বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন ও বামপন্থা

Posted by স্বাভিমান


বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন ও বামপন্থা
(বরাক কন্ঠ, ১৯শে মে সংখ্যার জন্য)
অরূপ বৈশ্য
আজকের সময়ে প্রথমবারের মত যদি কোন পর্যবেক্ষক বরাক উপত্যকার মাটিতে পা রাখেন, তাহলে ‘বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে সংকীর্ণ রাজনীতি’, ‘জনৈক বিধায়িকার বৈবাহিক সম্পর্ক নিয়ে চর্চা’ ইত্যাদি বিষয়ের প্রাবল্য দেখে ১৯শে মে’র ঐতিহ্য নিয়ে তাঁর সংশয় দেখা দেবে। বৌদ্ধিক চর্চার ও ভাষা বিকাশের কেন্দ্র হিসেবে যে বিশ্ববিদ্যালয় ১৯শে মে’র ঐতিহ্যের প্রতীক হয়ে উঠতে পারত, বরাকের দুর্বল মধ্যশ্রেণির দিল্লি-দিসপুরের হুকুম-নির্ভর রাজনীতির তল্পিবাহক বর্ণহিন্দু বৌদ্ধিক সমাজ সেই বিশ্ববিদ্যালয়কে তাদের বুদ্ধিবৃত্তিগত চর্চার প্রতীক করার বদলে আধিপত্য বজায় রাখার ‘মহান খেলায়’ ১৯শে জুনের প্রতীক করে তুললেন। ১৯শে মে’র গুলিচালনার ঘটনার প্রতিবাদে উত্তাল হাইলাকান্দি কীভাবে এবং কেন অতর্কিতে ১৯শে জুনের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পরিণতির দিকে পা বাড়াল তার একটা আঁচ পাওয়া যায় আজকের সময়ের উপরুল্লিখিত পরিণতির মধ্যে।
বরাকের একষট্টির ভাষা আন্দোলন নিয়ে আলোচনা করার সময় পার্শ্ববর্তী বর্তমান বাংলাদেশ বা তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের সেসময়কার পরিস্থিতি বিবেচনায় রাখা উচিত। একই ভাষিক-সাংস্কৃতিক অঞ্চল ছাড়াও যে মুখ্য কারণগুলো আমাদেরকে সেখানকার পরিস্থিতি বিবেচনায় রাখতে বাধ্য করে তা হলো – এক, বরাক উপত্যকার বর্তমান করিমগঞ্জ জেলা পূর্ব-পাকিস্তানের সিলেট জেলা থেকে রাজনৈতিকভাবে বিচ্ছন্ন হয়ে যাওয়ার পর খুব বেশি সময় অতিবাহিত হয়নি – বিচ্ছিন্ন হওয়ার সময়ের যুবকরা ভাষা আন্দোলনের সময়ও যুবক; দুই, করিমগঞ্জ জেলার ভূমি ব্যবস্থা, আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা, অতীত সংগ্রামের ঐতিহ্যের সাথে মিল; তিন, তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান থেকে ছিন্নমূল উদ্বাস্তুদের মূলত কাছাড় জেলার ও শহর শিলচরে বসতি এবং বিভিন্ন পেশায় ও সরকারি চাকুরিতে থিতু হওয়া। এছাড়া যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি আমাদের দৃষ্টি এড়িয়ে যাওয়া উচিত নয় তা হলো, বরাকের একষট্টির ভাষা আন্দোলনের সময়কালেই পূর্ব-পাকিস্তানের বাঙালি জাতিয়তাবাদের উন্মেষ।
পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করার পর আয়ুব খান ১৯৫৮ সালের ২৪ অক্টোবরে ঢাকার পল্টন ময়দানে প্রথম জনসভা করেন। এই জনসভায় পূর্ব-পাকিস্তানের লাখো বাঙালির স্বতঃস্ফূর্ত সমাবেশ পশ্চিমী শাসকের প্রতি জনসমর্থনকে দেখায়। ঐ জনসভার আগেই মৌলানা ভাসানি ও ন্যাশনেল আওয়ামি পার্টির নেতাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের কঠোর সামন্ত ব্যবস্থার কাঠামো থেকে বেরিয়ে আসা নতুন গ্রামীণ বুর্জোয়া শ্রেণি যখন আয়ুব খানের রাষ্ট্রীয় নীতির সমর্থনে এগিয়ে আসছে, তখন পূর্ব-পাকিস্তানের সামন্ত অবশেষের ধারক জোতদার-মহাজন শ্রেণির সাথে সমঝোতা করে আয়ুব খান তাঁর সমর্থন ভিত্তি তৈরি করেছেন। অর্থাৎ প্রগতিশীল ভূমিকা পালন করতে সক্ষম নব্য পুজিঁমালিক গ্রামীণ বুর্জোয়ারা যখন পশ্চিম পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় শ্রেণি, তখন পূর্ব-পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় শ্রেণি প্রতিক্রিয়াশীল প্রাক-পুঁজি বা অ-পুজিঁবাদী জোতদার-মহাজনরা যারা স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে অত্যন্ত আগ্রহী থাকে। শাসনের কোন কোন পর্যায়ে দিসপুরের শাসকও ব্রহ্মপুত্র-বরাকে এরকম বিপরীত ধরনের শ্রেণি সমঝোতা গড়ে তুলেছে কিনা তা বিচার করে দেখা যেতে পারে। সে যাই হউক, পূর্ব-পাকিস্তানের এই শ্রেণি সমঝোতাকে হাতিয়ার করে সামরিক শাসনের উপর ১৯৬০-এর ১৫ ফেব্রুয়ারীর আস্থা ভোটের পক্ষে আয়ুব খান পূর্ব-পাকিস্তানে ৯৫.৬% ভোট পান। এরকম এক পরিস্থিতিগত প্রেক্ষাপটেই পূর্ব-পাকিস্তানে কম্যুনিস্ট পার্টি স্বাধীন পূর্ব-পাকিস্তানের পক্ষে মত পোষণ করে। কিন্তু কেন এবং কীভাবে কম্যুনিস্ট পার্টি বাঙালি জাতিয়তাবাদের নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হয় তার একটা যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা তুলে ধরেছেন বদরুদ্দিন উমর তাঁর ‘দ্য ইমারজেন্স অব বাংলাদেশ (দ্বিতীয় খণ্ড)’ গ্রন্থে। পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক শাসন ও সাম্রাজ্যবাদের মদতপুষ্ট পশ্চিম পাকিস্তানী বুর্জোয়াদের পুঁজির আধিপত্যের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান শ্রমিক-কৃষক-ছাত্র বিক্ষোভ ও প্রতিরোধ        পূর্ব-পাকিস্তানের বাঙালি জাতিয়তাবাদের কোর হিসেবে বিকশিত হতে থাকে এবং এই প্রতিরোধ আন্দোলন পশ্চিমী শাসকদের সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাজনীতিকেও প্রতিহত করে। কিন্তু কম্যুনিস্ট পার্টি এই জাতিয়তাবাদকে শ্রমিক শ্রেণির ও গণ-আকাঙ্খার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার করেনি। ১৯৬২-এর ইন্দো-চীন যুদ্ধের পর দুই শিবিরে বিভক্ত কম্যুনিস্ট পার্টির উভয় গোষ্ঠী পূর্ব-পাকিস্তানের জাতিয়তাবাদের প্রশ্নে কোন সুনির্দ্দিষ্ট নীতি গ্রহণ করতে পারেনি। কারণ পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠীর অবস্থান সোভিয়েত রাশিয়া না চীন কার বেশি সহায়ক – এটাই মুখ্য বিচার্য বিষয় হয়ে ওঠে। ফলে এই বাঙালি জাতিয়তাবাদের নেতৃত্ব চলে যায় বাঙালি মধ্যশ্রেণির হাতে। সবাইকে নিয়ে ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট পরিচালনে আগ্রহী সুরাবর্দীর মৃত্যুর পর শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামি লিগকে পুনরুজ্জীবিত করেন এবং সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ও শ্রমিক-কৃষকের স্বার্থসম্বলিত বিষয়গুলিকে বাদ দিয়ে বাঙালি উগ্রজাতিয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির ছত্রছায়ায় সবাইকে সমাবেশিত করেন। তথাপি সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ও সাম্প্রদায়িক বিভাজনের বিরুদ্ধে শ্রমিক-কৃষক-ছাত্রদের প্রতিরোধ আন্দোলন ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এক পৃথক জাতি-রাষ্ট্র গঠনের আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়। কিন্তু বরাক উপত্যকায় ভাষা আন্দোলন নিঃশেষিত হয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মধ্য দিয়ে। এই করুণ পরিণতির কারণ হিসেবে যারা পিছিয়ে পড়া অর্থনীতিতে ক্রিয়াশীল ইসলামী মৌলবাদী ও মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় আবেগকে দেখাতে চান তাদের যুক্তি যে ধোপে টেকে না, তার জলজ্যান্ত প্রমাণ পূর্ব-পাকিস্তানের ভাষা  আন্দোলনের পরিণতি। বরঞ্চ এই পরিণতির কারণ খোঁজার জন্য অন্য একটি পর্যবেক্ষণের দিকে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করা মনে হয় সমীচীন হবে।
বরাকের বুদ্ধিজীবীদের একষট্টির ভাষা আন্দোলনের তথ্য সম্বলিত যে সব পুস্তক প্রকাশিত হয়েছে সেইসব পুস্তকে সন্নিবিষ্ট তথ্যে দেখা যায় যে গণঅংশগ্রহণের মাধ্যমে করিমগঞ্জ জেলা থেকে এই আন্দোলনের সূত্রপাত  হয়ে শেষ পর্যায়ে নেতৃত্ব চলে আসে শিলচরে এবং তারপর ১৯শে জুনের ঘটনার মধ্য দিয়ে তার পরিসমাপ্তি ঘটে। ছিয়াশির আন্দোলনের সাথে ব্যক্তিগতভাবে জড়িয়ে থাকার সুবাদে এই লেখকেরও অনুরূপ অভিজ্ঞতা হয়েছে। করিমগঞ্জ জেলাতেই আন্দোলন দানা বাঁধে এবং পরবর্তীতে শিলচরের নেতৃত্বে আন্দোলনের প্রাণশক্তি লোপ পায়। এই পর্যবেক্ষণের একটি ব্যাখ্যা এভাবে দেওয়া যেতে পারে। বাংলাদেশের মত করিমগঞ্জ জেলায় কৃষক আন্দোলনের এবং কিছু পরিমাণে শ্রমিক আন্দোলনের এক ঐতিহ্য রয়েছে এবং কম্যুনিস্ট পার্টিগুলো দীর্ঘকাল এই ঐতিহ্য বহনও করেছে। ফলে ভাষিক অধিকারের সংগ্রামও দ্রুত গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু জাতিয়তার প্রশ্নে কম্যুনিস্টদের অস্বচ্ছ ও দোদুল্যমান দৃষ্টিভঙ্গির ফলে নেতৃত্ব চলে যায় ডানপন্থী মধ্যবিত্ত নেতৃত্বের হাতে। শ্রমিক ঐক্যে বিঘ্ন ঘটা নিয়ে শংকিত ভারতীয় কম্যুনিস্টরা কখনওই ‘নিপীড়িত জাতি থেকে আসা কম্যুনিস্ট ও নিপীড়ক জাতি থেকে আসা কম্যুনিস্টদের দ্বিবিধ ভূমিকার’ লেনিনীয় সূত্রায়নকে খুব দক্ষতার সাথে কাজে লাগাতে পারেনি। নেতৃত্বদায়ী মধ্যবিত্ত কম্যুনিস্টদের উগ্রজাতিয়তাবাদী ‘ইনার কোর’-এর প্রভাব বিস্তারকারী স্পৃহা এর পেছনে মুখ্য কারণ হিসেবে কাজ করেছে। তাই বরাকের ভাষা আন্দোলনের লাগাম যখন চলে আসে মধ্যবিত্ত শ্রেণি ও তাদের প্রধান দল কংগ্রেসের হাতে, তখন স্বাভাবিকভাবেই এই আন্দোলনের কেন্দ্র হয়ে ওঠে শিলচর। ব্যবসা-বাণিজ্য-ক্ষুদ্র উৎপাদন ও বিভিন্ন পেশাকে কেন্দ্র করে যে  মধ্যশ্রেণি তখন গড়ে উঠেছিল, করিমগঞ্জ জেলায় এই শ্রেণিটি ছিল খুবই দুর্বল। দেশভাগজনিত উদ্বাস্তুদের হিন্দু চেতনার প্রভাব বেশ প্রকটভাবেই ছিল এই মধ্যশ্রেণির উপর। উপরন্তু সুজিৎ চৌধুরী তাঁর ‘শ্রীহট্ট কাছাড়ের প্রাচীন ইতিহাস’ গ্রন্থে যেভাবে সিদ্ধেশ্বর কপিলাশ্রমে মন্দির ভিত্তিক অর্চনা এবং বারুণী স্নান --- উচ্চবর্ণ ও নিম্নবর্ণের ধর্মাচারের দুটি সমান্তরাল ধারার টানাপোড়েনকে সুদূর অতীতের ধর্মীয় সংঘাতের ক্ষীয়মান ধারা হিসেবে দেখাতে চেয়েছেন, কাছাড়ের বর্তমান বাস্তব সমাজজীবনেও সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় এই দূরত্ব খুবই প্রকটভাবে বিদ্যমান। তাই বরাকের মধ্যশ্রেণির নেতৃত্বে ভাষিক জাতিয়তাবাদ বরাকের মুসলিমদের এবং এমনকী স্থানীয় তপসিলিদেরও প্রভাবিত করতে ব্যর্থ হয়। দিসপুরের শাসক শ্রেণির সাথে বরাকের বর্ণহিন্দু মধ্যশ্রেণির দ্বন্দ্ব সরকারি সুযোগ-সুবিধার ভাগবাটোয়ারার সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, অথচ অন্যান্যদের স্বার্থ ছিল মূলত ভূমিকেন্দ্রিক এবং এক ক্ষুদ্র মুসলিম বিত্তশালীদের উৎপাদনশীল বিনিয়োগের সুযোগের সাথে। তাই আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে মুসলিমদের যে ব্যাপক অংশগ্রহণ ছিল নেতৃত্বের হাত বদলের সাথে এই জনসমর্থনকে ক্রমশঃ দূরে ঠেলে দিতে সমর্থ হয় অসমীয়া উগ্রজাতিয়তাবাদী নেতৃত্বের তল্পিবাহকরা। ফলে কম্যুনিস্ট পার্টির ব্যর্থতার সুযোগে সাম্রাজ্যবাদ ও দেশীয় শাসকদের সাথে আপসকারী পূর্ব-পাকিস্তানের মুসলিম মধ্যশ্রেণি যখন ভাষিক জাতিয়তাকে এক পৃথক রাষ্ট্র গঠনের আন্দোলনে রূপান্তরিত করতে পারল, তখন প্রায় একই প্রেক্ষাপটে বরাকের মধ্যশ্রেণির পৃথক রাজ্য গঠনের দাবি সম্প্রদায়গত শঙ্কা ও সংঘাতের মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হল।
উভয়ের প্রেক্ষাপট মোটামুটিভাবে একই বলার পেছনে যে বিষয়গুলি যুক্তিগ্রাহ্য হিসেবে বিবেচিত হতে  পারে তা হলো – এক, প্রায় একই সময়ে উভয় অঞ্চলে ভাষা আন্দোলনের বিকাশ; দুই, উভয়ই একই সাংস্কৃতিক অঞ্চলের অঙ্গ। এব্যাপারে আচার্য নিহাররঞ্জন রায়ের বক্তব্য উদ্ধৃত করা যেতে পারে – “বরাক ও সুরমা নদীর উপত্যকা মেঘনা উপত্যকারই (মৈমনসিং-ত্রিপুরা-ঢাকা) উত্তরাংশ মাত্র। এই দুই উপত্যকার মধ্যে প্রাকৃতিক সীমা কিছু নাই বলিলেই চলে। ......এখনও শ্রীহট্ট-কাছাড়ের হিন্দু-মুসলমানের সমাজ ও সংস্কৃতি বাংলার পূর্বতন জেলাগুলির সঙ্গে একসূত্রে গাঁথা। শুধু তাহাই নয়, লৌকিক ও অর্থনৈতিক বন্ধনও বাংলার এই জেলাগুলির সঙ্গে”। তিন, বহির্বিশ্বের সাথে যোগাযোগের জন্য বাংলাদেশের যেমন রয়েছে সামুদ্রিক জলপথ, তেমনি পশ্চিমবঙ্গের মধ্য দিয়ে বহিঃরাজ্যের সাথে যোগাযোগের জন্য বরাকের রয়েছে বাংলাদেশের স্থলভূমি। সুতরাং বিচ্ছিন্ন হওয়ার আকাঙ্খার মধ্যে ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতার কোন ভীতি ক্রিয়াশীল ছিল না।
রঞ্জিত হসকোতে ও ইলিজা ট্রোজানোয় তাদের “কনফ্লুয়েন্স” গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে বাণিজ্যপথ ও নদী-সমুদ্রের সঙ্গমস্থলেই বিভিন্ন ভাষা-সংস্কৃতির সংমিশ্রণ ঘটে ও মহান সভ্যতাগুলি গড়ে উঠে – প্রাচীন আলেকজান্দ্রীয়া এর এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ যা এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার সঙ্গমস্থল হিসেবে গড়ে উঠেছে। বরাক উপত্যকা সহ বাংলার পূর্বাঞ্চল এরকমই সঙ্গমস্থলের এক ক্ষুদ্র সংস্করণ যেখানে অনেকগুলো বাণিজ্যপথ ও নদী-সমুদ্র এসে মিলেছে। উপরন্তু উর্বর নদী-উপত্যকা গড়ে উঠার সাথে সম্পর্ক রেখে বাংলার পূর্বাঞ্চল ও বরাক উপত্যকার বিস্তৃত অঞ্চলে লাঙ্গলভিত্তিক সভ্যতার উন্মেষ পশ্চিমবঙ্গের পরে ঘটায় এখানে সভ্যতার এক বিশেষ উপাদান সংযোজিত হয়েছে। এঅঞ্চলে ইসলাম ধর্ম বাঙালির ইসলাম হিসেবে বিকশিত হয়। রিচার্ড এম ঈটন তাঁর ‘দ্য রাইজ অব ইসলাম এন্ড দ্য বেঙ্গল ফ্রন্টিয়ার’ গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে এঅঞ্চলে ইসলাম ‘সভ্যতা বিকাশের মতাদর্শ’ হিসেবে -- লাঙ্গলভিত্তিক ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। স্থায়ী কৃষির বিকাশের জন্য হিন্দু ব্রাহ্মণদের চেয়ে মোল্লা, হাজী সহ অন্যান্য ইসলাম ধর্মীয় প্রবক্তাদের বসতি স্থাপনের জন্য প্রত্যন্ত অঞ্চলে অনেক বেশি জমি মিলেছিল এবং ফলে জঙ্গল সাফাইয়ে কুঠার, জমি আবাদের জন্য লাঙ্গল, ধর্মীয় মতাদর্শের জন্য ধর্মগ্রন্থ যা বহুলভাবে উপলব্ধ করানোর জন্য ইসলামী সভ্যতার কাগজ তৈরির প্রযুক্তি – এই সব মিলে বাঙালিত্বের সঙ্গে ইসলাম মিশে গিয়েছিল। ফলে এতদঅঞ্চলের বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডারে আরবি-পার্শি শব্দের প্রাধান্য দেখা যায় এবং এই প্রাবল্য সভ্যতা বিকাশের সাথে সংযোজিত হওয়ায় বাংলা ভাষার প্রাণশক্তিকেও বহন করে। ফলে পূববাংলা বা বরাক উপত্যকায় ইসলামের সাথে বাঙালিয়ানার কোন দ্বন্দ্ব নেই। বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলনে এই দ্বন্দ্ব দেখা দেয় হিন্দু মধ্যশ্রেণির নেতৃত্বের অপরিণামদর্শিতা ও সংকীর্ণতা এবং কম্যুনিস্ট নেতৃত্বের ব্যর্থতার ফলে। একষট্টির ভাষা আন্দোলনের এই পরিণতি বরাকবাসীর সংগ্রামী চেতনার মেরুদণ্ডকেই ভেঙে দিয়েছে। নতুন করে জেগে ওঠা শ্রমিক-কৃষক-ছাত্র আন্দোলনের প্রেক্ষিতে এক সুস্থ জাতিয়তাবাদ আবারও মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে কিনা তা সম্পূর্ণতই নির্ভর করছে নয়া বামপন্থার উত্থানের উপর। 

0 comments:

স্বাভিমান:SWABHIMAN Headline Animator

^ Back to Top-উপরে ফিরে আসুন