জাতীয়তাবাদী শিবিরের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবি – কিছু কথা

Posted by স্বাভিমান Labels: ,



।। অরূপ বৈশ্য।।


     
আমার অসম, ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮
  জা
তীয়তাবাদী শিবির থেকে আসামের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্ন পুনরায় উত্থাপিত হলো। ২৫ ফেব্রুয়ারি আমার অসম পত্রিকায় প্রকাশিত এক সংবাদ এই তথ্য পরিবেশন করে। সংবাদ শিরোনামে বিশিষ্ট লেখক অদীপ ফুকনের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন ভারতীয় রাষ্ট্রের অতি-কেন্দ্রিক ব্যবস্থা এক মহাকেন্দ্রিক ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে। ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের মাধ্যমে ভারতীয় রাজনীতি ও অর্থনীতিতে যেটুকু বিকেন্দ্রীকরণের ব্যবস্থা কায়েম করা হয়েছিলো তা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ছে। পরিস্থিতিটা যদি এমন হতো যে অসমীয়া উৎপাদক ও ব্যবসায়ীরা তাদের উৎপাদ ও পরিষেবা নিয়ে সর্বভারতীয় বাজারের অংশগ্রহণকারী
, এই বাজারের চাহিদা অনুযায়ী অন্যান্য ভাষা-সংস্কৃতির ভাবের আদান প্রদানের জন্য অনুষ্ঠান প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে এবং এগুলির জন্য কেন্দ্রীয় পরিচালনা প্রয়োজন, তাহলে কেউ কেন্দ্রীভবনের বিরোধিতা করত না। অসম বিকাশ পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে অন্তর্নিহিত, আন্তর্জাতিক ও জাতীয় স্তরে এটাই বাস্তব সত্য। এই বাস্তবতায় অনুন্নত দেশ/জাতি/অঞ্চল থেকে উন্নত দেশ/জাতি/অঞ্চলের দিকে পুঁজি ও সম্পদের বহির্গমন হতে থাকে। উত্তরোত্তর ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন এই অসাম্যকে বৈধতা প্রদান করে ও অনুন্নত দেশ/জাতি/অঞ্চলের মৃত্যু পরোয়ানা ঘোষণা করে। উপনিবেশিক ও উত্তর-উপনিবেশিক কাঠামোয় উন্নয়নের অসম বিকাশের যে পরিবেশ গড়ে উঠেছে, সেই পরিবেশে দিল্লিতে ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন ছিল অন্তর্নিহিত। এই অসাম্যকে কমিয়ে আনতে প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় আয়োজন ও ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ। কেন?

            ধরুন রাম ও রহিমের মধ্যে দৌড় প্রতিযোগিতা হবে (বাজার মানেই প্রতিযোগিতা)। অথচ রহিম খোঁড়া। পরিচালকমণ্ডলি অনেক হিসেব নিকেশ করে ঠিক করলেন, রহিম একপায়ে সাইকেল চালাবে ও রাম দৌড়াবে। ধরে নিন এটা একটা জুতসই বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থা। এবার সমানে সমানে প্রতিযোগিতা হবে। কিন্তু পরিচালকমণ্ডলীতে যদি সবাই রামের প্রতিনিধি থাকে তাহলে এই বৈজ্ঞানিক যুক্তি না মানারই সম্ভাবনা বেশি এবং রামের জয় ও রহিমের পরাজয় পূর্বনির্ধারিত। এভাবে নিরন্তর চলতে থাকবে ও এক সময় রহিম আর প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া থেকে বিরত থেকে না খেয়ে মরবে। অর্থাৎ সুষ্ঠু প্রতিযোগিতার জন্য প্রয়োজন একটি পরিচালকমণ্ডলী ও পক্ষপাতহীন ব্যবস্থার জন্য সবার অংশগ্রহণ। অর্থনীতির ক্ষেত্রে এধরনের নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ও ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ। নয়া অর্থনীতির প্রবক্তারা পুঁজির উপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের বিরোধী, বরঞ্চ এই অর্থনীতিতে পুঁজি সম্পূর্ণভাবে রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করবে। লগ্নি পুঁজির দাপট, উৎপাদন ও সম্পদের ব্যক্তি মালিকানা, শ্রমের অস্থায়ীকরণ ও স্তরীভবন ইত্যাদি হচ্ছে নয়া-উদারবাদী অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য। তাই বিনিয়োগকারীদের আকর্ষিত করতে সস্তা শ্রম, সস্তা প্রাকৃতিক সম্পদ, সস্তা মানির বন্দোবস্ত করার দায়িত্ব নিয়েছে সরকার। বেসরকারিকরণ চলছে দ্রুতগতিতে, শ্রমিক সুরক্ষার আইন বদলাচ্ছে, জনগণের অর্থ এমনকি পেনশন ফাণ্ডও ব্যক্তি মালিকদের হাতে চলে যাওয়ার বন্দোবস্ত হচ্ছে। প্রয়োজন পড়েছে সর্বভারতীয় সমসত্তাবিশিষ্ট বাজার নির্মাণ। ক্ষমতার কেন্দ্রীভবনের পেছনে এটাই হচ্ছে চালিকাশক্তি, তথাকথিত দেশপ্রেমের সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের পেছনে রয়েছে সর্বভারতীয় সমসত্তাবিশিষ্ট বাজার নির্মাণের তাগিদ। আর্থিক ও সাংস্কৃতিক এই এজেণ্ডাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে রাষ্ট্রীয় আয়োজনের পক্ষে জনমত নির্মাণের জোর আয়োজন চলছে। বৈচিত্র্যকে ধ্বংস করে দিতে তথাকথিত হিন্দু সংস্কৃতির জয়গানের পেছনে এটাই আসল রহস্য। ভাষা যেহেতু ধর্মের গণ্ডি অতিক্রম করে যায় ও বৈচিত্র্য ভাষা বিকাশের প্রাণশক্তি, তাই হিন্দুত্ব সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের সাথে যুক্ত রয়েছে ভাষিক আগ্রাসন বা ভাষার প্রাণহীন একমুখীন ধর্মীয় রূপান্তর।
         অসমীয়া জাতিয়তাবাদী শিবির থেকে পুনরুত্থাপিত পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবি ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের বিরুদ্ধে একটি সময়োচিত দাবি। অসমীয়া মধ্যশ্রেণি কেন্দ্রীকতার বিপদ সম্পর্কে শঙ্কিত। কিন্তু অসমীয়া জাতিয়তাবাদী কূপমণ্ডূকটা (বাংলার ক্ষেত্রে বাঙালি কুপমণ্ডূকতা ইত্যাদি) তাদেরকে কেন্দ্রীকতার ফলে সামগ্রিক বিপর্যয়ের পরিণতি দেখতে অপারগ করে তুলে। তাই অভ্যন্তরীণ অনা-অসমীয়া জনগোষ্ঠীদের সাথে ক্ষমতা ও সুযোগ সুবিধা ভাগ করে নেওয়ার ব্যাপারে এই মধ্যশ্রেণি অত্যন্ত স্পর্শকাতর। জাতীয়তাবাদী শিবিরের এই অবস্থানই তাদেরকে কেন্দ্রীভবনের আগ্রাসী শক্তির লেজুড়ে পরিণত করে ও আসামকে ঠেলে দেয় বিপর্যয়ের মুখে। কেন্দ্রীভবনের সামাজিক-আর্থিক-রাজনৈতিক শক্তিকে পরাস্ত করার একমাত্র পূর্বশর্ত হচ্ছে আসামের বহুভাষিক বহু পরিচিতিগত জনগোষ্ঠীগুলোর ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে বৈচিত্র্যকে ও ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের প্রশ্নকে অস্বীকার করে বৈচিত্র্যের উপর আঘাত ও কেন্দ্রীকতার সর্বভারতীয় প্রক্রিয়াকে প্রতিহত করা যায় না। নীতিগতভাবে না হলেও যুদ্ধ জয়ের কৌশল হিসেবেও জাতিয়তাবাদী শিবির যদি এই বাস্তব উপলব্ধি করতে পারেন তাতেই মঙ্গল। অন্যথায় আসামবাসীর সামুহিক ধ্বংস কেউ রুখতে পারবে না। 

কোরাসের উদ্যোগে ঝুমুর উৎসব

Posted by স্বাভিমান Labels: , , ,

অরূপ বৈশ্য 

(মুখবন্ধ ঃ বরাক উপত্যকাভিত্তিক ঝুমুর ও কাঠিনাচ প্রতিযোগিতা বিগত কয়েক বছর ধরে বরাক উপত্যকার বিভিন্ন বাগানে অনুষ্ঠিত করে আসছে কোরাস সাংস্কৃতিক সংস্থা। বড়শিঙ্গা, নারাইছড়া, ডলু, দেওয়ান ইত্যাদি বাগান হয়ে এবার অনুষ্ঠিত হলো কালাইন বাগানে। প্রতিবারই তার সফল রূপায়ণ হচ্ছে ও চা-বাগানের ঝাড়খণ্ডী আদিবাসী চা-শ্রমিকদের উত্তরোত্তর আগ্রহ বাড়ছে। এই সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সফল রূপায়ণ করতে  কোরাসের সদস্যদের কঠোর মানসিক ও শারীরিক শ্রম করতে হয়। কোরাস যেহেতু সরকারি, রাজনৈতিক ও কোনো বহুজাতিক বাণিজ্যিক কোম্পানীর আর্থিক সাহায্য নেয় না, তাই কোরাসের সদস্যদের এই প্রোগ্রামের জন্য ক্ষুদ্র চাঁদা সংগ্রহ করতে হয়, সংগ্রহ করতে হয় বাড়ি বাড়ি ঘুরে শুভাকাঙ্খীদের অনুদান। একটা বড় অনুষ্ঠানের প্রস্তুতিপর্বে ও  আয়োজনে প্রয়োজনীয় সবকিছুর ব্যবস্থা করতে হয় কোরাসের সদস্যদের যৌথ উদ্যোগে। এবারে কালাইনের অনুষ্ঠানেও এর ব্যতিক্রম হয় নি। তবে এতো বিশাল আয়োজন কোরাসের একার পক্ষে সম্ভব হতো না, যদি না বাগান-শ্রমিকরা তাদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন, অনুষ্ঠান পরিচালনায় সর্বতোভাবে সহযোগিতা করতেন।)
  
প্রতিবছরের ন্যায় অসম মজুরি শ্রমিক ইউনিয়ন ও কালাইন বাগান শ্রমিক প্রতিনিধিদের ব্যবস্থাপনায় ঝুমুর কাঠিনাচ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হলো ১৮ ফেব্রুয়ারী রবিবার, ২০১৮ তারিখে কালাইন বাগান ১২ নং মাঠে। শ্রমিক ও চা-বাগানের মানুষদের উপস্থিতি ও অংশগ্রহণ ছিল ব্যাপক। এই ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করতে গিয়ে কোরাসের সদস্যদের অনেক পরিশ্রম করতে হয়। বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাঁদা তোলা থেকে অনুষ্ঠানের সমস্ত আয়োজন করতে হয় কোরাসের সদস্যদেরই। এবারের অনুষ্ঠানে কালাইন বাগানের শ্রমিকরা ও স্বেচ্ছাসেবকরা গোটা অনুষ্ঠানকে সামলেছেন ও অতিথি আপ্যায়ন করেছেন অত্যন্ত যত্ন সহকারে এবং নিজেদের শ্রম ও কস্টার্জিত সামান্য আয় থেকে সবার যৌথ অবদানের মাধ্যমে। এদিক দিয়ে এই অনুষ্ঠান সফল। কিন্তু এই অনুষ্ঠানের সুদূর প্রসারী প্রভাব সুনুশ্চিত করতে হলে, আমাদের ভাবতে হবে সংস্কৃতি চর্চার সামগ্রিকতা নিয়ে।

সংস্কৃতি মানে গোটা জীবন চর্চা। একটি জনগোষ্ঠীর আচার-অনুষ্ঠান, রীতি নীতি, খাদ্যাভাস, বেশভূষা, ভালবাসা, প্রেম পিরীতি সবকিছুই সংস্কৃতির অঙ্গ। সংস্কৃতি চর্চার একটি প্রধান উপাদান হচ্ছে ভাষা। ভাষা হচ্ছে গোটা জীবন চর্চার বিমূর্ত প্রকাশ। মানুষ পৃথিবীতে বাস করে এক নির্দিষ্ট সামাজিক সম্পর্কে। এই সামজিক সম্পর্কের পরিধিতে নিরন্তর চলমান সংঘাত ও সহাবস্থান নির্ধারণ করে দেয় একেকটি জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি। এই আবর্তে সচেতন সাংস্কৃতিক চর্চার প্রয়োজনীয়তা কোথায়? কীভাবেই বা নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর নিজস্ব সংস্কৃতি চর্চার সাথে সচেতন সাংস্কৃতিক উদ্যোগ যোগসূত্র স্থাপন করে?

ধরা যাক চা-শ্রমিকরা সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিল ৩৫০ টাকা মজুরি না দিলে বাগানে কাজ করবে না। মালিক ও শ্রমিকের সম্পর্কের মধ্যে এই সংঘাতের পথে টিঁকে থাকার লড়াইয়ের প্রভাব তাদের শরীরী ভাষায়, মুখের ভাষায়, সামাজিক কথোপকথনে, জোটবদ্ধতায়, নাচে-গানে, আচার-অনুষ্ঠানে পড়বে। অন্যদিকে ধরা যাক মালিক ঘোষণা করল যে নিরিখ বাড়িয়ে ২৫ কেজি করতে হবে। শ্রমিকরা মেনে নিতে বাধ্য হলো। এই সমঝোতার ফলে শ্রমিকদের পরিশ্রম করতে হয় বেশি, বর্ধিত শারীরিক ও মানসিক কষ্টকে লাঘব করতে আত্মসমর্পণ করতে হয় ভগবানের কাছে, নেশার কাছে, বাজারি বিনোদনের কাছে, সামাজিক-রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক ক্ষমতাবান ও সর্বশক্তিমানদের কাছে। ঠিক অনুরূপভাবে ভাল পাঠশালা, উপযুক্ত শিক্ষক, মাতৃভাষায় ও বিনামূল্যে পাঠদানের অধিকারের আদায়ের লড়াই এক সংস্কৃতি চর্চার জন্ম দেয়, আবার এই পরিস্থতিতিকে মেনে নিলে আত্মসমর্পণ করতে হয় দেবী সরস্বতীর কাছে, ক্ষমতাবানদের কাছে। অর্থাৎ একদিকে প্রতিবাদী সংস্কৃতি ও অন্যদিকে আত্মসমর্পণ বা স্থিতাবস্থার সংস্কৃতি এই দু’য়ের সংঘাত চলতে থাকে নিরন্তর বিভিন্ন রূপে এবং একটি নির্দিষ্ট সময়ে একটি ধারাই আধিপত্য বিস্তার করে থাকে। চলমান এই সংঘাতের ফাটল দিয়েই অনুপ্রবেশ ঘটে সচেতন প্রগতিশীল বা প্রতিক্রিয়াশীল সংস্কৃতি চর্চার, এবং দু’য়ের টানাপোড়েন চলতে থাকে সাংস্কৃতিক আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে। সংস্কৃতির কোন ধারা আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হবে তা ইতিহাস নির্ধারিত হলেও ইতিহাসকেও প্রভাবান্বিত করে নির্দিষ্ট সামাজিক সম্পর্ককে তুলে ধরার এবং এই সম্পর্কে নিহিত প্রগতিশীল সামাজিক শক্তিকে এক করার বা বিভাজিত করার সাংস্কৃতিক প্রয়াস।

চা-শ্রমিকদের ক্ষেত্রে বর্তমান সামাজিক সম্পর্কের স্বরূপ কি? ঝাড়খণ্ডী-আদিবাসী-চা শ্রমিকদের এলাকা চা-বাগানগুলির পাশেই অন্যান্য ছোট বড় বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর বাস। তাদের পড়শি বাঙালিদের সাথে সামাজিক সম্পর্কের অবস্থানটা দেখা যাক। তাদের পাশের গ্রামেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর্মরত অনেক শ্রমিক আছে যারা তাদের মতই কম মজুরি পায়, অনেক মহিলা শ্রমিক আছে যাদের মাসিক আয় বাগানের মহিলা শ্রমিকদের চেয়েও কম। গ্রামগুলিতে পুরোনো অনেক স্বচ্ছল পরিবার অনিয়মিত আয়ের শ্রমিকে রূপান্তরিত হয়েছে। আবার এই গ্রামাঞ্চলে মাস্টার-ডাক্তার-বাবু-কেরাণী ইত্যাদি মানসিক শ্রমে নিযুক্ত শ্রমিকদের দেখা পাওয়া যায়, যা প্রায় দেখাই যায় না চা-বাগানে। মানসিক শ্রম থেকে চা-শ্রমিক পরিবারদের দূরে সরিয়ে রাখার দু’টি প্রধান হাতিয়ার হচ্ছে মাতৃভাষায় পঠন পাঠনের সুযোগ ও তপশিলি জাতি/জনজাতির অধিকার না দেওয়া। চা-বাগানের কচিকাঁচাদের স্কুল ছুটের হার বেশি হওয়ার একটি অন্যতম কারণ ঘরের মায়ের মুখের ভাষার সাথে বিদ্যালয়ের শিক্ষকের মুখের ভাষার দূরত্ব। ঠিক তেমনি ১৯৫২ সালে তপশিলি জাতি/জনজাতির স্বীকৃতি উঠিয়ে দেওয়ার ফলে যে কতিপয় যুবক যুবতীরা কিছুটা পড়াশুনা করেছে তারাও মানসিক শ্রমের সাথে যুক্ত হতে পারেনি, তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক প্রতিনিধি নির্বাচনেও এই জনগোষ্ঠী ব্যর্থ হয়েছে। এটা হচ্ছে জনগোষ্ঠীগত বঞ্চনার দিক। কিন্তু শ্রমিক হিসেবে বঞ্চনার এক সর্বজনীন রূপও চা-বাগান শ্রমিকদের আশপাশে বিরাজ করছে এবং এই সর্বজনীন রূপ দেখিয়ে দিচ্ছে সামাজিক সম্পর্কের আরেক বাস্তবতা যার অভ্যন্তরে বাগান ও গ্রামের মানুষ প্রতিনিয়ত ভাবের আদান প্রদান করছে। এই সম্পর্কে ফাটল ধরালে প্রতিক্রিয়াশীল সংস্কৃতির লাভ, সম্পর্ককে সুদৃঢ় করে বৃহত্তর ঐক্য প্রগতিশীল সংস্কৃতির ভিত্তি।

প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক চর্চাকে মানুষের প্রতিবাদী সক্রিয়তার সাথে সচেতনভাবে যুক্ত করতে হবে, বাস্তব সামাজিক সম্পর্কের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ মেহনতি মানুষের সর্বজনীন ঐক্যের অন্তর্বস্তু থাকা সাংস্কৃতিক বয়ান তৈরি করতে হবে।

প্রগতিশীল বা প্রতিক্রিয়াশীল উভয়ের আবেগ নিহিত থাকে বাস্তব সামাজিক সম্পর্কে। বাস্তব সম্পর্কের গর্ভ থেকে তাকে আহরণ করে মহৎ বা ধ্বংসাত্মক বয়ান নির্মাণ করা যায়। এই আবেগকে বুঝতে হবে। প্রতিক্রিয়াশীলদের মদতে রয়েছে রাষ্ট্র, বাজার ও তার বিভিন্ন অনুষ্ঠান-প্রতিষ্ঠান, প্রগতিশীলদের দরকার বাস্তবতা বোঝার যৌথ কঠোর সচেতন প্রয়াস ও চর্চা।          

স্বাভিমান:SWABHIMAN Headline Animator

^ Back to Top-উপরে ফিরে আসুন