গুজরাট নির্বাচন ঃ পুরোনো মৃত্যু শয্যায়, নতুনের জন্ম যন্ত্রণা কী প্রচ্ছন্ন?
(অরুণোদয়, ডিসেম্বর ২০১৭ ঃ
সম্পাদকীয়)
মিডিয়া পণ্ডিতেরা বলেন
‘এন্টি-ইনকাম্বেন্সি বা দীর্ঘম্যাদী ক্ষমতার নেতিবাচক প্রভাব’, আমারা বলি ‘নিগেশন
অব নিগেশন বা নেতির নেতি’। কেন? মাঝখানের ১৮ মাসের জনতা দল শাসন বাদ দিলে ১৯৬০
সালে গুজরাট রাজ্য গঠনের পর থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত গুজরাট রাজ্য শাসনে অধিষ্ঠিত
ছিল কংগ্রেস দল। দীর্ঘ প্রায় ৩৩ বছরের শাসনের পর গুজরাটে বিজেপি’র উত্থানকে ‘এন্টি
ইনকাম্বেন্সি’ বলে যেমনি চালিয়ে দেওয়া যায় না, ঠিক তেমনি এবারের নির্বাচনে
আপাতদৃষ্টিতে অপ্রতিরোধ্য বিজেপি’র গতিরোধকেও এভাবে ব্যাখ্যা করা যায় না। এবারের
গুজরাট নির্বাচনের ফলাফল একদিকে জিগ্নেশ-অল্পেশ-হার্দিকদের এবং মূখ্যতঃ জিগ্নেশদের
স্থিতাবস্থা বিরোধী বিদ্রোহ ও কংগ্রেসি স্থিতাবস্থার রাজনীতির বিপরীতের ঐক্য,
অন্যদিকে সাম্প্রদায়িকতা ও উদারবাদী অর্থনীতির এবং কাল্পনিক গুজরাটি অস্মিতা ও
দেশপ্রেমের সঙ্ঘীয় রাজনীতির বিপরীতের ঐক্যের ইঙ্গিত বহন করে।
বাণিজ্য ও বিভিন্ন উৎপাদনী
উদ্যোগের প্রাধাণ্য থাকা ভারতীয় প্রদেশগুলির মধ্যে গুজরাট অন্যতম। সিন্ধু ও
হরপ্পান সভ্যতা, সমুদ্র বন্দরের সাথে প্রাচীন বাণিজ্য ইত্যাদির যোগসূত্র গুজরাটের
অবস্থানকে বিশেষত্ব প্রদান করেছে। স্বাধীনতা-উত্তর পর্যায়ে দুধ, মশলা, ডায়মণ্ড,
চামড়া, বস্ত্র ইত্যাদি উৎপাদন ও বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বড় বড়
প্রতিষ্ঠান। ব্যাপক দুগ্ধ কো-অপারেটিভগুলির সাথে যেমন কৃষক সম্প্রদায়ের যোগসূত্র
রয়েছে, ঠিক তেমনি বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগ রয়েছে বিভিন্ন
জনগোষ্ঠীর। এই প্রতিষ্ঠানগুলির পরিচালকদের মাধ্যমে জনগণের সাথে যোগসূত্র বজায় রেখে
এই অর্থনৈতিক ভিত্তির এক ভারসাম্যের নীতির মাধ্যমেই কংগ্রেস ১৯৬০-১৯৯৫ এই দীর্ঘ
কালপর্যায়ের শাসন বজায় রেখেছে। ১৯৬৯ সালে মোরারজী দেশাই ও ইন্দিরা গান্ধীর
নেতৃত্বে কংগ্রেসে ভাঙনের পর্যায়ে গুজরাটের সমাজে আরএসএস’র গভীর সাংগঠনিক
অনুপ্রবেশ ঘটে এবং ১৯৬৯ সালের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে গুজরাটে ব্যাপক সাম্প্রদায়িক
দাঙ্গা সংগঠিত হয়। ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বরে মূল্যবৃদ্ধি ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে
নবনির্মাণ আন্দোলন, ১৯৭৫ সালের মার্চে মোরারজি দেশাই’র অনির্দ্দিষ্ট কালের অনশন ইত্যাদি
ঘটনা প্রবাহের প্রেক্ষিতে ১৯৭৫-এর জুনের নির্বাচনে কংগ্রেস ৭৫ আসনে নেমে আসে, ১৬৭
জনের পূর্ববর্তী বিধান পরিষদে কংগ্রেসের প্রতিনিধি সংখ্যা ছিল ১৪০। জরুরি অবস্থার
পর ১৯৮০ সালের নির্বাচনে ইন্দিরা কংগ্রেস পুনরায় ক্ষমতায় চলে আসে।
এর পরবর্তী পর্যায়েই ভারতীয়
সমাজ – অর্থনীতি ও রাজনীতিতে ভারসাম্য ভাঙতে শুরু হয়। মণ্ডল-কমণ্ডলে সামাজিক আলোড়ণ ও নয়া উদারবাদী
অর্থনীতির দিকে ঝোঁক শিখর বিন্দুতে পৌঁছে বাবরি মসজিদ ভাঙা ও মনমোহন সিংহের আর্থিক
সংস্কার কর্মসূচী ঘোষণার মধ্য দিয়ে। এই ভারসাম্য ভাঙার শূন্যস্থান দিয়েই উত্থান
ঘটে বিজেপি ও সংঘ পরিবারের। স্থিতাবস্থার প্রতি জনগণের নেতি ঘোষিত হয় এক
প্রতিক্রিয়াশীল পথে। ১৯৯৫ সালে কেশুভাই প্যাটেলের নেতৃত্বে গঠিত হয় গুজরাটে
বিজেপি’র সরকার। তারপর দীর্ঘ ২২ বছর সংঘ পরিবারকে আর পেছন পানে তাকাতে হয়নি। ২০১৭
সালে এবারের নির্বাচনে গুজরাটের জনগণ দিয়ে দিল আরেক নেতি’র বার্তা, যা শিখর বিন্দু
ছুঁতে পারেনি দেশব্যাপী এক গণতান্ত্রিক বিকল্প রাজনীতির অনুপস্থিতিতে। কী ছিল এই
নির্বাচনের বৈশিষ্ট্য?
‘হার্দিক ফ্যাক্টর’ বা
পাতিদার আনামত আন্দোলন এবারের নির্বাচনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। ১৮০০
শতিকা পর্যন্ত পাতিদাররা শূদ্র বর্ণ হিসেবে বিবেচিত হতো। ব্রিটিশ রায়তওয়াড়ি
ব্যবস্থার মাধ্যমে খাজনা বাড়ানোর লক্ষ্যে পাতিদারদের জমি দেওয়া হয় এবং তারা
জমিমালিক কৃষিসমাজে পরিণত হয়। ১৮৬০ সালে বরোদার রেল লাইন নির্মাণের মাধ্যমে তূলা,
তামাক, তেলবীজ উৎপাদন ও রপ্তানীর মাধ্যমে পাতিদারদের একাংশ সম্পদশালী হয় এবং
বিদেশেও পাড়ি দেয়। আমেরিকার প্রতি দশ জন ভারতীয়দের মধ্যে একজন প্যাটেল এবং মোটেল
ব্যবসার জন্য এই প্যাটেলরা বিখ্যাত। রাজনৈতিকভাবে প্যাটেলরা প্রভাবশালী শক্তি হয়ে
পড়ে ভল্লবভাই প্যাটেল উপ-প্রধানমন্ত্রী ও
গৃহ মন্ত্রী থাকার সময় থেকে। প্যাটেল সমাজের অভ্যন্তরিণ অসাম্য ও শ্রেণি বিভাজন
উল্লেখনীয়ভাবে বৃদ্ধি ঘটে। জবলেস গ্রোথের মাধ্যমে ব্যাপক শিক্ষিত বেকার যুবকদের
ক্ষোভের উপর ভিত্তি করে ১৯৮৫ সালে প্যাটেলরা অবিসি সংরক্ষণ বিরোধী আন্দোলন গড়ে
তোলে যাতে মদত যোগায় সঙ্ঘ পরিবার। কিন্তু ১৯৯০ থেকে কৃষি বিপর্যয়, সরকারি
বিনিয়োগের অভাব ও জবলেস গ্রোথ অশিক্ষিত বা অর্ধ-শিক্ষিত মজুরবাহিনী ও
জমি-মালিকদেরও অস্থির করে তুলে। উদার অর্থনীতির দাপটে জনগণের সাথে যোগসূত্রের
পুরোনো ব্যবসায় ও উদ্যোগকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠানগুলিও চাপের মুখে পড়ে। রপ্তানি
বাণিজ্যে মন্দা এই পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলে। ১৯৯৫ সালের মন্ত্রীসভায়
প্যাটেলদের প্রতিপত্তিশালী অংশের প্রতিনিধিদের থেকে অনেককে মন্ত্রী বানিয়ে প্যাটেল
সমাজের অভ্যন্তরিণ ক্রমবর্ধমান এই ক্ষোভকে ম্যানেজ করার চেষ্টা হয়। এই প্রচেষ্টাকে
আরও সুসংহত রূপ দেওয়া হয় ২০০২-এর দাঙ্গা ও মেরুকরণের রাজনীতির মাধ্যমে। কিন্তু
১৯৯৫ সাল থেকে উদারবাদী মডেলের দীর্ঘ জবলেস গ্রোথ পরিক্রমা, উচ্চশ্রেণির বিলাসের
আকাঙ্খাকে মাথায় রেখে নগরায়ণ, কৃষি বিপর্যয়, পুরোনো উৎপাদনী আর্থিক কাঠামো ভেঙে
পড়া, সস্তা মজুর বাহিনীর আবির্ভাব স্থিতাবস্থার ভারসাম্যে ধরিয়েছে ফাটল, পাল্টে
দিয়েছে জাতি-বর্ণগত আকাঙ্খার স্বরূপ। অভ্যন্তরিণ এই রসায়নই প্যাটেল সমাজের নীচের
অংশকে তাড়িত করে অন্যান্য অ-প্যাটেল অবিসি ও দলিতদের সাথে হাত মেলাতে, সংরক্ষণ
বিরোধী অবস্থান থেকে সরে এসে সংরক্ষণের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তুলতে। এই আকাঙ্খাকে
প্রতিফলিত করতেই নীচু শ্রেণির প্যাটেলদের নেতা হিসেবে হার্দিক প্যাটেলের আবির্ভাব।
বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও নয়া উদারবাদী অর্থনীতির সামনে এই নতুন শ্রেণি
ডায়মেনশনকে শক্ত হাতে প্রতিহত করা ছাড়া বিজেপি’র আর কোনো উপায় ছিল না। গুজরাট
সরকারের অত্যাচার পাতিদার আন্দোলনকে করে তুলে আরও আপোসহীন। স্থিতাবস্থার বিরুদ্ধে
এই বিদ্রোহের সবচাইতে বিকশিত রূপ চোখে পড়ে জিগ্নেশের নেতৃত্বে দলিত আন্দোলনে,
যেখানে ঐক্যের আহ্বান সঙ্ঘ পরিবারের একেবারে বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে ধর্মীয়
সংখ্যালঘুদেরও এক করে নেয়। জিগ্নেশদের এই র্যাডিক্যাল অবস্থান নিতে পারার আসল
শক্তি লুকিয়ে আছে দলিত আন্দোলনে শ্রমিক শ্রেণির ব্যাপক উপস্থিতি ও শক্তি, যা
হার্দিক – অল্পেশদের ক্ষেত্রে এতোটা শক্তিশালী নয়। হার্দিক-অল্পেশদের সমাবেশকে
প্রভাবিত করতে জমিমালিক ও ব্যবসায়িক শ্রেণির উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। এই শ্রেণি
কৃষি বিপর্যয়, বিমূদ্রাকরণ ও জিএসটি’র আঘাতে বিজেপি’র উপর ক্ষেপে ছিল। কিন্তু
শ্রেণি হিসেবে তাদের দোদুল্যমান অবস্থানের ফলেই মোদী-শাহ নেতৃত্বের ‘গুজরাটি
অস্মিতা’ ও সাম্প্রদায়িক আহ্বানে সাড়া দিয়ে তাদের এক বড় অংশ শেষ মুহূর্তে বিজেপি’র
দিকে ঝোঁকে পড়ে।
স্থিতাবস্থার অভ্যন্তরে
বিজেপি বিরোধী ক্ষোভ ও স্থিতাবস্থার বাইরে বেরিয়ে আসার প্রবণতা নিয়ে বিদ্রোহ - এই
দু’য়ের জটিল সংমিশ্রণ ঘটানোর রণনীতি নিয়ে এগোয় কংগ্রেস এবং সেজন্যই
উচ্চশ্রেণি-বর্ণকে আকৃষ্ট করতে রাহুল গান্ধীর মন্দির পরিক্রমা।
গুজরাট নির্বাচনের ফলাফল
ভারতীয় পরিস্থিতিতে এক নতুন মোড় নেওয়ার ইঙ্গিত। এই ইঙ্গিত স্থিতাবস্থা বজায় রেখে
কংগ্রেসের দিকে নিঃশব্দে ঘুরে যাওয়া বা স্থিতাবস্থা ভেঙে দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয়
বিদ্রোহের দেশব্যাপী বিকাশ অথবা এ দু’য়ের পরাজয়ে ফ্যাসীবাদের উত্থানের দিকে আমাদের
দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বিপ্লবী শক্তির সক্রিয় অংশগ্রহণে স্থিতাবস্থা ভাঙার দেশব্যাপী
বিদ্রোহের জন্য আমরা অপেক্ষা করে থাকব।