উনিশের ঐতিহ্য ও বরাকের বুদ্ধিজীবী সমাজ
Posted by
উনিশের ঐতিহ্য ও
বরাকের বুদ্ধিজীবী সমাজ
(আমাদের সমকালের
জন্য)
অরূপ বৈশ্য
রবীন্দ্র সার্ধশতবর্ষ পূর্তির আবেশের মধ্যেই উনিশের আগমনী।
সেদিন আমার এক বন্ধুর মোটরবাইকের পিঠে চেপে যাচ্ছিলাম – হঠাৎ বন্ধুটি বলে উঠল,
রবীন্দ্রনাথ নিয়ে যে আদিখ্যেতা হচ্ছে তাতে ‘বাঙালি এলিটিজম’ বাড়বে এবং বন্ধুটি যে
মেটাফর দিয়ে মধ্যবিত্ত মানুষের চরিত্র বর্ণণা করল তা অত্যন্ত জুতসই হওয়া সত্বেও
‘ভদ্দরলোক শিষ্টাচারের’ নিয়ম মেনে এখানে উল্লেখ করা থেকে বিরত থাকলাম। আমার
বন্ধুটি সাধারণ বাস্তব জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে যে মন্তব্যটি করেছে, পরিশীলিতভাবে
প্রায় অনুরূপ মন্তব্য সম্প্রতি অর্থনীতিবিদ ও বামপন্থী বুদ্ধিজীবী অশোক মিত্র
করেছেন আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে। আটপৌরে জ্ঞান ও বুদ্ধিদীপ্ত
জ্ঞানের পর্যবেক্ষণ এক্ষেত্রে প্রায় একই। উনিশে মে দিবস পালনের নির্ঘন্টও কী
‘বাঙালি এলিটিজমের’ গণ্ডি পেরুতে পারছে? উনিশে মে’র মহান ঐতিহ্যের আবেশে
মোহাচ্ছন্ন করার প্রয়াসের বাইরে গিয়ে কেঊ কি এই প্রশ্ন উত্থাপন করেছে যে
স্বাধীনতার মাত্র তের বছরের মাথায় দেশীয় শাসকের জহ্লাদ বাহিনীর বুলেট কেন আমাদের
উপর বর্ষিত হয়? কেউ কি এই প্রশ্ন করেছে যে কোন ঐতিহ্য ১৯শে মে-কে ১৯শে জুনের সাম্প্রদায়িক
বিভাজনে কালিমালিপ্ত করে নতজানু হয়ে শাসকের বুলেটের ক্ষমতার কাছে আত্মসমর্পণ করতে
বাধ্য করে যার পরিণতিতে মেহরোত্রা কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশ না করে ও দোষীদের শাস্তি
না দিয়ে অনায়াসে জহ্লাদরা পার পেয়ে যায়? এই প্রশ্নগুলি না করে উনিশের ঐতিহ্য নিয়ে ‘আহ্লাদে
আটখানা’ হয়ে স্বস্তিবোধ করলে আমাদেরকে ‘ভূতের রাজার’ বর পাওয়ার অপেক্ষায় কালাতিপাত
করতে হবে। সুতরাং আমাদেরকে এই নিষ্ঠুর প্রশ্নগুলির উত্তর সন্ধান করতেই হবে, নাহলে
আমাদের মেরুদণ্ডটি তো ইতিমধ্যে ভেঙেছে – এবার মাথায় হাঁড়ি ভেঙে অচৈতন্য হওয়ার
ব্যবস্থা পাকা করা যাবে এবং হাঁড়ির দৈ যে নেপোয় খাবে এ নিশ্চিত।
ভূমিকার মেদবৃদ্ধি না করে এবার সরাসরি উপরুক্ত প্রশ্নগুলোতে
আসা যাক। বরাক উপত্যকার বাসিন্দাদের মত ভারতবর্ষের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর
ভাগ্য-বিড়ম্বনা কিন্তু রচনা হয়ে যায় দেশভাগের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা প্রাপ্তির সময়।
শিল্পমালিক ও মধ্যবিত্তশ্রেণির নেতৃত্বে ইউরোপ যখন আধুনিক সমাজ গড়েছে, তখন
বিড়লাদের মত ‘বম্বে ক্লাবের’ সদস্যরা ভূস্বামীদের সাথে আঁতাত করে কংগ্রেস
নেতৃত্বকে আপসের পথে ঠেলে দেয়। আধিপত্য প্রতিষ্ঠার এই শ্রেণি আকাঙ্খাই হিন্দু ও
মুসলিম ভারতে আমাদের দেশপ্রেম বিভাজিত হয়ে যায়। অথচ পার্শ্ববর্তী চীন দেশেও
জনগোষ্ঠীগত জটিলতা ছিল, কিন্তু ঐক্যবদ্ধ চীনারা আমাদের দু’বছর পর স্বাধীনতা অর্জন
করে এবং শ্রমিক-কৃষক শ্রেণির প্রতিনিধিত্বকারী কম্যুনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে আধুনিক
সমাজ গড়ার দিকে অনেকদূর এগিয়েও যায়। কিন্তু গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার মাওয়ের
প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় কম্যুনিস্ট পার্টির অভীষ্ট লক্ষ্য থেকে চীনা সমাজ বিপরীত
দিকে ঘুরে যায়। ভারতবর্ষে বহুদলীয় গণতন্ত্র চালু হলেও এমন এক সাংবিধানিক গণতন্ত্র
জারি করা হয় যা বাহ্যত ফেডারেল, কিন্ত অন্তর্বস্তুতে এককেন্দ্রিক। স্বাধীনতা
আন্দোলনের গর্ভে যে ভাষাভিত্তিক জাতিয়তাবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠে তাকে সামাল দিতে
ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠন করা হলেও, এই ভাষিক জাতিয়তাবাদের পূর্ণ বিকাশকে রোধ করতে রাজ্যগুলির
উপর কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত করা এবং রাজ্যের অভ্যন্তরে অন্যান্য ভাষিক
জনগোষ্ঠীদের কোন অধিকার সাব্যস্ত না করে কেন্দ্রীয়ভাবে হিন্দি আধিপত্যবাদী শক্তি ও
তাদের অধীনে রাজ্যিক স্তরে যেমন আসামে অসমীয়া আধিপত্যবাদী শক্তির এক চক্র তৈরি করা
হয়। বরাকের মধ্যশ্রেণি একই আধিপত্যকামী মতাদর্শ থেকে অভ্যন্তরীণ অবৈরী দ্বন্দ্বের
গণতান্ত্রিক সমাধানের পথ এড়িয়ে চলায় উনিশে মে উনিশে জুনের সাম্প্রদায়িক শঙ্কা ও
সংঘাতের পরিণতি লাভ করে। স্বাধীনতা আন্দোলন ও স্বাধীনতা প্রাপ্তির প্রতিক্রিয়াশীল
ধারার ঐতিহ্য থেকে মুক্ত হওয়ার প্রচেষ্টা ছাড়া ১৯ শে মে’র ‘ভাষা শহিদ দিবস’ পালনের
নির্ঘন্ট এলিটিজমকেই পুষ্ট করবে – জাতীয় অবমাননা ও বঞ্চানা থেকে মুক্তির লক্ষ্য
থাকবে অস্পষ্টভাবে বহুদূরে। অপ্রাপ্তির এই দীর্ঘ যাত্রা বরাকবাসীকে হতাশার জালে
আবদ্ধ করে নরকযন্ত্রণাকে ভবিতব্য বলে মেনে নিতেই প্রস্তুত করবে। অথচ এর বিপরীত
যাত্রা করার মত আমাদের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। কীভাবে?
বরাকভূমি যে অঞ্চলের প্রসারিত ভূমিখণ্ড সেটা হচ্ছে –
পূর্ব-বাংলা, পূর্ব-পাকিস্তান বা বর্তমান বাংলাদেশ। পূর্ব-পাকিস্তানের
শাসকশ্রেণি সবধরনের আপসের প্রতিক্রিয়াশীল
মতাদর্শ বহন করা সত্বেও পশ্চিম-পাকিস্তানের আধিপত্য থেকে মুক্ত হতে বাঙালি
জাতিয়তাবাদী আবেগকে ব্যবহার করে এক পৃথক রাষ্ট্র গঠন করতে পেরেছে। তার কারণ
বর্তমান বাংলাদেশের ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষরা বাঙালি চেতনায় সিক্ত। পূর্ব-বাংলার
ইসলাম বিস্তার লাভ করেছে সভ্যতা বিকাশের মতাদর্শ হিসেবে – স্থায়ী কৃষিতে অন্তর্ভুক্ত হয়ে বাঙালি
হওয়ার ব্রাহ্মণ্যবাদের বিকল্প পথ হিসেবে। শাসকের শাসানি – শরিয়তি কিংবা সুফী প্রভাবে
ধর্মান্তরিত হওয়ার প্রশ্ন নয় – এঅঞ্চলে ইসলামের বিস্তৃতি ঘটেছে এক সম্পূর্ণ ভিন্ন
পথে – এঅঞ্চলের মানুষ বাঙালি হয়েছে ইসলামের মতাদর্শগত আবহে এবং এজন্যই এঅঞ্চলে
বাঙালিদের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠরাই ইসলাম ধর্মাবলম্বী। আমাদের বরাক উপত্যাকাও তার
ব্যতিক্রম নয়। বরাকের মুসলমানদের গ্রামীণ পিছিয়ে পড়া হিন্দু মানুষের সাথে এক
স্বাভাবিক ঐক্যও রয়েছে। কারণ এঅঞ্চলে গ্রামীন নিম্নবর্ণের হিন্দুরাও
ব্রাহ্মণ্যবাদী প্রভাবের বাইরে এক স্বতন্ত্র ধর্মীয় সাংস্কৃতিক পরম্পরা এখনও বজায়
রেখেছে – সুজিৎ চৌধুরী যাকে বারুণী স্নান ও সিদ্ধেশ্বর কপিলাশ্রমে মন্দিরভিত্তিক
অর্চনাকে নিম্নবর্ণ ও উচ্চবর্ণের ধর্মাচারের দুটি সমান্তরাল ধারার টানাপোড়েনকে
সুদূর অতীতের ধর্মীয় সংঘাতের ক্ষীয়মান ধারা হিসেবে দেখাতে চেয়েছেন। বরাকের
বর্ণহিন্দু বুদ্ধিজীবী সমাজ যদি হিন্দুত্ববাদী ও আধিপত্যবাদী মতাদর্শের কুটিল চক্র
থেকে বেরিয়ে এসে বরাকের এই স্বাভাবিক ঐক্যকে সুদৃঢ় করার উদ্যোগে ব্রতী হন, তাহলে
১৯শে মে’র ঐতিহ্যের এক গণতান্ত্রিক পুনঃনির্মাণ এবং বরাকবাসীর উন্নয়ন সুনিশ্চিত
করা সম্ভব। এই ঐতিহ্যের পুনঃনির্মাণ করার শুরুয়াত হতে পারে প্রতিটি জনগোষ্ঠীর
সম-মর্যাদা ও সম-অধিকারের এক বাস্তবমুখী নীতিগত কর্মসূচী রূপায়ণের মাধ্যমে।
জাস্টিস সাচার ও রঙ্গনাথ মিশ্র কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশের পরও যারা ধর্মীয়
সংখ্যালঘুদের সংরক্ষণের বিরোধিতা করেন, যারা তপসিলিদের সংরক্ষণের সুযোগ থেকে
বঞ্চিত করে নিজের আখের গোছান – তাদের বাঙালিয়ানা যে মেকী ও ভণ্ডামি তাতে কোন
সন্দেহ থাকে না। বর্ণহিন্দুদের এই মানসিকতাই সুস্থ বাঙালি জাতিয়তাবাদী উন্মেষের
প্রধান অন্তরায়।
0 comments:
Post a Comment