এনআরসি হচ্ছে শ্রমিকদের উপর হামলার নয়া একটা যন্ত্র

Posted by শহিদুল হক


গত চৌঠা মার্চ ২০১৮, আসামের শিলচরে শহরের গান্ধী ভবনে অনুষ্ঠিত হয় 'ফোরাম ফর সোশ্যাল হারমনি' গণকনভেনশন কনভেনশনে আলোচনার বিষয়বস্তু ছি নাগরিকত্ব, নাগরিক অধিকার, অস্থায়ী ঠিকা শ্রমিক কর্মচারিদের আয় সামাজিক সুরক্ষা তথা নাগরিক নিরাপত্তা নয়া দিল্লির নিউ ট্রেড ইউনিয়ন ইনিশিয়েটিভ-এর সাধারণ সম্পাদক গৌতম মোদি ছিলেন একজন আমন্ত্রিত বক্তা আসামে এনআরসি থেকে উদ্ভুত সমস্যা শ্রমিক শ্রেণির উপর এর প্রভাব নিয়ে তার বক্তব্যের অনুলিখন করেছেন শহিদুল হক

 
গৌতম মোদি
রাক উপত্যকার বিভিন্ন গণসংগঠন, ট্রেড ইউনিয়ন গণতান্ত্রিক ব্যক্তিবর্গযারা ফোরাম ফর সোশ্যাল হারমনির ডাকে সামাজিক বৈষম্য সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে এখানে সমবেত হয়েছেন, তাদের সবাইকে আমার তরফ থেকে লাল সেলাম এই দুঘন্টা ধরে আমার পূর্ববর্তী বক্তাদের কাছ থেকে বর্তমান পরিস্থিতি, বিশেষ করে আসামের এন আর সি নাগরিকত্বের সংকট এবং মাতৃভাষার অধিকার সম্পর্কে যে সারগর্ভ বিশ্লেষণ শুনতে পেরেছি, এতে আমি ব্যক্তিগতভাবে তাদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি
         বিংশ শতকে, কিছু দূর অবধি একটা ধারণার গ্রহণযোগ্যতা ছিল যে পুঁজিবাদের জয়যাত্রায় অবশ্যই শ্রমিক শ্রেণির উপর শোষণ-নিপীড়ন বাড়বে , কিন্তু প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা সামাজিক বৈষম্য যেমনজাতিগত, ধর্মীয় বা লৈঙ্গিক বৈষম্য ইত্যাদি দূর হবে প্রগতিশীল ধারার অনেক সমাজবিদরাও এই ধারণা রাখতেন কিন্তু আজ এটা আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারব যে সেই ধারণা সম্পূর্ণরূপে ভুল ছিল অর্থাৎ পুঁজিবাদ সমাজে গণতান্ত্র প্রতিষ্ঠা করবে সবধরনের বৈষম্য দূর করবেএই ধারণার আর কোনো ভিত্তি নেই আজ উদাহরণ হিসেবে ধরে নিন, পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন ঐতিহাসিক অসাম্যনারী পুরুষের মধ্যেকার অসাম্য পরিবারে, সমাজে বা কর্মস্থলে পুঁজিবাদ কি এই অসাম্যকে দূর করেছে ? না বরং বাড়িয়েছ,  উৎসাহিত করেছে শ্রমের বাজারে একে মুনাফার স্বার্থে ব্যবহার করেছে যেকোনো কাজই হোক,  আমরা দেখি মহিলা পুরুষের মধ্যে মজুরির বৈষম্য তো রয়েছেই, উপরন্ত মহিলারা বেশি দমন-পীড়ণ শোষণের শিকার হন তাহলে পুঁজিবাদের ইতিহাস থেকে এই বিষয়টা স্পষ্টভাবে বেরিয়ে আসে যে সামাজিক বৈষম্যগুলো যদিও পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠা পাওয়ার অনেক আগেই এসেছিল, কিন্তু পুঁজিবাদ সেটাকে লালন পালন করেছে, কারণ পুঁজিবাদের মূল উদ্দেশ্য হল নিজের সিস্টেমটাকে এগিয়ে নেওয়া, সমাজ থেকে মুনাফা আদায় করে নেওয়া আর যদি শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ, বৈষম্য না থাকে তো শোষণ মুনাফা আদায় পুঁজিবাদের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়াবে শ্রমিক শ্রেণি যদি ধর্ম-জাতি-ভাষা ইত্যাদির বিভাজনের জন্য ঐক্যবদ্ধ না হোন, তো তারা কোনোদিনই এক সংগঠনে সংগঠিত হবেন না এটাই পুঁজিবাদের সহজ সমীকরণ
আজকের দিনে এই সমীকরণের পাশাপাশি আরেকটা চক্রান্তের বিষয় সামনে আসছে যে, কোনো শ্রমিক কাজ করার জন্য আইনিভাবে স্বীকৃত ? না কি বেআইনি আসামের এনআরসি- প্রশ্নে এই বিষয়টা আরও স্পষ্টভাবে সামনে আসে যেমন ধরুন , কোনো শ্রমিকের নাম এনআরসি- তালিকায় থাকল না, তো পুঁজিপতি বা কারখানার মালিক বা ঠিকাদার তাকে কী বলবে ? আপনি এনআরসিতে নেই, আপনি ভারতীয় নন বা আপনি বাংলাদেশি, মুসলমান, আপনার কাছে এদেশের নাগরিক হবার নথিপত্র নেই -- ইত্যাদি অভিধায় ভূষিত করে সেই শ্রমিককে কম মজুরিতে খাটাবে আজ ভারতবর্ষের শ্রমের বাজারে যারা খাটছেন, তাদের একটা বড়ো অংশ ভারতবর্ষের উত্তর উত্তরপূর্ব অর্থাৎ এই অঞ্চল থেকে আসছেনঐতিহাসিকভাবে যারা রাজনৈতিক বিভাজনের শিকার,  যেখানে অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় দারিদ্র শোষণের মাত্রা অধিক আর এখানেই দক্ষিণপন্থা তাদের ডালপালা বিস্তারে সক্রিয় বিশেষ করে বিজেপি-আরএসএস তাদের সঙ্ঘ পরিবার এখানে প্রভাবশালী ভূমিকায় থেকে শ্রমের বাজারে এই আইনি-বেআইনি বিভাজনের অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে আর এই সমস্যা শুধু আসামেই সীমাবদ্ধ নয় এই অঞ্চল থেকে সবচেয়ে বেশি পরিযায়ী শ্রমিকরা সারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে এনআরসি পরবর্তী সময়ে, এখানকার পরিযায়ী শ্রমিকরা দেশের কোনো বড়ো শহর বা ঔদ্যোগিক নগরগুলোতে যখন যাবে, তখন এটা অবধারিত যে, আসামের শ্রমিকরা নানাভাবে হেনস্তার শিকার হবেন, সঠিক দস্তাবেজের বাহানায় কোম্পানি বা পুঁজিপতিরা তাদের কম বেতনে খাটাবে এভাবে দেশের এই অঞ্চলের শ্রমিকদের উপর হামলার নয়া একটা যন্ত্র হচ্ছে এনআরসি
আজ, শ্রমের বাজারে একটা শব্দ প্রচলিত, সেটা হচ্ছে ঠিকা শ্রমিক ঠিকা শ্রমিক কারা ? – যাদের স্থায়ীকরণ হয়নি বা যারা দালালের মারফতে এসেছেন কাজ করতে ঠিকা শ্রমিক তারা, যারা স্থায়ী শ্রমিকদের মতো সমান কাজ করেন অথচ মজুরি কম পান, শ্রম আইনে শ্রমিকরা যেসব অধিকার পেয়ে থাকেন, সেগুলো তারা পাবেন না এই ব্যবস্থা আসলে পুরোনো সামাজিক বৈষম্যগুলকে সামনে রেখে পুঁজিবাদের কাঠামোর মধ্যে নিত্য নতুন বৈষম্য তৈরি করে শোষণের নয়া প্রাতিষ্ঠানিক রূপ

আজ যদি দেশের কোনো এক স্থানে বা কারখানায় লড়াকু ইউনিয়ন গঠিত হয়  ম্যানেজমেন্ট  মালিকশ্রেণিকে চাপের মুখে ফেলে তো এমন কথা রটানো হয় যে শ্রমিকরা যদি কোম্পানির কথা না মানেন তাহলে কাল থেকে ম্যানেজমেন্ট মালদা থেকে শ্রমিক আনবে মালদা থেকে শ্রমিক আনার কথা ছড়ানোর মানে কী ?

এটা বলা হয়ে থাকে যে সারা দেশে উন্নয়নের জোয়ার বইছে এটা ঠিক যে বিভিন্ন প্রান্তে ঔদ্যোগীকরণ হয়েছে কিন্তু এই উন্নয়নের যে জোয়ারের কথা বলা হচ্ছে সেটা শ্রমিক শ্রেণির জন্য নয়, সেটা বিশেষ একটা শ্রেণির উন্নয়ন এই উন্নয়নে শ্রমিক শ্রেণি কী পেয়েছে ? তাদের জীবনধারণের মান কি উন্নত হয়েছে ? না পুঁজিবাদ নিজের কাঠামোটাকে টিকিয়ে রাখতে আমাদের মধ্যে নিত্য-নতুন বৈষম্য বিভাজন তৈরির জাল বুনেছে, আর আমরাও শিকার হয়েছি আজ যদি দেশের কোনো এক স্থানে বা কারখানায় লড়াকু ইউনিয়ন গঠিত হয় ম্যানেজমেন্ট মালিকশ্রেণিকে চাপের মুখে ফেলে তো এমন কথা রটানো হয় যে শ্রমিকরা যদি কোম্পানির কথা না মানেন তাহলে কাল থেকে ম্যানেজমেন্ট মালদা থেকে শ্রমিক আনবে মালদা থেকে শ্রমিক আনার কথা ছড়ানোর মানে কী ? মানে এটাই যে মালদা থেকে এক মুসলমান-বাংলাদেশী-বিদেশী মজদুর এনে কাজ করাবে , যার মাথা তোলার কোনো অধিকার থাকবে না, যে চুপচাপ খেটে যাবে ইউনিয়ন করা শ্রমিকদের রোজি-রুটিতে আঘাত হানবে এই বিভাজনে লাভটা কার ? লাভটা না ওখানকার ইউনিয়ন করা শ্রমিকদের, না সেই মালদার শ্রমিকেরলাভটা হচ্ছে পুঁজিপতির

         এই সময়ে , যেকোনো লড়াকু শ্রমিক সংগঠন বা ইউনিয়নের জন্য জরুরি তাদের বিভিন্ন দাবি নিয়ে লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া কিন্তু বড়ো পরিবর্তনের জন্য কোনো শ্রমিক সংগঠনের কাছে আসল প্রত্যাহ্বান হচ্ছে যে এই লড়াইটাকে কারখানা বা কর্মস্থলের ভিতরেই সীমাবদ্ধ রাখবেন ? না কি নিজেদের দাবিদাওয়ার লড়াইগুলো বৃহত্তর রাজনৈতিক পরিসরে নিয়ে যাবেন অর্থাৎ সমস্যাগুলো তো কোনো না কোনোভাবে সমস্ত মজদুর বর্গের একই তাহলে কর্মস্থলের চৌহদ্দি থেকে দাবিদাওয়া অধিকারের এই লড়াইকে শ্রেণিগত চেতনায়, শোষিত বর্গের ভাষায় রাজনৈতিকভাবে উপস্থাপিত করতে হবে এই কাজটা আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত জরুরি কারণ সংঘ-বিজেপির রাজনীতিই বলুন আর আসামের ভূমিপুত্রদের ত্রাতা হিসেবে উঠে আসা উগ্র জাতীয়তাবাদী আসু-এজিপির কথাই ধরুন, এদের একটাই উদ্দেশ্য যে শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে নানাবিধ বিভাজনের যন্ত্র তৈরি করে শোষণের পথ সুগম করে দেওয়া আমরা এই জালে না আটকে, এদের রাজনীতিকে অপ্রাসঙ্গিক করে দিয়ে একই দাবিকে উর্ধে তুলে ধরব যে বাংলাদেশি-বিদেশি-হিন্দু-মুসলমান-ভূমিপুত্র-বহিরাগত ইত্যাদি বুঝি নাচাই সমগ্র শ্রমিক শ্রেণির সমান অধিকার
         নয়া উদারনীতিবাদী অর্থনীতিতে আমাদের দেশের বর্তমান আর্থিক নীতিগুলোর সামনে শুধু শ্রমিক শ্রেণিই নয়, সমাজের প্রতিটা বর্গই সংকটের মুখে এই নীতির ধারক-বাহকরা এটা বিভিন্ন কৌশলে প্রতিষ্ঠা করতে চাইবে যে বিভাজনের মাধমে সমাজের একটা অংশকে কোণঠাসা করে আরেকটাকে আধিপত্যকামী ভূমিকায় নিয়ে আসা এই দ্বন্দ্বকে ওরা দীর্ঘস্থায়ী রূপ দিতে চাইবে কারণ বর্তমান আর্থিক নীতি পুঁজিবাদের এই ক্ষমতা নেই যে সবার হাতে রোজগার তুলে দেয় গ্রামীণ এলাকায় যত বড়ো কৃষকই হোন না কেন, এই নীতিতে তার চলছে না শহুরে শিক্ষিত শ্রেণির হাতে চাকরি নেইসরকারি কী বেসরকারি আসামের কথাই ধরুন, এই নীতির কাছে সুরক্ষিত নয় অসমিয়া ভূমিপুত্ররাও, যাদের এনআরসি- পর বৈধ নাগরিকত্বের প্রমাণও থাকবে
তাই, সমস্ত প্রগতিশীল ট্রেড ইউনিয়নগুলোর এখন প্রয়োজন জোরের সাথে এই বিভাজনের নীতিকে প্রতাখ্যান করা এই কথাটা অনুধাবন করা যেবিভাজনের খেলাটা শ্রমিকশ্রেণি খেলেনি, খলেছে শোষকরা, শ্রমিক শ্রেণির বিরুদ্ধে

ভিডিও দেখুন এখানে-


0 comments:

স্বাভিমান:SWABHIMAN Headline Animator

^ Back to Top-উপরে ফিরে আসুন