দুটি সংক্ষিপ্ত লেখা ঃ (১) সাবেরিদাকে আমি যেভাবে দেখেছি (২) মাতৃভাষা, রাষ্ট্রভাষা ও রাষ্ট্র
Posted by
সাবেরিদাকে আমি যেভাবে দেখেছি – অরূপ বৈশ্য
মূল্যায়ন
নয়, চিত্রায়ণ
প্রয়াত আবুল হুসেন মজুমদার যাকে আমি অন্য অনেকের মত
সাবেরিদা বলে সম্বোধন করতাম তাঁর সাথে প্রথম কখন পরিচয় ঘটে তার সন-তারিখ স্মরণে
নেই। কী পরিস্থিতিতে পরিচয় ঘটেছিল তাও ঠিকঠাক মনে নেই। সম্ভবত চন্দনদার (চন্দন
সেনগুপ্ত) সাথে রাজনৈতিক কোন বিষয়ে নিয়ে আলোচনার জন্য ওনার সাথে দেখা করেছিলাম।
কোন কিছুর বিস্তৃত খুঁটিনাটি আমার স্মৃতিতে থাকে না। দীর্ঘদিনের পরিচয়ে যে বিশেষ
সাধারণ বৈশিষ্ট্য মনে দাগ কাটে তা’ই স্মৃতির কোন এক স্তরে বাসা বেঁধে বসে থাকে। সাবেরিদা
সেরকমই এক ব্যক্তিত্ব যার বিশিষ্টতা প্রশ্নাতীত। তাঁকে কেন্দ্র করে বিতর্কও কম ছিল
না। সেটাই স্বাভাবিক। যার নিজস্ব মত আছে এবং যে কোন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নিজের
মতকে যুক্তির কাঠামোয় তুলে ধরার সৎ সাহস যার আছে তাকে নিয়ে বিতর্ক তো হবেই।
সাবেরিদাকে অনেকে অনেকভাবে দেখেছেন। যেমন গল্পকার মলয় কান্তি দে যেভাবে দেখেছেন তা
তাঁর ‘বদ্ধজলার মর্মকথা’ গল্পের চরিত্রের মধ্যে ফুটে উঠেছে। এই সংক্ষিপ্ত নিবন্ধ
কোন স্মৃতিচারণ নয়, তাঁর অবদান নিয় কোন মূল্যায়নও নয়, আমার দেখা সাবেরিদাকে তুলে
ধরার প্রয়াস মাত্র।
ভাষার
প্রশ্নে
নব্বইয়ের দশকের কোন এক সময়ে সাবেরিদার বাড়িতে ভাষার প্রশ্ন
নিয়ে কথা হচ্ছিল। সাবেরিদাই মূলত কথা বলছিলেন, আমি তাঁর কথার বিরতিতে আমার মত
ব্যক্ত করছিলাম। বেরিয়ে যাওয়ার সময় তাঁর ঘর থেকে সুনীতি চট্টোপাধ্যায়ের অডিবিএল
বইখানা নিয়ে আসি। সম্ভবত বছর দু’য়েক পর সাবেরিদা আমাকে ফোন করে বললেন, “অরূপ, আমার
অডিবিএল বইটা বোধহয় তোমার কাছে, আমার লাগছিল”। ভাষার উপর সেদিনের তাঁর কথা নিয়ে
নিজের মধ্যে পর্যালোচনা করার চেষ্টা করি। তাতে তাঁর সম্পর্কে আমার ধারণা হয় যে
সাবেরিদা ভাষাকে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবেই বেশী গুরুত্ত্ব দেন, ভাষা যে উপলব্ধি - কনসেপ্ট
ও চেতনার প্রকাশ সেব্যাপারটি তাঁর কাছে গৌণ। এর কিছুদিন পর গণতান্ত্রিক লেখক
সংস্থার উদ্যোগে ভাষার অধিকারের প্রশ্ন নিয়ে শিলচর মহিলা কলেজে এক সেমিনার
অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে নির্দিষ্ট বক্তা হিসেবে সাবেরিদা লিখিত বক্তব্য পেশ করেন। সে
পাণ্ডুলিপি এখন কারুর কাছে গচ্ছিত আছে কিনা আমার জানা নেই। সাবেরিদা তাঁর বক্তব্যে
নিম্ন অসমের বাঙালি মুসলমানদের ভাষার অধিকার খর্ব হওয়ার ইতিহাস এবং তাদের
অনগ্রসরতার আন্তঃসম্পর্ক অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণভাবে তুলে ধরেন। অর্থাৎ মতাদর্শগতভাবে
তাঁর অবস্থান যেখানেই থাকুক না কেন, তাঁর চিন্তার চালিকাশক্তি ছিল মানব-কল্যাণ ও
সমাজের সবচাইতে নিপীড়িত সবহারাদের বিষয়।
ইসলাম
ধর্মের প্রশ্নে
ইসলাম ধর্মের চর্চা, ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনা ও ইসলামে
বিশ্বাসী মানুষের জীবনযাত্রার মধ্যে বিশ্বজোড়া বিভিন্নতা রয়েছে। আবার ইসলামে
বিশ্বাসী একই সংগঠনের মধ্যেও স্থান-কালের বিচারে বিভিন্নতা রয়েছে। যে ওয়াহাবি
মতবাদ উপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে ‘বাঁশের কেল্লার’ লড়াইয়ে কৃষক বিদ্রোহী তিতুমীরের
মত নিপীড়িত মানুষের পক্ষের নায়কের জন্ম দেয়, আজ সেই ওয়াহাবি মতবাদকে অন্যত্র
সাম্রাজ্যবাদীরা ব্যবহার করছে সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে। কোন নির্দিষ্ট মতাদর্শে
বিশ্বাসীরা কোন শ্রেণির স্বার্থে কাজ করছে, নিপীড়িক না নিপীড়িতের হয়ে, সেই ভূমিকা
মতদর্শের উপরও প্রভাব বিস্তার করে। সেই ভূমিকার চূলচেরা বাস্তব ব্যখ্যা ছাড়া কোন
সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় না। অথচ প্রকৃত বৌদ্ধিক চর্চার বাইরে সাধারণ প্রবণতাই
হচ্ছে চটজলদি একমাত্রিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া। এই সাধারণ সত্য ব্যক্তি ও গোষ্ঠী
উভয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। সাবেরিদা জামাতে ইসলামী দলের সদস্য ছিলেন। মাঝখানে
স্বল্পসময়ের জন্য এই সংস্রব ত্যাগ করেছিলেন। স্থানীয় পত্রিকায় সেরকম একটি সংবাদ
সম্ভবত প্রকাশিত হয়েছিল। জামাতে ইসলামী দলের রাজনৈতিক ইসলাম নিয়ে এখানে আলোচনা
করার সুযোগ নেই। জামাতে ইসলামী দল ভারত বিভাজনের বিরোধী ছিল। কিন্তু তাদের এই
ভূমিকা ম্লান হয়ে যায় যখন জানা যায় যে তাদের এই বিরোধিতার পেছনে এই দলের তাত্ত্বিক
নেতাদের ভিন্ন এক মতাদর্শগত ধারণা ছিল। এই তাত্ত্বিক প্রবক্তারা ভেবে ছিলেন যে
ইসলামের সাম্যের আবেদনে সাড়া দিয়ে অবিভক্ত ভারতের অ-মুসলমানরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ
করবে। সাবেরিদা তাঁর বিদ্রোহী সত্তা ও কুসংস্কারমুক্ত মানসিকতার তাগিদেই সম্ভবত
সাম্রজ্যবাদ বিরোধী রাজনৈতিক ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন, কারণ তাঁর বৌদ্ধিক
নেতৃত্বে পরিচালিত অরাজনৈতিক সংগঠনের উদ্যোগে সাম্রজ্যবাদ বিরোধী বহু আলোচনাচক্র
অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং বর্তমান লেখকেরও তাঁর আমন্ত্রণে এধরনের সেমিনারে বক্তা হিসেবে
যোগ দিয়ে তাঁর বক্তব্য শোনার সুযোগ ঘটেছে। কিন্তু কুসংস্কারমুক্ত আধুনিক ইসলাম
গড়ার প্রয়াসও যে ইসলামকে আমজনতা বিরোধী অবস্থানের দিকে ঠেলে দেয় যদি আরও কিছু অনিবার্য
শর্ত পূরণ না হয়, সেব্যাপারে তিনি কতটা সচেতন ছিলেন তা বোঝার কোন সুযোগ ছিল না,
কারণ ইসলামকে বিকৃত করার উগ্র-হিন্দুত্ববাদীদের প্রয়াসের অত্যন্ত সঙ্গত বিরোধিতা ছাড়া
ধর্ম নিয়ে ব্যক্তিগত স্তরেও তিনি বিশেষ আলোচনা কোনদিন করেননি। সুতরাং জামাতে
ইসলামের ভারত বিভাজন বিরোধী ও অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী রাজনৈতিক অবস্থানের যে
ক্ষেত্র তাতেই ছিল তাঁর আবাস, ইসলামের বিশুদ্ধীকরণের দিকে ছিল তাঁর নজর, কিন্তু
ইসলামীকরণের মতাদর্শের প্রতি তাঁর বিশেষ আকর্ষণ ছিল না। সেটা না হওয়ার পেছনে মুখ্য
কারণ এই যে তাঁর চিন্তন-মননের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল নিপীড়িত শ্রেণির মানুষ ও তাঁর
নিপীড়িক বিরোধী অবস্থান। সেজন্যই তিনি অনায়াসেই আমাদের মত কম্যুনিস্ট মতাদর্শে
বিশ্বাসীদের সাথে মেহনতি মানুষের সংগ্রামী কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ করতে পারতেন। এই
আগ্রহই তাঁকে এঅঞ্চলে সুফীবাদের ভূমিকা নিয়ে দীর্ঘ রচনা লিখতে অনুপ্রাণিত করে।
হাতে লেখা প্রায় শত পৃষ্ঠার এক পাণ্ডুলিপি তিনি আমাকে পড়তে দিয়েছিলাম, সেই
পাণ্ডুলিপির প্রতিলিপি এখনও আমার ঘরে পড়ে রয়েছে কিনা খুঁজে দেখতে হবে।
বুদ্ধিজীবী
প্রশ্নে
আমরা প্রতিনিয়ত তথাকথিত কেজো বুদ্ধিজীবীর সম্মুখীন হই যারা
সবসময়ই নিজের মতকে প্রতিষ্ঠানের ও প্রভাবশালীদের অনুমোদন পাওয়ার লক্ষ্যকে সামনে
রেখে পরিচালিত করেন, সেদিক থেকে তিনি ব্যতিক্রম। কিন্তু সব মানুষেরই যেমন কিছু
দুর্বলতা থাকে, তাঁরও নিশ্চয়ই থেকে থাকবে। বিবৃতি দিয়ে স্বল্প সময়ের জন্য জামাতের
সঙ্গ ত্যাগ এবং আবার এর সাথে যুক্ত হওয়ার ঘটনা কোন দুর্বলতার লক্ষণ কিনা
সেব্যাপারে তাঁর সাথে কথা বলার ইচ্ছে থাকলেও সেটা আর হয়ে উঠেনি। মতাদর্শগত ও
ধর্মীয় পরিচিতি তাঁর বৌদ্ধিক অবদানের স্বীকৃতি পাওয়ার ক্ষেত্রে যে অন্তরায় সেটা
তিনি উপলব্ধি করতেন ও এব্যাপারে তাঁর মর্মবেদনাও তিনি একান্তে ব্যক্ত করতেন।
ইতিহাসবিদ সুজিৎ চৌধুরীর বহু মতের সাথে তিনি একমত ছিলেন না, সেটা তিনি কোথাও
লিখিতভাবে ব্যক্ত করেছেন কিনা আমার জানা নেই। বরাক উপত্যকার প্রেক্ষিতে সুজিৎ
চৌধুরী নিশ্চয়ই নিজেই ছিলেন এক প্রতিষ্ঠান। সুতরাং খোলাখুলি প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা
করা বরাক উপত্যাকার বৌদ্ধিক চর্চার পরিবেশে খুব একটা খাপ খায় না। বাংলার জাতি-বর্ণ
পরিচিতির প্রশ্নে ইতিহাসবিদ ডি.আর.ভাণ্ডারকারের ব্যাখ্যার সূত্র ধরে সুজিৎ চৌধুরী কিছু
সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন। কিন্ত ভাণ্ডারকারের ব্যাখ্যাই ভ্রান্ত ও অপ্রতুল
তথ্যনির্ভর বলে অন্যান্য ইতিহাসবিদদের দাবির প্রেক্ষিতে সুজিৎ চৌধুরীর কোন লেখা
প্রকাশ পায়নি। এনিয়ে এঅঞ্চলের কোন ইতিহাসবিদের ভিন্ন কোন লেখা যখন নেই, তখন এনিয়ে
প্রশ্ন উত্থাপন করে লেখার জন্য একদিন কথায় কথায় আমি তাঁকে বলেছিলাম। উত্তরে বললেন
যে তিনি লিখলে কেউ সেটা গ্রহণ করবে না। আমার মনে হয়েছে যে তিনি বলতে চেয়েছেন যে
সেটা তাঁর ক্ষেত্রে অনধিকার চর্চা। বরাক উপত্যকার বৌদ্ধিক পরিবেশে এই যে অনধিকারের
আবহ তা তাঁকেও প্রভাবিত করেছে। অন্য অনেকের মত এটাও তাঁর একটি দুর্বলতা। বৌদ্ধিক
বিতর্ক মানেই যে কেউ কাউকে ছেড়ে কথা বলবে না সেই আবহ বরাকে তৈরি হয়নি। বরাক
উপত্যকার সমাজ জীবনে সেই কর্তাভজা পরিবেশ সর্বত্র এখনও গেঁড়ে বসে আছে। সাবেরিদা এর
থেকে বেরিয়েও বেরোতে পারেননি।
আমাদের
বন্ধুত্ব
আমাদের সাথে ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠার পেছনে আরেকটি কারণ ছিল। আমরা
তথাকথিত বামপন্থী উন্নাসিকতা ও কূপমণ্ডূকতাকে ঝেড়ে ফেলে ধর্মীয় কারণেও নিপীড়িতের
ব্যথিত হৃদয়ের সাথী হতে পিছপা হতাম না। সালমান রুশদির ‘স্যাটানিক ভার্সেস’-এর কোন
এক মন্তব্য ইসলামে বিশ্বাসীদের মনে আঘাত করে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ থেকেই
জনগোষ্ঠীগত সাইকি’তে আঘাত দেওয়ার প্রতি আমাদের বিরোধী অবস্থান ব্যক্ত করার
উদ্যেশ্যে শিলচরে গণতান্ত্রিক লেখক সংস্থার উদ্যোগে একটি সেমিনার সংগঠিত করা হয়। গণতন্ত্রের
ও আঘাতপ্রাপ্ত জনগোষ্ঠীর সাথে যুক্তিবিন্যস্ত মত বিনিময় করার পরিবেশ তৈরির
স্বার্থে খোলাখুলি এই মত ব্যক্ত করা জরুরি বলে আমরা মনে করি। কারণ একথা স্মরণে
রাখা জরুরি যে গোটা বিশ্বব্যবস্থার প্রেক্ষিতে মুসলমান সম্প্রদায় এক নিপীড়িত
জনগোষ্ঠী। নিপীড়িতরা স্বাভাবিক কারণেই স্পর্শকাতর। আজকে যারা ইসলামী সন্ত্রাসের
বর্বরতার নিদর্শন দিয়ে আমাদের এই অবস্থানের বিরোধিতা করতে চান তাঁরা যেন একথা বিবেচনায়
রাখেন যে এই সন্ত্রাসবাদ দীর্ঘ সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ নীতির সন্তান। সাম্রাজ্যবাদী
রিজিম চ্যাঞ্জের রণনীতিতে সামিল করে নেওয়া হচ্ছে বহু রাষ্ট্রশক্তিকে, গড়ে তোলা
হচ্ছে প্রাইভেট আর্মি। বর্তমানে সিরিয়ার আসাদ শাসনের অবসানের রণনীতি যে বুমেরাং
হয়ে ফিরে এসেছে সাম্রাজ্যবাদীদের দিকে সে তথ্য সবারই জানা। প্রভু শক্তির দাপটে
মানবতা যখন লাগাতার ভূলুণ্ঠিত হয়, যখন মানবিকতা প্রতিষ্ঠার বিকল্প শক্তি অত্যন্ত
দুর্বল হয়, তখন প্রতিরোধের সংগ্রামে এধরনের বিকৃতি ঘটে বা ন্যস্তস্বার্থই জনমতকে
তাদের পক্ষে টানতে এধরনের বিকৃতি ঘটায়। যাইহউক, সালমান রুশদির বিষয় নিয়ে
সাবেরিদাকে সামিল করার জন্য তাঁর সাথে কথা বলে দেখলাম তিনিও আমাদের মত গণতান্ত্রিক
বিরোধিতার অবস্থানে আবদ্ধ থাকতে আগ্রহী। বৌদ্ধিক চর্চার জন্য সাবেরিদা জেহাদ থেকে
ইসলামের ইজতিহাদকেই (স্বাধীন যুক্তিতর্ক) গুরুত্ত্ব দিতেন বেশী, যদিও তাঁর
বিদ্রোহী সত্তা তাঁকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ইসলামের জেহাদের দিকেই যে আকৃষ্ট করবে
সেটাই স্বাভাবিক। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী চলমান গণ-সংগ্রামের পরিস্থিতিতে ইজতিহাদ ও
জেহাদের মধ্যে আলাপচারিতা চলতে থাকে। ভিন্ন পরিস্থিতিতে জেহাদ যুক্তি মানে না। কিন্তু
যারা বামপন্থাকে চলমান সংগ্রামের সাথে যুক্ত করে দেখতে আগ্রহী নন, যারা
প্রগতিশীলতাকে এক মনোগত বিষয় হিসেবেই ভাবতে অভ্যস্ত তারা শুধুমাত্র আমাদের
বিরোধিতাই করলেন না, সাবেরিদাকে কেন্দ্রে রেখে বহু অপ্রাসঙ্গিক অভিধায় আমাদের
কটাক্ষ করতেও কসুর করলেন না। নিপীড়িতের চলমান সংগ্রামের মধ্যে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখলে
ধার্মিক, নাস্তিক, ধর্মবিরোধী সবাই তাদের নিজ নিজ মতাদর্শ নিয়েও বহু সাধারণ
ক্ষেত্রে ঐক্যবদ্ধভাবে সামিল হতে পারে, সাবেরিদার সাথে আমাদের বন্ধুত্ব ছিল এই
সূত্রে গাঁথা। সাবেরিদার সাথে আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ ক্ষোভও ছিল এই নিয়ে যে সাচার,
রঙ্গনাথ মিশ্র কমিশনের গণতান্ত্রিক সুপারিশগুলো নিয়ে জনমত গঠনে তাঁর কলম ও
উদ্যোগকে খুব বেশী শাণিত করতে দেখা যায়নি।
চাটুকারদের
পাশে ব্যতিক্রম
আমার দেখা সাবেরিদাকে চিত্রায়িত করতে হলে এক তাত্ত্বিক
কাঠামোর আশ্রয় নিতে হয়। স্থিথাবস্থার অভ্যন্তরে ন্যায়-অন্যায়, শুভ-অশুভ,
নিপীড়িত-নিপীড়ক, পরজীবী-শ্রমজীবী, প্রতিষ্ঠান-অপ্রতিষ্ঠান ইত্যাদি বিপরীত শক্তির
প্রবহমান সংঘাত প্রতিটি গোষ্ঠী ও ব্যক্তির চিন্তা-চেতনায় একধরনের দ্বন্দ্ব সৃষ্টি
করে। এই দ্বন্দ্ব যত তীব্র হয় ততই এই স্থিথাবস্থার বেড়াজাল থেকে স্বাধীনতা ও
মুক্তির চাহিদা তীব্র হতে থাকে। চিন্তা-চেতনার এক প্রক্রিয়া এই চাহিদাকে প্রশমিত
করে রাখে, বিপরীত প্রক্রিয়া তাকে চাগিয়ে দেয়। প্রথম প্রক্রিয়ায় আমরা একমাত্রিক
মানুষ, বিপরীত প্রক্রিয়ায় আমরা দ্বিমাত্রিক বা বহুমাত্রিক সংঘাতে অস্থির। সাবেরিদার
অবস্থান ছিল এ দু’য়ের মাঝখানে। তিনি স্থিথাবস্থাকে মেনে নিতে পারতেন না, আবার
ইসলামী আদর্শের অভ্যন্তরে থেকে তাকে বিদ্রোহী পথে পরিচালনা করার দিকেও অগ্রসর হতে
পারতেন না। সেদিক থেকে তিনি বেঁচে ছিলেন বৌদ্ধিক সত্তার ইসলামী ইজতিহাদের মধ্যে,
বিদ্রোহী সত্তার অবদমনের মাধ্যমে আত্মসমর্পণ করে। তাই বলা যায় যে তিনি জামাতে
ইসলামী হয়েও জামাতে ইসলামী নন বা জামাতে ইসলামীর এক নিজস্ব ভিন্ন রূপ। প্রযুক্তি ও
আয়ের কাঠামোয় মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীদের জীবন যাপনের স্বাচ্ছন্দ্যের যে বৃদ্ধি
ঘটাচ্ছে তাতে হুকুমের গোলাম হয়ে, অনৈতিক উপায়ে বা দিনভর একঘেঁয়েমি কাজের মধ্য দিয়ে
আয়বৃদ্ধি সেই বুদ্ধিজীবী শ্রেণির আত্মতৃপ্তি প্রদানের কারক হয়ে উঠছে। কাজের
ক্ষেত্রে তাদের নিজের কোন স্বাধীন সত্তার নিয়ন্ত্রণ না থাকা ও কাজের প্রক্রিয়া
থেকে তাদের মানসিক বিচ্ছিন্নতা সত্ত্বেও এই স্বাচ্ছন্দ্য এই শ্রেণিকে আত্মতৃপ্ত
করে তুলছে। শোষণ-বঞ্চনা ও স্থিতাবস্থা বজায় রাখার জন্য এ বড়ই উপযোগী পরিস্থিতি।
বুদ্ধিজীবী শ্রেণির একমাত্রিক মানুষ হয়ে ওঠার এ এক ভয়ঙ্কর পরিণতি। স্থিতাবস্থার
অবসানে আমাদের প্রয়োজন দ্বিমাত্রিক ও বহুমাত্রিক মানুষ যার অভ্যন্তরিণ সংঘাতে
স্বাধীনতা ও মুক্তির স্পৃহা তীব্রতর হবে, মানুষ হয়ে উঠবে অমানবিক স্থিথাবস্থা
ভাঙার আগ্রহে এক একজন বিদ্রোহী। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে আমাদের সমাজে
সাবেরিদার মত মানুষের খুবই প্রয়োজন যারা অন্তত চাটুকারদের স্বর্গে সুখনিদ্রায়
ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। তাই সাবেরিদার মৃত্যুজনিত শূন্যতা আমাদের পীড়া দেয়। সেই
শূন্যতাকে ভরাট করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার শপথ ছাড়া আর কীভাবে সাবেরিদার মত
বিদ্বজ্জনকে শ্রদ্ধা জানানো যেতে পারে?
(এই সংক্ষিপ্ত নিবন্ধটি লেখার সময় কোন নথি-পত্র বা
তথ্য-সূত্রের আশ্রয় নেওয়া হয়নি, সম্পূর্ণ অতীত পাঠ ও অভিজ্ঞতার স্মৃতি থেকে লেখা,
তাই তথ্যগত কোন ত্রুটি থেকে থাকলে তার সম্পূর্ণ দায় লেখকের)
মাতৃভাষা, রাষ্ট্রভাষা ও রাষ্ট্র – অরূপ বৈশ্য
মানুষের
শ্রমের মাধ্যমে গড়ে উঠছে রকমারি প্রযুক্তি ও সামগ্রী এবং গড়ে উঠছে জটিল সব মানব
সম্পর্ক। তাকে একে অপরের বোধগম্য করার যে প্রধান মাধ্যম তা হচ্ছে ভাষা। সেভাবে
দেখলে ভাষা হচ্ছে মানুষে মানুষে যোগাযোগের মাধ্যম। কিন্তু ভাষা তো শুধু তাই নয়,
ভাষা মনেরও আয়না। অর্থাৎ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর উপলব্ধি, চিন্তা-চেতনা, ধারণা,
উন্নয়নের মান ও বিকাশের স্তর ব্যক্ত হয় ভাষার গঠনে। সেজন্যই মায়ের কাছ থেকে শেখা
প্রথম ভাষাটি গুরুত্ত্বপূর্ণ। ব্যক্তি ও সামাজিক সত্তা হিসেবে বেড়ে উঠার ঊষালগ্নেই
যদি মাতৃভাষার প্রথম সোপানটি কেড়ে নেওয়া হয়, তাহলে তার বিরূপ প্রভাব পড়তে বাধ্য
সামাজিক নিয়মে, দেখা দিতে বাধ্য সামাজিক অস্থিরতা। অঞ্চল, দেশ ও বিশ্বজুড়ে চলছে
সেই ভাষা-রাজনীতির বহুবিধ খেলা যার পরিণতিতে আজ চারিদিকে অসাম্য ও ধ্বংসের তাণ্ডব।
ভাষার বিকাশ ও উন্নয়ন পরস্পর সংম্পৃক্ত। এ’দুয়ের অগ্রগতির সাথে সাথে গড়ে উঠে
জাতীয় চেতনা ও তার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও শাসন প্রণালী যা জন্ম
দেয় জাতিরাষ্ট্রের। গনতান্ত্রিক পথে বিকশিত রাষ্ট্র বহুভাষিক ও বহুজাতিক চরিত্রকে
মান্যতা দিতে বাধ্য। একে বলপূর্বক নাকচ করার প্রচেষ্টা জন্ম দেয় জাতি-সংঘর্ষের ও উগ্রজাতিয়তাবাদের। ফলে বিচ্ছিন্ন
হওয়ার অধিকারের মধ্যেই আত্মমর্যাদা ও আত্মপরিচয় বজায় রাখার একমাত্র পথ খোলা থাকে।
এই বিচ্ছিন্ন হওয়ার অধিকার সাব্যস্ত করতে গিয়েই ভাষিক জাতিয়তাবাদকে ভিত্তি করে
জন্ম নিয়েছে আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশ। রাষ্ট্রের বহুভাষিক – বহুজাতিক
চরিত্র বজায় রাখার প্রাথমিক শর্তই হচ্ছে মাতৃভাষায় পঠন-পাঠন, উচ্চশিক্ষা ও
সরকারি-প্রশাসনিক কাজকর্ম করার অধিকার সাব্যস্ত করা। ফলে রাষ্ট্রভাষা বলে কোন
ভাষাকে জাহির করা মানে অন্য সব ভাষার বিরুদ্ধে মৃত্যু পরোয়ানা জারি করা।
সরকার,
প্রশাসন ও বিচার বিভাগ এককথায় রাষ্ট্রই সবার নাগরিক অধিকারকে সুনিশ্চিত করে। সেজন্যই নাগরিক তালিকায় নাম ওঠানোর প্রশ্ন নিয়ে
আসামের ভাষিক রাজনীতি আজ এতো সরগরম। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ‘এনআরসি’ তৈরি হলে
আসামের নির্বাচনী রাজনীতিতে ‘বিদেশি ইস্যু’র
অন্যতম হাতিয়ারটি চিরতরে ভোঁতা হয়ে যাবে, তাতে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে
সকল নিপীড়িত মানুষেরই মঙ্গল। বাংলাদেশ আসামের প্রতিবেশী রাষ্ট্র হওয়ায় বাঙালিদের
উপরই ঝুলতে থাকে অনুপ্রবেশকারীর খড়গ। নেহেরু-লিয়াকত
ও ইন্দিরা-মুজিব চুক্তির শর্ত ভুলে গিয়ে এই খড়গতে শাণ দেওয়া হয় কখনও বাঙালি
মুসলমানদের বিরুদ্ধে, কখনও বাঙালি হিন্দুদের বিরুদ্ধে। এই বিভাজনের মানসিকতার ফলেই
বরাকের বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজ অসমীয়া আগ্রাসন নিয়ে যতটা স্পর্শকাতর, বাঙালি মেহনতি
মানুষের দুঃখ-দুর্দশা ও উন্নয়ন নিয়ে ততটাই উন্নাসিক। অথচ এই দু’টি বিষয়ই পরস্পর
সম্পৃক্ত, একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটিকে মোকাবিলা করা যায় না। এই পরস্পর
বিচ্ছিন্ন পরিস্থিতির আড়ালে হারিয়ে যায় গণতন্ত্রের মুল মন্ত্র – ‘সবার সমান
অধিকার, সমান মর্যাদা’। আশার কথা এই যে মেহনতি মানুষের মুখে উন্নয়নের নতুন ভাষা
ফুটতে শুরু করেছে, সেটা যখন সবার কর্ণগোচর হওয়ার মত শক্তি সঞ্চয় করবে, তখনই নতুন
আশা সঞ্চারিত হবে, বৌদ্ধিক চর্চার ভাষাও বিকশিত হবে। (ড০ রাজীব কর সম্পাদিত 'উনিশের ডাকে' প্রকাশিত)
0 comments:
Post a Comment