আসাম নির্বাচন ঃ এক ভিন্ন দৃষ্টিকোণ (খসড়া)

Posted by স্বাভিমান

আসাম নির্বাচন ঃ এক ভিন্ন দৃষ্টিকোণ (খসড়া)
(অরুণোদয়ের জন্য, প্রুফ দেখা বাকী)   
অরূপা মহাজন
ইতিমধ্যে আসাম নির্বাচনের দলগত ভোটপ্রাপ্তির পরিসংখ্যান পত্রপত্রিকায় বহুল প্রচারিত হয়েছে। এই পরিসংখ্যান থেকে এব্যাপারটি স্পষ্ট যে দল হিসেবে বিজেপি তার গ্রহণযোগ্যতা বিগত বিধানসভার তূলনায় বহুপরিমাণে বৃদ্ধি ঘটিয়েছে। অন্যদিকে কংগ্রেস মুষ্ঠিমেয় ক’টি আসন বাদ দিয়ে প্রায় সবকটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে শতাংসের হিসেবে যে ভোট লাভ করেছে, তাতে নির্বাচনী রাজনীতির বিচারে কংগ্রেসের ভরাডুবিই বলা যেতে পারে। বিগত বিধানসভা নির্বাচনে ইউডিএফ যে কটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে সেই আসনগুলির বিচারে এবারের নির্বাচনে ইউডিএফ-এর প্রাপ্ত ভোট বেশ ভারী মাত্রায় কমেছে। গতবারের তূলনায় কম আসন ও ভোট প্রাপ্তি ঘটায় এবং ইউডিএফ সুপ্রিমো বদরুদ্দিন আজমল নিজেই পরাজিত হওয়ায় রাজনৈতিক দল হিসেবে ইউডিএফ তার জীবনী শক্তি নিঃশেষ হওয়ার দিকে পা বাড়িয়ে দিয়েছে। বামপন্থী দলগুলির শুকিয়ে যাওয়া এমন স্তরে পৌঁছে গেছে যে নতুন শেকড়ের সন্ধান ছাড়া বামপন্থার পুনরুজ্জীবন কল্পনাতীত। এই পরিপ্রেক্ষিতে রাজনীতিতে ভাজপা’র উত্থান শধুমাত্র সরকারি ক্ষমতা দখলকেই সূচীত করে না, এক বিরোধী রাজনীতির শূন্যতাকেও সূচীত করে। সংঘীয় মতাদর্শ আগামী দিনে এই  শূন্যতাকে যদি পুরোপুরি ভরাট করে নিতে পারে তাহলে আসামবাসীর জন্য অপেক্ষা করে আছে এক ভয়ঙ্কর দিন। আসামে ভাজপা’র উত্থান জাতীয় সংঘীয় রাজনীতিতে যে সার-পানী জুগিয়েছে তাতে তাদের সর্বভারতীয় নেতৃত্বের উৎফুল্লিত হওয়ারই  কথা।
আসামে ভাজপা’র উত্থান দু’টি কঠোর ও আত্মঘাতী সত্যকে সামনে এনেছে। প্রথমত এই নির্বাচনে অসমীয়া শিক্ষিত মধ্যশ্রেণি তাদের আত্মসমর্পণ ও পরাজয়কে নির্লজ্জের মত মেনে নিয়ে উগ্রজাতিয়তাবাদকে পুনরুজ্জীবিত করেছে। দীর্ঘ উগ্রজাতিয়তাবাদী  রাজনীতি জাতি হিসেবে অসমীয়াদের যে প্রভুত ক্ষতি সাধন করেছে, একে একে  বিভিন্ন জনগোষ্ঠী এমনকি জনজাতীয়রাও যখন অসমীয়া পরিচয়ের বাইরে চলে যাওয়ার প্রবণতা দেখাচ্ছে, তখন এই অভিজ্ঞতা হিন্দু শিক্ষিত মধ্যশ্রেণিকে জাতীয় আঞ্চলিকতাবাদের এক গণতান্ত্রিক উন্মেষের কথা ভাবতে বাধ্য করছিল। কিন্তু এই উষালগ্নে অসমীয়া হিন্দু শিক্ষিত মধ্যশ্রেণি উগ্রজাতিয়াতাবাদের পুনরুজ্জীবনের জন্য জাতীয় আঙিনায় এক সহজ আশ্রয় খুঁজে পেয়ে শ্রমজীবী মানুষের দৃষ্টিকোণ থেকে গণতান্ত্রিক জাতিয়বাদী উন্মেষের কঠিন পথ পরিহার করল। অসমীয়া হিন্দু শিক্ষিত মধ্যশ্রেণির এই জাতিধ্বংসী পথ গোটা আসামের জনজীবনে অন্ধকার নামিয়ে আনতে সাহায্য করবে। উল্টোদিকে মানসিকভাবে বিধ্বস্ত ও পরাজিত বাঙালি হিন্দু শিক্ষিত  মধ্যশ্রেণি শুরু থেকেই প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির কাছে আত্মসমর্পণ করে বসেছিল, বহিরাগত ও বিদেশী এই দ্বৈত বয়ানে বিভাজিত বাঙালি সমাজে তারা এক নমনীয় হিন্দুত্বের পথ শুরু থেকেই বেছে নিয়েছিল। অসমীয়া খিলঞ্জিয়া রাজনীতির বিরোধিতা ও পূর্ববঙ্গ থেকে বিতাড়িত হওয়ার দায় মুসলিমদের উপর চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা থেকে মুসলিম বিরোধিতা –এই দু’য়ের টানাপড়েনে জাতীয় ছত্রচ্ছায়ায় খিলঞ্জিয়া শিবিরে আশ্রয় নেওয়াকেই তারা শ্রেয় মনে করল। হিন্দু বহিরাগতদের আশ্রয় দেওয়ার একগুচ্ছ নাটক করে বিজেপি তাদেরকে মানসিকভাবে কাছে টেনে নিল। অনুরূপভাবে অসমীয়া মধ্যশ্রেণিও কৌশলগতভাবে বাঙালি হিন্দু বহিরাগতের অধিকারের প্রশ্নকে মেনে নিয়ে বিজেপি শিবিরে আশ্রয় নেয়। গণতান্ত্রিক বয়ান ও গণতান্ত্রিক শক্তির অভাবে ভাজপা’র এই বিদেশি বিরোধিতা ও খিলঞ্জিয়া অধিকারের আড়ালে মুসলিম বিদ্বেষী রাজনীতিকেই মানসিকভাবে মেনে নিতে বাধ্য হলো পরস্পর বিবদমান দুই ভাষিক জনগোষ্ঠীর শিক্ষিত মধ্যশ্রেণি। মানসিক এই আত্মসমর্পণের পেছনে রসদ জুগিয়েছিলেন ২০১১-এর নির্বাচনের আগে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং তরুণ গগৈ তাঁর ‘হু ইজ আজমল’ ডায়লগের মধ্য দিয়ে। অভিবাসী মুসলিমরা আসামের ক্ষমতা দখল করে নেবে, এই জুজুর ভয়কে কাজে লাগিয়ে কংগ্রেস উজান আসামের বহু আসন জিতে আসে ২০১১ সালে। এবার এই একই জুজুর ভয় অতি সুকৌশলে কাজে লাগিয়েছে ভাজপা, কেন্দ্রে ক্ষমতায় থাকায় এবং মতাদর্শত কারণে ভাজপাই মুসলমানদের রোখার ক্ষেত্রে বেশি গ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। এজিপি’র  অনেকগুলো আসনে বিজয় ও ভোটবৃদ্ধিকে অনেকে আঞ্চলিকতাবাদের অস্তিত্বকে বড় করে দেখেন, কিন্তু আমার মনে হয় বিজেপি-এজিপি আসন সমঝোতা ও হিন্দুত্ববাদী ভোটবেসকে আশ্রয় করেই এজিপি এতগুলো আসন জিততে পেরেছে এবং আঞ্চলিকতাবাদকে জাতীয় হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিতে আত্মস্থ করে নেওয়ার এ এক অন্তর্বর্তীকালীন পর্যায়। এরজন্যই প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক যে হিন্দু শিক্ষিত মধ্যশ্রেণি কংগ্রেস শিবির ত্যাগ করে ভাজপা শিবিরে চলে যাওয়ার পেছনে বস্তুগত ভিত্তি কি ছিল?
পাঠকের নিশ্চয়ই স্মরণে আছে ডিমাপুরের মিথ্যা অভিযোগে এক মুসলিম শ্রমিককে গণপিটুনিতে মেরে ফেলার ঘটনা। এই ঘটনা সম্পর্কে এক নিবন্ধে আমি লিখেছিলাম যে এই ঘটনার পেছনে উজান আসামে সক্রিয় সর্বক্ষণের আরএসএস কর্মীদের দীর্ঘ হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শগত প্রচারের এক গভীর ভূমিকা রয়েছে। এই মতাদর্শগত প্রচার এতোই বিস্তৃত ও সর্বগ্রাসী যে অ-খৃষ্টান নাগা, আদিবাসী্দের মত সম্প্রদায়কেও এই মতাদর্শের ছত্রছায়ায় নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে, কারণ হিন্দু জাগরণের প্রচারকে গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য এর সাথে ব্যাপক জনসেবামূলক কাজও সংঘ পরিবারের রয়েছে। উজান আসামের জনজাতীয়দের মধ্যেও আরএসএস অনুপ্রবেশ খাটো করে দেখার কোনো কারণ নেই। বরাক উপত্যকার ময়নাগড় চা-বাগানে মুসলিম গাড়ী চালককে আদিবাসী যুবকদের পিটিয়ে হত্যা করা, করিমগঞ্জ শহরের জনৈক মুসলিম অধ্যাপককে মারপিট করা, অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামিয়ে মুসলিম লোকদের উপর আক্রমণ, শিলচর মেহেরপুরের মন্দিরে গরুর মাংসের মিথ্যা রটনার মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা, শিলচর রংপুরের অনুরূপ ঘটনা এই সবগুলিই ছিল নির্বাচনী মহড়া। এই মহড়াকে কেন্দ্র করে তৃণমূল স্তরে তপসিলি জাতি, জনজাতি, অবিসিদের মধ্যে হিন্দুত্ববাদী প্রচারে আকৃষ্ট করার জন্য রয়েছে আরএসএস-এর তৃণমূল শাখা ও সংগঠক। কিন্তু এই প্রচারকে জোরের সাথে খণ্ডন করার জন্য ছিল না কোন কংগ্রেসী বা বামপন্থীদের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, এরা সবাই হিন্দু ভোট খোয়ানোর ভয়ে  তোষামোদের রাজনীতি করছিলেন। উপরন্তু কংগ্রেসীরাও হিন্দু-মুসলিম বিভাজনের অঙ্কে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার স্বপ্ন দেখছিলেন এবং দুর্নীতিগ্রস্ত কংগ্রেসী র‍্যাঙ্ক এণ্ড ফাইলের উগ্র-হিন্দুত্ববাদের মতাদর্শগত বিরোধিতা করার মানসিক শক্তিও ছিল না। কংগ্রেসি এই র‍্যাঙ্ক এণ্ড ফাইলের হাতে এক মোক্ষম অস্ত্র তুলে দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ তার শাসনের শেষ বছরে, যখন তার ডানহাত বলে পরিচিত হিমন্ত বিশ্ব শর্মা তাঁকে ত্যাগ করে চলে যান। হিমন্ত বিশ্ব শর্মা চতুর রাজনীতিবিদ হিসেবে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে ও বিজেপি’র পক্ষে জনমতের আঁচ আগেই করতে  পেরেছিলেন এবং সেজন্যই তাঁর শিবির ত্যাগ, কংগ্রেসের সাথে মতবিরোধের প্রশ্ন ছিল গৌণ। শেষ বছরে তরুণ গগৈ বেশ কিছু জনকল্যাণমূলক প্রকল্প ঘোষণা করেন, কিন্তু  দুর্নীতিগ্রস্ত কংগ্রেসি স্থানীয় নেতৃত্ব ও র‍্যাঙ্ক এণ্ড ফাইল এগুলি রূপায়ণ হতে দেয়নি, আর কিছু প্রকল্প ভাজপা’র মদতপুষ্ট এক সংগঠন মামলা দায়ের করে স্থগিতাদেশ দিয়ে আটকে দেয়। এগুলি রূপায়ণ করতে পারলেও কংগ্রেসিরা কিছুটা মাথা তুলে দাঁড়াতে পারতেন।
উন্নয়নের প্রশ্ন এবারের নির্বাচনে এক গুরুত্ত্বপূর্ণ বিষয় ছিল, বিশেষ করে নবপ্রজন্মের মধ্যে। উন্নয়নের প্রশ্নে কংগ্রেস বিরোধী ক্ষোভ ছিল এবং বিজেপি নিজেকে উন্নয়নের রাজনীতির প্রতিভূ হিসেবে নিজেকে জাহির করছিল। জনজাতীয় মুখ্যমন্ত্রী প্রার্থী, জনজাতীয় সংগঠনগুলির সাথে রফা ইত্যাদি জনজাতীয় ভোটকে সমাবেশিত করার ক্ষেত্রে বিজেপি’র পক্ষে কাজে লেগেছে। কিন্তু আমার মনে হয় উন্নয়ন সহ  বাকি প্রশ্নগুলি ছিল মূলত হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির অধীন। ভাজপা’র পক্ষে নির্বাচনী আবেগ তৈরির তুরূপের তাস ছিল হিন্দুত্ববাদ ও বিদেশি মুক্ত আসাম গড়ার শ্লোগানের আড়ালে মুসলিম বিরোধিতা। ভাষিক জাতিয়তাবাদকে যারা বহন করবে সেই নীচুতলার সব জনগোষ্ঠী যখন হিন্দুত্ববাদী শিবিরের দিকে সরে গেছে, তখন শিক্ষিত হিন্দু মধ্যশ্রেণির সর্বভারতীয় প্রভুর কাছে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর থাকে না। নতুন কোনো গণতান্ত্রিক বয়ান তৈরির বৌদ্ধিক ও মানসিক শক্তি হারিয়ে এই শিক্ষিত হিন্দু মধ্যশ্রেণিটি ইতিমধ্যে  দেউলিয়া হয়ে উঠেছে।

এটা পরিতাপের বিষয় যে বুদ্ধি দিয়ে যাদের বোঝার কথা তাদেরকে অভিজ্ঞতা থেকে শিখতে হচ্ছে। ভাজপা’র রাজনীতির মোহভঙ্গ ঘটা স্বাভাবিক, কারণ অপরকে ঘৃণা করার হাতিয়ার দিয়ে মানুষ বেঁচে থাকতে পারে না। মানুষের চাই রুজি-রুটি-রোজগার, উন্নয়ন। ভাজপার উদারবাদী অর্থনীতি মানুষের এই সমস্যার সমাধান করতে পারে না। রাজনৈতিক প্রশ্নেও ভাজপাকে মোকাবিলা করতে হবে অনেক জটিলতা। বাঙালি হিন্দু বহিরাগতদের নাগরিকত্ব, ছয় জনগোষ্ঠীর জনজাতীয়করণ ও চা-শ্রমিকদের মজুরির প্রশ্নে ভাজপাকে মোকাবিলা করতে হবে অভ্যন্তরিণ বিরোধিতা। আসামের রাজনীতি যে অচিরেই আবার অস্থির হয়ে উঠবে সে কথা জোর দিয়ে বলা যায়। কিন্তু শিক্ষিত মধ্যশ্রেণি যদি নতুন করে ভাবতে না শেখে ও দ্রুত বিকল্প রাজনৈতিক বিকল্প গড়ে না উঠে, তাহলে এই শূন্যতা এক অন্ধকারময় অমানবিক পরিস্থিতির জন্ম দেবে।


         

0 comments:

স্বাভিমান:SWABHIMAN Headline Animator

^ Back to Top-উপরে ফিরে আসুন