Posted by স্বাভিমান

 

*উচ্ছেদের অর্থনীতি ও রাজনীতি এবং রাজনীতির উচ্ছেদ*

 

আসামে যে সময়ে উচ্ছেদ অভিযান জোর পেয়েছে, সেই সময় বিশ্বব্যাপী নিওলিবারেল ফিনান্সিয়্যালিজম পরিত্যাগ করার প্রবণতা দেখা দিয়েছে।   পুঁজিবাদের অতি-উৎপাদনের (over-production) সংকট, কিংবা বেকারত্ব বৃদ্ধি ও মজুরি পড়ে গিয়ে ঊনভোগের (Under-consumption) সংকট থেকে বেরিয়ে আসার প্রাথমিক স্বপ্ন ও স্বপ্নের হ্যাংঅভারের পর্যায় পেরিয়ে গেছে বহু আগেই। বিশ্ব ক্ষমতাকেন্দ্রের অভ্যন্তরিণ দুর্বলতা এমনভবে প্রকট হয়েছে যে সবাই একে অপরকে কনুই-ঠেলে নিজের মরদেহের সাড়ে তিন হাত জায়গার মালিকানা নিয়ে নিতে চাইছে।

উদারবাদ থেকে বেরিয়ে আসার মরিয়া চেষ্টা নতুন সংকটের জন্ম দিচ্ছে। ২০১৯ সালে চিন থেকে ৩০০ বিলিয়ন ডলার আমদানির উপর ট্রাম্প ১০% ইম্পোর্ট টারিফ লাগিয়েছিলেন। চিন তার মূদ্রা রেনমিনবি ডলারের তূলনায় অনেক নিচে পড়তে দিয়ে ওয়ার্লড স্টক ও সরকারি বণ্ডের বাজারে পড়তি আয়ের হাহাকার লাগিয়ে দেয়। এবারও ট্রাম্পের টারিফ কার্ড আশানুরূপ ফল দেয়নি। লেবার আর্বিট্রেজের নিওলিবারেল পুনর্গঠন অর্থাৎ সস্তা শ্রমের দেশে ফ্যাক্টরি নিয়ে যাওয়ার পরিস্থিতিকে ঘুরিয়ে আমেরিকাতে ম্যানুফেকচারিং বিনিয়োগ বাড়ানো যাবে কিনা সেটাও অনিশ্চিত। 

তবে বাণিজ্য পথে সামরিক দাপট ও বিশ্ব রপ্তানী বাণিজ্যে আমেরিকান বাজারের টানে ডলার নির্ভরতায় আমেরিকান বিশ্ব-দাপট এখনও বজায় থাকলেও, অভ্যন্তরিণ বাজারে ভোগ্যপণ্যের চাহিদার পতন ওয়ালস্ট্রিট ও মেইনস্ট্রিটের সংঘাতকে তীব্র করেছে, ডলার বহির্ভূত আঞ্চলিক মূদ্রায় বাণিজ্য বৃদ্ধি পাচ্ছে, এবং চিনের সামরিক শক্তির অগ্রগতির সাথে তাল মিলিয়ে রেইনমিনবির উপর নির্ভরতা বাড়ছে। 

অন্যদিকে চিনের বিদেশি বিনিয়োগ মূলত পরিকাঠামোয়, বাণিজ্য পথ নির্মাণে এবং প্রাকৃতিক সম্পদ-নির্ভর উৎপাদনে। উদাহরণস্বরূপ, আফ্রিকায় সোলার সেল উৎপাদন অত্যন্ত শোষণমূলক। শোষণমূলক বিশ্ব-পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় মূল্যের চলাচলের একটি হিসাবে দেখা গেছে যে, বিশ্বশক্তি হিসাবে চিনের অবস্থান এখন উন্নয়নশীল ও উন্নত দেশের মাঝামাঝি থেকে অনেকটা উপরে। সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বশক্তি হিসাবে চিনের অগ্রগতি অনেকটাই নির্ভরশীল বহির্দেশীয় বিনিয়োগ থেকে অতিরিক্ত মূল্য আহরণ করে অভ্যন্তরিণ বাজারে ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বৃদ্ধির উপর। অর্থাৎ ক্রয়ক্ষমতা থাকা এক বিশাল মধ্যবিত্তের চাহিদার বাজার সৃষ্টি, আর তার পরিণতিতে দেখা দেওয়া তীব্র অসাম্যের ভার পরনির্ভরশীল দেশের শ্রমজীবীদের উপর চাপিয়ে দেওয়া। চিনের একদলীয় শাসনের জন্য একাজটি করা সহজ। আর প্রতিযোগিতা ও অরগ্যানিক কম্পোজিশন অব ক্যাপিটেলের নিয়ম অনুযায়ী পুঁজির ভৌগোলিক সম্প্রসারণের মৌলিক বৈশিষ্ট্যকে মেনে নিলে পুঁজিবাদী অর্থনীতির সাম্রাজ্যবাদী অগ্রগতিই ভবিতব্য। কিন্তু নয়া-উপনিবেশগুলিতে বিদ্রোহ এবং বিশাল মধ্যবিত্তের চাহিদার বাজার তৈরির প্রচেষ্টায় ভয়ানক পরিবেশ বিপর্যয় -- বিশ্ব পুঁজিবাদী সংকটকে আরও গভীর করবে। 

দেশে দেশে সস্তাশ্রমের ভিত্তিতে নয়াউদারবাদী উৎপাদনী পুনর্গঠনের মাধ্যমে উন্নয়শীল দেশে যে বিনিয়োগ ও ঋণের সুযোগ তৈরি হয়েছিল তার প্রধান অনুসঙ্গ ছিল "বিস্থাপনের মাধ্যমে সঞ্চয়ন"। অর্থাৎ একইসাথে সস্তা প্রাকৃতিক সম্পদ ও সস্তাশ্রমের যোগান সুনিশ্চিত করা  -- উচ্ছেদ জমি থেকে, উচ্ছেদ সম্পত্তি থেকে, উচ্ছেদ স্থায়ী কর্মসংস্থান থেকে এবং তার অনুসঙ্গ হিসাবে উচ্ছেদ লোকায়ত ধর্ম, সংস্কৃতি, বিশ্বাস থেকে। সেটা ইউরোপে পুঁজিবাদের বিকাশে এনসার্কেলম্যান্ট মুভমেন্ট থেকে এই কারণে গুণগতভাবে আলাদা যে, সেসময় অতিরিক্ত শ্রমের উৎপাদনী পুনর্বাসন ও আমেরিকায় সম্প্রসারণের সুযোগ ছিল।  কিন্তু পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সংকটের দীর্ঘকালীন টিঁকে থাকা ও গভীর হওয়ার ফলে বিনিয়োগকারী উন্নত দেশ এবার নিজ দেশে ম্যানুফেকচারিং বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে গুরুত্ত্ব দিচ্ছে। বিশ্ব ফিনান্সিয়েলাইজেশনে চিনের গভীর সংযুক্তি সত্ত্বেও, চিনের একদলীয় শাসন ও রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের ফলে দ্রুত অভ্যন্তরিণ ম্যানুফেকচারিং বিনিয়োগের উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার সুবিধা রয়েছে। ফলে চিন বিনিয়োগের বাজারে দাপট দেখাচ্ছে। সে যা'ই হোক, অসমের উচ্ছেদ নিয়ে আলোচনায় প্রাসঙ্গিক প্রেক্ষিত হিসাবে বিশ্ব-ব্যবস্থার সামান্য উল্লেখ প্রয়োজন ছিল। 

কিন্তু যদি বিশ্ব-পুঁজিবাদী সংকট থেকে বেরিয়ে আসা না যায়, তাহলে দমনমূলক নীতি দিয়ে তো আর একটি ব্যবস্থা টিঁকিয়ে রাখা যায় না -- সার্বিক ধ্বংস বা সমাজবাদী উত্থান নিশ্চিত। বিশ্ব-পুঁজিবাদ যখন নতুন পথের সন্ধানে বিভিন্ন ধরনের প্রেসক্রিপশন নিয়ে তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক বিতর্ক করছে, তখনই মধ্যভারতে মাওয়িস্ট দমনের এবং আসামে বাংলাদেশি তাড়ানোর অছিলায় এমন বিভৎস উচ্ছেদ অভিযান কেন?

ভারত কী অর্থনীতিতে নয়াউদারবাদ ও রাজনীতিতে বর্তমান চিনা পথ অনুসরণের জাতীয় বিকাশের রণনীতির এক ককটেল তৈরি করছে? সমগ্র দেশজুড়ে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ম্যানুফেকচারিং নেটওয়ার্ক, মাও আমলের ভূমি সংস্কার ও সমবায়িক উৎপাদন, বিশ্বশক্তি হিসাবে চিনের উত্থানের ফলে বাইরে থেকে চিনের অভ্যন্তরে মূল্যের ট্রান্সফার, একদলীয় শাসন, রাষ্ট্রীয় আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদের শক্তিশালী উপস্থিতি ইত্যাদির যে সুবিধা চিনের রয়েছে, তার কোনটাই ভারতের নেই। উন্নয়শীল দেশগুলির মধ্যে ভারত খানিকটা এগিয়ে এই কারণেই যে "কারেন্সি একচ্যাঞ্জ রেট" রিজিম ভেঙে বাজার-নির্ভর করার ক্ষেত্রে ভারত দীর্ঘ সময় নিয়েছে এবং সেটা সম্ভব হয়েছে ইউপিএ জমানায় সরকারের উপর ভারতীয় বৈচিত্র্য ও গণতন্ত্রের চাপ থাকার ফলে। এনডিএ জমানায় সেই চাপ ভেঙে ফেলার আয়োজন করা হচ্ছে এবং এক দমনমূলক রাষ্ট্রবাদ চালুর প্রচেষ্টা চলছে। 

সেই রাষ্ট্রবাদ টিঁকে থাকবে কীসের উপর ভিত্তি করে? সেই ভিত তৈরির আয়োজন করতে মরিয়া হয়ে লেগেছে বিজেপি সরকার, এক বিকৃত পুঁজিবাদী বিনিয়োগ ও বিকাশকে ত্বরান্বিত করতে চাইছে। দেশীয় পুঁজিপতিদের বিনিয়োগ সম্ভব অনুন্নত-প্রযুক্তির উৎপাদন-প্রক্রিয়ায়, যেমন মাইনিং, বিদ্যুৎ উৎপাদন, পরিকাঠামো ইত্যাদি। হাই-টেকনোলজিতে যেতে হলে চিনের ও প্রধানত আমেরিকার উপর নির্ভর করতে হবে। কিন্তু ৯০ শতাংশের অধিক মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমিয়ে দিয়ে এক ক্ষুদ্র উচ্চ ও মধ্যবিত্ত উপভোক্তার চাহিদার বাজার দিয়ে এই দেশীয় বিনিয়োগকে লাভজনক বিনিয়োগ হিসাবে কীভাবে টিঁকিয়ে রাখা সম্ভব, যখন বিশ্ব রপ্তানী বাণিজ্যে ভাঁটার টান চলছে, যখন উৎপাদনে কাঁচামালের চাহিদা কমছে, যখন ভোগ্যপণ্য উৎপাদনে চাহিদার সংকট উৎপাদনী হাতিয়ার উৎপাদনের সেক্টরকেও গ্রাস করে নিচ্ছে? পুঁজিবাদের নিজস্ব বিকাশের গতিকে আঁটকে দিয়ে ভারত সরকার তার সমাধানে মিলিটারি উৎপাদনী বিনিয়োগে গুরুত্ত্ব দিচ্ছে, কিন্তু সেখানেও একই সমস্যা। কর্মসংস্থান তৈরির বদলে কর্মসংকোচনের মাধ্যমে সস্তা শ্রম ও সম্পদের যোগান নিশ্চিত করে "রাষ্ট্রবাদ" টিঁকে থাকতে পারে না, বড়জোর সাময়িক কিছু রাজনৈতিক সাফল্য অর্জন করা যেতে পারে, কিন্তু ভারতীয় নির্বাচনী গণতন্ত্রও তাতে পথ আগলে দাঁড়িয়ে যেতে পারে। অথবা এক অত্যাচারী স্বল্পম্যাদী শাসনব্যবস্থা সার্বিক বিশৃঙ্খলা কিংবা নতুন সমাজবাদী রাজনীতির জন্ম দিতে পারে। 

আসামের মিনারেল রিসোর্স লুট করা নিয়ে সম্প্রতি সামাজিক পরিসরে আলোচনা চলছে। আসামে তেল, গ্যাস, কয়লার উপস্থিতির কথা আগে যেটুকু জানা ছিল, সেখানেও বিনিয়োগ ও উৎপাদন কমেছে বৈ বাড়েনি। মেঘালয়ের কয়লা আধুনিক টার্বাইনের জন্য উপযোগী কী না এনিয়ে মতান্তর আছে। শালেকাঠি তাপ-বিদ্যুৎ প্রকল্প ব্যক্তিগতকরণেও লাভজনক হয়নি। সুতরাং মাটির নিচের সম্পদ থাকলেই যে তার উত্তোলনে লাভজনক বিনিয়োগ হবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই, আর ব্যক্তি পুঁজি অনিশ্চয়তার বাজারে এতো বৃহৎ বিনিয়োগে আসবে না, রাষ্ট্রের লোন নেওয়ার সুযোগও সীমিত। অভ্যন্তরিণ বাজার থেকে লোন নেওয়ার সুযোগ কম, বিদেশী লোন নিলে পরনির্ভরতা ও লুটপাট এবং দেশের জনগণকে আরও সংকটের মধ্যে ঠেলে দেবে। তাতে রাষ্ট্রবাদ কী করে টিঁকে থাকবে? তথাপি বিনিয়োগের জন্য রাষ্ট্রবাদী বিজেপির মরিয়া প্রয়াসে উচ্ছেদের রাজনীতি ছাড়া বিকল্প নেই। তাদের জন্য ক্যাচ-২২ সিচ্যুয়েশন।

কিন্তু আসামের উচ্ছেদের অর্থনীতি ও রাজনীতিতে বিজেপি সরকার যে সাময়িক সাফল্য আশা করছে, তার ভিত্তি কী? এর বিরুদ্ধে কী কোন রণনীতি রচিত হতে দেখা যাচ্ছে? স্মরণে রাখবেন, বিজেপির রাষ্ট্রবাদের বিপরীতে কংগ্রেসের বৈচিত্র্যবাদ অর্থনীতির ক্ষেত্রে বিশেষ কোন পার্থক্য রচনা করছে না। এক অদ্ভূত বিরোধ, যেখানে ঘোষিত রাজনৈতিক মতাদর্শ আলাদা হলেও অর্থনীতিতে মিল -- এই অন্তর্নিহিত বিরোধের মীমাংসা কীভাবে হবে সেটা এখনই বলা মুস্কিল। কর্ণাটকে কংগ্রেস সরকার শ্রেণিসংগ্রামের চাপে পিছু হঠছে, বিজেপির মত আগ্রাসী মনোভাব দেখাচ্ছে না, কিন্তু শ্রেণিসংগ্রামের চাপ যেখানে নেই সেখানে অর্থনীতিতে বিজেপির মত আচরণ করছে।

আসামের সমাজের গভীরে চূড়ান্ত হতাশার পরিবেশ।মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের শিক্ষিত সন্তানদের কোন "কোয়ালিটি জব" কিংবা সামাজিক মর্যাদাসম্পন্ন চাকুরির নিশ্চয়তা নেই, সার্বিক বেকারত্ব সমাধানের কোন আশার আলো দেখা যাচ্ছে না। এমতাবস্থায় সমাজের এই অংশটি, এমনকি গ্রামাঞ্চলেও, যে কোন প্রলোভনে বিশাল কায়িক শ্রমজীবীদের সুরক্ষার বিষয়কে পদদলিত করতেও দ্বিধাবোধ করছে না, তাদের কাছে এক ডেসপারেট পরিস্থিতি যেখানে নতুন সমাজ-গঠনের বিকল্প রাজনীতির স্বপ্নও অনুপস্থিত।  

আসাম সরকার যখন সার্বিকভাবে আম-জনতার উপর উচ্ছেদের আক্রমণ নামিয়ে এনেছে, তখন যে জনগোষ্ঠীর উপর আক্রমণ নামিয়েছে তদের মধ্যেও প্রত্যক্ষ বা অপ্রত্যক্ষ সামাজিক ভিত বজায় রাখতে সক্ষম হচ্ছে, এমনকি বিজেপির রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মধ্যেও। কীভাবে? তার উত্তরে সবাই বলবে, জনগোষ্ঠীগত বিভাজন তৈরির রাজনীতি।

কিন্তু আক্রমণ যখন সর্বগ্রাসী, তখন জনগোষ্ঠীগত ঐক্য গড়ে ওঠার বাস্তবতা দেখা দেয় এবং সেই ঐক্য গড়ে ওঠার লক্ষণও দেখা যাচ্ছে, সেজন্যই বিজেপি সরকার চিন্তিত। কিন্তু তাদের একটা পরিস্থিতিগত সুবিধাও রয়েছে। গ্রামাঞ্চলে মধ্যশ্রেণির অংশ এই উন্নয়ন মডেলের বলপ্রয়োগে উচ্ছেদ মানসিকভাবে মানতে না পারলেও, নিজের জনগোষ্ঠীর শ্রমজীবীদের স্বার্থ বলিদান দিয়ে উন্নয়নের কাজের ঠিকা, সাপ্লাই এবং কর্মসংস্থানের সুযোগের আশায় শাসকের পক্ষ নিয়ে নিতে পারে, এমনকি আজকের এই হতাশাজনক ও বিকল্পহীন আর্থিক-রাজনীতির পরিবেশে এরা অর্থ রোজগারের আশায় নিজ জনগোষ্ঠীর সস্তা-লেবার সাপ্লায়ার হতেও পিছপা না হতে পারে। অর্থাৎ শাসকের কাছে অত্যন্ত ভঙুর হলেও মধ্যস্তত্ত্বভোগীর এক স্তরতন্ত্রের কাঠমো তৈরির সুযোগ রয়েছে, বিশেষ করে সেই পরিস্থিতিতে যখন বিকল্প সমাজ-গঠনের রাজনীতির কোন স্বপ্নও অনুপস্থিত। আর জনগোষ্ঠীগতভাবে বিভাজিত শ্রমজীবীরা যখন তাদের সমাজের একাংশ শ্রেণিকে শাসকের পক্ষ নিতে দেখে, তখন তারা আত্মসমর্পণে ও ভাগ্যকে মেনে নিতে বাধ্য হয়। 

সুতরাং উচ্ছেদের অর্থনীতি ও রাজনীতিকে উচ্ছেদ করতে হলে দ্রুত শ্রমজীবীদের ঐক্য গড়ার, শ্রমজীবীদের সংগঠন গড়ার প্রতি মনোনিবেশ ও ফোকাস রাখতে হবে, একাজটি দ্রুত করতে হবে গণসংগ্রাম ও নির্বাচনী সংগ্রামের অভ্যন্তরেই। শ্রমজীবীদের সংগঠন ও সংগ্রামের বিকাশ বিকল্প রাজনীতির ন্যারেটিভকেও মূলস্রোতে নিয়ে আসবে। পঞ্চায়েতের ও গ্রামসভার হাতে অধিক ক্ষমতা, আমূল ভূমি সংস্কার, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগে স্থানীয় বিনিয়োগের সরকারি সুবিধা ও সুরক্ষা এবং সর্বোপরি সমবায়িক উৎপাদনের বিষয় সংগ্রামী এজেণ্ডায় প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ সংগ্রামের গর্ভে ধীরে ধীরে স্থান করে দিতে হবে।

 

Posted by স্বাভিমান

 

ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের দুর্বলতা

বিগত শতিকার আশির দশক পর্যন্ত রাজনীতিতে ট্রেড-ইউনিয়নের প্রভাব বিদ্যমান ছিল। বামপন্থী ট্রেড-ইউনিয়নের ভূমিকা শুধু  নির্দ্দিষ্ট শিল্পের অভ্যন্তরে পুঁজি ও শ্রমের মধ্যেকার দর-কষাকষিতে সীমাবদ্ধ ছিল না, রাষ্ট্র ও  রাজনীতিকে সমাজবাদের দিকে পরিচালিত করার অক্ষ হিসাবেও ট্রেড-ইউনিয়ন পাওয়ারকে পরিচালিত করার লক্ষ্য ছিল।১৮৫০ সালের পর রেলপথ নির্মাণের ফলে বোম্বে, কলকাতা, বিহারে যে অসংখ্য জুটমিল ও কয়লাখনি গড়ে ওঠে তাতে শিল্প-শ্রমিকের উদ্ভব ঘটে। শ্রমিকের উপর অতি-শোষণের বিরুদ্ধে শ্রমিকদের বিক্ষোভ ধর্মঘট ছিল তখন স্বঃতস্ফূর্ত। ১৯২০ সালে শ্রমিকের অর্থনৈতিক অধিকার, সামাজিক ন্যায় ও স্বাধীনতার রাজনৈতিক লক্ষ্যে গঠিত হয় এআইটিইউসি এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে তার প্রভাব পরিলক্ষিত হয়, বিশেষ করে ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের ফলে। স্বাধীনতা-উত্তর পর্যায়ে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, নবরত্ন ইত্যাদির মাধ্যমে শিল্পায়নের ফলে বৃহৎ উদ্যোগকে কেন্দ্র করে ইণ্ডাস্ট্রী ও ফিনান্স সেক্টরে ট্রেড-ইউনিয়নের শক্তির ক্ষমতা বৃদ্ধি ঘটতে থাকে। কল্যাণকামী ও বৈচিত্র্যের গণতন্ত্রের নীতিতে প্রতিটি নতুন অভ্যন্তরিণ সামাজিক সংঘাত নতুন নতুন দলের জন্ম দেয় এবং প্রতিটি দল তার নিজস্ব রাজনৈতিক-শক্তি প্রদর্শনে ট্রেড-ইউনিয়ন পাওয়ারকে ব্যবহার করতে একেকটি ইউনিয়ন খুলে বসে। রাজনৈতিক দলের নিজস্ব ক্ষমতার স্বার্থের বাইরে বৃহত্তর কোন রাজনৈতিক লক্ষ্যে ট্রেড-ইউনিয়ন পাওয়ার সর্বশেষ ব্যবহৃত হয় ১৯৭৪ সালের রেল ধর্মঘটে যা ইন্দিরা-ইমার্জেন্সির বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলন গড়ে ওঠার আত্মশক্তির যোগান দেয়। দুর্নীতি ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বিরুদ্ধে ক্ষোভের উপর ভিত্তি করে ১৯৭৪ সালের মধ্যবিত্ত বা বুদ্ধিজীবী-শ্রমিকদের পরিচালিত গুজরাটের নবনির্মাণ আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৭৫ সালে বিহারে জয়প্রকাশ নারায়ণের উত্থান ঘটে বটে, কিন্তু ইমার্জেন্সি বিরোধী আন্দোলনের মূল প্রেরণাশক্তি ছিল রেল-ধর্মঘট।

উনিশ আশির দশকের সময় থেকে ট্রেড-ইউনিয়ন মানে রাজনৈতিক দলের হুকুমে পরিচালিত একটি প্রত্যঙ্গে পরিণত হতে শুরু করে, এবং ধীরে ধীরে ডান-বাম সব ট্রেড-ইউনিয়নের ক্ষমতা এতোটাই দুর্বল হয়ে পড়ে যে রাজনৈতিক দলের শক্তির উৎস ট্রেড-ইউনিয়ন থেকে সরে যায়। শ্রম ও উৎপাদন প্রক্রিয়ার উদারবাদী পুনর্গঠনের ফলে স্থান-কালে বহুধা-বিভাজিত শ্রমিকের সঙ্ঘশক্তি নিঃশেষ করে দেয়। যুদ্ধোত্তর পর্যায়ের ওয়েলফেয়ার অর্থনীতির নিউ-ডিলের পর্যায় সমাপ্ত হয়ে শ্রমিকের উপর পুঁজির সর্বগ্রাসী আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে মনোগত ও ঘোষিত লক্ষ্যে বামেরা শ্রমিকের পক্ষ অবলম্বন করলেও, সমগ্র রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে পুঁজি এবং তার পরিণতিতে ডান ও বামের মধ্যে বিশেষ কোন পার্থক্য করতে জনগণ ব্যর্থ হয়, রাজনীতিবিহীন নৈতিকতার ও বৈচিত্র্যের গণতন্ত্রের একমাত্র বৈশিষ্ট্যে জনগণ কিছুকাল বামেদের আলাদা করে চেনে। কিন্তু রাজনীতিই নিয়ন্ত্রক লেনিনের সেই কথার সূত্র ধরে যখন সমাজ নিজেই দুর্নীতিকে রাজনীতির অঙ্গ বিবেচনা করার মত টিনা ফ্যাক্টরের পরিস্থিতিতে উপনীত হয়, তখন বামপন্থাকে জনবিচ্ছিন্ন অকর্মণ্য রাজনীতি ভাবতে শুরু করে।

১৮৫০ ব্রিটিশের রেলপথ নির্মাণের সূত্র ধরে শিল্পায়নের মাধ্যমে যে শিল্প-শ্রমিকের আবির্ভাব ঘটেছিল এবং ধীরে ধীরে স্বতঃস্ফূর্ত শ্রমিক বিক্ষোভ ও ধর্মঘট হতে শুরু করেছিল তারই ধারাবাহিকতায় ১৯২০ সালে একমাত্র ট্রেড-ইউনিয়ন এআইটিইউসি গড়ে ওঠে যা স্বাধীনতা ও স্বাধীনতা-উত্তর রাজনীতিকে প্রভাবিত করে, সেই গতিপথে গুরুত্ত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় বিশ্ব-যুদ্ধোত্তর ওয়েলফেয়ার ইকোনমি।

ওয়াশিংটন কনশেনশাস ভাঙছে, আমেরিকার অভ্যন্তরে ওয়াল স্ট্রিট ও মেইন-স্ট্রিটের সংঘাত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা আনিশ্চিত। পুঁজি আরেকটি পুনর্গঠনের সন্ধানে। জিলে জোঁ থেকে আরব স্প্রিং হয়ে অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট এর মত দেশে দেশে শ্রমজীবীদের বিক্ষোভ সমগ্র বিশ্বকে তটস্থ করে রেখেছে, কিন্তু তার রাজনৈতিক ম্যানিফেস্টেশন ঘটছে সাম্রাজ্যবাদী শিবিরগুলোর  মধ্যেকার টানাপোড়েনে কিংবা সহাবস্থানে। কোন বিকল্প বাম-রাজনীতিতে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে না। আমেরিকায় বার্ণি-সেণ্ডার্স বাম-ঘেঁষা রাজনীতির আশা জাগিয়ে আমেরিকার বাইপোলার-কনশেন্সাসের একটি মেরু ডেমোক্র্যাটদের সাথে জুড়ে গেলেন। ইউকে’র কর্বিন লেবার পার্টিকেও কাঠগড়ায় তুলে নিজের স্বাতন্ত্র্য ধরে রাখতে পেরেছেন, শ্রমজীবী মানুষ যে বাম বিকল্প চায় সেটা তারও ইঙ্গিতবহ।

এই প্রসঙ্গ আর বিস্তৃত না করে, একথা নির্দ্ধিধায় বলে দেওয়া যায় যে, বাম রাজনীতি এক বিভ্রান্তির অবস্থায় রয়েছে। শ্রমিকের সঙ্ঘশক্তি বা ট্রেড-ইউনিয়ন পাওয়ার গড়ে তুলতে পৌনঃপুনিক ব্যর্থতা কোন এক তাত্ত্বিক বিভ্রান্তির দিকে ইঙ্গিত করে। ট্রেড- ইউনিয়নের ক্ষেত্রে এই বিভ্রান্তির সূত্রপাত শ্রেণির ধারণায় বিভ্রান্তি থেকে। ভারতের মত দেশে যেখানে ইনফর্মাল সেক্টর সবসময়ই বৃহৎ সেখানে প্রথমে ধরে নেওয়া হলো শিল্প-শ্রমিকরাই শ্রমিকশ্রেণি। নিওলিবারেল পুনর্গঠনের পর যখন নতুন নতুন বৃহৎ ইনফর্মাল সেক্টরের জন্ম হয়েছে, ফর্মাল সেক্টরের নির্দ্দিষ্ট স্থান-কালে যুক্ত সংগঠিত শ্রমিকের পরিসর প্রায় ভেঙে গেছে, তখন শ্রেণি প্রশ্নে বিভ্রান্তি ট্রেড-ইউনিয়ন শক্তিকে দুর্বল করে কিংবা ইকোনমিজমের গাড্ডায় নিমজ্জিত করে। ইনফর্মাল সেক্টর হচ্ছে এমন একটা সেক্টর যেখানে শ্রমিকদের মধ্যে শ্রেণি-বর্ণের ফিউশন প্রায় সম্পূর্ণ। অথচ ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের নিজস্ব রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার কোন পথের সন্ধান না দিয়ে, বামপন্থীরা রাজনীতির নামে ওটার খানিক সেটার খানিক দিয়ে এক মিশ্রণ পরিবেশন করছেন।

মার্ক্সসীয় দৃষ্টিভঙ্গীতে শ্রেণির হিসাব নেওয়া হয় উদ্বৃত্ত মূল্য উৎপাদন, আহরণ ও বন্টনের প্রক্রিয়া দিয়ে। সেই হিসাবে সমাজ-ব্যবস্থারও মূল্যায়ন করা হয়। উদ্বৃত্ত শ্রম যখন অর্থের সাথে বিনিময় হয় তখন উদ্বৃত্ত মূল্য এবং যখন সামগ্রী হিসাবে ব্যবহার বা ভোগ করা হয় তখন উদ্বৃত্ত সামগ্রী হিসাবে দেখা দেয়। উদ্বৃত্ত আহরণের তিনটি বিকল্প রয়েছে। প্রথম দু’টি রূপ বিভিন্ন মাত্রায় আমাদের সমাজে বিদ্যমান। প্রত্যক্ষ উৎপাদক থেকে আহৃত উদ্বৃত্ত সমাজের বিভিন্ন অংশের মধ্যে বন্টিত হয় এবং এভাবেই উদ্বৃত্ত শ্রমজীবীদের শ্রম-প্রক্রিয়ায় এক সূত্রে গাঁথে।

শ্রেণিসংগ্রামের দু’টি গুরুত্ত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, উদ্বৃত্ত তৈরি ও আহরণকে পরিবর্তনের জন্য লড়াই করা যাতে উৎপাদন খণ্ডের চরিত্র পরিবর্তন হয় এবং উদ্বৃত্তের বিতরণ ও প্রাপ্তির পরিবর্তনের জন্য সংগ্রাম যা শ্রমিকের অস্তিত্বের পরিবেশকে পরিবর্তন করে যা উদ্বৃত্ত তৈরি ও আহরণের চরিত্রকে প্রতিফলিত করে এবং সম্পদের বিতরণ ও প্রাপ্তির প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে। পরিবারের অভ্যন্তর থেকে শুরু করে প্রতিটি অনুষ্ঠান, প্রতিষ্ঠান ও সামাজিক সম্পর্কে এই বিতরণ ও প্রাপ্তির সংগ্রাম নিয়ত চলতে থাকে, এবং সেটাই চলমান শ্রেণিসংগ্রাম, সেখানে ট্রেড-ইউনিয়ন মুভমেন্টকে সম্পদ বা উদ্বৃত্তের সেই অভ্যন্তরিণ আহরণ ও বিতরণ নির্ধারণ করতে হয়, যাতে শ্রেণি-শ্রক্তির ভারসাম্য বোঝা যায় এবং প্রত্যক্ষ উৎপাদকের সংগ্রামকে ট্রেড-ইউনিয়ন মুভমেন্টের সাথে জুড়ে নেওয়া যায়।

একটি নির্দিষ্ট বৃহৎ শিল্পের পরিসরে উদ্বৃত্ত বন্টনের অভ্যন্তরিণ পরিবর্তনগুলো আমরা সহজেই অনুধাবন করতে পারি, অ্যারিস্ট্রোক্রেসি লেবার কিংবা মধ্যসত্ত্বভোগী শক্তিশালী হচ্ছে, প্রত্যক্ষ উৎপাদকের থেকে মধ্যস্তত্বভোগীর বহুবিধ স্তর তৈরি হচ্ছে, না সমসত্ত্বা তৈরি হচ্ছে তা আমরা সহজেই যাচাই করে দেখতে পারি এবং সে অনুযায়ী সংগ্রামের রূপ নির্ধারণ করতে পারি।  কিন্তু ইনফর্মাল সেক্টারের বাড়বাড়ন্তে বহুধা-বিভক্ত শ্রমিকেদের মধ্যে এই শ্রম-প্রক্রিয়ার হিসাব নেওয়া বেশ দুরূহ কাজ এবং সমসত্ত্বা্র বৈশিষ্ট্য যে ইউনিয়ন-পাওয়ার গড়ে তোলার উপাদান এবং সমাজ-পরিবর্তনের রাজনৈতিক লক্ষ্যকে ইউনিয়ন সংগ্রামের নিজস্ব গতিপথে সামিল হওয়ার পূর্বশর্ত তা নির্ধারণ করা কঠিন।

সেক্ষত্রে শ্রেণিকে আমরা শুধু উদ্বৃত্ত মূল্যের উৎপাদন, আহরণ ও বিতরণের বৈশিষ্ট্য দিয়ে চিহ্নিত করতে পারি না। আমাদের শ্রেণির প্রশ্নটিকে ক্রমাগত পরিবর্তনীয় চেতনার স্তর দিয়ে নির্ধারণ করতে হয়। অর্থাৎ শ্রমিকশ্রেণি আসলে শ্রমিকের অস্তিত্বের এক হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া (continuous transformation of being into becoming)এই শ্রমিক কারা? তারা শ্রমজীবীদের বিভিন্ন অংশ যারা জাতি-ধর্ম-বর্ণের কিংবা উদ্বৃত্ত শ্রমের মূল্য বা সামগ্রীর ভাগ-বাটোয়ারার সংঘাতের বহুবিধ চেতনাকে বয়ে বেড়াচ্ছে। অর্থাৎ শ্রমিকরা অর্থনৈতিক ও সামজিক দিক থেকে বহুবিধ ক্যাটাগরির। কিন্তু বিশাল সার্ভিস সেক্টরের দুনিয়াতে ইনফর্মাল শ্রমিকদের মধ্যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্যাটাগরির একটা “অটোম্যাটিক ফিউশন” প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে। অথচ বহুধাবিভক্ত শ্রমিক যেহেতু কোন সমস্তত্বাকে প্রতিনিধিত্ব করে না, ফলে শ্রমিকশ্রেণির সংগ্রামে শ্রমিকশ্রেণির রাজনীতিতে রূপান্তর ঘটে না। তাই শ্রেণির প্রশ্নকে নির্ধারিত করতে হবে তার সংগ্রামের গর্ভে। শ্রেণিকে তার সংগ্রাম থেকে আলাদা করে দেখার এবং সংগ্রামী ঐক্যের মাধ্যমে চেতনার যৌথতার দিকে ক্রমাগত পরিবর্তন ও উল্লম্ফনের মাধ্যমে শ্রেণির ধারনাকে আত্মস্থ না করতে পারার যান্ত্রিকতা ট্রেড-ইউনিয়ন মুভমেন্টে বাম-বিচ্ছিন্নতা ঘটিয়েছে।

গণিতের ভাষায় শ্রেণিকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায় ঃ The continuous derivative of a function of a matrix which contains various economic and social categories as its variable elements.

Posted by স্বাভিমান

 গরুখুটি, গরু, কৃষক-শ্রমিক ও বাম – রাজনীতি

গরুখুটির কৃষি ও ডায়েরি প্রকল্প উচ্ছেদ হওয়া কৃষকদের কৃষি-সমবায়ের অধীনে আনা হোক।

 

দরং জেলার শিপাঝার রাজস্বচক্রের অভিশপ্ত গ্রাম গরুখুটি আবারও সংবাদ শিরোনামে। অভিশপ্ত এই কারণে যে ২০২১ সালে এবং ২০২৫ সালে দু’দুবার প্রচারের আলোকে এসেছে বাসিন্দাদের বিপর্যয়ের প্রতীক হিসাবে।

২০২১ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর, বিশাল পুলিশ বাহিনী ও বুলডোজার নিয়ে গরিব চাষিদের উচ্ছেদ অভিযান। ১২ বছরের এক নাবালক সহ পুলিশের গুলিতে দুইজনের মৃত্যু ৯৬৬ পরিবারের ৭০০০ কৃষিজীবীদের উচ্ছেদ।

যে কোন মানবিক পরিস্থিতি দেখা দিলে হৃদয় কাঁপিয়ে দেওয়া সেই বিখ্যাত “শকুন ও একটি ছোট্ট মেয়ের” ছবি আজও বিশ্ববাসী স্মরণ করে। ২০১১ সালে জানা যায় সুদানের দুর্ভিক্ষ-পীড়িত এই ছোট্ট শিশুটি ছিল ছেলে যে হামাগুড়ি দিয়ে আধ কিলোমিটার দূরে রাষ্ট্রসংঘের ত্রাণশিবিরের দিকে যাচ্ছিল এবং সে নাকি বেঁচেও যায়। এই ছবির জন্য চিত্রকার পুলিৎজার পুরষ্কার পান। কিন্তু পুরষ্কার পাওয়ার চার মাস পরে অন্তর্দহনে আত্মহত্যা করেন। কেন তিনি ছবি না তোলে শিশুটিকে বাঁচাতে গেলেন না, এই প্রশ্ন তাঁর মনকে বিদীর্ণ করছিল। 

সেদিন গরুখুটিতে উচ্ছেদ অভিযানে পুলিশের সাথে যাওয়া এক ফটোগ্রাফারকে ঠিক তার বিপরীত ভূমিকায় দেখে বিশ্ববাসী আঁৎকে উঠেছিল। ছবিতে দেখা যাচ্ছিল পুলিশের গুলিতে নিহত এক কৃষকের মরদেহের উপর উঠে এক চিত্রকারের উদ্যাম নৃত্য। সমাজের অভ্যন্তরে কতটা ঘৃণার চাষ হলে এমন বর্বর বহিঃপ্রকাশ ঘটতে পারে। উচ্ছেদ হওয়া লোকরা ছিল গরিব মুসলিম চাষি।

 ঘটনার পর সরেজমিনে সমীক্ষা করতে “জন হস্তক্ষেপ” সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকে জওহর লাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি ড০ বিকাশ বাজপাই, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের দেশবন্ধু কলেজের অধ্যাপক বিশ্বজিত মহান্তি এবং ওড়িষ্যার বরিষ্ঠ সাংবাদিক ও সমাজকর্মী শ্রী সুধীর পট্টনায়েক আসেন। উচ্ছেদ অভিযানের পর গরুখুটিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে লিখিত কোন বাধা না থাকলেও, গোটা এলাকা পুলিশ আরক্ষী বাহিনী দিয়ে ঘেরাও করে রাখা হয়েছিল, বাইরের পর্যবেক্ষকদের প্রবেশ অলখিতভাবে নিষিদ্ধ ছিল। অসম মজুরি শ্রমিক ইউনিয়নের গুয়াহাটির কর্মকর্তারা স্থানীয় গ্রামবাসীদের সহযোগিতায়  নদিপথে নৌকা দিয়ে ও বাকী পথ মোটরবাইকে অকুস্থলে পৌঁছার আয়োজন করেন এবং গরুখুটি ১, ২ এবং ৩ নম্বর গ্রামবাসীদের সাথে কথা বলার সুযোগ ঘটে। সাথে ছিলেন অসম মজুরি শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক। পরবর্তীতেও সেখানে সভা করা হয় এবং গুয়াহাটী চচলের উচ্ছেদ বিরোধী সমাবেশেও সেখান থেকে গ্রামবাসীরা যোগ দেন। জন হস্তক্ষেপের জারি করা দীর্ঘ প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, ৯ জুন ২০২১ সালেই সরকার ঘোষণা করে দিয়েছিল যে ৭৭০০০ বিঘা জমি ইতিমধ্যে সম্পূর্ণ দখলমুক্ত করা হয়েছে, এবং মন্ত্রী – এমএলএ’দের বলা হয়েছে তা ব্যবহারের জন্য পদক্ষেপ নিতে। ৭৭০০০ বিঘার অর্ধেকের বেশি জমি ব্রহ্মপুত্রের নদি-ভাঙনে আগেই তলিয়ে গেছিল। উচ্ছেদ প্রক্রিয়ায় কোন আইন-কানুন মানা হয়নি। প্রতিবেদন ২০১৯ সালের কর্পোরেট-বান্ধব ভূমি  নীতি বাতিলের দাবি জানায়। এই ঘটনার উপর ঘটিত তদন্ত কমিশন ২০২৪ সালে রিপোর্ট জমা দেয়, রিপোর্টে জোরজবরদস্তি উচ্ছেদের জন্য সরকারের সমালোচনা করে এবং ষোলটি পরামর্শ দেয় যার মধ্যে আসাম ল্যাণ্ড ও রেভিন্যু রেগুলেশনে যে দুর্বলতাগুলি আছে তা দূর করার পরামর্শ অন্যতম।

 সাম্প্রদায়িক সামাজিক বাতাবরণকে কাজে লাগিয়ে সংখ্যালঘু অঞ্চলে উচ্ছেদ অভিযানকে সামাজিক মান্যতা প্রদানের চেষ্টা হলেও কর্পোরেট স্বার্থ হিন্দু-মুসলিম বিচারে আগ্রহী নয়, ফলে উচ্ছেদ এখন জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সর্বত্র এক রাষ্ট্রীয় অভিযান হিসাবে পরিণত হয়ছে, জনগণও তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াচ্ছে। সরকারকে জনগণের মনের কথা শুনতেই হবে।

 

এই উচ্ছেদ অভিযান কেন? সেখানে কমার্শিয়াল ডায়েরি ফার্মিং প্রকল্প করা হবে যার জন্য ইউনিট প্রতি ৫০ লাখ টাকা সরকারি ভর্তুকি থাকবে। ৫.৫ কোটি টাকার গরুখুটি এগ্রিকালচারেল প্রজেক্ট হবে। প্রথমটির জন্য গুজরাট থেকে ৩০০ গির গরু আনা হয়, কিন্তু প্রজেক্ট পরিত্যক্ত হওয়ায় কংগ্রেস দলনেতা গৌরব গগৈ অভিযোগ তোলেন যে আসলে প্রজেক্টের নামে গরুগুলি শাসক দলের  মন্ত্রী এমএলএদের সস্তায় বিক্রি করে দেওয়া হয়। মুখ্যমন্ত্রী তার জবাবে বলেছেন, গরুগুলি অসুস্থ হওয়ায় প্রজেক্ট স্টাফরা তা ম্যানেজ করতে পারছিল না, তাই এমএলএ মন্ত্রীরা সস্তায় কিনে নেন। এরপরই মুখ্যমন্ত্রী তাঁর বহুল ব্যবহৃত ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করেন, তিনি বলেন, গোমাংস ভক্ষনকারীরা কীভাবে গরু চুরির ও সুরক্ষার কথা বলে।

সামগ্রীক বিচারে বিষয়টি শুধু দুর্নীতির নয়, নির্বাচনী তরজা হিসাবে দুর্নীতির বয়ানবাজী চলতে থাকবে, আর সমাজে দুর্নীতিও চলতে থাকবে। উচ্ছেদ হওয়া ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ দুর্নীতির এই তরজায় কতটা প্রভাবিত হোন বলা মুস্কিল, তাদের প্রতিষ্ঠান-বিরোধী ক্ষোভ পুঞ্জিভূত হয় তাদের জীবনের দুর্দশা থেকে। সেই হিসাব থেকে আমাদের সমাধানের পথ খুঁজতে হয়।

ইউনিয়ন সূত্রে জানা যায় যে উচ্ছেদ ও উচ্ছেদ-পরবর্তী পর্যায়ে মুসলিম কিছু ধনি লোক উচ্ছেদের পক্ষে ও উচ্ছেদের পর আইনি ও গনতান্ত্রিক সংগ্রামকে প্রশমিত করতে মুসলিম কৃষক ও মেহনতি মানুষদের বাগে আনার ভূমিকা পালন করেন। মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা কেন এরকম ভূমিকা নিলেন? কারণ একদিকে বর্তমানের প্রেক্ষিতে তাদের জমানো অর্থকে উৎপাদনী পুঁজিতে রূপান্তরিত করার জন্য আমজনতাকে সাথে নিয়ে চাপ সৃষ্টি করার মত শ্রেণিশক্তি ও মানসিকতা তাদের নেই, অন্যদিকে কর্পোরেট মানি-পাওয়ার এতোটাই শক্তিশালী যে শুধু তাদের নিজস্ব পুঁজির মুনাফার স্বার্থ নয়, সরকারি অর্থও কীভাবে ব্যয় হবে সেই রাজনীতিকেও নির্ধারণ করে। ফলে কর্পোরেট ও সরকারি পুঁজি বিনিয়োগের মাধ্যমে রেন্ট-মুনাফার যে ভ্যালু-চেইন তাতে ছোট শরিক হিসাবে মেজোরিটির দালালদের তলায় সংখ্যালঘু দালাল হিসাবে তাদের প্রবেশ ঘটে, সেই সুবাদে টাকা খাটিয়ে কিছু আয় করে নেওয়া যায়।

ফলে উন্নয়নের এমন একটি আধুনিক ও উপযোগী কৃষি ও দুগ্ধ প্রকল্পও লুণ্ঠণের উদ্যোগে পরিণত হয়। আমরা চাই না কোন সম্প্রদায় পশ্চাদপদ ভূমি-সম্পর্কে পড়ে থাকুক, আমরা চাই না উৎপাদনের আধুনিক উপকরণ ব্যবহার বাধাপ্রাপ্ত হোক। কিন্তু আধুনিকতার নামে যেভাবে উচ্ছেদ করে নিঃস্ব মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি করা হচ্ছে, যেভাবে সরকারি বিনিয়োগের দুর্নীতি ও কর্পোরেট পুঁজির লুণ্ঠনকে প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে তাতে গ্রামীণ স্বনির্ভর অর্থনীতির আর কিছু অবশিষ্ট থাকবে না, ল্যুম্পেন কালচার ও দালালি আয়ের বাতাবরণে সামাজিক বিকৃতি দেখা দেবে। সরকারকে এর থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী গোমাংস ভক্ষণের সাথে এই ইস্যু জুড়ে দিয়ে, প্রকারান্তরে গ্রামীণ কৃষক ও শ্রমিকের অধিকারের উপর দাঁড়িয়ে স্বনির্ভর অর্থনীতি গড়ার রাজনীতিকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিলেন। এখানেই বাম-রাজনীতির উত্থানের প্রাসঙ্গিকতা। এটা অনস্বীকার্য যে আসামে দক্ষ ও পরিশ্রমী কৃষক ও শ্রমিকের সবচাইতে বড় অংশ বাঙালি-মুসলমান। পশচাদপদ কৃষি অর্থনীতিতে তাঁরা কৃষি-উৎপাদনের জন্য গো-পালন করতেন, আবার সেই উৎপাদন প্রক্রিয়ার সাথে সামঞ্জস্য রেখে গো-মাংস ভক্ষনের জন্য গরু বিক্রি করতেন – এই প্রাণি-হত্যা নিছক হত্যা নয়, এটা জীবন ও প্রাণশক্তির অঙ্গ।

এখন চাষের জমিতে আর গরু ও লাঙ্গল ব্যববহার হয় না। গ্রামীণ কৃষকরা গরু পালেন এবং  তা পালনের অনুপযুক্ত হলে তা বিক্রি করেন – তাতে তাদের পারিবারিক ভরণপোষণের খানিকটা সাশ্রয় হয়। অর্থাৎ গো-মাংস ভক্ষণ কৃষক পরিবারের সাশ্রয়ের জন্য গ্রামীণ কমার্শিয়্যাল বাজারের চাহিদা তৈরির উপাদান, হিন্দু-মুসলিম সবাই সেই বাজারের চাহিদার জোগান ধরতেই দুধেল গাই ছাড়া দুধ দেওয়া বন্ধ করেছে তেমন গরু কিংবা বলদ বিক্রি করে সামান্য আয় করেন। দেশ বিদেশের কমার্শিয়্যাল বাজারের যোগানদার হিসাবে কারা বড় বড় গোমাংসের ব্যবসায় জড়িত সেটা তো সর্বজনবিদিত।

সুতরাং গোমাংস ভক্ষণের মত একটি আর্থিক ও খাদ্যাভাসের বিষয়কে যখন সাম্প্রদায়িক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা হয়, তখন তা শ্রমিক-কৃষকদের উপর গিয়ে আঘাত পড়ে, আঘাত পড়ে স্বনির্ভর গ্রামীণ অর্থনীতির অবশিষ্টকে ভেঙে ফেলার লক্ষ্যে। কিন্তু উপরের কর্পোরেট ও সরকারি পুঁজির লুণ্ঠনের নিয়মে সেই ধর্ম-রাজনীতি সহায়ক ভূমিকা পালন করে। বরাকের সুপারি ব্যবসার ক্ষেত্রেও আমরা একই পরিণতি দেখেছি, স্থানীয় ব্যবসায়িদের আত্মসমর্পণ ও ক্ষুদ্র কৃষকদের হাহাকার। সেখানেই বাম-রাজনীতির প্রাসঙ্গিকতা, সেটা শুধু দুর্নীতি বিরোধিতা দিয়ে মোকাবিলা করা সম্ভব নয়।

আমাদের দাবি তুলতে হবে, গরুখুটির কৃষি ও ডায়েরি প্রকল্প উচ্ছেদ হওয়া কৃষকদের কৃষি-সমবায়ের অধীনে আনা হোক।  

স্বাভিমান:SWABHIMAN Headline Animator

^ Back to Top-উপরে ফিরে আসুন