শ্রমিক শ্রেণির উদ্দেশ্যে বিপ্লবী প্রস্তুতির আহ্বান জানানোর সময় সমাগত
Posted by Labels: অরুণোদয়, মার্ক্সবাদ, শ্রমিক আন্দোলন
(অরুণোদয়
– সম্পাদকীয়)
ভারতীয়
সমাজে অসাম্যের কদর্য চেহারা প্রকাশ করেছেন দুই স্বনামধন্য লেখক। ‘একুশ শতকের পুঁজিবাদ’ গ্রন্থের লেখক থমাস পিকেটি ও তাঁর
সহযোগী লুকাস চ্যান্সেলের “ভারতীয়দের
আয়ের অসাম্য, ১৯২২-২০১৪” শীর্ষক পেপার প্রকাশিত হয়েছে। এই
পরিসংখ্যান দেখায় যে উপরের ১% লোকের আয়বৃদ্ধি দেশ হিসেবে ভারতবর্ষে সর্বোচ্চ এবং
তা ১৯৮২-৮৩ সালের ৬.২% থেকে বেড়ে ২০১৩-১৪ সালে ২১.৭%-এ দাঁড়িয়েছে যা ব্রিটিশ আমলের
সর্বোচ্চ রেকর্ড ১৯৩৯-৪০ সালে ২০.৭% থেকেও বেশি। ১৯৮০-২০১৪ সালের মধ্যে জনসংখ্যার
নীচের ৫০%-এর ৮৯%, তারপরের ৪০%-এর ৯৩%,
জনসংখ্যার উপরের ১০%, ১%, ০.১%, ০.০১%
ও ০.০০১%-এর আয়ের বৃদ্ধি ঘটেছে যথাক্রমে ৩৯৪%, ৭৫০%, ১,১৩৮%, ১,৮৩৪% ও ২,৭২৬%। আশির দশক থেকে আমাদের দেশে যে
উদারবাদী নয়া আর্থিক নীতি চালু হয়েছে এর সাথে এই অসাম্য বৃদ্ধির সম্পর্ক রয়েছে।
অন্যদিকে,
১১৯টি দেশের মধ্যে সমীক্ষা চালিয়ে ‘ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউট’
বিশ্ব ক্ষুধা সূচকের ফল প্রকাশ করেছে।
এতে দেখা গেছে ২০১৪ সালেও বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে গোটা বিশ্বে ভারতের স্থান ছিল ৫৫।
২০১৬-য় সূচক নেমে আসে ৯৭-এ। আরও এক বছরের মধ্যে তা নেমে এল ১০০য়। ব্রিকস-ভুক্ত
দেশগুলির মধ্যে ভারতের স্থান সর্বনিম্ন। যুদ্ধ বিধ্বস্ত ইরাক, কিম জং উনের উত্তর কোরিয়া, প্রতিবেশী নেপাল বা বাংলাদেশের নীচে
নেমে গিয়েছে ভারত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিস্থিতি
আশঙ্কাজনক। ধনী ও ব্যক্তি মালিকদের স্বার্থে রচিত ভারত সরকারের আর্থিক নীতির এ এক
করুণ পরিণতি।
দেশপ্রেম
ও স্বদেশী অর্থনীতির কুচকাআওয়াজের আড়ালে ভারতবর্ষের সরকার কর্পোরেট দুনিয়ার
নির্ধারিত উন্নয়ন মডেল অনুসরণ করে আসছে। ইউপিএ জমানায় উদারনীতি ও কল্যাণনীতির
মধ্যে যে সামান্য টানাপোড়েন ছিল, এনডিএ
জমানায় তা একেবারেই উবে গেছে। আর্থিক সংস্কার কর্মসূচীর জয়গানে দিল্লির ক্ষমতার
করিডোর উল্লসিত। এই উন্নয়ন মডেল ভারতবর্ষের নিজস্ব শিল্প বিকাশের পথকে করেছে
অবরুদ্ধ, কৃষিনির্ভর ভারতীয়
সমাজকে করেছে বিপর্যস্ত।
লেনিন
শিল্প পুঁজি ও বিত্ত পুঁজির (ব্যাংকিং পুঁজি) সম্পর্ক, একচেটিয়া মালিকানা ও পুঁজিবাদের সর্বশেষ রূপ সাম্রাজ্যবাদকে
দেখেছিলেন। কিন্তু বহুবিধ ইনস্ট্রুম্যান্টের মাধ্যমে বিত্ত পুঁজির নিজস্ব বাজারের
এতো ব্যাপক বিকাশ, বিশাল ও মিটিওরিক
স্পিডে বিশ্ববাজারে ঘোরাফেরা করা বিত্ত পুঁজির নিজস্ব বিনিয়োগ অভূতপূর্ব। এই
বিনিয়োগ নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করে না, অথচ
ব্যক্তি মালিক বিনিয়োগকারীদের কাছে জমা হয় মুনাফার পাহাড়। এই মুনাফা আসে বাজারের
মাধ্যমে সাধারণ মানুষের আয়ের অর্থ পুঁজিপতিদের হাতে সঞ্চালিত হওয়ার মধ্য দিয়ে। এই
প্রক্রিয়ার উপর রাষ্ট্র ও সরকারের সমস্ত নিয়ন্ত্রণ কাঠামো ভেঙে দেওয়া হয়েছে। ভেঙে
দেওয়ার এই প্রক্রিয়া শুরু হয় ১৯৭১ সালে মুদ্রার বিনিময় নীতিতে গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড
উঠিয়ে দিয়ে বিশ্ব বাণিজ্যে মার্কিন ডলারের বিশ্ব আধিপত্য সুনিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে
এবং এরপর সবকটি দেশকে তাদের নিজস্ব ফিনান্স সেক্টরের উপর নিয়ন্ত্রণ উঠিয়ে দিতে
বাধ্য করে। বর্তমানে মার্কিন ডলারের বিশ্ব আধিপত্য আবার চ্যালেঞ্জের মুখে। বহুবিধ মুদ্রা
তাদের নিজস্ব আঞ্চলিক বাজারের উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে সচেষ্ট রয়েছে, কিন্তু মূল চ্যালেঞ্জটি আসছে চীনের
কারেন্সি ইউয়ান বা রেনমিনবি থেকে। বিশ্বজোড়া যে এক যুদ্ধের পরিবেশ ও প্রস্তুতি
দেখা যাচ্ছে, তার পেছনে রয়েছে এই
চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিশ্ব আধিপত্য বজায় রাখার আমেরিকান ওয়াল স্ট্রিটের আর্থিক
নীতির ব্যর্থতা।
মানবসভ্যতা
প্রত্যক্ষ করেছে কীভাবে নতুন নতুন প্রযুক্তির আবিষ্কার দেশে দেশে শিল্পদ্যোগ গড়ে
তুলেছে, কীভাবে স্টিম
ইঞ্জিনের আবিষ্কার ভৌগোলিক বাধা অতিক্রম করে জাতিতে জাতিতে যোগাযোগ গড়ে তুলেছে,
কীভাবে মানুষের জন্য কর্মসংস্থান গড়ে
তুলেছে। উৎপাদনের সাথে ক্রমাগত জীবন্ত শ্রমিকের সংযোগ স্থাপন সুনিশ্চিত করেছে
পুঁজির মুনাফা ও সঞ্চয়ন। বিগত কয়েক দশকে প্রযুক্তির দুনিয়ায় অভূতপূর্ব বিকাশ
ঘটেছে। নতুন প্রযুক্তি বিপ্লবের মাধ্যমে অটোমেশনের ফলে শ্রম সংকোচন ঘটছে তীব্র
গতিতে। সাইবারটেনিকসের পর এসেছে রবোটিকস। চালকবিহীন গাড়ি চালু হচ্ছে ও রবোটের
মাধ্যমে বৈদ্যুতিন লাইন মেরামতির মত দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশের
সিটিগুলিতেও এ দৃশ্য আগামী দিনে হয়ত দেখা যাবে।
স্বাধীনতা-উত্তর
ভারতবর্ষে কৃষক বিদ্রোহ বিশেষ করে সত্তরের দশকের কৃষক বিদ্রোহের ফলে ১৯৭২ সালে
জমির সিলিং নিয়ে জাতীয় নির্দেশিকা জারি হয়। ভারতবর্ষে সীমিত হলেও ভূমি সংস্কার
হয়েছে, কৃষি মজুরের উপস্থিতি
বৃদ্ধি ঘটায় বৃহৎ পুঁজিপতিরা পুঁজিবাদী কৃষি ফার্ম গড়ে তোলার ইচ্ছা ব্যক্ত করে
সত্তরের দশকেই, সবুজ বিপ্লবের মাধ্যমে
কৃষিতে যে আধুনিক সরঞ্জামের ব্যবহার শুরু হয় তা বর্তমানে ব্যাপক আকার নিয়েছে,
কৃষি সরঞ্জাম সরবরাহ ও উৎপন্ন সামগ্রী
ক্রয়ের ক্ষেত্রে সরকারি বিনিয়োগ ও অংশগ্রহণ কমে গেছে এবং এই দুই ক্ষেত্রেই ঘটেছে
বহুজাতিক কর্পোরেটদের ব্যাপক অনুপ্রবেশ, রপ্তানিযোগ্য
ক্যাশ ক্রপ উৎপাদনে ও খাদ্য সামগ্রী ছাড়া অন্যান্য কৃষি উৎপাদনেও গুরুত্ব দেওয়া
হয়েছে, কৃষি সামগ্রীর
মূল্যবৃদ্ধি ও সরকারি সহায়তার অভাবে ভাগচাষ হয়ে পড়েছে অলাভজনক, মাঝারি কৃষকদের একাংশ কৃষি ফার্মের দিকে
ঝুঁকছেন ও বড় অংশ কৃষি উৎপাদন থেকে অন্য পেশায় সরে যাচ্ছেন – বরাক উপত্যকার মত পিছিয়ে পড়া অঞ্চলেও এ
প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। চুক্তি প্রথায় চাষের মদত দিচ্ছে বৃহৎ বহুজাতিক কর্পোরেট –
এই প্রবণতা আরও গতি পেয়েছে খুচরা বাজারও
কর্পোরেটদের দখলে চলে যাওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। প্রাকৃতিক সম্পদ, সম্পত্তি ও নির্মাণ সেক্টরে বিশ্বপুঁজির
বিনিয়োগের প্রবণতার সাথে সামঞ্জস্য রেখে ব্যাপক কৃষক ও নগরায়ণের মাধ্যমে শহুরে আন্ডার-ক্লাস
ব্যাপকভাবে উচ্ছেদ হচ্ছেন। এভাবে তৈরি হচ্ছে এক ব্যাপক গ্রামীণ ও শহুরে শ্রমিক
বাহিনী ও প্রব্রজিত শ্রমিক এবং একইসাথে তৈরি হচ্ছে শ্রমিকদের রিজার্ভ আর্মি। এভাবে
বহুবিধ অভ্যন্তরীণ ও বাইরের চাপে বদলে যাচ্ছে উৎপাদনের সামাজিক সম্পর্ক। বহুজাতিক
পুঁজির ও বাজারের উপর নির্ভরশীল জমিদার পুঁজিপতি, কৃষক পুঁজিপতি ও ক্ষুদ্র কৃষক ও ব্যাপক কৃষি মজুর এটাই হচ্ছে
কৃষি ব্যবস্থার প্রধান দিক। প্রতিটি সংকটকালে পুঁজির পুনর্গঠন প্রক্রিয়া চালু হয়।
নয়া উদারবাদী পুনর্গঠনের ফলে সংগঠিত শ্রমিকদের ক্ষেত্র ভেঙে যাচ্ছে, জন্ম নিচ্ছে প্রতিটি অঞ্চল প্রতিটি
জাতির মধ্য থেকে ব্যাপক অসংগঠিত শ্রমিক বাহিনী। এর প্রভাব পড়ছে পরিচিতির
আন্দোলনগুলোতেও।
বিগত
দশকগুলোতে ভারতবর্ষে ও গোটা বিশ্বে যে পরিচিতির আন্দোলন জন্ম নিয়েছিলো সেগুলির
অবস্থা কী? সেই আন্দোলনগুলি
পরিচালিত হচ্ছিল মূলত মধ্যশ্রেণির নেতৃত্বে এবং আম জনতা তাদের আহ্বানে সামিল
হচ্ছিলেন। এই আন্দোলনগুলি এখন ভাঁটার টানে। কিন্তু পরিচিতির গণতান্ত্রিক অধিকারের অন্তর্বস্তুর
নিষ্পত্তি হয়ে যায়নি। এই সংগ্রাম জাগ্রত হবে শ্রমিক শ্রেণির দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ও
শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে।
বহুজাতিক
কর্পোরেট পুঁজির নিয়ন্ত্রণাধীন ভারতীয় অর্থনীতি তীব্র সংকটের মুখে পড়েছে। বিগত
প্রায় তিন দশক থেকে জবলেস গ্রোথের পর্যায় চলছে ক্রমাগত। রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ বৃদ্ধি
করে ব্যক্তি পুঁজির বিনিয়োগকে উৎসাহিত করার মধ্য দিয়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার
সম্ভাবনাও ক্ষীণ,পাবলিক সেক্টর
ব্যাঙ্কে অর্থের যোগান দিয়ে ধার দেওয়ার ক্ষমতা বাড়ানোর সরকারি পদক্ষেপ কতটা
উৎপাদনী বিনিয়োগ বাড়াতে সক্ষম হবে তা সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়। একদিকে ব্যাপক
কর্মহীনতা ও অন্যদিকে ভারতীয় গণতন্ত্রে ভোগ করে আসা যেটুকু সামাজিক নিরাপত্তার ও
আয়ের গ্যারান্টি ছিল তাও হারাচ্ছে কর্মরত শ্রমিক শ্রেণি। উৎপাদনের সাথে জীবন্ত
শ্রমিকের সংযোগ স্থাপনের সুযোগ সংকুচিত হওয়া একদিকে যেমনি পুঁজির সংকট ডেকে এনেছে,
অন্যদিকে শ্রমিক শ্রেণিকেও করে তুলছে
অস্থির। এই অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ছে সমাজ ও রাজনীতিতে। বহুধা বিভক্ত শ্রমিক শ্রেণিকে
ঐক্যবদ্ধ করার ও শ্রমিক শ্রেণির উদ্দেশ্যে বহুজাতিক কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণ থেকে দেশকে
মুক্ত করার বিপ্লবী প্রস্তুতির আহ্বান জানানোর সময় সমাগত।
0 comments:
Post a Comment