উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনের কিছু দিক (তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া)

Posted by স্বাভিমান

কোনো বড়মাপের সাম্প্রদায়িক ঘটনা বা দাঙ্গা ছাড়াই উত্তপ্রদেশে এবার বিজেপি’র  উত্থান ঘটল, ১৯৯২-এর বাবরি মসজিদের ঘটনা পরবর্তী নির্বাচন থেকেও এবারে বিজেপি’র নির্বাচনী সাফল্য অনেক বেশি। কী ছিল বিজেপি’র স্ট্র্যাটেজি? বিজেপি অতি দক্ষতার সাথে সুকৌশলে দু’টি পরস্পর বিরোধী বিষয়ের মিশ্রণ ঘটিয়েছে। বড়মাপের বা ম্যাক্রোস্তরের দু’টি বিষয়ের তৃণমূল পর্যায়ে মানুষের দৈনন্দিন জীবনে অর্থাৎ মাইক্রো স্তরে যে বহিঃপ্রকাশ তাকেই মিশ্রিত করে পেশ করে জনগণকে নিজেদের দিকে আকৃষ্ট করতে। এই দু’টি বিষয়ের একটি হলো নয়া-উদারবাদী অর্থনীতি বিরোধী ক্ষোভ ও অন্যটি সাম্প্রদায়িকতা। মানুষের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় উন্নয়ণের বিষয় যেমন সড়ক-বিদ্যুৎ-পানীয় জল-সামাজিক সুরক্ষা-রোজগারের সুরক্ষা-মজুরি-শিক্ষা-স্বাস্থ্য ইত্যাদিকে হাতিয়ার করা, অন্যদিকে কবরস্থান-শ্মশান, ঈদ-পূজা, রোমিও বাহিনী ইত্যাদি বয়ানের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িকতাকে মানুষের একেবারে দৈনন্দিন জীবনে নামিয়ে আনা। এই দু’টি বয়ানকে মানুষের কল্পনাশক্তির কাছাকাছি নিয়ে আসার জন্য উপরে ও তৃণমূলে উভয়স্তরে সাংগঠনিক প্রস্তুতি নিয়েছিল সংঘ পরিবার। উল্টোদিকে বিরোধী শক্তি পুরোনো ধাঁচের সমীকরণ, বড় মাপের উন্নয়ণ (বৃহৎ সড়ক ও ব্রিজ প্রকল্প ইত্যাদি) ও কৃষক ইস্যু নিয়ে মানুষের সামনে হাজির হয়। যখন হাজার হাজার ইউপি-বাসী দিনমজুর মহারাষ্ট্র থেকে ভোট দিতে আসে তখন তাদের কাছে যেমন চাকুরির সুরক্ষা, সামাজিক সুরক্ষা বড় বিষয় হয় তখন তাদের সাথে শহর ও গ্রামের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ ও বেকারদেরর ইস্যু মিলে যায় – শহরবাসী ও গ্রামবাসী ছোট ছোট উন্নয়নের বিষয়কেই প্রাধাণ্য দেয়, উদারবাদী অর্থনীতিতে যে বিষয়গুলি সবচাইতে বেশি উপেক্ষিত। আন্না হাজারের দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়ে সঙ্ঘ পরিবার যেমন ফায়দা লুটেছে, বিমূদ্রাকরণ নিয়ে বিরোধী দল এবং বিশেষ করে বামদলগুলি সেরকম কোনো আন্দোলন দিল্লিতে গড়ে তুলল না এবং ফলে বিরোধী পক্ষের বয়ান আমজনতার বয়ান হয়ে উঠল না। বিরোধীরা জিডিপি গ্রোথ ও দীর্ঘম্যাদী কুফল নিয়ে যে কূটতর্ক করলেন তা সাধারণ মানুষের বোধগম্য হল না, কারণ মেহনতি মানুষ শেখে জীবনসংগ্রাম ও সচেতন সংগ্রামের মাধ্যমে। বিরোধীদের কেন্দ্রীয় কোনো সচেতন সংগ্রাম না থাকায় আমজনতা বিমুদ্রাকরণকে ধনী বিরোধী পদক্ষেপ হিসেবে মেনে নিল। নয়া-উদারবাদী অর্থনীতির সবচাইতে কট্টর রূপায়ণকারী দল হওয়া সত্ত্বেও বিজেপি এই অর্থনীতির বিরুদ্ধে গণক্ষোভকে বিরোধী দলগুলির বিরুদ্ধেই কাজে লাগালো। বিহার থেকে শিক্ষা নিয়ে বিজেপি ইউপি-তে স্ট্র্যাটেজি পাল্টেছে, তবে বিহারে একাজটি কঠিন হতো কারণ লালু প্রসাদ আর যাই হোক সূক্ষ্ম দেহাতি কারুকার্য বুঝতে উস্তাদ।
সঙ্ঘ পরিবারের উপরোক্ত স্ট্র্যাটেজি’র বিপরীত স্ট্র্যাটেজি কী হতে পারে? নয়া উদারবাদী অর্থনীতির সাথে যুক্ত প্রথম বিষয়গুলি কিন্তু অন্তর্বস্তুতে বিজেপি বিরোধী ইস্যু, সুতরাং সেই ইস্যুগুলিকে তৃণমূল স্তরে গণআন্দোলনের মাধ্যমে আরও তীব্র ও র‍্যাডিকেলাইজেশন করলে বিজেপি এগুলির সমাধান করতে পারবে না বা তাদের উদারবাদী আর্থিক সংস্কারের নীতি থেকে সরে আসতে হবে যা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। উদারবাদী আর্থিক সংস্কারের অর্থই হচ্ছে সরকারি সামাজিক ব্যয় কমানো, বেসরকারিকরণ ও বৃহৎ পুঁজিপতিদের স্বার্থে নীতি প্রণয়ণ করা। তাতে যে গণক্ষোভকে বিজেপি কাজে লাগিয়েছে তা আরও বৃদ্ধি পাবে ও রেডিক্যালাইজড হবে। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে গণতন্ত্রকে জনগণের বিষয় করে তুলতে হলে সেই তৃণমূল স্তরেই তাকাতে হবে। তৃণমূল স্তরে ব্যবহারিক জীবনে এমন কিছু সামাজিক আচার-অনুষ্ঠাণ-প্রতিষ্টান প্রচলিত ও প্রবহমান থাকে যা সামাজিক ঐক্যের উপর প্রতিষ্ঠিত। এগুলিকে সুকৌশলে ভেঙে দেওয়া হচ্ছে বিশেষ করে ১৯৯২ সালের পর থেকে। সাম্প্রদায়িকতাকে মোকাবিলা করার জন্য মেহনতি মানুষ এগুলির মাধ্যমেই গণতান্ত্রিক বয়ানের সাথে যোগসূত্র স্থাপন করতে পারে। ভাষিক অধিকার, সংখ্যালঘুর অধিকারের প্রশ্নগুলির তৃণমূল স্তরে, বিদ্যালয় স্তরে, সামাজিক স্তরে যে ইস্যুগুলির মাধ্যমে রূপ পায় সেখানে লড়তে হবে। তৃণমূল স্তরে উদারবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী এই লড়াইয়ের সহযোগী হিসেবে যদি উপরে তার সামগ্রিক রূপ নিয়ে অবিরত প্রচার ও জনমত গঠনের কাজ করা যায় তাহলেই গণতান্ত্রিক আন্দোলন বিকশিত হবে, দেশব্যাপী গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্য ও দেশব্যাপী গণজাগরণের রূপ নেবে।               

0 comments:

স্বাভিমান:SWABHIMAN Headline Animator

^ Back to Top-উপরে ফিরে আসুন