Posted by স্বাভিমান

 

ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের দুর্বলতা

বিগত শতিকার আশির দশক পর্যন্ত রাজনীতিতে ট্রেড-ইউনিয়নের প্রভাব বিদ্যমান ছিল। বামপন্থী ট্রেড-ইউনিয়নের ভূমিকা শুধু  নির্দ্দিষ্ট শিল্পের অভ্যন্তরে পুঁজি ও শ্রমের মধ্যেকার দর-কষাকষিতে সীমাবদ্ধ ছিল না, রাষ্ট্র ও  রাজনীতিকে সমাজবাদের দিকে পরিচালিত করার অক্ষ হিসাবেও ট্রেড-ইউনিয়ন পাওয়ারকে পরিচালিত করার লক্ষ্য ছিল।১৮৫০ সালের পর রেলপথ নির্মাণের ফলে বোম্বে, কলকাতা, বিহারে যে অসংখ্য জুটমিল ও কয়লাখনি গড়ে ওঠে তাতে শিল্প-শ্রমিকের উদ্ভব ঘটে। শ্রমিকের উপর অতি-শোষণের বিরুদ্ধে শ্রমিকদের বিক্ষোভ ধর্মঘট ছিল তখন স্বঃতস্ফূর্ত। ১৯২০ সালে শ্রমিকের অর্থনৈতিক অধিকার, সামাজিক ন্যায় ও স্বাধীনতার রাজনৈতিক লক্ষ্যে গঠিত হয় এআইটিইউসি এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে তার প্রভাব পরিলক্ষিত হয়, বিশেষ করে ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের ফলে। স্বাধীনতা-উত্তর পর্যায়ে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, নবরত্ন ইত্যাদির মাধ্যমে শিল্পায়নের ফলে বৃহৎ উদ্যোগকে কেন্দ্র করে ইণ্ডাস্ট্রী ও ফিনান্স সেক্টরে ট্রেড-ইউনিয়নের শক্তির ক্ষমতা বৃদ্ধি ঘটতে থাকে। কল্যাণকামী ও বৈচিত্র্যের গণতন্ত্রের নীতিতে প্রতিটি নতুন অভ্যন্তরিণ সামাজিক সংঘাত নতুন নতুন দলের জন্ম দেয় এবং প্রতিটি দল তার নিজস্ব রাজনৈতিক-শক্তি প্রদর্শনে ট্রেড-ইউনিয়ন পাওয়ারকে ব্যবহার করতে একেকটি ইউনিয়ন খুলে বসে। রাজনৈতিক দলের নিজস্ব ক্ষমতার স্বার্থের বাইরে বৃহত্তর কোন রাজনৈতিক লক্ষ্যে ট্রেড-ইউনিয়ন পাওয়ার সর্বশেষ ব্যবহৃত হয় ১৯৭৪ সালের রেল ধর্মঘটে যা ইন্দিরা-ইমার্জেন্সির বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলন গড়ে ওঠার আত্মশক্তির যোগান দেয়। দুর্নীতি ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বিরুদ্ধে ক্ষোভের উপর ভিত্তি করে ১৯৭৪ সালের মধ্যবিত্ত বা বুদ্ধিজীবী-শ্রমিকদের পরিচালিত গুজরাটের নবনির্মাণ আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৭৫ সালে বিহারে জয়প্রকাশ নারায়ণের উত্থান ঘটে বটে, কিন্তু ইমার্জেন্সি বিরোধী আন্দোলনের মূল প্রেরণাশক্তি ছিল রেল-ধর্মঘট।

উনিশ আশির দশকের সময় থেকে ট্রেড-ইউনিয়ন মানে রাজনৈতিক দলের হুকুমে পরিচালিত একটি প্রত্যঙ্গে পরিণত হতে শুরু করে, এবং ধীরে ধীরে ডান-বাম সব ট্রেড-ইউনিয়নের ক্ষমতা এতোটাই দুর্বল হয়ে পড়ে যে রাজনৈতিক দলের শক্তির উৎস ট্রেড-ইউনিয়ন থেকে সরে যায়। শ্রম ও উৎপাদন প্রক্রিয়ার উদারবাদী পুনর্গঠনের ফলে স্থান-কালে বহুধা-বিভাজিত শ্রমিকের সঙ্ঘশক্তি নিঃশেষ করে দেয়। যুদ্ধোত্তর পর্যায়ের ওয়েলফেয়ার অর্থনীতির নিউ-ডিলের পর্যায় সমাপ্ত হয়ে শ্রমিকের উপর পুঁজির সর্বগ্রাসী আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে মনোগত ও ঘোষিত লক্ষ্যে বামেরা শ্রমিকের পক্ষ অবলম্বন করলেও, সমগ্র রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে পুঁজি এবং তার পরিণতিতে ডান ও বামের মধ্যে বিশেষ কোন পার্থক্য করতে জনগণ ব্যর্থ হয়, রাজনীতিবিহীন নৈতিকতার ও বৈচিত্র্যের গণতন্ত্রের একমাত্র বৈশিষ্ট্যে জনগণ কিছুকাল বামেদের আলাদা করে চেনে। কিন্তু রাজনীতিই নিয়ন্ত্রক লেনিনের সেই কথার সূত্র ধরে যখন সমাজ নিজেই দুর্নীতিকে রাজনীতির অঙ্গ বিবেচনা করার মত টিনা ফ্যাক্টরের পরিস্থিতিতে উপনীত হয়, তখন বামপন্থাকে জনবিচ্ছিন্ন অকর্মণ্য রাজনীতি ভাবতে শুরু করে।

১৮৫০ ব্রিটিশের রেলপথ নির্মাণের সূত্র ধরে শিল্পায়নের মাধ্যমে যে শিল্প-শ্রমিকের আবির্ভাব ঘটেছিল এবং ধীরে ধীরে স্বতঃস্ফূর্ত শ্রমিক বিক্ষোভ ও ধর্মঘট হতে শুরু করেছিল তারই ধারাবাহিকতায় ১৯২০ সালে একমাত্র ট্রেড-ইউনিয়ন এআইটিইউসি গড়ে ওঠে যা স্বাধীনতা ও স্বাধীনতা-উত্তর রাজনীতিকে প্রভাবিত করে, সেই গতিপথে গুরুত্ত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় বিশ্ব-যুদ্ধোত্তর ওয়েলফেয়ার ইকোনমি।

ওয়াশিংটন কনশেনশাস ভাঙছে, আমেরিকার অভ্যন্তরে ওয়াল স্ট্রিট ও মেইন-স্ট্রিটের সংঘাত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা আনিশ্চিত। পুঁজি আরেকটি পুনর্গঠনের সন্ধানে। জিলে জোঁ থেকে আরব স্প্রিং হয়ে অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট এর মত দেশে দেশে শ্রমজীবীদের বিক্ষোভ সমগ্র বিশ্বকে তটস্থ করে রেখেছে, কিন্তু তার রাজনৈতিক ম্যানিফেস্টেশন ঘটছে সাম্রাজ্যবাদী শিবিরগুলোর  মধ্যেকার টানাপোড়েনে কিংবা সহাবস্থানে। কোন বিকল্প বাম-রাজনীতিতে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে না। আমেরিকায় বার্ণি-সেণ্ডার্স বাম-ঘেঁষা রাজনীতির আশা জাগিয়ে আমেরিকার বাইপোলার-কনশেন্সাসের একটি মেরু ডেমোক্র্যাটদের সাথে জুড়ে গেলেন। ইউকে’র কর্বিন লেবার পার্টিকেও কাঠগড়ায় তুলে নিজের স্বাতন্ত্র্য ধরে রাখতে পেরেছেন, শ্রমজীবী মানুষ যে বাম বিকল্প চায় সেটা তারও ইঙ্গিতবহ।

এই প্রসঙ্গ আর বিস্তৃত না করে, একথা নির্দ্ধিধায় বলে দেওয়া যায় যে, বাম রাজনীতি এক বিভ্রান্তির অবস্থায় রয়েছে। শ্রমিকের সঙ্ঘশক্তি বা ট্রেড-ইউনিয়ন পাওয়ার গড়ে তুলতে পৌনঃপুনিক ব্যর্থতা কোন এক তাত্ত্বিক বিভ্রান্তির দিকে ইঙ্গিত করে। ট্রেড- ইউনিয়নের ক্ষেত্রে এই বিভ্রান্তির সূত্রপাত শ্রেণির ধারণায় বিভ্রান্তি থেকে। ভারতের মত দেশে যেখানে ইনফর্মাল সেক্টর সবসময়ই বৃহৎ সেখানে প্রথমে ধরে নেওয়া হলো শিল্প-শ্রমিকরাই শ্রমিকশ্রেণি। নিওলিবারেল পুনর্গঠনের পর যখন নতুন নতুন বৃহৎ ইনফর্মাল সেক্টরের জন্ম হয়েছে, ফর্মাল সেক্টরের নির্দ্দিষ্ট স্থান-কালে যুক্ত সংগঠিত শ্রমিকের পরিসর প্রায় ভেঙে গেছে, তখন শ্রেণি প্রশ্নে বিভ্রান্তি ট্রেড-ইউনিয়ন শক্তিকে দুর্বল করে কিংবা ইকোনমিজমের গাড্ডায় নিমজ্জিত করে। ইনফর্মাল সেক্টর হচ্ছে এমন একটা সেক্টর যেখানে শ্রমিকদের মধ্যে শ্রেণি-বর্ণের ফিউশন প্রায় সম্পূর্ণ। অথচ ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের নিজস্ব রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার কোন পথের সন্ধান না দিয়ে, বামপন্থীরা রাজনীতির নামে ওটার খানিক সেটার খানিক দিয়ে এক মিশ্রণ পরিবেশন করছেন।

মার্ক্সসীয় দৃষ্টিভঙ্গীতে শ্রেণির হিসাব নেওয়া হয় উদ্বৃত্ত মূল্য উৎপাদন, আহরণ ও বন্টনের প্রক্রিয়া দিয়ে। সেই হিসাবে সমাজ-ব্যবস্থারও মূল্যায়ন করা হয়। উদ্বৃত্ত শ্রম যখন অর্থের সাথে বিনিময় হয় তখন উদ্বৃত্ত মূল্য এবং যখন সামগ্রী হিসাবে ব্যবহার বা ভোগ করা হয় তখন উদ্বৃত্ত সামগ্রী হিসাবে দেখা দেয়। উদ্বৃত্ত আহরণের তিনটি বিকল্প রয়েছে। প্রথম দু’টি রূপ বিভিন্ন মাত্রায় আমাদের সমাজে বিদ্যমান। প্রত্যক্ষ উৎপাদক থেকে আহৃত উদ্বৃত্ত সমাজের বিভিন্ন অংশের মধ্যে বন্টিত হয় এবং এভাবেই উদ্বৃত্ত শ্রমজীবীদের শ্রম-প্রক্রিয়ায় এক সূত্রে গাঁথে।

শ্রেণিসংগ্রামের দু’টি গুরুত্ত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, উদ্বৃত্ত তৈরি ও আহরণকে পরিবর্তনের জন্য লড়াই করা যাতে উৎপাদন খণ্ডের চরিত্র পরিবর্তন হয় এবং উদ্বৃত্তের বিতরণ ও প্রাপ্তির পরিবর্তনের জন্য সংগ্রাম যা শ্রমিকের অস্তিত্বের পরিবেশকে পরিবর্তন করে যা উদ্বৃত্ত তৈরি ও আহরণের চরিত্রকে প্রতিফলিত করে এবং সম্পদের বিতরণ ও প্রাপ্তির প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে। পরিবারের অভ্যন্তর থেকে শুরু করে প্রতিটি অনুষ্ঠান, প্রতিষ্ঠান ও সামাজিক সম্পর্কে এই বিতরণ ও প্রাপ্তির সংগ্রাম নিয়ত চলতে থাকে, এবং সেটাই চলমান শ্রেণিসংগ্রাম, সেখানে ট্রেড-ইউনিয়ন মুভমেন্টকে সম্পদ বা উদ্বৃত্তের সেই অভ্যন্তরিণ আহরণ ও বিতরণ নির্ধারণ করতে হয়, যাতে শ্রেণি-শ্রক্তির ভারসাম্য বোঝা যায় এবং প্রত্যক্ষ উৎপাদকের সংগ্রামকে ট্রেড-ইউনিয়ন মুভমেন্টের সাথে জুড়ে নেওয়া যায়।

একটি নির্দিষ্ট বৃহৎ শিল্পের পরিসরে উদ্বৃত্ত বন্টনের অভ্যন্তরিণ পরিবর্তনগুলো আমরা সহজেই অনুধাবন করতে পারি, অ্যারিস্ট্রোক্রেসি লেবার কিংবা মধ্যসত্ত্বভোগী শক্তিশালী হচ্ছে, প্রত্যক্ষ উৎপাদকের থেকে মধ্যস্তত্বভোগীর বহুবিধ স্তর তৈরি হচ্ছে, না সমসত্ত্বা তৈরি হচ্ছে তা আমরা সহজেই যাচাই করে দেখতে পারি এবং সে অনুযায়ী সংগ্রামের রূপ নির্ধারণ করতে পারি।  কিন্তু ইনফর্মাল সেক্টারের বাড়বাড়ন্তে বহুধা-বিভক্ত শ্রমিকেদের মধ্যে এই শ্রম-প্রক্রিয়ার হিসাব নেওয়া বেশ দুরূহ কাজ এবং সমসত্ত্বা্র বৈশিষ্ট্য যে ইউনিয়ন-পাওয়ার গড়ে তোলার উপাদান এবং সমাজ-পরিবর্তনের রাজনৈতিক লক্ষ্যকে ইউনিয়ন সংগ্রামের নিজস্ব গতিপথে সামিল হওয়ার পূর্বশর্ত তা নির্ধারণ করা কঠিন।

সেক্ষত্রে শ্রেণিকে আমরা শুধু উদ্বৃত্ত মূল্যের উৎপাদন, আহরণ ও বিতরণের বৈশিষ্ট্য দিয়ে চিহ্নিত করতে পারি না। আমাদের শ্রেণির প্রশ্নটিকে ক্রমাগত পরিবর্তনীয় চেতনার স্তর দিয়ে নির্ধারণ করতে হয়। অর্থাৎ শ্রমিকশ্রেণি আসলে শ্রমিকের অস্তিত্বের এক হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া (continuous transformation of being into becoming)এই শ্রমিক কারা? তারা শ্রমজীবীদের বিভিন্ন অংশ যারা জাতি-ধর্ম-বর্ণের কিংবা উদ্বৃত্ত শ্রমের মূল্য বা সামগ্রীর ভাগ-বাটোয়ারার সংঘাতের বহুবিধ চেতনাকে বয়ে বেড়াচ্ছে। অর্থাৎ শ্রমিকরা অর্থনৈতিক ও সামজিক দিক থেকে বহুবিধ ক্যাটাগরির। কিন্তু বিশাল সার্ভিস সেক্টরের দুনিয়াতে ইনফর্মাল শ্রমিকদের মধ্যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্যাটাগরির একটা “অটোম্যাটিক ফিউশন” প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে। অথচ বহুধাবিভক্ত শ্রমিক যেহেতু কোন সমস্তত্বাকে প্রতিনিধিত্ব করে না, ফলে শ্রমিকশ্রেণির সংগ্রামে শ্রমিকশ্রেণির রাজনীতিতে রূপান্তর ঘটে না। তাই শ্রেণির প্রশ্নকে নির্ধারিত করতে হবে তার সংগ্রামের গর্ভে। শ্রেণিকে তার সংগ্রাম থেকে আলাদা করে দেখার এবং সংগ্রামী ঐক্যের মাধ্যমে চেতনার যৌথতার দিকে ক্রমাগত পরিবর্তন ও উল্লম্ফনের মাধ্যমে শ্রেণির ধারনাকে আত্মস্থ না করতে পারার যান্ত্রিকতা ট্রেড-ইউনিয়ন মুভমেন্টে বাম-বিচ্ছিন্নতা ঘটিয়েছে।

গণিতের ভাষায় শ্রেণিকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায় ঃ The continuous derivative of a function of a matrix which contains various economic and social categories as its variable elements.

0 comments:

স্বাভিমান:SWABHIMAN Headline Animator

^ Back to Top-উপরে ফিরে আসুন