অরূপ বৈশ্য
(মুখবন্ধ ঃ বরাক
উপত্যকাভিত্তিক ঝুমুর ও কাঠিনাচ প্রতিযোগিতা বিগত কয়েক বছর ধরে বরাক উপত্যকার
বিভিন্ন বাগানে অনুষ্ঠিত করে আসছে কোরাস সাংস্কৃতিক সংস্থা। বড়শিঙ্গা, নারাইছড়া,
ডলু, দেওয়ান ইত্যাদি বাগান হয়ে এবার অনুষ্ঠিত হলো কালাইন বাগানে। প্রতিবারই তার সফল
রূপায়ণ হচ্ছে ও চা-বাগানের ঝাড়খণ্ডী আদিবাসী চা-শ্রমিকদের উত্তরোত্তর আগ্রহ বাড়ছে।
এই সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সফল রূপায়ণ করতে কোরাসের সদস্যদের কঠোর মানসিক ও শারীরিক শ্রম
করতে হয়। কোরাস যেহেতু সরকারি, রাজনৈতিক ও কোনো বহুজাতিক বাণিজ্যিক কোম্পানীর
আর্থিক সাহায্য নেয় না, তাই কোরাসের সদস্যদের এই প্রোগ্রামের জন্য ক্ষুদ্র চাঁদা সংগ্রহ করতে হয়, সংগ্রহ করতে
হয় বাড়ি বাড়ি ঘুরে শুভাকাঙ্খীদের অনুদান। একটা বড় অনুষ্ঠানের প্রস্তুতিপর্বে ও আয়োজনে প্রয়োজনীয় সবকিছুর ব্যবস্থা করতে হয় কোরাসের
সদস্যদের যৌথ উদ্যোগে। এবারে কালাইনের অনুষ্ঠানেও এর ব্যতিক্রম হয় নি। তবে এতো বিশাল আয়োজন
কোরাসের একার পক্ষে সম্ভব হতো না, যদি না বাগান-শ্রমিকরা তাদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে
দিতেন, অনুষ্ঠান পরিচালনায় সর্বতোভাবে সহযোগিতা করতেন।)
প্রতিবছরের ন্যায় অসম মজুরি
শ্রমিক ইউনিয়ন ও কালাইন বাগান শ্রমিক প্রতিনিধিদের ব্যবস্থাপনায় ঝুমুর কাঠিনাচ
প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হলো ১৮ ফেব্রুয়ারী রবিবার, ২০১৮ তারিখে কালাইন বাগান ১২ নং মাঠে।
শ্রমিক ও চা-বাগানের মানুষদের উপস্থিতি ও অংশগ্রহণ ছিল ব্যাপক। এই ধরনের
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করতে গিয়ে কোরাসের সদস্যদের অনেক পরিশ্রম করতে হয়। বাড়ি বাড়ি
গিয়ে চাঁদা তোলা থেকে অনুষ্ঠানের সমস্ত আয়োজন করতে হয় কোরাসের সদস্যদেরই। এবারের
অনুষ্ঠানে কালাইন বাগানের শ্রমিকরা ও স্বেচ্ছাসেবকরা গোটা অনুষ্ঠানকে সামলেছেন ও
অতিথি আপ্যায়ন করেছেন অত্যন্ত যত্ন সহকারে এবং নিজেদের শ্রম ও কস্টার্জিত সামান্য
আয় থেকে সবার যৌথ অবদানের মাধ্যমে। এদিক দিয়ে এই অনুষ্ঠান সফল। কিন্তু এই
অনুষ্ঠানের সুদূর প্রসারী প্রভাব সুনুশ্চিত করতে হলে, আমাদের ভাবতে হবে সংস্কৃতি
চর্চার সামগ্রিকতা নিয়ে।
সংস্কৃতি মানে গোটা জীবন
চর্চা। একটি জনগোষ্ঠীর আচার-অনুষ্ঠান, রীতি নীতি, খাদ্যাভাস, বেশভূষা, ভালবাসা,
প্রেম পিরীতি সবকিছুই সংস্কৃতির অঙ্গ। সংস্কৃতি চর্চার একটি প্রধান উপাদান হচ্ছে
ভাষা। ভাষা হচ্ছে গোটা জীবন চর্চার বিমূর্ত প্রকাশ। মানুষ পৃথিবীতে বাস করে এক
নির্দিষ্ট সামাজিক সম্পর্কে। এই সামজিক সম্পর্কের পরিধিতে নিরন্তর চলমান সংঘাত ও
সহাবস্থান নির্ধারণ করে দেয় একেকটি জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি। এই আবর্তে সচেতন
সাংস্কৃতিক চর্চার প্রয়োজনীয়তা কোথায়? কীভাবেই বা নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর নিজস্ব
সংস্কৃতি চর্চার সাথে সচেতন সাংস্কৃতিক উদ্যোগ যোগসূত্র স্থাপন করে?
ধরা যাক চা-শ্রমিকরা সবাই
মিলে সিদ্ধান্ত নিল ৩৫০ টাকা মজুরি না দিলে বাগানে কাজ করবে না। মালিক ও শ্রমিকের
সম্পর্কের মধ্যে এই সংঘাতের পথে টিঁকে থাকার লড়াইয়ের প্রভাব তাদের শরীরী ভাষায়,
মুখের ভাষায়, সামাজিক কথোপকথনে, জোটবদ্ধতায়, নাচে-গানে, আচার-অনুষ্ঠানে পড়বে।
অন্যদিকে ধরা যাক মালিক ঘোষণা করল যে নিরিখ বাড়িয়ে ২৫ কেজি করতে হবে। শ্রমিকরা
মেনে নিতে বাধ্য হলো। এই সমঝোতার ফলে শ্রমিকদের পরিশ্রম করতে হয় বেশি, বর্ধিত
শারীরিক ও মানসিক কষ্টকে লাঘব করতে আত্মসমর্পণ করতে হয় ভগবানের কাছে, নেশার কাছে,
বাজারি বিনোদনের কাছে, সামাজিক-রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক ক্ষমতাবান ও সর্বশক্তিমানদের
কাছে। ঠিক অনুরূপভাবে ভাল পাঠশালা, উপযুক্ত শিক্ষক, মাতৃভাষায় ও বিনামূল্যে
পাঠদানের অধিকারের আদায়ের লড়াই এক সংস্কৃতি চর্চার জন্ম দেয়, আবার এই পরিস্থতিতিকে
মেনে নিলে আত্মসমর্পণ করতে হয় দেবী সরস্বতীর কাছে, ক্ষমতাবানদের কাছে। অর্থাৎ
একদিকে প্রতিবাদী সংস্কৃতি ও অন্যদিকে আত্মসমর্পণ বা স্থিতাবস্থার সংস্কৃতি এই
দু’য়ের সংঘাত চলতে থাকে নিরন্তর বিভিন্ন রূপে এবং একটি নির্দিষ্ট সময়ে একটি ধারাই
আধিপত্য বিস্তার করে থাকে। চলমান এই সংঘাতের ফাটল দিয়েই অনুপ্রবেশ ঘটে সচেতন
প্রগতিশীল বা প্রতিক্রিয়াশীল সংস্কৃতি চর্চার, এবং দু’য়ের টানাপোড়েন চলতে থাকে
সাংস্কৃতিক আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে। সংস্কৃতির কোন ধারা আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম
হবে তা ইতিহাস নির্ধারিত হলেও ইতিহাসকেও প্রভাবান্বিত করে নির্দিষ্ট সামাজিক
সম্পর্ককে তুলে ধরার এবং এই সম্পর্কে নিহিত প্রগতিশীল সামাজিক শক্তিকে এক করার বা
বিভাজিত করার সাংস্কৃতিক প্রয়াস।
চা-শ্রমিকদের ক্ষেত্রে
বর্তমান সামাজিক সম্পর্কের স্বরূপ কি? ঝাড়খণ্ডী-আদিবাসী-চা শ্রমিকদের এলাকা
চা-বাগানগুলির পাশেই অন্যান্য ছোট বড় বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর বাস। তাদের পড়শি বাঙালিদের
সাথে সামাজিক সম্পর্কের অবস্থানটা দেখা যাক। তাদের পাশের গ্রামেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে
কর্মরত অনেক শ্রমিক আছে যারা তাদের মতই কম মজুরি পায়, অনেক মহিলা শ্রমিক আছে যাদের
মাসিক আয় বাগানের মহিলা শ্রমিকদের চেয়েও কম। গ্রামগুলিতে পুরোনো অনেক স্বচ্ছল
পরিবার অনিয়মিত আয়ের শ্রমিকে রূপান্তরিত হয়েছে। আবার এই গ্রামাঞ্চলে
মাস্টার-ডাক্তার-বাবু-কেরাণী ইত্যাদি মানসিক শ্রমে নিযুক্ত শ্রমিকদের দেখা পাওয়া যায়,
যা প্রায় দেখাই যায় না চা-বাগানে। মানসিক শ্রম থেকে চা-শ্রমিক পরিবারদের দূরে
সরিয়ে রাখার দু’টি প্রধান হাতিয়ার হচ্ছে মাতৃভাষায় পঠন পাঠনের সুযোগ ও তপশিলি
জাতি/জনজাতির অধিকার না দেওয়া। চা-বাগানের কচিকাঁচাদের স্কুল ছুটের হার বেশি হওয়ার
একটি অন্যতম কারণ ঘরের মায়ের মুখের ভাষার সাথে বিদ্যালয়ের শিক্ষকের মুখের ভাষার
দূরত্ব। ঠিক তেমনি ১৯৫২ সালে তপশিলি জাতি/জনজাতির স্বীকৃতি উঠিয়ে দেওয়ার ফলে যে
কতিপয় যুবক যুবতীরা কিছুটা পড়াশুনা করেছে তারাও মানসিক শ্রমের সাথে যুক্ত হতে
পারেনি, তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক প্রতিনিধি নির্বাচনেও এই জনগোষ্ঠী ব্যর্থ হয়েছে।
এটা হচ্ছে জনগোষ্ঠীগত বঞ্চনার দিক। কিন্তু শ্রমিক হিসেবে বঞ্চনার এক সর্বজনীন রূপও
চা-বাগান শ্রমিকদের আশপাশে বিরাজ করছে এবং এই সর্বজনীন রূপ দেখিয়ে দিচ্ছে সামাজিক
সম্পর্কের আরেক বাস্তবতা যার অভ্যন্তরে বাগান ও গ্রামের মানুষ প্রতিনিয়ত ভাবের
আদান প্রদান করছে। এই সম্পর্কে ফাটল ধরালে প্রতিক্রিয়াশীল সংস্কৃতির লাভ, সম্পর্ককে
সুদৃঢ় করে বৃহত্তর ঐক্য প্রগতিশীল সংস্কৃতির ভিত্তি।
প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক চর্চাকে
মানুষের প্রতিবাদী সক্রিয়তার সাথে সচেতনভাবে যুক্ত করতে হবে, বাস্তব সামাজিক
সম্পর্কের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ মেহনতি মানুষের সর্বজনীন ঐক্যের অন্তর্বস্তু থাকা
সাংস্কৃতিক বয়ান তৈরি করতে হবে।
প্রগতিশীল বা
প্রতিক্রিয়াশীল উভয়ের আবেগ নিহিত থাকে বাস্তব সামাজিক সম্পর্কে। বাস্তব সম্পর্কের
গর্ভ থেকে তাকে আহরণ করে মহৎ বা ধ্বংসাত্মক বয়ান নির্মাণ করা যায়। এই আবেগকে বুঝতে
হবে। প্রতিক্রিয়াশীলদের মদতে রয়েছে রাষ্ট্র, বাজার ও তার বিভিন্ন
অনুষ্ঠান-প্রতিষ্ঠান, প্রগতিশীলদের দরকার বাস্তবতা বোঝার যৌথ কঠোর সচেতন প্রয়াস ও
চর্চা।