বিমা ক্ষেত্রে
বিদেশি বিনিয়োগ কার স্বার্থে
অরূপ বৈশ্য
যুগশঙ্খ, ৪ আগস্ট সংখ্যা |
আর্থিক সংস্কার কর্মসূচী
বিমা প্রকল্প বিশেষ করে জীবন বিমা হলো এক দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি যার নিয়ম মেনে পলিসি-হোল্ডারদের ভবিষ্যত দাবি অনুযায়ী বিমাকারী অর্থ আদায়
দেয়। জনগণের ভবিষ্যত সামাজিক সুরক্ষার জন্য এই সঞ্চয় দীর্ঘমেয়াদি হওয়ায় বিমা
প্রকল্পে জমা অর্থ দেশের উন্নয়নমূলক কাজে বিনিয়োগ হয় ও জাতীয় পুঁজি গঠনে সহায়তা
করে। যেহেতু জাতীয় উন্নয়নের জন্য সরকারই একমাত্র দায়বদ্ধ ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে
উত্তরদায়ী, তাই এভাবে সঞ্চিত জনগণের অর্থের উপর জাতীয় স্বার্থে সরকারেরই নিয়ন্ত্রণ
থাকা উচিত। ভারতবর্ষে কল্যাণকামী রাষ্ট্রের এই ধারণা বদলাতে শুরু করে যখন ১৯৯১
সালে সে সময়কার কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিং নয়া আর্থিক নীতির অধীনে
কাঠামোগত পুনর্গঠন বা আর্থিক সংস্কার কর্মসূচী
চালু করেন। স্বাধীনতা-উত্তর পর্যায়ে মিশ্র-অর্থনীতির নামে ভারতীয় রাষ্ট্র
পুরোনো বিদেশি প্রযুক্তি ও ভারী যন্ত্রপাতি আমদানির উপর নির্ভরশীল এক পুঁজিবাদী পথ
অনুসরণ করায় আমদানী-রপ্তানী ভারসাম্যের প্রশ্নটি সংবেদনশীল হয়ে পড়ে। বর্তমানে যা
আমদানী করা হয় তা যাতে ভবিষ্যতে নিজ দেশে উৎপাদন করা যায় অর্থাৎ ইমপোর্ট
সাবস্টিট্যুশনের নীতির কথা মুখে বলা হলেও স্বার্থান্বেষি শ্রেণির মন জয় করার জন্য
এই নীতি বাস্তবায়নে অভ্যন্তরীণ কাঠামোগত বাধাগুলি দূর করার কোন সদিচ্ছা দেখানো হয়
না। ফলে নব্বইয়ে তেলের মূল্যবৃদ্ধি হওয়ায় রপ্তানী থেকে আমদানীর পাল্লা ভারী হয়ে
পড়ে ও বিদেশি মূদ্রার অভাব দেখা দেয় যা নব্বইয়ের ‘ব্যালেন্স অব পেমেন্ট ক্রাইসিস’
হিসেবে বহুল পরিচিত। ফলে ভারত সরকারকে কাঠামোগত পুনর্গঠন বা আর্থিক সংস্কার কর্মসূচীর
শর্তে আইএমএফ-ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক থেকে ধার নিতে হয়। এই শর্তাবলির মধ্যে প্রধান শর্ত
হচ্ছে এই যে ভারত সরকারকে সবকিছু থেকে সরকারি নিয়ন্ত্রণ উঠিয়ে দিতে হবে এবং
দেশি-বিদেশি ব্যাক্তি পুঁজিকে অবাধ মুনাফা করার সুযোগ করে দিতে হবে। এই উদার
আর্থিক নীতির নিয়ম মেনেই ২০০০ সালে বিমা ক্ষেত্রে ব্যাক্তি মালিকানার ও ২৬%
পর্যন্ত বিদেশি পুঁজি বিনিয়োগের অনুমতি দিয়ে আই.আর.ডি.এ আইন, ২০০০ জারি করা হয়।
দ্বিতীয় প্রজন্মের সংস্কার
বিদেশি বিনিয়োগ দু’ভাবে হতে পারে। কোন বিদেশি কোম্পানী দেশিয়
কোম্পানীর শেয়ার সরাসরি নির্দিষ্ট কোম্পানী থেকে কিনে নিতে পারে এবং সেক্ষেত্রে
সেই কোম্পানীর বোর্ডের ও পরিচালনার অংশীদার হয়ে যাবে। আবার শেয়ার বাজার থেকে পোর্টফোলিও
বিনিয়োগের মাধ্যমে সেই বিমা কোম্পানীর শেয়ার কিনে নিতে পারবে এবং সেক্ষেত্রে
কোম্পানী বোর্ড ও ম্যানেজম্যান্টের কোন অংশীদার হতে পারবে না। সেবি’র (SEBI) নিয়ম অনুযায়ী শেয়ার বাজার থেকে বিদেশি
বিনিয়োগকারীরা ২৪ শতাংশের বেশি ক্রয় করতে পারবে না, তবে অন্যান্য শেয়ার-হোল্ডারদের
অনুমতি নিয়ে তা বাড়ানো যাবে। আই.আর.ডি.এ’র ২০১৪ সালের
রিপোর্ট অনুসারে জীবন বিমা ক্ষেত্রে ২৪টি ও অন্যান্য বিমা ক্ষেত্রে ২১টি কোম্পানী
রয়েছে। তারমধ্যে জীবন বিমায় ১টি ও অন্যান্য বিমা ক্ষেত্রে ৪টি সরকারি কোম্পানী
রয়েছে। জীবন বিমায় মোট বিদেশি বিনিয়োগ ৬০৪৫.৯ কোটি টাকা যা মোট পুঁজির ২৩.৬% এবং অন্যান্য বিমায় রয়েছে ১৫৮৬.৬ কোটি যা মোট পুঁজির ১৬.৬৭%। সাহারা ছাড়া ২৩টি ব্যাক্তি মালিকানাধীন কোম্পানীর
সবকটি কোম্পানী তাদের মোট বিনিয়োগের নির্ধারিত ২৬ শতাংশের প্রায় পুরোটাই বিদেশি
কোম্পানীর কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। বর্তমান এনডিএ সরকার বিমা ক্ষেত্রে বিদেশি
বিনিয়োগের ২৬% সর্বোচ্চ সীমা বাড়িয়ে ৪৯% করার জন্য ক্যাবিনেট সম্মতি দিয়ে দিয়েছে
এবং এই প্রস্তাব পার্লামেন্টের অনুমোদনের অপেক্ষায়। ইউপিএ সরকারের প্রথম প্রজন্মের
সংস্কারের হাত ধরে দ্বিতীয় প্রজন্মের সংস্কার কর্মসূচী দ্রুতগতিতে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার
এই সরকারের মনোবাসনা অনুযায়ী এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বিগত কংগ্রেস সরকারের
অর্থমন্ত্রী পি. চিদাম্বরম তাঁর
কার্যকালেই এই প্রস্তাব রেখেছিলেন, কিন্তু কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ শক্তি ও সহযোগীদের
চাপের ফলে তিনি এই প্রস্তাব কার্যকরী করতে পারেননি। ভারত সরকার ৪৯ শতাংশ বিদেশি
প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ ফরেন ইনভেস্টম্যান্ট প্রমোশন বোর্ডের (FIPB) মাধ্যমে করার প্রস্তাব দিয়ে দেখাতে চাইছে যে কোম্পানীর
নিয়ন্ত্রণ ভারতীয় প্রমোটারদের হাতে থাকবে। এটা আসলে একটা প্রহেলিকা। বিদেশি
বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আসল রহস্যটা যাচাই করে দেখা যাক।
ভারতীয় জীবন বিমা বনাম প্রাইভেট কোম্পানী
৩৬ কোটি পলিসি নিয়ে ভারতীয় বিমা ক্ষেত্র পৃথিবীর সর্ববৃহৎ
ক্ষেত্র এবং আগামী পাঁচ বছর এই ক্ষেত্রের দ্রুত বিকাশের পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
দেশের মোট জনসংখ্যার ৬৫ শতাংশের বয়স ৩৫ বছরের কম। সুতরাং যারা বিদেশি বিনিয়োগের
পক্ষে তাদের যুক্তি হলো এই ক্রমঃবিকাশমান সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে গেলে প্রচুর
বিনিয়োগের প্রয়োজন এবং বিভিন্ন কোম্পানীর মধ্যে প্রতিযোগিতা হলে পলিসি-হোল্ডারদের
সংখ্যা বাড়বে এবং পলিসি-হোল্ডাররা লাভবান হবে। বিশ্বের উন্নত দেশের বিমা বাজার এক
সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এবং সেক্ষেত্রে বিমায় বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে ভারতীয়
বাজার অত্যন্ত লোভনীয়। উপরন্তু পেনশন আইন অনুযায়ী পেনশনে বিদেশি বিনিয়োগের মাত্রা
বিমা ক্ষেত্রের অনুরূপ হবে। অর্থাৎ এই দুটি ক্ষেত্রে ভারতীয় জনগণের জমা অর্থ
ব্যাক্তি মালিকরা তাদের মুনাফার কথা বিবেচনায় রেখে অন্যত্র বিনিয়োগ করবে। সরকারি
নিয়ন্ত্রণহীন এই ব্যাক্তি-মালিকানাধীন কোম্পানীদের কাছে পলিসি-হোল্ডারদের স্বার্থ
নয়, মুনাফার স্বার্থই প্রধান। একটি হিসাবে দেখা গেছে, প্রাইভেট কোম্পানীর ক্ষেত্রে
গড় বার্ষিক প্রিমিয়াম ৬০,০০০ টাকা, অন্যদিকে এলআইসি’র গড় প্রিমিয়াম ৯০০০ টাকা। এই
ব্যবধান থেকে এটা স্পষ্ট যে সরকারি বাধ্যবাধকতা থাকায় এলআইসি’র পলিসিগুলো অনেক
বিস্তৃত ও অত্যন্ত কম আয়ের লোকদের জন্যও উপযোগী। বেশি আয়ের পলিসি-হোল্ডাররা যদি
প্রাইভেট কোম্পানীতে চলে যায়, তাহলে এলআিইসিকেও প্রতিযোগিতায় টিঁকে থাকার জন্য
বাধ্য হয়ে প্রাইভেট কোম্পানীর মত তার পলিসিকে পুনর্গঠন করতে হবে। উপরন্তু মুনাফা
বৃদ্ধির লক্ষ্যে ও বিদেশি বৃহৎ পুঁজির চাপে প্রাইভেট কোম্পানীগুলো একজোট হয়ে বা
অধিগ্রহণের মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা রোধ করে একচেটিয়া ব্যবসার মাধ্যমে
সরকারি ক্ষেত্রের চরিত্র পালটে দেবে। অর্থমন্ত্রী বলেই দিয়েছেন যে সব কোম্পানী
যাতে সবার পলিসি বিক্রি করতে পারে এবং কর্পোরেট এজেন্ট হয়ে উঠে সে নিয়ম চালু করা
হবে। ২০১০-১১ সালের একটি হিসাবে দেখা গেছে যে পলিসি তামাদি হয়ে যাওয়ার অনুপাত (Lapsation ratio) এলআইসি’র ক্ষেত্রে মাত্র ৫%, প্রাইভেট
কোম্পানীগুলোর ক্ষেত্রে সেটা ৪২%। প্রাইভেট কোম্পানীর পলিসি-হোল্ডাররা প্রায়শঃই এক
বছরের পর আর প্রিমিয়াম দেন না, কারণ যেভাবে বোঝানো হয় একবছর পর তাদের কাছে বিমা-প্রকল্পগুলি
সেরকম লাভজনক মনে হয় না। এলআইসি’র ক্ষেত্রে শেয়ার বাজারে বিনিয়োগের জন্য ১০% সীমা
নির্ধারণ করা আছে, অর্থাৎ এলআইসি তার জমা পুঁজির (ভারতীয় জনগণের অর্থ) বড় অংশই
বিনিয়োগ করে উন্নয়নমূলক পরিকাঠামোগত প্রকল্পে। এলাআইসি’র জমা ধনরাশি জাতীয় পুঁজি
গঠনের কাজে লাগে। অন্যদিকে প্রাইভেট কোম্পানীগুলি শেয়ারে বিনিয়োগ করে পলিসি-হোল্ডারদের
জমা অর্থের রিস্ক পলিসি-হোল্ডারদের ঘাড়েই চাপিয়ে দেয়। শেয়ার বাজারের অনিশ্চয়তা
পলিসি-হোল্ডারদের জমা অর্থের পুরোটাই হাপিস হয়ে যাওয়ার দুশ্চিন্তায় কালঘাম ছুটে।
এবার ক্রমবর্ধমান বিমা বাজারের গালগল্প ও জাতীয় স্বার্থের জয়গান বিচার করে দেখা
যাক।
বিমা বাজার ও জাতীয় স্বার্থ
সাধারণ যুক্তিতেই বোঝা যায় যে জনগণের হাতে সঞ্চয় করার মত ধন
যত বাড়বে ততই বিমারাশি বাড়বে। এটাও দু’ভাবে হতে পারে। সাংসারিক ও অন্যান্য
আনুষাঙ্গিক ব্যয় করার পর সঞ্চয় করার মত অর্থ থাকা লোকের সংখ্যা বৃদ্ধি করে, আবার
যারা এখন সঞ্চয় করেন জনসংখ্যার সেই ক্ষুদ্র অংশের আয় বৃদ্ধির নীতির মাধ্যমে
তাদেরকে বিমায় সঞ্চয় করতে অনুপ্রাণিত করে। যে কোন সরকার যদি দেশের স্বার্থ ও জাতীয়
স্বার্থ মাথায় রাখে তাহলে তাকে প্রথম পথই অনুসরণ করতে হবে। কারণ দেশ মানে শুধু
একটি ভূগোল নয়, দেশ মানে সেই ভৌগোলিক স্থানে বাসকারী মানুষ। সরকার যদি সেই স্বার্থ
মাথায় রাখে তাহলে অর্থনীতিকে এমনভাবে পরিচালিত করতে হবে যাতে উৎপাদন, উৎপাদিকা
শক্তি ও তার থেকে সাধারণের আয় বৃদ্ধি ঘটে এবং এই আয় বৃদ্ধির ফলে জমা পুঁজি উন্নয়ন
খাতে ব্যয় করার জন্য সরকারের ঘরেই যায় তার জন্য বীমা-ব্যাঙ্কের মত আর্থিক
প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে। সেই পথই দেশীয় ও জাতীয় অর্থনীতির
পথ। কিন্তু ইউপিএ ও এনডিএ সরকার দ্বিতীয় পথ অবলম্বন করেছে এবং বিমা ক্ষেত্রে
বিনিয়োগের জন্য দেশিয় বাজার থেকে পুঁজি সংগ্রহ না করে প্রাইভেট মালিকদের বিনিয়োগের
উপর নির্ভর করছে। দেশিয় ব্যক্তি-মালিকদের যেহেতু সেই ক্ষমতা নেই, তাই বিদেশি বিনিয়োগ।
কিন্তু এই পদক্ষেপ যে দেশিয় অর্থনীতিকে চূড়ান্ত অনিশ্চয়তার দিকে নিয়ে যাচ্ছে এবং
প্রাইভেট বিনিয়োগ যে কর্মসংস্থান সৃষ্টিরও সহায়ক না হতে পারে বিভিন্ন উন্নয়নশীল
দেশের অভিজ্ঞতা থেকে সেটা আজ প্রমাণিত সত্য।
অনিশ্চিত ভবিষ্যত
0 comments:
Post a Comment