বর্তমান প্রেক্ষিতে ফ্যাসিবাদের বিপদ : সম্পাদকীয় নিবন্ধ – অরুণোদয়

Posted by স্বাভিমান Labels: , , , ,




(সম্পাদকীয় নিবন্ধ – অরুণোদয়)

(C)Image:ছবি
দেশবাসীকে ‘সত্য ভাষণ’ ও ‘দেশপ্রেমের’ পাঠদানের মহড়া চলছে দেশজুড়ে। ‘সত্য ভাষণের’ তিনটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে, এক, ইন্দ্রীয় গ্রাহ্য সবকিছুকেই সত্য বলে ধরে নিও, যুক্তির কাঠামোয় একে বিচার করে দেখার জন্য মস্তিষ্ককে ব্যবহার করো না, লাল রঙকে লাল ও গেরুয়াকে কেন গেরুয়া বলে দেখো সে প্রশ্ন উত্থাপন করো না অর্থাৎ একধরনের ‘অ্যানিমেল ইনস্টিংকট’ দিয়েই সত্যকে আবিষ্কার করো। দুই, বারংবার উচ্চস্বরে উচ্চারিত তথ্যকে বিনাপ্রশ্নে সত্য বলে ধরে নিও, তিন, ষাঁড় যেমন লাল রঙ দেখলেই উত্তেজিত হয়ে উঠে, সেরকম ‘সত্যসাধকদের’ উত্তেজিত ষণ্ড-ব্যবহার অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বৈশিষ্ট্য হিসেবে গণ্য করো। অনুরূপভাবে ‘দেশপ্রেমের” পাঠদানেরও তিনটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে, এক, দেশের ভূখণ্ডের প্রতি চরম প্রশ্নাতীত আনুগত্য প্রকাশ করো, যারা এই আনুগত্য দেখাবে না তারা দেশবাসী হলেও তাদেরকে কোতল করে দেওয়ার মানসিকতা পোষণ করো, কিন্তু অন্য দেশের সার্ব্বভৌমত্ব লঙ্ঘিত হলে এর পেছনে যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে বলে ধরে নিও। দুই, অপরকে ঘৃণা করতে শিখো, তিন, রাষ্ট্র যা বলে তাকেই বেদবাক্য জ্ঞানে মেনে নিও এবং যুদ্ধ ও সৈনিক-আত্মত্যাগের মানদণ্ডকে দেশেপ্রেমের একমাত্র মাপকাঠি হিসেবে জ্ঞান করো।

উপরোক্ত এই একমাত্রিক ধারণা সকল ধরনের প্রতিষ্ঠান ও তার পরিচালকদের অসংবেদনশীল ও অমানবিক করে তোলে এবং যার ফলে রোহিত ভেমুলার মত ছাত্রদের হতাশা ও কান্না তাদের কর্ণগোচর হয় না, অকালে মৃত্যু বরণ করেই তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হয়, তারপরও নির্লজ্জের মত রোহিত ভেমুলা দলিত ছিল কিনা তা নিয়ে বিতর্ক তৈরি করা হয়। এই ধারণার বশবর্তী হয়েই জেএনইউ’র কতিপয় ছাত্রের বিচ্ছিন্নতাবাদী শ্লোগান দেওয়ার অভিযোগকে কেন্দ্র করে তাদের উপর ঝাপিয়ে পড়ে ভারতীয় রাষ্ট্র-বাহিনী ও ‘দেশপ্রেমিক’ সর্দারেরা। মত প্রকাশের ও স্বাধীন বিতর্কের যদি কোন প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা না থাকে তাহলে শুধু স্তাবকরাই কথা বলে, কথা বলার সীমা লঙ্ঘনের ভয়ে বিরোধী মতাবলম্বীরা তটস্থ থাকে, আর নেতা ও পরিচালকরা স্তাবকদের দেওয়া তথ্য ছাড়া আর কিছুই জানতে পারেন না। রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে এধরনের পরিবেশ জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে এক ভয়ানক পরিণতি ডেকে আনতে পারে। মত প্রকাশের স্বাধীনতাহীনতার এরকম পরিস্থিতিতে ১৯৪৩-এর বাংলার মন্বন্তরের ২৫ লাখ মানুষের মৃত্যুর খবর প্রচারিত হয়নি, ১৯৫৮-৬১ সালে চীনের দুর্ভিক্ষে প্রায় ৩ কোটি লোকের মৃত্যুর খবর চীনা কম্যুনিস্ট পার্টীর সদর দপ্তর জানতে পায়নি, তার কারণ যে গণতন্ত্রহীনতা সেকথা মাও যে দঙ পরবর্তীতে স্বীকার করেছেন। আমাদের দেশে বর্তমানে মত প্রকাশের স্বাধীনতার সীমা নিয়ে যারা ঢোল পেটাচ্ছে তারা সম্প্রতি ইউকে’র স্কটল্যাণ্ড ও স্পেনের ক্যটালনিয়া’র বিচ্ছিন্ন হওয়ার অধিকারের প্রশ্নে গণভোট থেকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের আচরণের ব্যাপারে কোন শিক্ষা নেয়নি। এর বিপরীতে রাষ্ট্রশক্তির পক্ষে ওকালতি করা বুদ্ধিজীবীদের যুক্তি হচ্ছে ভারতীয় ও ইউরোপীয় মনস্তত্ত্ব এক নয়, ভারতীয় মনস্তত্ত্বের রক্ষক হিসেবে রাষ্ট্র সঠিক আচরণই করছে। এটা শুধু কুযুক্তিই নয়, আসলে রাষ্ট্রশক্তি জল মেপে দেখতে চাইছে যে উগ্র-দেশপ্রেমের আবেগে ভারতীয় গণমানসকে উত্তেজিত করা যায় কিনা। এই জল মাপার জন্যই স্থানীয় স্তরের নেতারা একের পর এক উগ্র-হিন্দুত্ববাদী ও উগ্র-দেশপ্রেমিক বয়ানবাজী করে চলেছে, আর সরকার ও রাষ্ট্র অর্থপূর্ণ মৌনতা অবলম্বন করে প্রতিক্রিয়া দেখছে।
ইতিহাস বলছে প্রাচীন গ্রিসে এথেনীয় ভোটভিত্তিক নির্বাচন চালু হলে তা প্রথম ছড়িয়ে পড়ে পূবের দেশগুলিতে, পশ্চিমের দেশগুলিতে নয়, ভারতবর্ষের পুর-প্রশাসনেও যে এই প্রথার প্রয়োগ হয় তার বহু নিদর্শন রয়েছে। সনাতন ভারত, বৌদ্ধ ভারতের প্রতিষ্ঠান এবং আকবরের রাজত্বে মোগল প্রতিষ্ঠানেও বহুমতের স্বাধীন বিতর্কের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়, কিন্তু মনুবাদী ব্রাহ্মণ্যবাদী ঐতিহ্যই ভারতবর্ষের এই অতীত গৌরবময় অধ্যায়কে নস্যাৎ করে দিতে সদা সচেষ্ট রয়েছে। উপরন্তু বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় যে কোনো রাষ্ট্রই যে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার পক্ষে সচেষ্ট থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এটুকু বোঝার ক্ষমতা রাখে যে কোনটি স্থিতাবস্থার প্রতি প্রকৃত চ্যালেঞ্জ এবং কোনটি নেহাৎ বৌদ্ধিক বিতর্ক। আমেরিকান রাষ্ট্রের পাশবিক আক্রমণের রক্তঝরানো ইতিহাস, কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি রাষ্ট্রের কঠোর অমানবিক আচরণ সম্পর্কে সবাই কমবেশি অবগত, কিন্তু আমেরিকার রাষ্ট্রনীতির বিরুদ্ধে প্রতিনয়ত মতপ্রকাশ করে চলেছেন সে দেশের সংবেদনশীল বুদ্ধিজীবী ও ছাত্ররা, অথচ দেশদ্রোহের অভিযোগে তাদের গ্রেপ্তার হতে হচ্ছে না, সেটাও বাস্তব। আমেরিকান রাষ্ট্র ওয়াল স্ট্রিটের স্বার্থের প্রহরী, যতক্ষন না সেই স্বার্থ বিঘ্নিত হওয়ার মত পরিস্থিতি দেখা দিচ্ছে ততক্ষণ রাষ্ট্র অত্যন্ত সহনশীল। রাষ্ট্রের শাসন কাঠামোর গ্রহণযোগ্যতা যখন তলানিতে এসে ঠেকে, তখনই রাষ্ট্র সব ধরনের বিরোধী মতকে ভয় পায় ও আক্রমণাত্মক হয়ে উঠে।    আম-জনতাকে ‘দেশপ্রেমের’ মোহে মোহগ্রস্ত করে রাষ্ট্রের ফ্যাসিবাদীকরণের দিকে যাত্রা শুরু হয়। সেরকম পরিস্থিতি আমেরিকাতেও দেখা দিতে পারে, বুশ-জমানায় সেরকম কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে, কিন্তু ভারতবর্ষে সেই যাত্রা এক বাস্তবরূপে ইতিমধ্যে হাজির হয়েছে তা হলফ করে বলা যায়। ফ্যাসিবাদ শুধুমাত্র এক মূল্যবোধের নাম নয়, যে বা যাদের হাত ধরে তা বাস্তবে আবির্ভূত হয় তারা ত্যাগী, সন্ন্যাসী, নিষ্ঠাবান, সৎ কিনা এবিচার নিরর্থক, কারণ ফ্যাসিবাদ রাষ্ট্রের একটি রাজনৈতিক রূপ। এঅঞ্চলের এক ‘দেশপ্রেমিক’ বুদ্ধিজীবী ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে লিখতে গিয়ে ইন্দোনেশিয়ার দিকে তাকাতে বিরোধীপক্ষকে পরামর্শ দিয়েছেন। ১৯৬৫-৬৬ সালের ইন্দোনেশিয়ার ইতিহাস তাঁর হয়ত স্মরণে নেই। সুকার্নোকে ক্ষমতাচ্যুত করে আমেরিকান পুতুল সুহার্তোকে ক্ষমতায় বসাতে গিয়ে সেদেশের আর্মি দেশবাসীর উপর নৃশংস আক্রমণ নামিয়ে আনে এবং এই আক্রমণের প্রধান লক্ষ্যবস্তু হিসেবে কম্যুনিস্টদের গণ-পার্টী ইন্দোনেশীয় কম্যুনিস্ট পার্টীর (পিকেআই) প্রায় ১০ লাখ সদস্যকে নির্বিচারে কোতল করে। সে যাইহউক, বিভিন্ন দেশে বামপন্থীরাও ফ্যাসিবাদী আচরণ করেছে, সেকথা অনস্বীকার্য। কিন্তু তারা তখনই এই আচরণ করেছে যখন তারা ডানদিকে সরে গিয়ে পুঁজিবাদের সাথে আপসের পথ অবলম্বন করেছে। আমাদের দেশের পশ্চিবঙ্গের মত একটি মাত্র অঙ্গ রাজ্যে ক্ষমতায় অবতীর্ণ হয়ে বামপন্থীদের পার্টী-সমাজ গড়ে তোলার সর্বগ্রাসী প্রচেষ্টার সাথে তাদের নিও-লিবারেল পলিসি মেনে নেওয়া, সেজ গঠন, নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট তৈরির উদ্যোগ, ডাও ক্যামিকেলের মত কুখ্যাত বহুজাতিক কোম্পানীকে নিজ রাজ্যে ডেকে আনা ইত্যাদি ডানপন্থী উদ্যোগকে এককরে দেখতে হবে। তাঁরা যদি অতীতের ভুল সংশোধন করে জনগণের কাছে ক্ষমা প্রার্থী না হোন তবে তাদের কাছ থেকেও ভবিষ্যত ভারত জবাবদিহি চাইবে।
সবার সম্মতিতে শান্তিপূর্ণভাবে যদি একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বজায় রাখা যায়, তাহলে কোন শাসকই চাইবে না রাষ্ট্রের ফ্যাসিবাদী রূপান্তর (আরএসএস ও আইসিসের মত উগ্র-মতাদর্শগত সংগঠনের কথা ভিন্ন, কারণ এদের একমাত্র উদ্দেশ্য তাদের সংজ্ঞায়িত ধর্মের ভিত্তিতে ধর্মরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা)। আশির দশকে রাজীব গান্ধীর সময় থেকে ভারতবর্ষ যে নিও-লিবারেল অর্থনীতির পথিক হয় এবং নব্বইয়ে মনমোহন সিঙের আমলে যাতে সরকারি সীলমোহর দেওয়া হয় সেই পথ ধরে ভারতবর্ষ এখন বিশ্ব-পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার উত্থান-পতনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। স্তরীভূত শ্রমমূল্যের শোষণ (diferential exploitation) এখনও বজায় রয়েছে এবং ভারতবর্ষের মত দেশ থেকে বহুজাতিক কোম্পানীগুলি অতি-মুনাফা করে চলেছে, কিন্তু উদ্বৃত্ত মূল্য আহরণের মাধ্যমে শ্রমশোষনের প্রক্রিয়া বিশ্বব্যাপী ক্রমশ সাধারণীকৃত হচ্ছে। এই বিশ্ব-পুঁজিবাদী অর্থ-ব্যবস্থা আজ ভীষণ সঙ্কটে। এই সংকট এতোই তীব্র যে যুদ্ধের মাধ্যমে পুরোনো সম্পদ ধ্বংস করে দিয়েও পুঁজি কোনো লাভজনক বিনিয়োগের সন্ধান পাচ্ছে না। বৃহৎ আকারের প্রতিরক্ষা সামগ্রীর ঠিকা প্রাপক লকহিড ও রলস রয়েসের মত কোম্পানীর অসফল হওয়ার কাহিনী সেইদিকেই ইঙ্গিত করে। পুঁজিবাদ টিঁকে থাকে মুনাফা - আরও মুনাফা, সঞ্চয় – আরও সঞ্চয় এই নীতির উপর ভিত্তি করে, সেই অর্থনীতি নিজেই যে বিশ্বজোড়া চূড়ান্ত অসাম্য, আমজনতার ক্রয় ক্ষমতা কমে যাওয়া ও চূড়ান্ত বেকারত্বের জন্ম দিয়েছে তার ফাঁদে সে নিজেই ঢুকে গেছে এবং এর থেকে বেড়িয়ে আসার কোন পথ খুঁজে পাচ্ছে না। শ্রমিক-কর্মচারী ও মধ্যবিত্তের উপর চূড়ান্ত আঘাত নামিয়ে এবং লগ্নি-পুঁজির স্বনির্ভর নতুন ফাইনান্সিয়্যাল বাজার তৈরি করে এই সংকট থেকে বেড়িয়ে আসার যে নিও-লিবারেল পলিসি’র প্রবর্তন হয়েছিল তাও এখন অসার প্রমাণিত হচ্ছে, অসার প্রমাণিত হয়েছে ‘গ্রোথ অনলি ও ট্রিকল ডাউন’ তত্ত্বের কার্যকারিতা। এই পরিস্থিতিতে যুদ্ধ উন্মাদনা, ফ্যাসিবাদী শক্তির উত্থান ও বর্বরতার রাজত্ব কায়েমের মত একমাত্রিক ধ্বংসাত্মক প্রক্রিয়াকে মেনে নেওয়া ছাড়া বিশ্বপুঁজিবাদের আর কোনো গঠনমূলক কার্যকারিতা অবশিষ্ট নেই। এই শূন্যতার মধ্যেই সংঘ পরিবারের উত্থান, এই শূন্যতার মধ্যেই দেশে দেশে ফ্যাসিবাদী শক্তি ও যুদ্ধ-উন্মাদদের বাড়বাড়ন্ত। যে বামপন্থীরা এই শূন্যতা পূরণ করতে পারত তারা ডানদিকে আপস করতে গিয়ে সম্পূর্ণ পরাভূত। এটার একটু, ওটার একটু – এই লাল মিশ্রণের ঔষধ এখন আর জনগণের অসুখ নিবারণে অপারগ। তবে আশার কথা গোটা ইউরোপ জুড়ে নতুন বামপন্থীদের উত্থান পরিলক্ষিত হচ্ছে, যারা শুধু বিকল্প অর্থনীতির কথাই বলছে না, রাষ্ট্রের ক্রমবিকশিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে এই অর্থনীতিতে জনগণের অংশগ্রহণের কথা বলছে, যে গণতন্ত্র সবার মত প্রকাশের, সুষ্ঠু বিতর্ক করার, স্বাধীন মিডিয়ার, সবার নির্বাচিত হওয়ার লিবারেল ডেমোক্রেসির অধিকারের চাইতেও বেশি কিছু।
ভারতবর্ষেও যে তার নিজ ঐতিহ্য ও ইতিহাসের উপর দাঁড়িয়ে সেই শক্তির উত্থান হবে না সে ব্যাপারে কেউ নিশ্চিত নন। ইতিমধ্যে যেভাবে রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গৈরিকীকরণের বিরুদ্ধে, মত প্রকাশের স্বাধীনতার দাবিতে, ‘গ্রোথ অনলি’ অর্থনীতির বিরুদ্ধে গণরোষ দেখা যাচ্ছে তাতে সঙ্ঘ-পরিবারের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। কিন্তু যেভাবে বিপর্যস্ত কৃষি পরিস্থিতি থেকে উদ্ভূত ন্যায্য ক্ষোভ জাঠ ও অ-জাঠের সংঘাতে পর্যবসিত হচ্ছে, শ্রমিক শ্রেণির কাঠামোগত পরিবর্তনের ফলে গণতন্ত্রের প্রশ্নে শ্রেণি-অসচতনেতা বিরাজ করছে তাতে গণতন্ত্রপ্রেমীদের আশ্বস্ত হওয়ার মতও কিছু নেই। জেএনইউ বিতর্কে উগ্র-দেশপ্রেমিকরা খানিকটা পিছু হটেছে, আর্থিক নীতিতেও কিছুটা পিছু হটার লক্ষণ বাজেটে প্রকাশ পেয়েছে, কিন্তু তাতে আত্মতুষ্টির কোনো স্থান নেই। কারণ এককদম পিছু হটা দু’কদম এগিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি হতে পারে। সুতরাং সময় থাকতেই ঐক্যবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন ও গণতান্ত্রিক উপায়ে সরকারের উপর আরও বড়ধরনের চাপ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। বাজেটের দিকে চোখ বোলালেই জনদরদী আওয়াজ ও বাস্তব পদক্ষেপের মধ্যে ফারাকটা ধরা পড়ে।

বিশ্ববাজারে তেলের মূল্য হ্রাসের ফলে তেল আমদানী থেকে বিশাল অঙ্কের রেভিন্যু সঞ্চয়, সরকারি সম্পত্তি বিক্রি করে সরকারি আয় ইত্যাদির সাথে তূলনামূলক বিচার করলে কৃষি ও সামাজিক ক্ষেত্রে সরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধির পরিমাণ আহামরি কিছু নয়। উপরন্তু খাদ্য সামগ্রীর উপর একশ শতাংশ বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের ছাড় খুচরো বাণিজ্যে বিদেশি বিনিয়োগের দিকেই এককদম অগ্রসর হওয়াকে সূচিত করে। পিএফ ও পেনসন ফাণ্ডের উপর হস্তক্ষেপ ভবিষ্যতে বেসরকারিকরণের দিকে যাত্রাকে সূচিত করে, কারণ কংগ্রেস সরকার বাজার নির্ভর যে ‘এনপিএস’ চালু করেছিল বিজেপি দলের মুখপাত্ররা তার জয়গানই গাইছেন, শুধু দায়টা ঠেলে দিতে চাইছেন কংগ্রেসের উপর। তবে আগের অবস্থান থেকে সরে গিয়ে এবারের বাজেটে যে এনরেগার মত প্রকল্পের প্রয়োজনীতার কথা স্বীকার করা হয়েছে এবং তাতে বরাদ্দ বেশ খানিকটা বৃদ্ধি করা হয়েছে তা ইতিবাচক পদক্ষেপ (যদিও মজুরির বৃদ্ধি হিসেবে রাখলে এই বরাদ্দ বৃদ্ধি বাস্তবে খুব বেশি নয়)। পরিসংখ্যান বলছে, জাতীয় আয়ের অনুপাতে ২০১৩-১৪ সালে সামাজিক ক্ষেত্রে বরাদ্দ হয়েছিল ১.২ শতাংশ, ২০১৫-১৬ সালে প্রকৃত ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ০.৭ শতাংশ, আর এবছর বাজেটে বরাদ্দ হলো ০.৬ শতাংশ। গ্রামোন্নয়ণে ২০১৩-১৪ সালে বরাদ্দ ছিল জাতীয় আয়ের ১.৮ শতাংশ, এবার বরাদ্দ হলো ১.৫ শতাংশ। উপরন্তু বরাদ্দ অর্থের বাস্তবে প্রয়োগের দিক তো দেখার এখনো বাকী। তথাপি এবারের বাজেটে সামাজিক ক্ষেত্র, কৃষি ইত্যাদির উপর যে জোর দেওয়া হয়েছে সেটাও এই সরকারের থেকে আশা করা যায়নি। কারণ এবারের বাজেটে তাদের ঘোষিত অর্থনীতি থেকে সরে গিয়ে একটু জনকল্যাণের দিকে বেঁকে যাওয়া পরিলক্ষিত হয় এবং এটা সম্ভব হয়েছে সংসদীয় নির্বাচনী গণতন্ত্রে জনগণের চাপের ফলে। আমাদের এই গণতন্ত্রকে শুধু রক্ষা করার শপথ নিলেই হবে না, এই গণতন্ত্রকে বিকশিত করার ও বিকল্প অর্থনীতির কর্মসূচীর ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। জনগণ আর পুরোনো বোতলে নতুন মদ দেখতে প্রস্তুত নয়, বিকল্পহীনতায় জনগণ যদি গণতন্ত্র ও কল্যাণমূলক অর্থনীতির বর্তমান বোতলকেই ভাঙতে উদ্যত হয়, তাতে তাদের দোষ দেওয়া যাবে না। 



                           

0 comments:

স্বাভিমান:SWABHIMAN Headline Animator

^ Back to Top-উপরে ফিরে আসুন