নাট্য আন্দোলন – একটি ভাবনা /সংযোজন ঃ বিশ্ব নাট্য দিবস উপলক্ষ্যে কোরাস নাট্য সংস্থা অয়োজিত আড্ডা থেকে ফিরে এসে।
Posted by Labels: বরাক উপত্যকা, বাংলা নাটক
।। অরূপ বৈশ্য।।
( বিশ্বনাট্যদিবস উপলক্ষে লেখা প্রবন্ধটি অরুণোদয়ে বেরুবে)
বরাক উপত্যকার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে
এক বিশেষ স্থান জুড়ে রয়েছে নাট্যচর্চা। সামগ্রিক পরিস্থিতি ও সময়ের সাথে তাল
মিলিয়ে বরাকের নাট্যচর্চারও রয়েছে জোয়ারভাটা। বরাকের এই নাট্যচর্চা ও নাট্য
আন্দোলনের বিষয় নিয়ে গভীর কোন বিশ্লেষণ বা পর্যায়ক্রমিক ইতিহাস রচনার কাজে কোন
নাট্যকর্মী, গবেষক বা সমালোচক ব্রতী রয়েছেন বলে আমার জানা নেই। সমালোচকদের একাংশ
বরাকের নাট্যচর্চাকে পশ্চিমবাংলা বিশেষ করে কলকাতার অনুকরণ হিসেবে অভিহিত করে কোন
ধরনের বিশ্লেষণে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তাকে নাকচ করে দেন। অথচ কলকাতার নাট্যচর্চা
বরাকের মত প্রত্যন্ত অঞ্চলের ক্ষুদে শহরের নাট্যচর্চাকেও যে প্রভাবিত করতে পেরেছে
তারও একটা কার্যকারণ সম্পর্ক বিচার করে দেখা চাই। যারা অতীতের নাট্যমোদীদের নাটক
দেখার উৎসাহকে অনুকরণের স্পৃহা বলে খারিজ করে দেন এবং যারা ‘যা
কিছু বিদ্যমান’ তা নিয়েই
বেঁচেবর্তে থাকতে চান – তাদের দু’দলই
ভাবনার যান্ত্রিকতায় আবদ্ধ হয়ে যান। ‘সব ঠিক আছে’ বা ‘সবই ফাঁকি’ – এই দুয়ের
টানাপোড়েনে ‘নাট্য আন্দোলনের’ নতুন
রূপরেখা তৈরির প্রয়াস অনায়াসেই দিকভ্রষ্ট হয়। একথা অনস্বীকার্য যে বরাকের
বিভিন্ন পর্যায়ের নাট্য আন্দোলনের জোয়ার মূলত শহরকেন্দ্রিক এবং সামগ্রিক পরিস্থিতি
ও কলকাতার নাট্যচর্চার প্রভাবে প্রভাবিত থেকেছে। প্রাণের সাথে প্রাণ জুড়িয়ে নতুন
প্রাণের সঞ্চার করতে পারেনি অর্থাৎ সময়ের তাগিদে যে নাটক ও নাট্যদর্শক তৈরি
হয়েছিল তাকে বরাকের লোকজীবনের স্পর্শে রাঙাতে পারেনি। তথাপি ভাঁটার অন্তিম লগ্নেও
বরাকের ‘নাট্যজননীর’ প্রাণশক্তি
একেবারে ফুরিয়ে যায়নি, যদিও নাট্যচর্চার এই প্রাণশক্তিকে ‘ভেন্টিলেটারের’ উপর নির্ভর করে ধরে রাখতে হচ্ছে। কোন
এক ‘অলৌকিক’ কারণে এই ‘নাট্যজননী’ ভেন্টিলেটার থেকে বেরিয়ে এসে আবারও
অন্তঃসত্ত্বা হয়ে নতূন প্রাণের জন্ম দিতে সক্ষম হয়ে উঠতে পারে। সাধারণের কাছে এই
‘অলৌকিক’ কারণটিই আসলে পরিস্থিতি, সময় ও উদ্যমের কার্যকারণগত
সম্পর্ক।
সামগ্রিকভাবে
নাট্যচর্চা এই নিবন্ধের বিষয় নয়, বরঞ্চ নাট্যচর্চা কখন
নাট্য আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করেছে এবং সমাজে আলোড়ণ সৃষ্টি করতে পেরেছে সেটাই
এখানে আলোচ্য বিষয়। আঠারো শতিকার ইউরোপের আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে
প্রাণবন্ত নাট্যচর্চা থেকে উদ্ভূত রঙ্গমঞ্চকে এদেশে আমদানি করে বাংলাতে
গিরিশচন্দ্র ঘোষের মত বাবুরা যে বিষয়গুলিকে সংযোজিত করে পেশাদারি নাটকের জন্ম
দিয়েছিলেন তা কলোনিয়্যাল প্রভুদের উপযোগিতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। যখন সামাজিক
পরিস্থিতি নিস্তরঙ্গ ও স্থিতিশীল, যখন ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রকদের
আধিপত্য প্রশ্নাতীত, সেই সময়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী মননশীল
নাটক দর্শকদের সামনে উপস্থাপিত করা কি সম্ভব? নাটক এমন এক
শিল্পমাধ্যম যা ‘নাট্য আন্দোলন’ রূপেই
প্রতিভাত হয় এবং সমাজ পরিবর্তনের সহায়ক হয়ে উঠে। কারণ নাটক থেকে সমাজ ও সমাজ
থেকে নাটক – এই দ্বিবিধ ও বিপরীতমুখী প্রত্যক্ষ ও নিরন্তর
যাত্রার সংঘাতময় পরিস্থিতিই এই শিল্পকর্মের মূল রহস্য। ফলে নাটক প্রায়শই
সমাজবদ্ধ ও সেই সুবাদে রাজনীতির সামাজিকীকরণের সাথে যুক্ত হয়ে রাজনীতিবদ্ধ। অবশ্য
নিস্তরঙ্গ আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতেও অন্তঃসলিলা ব্যতিক্রমী সৃষ্টিশীল নাট্যচর্চার
কাজ নিরন্তর চলতে পারে এক সর্বব্যাপী নাট্য আন্দোলনের অপেক্ষায় সলতে পাকানোর কাজ
হিসেবে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে ১৯২৯ সালে আমেরিকায় গ্রুপ থিয়েটারের জন্ম হওয়া এক ভিন্ন তাৎপর্য বহন
করে। ১৯২৯ সাল – শেয়ার বাজারের পতনের মাধ্যমে বিশ্ব পুঁজিবাদের মহামন্দার ঘোষণা। শ্রমিক
ছাঁটাই, তীব্র বেকারত্ব, ক্ষুধা-অনাহার
ও লাগামহীন সামাজিক অসাম্যের ফলে চারিদিকে সামাজিক অস্থিরতা। সংকটে জেরবার
অর্থব্যবস্থা থেকে উদ্ভূত আগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদী রাজনীতি। একদিকে উত্থানোন্মুখ
জার্মান ফ্যাসিবাদ ও যুদ্ধের জন্য অক্ষশক্তি-মিত্রশক্তির শিবির বিভাজনের প্রস্তুতি,
অন্যদিকে ন্যায়-সাম্য-মুক্তির লক্ষ্যে ও ঐক্য-ভ্রাতৃত্ব-সহমর্মিতার
ভিত্তিতে দেশ-জাতি-জনগণের সংগ্রামের প্রস্তুতি। এই প্রস্তুতির মুখে দাঁড়িয়েই
আমেরিকাতে গ্রুপ থিয়েটার এবং ভারতবর্ষে গণনাট্য আন্দোলনের বিস্তার। সাম্রাজ্যবাদী
অক্ষশক্তি ও মিত্রশক্তির দুই কেন্দ্র জার্মানী ও আমেরিকা এবং দেশ-জাতি-জনগণের
সংগ্রামের মতাদর্শগত কেন্দ্র সবচাইতে প্রাগ্রসর ও প্রতিবাদমুখর আমেরিকান
শ্রমিকশ্রেণি। এরজন্যই ‘ব্ল্যাক থিয়েটার’ থেকে আরম্ভ করে বিভিন্ন ধরনের প্রাণবন্ত ‘থিয়েটার
প্রেক্টিস’ তখন গড়ে উঠে আমেরিকার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে।
বাংলা তথা ভারতবর্ষের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশে এই নাট্য আন্দোলনে এক ভিন্ন মাত্রা
যোগ হয়, যখন বাংলায় মঞ্চস্থ হয় বিজন ভট্টাচার্যের ‘নবান্ন’ নাটক। বিয়াল্লিশের মন্বন্তরের করুণ পরিণতির
উপর ভিত্তি করে রচিত এই নাটক মধ্যবিত্ত মননে আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং শুরু হয়
লোকসমাজের মধ্যে গিয়ে নাট্য আন্দোলন গড়ে তোলার শিক্ষিত
মধ্যবিত্ত নাট্যকর্মীদের যাত্রা। এই নাট্য আন্দোলনে লোকসংস্কৃতির
বিভিন্ন কাঠামো ব্যবহার করার কিছুটা প্রচেষ্টা থাকলেও এবং বাংলার লোকসমাজের ও
সমসাময়িক বিষয়বস্তু উঠে আসলেও আঙ্গিকের দিক থেকে ‘গ্রুপ থিয়েটারের’ আঙ্গিক
থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি এবং এই নাট্য আন্দোলন মধ্যবিত্ত শিক্ষিত ‘ভদ্দরলোক দৃষ্টিভঙ্গির’ নিয়ন্ত্রনাধীন রয়ে যায়। ইতিমধ্যে যুদ্ধ পরবর্তীতে
শ্রম-পুঁজির ‘নিউ ডিলের’ মাধ্যমে সামাজিক স্থিতিশীলতার বাতাবরণ
আমেরিকান শ্রমিক শ্রেণির নতুন সমাজ গড়ার লড়াকু ‘মতাদর্শগত
কোর’ পুঁজির সাথে সমঝোতার মাধ্যমে তার প্রাণশক্তি হারিয়ে
ফেলতে শুরু করেছে এবং এর প্রভাব বাংলার গণনাট্য আন্দোলনেও পড়তে শুরু করেছে।
উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনের জোয়ারে বাংলার নাট্য আন্দোলন যে নতুন সমাজ গড়ার এজেণ্ডাকে
সামনে রেখেছিল তা ধীরে ধীরে সংস্কারমুখী প্রবণতায় পর্যবসিত হতে শুরু করে। যে সব
কৃষক বিদ্রোহ স্বাধীনতার নামে ঔপনিবেশিক আপস মেনে নিতে অস্বীকার করেছিল এবং যার
উপর ভিত্তি করে বামপন্থা টিঁকে থাকতে পারত সেগুলির মধ্যপন্থী সমাধান বামপন্থায়
ভাঁটার টানের জন্ম দিল। আসলে শ্রমিক-কৃষকের প্রশ্নটি যে আমাদের মত দেশে
ভাষা-জাতি-বর্ণের প্রশ্নের অধীন হয়ে রয়েছে – এই সত্যটি
বামপন্থীরা অনুধাবন করতে পারেননি। ফলে তথাকথিত স্বাধীনতা অর্জেনের মাধ্যমে
শ্রমিক-কৃষক সমস্যার যে আপাত সমাধান বেরিয়ে আসল তাতে বামপন্থীরা আর নিজেদের বাম
অস্তিত্ব বজায় রাখার জনভিত্তি খুঁজে পেলেন না। গণনাট্য কর্মীদের উপর যখন নেমে এল
রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস তখন সাংস্কৃতিক আন্দোলনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কম্যুনিস্ট পার্টির
সর্বভারতীয় নেতা পি সি যোশী সংস্কারমুখী কর্মসূচীর ভিত্তিতে নগরকেন্দ্রিক নাট্য
চর্চার উপর গুরুত্ব দিলেন। প্রাণবন্ত-প্রাণচঞ্চল
নাট্যচর্চার এই পর্যায়ে ‘ভদ্দরলোকদের’ গণ্ডি পেরিয়ে এক নতুন নাট্য ধারা যাকে
সমাজ বহন করবে এরকম কোন নাট্য ধারার জন্ম দিতে ব্যর্থ হলো। এই ব্যর্থতা জন্ম দিল
নাট্যচিন্তার বিভিন্ন ‘মতবাদ’ নিয়ে
অবান্তর সব বিতর্ক – আসলে এইসব বিতর্কের আড়ালে ছিল পরাজয়ের
গ্লানি থেকে মুখ লুকোনোর প্রচেষ্টা। ৩০-৪০ দশকের অস্থির পরিস্থিতি যে নাট্য
আন্দোলনের জন্ম দিয়েছিল সেখানে নাট্যচিন্তার বিভিন্ন মতবাদে বিশ্বাসীরা একযোগে
নাট্যচর্চায় ব্রতী হতে বাধ্য হয়েছিলেন, কম্যুনিস্ট পার্টির
সাংগঠনিক নিয়ন্ত্রনের প্রশ্নটি সেখানে ছিল অবান্তর। সমাজ পরিবর্তনের ভাসাভাসা এক
মতাদর্শগত আবহের নিয়ন্ত্রনের প্রশ্নকে বিফলতার কারণ হিসেবে যারা বিবেচনা করেন
তারা ‘স্নানের জলের সাথে বাচ্চাটিকে’ ছুঁড়ে
ফেলার দুঃসাহস করেন। বরাক উপত্যকায় ঐ পর্যায়ে কীধরনের নাট্যচর্চা হয়েছিল তার
কোনো লিখিত বয়ান আমাদের কাছে নেই এবং এব্যাপারে আমার কোন ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাও
থাকার কথা নয়। কিন্তু একথা আমাদের মনে রাখতে হবে যে বাঙালি অধ্যুষিত বরাকভূমি
পূববাংলারই সম্প্রসারিত অংশ এবং ‘নবান্ন’ নাটকের পর পূববাংলাতেই আইপিটিএ’র শাখা গড়ে ওঠে এবং
তেভাগা-নানকার কৃষক বিদ্রোহ বর্তমান বরাক উপত্যকার বিস্তৃত অঞ্চলকেও প্রভাবিত করে।
পরবর্তীতে দেশভাগজনিত ছিন্নমূল উদ্বাস্তুদের আবেগ, কৃষক বিদ্রোহ-শ্রমিক আন্দোলন, সাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি সমস্ত সমসাময়িক বিষয় উঠে আসে পঞ্চাশের দশকের পশ্চিমবাংলার নাট্যচর্চায়ও। কিন্তু গ্রুপ থিয়েটারের অঙ্গনে এই নাট্যচর্চাও বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্তের সীমানা অতিক্রম করে বৃহত্তর সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে পারল না। ফলে দিশাহীন বিতর্কে নিমজ্জিত হয়ে গ্রুপ থিয়েটারকে পর্যবসিত হতে হল বাজারশক্তির ক্রীড়নকে। কিন্তু ১৯৬৫ সালের ‘কল্লোল’ নাটক জনমণ্ডলীর জনপ্রিয়তা ও জনসমর্থন লাভে সফল হলো। ঐ একই সময়ে ১৯৬৭ সালে ‘শতাব্দী’ নাট্যগোষ্ঠী গঠন করে বাদল সরকার তৃতীয় নাট্য ধারার প্রয়োগে সচেষ্ট হন। তৃতীয় বিশ্বের বিষয়বস্তুর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি আঙ্গিক হাজির করার এক প্রয়াস নেন বাদল সরকার। গণআন্দোলনের পাশাপাশি নাট্য-আন্দোলনকেও যাতে সমাজ বহন করে নিয়ে যেতে পারে, সামাজিক আন্দোলনগুলিই যাতে মতাদর্শগত সংগ্রাম চালিয়ে যেতে নিজেরাই নাটক তৈরি করতে এবং সংগ্রামরত জনগণের সামনে পেশ করতে পারে অর্থাৎ নবউত্থিত জনসমাজের সাথে যাতে নাট্যচর্চা এক জৈবিক সম্পর্কে আবদ্ধ থাকে – সেই চিন্তা থেকেই সম্ভবত বাদল সরকার বিষয়বস্তু ও আঙ্গিকের এক সুসমঞ্জস্য কাঠামো তৈরি করার চেষ্টায় ব্রতী হন। কিন্তু এই ধারাও শুরুতে যে আশার আলো জাগিয়েছিল তা বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়। তথাপি গ্রামসমাজের বিষয়বস্তুকে শহরে তুলে এনে নগরকেন্দ্রিক এবং ‘শিক্ষিত-ভদ্দরলোক’ নিয়ন্ত্রিত নাট্য ধারার সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে বাদল সরকারের এই প্রয়াস নাটকের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্ষেত্রে এক অগ্রগতি হিসেবেই বিবেচিত হয়। কিন্তু ষাটের দশকের টালমাটাল সময়ের টানে নাটকের যে জনপ্রিয়তা দেখা দিয়েছিল তাকে জনসমাজের নিজস্ব সাংস্কৃতিক চর্চার ধারা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা যায়নি।
ষাটের দশকের শেষে বিশ্ব-পুঁজিবাদ আবারও এক গভীর সংকটের পর্যায়ে প্রবেশ করে। এই পরিপ্রেক্ষিতে বাস্তুহারাদের পুনর্বাসনের অধিকার, খাদ্য আন্দোলন ইত্যাদিকে হাতিয়ার করে বামপন্থীদের গ্রহণযোগ্যতার গ্রাফ পুনরায় উর্ধমুখী হতে শুরু করে। ইমার্জেন্সি বিরোধী জেপি’র আন্দোলনের আবহে বামপন্থী সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা যে বেঞ্চমার্ক অতিক্রম করে তার হদিস মেলে ১৯৭৭-এর নির্বাচনী ফলাফলে। বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসে এবং একইসাথে এও অভিযোগ উঠতে শুরু করে যে কম্যুনিস্ট পার্টি নাট্য আন্দোলনকে নির্বাচনে ব্যবহার করেছে এবং এনিয়ে বিতর্ক দানা বাঁধতে শুরু করে। এই অভিযোগ সত্য, কিন্তু এহ বাহ্য। নির্বাচনী লড়াই যদি সামাজিক লড়াইয়ের একটি পর্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়, তাহলে নাটকের মত শিল্পমাধ্যম তাতে ব্যবহৃত হলে কোন মহাভারত অশুদ্ধ হয় না। যা নাট্য আন্দোলনকে অশুদ্ধ করে ও শুকিয়ে যেতে সাহায্য করে তা হল নির্বাচনপূর্ব সমাজপরিবর্তনের এজেণ্ডাকে নির্বাচন পরবর্তীতে ক্রমশঃ পরিহার করার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। নাট্য আন্দোলনকে যা ব্যাহত করে তা হলো বৃহত্তর সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনে একে অঙ্গীভূত করার পরিবর্তে মধ্যবিত্ত ‘বাবু-ভদ্দরলোকদের’ প্রাণহীন গণ্ডিতে তাকে আবদ্ধ করা। এই পর্যায়ের নাট্য আন্দোলনে আবারও ৩০-৪০ দশকের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। ১৯৮০-এর উদার-অর্থনীতির অন্তর্গত কাঠামোগত পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার মধ্যে বামফ্রন্টের বাম-রাজনীতি ১৯৮২ সালে পুনরায় ক্ষমতায় আসার পর যেভাবে অঙ্গীভূত হয়ে যায়, ঠিক সেভাবেই নাট্য-আন্দোলনও বাজারের চাহিদার বাইরে বেরিয়ে প্রাণশক্তি সঞ্চারিত করতে অপারগ হয়। এই দুই পর্যায়ই বিষয়বস্তু ও আঙ্গিকের এক জীবন্ত ঐক্যের ভিত্তিতে নতুন কোন স্বনিয়ন্ত্রিত ও সমাজ-নিয়ন্ত্রিত নাট্যধারার সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়।
৩০-৪০ দশকের পূববাংলার এবং ষাটের দশকের পশ্চিমবাংলার নাট্যচিন্তার এই সীমাবদ্ধতার প্রভাবে বরাক উপত্যকার নাট্যচর্চাও প্রভাবিত ছিল। এই প্রভাব এখনও দৃঢ়ভাবে বিদ্যমান থাকায়ই বরাকের নাট্যচর্চা ‘ভেন্টিলেটারের’ উপর নির্ভর করে বেঁচে আছে। কিন্তু আন্দোলনের ক্ষেত্রে এতগুলো ব্যর্থতা বরাকের মত প্রত্যন্ত অঞ্চলের নাট্যকর্মীদের সামনে এক নতূন সুযোগও এনে দিয়েছে, বিশেষ করে এই কারণে যে আমাদের রয়েছে পূববাংলার মত ভাষিক অধিকারের প্রশ্নে জীবন্ত ও নিরন্তর গণকার্যকলাপের এক ঐতিহ্য। সুতরাং এই ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নেওয়ার বৌদ্ধিক চর্চা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার প্রাণবন্ত প্রচেষ্টা যদি বরাকের নাট্যকর্মীরা অব্যাহত রাখে তাহলে এক নতুন সৃষ্টি উন্মাদনায় আবারও জেগে উঠার সুযোগ আমাদের সামনে আসছে। নাট্যচর্চার প্রাণশক্তি সঞ্চার করার জন্য বিষয়ীগত পরিস্থিতি আবারও অনুকূল হয়ে উঠছে। বিশ্বায়নের সম্মোহনী মায়া এখন মুহ্যমান – উদার আর্থিক নীতি আর্থ-রাজনৈতিক সংকটকে প্রতিনিয়ত ঘনীভূত করে চলেছে। পুনরায় শ্রমিকশ্রেণির জাগরণ আমেরিকার ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ আন্দোলনের রূপে উইসকনসিন প্রদেশে ব্যাপক ও জঙ্গি শ্রমিক ধর্মঘট সংগঠিত করে গোটা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ছে। আমাদের মত কৃষক প্রধান ও জাতি-বর্ণে বিভাজিত দেশের জনগণের লড়াইয়ের জন্য সবচাইতে প্রাগ্রসর শ্রমিক শেণির মতাদর্শগত কোর আবার জেগে উঠছে। বিশ্বব্যাপী এই শ্রমিক আন্দোলনের মধ্যে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের বিস্তারও আবার পরিলক্ষিত হচ্ছে। বেকারত্ব, অসাম্য, দারিদ্র, অনাহার-বুভুক্ষা আমাদের মত দেশের ঘুমন্ত শ্রমিক-কৃষককেও জাগিয়ে তুলছে, আড়মোড়া ভেঙে ঘুম থেকে জেগে ওঠা সিংহের গর্জনধ্বনি প্রতিনিয়ত দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভেসে আসছে। নবউত্থিত সামাজিক আন্দোলন সমস্ত ধরনের নিস্পেষণ যন্ত্রকে ভেঙে দিয়ে নতুন সমাজ গড়ার আকাঙ্খাকে প্রকাশ করছে। এই নতুনের সন্ধান করাটাই আজকের সময়ের জরুরি কাজ যা সামাজিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে যতটুকু প্রযোজ্য, ঠিক তেমনি প্রযোজ্য নাট্য আন্দোলনের ক্ষেত্রেও। বরাকের নাট্যচর্চার ক্ষেত্রে নতুনের এই সন্ধান শুরু হতে পারে অতীত অভিজ্ঞতার সার সংকলন, বরাকের জনসমাজকে জানা ও বোঝার প্রচেষ্টা, গণ-আবেগকে বুঝতে ইতিহাসের চর্চা ও সর্বোপরি নতুন বিষয়বস্তু ও আঙ্গিক নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার প্রচেষ্টার মাধ্যমে। এই কাজ করার জন্য বরাকে এক শক্তিশালী নাট্যকর্মীদলের উপস্থিতি রয়েছে, প্রয়োজন শুধু সঠিক দৃষ্টিভঙ্গির।
সংযোজনঃ বিশ্ব নাট্য দিবস উপলক্ষ্যে কোরাস নাট্য সংস্থা অয়োজিত আড্ডা থেকে ফিরে এসে।
উক্ত অলোচনা মূলতঃ এঅঞ্চলের নাট্যচর্চার
সমস্যার মধ্যে কেন্দ্রীভূত হলেও এর সূত্র ধরে নাট্যচর্চার সাধারণ সংকটের
দিকগুলিকেও উন্মোচিত করার লক্ষ্যে আলোচনায় ক্রমশঃ গভীর বিষয়গুলি উত্থাপিত হয়েছে।
এই সংযোজন আসলে সেদিনের আলোচনায় উত্থাপিত বিষয়গুলির প্রেক্ষাপটে মূলতঃ আমার
ব্যক্তিগত মতামত।
প্রশ্ন উঠেছে বরাক উপত্যকার নাট্যচর্চার
প্রাণকেন্দ্র শিলচরে যারা নাট্যশিল্পী-পরিচালক তথা কর্মী তাদের মধ্যে কতজনকে পাওয়া
যাবে যারা নিজের শিল্পীসত্তার তাগিদে নাট্যচর্চার ক্ষেত্রে সমস্ত বাধাবিঘ্ন দূর
করার জন্য স্বাধীনভাবে চিন্তাভাবনা করতে, বিকল্প পথ অনুসন্ধান করতে এবং নতুন
পরীক্ষা-নিরীক্ষার লড়াই চালিয়ে যেতে প্রস্তুত? উত্তর এসেছে নেতিবাচক। গরিষ্ঠাংশরাই
পরিকাঠামো, স্পনশরার ইত্যাদির অভাবকেই তাদের নিষ্ক্রিয়তার মূল কারণ হিসেবে মেনে
নিয়ে আত্মতুষ্ট। বিষয়টাকে যদি উল্টোদিক থেকে দেখা যায়, তাহলে এই পরিস্থিতির একটা
কারণ অনুসন্ধানের এবং তার থেকে উত্তরণের পথ অনুসন্ধানের একটা প্রচেষ্টা করা যেতে
পারে। মাত্রার তারতম্য বাদ দিলে নাট্যজগতে একটি নাট্যধারা তৈরির প্রয়াস করার জন্য
যে প্রাণশক্তি প্রয়োজন তার অভাব শিলচরের মধ্যবিত্ত নাট্যশিল্পী-পরিচালক তথা কর্মীদের মত
প্রায় সর্বত্রই সর্বত্রই পরিলক্ষিত হচ্ছে, তারমানে এই নয় যে ভাল নাটক একেবারেই তৈরি হচ্ছে না। ভাল
নাটকের সংজ্ঞা এখনও আভিজাত্যের গণ্ডি পেরোতে পারেনি, যদিও এই গণ্ডি পেরোনোর জন্য
প্রয়োজনীয় আঘাত মাঝেমধ্যেই এসেছে, কিন্তু এই আঘাত কখনওই পেটি বা প্রোটো-বুর্জোয়া
অর্থে মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে আসেনি। মধ্যবিত্ত শ্রেণি-উৎস থেকে উঠে আসা কিছু
ব্যক্তি পপুলার ক্লাসের প্রয়াসের সাথে সামিল হয়ে এই আঘাত হানার প্রচেষ্টা করেছিলেন
যা পরিস্থিতিগত কারণে সাময়িকভাবে সফল হলেও সামগ্রিকভাবে একটি চলমান নাট্যধারার
জন্ম দিতে বিফল হয়েছে। অন্যদিকে আভিজাত্যের গণ্ডি পেরিয়ে মধ্যবিত্তের নাট্যচর্চাকে
কেন্দ্র করে রাষ্ট্র ও পুঁজি-নির্ভর কোন নাট্য-ইণ্ডাস্ট্রি ভারতবর্ষের কোথাও গড়ে
উঠেনি বলেই আমার ধারণা। নাট্য-আন্দোলন কথাটি উল্লেখ করলেই অনেকে একে সংকীর্ণ অর্থে
রাজনীতি হিসেবে বিবেচনা করেন এবং তাতে শিল্প কথাটির মাহাত্ম্য নিঃশেষ হয়ে গিয়ে
প্রচার-সর্বস্ব হয়ে যায় বলেই তাদের ধারণা। শিল্পগুণ বজায় রাখতে তারা যথাসম্ভব নাট্য-আন্দোলনের
ধারণা থেকে দূরে থাকারই পক্ষপাতী। যে সামন্ত শ্রেণির বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে নাট্যশিল্প
সহায়তা পেয়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল, সেই শ্রেণির কাছে এবং নব্য এলিট শ্রেণির কাছেও এই
শিল্প আর বিনোদনের মাধ্যম নয়, সুতরাং নাট্য-চর্চায় তাদের মদত আশা করা যায় না।
ইউরোপে যেমনি শিল্প-বিপ্লবকে কেন্দ্র করে উত্থানোন্মুখ বুর্জোয়া শ্রেণি জনগণকে
তাদের মতাদর্শের দিকে টেনে আনার জন্য নাটকের মত শক্তিশালী মাধ্যমকে ব্যবহার করার
উদ্দেশ্যে নাট্যচর্চাকে মদত দিয়েছেল সেরকম পরিস্থিতিও আমাদের নাট্যশিল্পী-পরিচালক
তথা কর্মীদের জন্য অনুপস্থিত, ফলে যেটুকু সীমাবদ্ধ রাষ্ট্রীয় মদত রয়েছে তারও কোন
মহৎ গণ-আবেগ তৈরির উদ্দেশ্য নেই। তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়ালো এই যে আমাদের মত দেশে বিশেষ
করে আমাদের মত অঞ্চলে নাট্য-চর্চার প্রাণশক্তিকে ধরে রাখতে হলে নাট্যশিল্পী-পরিচালক
তথা কর্মীদের নিজেদেরকেই উদ্যোগী হতে হবে। এই উদ্যোগী হয়ে ওঠার প্রবণতা থাকা মধ্যবিত্ত
লোকের সংখ্যা নিতান্তই কম হওয়ায় মধ্যবিত্তদের মধ্যে একটা চলমান টিম-ওয়ার্ক গড়ে
তোলা প্রায় অসম্ভব। সংখ্যার এই বাধা অতিক্রম করতে না পারলে কোন চলমান নাট্যচর্চাও
সম্ভব নয়।
নাটক যেহেতু শিল্পী ও দর্শকের এক জীবন্ত
সম্পর্ক স্থাপনের উপর নির্ভরশীল, তাই নাটকের কালজয়ী হয়ে উঠার গুণকে ভবিষ্যতের বিচারের
জন্য তুলে রাখা যায় না, নাটক করার জন্য প্রয়োজন জীবন্ত শিল্পী, দর্শক এবং এই দর্শককে
দেখানোর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা। তাই বিশ্ব নাট্যধারায় নাট্যশিল্প নিয়ে বিভিন্ন
মতবাদের বিতর্কগুলো গড়ে উঠেছে রাজনৈতিক ডামাডোলের পরিস্থিতিতে। ফরাসি-বিপ্লবের আগে-পরে,
রুশ-বিপ্লবের আগে-পরে, ইউরোপের শিল্প-বিপ্লবের পর্যায়ে বা ফ্যাসিবাদ বিরোধী
গণ-প্রতিরোধের সময়েই নাটকের বিভিন্ন মতবাদ গড়ে উঠেছে এবং তার ভিত্তিতে নাট্যচর্চার
গতি-প্রকৃতি নির্ধারিত হয়েছে। চীন বিপ্লব বা আমাদের মত দেশের কৃষক বিদ্রোহকে
কেন্দ্র করে মধ্যবিত্তের মধ্যে জনপ্রিয় তেমন কোন নাট্যধারা বা তা নিয়ে কোন আলোড়ণ
সৃষ্টিকারী বিতর্ক গড়ে ঊঠেনি, যেটুকু ব্যতিক্রমী চর্চা ছিল তার মূল ধারক-বাহক ছিল
পপুলার ক্লাস এবং তাকে ঘসেমেজে ঠিকঠাক করার দায়িত্ব নিয়েছিলেন কতিপয় আলোকপ্রাপ্ত
শিক্ষিত মধ্যশ্রেণির লোক। জীবন্ত দর্শক ও জীবন্ত দর্শকের কাছে পৌঁছনোর উপর যেহেতু
নাট্যশিল্প নির্ভরশীল, সুতরাং নাট্যচর্চার ক্ষেত্রে উপযোগিতাবাদ সবসময়ই একটি
অন্তর্নিহিত বিষয়। নাটক করার উদ্দেশ্য নাটকের শিল্পগুণকে বিনষ্ট করে না, বরঞ্চ এই
উদ্দেশ্যই নাটকের টিঁকে থাকার ও নতুন নাট্যধারা সৃষ্টির প্রয়াসের মূল প্রাণশক্তি।
এটি একটি নৈতিকতার প্রশ্ন নয়, এটি হচ্ছে বাস্তবচর্চার প্রশ্ন। বিশ্বনাট্যে যত
বিতর্ক, যত মতবাদ বা ধারা তাকে সেসময়ে বা বর্তমানে যে নামেই অভিহিত করা হোক না কেন
তা আসলে বাস্তবকে ব্যাখ্যা করা নিয়েই ভিন্ন ভিন্ন হাতিয়ার। কোন হাতিয়ার দিয়ে
বাস্তবকে বেশি ভালভাবে ব্যাখ্যা করা যায় এবং এই ব্যাখ্যার উপর দাঁড়িয়ে কোন নাট্যধারা
দিয়ে উপরোক্ত বাধার প্রাচীরগুলিকে দূর করা যায় সেটাই মূল বিচার্য। নাট্যধারা নিয়ে
এই চর্চা আসলে বিষয় ও বিষয়ীর বিচ্ছিন্নতাকে চেনা ও এই বিচ্ছিন্নতাকে দূর করার এক
প্রক্রিয়া সঞ্জাত। এটা কোন রাজনৈতিক নির্দেশ জারি করার বিষয় নয়, কিন্তু রাজনীতিতে
যেমন ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে রয়েছে এক উদ্দেশ্য ঠিক তেমনি নাট্যচর্চারও রয়েছে সমাজ-পরিবর্তনের
এক উদ্দেশ্য। এজন্যই রাজনৈতিক উথাল-পাতাল ও নাট্যচর্চার উত্থান-পতন হাতে হাত
ধরাধরি করেই চলতে দেখা যায়। কিন্তু একথা নিশ্চয়ই বলা যায় না যে নাট্যচর্চা
রাজনীতি-চর্চার বাইরে স্বতন্ত্র ধারা হিসেবে চালু থাকতে পারে না। নাট্যচর্চার
স্বয়ং-পরিচালনকে অস্বীকার করার ফলেই স্তালিন-পরবর্তী সোভিয়েত রাশিয়ায় নাট্য-চর্চায়
বন্ধ্যাত্ব দেখা দিয়েছিল, অন্যথায় স্তালিস্লাভস্কি-মেয়ারহোলদ বিতর্ক তাদের মতবাদকে
অতিক্রম করে যেতে পারত। কম্যুনিস্ট পার্টির হুকুমবাদ সত্বেও যে রাশিয়ায় ইয়েজি
গ্রোতোভস্কিকে আমরা পাই সংযোগ স্থাপনার তত্ব গড়ে তোলার ব্রতী হিসেবে, তার
অন্তর্নিহিত শক্তি নিহিত রয়েছে রুশ-বিপ্লবের প্রাণ শক্তির মধ্যে । তাঁর এই
প্রচেষ্টা গড়ে ওঠে আসলে নিজেকে জানা, মানুষকে জানা এবং কথার মারপ্যাঁচে বিমূর্ত বা
অ্যাবস্ট্রাক্ট হয়ে উঠে যে সত্যটি সেই মানবতাকে জানার মধ্য দিয়ে। লুকাচ-ব্রেশট
বিতর্কও আসলেও তাই সমাজ-পরিবর্তনের জন্য বাস্তবকে জানার ও উপস্থাপিত করার উদ্দেশ্য
সঞ্জাত। লুকাচের বাস্তববাদের সমালোচনা করতে গিয়ে ব্রেশট লিখেছেন “কোনও বাস্তববাদী
লেখক তাঁর জানা বিষয়ের পুনরাবৃত্তি করে সন্তুষ্ট থাকতে পারেন না, কারণ তা বাস্তবের
সঙ্গে জীবন্ত সম্পর্ক সূচিত করবে না”। আবেগের বিভিন্ন দিক যেমন অনন্বয় (alienation),অ্যারিস্টটলের বিমোক্ষণ (catharsis) ইত্যাদি নিয়ে যেসব
বিতর্ক হয়েছে সে সবগুলিও আসলে সমাজ-বাস্তবেরই অঙ্গ। আউগুস্তো বোয়ালকে
ব্রেশট পরবর্তী ব্রেশট বলা হলেও ব্রাজিলের সমাজ বাস্তবতার চর্চার মাধ্যমেই তিনি লিখলেন
‘Theatre of the oppressed’-এর তত্ব এবং ছড়িয়ে
দিতে সক্ষম হলেন নাট্য-আন্দোলনকে দেশ-কালের সীমানার বাইরে। সুতরাং বাস্তব চর্চা
অর্থাৎ দেশ-কালের সমাজ-রাজনীতি চর্চাই নতুন নাট্য আন্দোলন গড়ে তোলার মূল চাবিকাঠি।
অনেকে বলেন ফর্ম থেকে কনটেন্টে যাওয়া যায়, সেই কথাটা প্রযোজ্য হতে পারে কোন
পূর্ব-নির্ধারিত নাট্যধারা অনুশীলনের ক্ষেত্রে, নতুন নাট্য-অন্দোলন গড়ে তোলার
ক্ষেত্রে নয়। বাদল সরকারও তৃতীয় বিশ্বের বাস্তব বিষয়ের উপর দাঁড়িয়েই একটা রূপের
জন্ম দিয়েছিলেন – এই ফর্ম ও কনটেন্টকে এখন আর আলাদা করা যায় না এবং ফর্মের ভাণ্ডে
প্রবেশ করার চেষ্টা করলেই কনটেন্টের ভাণ্ডে স্বাভাবিক প্রবেশ ঘটে যায়। সুতরাং
আমাদের নিজস্ব বাস্তব চর্চা থেকেই আমাদের নাট্যচর্চার দিশা ঠিক করতে হবে, এছাড়া
বিকল্প কোন পথ নেই। বাস্তব যেহেতু স্তরীভূত, তাই বাস্তবকে জানার প্রচেষ্টাও এক
চলমান সচেতন প্রচেষ্টা - একমাত্রিক ও এককালীন নয়। আমাদের এই বাস্তবের কিছু সাধারণ
দিকের কথা আগে উল্লেখ করেছি, এবার আরও কিছু দিক তুলে ধরার প্রয়োজন বোধ করছি।
সাম্প্রতিককালে মেট্রোসিটি কিংবা শহরগুলিতে
কতকগুলো বিদ্রোহ সংগঠিত হতে দেখেছি যেখানে মধ্যবিত্ত প্রফেশন্যাল ক্লাসের অংশগ্রহণ
ছিল স্বতঃস্ফূর্ত ও ব্যাপক। কিন্তু বিদ্রোহগুলি হয় স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে নতুবা
বিপথগামী হয়ে নতুন কোন মহৎ আবেগ তৈরিতে ব্যার্থ হয়েছে। অন্যদিকে পপুলার ক্লাসকে
সমাবেশিত করে ভাষা-সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে প্রোটো ও পেটি-বুর্জোয়া শ্রেণির
বিদ্রোহগুলিও সংকীর্ণতায় নিমজ্জিত হয়েছে। এর থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার হয়ে পড়ে যে
এই শ্রেণিগুলো এত শক্তিশালী নয় যে তারা নিজেরাই স্বাধীনভাবে কোন নতুন চিন্তার জন্ম
দিতে পারে। এই পর্যবেক্ষণ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে বাধ্য করে যে আজকের সময়ে যখন
বিনোদনের জন্য হাজারো মাধ্যম স্থিতাবস্থা বজায় রাখার পক্ষে সরকারি ও বেসরকারিভাবে
ব্যবহৃত হচ্ছে, সেই সময়ে নতুন নাট্যধারা সৃষ্টির জন্য যে প্রাণশক্তির প্রয়োজন তা শ্রেণি
হিসেবে শহুরে শিক্ষিত মধ্যশ্রেণির সম্ভবত নেই এবং সেজন্য তারা বাস্তব-চর্চা থেকেও মুখ
ফিরিয়ে রয়েছেন, ঘর থেকে বেরিয়ে দু’পা ফেলে তারা দেখতে আগ্রহী নন তাদের প্রতিবেশিরা
কী করছে। সুতরাং যে কতিপয় ব্যক্তি নাট্যচর্চা করতে চূড়ান্তভাবে আগ্রহী তারা কোন
জায়গা থেকে যাত্রা শুরু করবেন? আমার মতে বাস্তবকে এই মধ্যবিত্ত সৌখীন
নাট্যপ্রেমীদের চোখের সামনে তুলে আনতে হবে, গাঁয়ে-ভূয়ের-চাবাগানের
চাষা-ভূষা-লেবারদের জীবনের নাটক এনে তাদের সামনে হাজির করতে হবে। এই কুশীলবরা যখন
এদেরই জীবন-বাস্তব ও বিমূর্ত-আবেগ এদের সামনে তুলে ধরবে তখন তারা লজ্জা পাবে প্রতিবেশিকে
চেনে না জানে না বলে – আশ্চর্য হবে এই ভেবে যে এরাও পারে। এই বোধ থেকেই শুরু হতে
পারে বাস্তব-চর্চার যাত্রা এবং এই যাত্রা থেকেই শুরু হতে পারে সমস্ত বাধা-বিপত্তি
অতিক্রম করে নতুন নাট্যধারার আন্দোলন গড়ে তোলার প্রাণচাঞ্চল্য।
(অভ্র নামিয়ে নিলে বাংলাতে লেখাটা এমনিতেই পড়তে পাবেন।যাদের তাতেও সে সময় নেই তাঁরা নিচে পিডিএফ পড়তে পারেন। সে ক্ষেত্রেও আপনার ফ্লাসপ্লেয়ারের দরকার পড়তে পারে)
1 comments:
লেখাটা পড়লাম। কয়েকটি জায়গা নিশ্চয় ভালো লেগেছে। তাহলো বরাকউপত্যকার নাটকের অতীতকে অস্বীকার করবার প্রবণতাকে সমালোচনা করা। কিন্তু সেই অতীত যে পর্যালোচনা শুরু হওয়া উচিত গণনাট্য থেকে নয়, একেবারে প্রাচীন নাট্যকলার পরম্পরার থেকে। "বরাক উপত্যকায় ঐ পর্যায়ে কীধরনের নাট্যচর্চা হয়েছিল তার কোনো লিখিত বয়ান আমাদের কাছে নেই এবং এব্যাপারে আমার কোন ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাও থাকার কথা নয়। কিন্তু একথা আমাদের মনে রাখতে হবে যে বাঙালি অধ্যুষিত বরাকভূমি পূববাংলারই সম্প্রসারিত অংশ এবং ‘নবান্ন’ নাটকের পর পূববাংলাতেই আইপিটিএ’র শাখা গড়ে ওঠে এবং তেভাগা-নানকার কৃষক বিদ্রোহ বর্তমান বরাক উপত্যকার বিস্তৃত অঞ্চলকেও প্রভাবিত করে। " বরাকউপত্যকাতে মণিপুরি-ঝাড়খণ্ডী নাট্যধারার সঙ্গে বাংলানাটকের ধারার আদান-প্রদানের ইতিবৃত্তও বহু পুরোনো। গণনাট্যের সময়েও এটা ছিল। এই কথাটাও মোটের উপর সঠিক,"বরাকের নাট্যচর্চার ক্ষেত্রে নতুনের এই সন্ধান শুরু হতে পারে অতীত অভিজ্ঞতার সার সংকলন, বরাকের জনসমাজকে জানা ও বোঝার প্রচেষ্টা, গণ-আবেগকে বুঝতে ইতিহাসের চর্চা ও সর্বোপরি নন বিষয়বস্তু ও আঙ্গিক নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার প্রচেষ্টার মাধ্যমে। এই কাজ করার জন্য বরাকে এক শক্তিশালী নাট্যকর্মীদলের উপস্থিতি রয়েছে, প্রয়োজন শুধু সঠিক দৃষ্টিভঙ্গির। " এই সঠিক 'দৃষ্টিভঙ্গীটি' একটি ফাঁকি। কারণ, এর আগেই শিল্পের প্রয়োজনীয় ন্যূনতম ঐক্যের দৃষ্টির কথাটি স্পষ্ট। বাকিটা একেবারেই বিমূর্ত। এবং এখানে ঐকমত্যের সম্ভাবনা প্রায় নেইই। সেটি যদি রাজনৈতিক দৃষ্টির কথা হয় তবে তাও হতে অন্যায় নেই, কিন্তু সেটি সাধারণভাবে নাট্যকর্মীদের দৃষ্টিভঙ্গী হবে না। এ শিল্পের কর্মপ্রক্রিয়ার প্রশ্ন। রাজনৈতিক হতাশার নয়। এই যে কথাটা,"সামগ্রিকভাবে নাট্যচর্চা এই নিবন্ধের বিষয় নয়, বরঞ্চ নাট্যচর্চা কখন নাট্য আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করেছে এবং সমাজে আলোড়ণ সৃষ্টি করতে পেরেছে সেটাই এখানে আলোচ্য বিষয়।" বোঝাগেল আন্দোলন কথাটাকে এখানে শৈল্পিক অর্থে নয় রাজনৈতিক অর্থে নেয়া হয়েছে। এবং ইতিবৃত্ত পড়ে যেটি বোঝা গেল, তা এই যে পূঁজিবাদের সংকটের বেলা রাজনৈতিক উদ্যম যেভাবে বাড়ে, তেমনি নাট্যশিল্প আন্দোলনের চেহারা নেয়। সংকট কোনো ভাবে কেটে গেলে রাজনীতিতেও যেমন একটা আপোসের ভাব আসে, তেমনি আসে নাটকেও। এই ব্যাখ্যাতে কোনো ত্রুটি নেই। কিন্তু তাতে সামগ্রিক নাট্যচর্চার কোনো সমস্যা আছে কি? আধুনিক নাটক একটি পশ্চিমা আঙ্গিক। এবং মূলত শহুরে মধ্যবিত্তদের শিল্প আঙ্গিক। এ কালে ভদ্রে গ্রামাঞ্চলে গেলেও শহুরে মাধ্যম হিসেবেই যায় , এর কি আদৌ কখনো সমস্ত জনতার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অঙ্গ হবার আশা আছে? আর নাহলেই বা হতাশার কিছু আছে কি? আমিতো মনে করি, চিত্রভানুর 'আইজও আন্ধাইর' কিম্বা শেখর দেবরায়ের 'মনসাকথা' বরাক উপত্যকার স্বাতন্ত্র্যকে চেনাতে সাহায্য করে। এমন কিছু নজির টেনে কথা বললে লেখাটা আরো আকর্ষণীয় হতো। "তথাপি গ্রামসমাজের বিষয়বস্তুকে শহরে তুলে এনে নগরকেন্দ্রিক এবং ‘শিক্ষিত-ভদ্দরলোক’ নিয়ন্ত্রিত নাট্য ধারার সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে বাদল সরকারের এই প্রয়াস নাটকের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্ষেত্রে এক অগ্রগতি হিসেবেই বিবেচিত হয়।" এখানে 'তুলে এনে' কথাটি সঠিক। আর বাদল সরকারের নাটকও শিক্ষিতমধ্যবিত্তের নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল, মেনে নিতে কষ্ট হয়। মনে হয়, 'আরোপ' বলে। হ্যা, তিনি প্রচুর ভালো নাটক করেছেন, সেই নাটকগুলো আগামীদিনে আর বহু ভালোনাটকের প্রেরণাস্রোত হিসেবে কাজ করবে। পথনাটককে একটা শিল্পে পর্যায়ে তুলে এনেছেন। কিন্তু সেই প্রেরণাতে বরাক উপত্যকার নিজস্ব নাটক লেখা হতেই পারত। হয়েছে বলে জানি না, যদিও তাঁর নাটক অভিনীত হয়েছে প্রচুর। কারণ, কলকাতার শিল্পীদের নাটক, গান , কিম্বা কবিতার আমাদের এখানে বাজার সবসময়েই ভালো।
Post a Comment