“ এরাই আন্দোলন করব – আমরার দ্বারা অইত নায়, আমরা বরঞ্চ বাগড়া দিমু”

Posted by স্বাভিমান Labels: , , , ,






।। অরূপা মহাজন ।।
(অরুণোদয়ের জন্য)

            রাই আন্দোলন করব, আমরার দ্বারা অইত নায় এঅঞ্চলের একজন হিন্দু বুদ্ধিজীবীর এক পাসিং-রিমার্ক। কথার কথা শোনালেও মন্তব্যটির মধ্যে সারবত্তা রয়েছে। বাক্যবন্ধের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে হলে প্রেক্ষিত বিচার করেই এগোতে হবে। সম্প্রতি ইউডিএফ দলের বরাক উপত্যকা থেকে নির্বাচিত বিধায়ক, যিনি আবার এক ইসলামি ধর্মীয় সংগঠনের কর্মকর্তা, আসামের কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে এবং বরাকের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন। বিরোধী শিবিরের বিধায়ক হিসেবে বিভিন্ন গণসংগঠনের প্রতিনিধিদের নিয়ে সংগ্রামী মঞ্চ গঠন করে ইতিমধ্যে অনশন কর্মসূচীতে নেমে পড়েছেন এবং লাগাতার আন্দোলন কর্মসূচী ঘোষণা করে অন্যান্য বিধায়কদের পদত্যাগ করার আহ্বান জানিয়েছেন। বলাই বাহুল্য, অন্যান্য বিধায়কদের থেকে তাঁর আন্দোলনের প্রতি তেমন কোন ইতিবাচক সাড়া মেলেনি, বরঞ্চ কোন কোন প্রতিনিধি এমনও বলেছেন যে আন্দোলন করে কোন কাজ হয় না। নিন্দুকেরা কানাঘুষো করছে যে তিনি তাঁর ইউডিএফ পরিচিতি থেকে দূরত্ব বাড়িয়ে বরাকের নেতা হওয়ার যে চেষ্টা চালাচ্ছেন তাতে কংগ্রেসের দিকে পা-বাড়ানোর ইঙ্গিত নেই তো? এই নিন্দুকদের কথা যত কম চর্চা হয় ততই ভালো, কারণ এরা গণপ্রক্রিয়াকে কখনোই গুরুত্ব দেবে না। কংগ্রেস-সরকার বিরোধী আন্দোলনে যে মানুষের মধ্যে কংগ্রেস বিরোধিতা তীব্র হবে সেটা তারা বুঝতে চান না। এই আন্দোলন নিয়ে জোর চর্চার মধ্যেই বরাকের এক প্রতিষ্ঠিত বুদ্ধিজীবীর এই মন্তব্য। এই মন্তব্যের মধ্যেই লুকিয়ে আছে বরাকের আসল স্বরূপ এবং কঠোর বাস্তব।
           বিধায়কের নেতৃত্বে এই আন্দোলনের প্রেক্ষিতে করা এই মন্তব্যে এরাই মানে যে মুসলমানরাই এবং আমরা মানে যে শহুরে হিন্দু মধ্যবিত্ত তা এখানে একেবারেই প্রচ্ছন্ন। বরাকের শহুরে হিন্দু মধ্যবিত্ত নেতৃত্ব অনেকবারই বরাকের প্রতি বঞ্চনার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু তা কখনোই   গ্রাম-বরাকের মানুষকে আন্দোলিত করা তো দূরে থাক, কোন বার্তা তাদের কানে গিয়েই পৌঁছোয়নি।    বার্তা প্রবাহের জন্য যেমনি মিডিয়া প্রয়োজন, ঠিক তেমনি আন্দোলনের আহ্বান আম-জনতার কানে পৌঁছার জন্য মাধ্যমের দরকার। এক্ষেত্রে এই মাধ্যমটি কাঠামো উপরিকাঠামো ও কার্যক্রমের (Structural – super structural and functional) মিলিত এক উপাদান। শিলচরের শিক্ষিত হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণিটির গ্রামের সাথে কোন আত্মীয়তার বাঁধন নেই, যে কিছু সংখ্যকের গ্রামে বাড়ি ছিল তারাও পাততাড়ি গুটিয়ে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে শহর বাসিন্দা, অনেকেই ছেলে-মেয়েদের বাইরে পাঠিয়ে কলকাতার মফঃস্বলে ফ্ল্যাট-বাড়ি কিনে পরবাসী হওয়ার মনোবাসনা বাস্তবায়িত করতে ব্যস্ত। ব্লকের বিডিও শহর শিলচরের বাঙালি বর্ণহিন্দু চৌধুরী, না ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার অসমীয়া চৌধুরী তাতে গ্রামের মানুষের কোন ইতরবিশেষ ফারাক অনুভূত হয়না। বার্তা বহন করার সামাজিক সম্পর্কের কাঠামোটি মোটামুটিভাবে অনুপস্থিত। উপরিকাঠামো হিসেবে মুসলিম বিদ্বেষি হিন্দু মানসিকতাই একমাত্র মতাদর্শ যা দিয়ে গ্রামীণ হিন্দু মানুষের সাথে যোগসূত্র স্থাপন করা তাদের কাছে সম্ভব হয়, এমন কোন সেকুলার মতাদর্শ নেই যা দিয়ে এই কাজটি সমাধা করা যায়। এমন কোন কার্যকরী সংস্থা নেই যার শহুরে শিক্ষিত নেতৃস্থানীয় সদস্যরা গ্রামে গিয়ে মানুষকে আন্দোলনের বার্তা ও ঐক্যের আদর্শের কথা বোঝাবে এবং গ্রামের সাথে যোগসূত্র স্থাপনের জন্য নতূন মানুষ তৈরি করবে। উল্টোদিকে, শহরের মুসলমান মধ্যবিত্ত সমাজ গ্রাম থেকে উঠে আসা এবং গ্রামের সাথে তাদের নিবিড় জীবন্ত সম্পর্ক রয়েছে। তাদেরকে পরধর্মের প্রতি বিদ্বেষ প্রচার করে নিজেদের ধর্মীয় ঐক্য বজায় রাখতে হয় না এবং সে অর্থে এই ইসলাম নিজেই এক সেকুলার ভূমিকা পালন করতে সক্ষম। কোন এক বিশেষ মুহূর্ত কিংবা ঘটনাকে কেন্দ্র করে তাৎক্ষনিকভাবে সৃষ্ট বিদ্বেষের মনোভাব বাদ দিলে, ধর্মীয় বিদ্বেষের মনোভাব প্রতিনিয়ত সামাজিক চর্চার বিষয় হিসেবে ক্রিয়াশীল থাকে না, উপরুল্লিখিত আমরার মধ্যে যা বিদ্যমান এক চর্চার বিষয়। তারা যখন রাষ্ট্রযন্ত্রের কোন অংশকে শোষণ-বঞ্চনার হাতিয়ার হিসেবে চিহ্নিত করতে পারে, তখন তারা তাদের প্রতিবেশিদের দিকে ঐক্যের হাত বাড়িয়ে দিতে উদগ্রীব হয়ে থাকে। কিন্তু এই আমরার সাম্প্রদায়িক দিব্যদৃষ্টি তাদের হাতের রেখাচিত্রে বাংলাদেশের মানচিত্র দেখে, তকির নিচে লুকিয়ে থাকা ছুরি কল্পনা করে যেন ঐ হাত তকির দিকে যাবে এবং আমরার বুকের দিকে ঘুরে আসবে। একথা হলফ করে বলা যায়, সাধারণভাবে গ্রামাঞ্চলের মুসলিম সমাজের আচার-ব্যবহার (অসামাজিক কার্যকলাপে যুক্তরা সামাজিক মদতে নয়, রাজনৈতিক মদতেই পরিপুষ্ট) ঐক্য গড়ে তোলার সহায়ক, বরঞ্চ হিন্দু সমাজের মনোজগত ও সামাজিক জগত এই ঐক্যের পরিপন্থী। সুতরাং, উপরুল্লিখিত মন্তব্যটিকে আরেকটু প্রসারিত করে বলা যায়, ''এরাই আন্দোলন করব আমরার দ্বারা অইত নায়, আমরা বরঞ্চ বাগড়া দিমু।        তবে এই মন্তব্যের অন্তর্নিহিত সাধারণ বাস্তব আমরা ওরার বিভাজন দূর করে আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্র তৈরি করে না। কিন্তু ইতিমধ্যে পরিস্থিতির অনেক পরিবর্তন হয়েছে, যেখানে দাঁড়িয়ে আমরা-ওরা মিলে আমরা সবাই এক ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের সূচনা করতে পারে।
          বরাক ঊপত্যকার গ্রামীণ শ্রমিক, কঠোর পরিশ্রমী কৃষক সমাজের গরিষ্ঠাংশই মুসলিম সমাজভূক্ত। জনসংখ্যা ও দৈহিক শ্রমের মাত্রার দিক থেকে এরাই চোখে পড়ার মত। চা-শ্রমিক ছাড়া শহরের দিন-হাজিরার দৈহিক শ্রম ও বিভিন্ন নির্মাণ শ্রমিকদের মধ্যে ঝাড়খণ্ডী-আদিবাসী ও কৈবর্তদের বিশেষ উপস্থিতি রয়েছে, কিন্তু দক্ষ-শ্রমিকের গরিষ্ঠাংশই মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত। গ্রামীন আধিপত্যকারী শ্রেণির আধিপত্যের ভিত্তি হচ্ছে জমির মালিক ও মহাজন, তারাই আবার সরকারি অনুদানের মধ্যসত্ত্বভোগী ও মাঝারি নিয়ন্ত্রক এবং অন্যদিকে দিসপুরের তাবেদার রাজনৈতিক শ্রেণির তল্পিবাহক। এই দুয়ের মাঝখানে ছোট চাকুরে, ছোট দোকানদার ও ছোট জমির মালিক কৃষক পরিবার। গত বিশ-ত্রিশ বছর আগেও এই ছিল সাদামাটাভাবে বরাকের গ্রামাঞ্চলের বাস্তব চিত্র।
          বিগত বছরগুলিতে এই বাস্তব চিত্রের মাত্রাগত ব্যাপক পরিবর্তনের ফলে সামাজিক সম্পর্কের উপরও খানিকটা প্রভাব বিস্তার করেছে। বরাকের কৃষিতে গরু-লাঙ্গলের ব্যবহার একেবারেই কমে গেছে, তার জায়গা নিয়েছে পাওয়ার-টিলার ও ট্র্যাক্টর। ধানবীজের বৈচিত্রময় ফসলের জায়গা নিয়েছে বাজার নিয়ন্ত্রিত গুটিকয় ধানবীজ ও তার পরিপূরক সার, কম্যুনিটি ফিসারিজের জায়গা নিচ্ছে ব্যক্তিমালিকানাধীন ফিসারিজ। এশিয়ান ডেভেলাপমেন্ট ব্যাঙ্ক ও বিশ্ব ব্যাঙ্কের থেকে ধারের অর্থে গড়ে উঠছে বিভিন্ন ধরণের ইমারত, পাওয়ার লাইন, টাওয়ার লাইন ও মহাসড়ক। এইসব কর্মকাণ্ডকে কেন্দ্র করে পুরোনো মধ্যসত্ত্বভোগীদের সাথে নতূন আরেকদল ঠিকাদার-সাপ্লায়ার গোষ্ঠী জন্ম নিয়েছে। পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে উঠে এসেছে আরেকদল প্রতিপত্তিশালী গোষ্ঠী যারা এনরেগা সহ পঞ্চায়েত বিলি-বন্টনের ক্ষেত্রে ফড়ে-দালালের ভূমিকায় লিপ্ত। বহু পঞ্চায়েত প্রতিনিধি নব্য ধনিরা এখন ট্র্যাক্টর-পাওয়ার টিলার, গাড়ি-বাড়ির অলিখিত মালিক। পুরোনো ও নতূন মিলে এই গোষ্ঠীটি সম্প্রদায়গতভাবে মিশ্র চরিত্রের এবং বড়-মাঝারি ও ক্ষুদ্র মাপের স্তরতন্ত্রে অন্তর্ভুক্ত এই গোষ্ঠীটি একে অপরের উপর নির্ভরশীল। এই নির্ভরশীলতার ক্ষেত্রে দুর্নীতি এক মুখ্য ভূমিকায় রয়েছে এবং এভাবে এরা দিল্লি-দিশপুর থেকে বরাকের দালাল রাজনৈতিক নেতৃত্ব হয়ে এক শৃঙ্খলের মধ্যে আবদ্ধ রয়েছে। তাদের নিজেদের মধ্যে স্বার্থের দ্বন্দ্ব দেখা দিলেও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানই তাদের স্বার্থ সুরক্ষিত রাখার প্রধান গ্যারান্টি। রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার দূরবস্থার জন্য আমরা যখন ট্রান্সপোর্ট লবিকে দায়ী করি, তখন আমাদের একথাও স্মরণে রাখতে হয় যে বরাকের রাজনৈতিক নেতৃত্বের কত সংখ্যক গাড়ি এই ট্রান্সপোর্ট লবির অধীনে প্রতিদিন শিলচরগুয়াহাটির দূর্গম পথ পাড়ি দেয়। বরাকের প্রতি বঞ্চনার বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ জানানোর ক্ষেত্রে এই গোষ্ঠীর আত্মশক্তি স্বাভাবিকভাবেই দুর্বল হলেও, সামাজিক সংঘাত প্রশমিত করে রাখার ক্ষেত্রে তাদের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কারণ সামাজিক সংঘাত বেশিদূর এগোলে বিভিন্ন সম্প্রদায় থেকে উঠে আসা এই গোষ্ঠীটি তাদের আপাত-শান্তিপূর্ণ স্বার্থের ব্যাঘাত ঘটার সম্ভাবনা দেখে।
          অন্যদিকে এক ব্যাপক অংশের মানুষ পরিবার প্রতিপালনের জন্য অসংগঠিত শ্রমিক হিসেবে জড়িয়ে পড়ছে এই কর্মকাণ্ডে কায়িক শ্রমের যোগান দিতে। আগে যেসব ব্যাপক অংশের গরিব ও মাঝারি কৃষক কৃষিকাজ করেই সংসারের ব্যয় সংকুলান করতে সক্ষম ছিল, তারাই এখন এই ব্যাপক অসংগঠিত শ্রমিক। এই অসংগঠিত শ্রমিক দলে মুসলিম ও চা-জনগোষ্ঠীর লোকদের প্রাধান্য থাকলেও, আর্থিক সংকট সব সম্প্রদায়ের মানুষকেই এই দলে টেনে এনেছে। উপরের স্তরের চাকুরিজীবী যারা মোটা অংকের মাইনে পান শতাংশের হিসেবে তাদের শক্তি একেবারেই নগণ্য এবং নিজেরা দুর্নীতিতে লিপ্ত থাকুক বা নাই থাকুক দুর্নীতির জন্য এই ব্যবস্থার তারা সমালোচক কিন্তু এর দাওয়াই হিসেবে এখনও এরা আর্থিক উদারনীতিরই পক্ষে। তবে মধ্য ও নিম্ন স্তরের স্বল্প মাইনের সরকারিবেসরকারি চাকুরিজীবীরা উদারবাদী অর্থনীতির ব্যাপক কুপ্রভাবের কঠোর বাস্তবে অতীষ্ঠ। খুচরো ব্যবসায় বিদেশি লগ্নি ব্যাপক ক্ষুদে দোকানদারদেরও শঙ্কিত করে তুলছে। এছাড়া রয়েছে চা-শ্রমিক ও বিভিন্ন ক্ষুদ্র-মাঝারি ও ভারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের শ্রমিকরা। চা-শ্রমিক ছাড়া অন্যান্য শিল্প-শ্রমিকরা সংখ্যায় কম হলেও, এদেরও সম্প্রদায়গত গঠন মিশ্র চরিত্রের। এই ব্যাপক সংগঠিত-অসংগঠিত শ্রমিক ও নিম্নস্তরের মাস-মাইনের চাকুরিজীবীদের মধ্যে পূর্বের দেশজোড়া       দলিত-অবিসি জাগরণের এবং বর্তমানের দেশ ও বিশ্বজোড়া শ্রমিক-কৃষক আন্দোলন ও গণ-অভ্যুত্থানের ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে। সুতরাং, এরাই বরাকের প্রতি বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রধান ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই যে বঞ্চনার বিরুদ্ধে যারা কথা বলেন তাদের মস্তিষ্কে এই বাস্তবতা কোন প্রভাব ফেলে না।
         বরাকের ইউডিএফ বিধায়কের অনশন কার্যসূচীতে এখন পর্যন্ত মানুষের ব্যাপক গণ-সমর্থন পরিলক্ষিত হয়নি। অনেকের মতে বিধায়ক হওয়ার আগে তাঁর যে সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা ছিল এবং দুর্নীতি বিরোধী ভাবমূর্তি ছিল, বিধায়ক হওয়ার পর তা তিনি বজায় রাখতে পারেননি এবং এরজন্যই তেমন জনসমর্থন মিলছে না। এই মতের যথার্থতা থাকলেও, যাদেরকে ভিত্তি করে এই আন্দোলন শক্তি সঞ্চয় করবে, বিধায়ক হিসেবে তাদের কোন বিষয় নিয়ে তিনি কোন কথা না বলাই জনমনকে আকর্ষিত করতে ব্যর্থ হওয়ার পেছনের মূল কারণ বলেই মনে হয়।   

0 comments:

স্বাভিমান:SWABHIMAN Headline Animator

^ Back to Top-উপরে ফিরে আসুন