এনরেগা আন্দোলন ও ‘টিম আন্নার’ গ্রামসসভা আন্দোলনে সাফল্য আসলে ভারতীয় সমাজের ‘বিপ্লবী অগ্রগতিতে’ পরিণত হবে
Posted by Labels: Arunodoy, capitalism, peasant movement
(অরুণোদয়ের
জন্য)
অরূপা
মহাজন
সুতরাং
রাষ্ট্র ও সরকারের বিভিন্ন
প্রতিষ্ঠানে আসীন আমাদের
নীতি-নির্ধারকদের
প্রভাবিত করার দুই পরস্পর
বিপরীতমুখী ও বৈরী সম্পর্কে
আবদ্ধ শক্তি প্রতিনিয়ত ক্রিয়াশীল
রয়েছে। আইএমএফ,
ওয়ার্ল্ড
ব্যাঙ্ক,
গ্লোবাল
ওলিগোপলিজ বা বৃহৎ পুঁজির
মালিক ও কর্পোরেট দুনিয়ার
প্রভাবে সরকার ‘নিও
লিবারেল’ পলিসি
অনুসরণ করে। আবার এই পলিসির
কুপ্রভাবের বিরুদ্ধে গণ-বিদ্রোহ
যে পরিমাণে নীতি-নির্ধারকদের
প্রভাবিত করতে পারে সেই পরিমাণে
পিছু হঠতে বাধ্য করে। যেহেতু
বিদ্রোহ বা গণ-মতামতকে
বিদ্যমান প্রাতিষ্ঠানিক
গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্য
দিয়েই নীতি-নির্ধারকদের
প্রভাবিত করতে হয়,
তাই
দুর্বল সামাজিক শ্রেণির
মানুষের জন্য দুটি উপায় খোলা
থাকে। হয় আন্দোলনকে এমন স্তরে
নিয়ে যাওয়া যাতে আন্দোলনের
প্রভাবাধীন অঞ্চলে রাষ্ট্রের
উপস্থিতি বজায় রাখা দুঃসাধ্য
হয়ে ওঠে,
নাহয়
এই আন্দোলনের পক্ষে প্রভাবশালী
‘মধ্যবিত্ত শ্রেণির’
এক গুরুত্বপূর্ণ অংশের
মধ্যে মতামত তৈরি করা যাতে
প্রশাসনযন্ত্রের অন্দরমহলে
বিষয়বস্তুর পক্ষে লবি গড়ে
ওঠে। দু’টি নির্বাচনের
অন্তর্বর্তী সময়ে সরকারের
নীতিগ্রহণ ও তার প্রয়োগে
জনগণের মতামত প্রতিফলিত করার
অন্য কোন পথ খোলা থাকে না ।
তথাপিও নির্বাচনে পরিত্যাজ্য
হওয়ার ভয়েও নীতি-নির্ধারকরা
নিও-লিবারেল
অর্থনীতির পথ অনুসরণের ক্ষেত্রে
ধীরে চলার নীতি গ্রহণ করতে
অনেক সময়েই বাধ্য হয়। সুতরাং
নিও-লিবারেল
অর্থনীতির গ্রোথ-নির্ভর
উন্নয়ন মডেলের ক্ষেত্রে
সবচাইতে উপযুক্ত পরিবেশ হতে
পারে প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্রকে
খর্ব করা ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে
সরকারী নিয়ন্ত্রণ উঠিয়ে দিয়ে
বেসরকারীকরণ করা। উল্টোদিকে
সামাজিক উন্নয়নের মডেলের
জন্য উপযুক্ত পরিবেশ হচ্ছে
রাষ্ট্রীয় কাঠামোর গণতান্ত্রিক
পুনর্গঠন ও রাষ্ট্রীয়করণের
মাধ্যমে উন্নয়ন প্রক্রিয়ার
উপর সামাজিক নিয়ন্ত্রণ কায়েম
করা,
প্রাইভেট
বা পাবলিক-প্রাইভেট
মডেলের পরিবর্তে স্টেট
(পাবলিক)-সোসাল
মডেল তৈরি করা। নিও-লিবারেলাইজেশন
বা গ্লোবেলাইজেশনের বিরুদ্ধে
সামাজিক উন্নয়নের জন্য সংগ্রামের
একটি মুখ্য দিক হচ্ছে গণতন্ত্রকে
প্রসারিত করার সংগ্রাম।
গণতন্ত্রকে প্রসারিত করার
সংগ্রাম আরও একটি দিক থেকে
গুরুত্বপূর্ণ। পুঁজিবাদের
বিকল্প হিসেবে এতাবৎ গড়ে ওঠা
সমাজবাদী প্রকল্পগুলির
বিপর্যয়ের একটি অন্যতম মুখ্য
দিক হচ্ছে এই যে,
পুঁজির
প্রসারণের পর্যায়ে বুর্জোয়া
গণতন্ত্র যে অধিকারগুলো
সুনিশ্চিত করতে পেরেছে,
সমাজবাদী
প্রকল্পে এই গণতন্ত্রকে তো
অতিক্রম করতে পারেইনি,
বরঞ্চ
বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক
অধিকারগুলোকেও অনেকক্ষেত্রে
খর্ব করেছে। ভারতবর্ষের
ক্ষেত্রে তো কলোনিয়াল লিগেসি
বুর্জোয়া গণতন্ত্রকেও খর্ব
করে রেখেছে । সুতরাং গ্লোবেলাইজেশন
বা পুঁজিবাদের বিকল্প নির্মাণ
তো ভারতবর্ষের মত দেশে শুরু
হবে নয়া-গণতন্ত্র
প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। বিকল্প
নির্মাণের যাত্রা শ্রমিক
শ্রেণির পার্টি ও ব্যবস্থায়
গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও প্রসারিত
করার সংগ্রামকে এড়িয়ে গিয়ে
করা যাবে না । শ্রমিক শ্রেণির
পার্টি যদি শ্রেণির সাথে
জৈব-সম্পর্কহীন
‘ভ্যানগার্ড’
হয়,
তাহলে
পার্টির উপর শ্রেণির নিয়ন্ত্রণ
থাকে না,
পার্টি
হয়ে ওঠে সর্বময় এবং এই যুক্তির
অনুশীলনে ধীরে ধীরে পার্টি-কর্তা
বা কর্তাগোষ্ঠী হয়ে ওঠেন
পার্টির নিয়ন্ত্রক। পার্টি
যে রাষ্ট্র পরিচালন করে সেই
রাষ্ট্রীয় কাঠামো যদি থাকে
জনগণের নিয়ন্ত্রণ থেকে অনেক
দূরে তাহলে পার্টি-রাষ্ট্রের
এক জগদ্দল পাথর জনগণের ঘাড়ে
চেপে বসে। এধরণের গণতন্ত্রহীন
কাঠামো যেখানে জনগণ শুধু শাসিত
হওয়ার ভাগিদার,
শাসনের
অন্দরমহল তাদের কাছে রহস্যময়
জগত,
সেরকম
এক কাঠামো বিশ্ব-পুঁজিবাদী
আগ্রাসন স্থায়ীভাবে মোকাবিলা
করতে পারে না,
পুঁজিবাদের
বিকল্প গড়ে তোলার জন্য উপযুক্ত
পরিবেশ হওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে
না। গণতান্ত্রিক পরিবেশ শ্রমিক
শ্রেণিকে সক্রিয় হতে,
পুঁজিবাদী
শোষণের নিয়মকে চিনতে এবং
বিকল্প অর্থনীতি গড়ে তোলার
ক্ষেত্রে উৎসাহী হতে সাহায্য
করে। তাই গণতন্ত্রের জন্য
সংগ্রাম শোষণ-শাসন
ও অসাম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামের
অপরিহার্য পূর্বশর্ত। এই
দৃষ্টিকোণ থেকে ‘আন্না
টিমের’ গ্রামসংসদ
বা গ্রামসভাকে শক্তিশালী
করার মধ্য দিয়ে গণ-ক্ষমতায়নের
জন্য তৃণমূল গণতান্ত্রিক-প্রতিষ্ঠানের
বৈধতা প্রদানের আন্দোলনের
আহ্বান এক গুরুত্বপূর্ণ
পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হতে
পারে। আইনী বৈধতা থেকেও যা
বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা হলো এই
যে দাবি আদায়ের গণ-সক্রিয়তার
মধ্য দিয়ে জনগণ তাকে ব্যবহার
করার পন্থা-পদ্ধতিও
শিখতে আরম্ভ করবে।
এই
গ্রামসভার সাথে আরেকটি বিষয়কে
যদি যুক্ত করা যায় তাহলে ‘নিও
লিবারেলিজমের’ বিরুদ্ধে
সংগ্রামের এক বৃহৎ ক্ষেত্র
তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা প্রবলভাবে
দেখা দেবে। বিশ্ব পুঁজিবাদী
সংকটের দু’টি প্রধান
লক্ষণ হচ্ছে – (১)
ব্যাপক
মাত্রায় বেকারের সংখ্যা ও
সামাজিক অসাম্য বৃদ্ধি অর্থাৎ
বাজারে উৎপাদিত শিল্প-পণ্যের
চাহিদা পড়ে যাওয়া ও সামাজিক
অস্থিরতা দেখা দেওয়া (২)
প্রান্তিক
দেশগুলির শ্রম-সম্পদ
লুণ্ঠনের তীব্রতা বৃদ্ধির
ফলে একের পর এক গণবিক্ষোভ দেখা
দেওয়া। এই পরিস্থিতিতে সামাজিক
ও আর্থিক ভারসাম্য বজায় রাখতে
রাষ্ট্র সামাজিক ব্যয় বৃদ্ধি
করে শ্রম-নিয়োগের
দায়িত্ব নেয়। এরকম এক ঐতিহাসিক
পরিস্থিতিতেই পশ্চিমের দেশে
শ্রমের অধিকার বৈধতা পেয়েছিলো
। ভারতবর্ষে এই অধিকারের
দাবিতে আন্দোলনের ফলে এবং
বর্তমান আর্থিক সংকটের
পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৫ সালে
এনরেগা আইনের মাধ্যমে শ্রমের
অধিকার সাংবিধানিক স্বীকৃতি
লাভ করে । রাষ্ট্রের এই ভূমিকায়
পুঁজিবাদী বাজার অর্থনীতির
ক্ষেত্রে উল্টোদিক থেকে এক
প্রতিকূল পরিস্থিতিরও জন্ম
দেয়। অধিক মাত্রায় শ্রমিক
নিয়োগের ফলে শ্রমিক শ্রেণির
দরকষাকষির ক্ষমতার বৃদ্ধি
ঘটে এবং শ্রমিক শ্রেণি মজুরি
বৃদ্ধি,
ইউনিয়ন
অধিকার ও অন্যান্য সামাজিক
সুরক্ষার দাবিতে আন্দোলনে
নেমে পড়তে আরম্ভ করে। অর্থাৎ
দুই বিপরীতমুখী গতির সংঘাত
অনিবার্য হয়ে ওঠে । একদিকে
বাজারের চাহিদার জন্য শ্রম
নিয়োগ এবং অন্যদিকে দরকষাকষির
ক্ষমতা বৃদ্ধির ফলে বাজারের
নিয়ম ও অতি-মুনাফার
বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণির
চ্যালেঞ্জ।
২০০৫
সালে যে এনরেগা আইন জারি হয়
যা বর্তমানে গোটা ভারতবর্ষে
চালু রয়েছে,
সেই
আইনের অনেক দুর্বলতা থাকা
সত্বেও এর সুফল ফলতে শুরু
করেছে। এই আইনের অনেকগুলি
দুর্বলতার মধ্যে একটি হচ্ছে
৬ নং অনুচ্ছেদের ২৭ নং ধারা
যেখানে বলা হয়েছে যে দুর্নীতির
অভিযোগে কোন এলাকার স্কিম
কেন্দ্র বাতিল করে দিতে পারে
। এই আইন স্বচ্ছ ও দুর্নীতিমুক্তভাবে
প্রয়োগ করতে চূড়ান্ত গণ-সচেতনতা
ও গণ-সক্রিয়তার
প্রয়োজন পড়ে। কারণ স্থানীয়
প্রশাসনযন্ত্র এই আইন প্রয়োগে
উৎসাহী থাকে না এবং এর সঠিক
রূপায়ণ এড়িয়ে যাওয়ার অজুহাত
খুঁজতে থাকে । আইনের এই ধারাকে
রূপায়ণকারী সংস্থাগুলি জনগণকে
ভয় দেখানোর অস্ত্র হিসেবে
ব্যবহার করে । অভিযোগ করলে
যদি প্রকল্পই বাতিল হয়ে যায়
তাহলে শ্রমিকরা অভিযোগ করা
থেকে বিরত থাকাই শ্রেয় মনে
করবে । প্রতিজন ব্যক্তির জন্য
নয়,
পারিবারিকভাবে
১০০ দিনের কাজের বিধান আরেকটি
এরকম দুর্বলতার দিক। আইনের
এরকম অনেক দুর্বলতা এবং প্রয়োগের
ক্ষেত্রে অনেক জটিলতা ও বাধা
থাকা সত্বেও,বিভিন্ন
রাজ্যের তথ্য বলছে যে যেসব
এলাকায় ইতিমধ্যে এনরেগার
কাজের যথেষ্ট পরিমাণে অগ্রগতি
ঘটেছে তার প্রভাবে পার্শ্ববর্তী
এলাকার অন্যান্য
ক্ষেত্রের শ্রমিকদের দরকষাকষির
ক্ষমতা বৃদ্ধি ঘটিয়েছে। পিছিয়ে
পড়া অঞ্চল থেকে কাজের সন্ধানে
শিল্পবহুল অঞ্চলে শ্রমিকদের
প্রব্রজন অসংগঠিত ও কায়িক
শ্রমিকদের দরকষাকষির ক্ষমতা
কমিয়ে দেয়। বহু এলাকায় এধরনের
প্রব্রজন অনেকটা হ্রাস পেয়েছে
। কম মজুরির কাজের ক্ষেত্র
ছেড়ে এনরেগার কাজে চলে আসার
প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে,
কম
মজুরির কাজের ক্ষেত্রে মজুরি
বৃদ্ধি করার চাপ তৈরি হয়।
আসামের চা-মালিকরাও
যে এই আইনের প্রয়োগে শঙ্কিত
হয়ে উঠেছিল তার অন্তর্নিহিত
কারণও এর মধ্যেই রয়েছে। এনএসএসও-
এর
২০০৯-১০
সার্ভে রিপোর্ট অনুযায়ী
১৯৯৩-৯৪
তূলনায় শ্রম-শক্তির
অংশ গ্রহণের হার (বিশেষ
করে মহিলাদের ক্ষেত্রে)
ও
কর্মী নিয়োগের পরিমাণ সর্বভারতীয়
ক্ষেত্রে কমেছে এবং তারজন্য
জবলেস্ গ্রোথ অন্যতম একটি
কারণ হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।
কিন্তু স্থানিক বিচারে
এনরেগার প্রভাব পরিলক্ষিত
হওয়ায় একথা নির্দ্বিধায় বলে
দেওয়া যায় যে এই আইন রূপায়ণের
আন্দোলন ছড়িয়ে দিতে পারলে
সামগ্রিক গুণগত পরিবর্তন
পাওয়া যাবে। এই
আইনের তিনটি মুখ্য বৈশিষ্ট্য
হচ্ছে – (১)
কাজ
চাইলে কাজ দিতে সরকার বাধ্য
– অন্যথায় বেকার
ভাতা দিতে হবে। (২)
কাজের
মাধ্যমে সামাজিক এসেট তৈরি
করতে হবে যাতে গ্রামোন্নয়ন
হয়। (৩)
প্রকল্প
নির্ধারণ,
তদারকি
ও হিসাব-পরীক্ষার
ক্ষেত্রে গ্রামসভাকে সর্বোচ্চ
ক্ষমতা প্রদান। সুতরাং এই
আইনকে সুষ্ঠুভাবে রূপায়ণ
করার,
এনরেগার
কাজে ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি,
শহরাঞ্চলেও
একে প্রসারিত করা ও বেকার ভাতা
দিতে রাজ্য সরকারগুলিকে বাধ্য
করার জন্য যদি এক ব্যাপক আন্দোলন
গড়ে তোলা যায়,
তাহলে
আর্থিক-সামাজিক
শক্তির ভারসাম্য বদলে দেওয়ার
ক্ষেত্রে এবং শ্রমিক আন্দোলন
বিকশিত হওয়ার ক্ষেত্রে এক
সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে।
শ্রমিক
শ্রেণির ক্ষমতা দখল ও রাষ্ট্রের
প্রকৃত বৈপব্লিক রূপান্তরের
পূর্বে সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা
অনেকগুলি বৈপব্লিক অগ্রগতির
মধ্য দিয়ে যায়। এনরেগা আন্দোলন
ও ‘টিম আন্নার’
গ্রামসংসদের আন্দোলনে
সাফল্য আসলে,
আমার
মতে ভারতীয় সমাজে এধরনের এক
বৈপ্লবিক অগ্রগতি ঘটবে।
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~`
লেখাটা চাইলে আপনি এখানেও পড়তে পারেন, আপনার শুধু ফ্লাসপ্লেয়ার নামিয়ে নেবার দরকার পড়তে পারে।
0 comments:
Post a Comment