।। অরূপ বৈশ্য।।
জাতীয়তাবাদী শিবির থেকে আসামের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের
প্রশ্ন পুনরায় উত্থাপিত হলো। ২৫ ফেব্রুয়ারি আমার অসম পত্রিকায় প্রকাশিত এক সংবাদ
এই তথ্য পরিবেশন করে। সংবাদ শিরোনামে বিশিষ্ট লেখক অদীপ ফুকনের বক্তব্য
প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন ভারতীয় রাষ্ট্রের অতি-কেন্দ্রিক ব্যবস্থা এক
মহাকেন্দ্রিক ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে। ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের মাধ্যমে ভারতীয়
রাজনীতি ও অর্থনীতিতে যেটুকু বিকেন্দ্রীকরণের ব্যবস্থা কায়েম করা হয়েছিলো তা
সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ছে। পরিস্থিতিটা যদি এমন হতো যে অসমীয়া উৎপাদক ও ব্যবসায়ীরা তাদের
উৎপাদ ও পরিষেবা নিয়ে সর্বভারতীয় বাজারের অংশগ্রহণকারী, এই বাজারের চাহিদা অনুযায়ী অন্যান্য ভাষা-সংস্কৃতির
ভাবের আদান প্রদানের জন্য অনুষ্ঠান প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে এবং এগুলির জন্য
কেন্দ্রীয় পরিচালনা প্রয়োজন, তাহলে কেউ
কেন্দ্রীভবনের বিরোধিতা করত না। অসম বিকাশ পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে অন্তর্নিহিত, আন্তর্জাতিক ও জাতীয় স্তরে এটাই বাস্তব সত্য। এই
বাস্তবতায় অনুন্নত দেশ/জাতি/অঞ্চল থেকে উন্নত দেশ/জাতি/অঞ্চলের দিকে পুঁজি ও
সম্পদের বহির্গমন হতে থাকে। উত্তরোত্তর ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন এই অসাম্যকে বৈধতা
প্রদান করে ও অনুন্নত দেশ/জাতি/অঞ্চলের মৃত্যু পরোয়ানা ঘোষণা করে। উপনিবেশিক ও
উত্তর-উপনিবেশিক কাঠামোয় উন্নয়নের অসম বিকাশের যে পরিবেশ গড়ে উঠেছে, সেই পরিবেশে দিল্লিতে ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন ছিল
অন্তর্নিহিত। এই অসাম্যকে কমিয়ে আনতে প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় আয়োজন ও ক্ষমতার
বিকেন্দ্রীকরণ। কেন?
ধরুন রাম ও রহিমের মধ্যে দৌড় প্রতিযোগিতা হবে (বাজার
মানেই প্রতিযোগিতা)। অথচ রহিম খোঁড়া। পরিচালকমণ্ডলি অনেক হিসেব নিকেশ করে ঠিক
করলেন, রহিম একপায়ে সাইকেল চালাবে ও রাম দৌড়াবে। ধরে নিন এটা
একটা জুতসই বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থা। এবার সমানে সমানে প্রতিযোগিতা হবে। কিন্তু
পরিচালকমণ্ডলীতে যদি সবাই রামের প্রতিনিধি থাকে তাহলে এই বৈজ্ঞানিক যুক্তি না
মানারই সম্ভাবনা বেশি এবং রামের জয় ও রহিমের পরাজয় পূর্বনির্ধারিত। এভাবে নিরন্তর
চলতে থাকবে ও এক সময় রহিম আর প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া থেকে বিরত থেকে না খেয়ে মরবে।
অর্থাৎ সুষ্ঠু প্রতিযোগিতার জন্য প্রয়োজন একটি পরিচালকমণ্ডলী ও পক্ষপাতহীন
ব্যবস্থার জন্য সবার অংশগ্রহণ। অর্থনীতির ক্ষেত্রে এধরনের নিয়ন্ত্রণের জন্য
প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ও ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ। নয়া অর্থনীতির প্রবক্তারা
পুঁজির উপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের বিরোধী, বরঞ্চ এই
অর্থনীতিতে পুঁজি সম্পূর্ণভাবে রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করবে। লগ্নি পুঁজির দাপট, উৎপাদন ও সম্পদের ব্যক্তি মালিকানা, শ্রমের অস্থায়ীকরণ ও স্তরীভবন ইত্যাদি হচ্ছে
নয়া-উদারবাদী অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য। তাই বিনিয়োগকারীদের আকর্ষিত করতে সস্তা শ্রম, সস্তা প্রাকৃতিক সম্পদ, সস্তা মানি’র বন্দোবস্ত করার দায়িত্ব নিয়েছে সরকার। বেসরকারিকরণ
চলছে দ্রুতগতিতে, শ্রমিক সুরক্ষার
আইন বদলাচ্ছে, জনগণের অর্থ এমনকি পেনশন ফাণ্ডও ব্যক্তি মালিকদের
হাতে চলে যাওয়ার বন্দোবস্ত হচ্ছে। প্রয়োজন পড়েছে সর্বভারতীয় সমসত্তাবিশিষ্ট বাজার
নির্মাণ। ক্ষমতার কেন্দ্রীভবনের পেছনে এটাই হচ্ছে চালিকাশক্তি, তথাকথিত দেশপ্রেমের সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের পেছনে রয়েছে
সর্বভারতীয় সমসত্তাবিশিষ্ট বাজার নির্মাণের তাগিদ। আর্থিক ও সাংস্কৃতিক এই
এজেণ্ডাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে রাষ্ট্রীয় আয়োজনের পক্ষে জনমত নির্মাণের জোর আয়োজন
চলছে। বৈচিত্র্যকে ধ্বংস করে দিতে তথাকথিত হিন্দু সংস্কৃতির জয়গানের পেছনে এটাই
আসল রহস্য। ভাষা যেহেতু ধর্মের গণ্ডি অতিক্রম করে যায় ও বৈচিত্র্য ভাষা বিকাশের
প্রাণশক্তি, তাই হিন্দুত্ব সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের সাথে যুক্ত রয়েছে
ভাষিক আগ্রাসন বা ভাষার প্রাণহীন একমুখীন ধর্মীয় রূপান্তর।
অসমীয়া জাতিয়তাবাদী শিবির থেকে পুনরুত্থাপিত পূর্ণ
স্বায়ত্তশাসনের দাবি ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের বিরুদ্ধে একটি সময়োচিত দাবি। অসমীয়া
মধ্যশ্রেণি কেন্দ্রীকতার বিপদ সম্পর্কে শঙ্কিত। কিন্তু অসমীয়া জাতিয়তাবাদী কূপমণ্ডূকটা
(বাংলার ক্ষেত্রে বাঙালি কুপমণ্ডূকতা ইত্যাদি) তাদেরকে কেন্দ্রীকতার ফলে সামগ্রিক
বিপর্যয়ের পরিণতি দেখতে অপারগ করে তুলে। তাই অভ্যন্তরীণ অনা-অসমীয়া জনগোষ্ঠীদের
সাথে ক্ষমতা ও সুযোগ সুবিধা ভাগ করে নেওয়ার ব্যাপারে এই মধ্যশ্রেণি অত্যন্ত
স্পর্শকাতর। জাতীয়তাবাদী শিবিরের এই অবস্থানই তাদেরকে কেন্দ্রীভবনের আগ্রাসী
শক্তির লেজুড়ে পরিণত করে ও আসামকে ঠেলে দেয় বিপর্যয়ের মুখে। কেন্দ্রীভবনের
সামাজিক-আর্থিক-রাজনৈতিক শক্তিকে পরাস্ত করার একমাত্র পূর্বশর্ত হচ্ছে আসামের
বহুভাষিক বহু পরিচিতিগত জনগোষ্ঠীগুলোর ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে
বৈচিত্র্যকে ও ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের প্রশ্নকে অস্বীকার করে বৈচিত্র্যের উপর
আঘাত ও কেন্দ্রীকতার সর্বভারতীয় প্রক্রিয়াকে প্রতিহত করা যায় না। নীতিগতভাবে না
হলেও যুদ্ধ জয়ের কৌশল হিসেবেও জাতিয়তাবাদী শিবির যদি এই বাস্তব উপলব্ধি করতে পারেন
তাতেই মঙ্গল। অন্যথায় আসামবাসীর সামুহিক ধ্বংস কেউ রুখতে পারবে না।
0 comments:
Post a Comment