গরুখুটি, গরু, কৃষক-শ্রমিক ও বাম – রাজনীতি
গরুখুটির
কৃষি ও ডায়েরি প্রকল্প উচ্ছেদ হওয়া কৃষকদের কৃষি-সমবায়ের অধীনে আনা হোক।
দরং জেলার শিপাঝার রাজস্বচক্রের অভিশপ্ত গ্রাম গরুখুটি আবারও সংবাদ শিরোনামে। অভিশপ্ত এই কারণে যে ২০২১ সালে এবং ২০২৫ সালে দু’দুবার প্রচারের আলোকে এসেছে বাসিন্দাদের বিপর্যয়ের প্রতীক হিসাবে।
২০২১ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর, বিশাল পুলিশ বাহিনী ও বুলডোজার নিয়ে গরিব চাষিদের উচ্ছেদ অভিযান। ১২ বছরের এক নাবালক সহ পুলিশের গুলিতে দুইজনের মৃত্যু ৯৬৬ পরিবারের ৭০০০ কৃষিজীবীদের উচ্ছেদ।
যে কোন
মানবিক পরিস্থিতি দেখা দিলে হৃদয় কাঁপিয়ে দেওয়া সেই বিখ্যাত “শকুন ও একটি ছোট্ট
মেয়ের” ছবি আজও বিশ্ববাসী স্মরণ করে। ২০১১ সালে জানা যায় সুদানের দুর্ভিক্ষ-পীড়িত
এই ছোট্ট শিশুটি ছিল ছেলে যে হামাগুড়ি দিয়ে আধ কিলোমিটার দূরে রাষ্ট্রসংঘের ত্রাণশিবিরের দিকে যাচ্ছিল এবং সে নাকি বেঁচেও যায়। এই ছবির জন্য চিত্রকার পুলিৎজার
পুরষ্কার পান। কিন্তু পুরষ্কার পাওয়ার চার মাস পরে অন্তর্দহনে আত্মহত্যা করেন। কেন
তিনি ছবি না তোলে শিশুটিকে বাঁচাতে গেলেন না, এই প্রশ্ন তাঁর মনকে বিদীর্ণ করছিল।
সেদিন গরুখুটিতে উচ্ছেদ অভিযানে পুলিশের সাথে যাওয়া এক ফটোগ্রাফারকে ঠিক তার বিপরীত ভূমিকায় দেখে বিশ্ববাসী আঁৎকে উঠেছিল। ছবিতে দেখা যাচ্ছিল পুলিশের গুলিতে নিহত এক কৃষকের মরদেহের উপর উঠে এক চিত্রকারের উদ্যাম নৃত্য। সমাজের অভ্যন্তরে কতটা ঘৃণার চাষ হলে এমন বর্বর বহিঃপ্রকাশ ঘটতে পারে। উচ্ছেদ হওয়া লোকরা ছিল গরিব মুসলিম চাষি।
সাম্প্রদায়িক সামাজিক বাতাবরণকে কাজে লাগিয়ে সংখ্যালঘু অঞ্চলে উচ্ছেদ অভিযানকে সামাজিক মান্যতা প্রদানের চেষ্টা হলেও কর্পোরেট স্বার্থ হিন্দু-মুসলিম বিচারে আগ্রহী নয়, ফলে উচ্ছেদ এখন জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সর্বত্র এক রাষ্ট্রীয় অভিযান হিসাবে পরিণত হয়ছে, জনগণও তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াচ্ছে। সরকারকে জনগণের মনের কথা শুনতেই হবে।
এই উচ্ছেদ অভিযান কেন? সেখানে কমার্শিয়াল ডায়েরি ফার্মিং প্রকল্প করা হবে যার জন্য ইউনিট প্রতি ৫০ লাখ টাকা সরকারি ভর্তুকি থাকবে। ৫.৫ কোটি টাকার গরুখুটি এগ্রিকালচারেল প্রজেক্ট হবে। প্রথমটির জন্য গুজরাট থেকে ৩০০ গির গরু আনা হয়, কিন্তু প্রজেক্ট পরিত্যক্ত হওয়ায় কংগ্রেস দলনেতা গৌরব গগৈ অভিযোগ তোলেন যে আসলে প্রজেক্টের নামে গরুগুলি শাসক দলের মন্ত্রী এমএলএদের সস্তায় বিক্রি করে দেওয়া হয়। মুখ্যমন্ত্রী তার জবাবে বলেছেন, গরুগুলি অসুস্থ হওয়ায় প্রজেক্ট স্টাফরা তা ম্যানেজ করতে পারছিল না, তাই এমএলএ মন্ত্রীরা সস্তায় কিনে নেন। এরপরই মুখ্যমন্ত্রী তাঁর বহুল ব্যবহৃত ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করেন, তিনি বলেন, গোমাংস ভক্ষনকারীরা কীভাবে গরু চুরির ও সুরক্ষার কথা বলে।
সামগ্রীক বিচারে বিষয়টি শুধু দুর্নীতির নয়, নির্বাচনী তরজা হিসাবে দুর্নীতির বয়ানবাজী চলতে থাকবে, আর সমাজে দুর্নীতিও চলতে থাকবে। উচ্ছেদ হওয়া ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ দুর্নীতির এই তরজায় কতটা প্রভাবিত হোন বলা মুস্কিল, তাদের প্রতিষ্ঠান-বিরোধী ক্ষোভ পুঞ্জিভূত হয় তাদের জীবনের দুর্দশা থেকে। সেই হিসাব থেকে আমাদের সমাধানের পথ খুঁজতে হয়।
ইউনিয়ন সূত্রে জানা যায় যে উচ্ছেদ ও উচ্ছেদ-পরবর্তী পর্যায়ে মুসলিম কিছু ধনি লোক উচ্ছেদের পক্ষে ও উচ্ছেদের পর আইনি ও গনতান্ত্রিক সংগ্রামকে প্রশমিত করতে মুসলিম কৃষক ও মেহনতি মানুষদের বাগে আনার ভূমিকা পালন করেন। মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা কেন এরকম ভূমিকা নিলেন? কারণ একদিকে বর্তমানের প্রেক্ষিতে তাদের জমানো অর্থকে উৎপাদনী পুঁজিতে রূপান্তরিত করার জন্য আমজনতাকে সাথে নিয়ে চাপ সৃষ্টি করার মত শ্রেণিশক্তি ও মানসিকতা তাদের নেই, অন্যদিকে কর্পোরেট মানি-পাওয়ার এতোটাই শক্তিশালী যে শুধু তাদের নিজস্ব পুঁজির মুনাফার স্বার্থ নয়, সরকারি অর্থও কীভাবে ব্যয় হবে সেই রাজনীতিকেও নির্ধারণ করে। ফলে কর্পোরেট ও সরকারি পুঁজি বিনিয়োগের মাধ্যমে রেন্ট-মুনাফার যে ভ্যালু-চেইন তাতে ছোট শরিক হিসাবে মেজোরিটির দালালদের তলায় সংখ্যালঘু দালাল হিসাবে তাদের প্রবেশ ঘটে, সেই সুবাদে টাকা খাটিয়ে কিছু আয় করে নেওয়া যায়।
ফলে উন্নয়নের এমন একটি আধুনিক ও উপযোগী কৃষি ও দুগ্ধ প্রকল্পও লুণ্ঠণের উদ্যোগে পরিণত হয়। আমরা চাই না কোন সম্প্রদায় পশ্চাদপদ ভূমি-সম্পর্কে পড়ে থাকুক, আমরা চাই না উৎপাদনের আধুনিক উপকরণ ব্যবহার বাধাপ্রাপ্ত হোক। কিন্তু আধুনিকতার নামে যেভাবে উচ্ছেদ করে নিঃস্ব মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি করা হচ্ছে, যেভাবে সরকারি বিনিয়োগের দুর্নীতি ও কর্পোরেট পুঁজির লুণ্ঠনকে প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে তাতে গ্রামীণ স্বনির্ভর অর্থনীতির আর কিছু অবশিষ্ট থাকবে না, ল্যুম্পেন কালচার ও দালালি আয়ের বাতাবরণে সামাজিক বিকৃতি দেখা দেবে। সরকারকে এর থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী গোমাংস ভক্ষণের সাথে এই ইস্যু জুড়ে দিয়ে, প্রকারান্তরে গ্রামীণ কৃষক ও শ্রমিকের অধিকারের উপর দাঁড়িয়ে স্বনির্ভর অর্থনীতি গড়ার রাজনীতিকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিলেন। এখানেই বাম-রাজনীতির উত্থানের প্রাসঙ্গিকতা। এটা অনস্বীকার্য যে আসামে দক্ষ ও পরিশ্রমী কৃষক ও শ্রমিকের সবচাইতে বড় অংশ বাঙালি-মুসলমান। পশচাদপদ কৃষি অর্থনীতিতে তাঁরা কৃষি-উৎপাদনের জন্য গো-পালন করতেন, আবার সেই উৎপাদন প্রক্রিয়ার সাথে সামঞ্জস্য রেখে গো-মাংস ভক্ষনের জন্য গরু বিক্রি করতেন – এই প্রাণি-হত্যা নিছক হত্যা নয়, এটা জীবন ও প্রাণশক্তির অঙ্গ।
এখন চাষের জমিতে আর গরু ও লাঙ্গল ব্যববহার হয় না। গ্রামীণ কৃষকরা গরু পালেন এবং তা পালনের অনুপযুক্ত হলে তা বিক্রি করেন – তাতে তাদের পারিবারিক ভরণপোষণের খানিকটা সাশ্রয় হয়। অর্থাৎ গো-মাংস ভক্ষণ কৃষক পরিবারের সাশ্রয়ের জন্য গ্রামীণ কমার্শিয়্যাল বাজারের চাহিদা তৈরির উপাদান, হিন্দু-মুসলিম সবাই সেই বাজারের চাহিদার জোগান ধরতেই দুধেল গাই ছাড়া দুধ দেওয়া বন্ধ করেছে তেমন গরু কিংবা বলদ বিক্রি করে সামান্য আয় করেন। দেশ বিদেশের কমার্শিয়্যাল বাজারের যোগানদার হিসাবে কারা বড় বড় গোমাংসের ব্যবসায় জড়িত সেটা তো সর্বজনবিদিত।
সুতরাং গোমাংস ভক্ষণের মত একটি আর্থিক ও খাদ্যাভাসের বিষয়কে যখন সাম্প্রদায়িক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা হয়, তখন তা শ্রমিক-কৃষকদের উপর গিয়ে আঘাত পড়ে, আঘাত পড়ে স্বনির্ভর গ্রামীণ অর্থনীতির অবশিষ্টকে ভেঙে ফেলার লক্ষ্যে। কিন্তু উপরের কর্পোরেট ও সরকারি পুঁজির লুণ্ঠনের নিয়মে সেই ধর্ম-রাজনীতি সহায়ক ভূমিকা পালন করে। বরাকের সুপারি ব্যবসার ক্ষেত্রেও আমরা একই পরিণতি দেখেছি, স্থানীয় ব্যবসায়িদের আত্মসমর্পণ ও ক্ষুদ্র কৃষকদের হাহাকার। সেখানেই বাম-রাজনীতির প্রাসঙ্গিকতা, সেটা শুধু দুর্নীতি বিরোধিতা দিয়ে মোকাবিলা করা সম্ভব নয়।
আমাদের দাবি তুলতে হবে, গরুখুটির কৃষি ও ডায়েরি প্রকল্প উচ্ছেদ হওয়া কৃষকদের কৃষি-সমবায়ের অধীনে আনা হোক।