদের ব্যবহারিক মালিকানার অধিকার? যে পথকে নাগরিকরা
নিজের পথ বলে ভাবত, আজ এই পথ নাগরিকদের বিরক্তি-ক্রোধ ও রোগের জন্মদাতা,
ভবিষ্যতে পথের মালিককে হয়ত দিতে হবে টোল-ট্যাক্স। যে
বাসিন্দারা প্রতিটি পাড়াকে নিজের পাড়া বলে ভাবত তারা এই শহরকে নিজের ভাবার
যৌথভাবনায় যেতে পারল না। এই শহর মুসলিম বাসিন্দাদের আপন করে নিতে পারল না, তাঁরা জমি বিক্রি
করে চলে গেলেন আরও ভেতরে। কিন্তু বিকৃত নগর সংস্কৃতির ব্যাপ্তি আরও ভেতরে প্রবেশ
করছে দ্রুত এবং তাদেরকেও গ্রাস করে নিচ্ছে যারা প্রাথমিক ধাক্কায় একটু দূরে চলে
গেছিলেন। এভাবে মানুষে মানুষে যে ভৌগোলিক দূরত্ব তৈরি হচ্ছে তা জন্ম দিচ্ছে মানসিক
দূরত্বের। সামাজিক মিলনের জায়গা নিচ্ছে শপিং মলের মত বাজারের প্রতিষ্ঠান যেখানে
বিত্তবানরা শুধু পণ্যকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেই ভাবের আদান প্রদান করতে পারেন।
অথচ কলকাতার তথাকথিত নবজাগরণ-পর্যায়ের ‘ভদ্রলোক মধ্যশ্রেণির’ মত এদের গ্রামাঞ্চলের
জমিদার-মহাজনি শ্রেণি-স্বার্থ না থাকায় এরা একটি প্রগতিশীল শ্রেণি হয়ে উঠতে পারত,
সত্তরের দশকে এই প্রবণতা দেখাও গিয়েছিল। অন্যরা বিচ্ছিন্ন, যাদের কোন সামাজিক
মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান নেই যেখানে ভাবের আদান প্রদান হতে পারে, তাই তাদের জন্য যে
সামাজিকতা বাকী থাকল তা দখল করে নিল ধর্মীয় উন্মাদনা। যেহেতু শহরের ভাষা-সংস্কৃতির
সামূহিক চর্চাকে নিয়ন্ত্রণ করছে বাজার ও ধর্ম, সুতরাং এই প্রতিষ্ঠানদ্বয়ই
নির্ধারণ করবে আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতি – সেটাই স্বাভাবিক। বাজার যে ভাষাকে চাইবে তাকে
রাখবে, যাকে চাইবে না তাকে ধ্বংস করবে। বাজার আমাদের বাংলা ভাষাকে ধ্বংস করবে না, কারণ বাঙালিরা
ইতিমধ্যেই এই সংকটের বাজারে পণ্যের এক বড়সড় ক্রেতা, কিন্তু বাজার ভাষার
রূপ-রস-গন্ধ শুষে নেবে – শুষে নেবে তার জীবন ও প্রাণশক্তি।
বিকল্প ভাবনা
আমাদের যদি ভাষা-সংস্কৃতির বিকাশ ও তার সাথে
সম্পর্কিত উন্নয়নকে সুনিশ্চিত করতে হয়, তাহলে উনিশের ঐতিহ্যের পুননির্মাণ করা জরুরি।
এই নির্মাণ কখনওই নৈর্ব্যক্তিক হতে পারে না। আমাদের ভাষা-সংস্কৃতির জীবন ও
প্রাণশক্তিকে আধার হিসেবে ধরতে হবে এবং উন্নয়নের শুধু গণতান্ত্রিক রূপ নয়, সামাজিক রূপ নিয়েও
ভাবতে হবে। উভয়ক্ষেত্রে শ্রম ও শ্রমজীবীদের অধিকারের প্রশ্নটি মুখ্য বিচার্য বিষয়
হিসেবেই রাখতে হবে। পঠন-পাঠনের ভাষা যদি মায়ের মুখের ভাষার কাছাকাছি না হয় বা
যোগসূত্রহীন হয় – ‘তাহলে মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ সম’ এই বুলি আওড়ে কী লাভ?
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় যদি চা-বাগানের মানুষদের তাদের মাতৃভাষায় পঠন-পাঠনের সুযোগ
করে দেওয়ার ক্ষেত্রে কোন ভূমিকাই পালন না করে তাহলে তাহলে একে উনিশের ঐতিহ্যের
প্রতিষ্ঠান বলে কী লাভ? আমাদের উন্নয়ন যদি ভাষিক ঐক্যের বদলে সামাজিক দূরত্বকেই
বাড়িয়ে তোলে, তাহলে এই উন্নয়নের কী প্রয়োজন? আমাদের ভাবতে হবে বিকল্প ভাবনা। বিকল্প ভাবনা
বাস্তবায়িত হতে পারে একমাত্র তখনই যখন আমাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও পরিকল্পনা
বিভাগে কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণের বদলে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হবে। এই বিকল্প
ভাবনার জন্য প্রয়োজন ধামাধরা গতের বাইরে বেরিয়ে এসে এক নতুন চিন্তা। আর এই নতুন
চিন্তার জন্ম দিতে পারে এক ঐক্যবদ্ধ ভাষিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলন। এই আন্দোলনই অধিকার
ও উন্নয়নের একমাত্র হাতিয়ার, যে উন্নয়ন কসমোপলিটান, স্যাকুলার ও যৌথ সামাজিক জীবনের
আবহ গড়ে তুলে।