কম্যুনিস্ট পার্টির ভূমিকা নিয়ে ভ্রান্তি (কিছু নোট)
শুরুতে একটা কথা বলে নেওয়া দরকার। কম্যনিস্ট
পার্টির রীতি হচ্ছে বাস্তব পরিস্থিতির বাস্তব ব্যাখ্যার উপর দাঁড়িয়ে একটি তত্ত্ব
নির্মাণ করা, এই তত্ত্বের লক্ষ্য ও ভিত্তি হওয়া চাই সর্বহারার আন্তর্জাতিকতাবাদ
এবং এই তত্ত্বের ভিত্তিতে অনুশীলন করা। বুর্জোয়া পার্টিগুলোর মতো ‘ঝোপ বুঝে কোপ’
মারার নীতি কম্যুনিস্ট পার্টি অনুশীলন করতে পারে না। স্বাধীনতার আগে ও অব্যবহিত
পরে কম্যুনিস্ট পার্টির এই সততা ছিল, যদিও এখন এই সততা কতটা বজায় আছে এনিয়ে অনেকেই
সন্দিহান।
কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের
মধ্যে টানপোড়েন শুরু হয় ত্রিশের দশকে। কংগ্রেস নিজেকে সব ভারতীয়দের প্রতিনিধি
হিসাবে দেখাতে ও মুসলিম লিগকে মুসলিম ভোটারদের দল হিসাবে স্বীকৃতি না দিতে সচেষ্ট
ছিল। আর মুসলিম লিগ কংগ্রেসকে হিন্দুর দল হিসাবে দেখাতে ও নিজে মুসলিমদের প্রতিনিধি
হিসাবে ক্ষমতার অংশীদার হতে তোড়জোড় শুরু করে চল্লিশের দশকের আগেই।
সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের
পরিস্থিতিতে ১৯৩৯ সালে কংগ্রেসের অভ্যন্তরে গান্ধীজী ও অন্যান্যরা ছিলেন জার্মানী ফ্যাসিবাদের
বিরুদ্ধে ব্রিটিশের সহযোগিতার পক্ষে, আবার বিনাশর্তে স্বাধীনতারও পক্ষে। বামপন্থী
দল এবং নেতাজী সুভাষ বোসের মত বামপন্থী নেতারা ছিলেন ‘ব্রিটেনের অসুবিধা মানে
ভারতের সুযোগ’ এই মতের পক্ষে। সব বামপন্থীরা এই মতের পক্ষে ছিলেন কারণ বামপন্থীরা
বিশ্বযুদ্ধকে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ হিসাবে ঘোষণা করেছিলেন। তৃতীয় ধারাটি ছিল
ব্রিটেনকে অসুবিধায় না ফেলে কোনো বিশেষ সুবিধা আদায় করে নেওয়া। কম্যুনিস্ট পার্টি
সচেষ্ট ছিল কংগ্রেস যাতে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের বিরুদ্ধে পূর্ণ স্বাধীনতার
রেডিক্যাল অবস্থান নেয় এবং সেজন্য প্রয়োজন ছিল হিন্দু-মুসলিম ঐক্য গড়ে তোলার।
জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে
কম্যুনিস্ট পার্টি প্রথম তাত্ত্বিক অবস্থান নেয় ‘অধিকারী থিসিস’-এর মাধ্যমে।
বাস্তব পরিস্থিতির বাস্তব ব্যাখ্যার উপর দাঁড়িয়ে কম্যুনিস্ট পার্টি ঘোষণা করে ভারতবর্ষ
একটি বহুজাতির দেশ। একইসাথে ঘোষিত হয় বিচ্ছিন্ন হওয়ার অধিকার নিয়ে জাতীয়
আত্মনিয়ন্ত্রণের। জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণ ছাড়া যেমনি ব্রিটিশের অধীনতা থেকে ভারতীয়দের
মুক্তির প্রশ্ন অবান্তর, ঠিক তেমনি বিচ্ছিন্ন হওয়ার অধিকারের অন্তর্বস্তু ছিল সবার
সহমত ও অধিকারের ভিত্তিতে ভারতীয় দেশ গঠন। কংগ্রেস এ অবস্থান মানতে পারেনি কারণ
তারা চাইছিল একচ্ছত্র শাসন। মুসলিম লিগের আপত্তি থাকার কথা নয়, কারণ তারা চাইছিল
ক্ষমতার অংশীদারিত্ব। সিপিআই-এর অবস্থান ছিল সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধে ব্রিটিশকে কোনো
সহযোগিতা নয়, কোনো সৈন্যও নয়।
সিপিআই এই অবস্থান থেকে সরে
যায় যখন ১৯৪১ সালে নাজী জার্মানী সোভিয়েত আক্রমণ করে। সিপিআই যে যুদ্ধকে
সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ হিসাবে ব্যাখ্যা করেছিলো, সেই যুদ্ধকে শুধুমাত্র সোভিয়েত আক্রমণের
ভিত্তিতে ফ্যাসিবিরোধী জনযুদ্ধ হিসাবে ঘোষণা করে বসল। এই জনযুদ্ধের সূত্রায়ন সিপিআই-কে
অভ্যন্তরিণ ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে দুর্বল অবস্থানে নিয়ে গেল। বামপন্থী
সুভাষ বসু আগের অবস্থানে অনড় ছিলেন, কিন্তু তিনিও কম্যুনিস্ট পার্টির বিপরীত অবস্থানে
থেকে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধে জার্মানীর ও জাপানের সহযোগিতা নিয়ে ভারত স্বাধীন করার
রণনীতি অবলম্বন করলেন। সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধকে জাতীয় মুক্তির আপসহীন সংগ্রামে
রূপান্তরিত করার রণনীতি থেকে সরে আসার সিপিআই এবং নেতাজী সুভাষ বসুর মতো
বামপন্থীদের উভয় ধারাই যে ভ্রান্ত ছিল ইতিহাস তার সাক্ষী।
ভারতকে বহুজাতিক দেশ ও
আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের সিপিআই-এর প্রস্তাব কংগ্রেস মেনে না নেওয়ায় এবং
বামপন্থীদের ভুলের জন্য এক খণ্ডিত ভারতবর্ষের ব্রিটিশ প্রজেক্ট সফল হলো।
হিন্দু-মুসলিম দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ বিভিজিত হলো। জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম
থেকে পিছু হঠা ও সাম্প্রদায়িক বাতাবরণে মুসলিম লিগের অবস্থান ও সিপিআই-এর অবস্থানের
মধ্যে যে ফারাক তাতে ধোঁয়াশার সৃষ্টি হলো। সিপিআই-এর বহুজাতিক দেশের কনসেপ্টের
মধ্যে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের মধ্যেও বহু জাতির ধারণা ছিল, যা দ্বিজাতি তত্ত্বে ছিল
না।
সেজন্যই স্বাধীনতার পর
ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের আন্দোলনে কম্যুনিস্ট পার্টি অগ্রণী ভূমিকা নেয় এবং ‘জনযুদ্ধের’
লাইনের ফলে স্বাধীনতা সংগ্রামে কম্যুনিস্ট পার্টির হারানো জনভিত্তি আবারও
পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়। ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের দাবিতে আন্দোলন গড়ে উঠে কারণ কংগ্রেস
আগে সেটা মেনে নিলেও একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এই প্রশ্নে টালবাহানা
করে। হিন্দি ভাষা সর্বত্র চাপিয়ে দিয়ে হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানের রাজনীতির
বিপরীতে সিপিআই-এর অবস্থান ছিল বহুভাষার অধিকারের সাথে হিন্দি সরকারি ভাষার,
দক্ষিণ ভারতের রাজনৈতিক শক্তির অবস্থান ছিল ইংরেজী কখনও কখনও, কিন্তু হিন্দি কখনও
নয়।
ভাষাভিত্তিক রাজ্যের
ভিত্তিতে ভারতবর্ষে যেটুকু ফেডারেল কাঠামো গড়ে উঠে সেটা আজ আবার আঘাতপ্রাপ্ত,
আবারও হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানের রাজনীতি প্রবল শক্তি নিয়ে হাজির যেখানে অন্য
কোনো ভাষিক-সাংস্কৃতিক বৈচিত্র অস্বীকৃত। আজকে পরিস্থিতি ভিন্ন। ভারতবর্ষের
জাতি-ধর্ম-বর্ণ-অঞ্চল নির্বিশেষে সর্বত্র ফিনান্স পুঁজিকে আশ্রয় করে যে নতুন
শ্রেণির সর্বভারতীয় ও গ্লোবাল নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে তারা এক সর্বভারতীয় কমন বাজারের
মাধ্যমে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী। তাদের মদতেই গড়ে উঠছে এক
প্রতিক্রিয়াশীল জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ছত্রছায়ায় 'এক দেশ – এক বাজার – এক আইনের
শ্লোগান' ও এর পক্ষে জনসমর্থন। সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার রাষ্ট্রপ্রধান কাশ্মীর
প্রশ্নে আবারও হিন্দু-মুসলিম দ্বিজাতি তত্ত্বের অবতারণা করেছেন ও মধ্যস্ততা করার
দিকে এগোচ্ছেন। এই পরিবর্তীত পরিস্থিতিতে কম্যুনিস্ট পার্টিকে সাম্রাজ্যবাদ ও
জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে নতুন করে ভাবতে হবে ও করতে হবে নতুন তাত্ত্বিক নির্মাণ।
0 comments:
Post a Comment